عَنْ جَابِرِ بْنِ سَمُرَةَ عَنِ النَّبِىِّ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- أَنَّهُ قَالَ : لَنْ يَّبْرَحَ هَذَا الدِّينُ قَائِمًا يُقَاتِلُ عَلَيْهِ عِصَابَةٌ مِنَ الْمُسْلِمِينَ حَتَّى تَقُومَ السَّاعَةُ، (رَوَاهُ مُسْلِمٌ)-
অনুবাদ : হযরত জাবের বিন সামুরা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘এই দ্বীন ক্বিয়ামত পর্যন্ত সর্বদা কায়েম থাকবে, যতদিন তার উপরে একদল মুসলমান সংগ্রাম করবে’।[1]
শাব্দিক ব্যাখ্যা : (১) لَنْ يَّبْرَحَ : مَا بَرِحَ (মা বারেহা) فعل ناقص বা অসমাপিকা ক্রিয়ার পূর্বে ‘লান তাকীদ’ সহযোগে ভবিষ্যৎকাল বাচক না-বোধক ক্রিয়া হয়েছে। শাব্দিক অর্থ : ‘কখনোই দূর হবে না’ অর্থাৎ সর্বদা বিদ্যমান থাকবে। أفعال ناقصة বা অসমাপিকা ক্রিয়া সমূহ সর্বদা جمله اسمية -এর পূর্বে বসে এবং اسم -কে رفع (পেশ) ও خبر-কে نصب (যবর) প্রদান করে। এই ক্রিয়ার ১৩টি শব্দ রয়েছে। তন্মধ্যে مَا بَرِحَ (মা বারেহা) শব্দটি কোন গুণের সর্বদা বিদ্যমানতার অর্থ প্রকাশ করে। অর্থাৎ ‘এই দ্বীন সর্বদা বিদ্যমান থাকবে’।
(২) يُقَاتِلُ عَلَيْهِ : ‘সংগ্রাম করে উহার উপরে’ অর্থাৎ উহার জন্য লড়াই করে। মাছদার اَلْمُقَاتَلَةُ যার অর্থ পরস্পরে যুদ্ধ করা।
(৩) عِصَابَةٌ : ‘দল’ বা জামা‘আত (طَائِفَةٌ)। হকপন্থী এই দলের পরিচয় অন্য হাদীছে এসেছে।
(৪) حَتَّى تَقُومَ السَّاعَةُ : ‘যতক্ষণ না ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে’। অর্থাৎ ক্বিয়ামত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত হকপন্থী একদল মুমিন সর্বদা দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিয়োজিত থাকবে।
৪. সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা : অত্র হাদীছটি কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে দিক নির্দেশনা দান করে। যেমন-
(১) দ্বীন তার আসল রূপে কিছু লোকের মধ্যে কায়েম থাকবে ক্বিয়ামত হবার পূর্ব পর্যন্ত। কেননা প্রকৃত তাওহীদপন্থী একজন লোক বেঁচে থাকতেও ক্বিয়ামত হবে না বলে হাদীছে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে।[2]
(২) দ্বীন বেঁচে থাকার জন্য সর্বযুগে সর্বদা একদল মুজাহিদের প্রয়োজন হবে। যারা কেবল দ্বীনের স্বার্থেই লড়াই করবে।
(৩) দ্বীন কায়েমের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। বাতিলের সঙ্গে জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগে তার সংঘর্ষ হ’তে পারে।
(৪) দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য মুসলমানদের মধ্যে একটি দল এগিয়ে আসবে। সকল মুসলমান নয়।
(৫) দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা দানকারী মুমিনগণ খাঁটি তাওহীদবাদী হবেন ও তাদের সংখ্যা কম হবে। অন্যেরা তাদের পরিত্যাগ করবে।
(৬) এই বিজয় হ’ল আদর্শিক বিজয়। রাজনৈতিক বিজয় নাও হ’তে পারে। কেননা রাজনৈতিক বিজয়ের জন্য সংখ্যা ও শক্তির বিজয় অপরিহার্য। কিন্তু মুমিনের জন্য পার্থিব বিজয় অপরিহার্য নয়। আল্লামা ত্বীবী বলেন, ‘য়ুক্বাতিলু’ হ’তে পরবর্তী বাক্যটি পূর্ববর্তী বাক্যটির ব্যাখ্যা হিসাবে এসেছে এবং ‘আলা’ হরফ দ্বারা সকর্মক (مُتَعَدِّي) করে يُظَاهِرُ (য়ুযা-হিরু) অর্থ বুঝানো হয়েছে। যার অর্থ হ’ল- يُظَاهِرُ بِالْمُقَاتَلَةِ عَلَى أَعْدَاءِ الدِّينِ ‘ঐ দলটি পরস্পরকে সহযোগিতা করবে দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে’। অর্থাৎ ‘এই দ্বীন কায়েম থাকবে চিরদিন, এই দলটির আন্দোলনের কারণে’।
এই দলটি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, عَنْ ثَوْبَانَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِى ظَاهِرِينَ عَلَى الْحَقِّ لاَ يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ حَتَّى يَأْتِىَ أَمْرُ اللهِ وَهُمْ كَذَلِكَ، (رَوَاهُ مُسْلِمٌ)- ‘আমার উম্মতের মধ্যে ক্বিয়ামত পর্যন্ত সর্বদা একটি দল হক-এর উপরে বিজয়ী থাকবে। পরিত্যাগকারীরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এমতাবস্থায় ক্বিয়ামত এসে যাবে ও তারা অনুরূপ অবস্থায় থাকবে’।[3] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘ইহূদী-নাছারাগণ ৭২ ফের্কায় বিভক্ত হয়েছে। আমার উম্মত ৭৩ ফের্কায় বিভক্ত হবে। সবাই জাহান্নামে যাবে একটি দল ব্যতীত। তারা হ’ল ঐ দল যারা مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِىْ ‘আমার ও আমার ছাহাবীদের তরীকার উপরে কায়েম থাকবে’।[4]
এখানে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কোন দলের নাম বলেননি বরং তাদের বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। বর্তমানে অসংখ্য ফের্কার এই গোলক ধাঁ-ধাঁর মধ্যে আমাদেরকে খুঁজে নিতে হবে কাদের মধ্যে বা কোন দলের মধ্যে ছাহাবী যুগের আদর্শ ও বৈশিষ্ট্য মওজুদ আছে। কেননা প্রত্যেকেই নিজেকে ‘নাজী ফের্কা’ বা মুক্তিপ্রাপ্ত দল বলে মনে করেন। এমনকি কট্টর মুশরিক ও বিদ‘আতী মুসলমানরাও অনুরূপ দাবী করে থাকে সোচ্চার কণ্ঠে।
এক্ষণে দেখতে হবে ছাহাবা যুগের বৈশিষ্ট্য কি ছিল। এ প্রসঙ্গে শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী (রহঃ) বলেন,وَقَدْ تَوَاتَرَ عَنِ الصَّحَابَةِ وَالتَّابِعِيْنَ أَنَّهُمْ كَانُوْا إِذَا بَلَغَهُمُ الْحَدِيثُ يَعْمَلُونَ بِهِ مِنْ غَيْرِ أَنْ يُّلاَحِظُوا شَرْطًا- ‘ছাহাবা তাবেঈন হ’তে একথা অব্যাহত ধারায় বর্ণিত হয়েছে যে, তাঁদের নিকটে হাদীছ পৌঁছে গেলে বিনা শর্তে তার উপরে আমল করতেন’।[5] অর্থাৎ হাদীছ ভিত্তিক জীবন যাপন ছিল ছাহাবা যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
ছাহাবা যুগের এই সুন্দর রীতিতে কিছুদিনের মধ্যেই ব্যত্যয় ঘটে। শুরু হয় বিদ‘আতীদের উত্থান যুগ (৩৭-১০০ হি.), সংকট যুগ (১০০-১৯৮ হি.), সুন্নাত দলনের যুগ (১৯৮-২৩২ হি.), সংকট পরবর্তী যুগ (২৩২-৪র্থ শতাব্দী হিজরী), অতঃপর বর্তমান তাক্বলীদী যুগ (৪র্থ শতাব্দী হিজরীর পরবর্তী)। আববাসীয় খলীফা মামূনের যুগে (১৯৮-২১৮ হি.) গ্রীক দর্শনের যে আরবী অনুবাদ শুরু হয়, তা এ যুগে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং ইহূদী, খৃষ্টানী, মজূসী, যরদশতী, হিন্দুস্থানী, তুর্কী, ইরানী ও অন্যান্য অনৈসলামী দর্শনের বই-পত্র আরবীতে অনূদিত হয়ে ইসলামী বিশ্বের চিন্তা-চেতনায় এক ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। কুরআন ও হাদীছের প্রকাশ্য অর্থের অনুসরণ ও ছাহাবা যুগের গৃহীত সহজ-সরল পথ ছেড়ে দিয়ে বিদ্বানগণ দর্শন ও কালাম শাস্ত্রের কুটতর্কে জড়িয়ে পড়েন। একই সাথে বিভিন্ন মুজতাহিদ ইমামের ফেকহী মতপার্থক্য, ছূফীবাদের প্রসার ইত্যাদি কারণে মুসলিম উম্মাহর সামাজিক ঐক্য ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। ইমাম গাযগালী (৪৫০-৫০৫ হি.) বলেন, ‘এই সময় আববাসীয় খলীফাগণ বিশেষ করে হানাফী-শাফেঈ বিতর্কে ইন্ধন যোগাতে থাকেন। ফলে উভয় পক্ষে বহু ঝগড়া-বিবাদ ও লেখনী পরিচালিত হয়’।[6]
এই সময়কার অবস্থা বর্ণনায় শাহ অলিউল্লাহ বলেন, ৪র্থ শতাব্দী হিজরীর পূর্বেকার লোকেরা কেউ কোন একজন নির্দিষ্ট বিদ্বানের মাযহাবের উপরে ঐক্যবদ্ধ ছিলেন না। কোন বিষয় সামনে এলে মাযহাব নির্বিশেষে যেকোন বিদ্বানের নিকট হ’তে লোকেরা ফৎওয়া জেনে নিতেন। ... কিন্তু পরবর্তীতে ঘটে গেল অনেক কিছু। ফিক্বহী বিষয়ে মতবিরোধ, বিচারকদের অন্যায় বিচার, হাদীছ শাস্ত্রে অনভিজ্ঞ লোকদের ফৎওয়া প্রদান ইত্যাদি কারণে অধিকাংশ লোক হক-বাতিল যাচাই করার মানসিকতা হারিয়ে ফেলে এবং প্রচলিত যেকোন একটি মাযহাবের তাক্বলীদ এমনভাবে আসন গেড়ে বসেছে, যেমনভাবে পিঁপড়া সবার অলক্ষ্যে দেহে ঢুকে কামড়ে থাকে’ (সংক্ষেপায়িত)।[7]
তাক্বলীদের মায়া বন্ধনে পড়ে মানুষ ছহীহ হাদীছের নিরপেক্ষ অনুসরণ থেকে দূরে সরে পড়ে। কে কত বড় ইমাম বা কে কত বড় দলের অনুসারী, এটাই তখন প্রধান বিচার্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। মাযহাবী তাক্বলীদের বাড়াবাড়ির ফলে হানাফী-শাফেঈ দ্বন্দ্বে ও শী‘আ মন্ত্রীর ষড়যন্ত্রে অবশেষে ৬৫৬ হিজরী মোতাবেক ১২৫৮ খৃষ্টাব্দে হালাকু খাঁর আক্রমণে বাগদাদের আববাসীয় খেলাফত ধ্বংস হয়। পরবর্তীতে মিসরের বাহরী মামলূক সুলতান রুকনুদ্দীন বায়বারাসের আমলে (৬৫৮-৭৬ হি.-১২৬০-৭৭ খৃঃ) মিসরীয় রাজধানীতে সর্বপ্রথম চার মাযহাবের জন্য পৃথক পৃথক আদালত কায়েম হয় ও প্রত্যেক মাযহাবের জন্য পৃথক কাযী বা বিচারক নিয়োগ করা হয়। ৬৬৫ হিজরীতে এ নিয়ম ইসলাম জগতের সর্বত্র চালু হয়ে যায় এবং চার মাযহাব বহির্ভূত কোন উক্তি বা সিদ্ধান্ত পবিত্র কুরআন বা ছহীহ হাদীছ মোতাবেক হ’লেও তার অনুসরণ নিষিদ্ধ গণ্য হয়।[8]
অতঃপর বুরজী মামলূক সুলতান ফারজ বিন বারকূক-এর আমলে (৭৯১-৮১৫ হি.) ৮০১ হিজরী সনে মুসলিম ঐক্যের প্রাণকেন্দ্র কা‘বা গৃহের চার পাশে চার মাযহাবের চার মুছাল্লা কায়েম হয়,[9] যা ১৩৪৩ হিজরীতে বর্তমান সঊদী শাসক পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আব্দুল আযীযের মাধ্যমে উৎখাত হয়।
এইভাবে তাক্বলীদের কু-প্রভাবে মুসলিম উম্মাহর বিভক্তি ও অন্তর্দ্বন্দ্ব স্থায়ীরূপ ধারণ করে। যা আজও বদ্ধমূল রয়েছে। বরং মা‘রেফাতের নামে, দেহতত্ত্বের নামে, তরীকার নামে, রাজনীতির নামে এই ভাঙ্গন ও আপোষ দ্বন্দ্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুর্ভাগ্য এই যে, অধিকাংশ দল ও মতের লোকেরা কুরআন ও সুন্নাহকেই তাদের মতের সপক্ষে ব্যবহার করছেন। ফলে ঐসব পন্ডিতদের ব্যাখ্যার বেড়াজাল ছিন্ন করে নির্ভেজাল তাওহীদ ও ছহীহ সুন্নাহর রৌদ্র করোজ্জ্বল রাজপথে ফিরে আসা অধিকাংশ জনগণের পক্ষে অসম্ভব হয়। এক্ষণে এইসব ব্যাখ্যা, অপব্যাখ্যা, দূরতম ব্যাখ্যার ধূম্রজাল থেকে বেরিয়ে এসে রাসূল (ছাঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী সেই মুক্তিপ্রাপ্ত ‘নাজী’ লোকদের কাফেলায় শরীক হওয়ার উপায় কি?
মুক্তির পথ
১. আপনাকে পবিত্র কুরআনের ঐ ব্যাখ্যা গ্রহণ করতে হবে, যে ব্যাখ্যা রাসূলের (ছাঃ) ছহীহ হাদীছ ও ছাহাবায়ে কেরামের বিশুদ্ধ আছার দ্বারা সমর্থিত।
২. কুরআন ও ছহীহ হাদীছের যে ব্যাখ্যা ছাহাবা, শ্রেষ্ঠ তাবেঈন ও তাঁদের অনুসারী মুহাদ্দিছ ফক্বীহ তথা হাদীছপন্থী বিদ্বানগণ কর্তৃক গৃহীত হয়েছে, তার অনুসরণ করতে হবে।
৩. নিজস্ব অভ্যাস, সামাজিক রেওয়াজ, প্রচলিত প্রথা, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ও সরকারী চাপ, বাপ-দাদা ও অমুক-তমুকের দোহাই ইত্যাদি তাক্বলীদী মায়াবন্ধন ছিন্ন করতে হবে ও সবদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দিকে ফিরে আসার মত দৃঢ় মানসিক শক্তি অর্জন করতে হবে।
৪. জীবনের সকল দিক ও বিভাগকে অহি-র বিধান অনুযায়ী ঢেলে সাজানোর জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্ত্তত থাকতে হবে।
৫. বৈষয়িক লাভ লোকসানের চাইতে জান্নাত পাওয়াকেই সবচেয়ে বড় পাওয়া মনে করতে হবে। এমনকি এজন্য পরিত্যাগকারীদের পরিত্যাগ, নিন্দুকদের নিন্দাবাদ এমনকি দুনিয়া হারানোর ঝুঁকি নিতে হ’লেও নিতে হবে।
বলা বাহুল্য উপরে বর্ণিত সকল বৈশিষ্ট্যের বাস্তব নমুনা ছিলেন ছাহাবায়ে কেরাম। তাঁদের এই সুন্দরতম বৈশিষ্ট্য সমূহ কোন ব্যক্তি বা দলের মধ্যে পাওয়া গেলে তাকে বা সেই দলকে নাজী দল বা ‘ফিরক্বায়ে নাজিয়াহ’ বলা যেতে পারে।
হকপন্থী উক্ত ‘নাজী ফের্কা’ বলতে কাদেরকে বুঝানো হয়েছে? (১) এ প্রসঙ্গে বিশ্বের অদ্বিতীয় মুহাদ্দিছ, ১০ লক্ষ হাদীছের হাফেয ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন,إِنْ لَمْ يَكُونُوا أَهْلَ الْحَدِيثِ فَلاَ أَدْرِي مَنْ هُمْ- ‘যদি তারা আহলেহাদীছ না হয়, তবে আমি জানিনা তারা কারা?[10]
(২) ইমাম বুখারী, তদীয় উস্তাদ আলী মাদীনী ও তদীয় উস্তাদ ইয়াযীদ বিন হারূণ বলেন, উক্ত দল হ’ল আহলেহাদীছ জামা‘আত। নইলে শী‘আ, মুরজিয়া, মু‘তাযিলা ও আহলুর রায়দের নিকট থেকে আমরা সুন্নাতের কিছুই আশা করতে পারিনা’।[11]
(৩) ইমাম আবুদাঊদ (রহঃ) বলেন,لَوْلاَ هَذِهِ الْعِصَابَةُ لَانْدَرَسَ الْإِسْلاَمُ يَعْنِي أَصْحَابَ الْحَدِيثِ- ‘যদি আহলেহাদীছ জামা‘আত দুনিয়াতে না থাকত, তাহ’লে ইসলাম দুনিয়া থেকে মিটে যেত’।[12]
(৪) ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ বলেন,فَهُمْ فِي أَهْلِ الْإِسْلاَمِ كَأَهْلِ الْإِسْلاَمِ فِي أَهْلِ الْمِلَلِ- ‘বিশ্বের সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে মুসলিম উম্মাহর যে মর্যাদা, মুসলিম উম্মাহর মধ্যে আহলেহাদীছদের অনুরূপ উচ্চ মর্যাদা রয়েছে’।[13]
(৫) শায়খ আব্দুল ক্বাদের জীলানী বলেন, ‘জেনে রাখ যে, বিদ‘আতীদের কতগুলি নিদর্শন হ’ল আহলেহাদীছদের নিন্দা করা। ...এসবই কেবল দলীয় গোঁড়ামি ও ক্রোধাগ্নি বৈ কিছুই নয়। অথচولا اسم لهم الا اسم واحد وهو أصحاب الحديث ‘আহলে সুন্নাতের অন্য কোন নাম নেই, আহলেহাদীছ ব্যতীত’।[14]
এক্ষণে আহলেহাদীছ বলতে কাদেরকে বুঝানো হয়েছে? তাঁরা কি কেবলমাত্র উম্মতের সেরা মুহাদ্দিছবৃন্দ, না তাঁদের অনুসারী হাদীছপন্থী অন্যান্য ওলামা ও সাধারণ মুসলমান হ’তে পারেন। এ প্রসঙ্গে পঞ্চম শতাব্দী হিজরীর খ্যাতনামা বিদ্বান ইমাম ইবনু হযম আন্দালুসী (মৃ. ৪৫৬ হি.) বলেন,
وَأهل السّنة الَّذين نذكرهم أهل الْحق وَمن عداهم فَأهل الْبِدْعَة فَإِنَّهُم الصَّحَابَة رَضِي الله عَنْهُم وكل من سلك نهجهم من خِيَار التَّابِعين رَحْمَة الله عَلَيْهِم ثمَّ أَصْحَاب الحَدِيث وَمن اتبعهم من الْفُقَهَاء جيلاً فجيلاً إِلَى يَوْمنَا هَذَا أَو من اقْتدى بهم من الْعَوام فِي شَرق الأَرْض وغربها رَحْمَة الله عَلَيْهِم-
‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত- যাদেরকে আমরা হকপন্থী ও তাদের বিরোধী পক্ষকে বাতিলপন্থী বলি, তাঁরা হলেন (ক) ছাহাবায়ে কেরাম (খ) তাঁদের অনুসারী শ্রেষ্ঠ তাবেঈগণ (গ) আহলেহাদীছগণ এবং (ঘ) ফক্বীহদের মধ্যে যারা তাঁদের অনুসারী হয়েছেন যুগে যুগে আজকের দিন পর্যন্ত এবং (ঙ) প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের ঐ সকল ‘আম জনসাধারণ যারা তাঁদের অনুসারী হয়েছেন যুগে যুগে আজকের দিন পর্যন্ত’।[15]
বুঝা গেল যে, ছাহাবায়ে কেরাম ও মুহাদ্দিছগণই কেবল আহলেহাদীছ ছিলেন না, বরং তাঁদের অনুসারী ‘আম জনসাধারণও ‘আহলেহাদীছ’ নামে সকল যুগে কথিত হ’তেন এবং আজও হয়ে থাকেন। যেমন- বিভিন্ন মাযহাবের ইমামদের ছাত্রগণই কেবল উক্ত ইমামের মুক্বাল্লিদ হিসাবে পরিচিত নন, বরং তাঁদের অনুসারী সাধারণ লোকদেরকেও উক্ত নামে অভিহিত করা হয়। ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, ‘এই হাদীছের মধ্যে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রকাশ্য মু‘জেযা নিহিত রয়েছে। কেননা এই গুণসম্পন্ন মুমিন আল্লাহর রহমতে রাসূল (ছাঃ)-এর যুগ হ’তে আজ পর্যন্ত বিদ্যমান রয়েছেন এবং ক্বিয়ামত পূর্বকাল পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবেন’।[16]
নিঃসন্দেহে এই উচ্চমর্যাদা ক্বিয়ামতের দিন কেবল তাদের জন্যই হবে, যারা দুনিয়াতে যেকোন মূল্যের বিনিময়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের উপরে কায়েম থেকেছেন এবং উপরে বর্ণিত পাঁচটি গুণ হাছিল করেছেন। এটা নিশ্চয়ই তারা নয়, যারা কেবল মুখে আহলেহাদীছ দাবী করেছে। অথচ ছহীহ হাদীছকে এড়িয়ে চলেছে। যারা তাদের ক্ষুদ্র দুনিয়াবী স্বার্থের জন্য সবকিছু করতে প্রস্ত্তত। কিন্তু অহি-র বিধান কায়েমের সংগ্রামে নিজের অহং-অহমিকা ও জান-মাল কুরবানী দিতে অপারগ কিংবা দ্বিধাগ্রস্থ।
অতএব আসুন! আমরা সেই দলের সন্ধান করি, যারা ধর্মীয় ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তথা জীবনের সকল দিক ও বিভাগে অহি-র বিধান অনুযায়ী চলার দৃপ্ত শপথে উজ্জীবিত, জিহাদী জাযবা নিয়ে ময়দানে কর্মরত এবং কথা, কলম ও সংগঠন নিয়ে সদা উচ্চকিত। কারণ জান্নাতুল ফেরদৌস তো কেবল তাদের জন্যই অপেক্ষা করছে। আল্লাহ আমাদেরকে সেই সংগ্রামী দলের অন্তর্ভুক্ত করুন- আমীন![17]
[1]. মুসলিম হা/১৯২২; মিশকাত হা/৩৮০১ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।
[2]. মুসলিম হা/১৪৮; আহমাদ হা/১২০৬২; মিশকাত হা/৫৫১৬ ‘ফিতান’ অধ্যায়।
[3]. মুসলিম হা/১৯২০ ‘ইমারত’ অধ্যায়, রাবী ছাওবান (রাঃ)।
[4]. তিরমিযী হা/২৬৪১; মিশকাত হা/১৭১; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৩৪৩, রাবী আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর (রাঃ)।
[5]. শাহ অলিউল্লাহ, আল-ইনছাফ ফী বায়ানি আসবাবিল ইখতিলাফ, সম্পাদনা : আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ (বৈরূত : দারুন নাফাইস, ২য় সংস্করণ ১৪০৪ হি.) ‘৪র্থ শতাব্দী হিজরীর পূর্বেকার লোকদের অবস্থা’ অধ্যায় ৭০ পৃ.।
[6]. শাহ অলিউললাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বা-লিগাহ (মিসর ছাপা : ১/১২৩ পৃ.)।
[7]. প্রাগুক্ত পৃ. ১২৩-২৪।
[8]. ইউসুফ জয়পুরী, হাক্বীক্বাতুল ফিকহ (বোম্বে, ভারত : তাবি) পৃ. ১১৫; আব্দুল্লাহেল কাফী আল-কোরায়শী, ফিরকাবন্দী বনাম অনুসরণীয় ইমামগণের নীতি (ঢাকা : ১ম সংস্করণ ১৯৬৩) পৃ. ১৭-১৮; গৃহীত : মাক্বরেযী ৪র্থ খন্ড পৃ. ১৬১।
[9]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৬; ফিরকাবান্দী পৃ. ১৮; গৃহীত : শাওকানী, বাদরুততালে‘ ২/২৬।
[10]. মুসলিম, শরহ নববী হা/১৯২০-এর টীকা দ্রষ্টব্য।
[11]. তিরমিযী, মিশকাত শেষ পৃষ্ঠা, ফাৎহুল বারী ১৩/২২৯, শারফু আছহাবিল হাদীছ ৫ ও ১৫ পৃ.।
[12]. খত্বীব বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ পৃ. ২৯।
[13]. ইবনু তায়মিয়াহ, মিনহাজুস সুন্নাহ (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, তাবি) ২/১৭৯।
[14]. আব্দুল ক্বাদের জীলানী, কিতাবুল গুনিয়াহ ওরফে গুনিয়াতুত ত্বা-লেবীন (মিসরী ছাপা ১৩৪৬ হি.) ১/৯০-৯১।
[15]. ইবনু হযম, কিতাবুল ফাছল ফিল মিলাল, শহরস্তানীর ‘মিলাল’ সহ (বৈরূত : মাকতাবা খাইয়াত্ব ১৩২১/১৯০৩) ২/১১৩।
[16]. মোল্লা আলী ক্বারী, মিরক্বাত, উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যা ৭/২৭৫ পৃ.।
[17]. মাসিক আত-তাহরীক (রাজশাহী), দরসে হাদীছ, ২/২ সংখ্যা, নভেম্বর ১৯৯৮।