عَنِ الْمِقْدَادِ بْنِ الأَسْوَدِ قَالَ : سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ- صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : يَقُولُ : لاَ يَبْقَى عَلَى ظَهْرِ الأَرْضِ بَيْتُ مَدَرٍ وَلاَ وَبَرٍ إِلاَّ أَدْخَلَهُ اللهُ كَلِمَةَ الإِسْلاَمِ بِعِزِّ عَزِيزٍ أَوْ ذُلِّ ذَلِيلٍ إِمَّا يُعِزُّهُمُ اللهُ فَيَجْعَلُهُمْ مِنْ أَهْلِهَا أَوْ يُذِلُّهُمْ فَيَدِينُونَ لَهَا- قَلْتُ فَيَكُونُ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ، رَوَاهُ أَحْمَدُ-
১. অনুবাদ : হযরত মিক্বদাদ (রাঃ) বলেন, তিনি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বলতে শুনেছেন যে, ভূপৃষ্ঠে এমন কোন মাটির ঘর বা পশমের ঘর (তাঁবু) বাকী থাকবে না, যেখানে আল্লাহ ইসলামের বাণী পৌঁছে দিবেন না। সম্মানীর ঘরে সম্মানের সাথে এবং অসম্মানীর ঘরে অসম্মানের সাথে। আল্লাহ যাদেরকে সম্মানিত করবেন, তাদেরকে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণের উপযুক্ত করে দিবেন। পক্ষান্তরে তিনি যাদেরকে অসম্মানিত করবেন, তারা (কর দানের মাধ্যমে) ইসলামের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হবে’। রাবী মিক্বদাদ (রাঃ) বলেন, (একথা শুনে আমি বললাম) ‘তখন তো তাহ’লে গোটা দ্বীন আল্লাহর হয়ে যাবে’ (অর্থাৎ সকল দ্বীরে উপরে ইসলাম বিজয়ী হবে)।[1] আহমাদ, ত্বাবারাণী কাবীর, হাকেম ও বায়হাক্বী হাদীছটি ‘মরফূ’ সূত্রে তামীম দারী (রাঃ) হ’তেও বর্ণনা করেছেন।[2]
২. রাবীর পরিচয় :
মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ আল-কিন্দী বলে প্রসিদ্ধ ইসলামের এই ৬ষ্ঠ তম মহান ছাহাবীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিম্নরূপ :
নাম মিক্বদাদ বিন ‘আমর বিন ছা‘লাবাহ বিন মালিক বিন রাবী‘আহ বিন আমির বিন মাত্বরূদ আল-বুহরানী আল-হাযরামী। ইবনুল কালবী বলেন যে, তাঁর পিতা ‘আমর স্বীয় গোত্রের লোকদের নিকটে প্রহৃত হয়ে রক্তাক্ত হ’লে হাযারামাউত চলে যান ও কিনদাহর সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। সেখানে তিনি বিবাহ করেন ও মিক্বদাদের জন্ম হয়। মিক্বদাদ বড় হ’লে সেখানে একজনের দ্বারা প্রহৃত হয়ে পায়ে তরবারির আঘাতে আহত হন ও মক্কায় পলায়ন করেন। সেখানে তিনি আসওয়াদ বিন ‘আবদ ইয়াগূছ-এর সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন ও তিনি মিক্বদাদকে পালিত পুত্র হিসাবে গ্রহণ করেন। ফলে ‘মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ’ নামেই তিনি সর্বত্র পরিচিত হন। পরে নিজ পিতার নামে ডাকার নির্দেশ জারী করে সূরা আহযাবের ৫ম আয়াত (ادْعُوهُمْ لِآبَائِهِمْ) নাযিল হ’লে তিনি ‘মিক্বদাদ বিন আমর’ বলে পরিচিত হন। কিন্তু পূর্ব নামের প্রসিদ্ধি এত বেশী ছিল যে, ঐ নামেই লোকে তাকে বেশী চিনত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে স্বীয় চাচাতো বোন যুবা‘আহ বিনতে যুবায়ের বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব-এর সাথে বিবাহ দেন।
তিনি আবিসিনিয়া ও মদীনা দু’স্থানেই হিজরত করার গৌরবের অধিকারী বদরী ছাহাবী ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে সকল যুদ্ধে শরীক হন। তিনিই ইসলামের ইতিহাসে আল্লাহর রাহে প্রথম ও একমাত্র ঘোড় সওয়ার সৈনিক হিসাবে বদরের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِنَّ اللهَ أَمَرَنِى بِحُبِّ أَرْبَعَةٍ وَأَخْبَرَنِى أَنَّهُ يُحِبُّهُمْ. عَلِىٌّ وَأَبُو ذَرٍّ وَالْمِقْدَادُ وَسَلْمَانُ- ‘আল্লাহ আমাকে চারজনকে (বিশেষভাবে) ভালোবাসার নির্দেশ দান করেছেন এবং তিনিও তাদেরকে ভালবাসেন বলে আমাকে জানিয়েছেন। তারা হ’লেন, আলী, আবু যর, মিক্বদাদ ও সালমান ফারসী’।[3] তিনি মিসর বিজয়ে অংশ গ্রহণ করেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটতম ও শ্রেষ্ঠ ছাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ৩৩ হিজরী সনে ৭০ বছর বয়সে তিনি মদীনা থেকে তিন মাইল দূরে ‘জুরুফ’ (جُرُفٌ) নামক স্থানে মৃত্যুবরণ করেন ও সেখান থেকে লোকেরা তাঁর লাশ কাঁধে বহন করে মদীনায় আনে। খলীফা ওছমান গণী (রাঃ) তাঁর জানাযায় ইমামতি করেন। ‘বাকী’ গোরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। তিনি ৪২টি হাদীছ বর্ণনা করেছেন। তন্মধ্যে একটি বুখারী ও মুসলিম সম্মিলিতভাবে ও তিনটি মুসলিম এককভাবে সংকলন করেছেন। হযরত আলী, আনাস, আব্দুর রহমান বিন আবী লায়লা প্রমুখ ছাহাবী তাঁর থেকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন।[4]
৩. সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা :
অত্র হাদীছটি ইসলামের বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক বিজয়ের ইঙ্গিত প্রদান করে এবং এটিকে পবিত্র কুরআনের সূরা ছফ-এর ৯নং আয়াতের ব্যাখ্যা হিসাবে অনেক হাদীছ বিশারদ পন্ডিত মন্তব্য করেছেন।[5] উক্ত আয়াতে আল্লাহ বলেন, هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ ‘তিনিই সেই সত্তা, যিনি তাঁর রাসূল (মুহাম্মাদ)-কে প্রেরণ করেছেন পথনির্দেশ ও সত্য দ্বীন সহকারে। যাতে তিনি একে সকল দ্বীনের উপরে বিজয়ী করে দেন। যদিও অংশীবাদীরা এটা পসন্দ করেনা’ (ছফ ৬১/৯)। অনেকেই বলেন যে, এই আয়াতের মর্মার্থ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ), খুলাফায়ে রাশেদীন বা পরবর্তী নেককার খলীফাগণের আমলে বাস্তবায়িত হয়ে গেছে। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা তা নয়। বরং তাঁদের মাধ্যমে উক্ত ভবিষ্যদ্বাণীর কিয়দংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। পরবর্তীতে বিভিন্ন যুগে আল্লাহর সৎকর্মশীল মুজাহিদ বান্দাদের মাধ্যমে উক্ত ওয়াদা বাস্তবায়িত হ’তে থাকবে এবং এক সময় ইমাম মাহদী ও হযরত ঈসা (আঃ)-এর আগমনের পরে বিশ্বব্যাপী ইসলামী শাসন কায়েমের মাধ্যমে উক্ত ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণভাবে কার্যকর হবে।[6] নিম্নোক্ত হাদীছটি এব্যাপারে ইঙ্গিত প্রদান করেন। যেমন ‘একদা আয়েশা (রাঃ) বলেন, হে রাসূল! আপনার আগমনের মাধ্যমে আমি মনে করি সূরায়ে ছফ-এর ৯ নং আয়াতে বর্ণিত ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণতা লাভ করেছে। জওয়াবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّهُ سَيَكُونُ مِنْ ذَلِكَ مَا شَاءَ اللهُ ‘নিশ্চয়ই তার কিয়দংশ ভবিষ্যতে বাস্তবায়িত হবে যতটুকু আল্লাহ ইচ্ছা করেন’।[7] (খ) হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল পারসিক রাজধানী কনস্টান্টিনোপল এবং রোমক রাজধানী রোম- এ দু’টি প্রধান রাজধানী শহরের মধ্যে কোনটি প্রথম মুসলমানেরা জয় করবে? তিনি তাঁর নিকটে লিখিতভাবে সংরক্ষিত একখানা হাদীছ সংকলন বের করে তা পড়ে বলেন, হেরাক্লিয়াসের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল প্রথমে বিজিত হবে’।[8] রাসূল (ছাঃ)-এর এই ভবিষ্যদ্বাণী প্রথমে ইয়াযীদ বিন মু‘আবিয়ার হাতে ৪৯ বা ৫১ হিজরীতে[9] এবং পরবর্তীতে ওছমানীয় খেলাফত কালে ১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দে মুহাম্মাদ আল-ফাতিহ (১৪৫১-৮১ খৃ.)-এর মাধ্যমে প্রায় ৮০০ বছর পরে পূর্ণতা লাভ করে, যা ওছমানীয় খেলাফতের রাজধানী ছিল এবং বর্তমানে তুরষ্কের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহানগরী হিসাবে পরিচিত। ২য় ভবিষ্যদ্বাণী হিসাবে ইতালীর রাজধানী রোম সহ সমগ্র ইউরোপ ইনশাআল্লাহ সত্বর বিজিত হবে।
(গ) অন্য হাদীছে ইসলামের রাজনৈতিক বিজয়ের কালানুক্রমিক বর্ণনা দিয়ে এরশাদ হয়েছে,
تَكُونُ النُّبُوَّةُ فِيكُمْ مَا شَاءَ اللهُ أَنْ تَكُونَ ثُمَّ يَرْفَعُهَا إِذَا شَاءَ أَنْ يَرْفَعَهَا ثُمَّ تَكُونُ خِلاَفَةٌ عَلَى مِنْهَاجِ النُّبُوَّةِ فَتَكُونُ مَا شَاءَ اللهُ أَنْ تَكُونَ ثُمَّ يَرْفَعُهَا إِذَا شَاءَ أَنْ يَرْفَعَهَا ثُمَّ تَكُونُ مُلْكاً عَاضًّا فَيَكُونُ مَا شَاءَ اللهُ أَنْ يَكُونَ ثُمَّ يَرْفَعُهَا إِذَا شَاءَ أَنْ يَرْفَعَهَا ثُمَّ تَكُونُ مُلْكاً جَبْرِيَّةً فَيَكُونُ مَا شَاءَ اللهُ أَنْ يَكُونَ ثُمَّ يَرْفَعُهَا إِذَا شَاءَ أَنْ يَرْفَعَهَا ثُمَّ تَكُونُ خِلاَفَةٌ عَلَى مِنْهَاجِ نُبُوَّةٍ. ثُمَّ سَكَتَ-
‘তোমাদের মধ্যে (১) নবুঅত থাকবে যতদিন আল্লাহ ইচ্ছা করবেন। অতঃপর তা উঠিয়ে নিবেন (২) এরপরে নবুঅতের তরীকায় খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে। আল্লাহ যতদিন ইচ্ছা সেটা রেখে দিবেন। অতঃপর উঠিয়ে নিবেন (৩) অতঃপর অত্যাচারী রাজাদের আগমন ঘটবে। আল্লাহ যতদিন ইচ্ছা তাদেরকে রেখে দিবেন। অতঃপর উঠিয়ে নিবেন (৪) অতঃপর জবর দখলকারী শাসকদের যুগ শুরু হবে। আল্লাহ যতদিন ইচ্ছা তাদেরকে রেখে দিবেন। অতঃপর উঠিয়ে নিবেন (৫) এরপরে নবুঅতের তরীকায় পুনরায় খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে। এই পর্যন্ত বলে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) চুপ হয়ে গেলেন’।[10]
১১ হিজরীতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে নবুঅতের যুগ শেষ হয়। অতঃপর তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী খিলাফতে রাশেদাহর ত্রিশ বছর অতিক্রান্ত হয়।[11] এরপরে উমাইয়া ও আববাসীয় ও তৎপরবর্তীদের মাধ্যমে অত্যাচারী রাজাদের যুগ শেষ হয়। অতঃপর বর্তমানে অধিকাংশ দেশে নামে বেনামে জবর দখলকারী শাসকদের যামানা চলছে। গণতন্ত্রের নামে দলীয় স্বৈরাচার ও নেতৃত্বের লড়াই এখন ঘরে ঘরে ও অফিসের চার দেওয়ালের মধ্যে প্রবেশ করেছে।
ন্যায়নীতি ও ন্যায়বিচার সবকিছুই এযুগে শক্তিমানদের একচ্ছত্র অধিকারে। জাহেলী যুগের গোত্র দ্বন্দ্ব এখন নগ্ন রাজনৈতিক দলীয় দ্বন্দ্বে রূপ লাভ করেছে। পুঁজিবাদ, সমাজবাদ ও দলতন্ত্রের অত্যাচারে অতিষ্ঠ মানবতা আজ ব্যাকুল হয়ে চেয়ে আছে এক সর্বব্যাপী রেনেসাঁর দিকে, পূর্ণাংগ সামাজিক বিপ্লবের দিকে, একটি নির্ভেজাল আদর্শ ও তার নির্ভেজাল অনুসারীদের দিকে। সে আদর্শ আর কিছুই নয়। সে হ’ল ইসলাম। আল-হেরা ও আল-মদীনার ইসলাম, আল-কিতাব ও আল-হাদীছের ইসলাম, আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ অহি-র ইলাহী জীবন বিধান। এক্ষণে চাই আদর্শবান ও আদর্শের জন্য নিবেদিতপ্রাণ একদল মানুষ একটি জামা‘আত।
[1]. আহমাদ হা/২৩৮৬৫; হাকেম হা/৮৩২৪; মিশকাত হা/৪২ ‘ঈমান’ অধ্যায়।
[2]. মির‘আত হা/৪২-এর আলোচনা ১/১১৪ পৃ.।
[3]. তিরমিযী হা/৩৭১৮; ইবনু মাজাহ হা/১৪৯; যঈফাহ হা/১৫৪৯।
[4]. ইবনু হাজার, আল-ইছাবাহ ক্রমিক ৮১৮৯; ইবনু সা‘দ, তাবাক্বাতুল কুবরা (বৈরূত : দার ছাদির ১৪০৫/১৯৮৫) ৩/১৬২-৬৩; ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী, মির‘আতুল মাফাতীহ শারহু মিশকাতিল মাছাবীহ (লাহোর : মাকতাবা সালাফিইয়াহ ১৩৮০/১৯৬১) হা/৪২-এর টীকা অবলম্বনে।
[5]. মিরক্বাত (দিল্লী ছাপা, তাবি) ১/১১৬; মির‘আত ১/৬৮; আলবানী, সিলসিলা ছহীহাহ (বৈরূত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ৪র্থ সংস্করণ ১৪০৫/১৯৮৫) হা/১, ১/৬ পৃ.।
[6]. আবুদাঊদ হা/৪২৮৪, ৪২৮৫; মিশকাত হা/৫৪৫৩, ৫৪৫৪।
[7]. মুসলিম হা/২৯০৭; মিশকাত হা/৫৫১৯।
[8]. হাকেম হা/৮৬৬২; আহমাদ হা/৬৬৪৫; দারেমী হা/৪৮৬; ছহীহাহ হা/৪।
[9]. ফাৎহুল বারী ৬/১২০-২১; আল-বিদায়াহ ৮/১৫৩ পৃ.।
[10]. আহমাদ হা/১৮৪৩০; মিশকাত হা/৫৩৭৮ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়; ছহীহাহ হা/৫।
[11]. আবুদাঊদ হা/৪৬৪৬, ৪৬৪৭; তিরমিযী হা/২২২৬; আহমাদ হা/২১৯৬৯; মিশকাত হা/৫৩৯৫; ছহীহাহ হা/৪৫৯।