عَنِ الْمِقْدَامِ بْنِ مَعْدِيكَرِبَ عَنْ رَسُولِ اللهِ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- أَنَّهُ قَالَ : أَلاَ إِنِّى أُوتِيتُ الْكِتَابَ وَمِثْلَهُ مَعَهُ أَلاَ يُوشِكُ رَجُلٌ شَبْعَانُ عَلَى أَرِيكَتِهِ يَقُولُ عَلَيْكُمْ بِهَذَا الْقُرْآنِ فَمَا وَجَدْتُمْ فِيهِ مِنْ حَلاَلٍ فَأَحِلُّوهُ وَمَا وَجَدْتُمْ فِيهِ مِنْ حَرَامٍ فَحَرِّمُوهُ وإن ما حرَّم رسولُ الله كما حَرَّمَ اللهُ...
অনুবাদ :
হযরত মিক্বদাম বিন মা‘দী কারিব* (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, জেনে রাখ যে, আমি প্রাপ্ত হয়েছি কুরআন ও তার সাথে তারই মত আরেকটি বস্ত্ত। সাবধান! সত্বর তোমাদের নিকটে খাট-পালংকে শুয়ে থাকা বিলাসী কিছু লোকের আবির্ভাব হবে। যারা বলবে, তোমাদের জন্য এই কুরআনই যথেষ্ট। এর মধ্যে তোমরা যেগুলিকে হালাল পাও তাকে হালাল জানো। তবে মনে রেখ নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূল যা হারাম করেন, তা আল্লাহ কর্তৃক হারাম করার ন্যায়’।[1]
শাব্দিক ব্যাখ্যা :
১. আলা (أَلاَ) : ‘সাবধান!’ (ا) হরফে তাম্বীহ حرف تنبيه কাউকে হুঁশিয়ার করার জন্য ও নিজের কথার প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য ألآ، أمآ، هَا ইত্যাদি হরফে তাম্বীহ ব্যবহার করা হয়। এগুলি حروف غير عامله-এর অন্তর্ভুক্ত, যা বাক্যের উপরে কোন عمل বা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না।
২. ইন্নী ঊতীতুল কিতাবা (إِنِّى أُوتِيتُ الْكِتَابَ) : ‘নিশ্চয়ই আমি প্রাপ্ত হয়েছি কিতাব’। (إِنِّي أُوتِيتُ)، أَيْ: أَتَانِيَ اللهُ ‘আমি প্রাপ্ত হয়েছি অর্থাৎ আল্লাহ আমাকে প্রদান করেছেন’ (মিরক্বাত)।
৩. ওয়া মিছলাহু মা‘আহূ (وَمِثْلَهُ مَعَهُ) : ‘এবং তার সাথে তার মত আরেকটি বস্ত্ত’। অর্থাৎ আমি কুরআনের সাথে তদনুরূপ আরেকটি বস্ত্ত প্রাপ্ত হয়েছি। ইমাম বায়হাক্বী (৩৮৪-৪৫৮ হি.) বলেন, এর দু’টি অর্থ হ’তে পারে। (ক) প্রকাশ্য অহিয়ে মাতলু তথা কুরআনের ন্যায় অহিয়ে বাতেন। গায়ের মাতলু অর্থাৎ হাদীছ প্রাপ্ত হয়েছেন। অথবা (খ) তিনি যেরূপ অহি-র মাধ্যমে কিতাব প্রাপ্ত হয়েছেন, তেমনি অহি-র মাধ্যমে তার ‘বায়ান’ বা ব্যাখ্যা প্রাপ্ত হয়েছেন। ফলে তিনি সে মোতাবেক কুরআনের ব্যাখ্যা দিতে পারেন। সাধারণ হুকুমকে নির্দিষ্ট করা, সেখানে কিছু কম করা, বেশী করা ইত্যাদি সর্ববিধ ব্যাখ্যা দান করেন। যার উপরে আমল করা উম্মতের জন্য কুরআনের ন্যায় ওয়াজিব (মির‘আত, মিরক্বাত)।
৪. আলা ইয়ুশিকু রাজুলুন শাব‘আ-নু (أَلاَ يُوشِكُ رَجُلٌ شَبْعَانُ) : ‘সাবধান শীঘ্র আবির্ভাব ঘটবে বিলাসী কিছু লোকের’। ইমাম ত্বীবী (মৃ. ৭৪৩ হি.) বলেন, এখানে ‘আলা’ (ألا) হরফে তাম্বীহকে দ্বিতীয়বার নিয়ে আসার কারণ হ’ল ঐ ব্যক্তির উপরে ধিক্কার ও ক্রোধ প্রকাশ করা, যে ব্যক্তি কুরআনকে যথেষ্ট মনে করে হাদীছের উপরে আমলকে পরিত্যাগ করে। তাহ’লে ঐ ব্যক্তির অবস্থা কিরূপ হবে, যে ব্যক্তি ‘রায়’-কে হাদীছের উপরে অগ্রাধিকার দেয়? ইমাম ত্বীবী-র উক্ত মন্তব্য উদ্ধৃত করার পর মিশকাতের আরবী ভাষ্যকার মোল্লা আলী ক্বারী (মৃ. ১০১৪ হি.) বলেন, একারণেই ইমাম আবু হানীফা (৮০-১৫০ হি.) যঈফ হাদীছকেও শক্তিশালী রায়-এর উপরে অগ্রগণ্য করেছেন’ (মিরক্বাত)। অথচ দুঃখজনক বাস্তবতা এই যে, হানাফী মাযহাবের নামে পরবর্তী ফক্বীহরা তাদের রচিত উছূল সমূহের দোহাই দিয়ে যঈফ দূরে থাক অসংখ্য ছহীহ হাদীছকে অগ্রাহ্য করে নিজেদের রায় মানতে হানাফী মাযহাবধারী লোকদেরকে তাক্বলীদের নামে বাধ্য করেছেন। اَوْشَكَ يُوْشِكُ বাবে ইফ‘আল থেকে এসেছে। اوشك، عسى، كاد، كَرَبَ ইত্যাদি افعال مقاربة অর্থাৎ নিকটবর্তী অর্থ প্রদান করে। ‘রাজুলুন শাব‘আনু’ (رَجُلٌ شَبْعَانُ) অর্থাৎ ‘বিলাসী পেটুক’ বলে হাদীছ পরিত্যাগকারী লোকদের কটাক্ষ করা হয়েছে। এখানে পুরুষ বলার মাধ্যমে পুরুষ ও নারী সকলকে বুঝানো হয়েছে। শ্রেষ্ঠত্বের কারণে কেবল পুরুষকে খাছ করা হয়েছে। কাযী আয়ায (রহঃ) বলেন, দু’টি কারণে এটা বলা হয়ে থাকতে পারে।
(ক) অধিক পেট পূজারী লোকগুলি সাধারণতঃ বোকা ও বিলাসী হয়ে থাকে। (খ) এর দ্বারা অর্থ-বিত্ত ও পদ মর্যাদার অহংকারে বুঁদ হয়ে থাকা আহাম্মক লোকগুলিকে বুঝানো হয়েছে। যারা কুরআন-হাদীছের কোন পরোয়া করে না। বর্তমান যুগের রাষ্ট্র ও সমাজনেতা এবং গদ্দীনশীন ও সাজ্জাদানশীন ধর্মীয় নেতাদের অহংকারী ভাবসাব ও কুরআন-হাদীছের বিধান সমূহের প্রতি অনীহা ও নিস্পৃহা মনোভাব রাসূল (ছাঃ)-এর উক্ত বক্তব্যের বাস্তবতা প্রমাণ করে বৈ-কি।
৫. ইন্না মা হাররামা রাসূলুল্লা-হি (إِنَّ مَا حَرَّمَ رَسُوْلُ اللهِ) : ‘নিশ্চয়ই যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হারাম করেন, তা আল্লাহ কর্তৃক হারাম করার ন্যায়’। এখানে হালালকে বাদ দিয়ে কেবল হারামকে উল্লেখ করার কারণ এটা বুঝানো যে, বৈষয়িক বিষয় সমূহের মূল হ’ল সিদ্ধতা (الْأَصْلَ فِي الْأَشْيَاءِ إِبَاحَتُهَا) যতক্ষণ না সেখানে শরী‘আত কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। পক্ষান্তরে ইবাদতের ক্ষেত্রে মূল হ’ল নিষিদ্ধতা (والاصل فى العبادة المنع)। অর্থাৎ শরী‘আতের নির্দেশ ব্যতীত ইবাদত মনে করে নতুন কিছু করলে তা হবে বিদ‘আত। ছহীহ বুখারীর জগদ্বিখ্যাত ভাষ্যকার ইবনু হাজার আসক্বালানী (৭৭৩-৮৫২ হি.) বলেন, রাসূল (ছাঃ) কৃত হারাম বা হালাল আল্লাহ কৃত হারাম বা হালালের ন্যায় (মিরক্বাত)। অতএব কুরআনের হুকুম ‘অকাট্য’ (قَطْعِيٌّ) এবং হাদীছের হুকুম ‘ধারণা নির্ভর’ (ظَنِّيٌّ), এই ধরনের বিভক্তি সম্পূর্ণরূপে বাতিল। বরং ছহীহ হাদীছ আক্বীদা ও আহকাম সকল বিষয়ে কুরআনের ন্যায় অকাট্য দলীল হিসাবেই গণ্য।
ব্যাখ্যা :
অত্র হাদীছটি ইসলামী আইনের দ্বিতীয় উৎস হাদীছের গুরুত্ব ও প্রামাণিকতা সম্পর্কে চূড়ান্ত বক্তব্য প্রদান করে। উক্ত হাদীছ থেকে নিম্নোক্ত বিষয় সমূহ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন-
১. হাদীছ কুরআনের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ ও একইরূপ আমলযোগ্য।
২. কুরআনের ন্যায় হাদীছও অহি-র মাধ্যমে নাযিল হয়েছে।
৩. হাদীছ কেবল কুরআনের ব্যাখ্যা নয় বরং হারাম-হালালের ব্যাপারসহ বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত দাতা।
৪. হাদীছের অনুসরণ মুমিনের জন্য অপরিহার্য। হাদীছ বিরোধিতা রাসূল (ছাঃ)-এর বিরোধিতার শামিল।
৫. হাদীছের বিরোধিতা খাঁটি মুমিনের দ্বারা কখনোই সম্ভব নয়। এটা কেবল তারাই করে থাকে, যারা আয়াসী কল্পনা ও বিলাসী চেতনার অধিকারী। এই লোকগুলি আর্থিক ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত নেতৃবৃন্দের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী।
৬. স্বার্থান্ধ ব্যক্তিরাই কেবল হাদীছের বিরোধিতা করে থাকে। যাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,وَإِذَا دُعُوا إِلَى اللهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ إِذَا فَرِيقٌ مِنْهُمْ مُعْرِضُونَ- وَإِنْ يَكُنْ لَهُمُ الْحَقُّ يَأْتُوا إِلَيْهِ مُذْعِنِينَ- ‘যখন তাদেরকে আল্লাহ ও রাসূলের দিকে আহবান করা হয় তাদের মধ্যে ফায়ছালা করার জন্য, তখন তাদের একদল মুখ ফিরিয়ে নেয়’ । ‘আর যদি সেখানে তাদের কোন স্বার্থ থাকে, তাহ’লে তারা তাঁর কাছে ছুটে আসে বিনীতভাবে’ (নূর ২৪/৪৮-৪৯)।
৭. কুরআনে নেই এমন যেসব বিষয় হাদীছে হারাম করা হয়েছে, তা কুরআন কর্তৃক হারাম করার ন্যায়। অনুরূপভাবে কুরআনে উল্লেখিত নেই এমন সমস্ত আদেশ-নিষেধ যা হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, তা সবই কুরআনের ন্যায় আমলযোগ্য।
৮. আক্বীদা বা আহকাম সকল বিষয়ে ছহীহ হাদীছ হ’ল মানদন্ড এবং নিঃসন্দেহে তা কুরআনের ন্যায় অকাট্য। কেননা রাসূল (ছাঃ) কোন কথা বলতেন না তাঁর নিকটে অহি না হওয়া পর্যন্ত (নাজম ৫৩/৩-৪)। আর ‘অহি’ হ’ল চূড়ান্ত সত্যের অভ্রান্ত উৎস।
৯. হাদীছ বিরোধিতার পরিণাম হ’ল দুনিয়াতে ফিৎনা-ফাসাদ ও আখেরাতে মর্মান্তিক আযাব (নূর ২৪/৬৩)।
১০. পথভ্রষ্টতা হ’তে বাঁচার একমাত্র উপায় হ’ল কুরআন ও সুন্নাহ উভয়কে কঠিনভাবে আকড়ে ধরা। ক্বিয়ামত পর্যন্ত এ দু’টি একত্রিত থাকবে। অতএব উভয়কে পৃথক ভাবা সিদ্ধ নয়। যেমন অন্য হাদীছে এসেছে, ‘আমি তোমাদের নিকটে দু’টি বস্ত্ত ছেড়ে যাচ্ছি। তোমরা কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না, যতদিন তোমরা এ দু’টি বস্ত্তকে কঠিনভাবে ধরে থাকবে। আল্লাহর কিতাব ও আমার সুন্নাত। এ দু’টি কখনোই বিভক্ত হবে না যতক্ষণ না হাউয কাওছারের কিনারায় পৌঁছে যাবে’।[2]
সুন্নাহর হেফাযতের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহর :
আল্লাহ বলেন, إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ- ‘আমরাই কুরআন নাযিল করেছি এবং আমরাই এর সংরক্ষণকারী’ (হিজর ১৫/৯)। এখানে ‘যিকর’ অর্থ আল্লাহ প্রেরিত ‘অহি’। অহি দু’প্রকার। অহিয়ে মাতলু বা আবৃত্ত অহি, যা তেলাওয়াত করা হয় এবং যা কুরআন হিসাবে অবতীর্ণ। অন্যটি হ’ল অহিয়ে গায়ের মাতলু বা অনাবৃত্ত অহি, যা ছালাতে তেলাওয়াত করা হয় না এবং যা হাদীছ নামে অভিহিত। আল্লাহ বলেন,وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى- إِنْ هُوَ إِلاَّ وَحْيٌ يُوحَى- ‘তিনি নিজ ইচ্ছামত কোন কথা বলেন না’। ‘সেটা আর কিছুই নয় অহী ব্যতীত, যা তার নিকটে প্রত্যাদেশ করা হয়’ (নাজম ৫৩/৩-৪)। অহি-র অভ্রান্ততা সম্পর্কে আল্লাহ সাক্ষ্য দেন,لاَ يَأْتِيهِ الْبَاطِلُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَلاَ مِنْ خَلْفِهِ تَنْزِيلٌ مِنْ حَكِيمٍ حَمِيدٍ- ‘সামনে বা পিছনে কোন দিক থেকেই এতে কোন মিথ্যা প্রবেশ করে না। এটি মহা প্রজ্ঞাময় ও মহা প্রশংসিত (আল্লাহর) পক্ষ হতে অবতীর্ণ’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৪২)। রাসূল (ছাঃ) যখন ‘অহি’ মুখস্ত করার জন্য খুব ব্যস্ততা দেখাচ্ছিলেন, তখন আল্লাহ পাক আয়াত নাযিল করে বলেন, لاَ تُحَرِّكْ بِهِ لِسَانَكَ لِتَعْجَلَ بِهِ- إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَقُرْآنَهُ- فَإِذَا قَرَأْنَاهُ فَاتَّبِعْ قُرْآنَهُ- ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا بَيَانَهُ- ‘তাড়াতাড়ি অহী আয়ত্ব করার জন্য আপনি দ্রুত জিহবা সঞ্চালন করবেন না’। ‘কেননা তা সংরক্ষণ ও পাঠ করানোর দায়িত্ব আমাদের’। ‘অতএব যখন আমরা তা (জিব্রীলের মাধ্যমে) পাঠ করাই, তখন আপনি সেই পাঠের অনুসরণ করুন’। ‘অতঃপর এর বিশদ ব্যাখ্যা দানের দায়িত্ব আমাদেরই’ (ক্বিয়ামাহ ৭৫/১৬-১৯)। অতএব কুরআনের ব্যাখ্যা হিসাবে হাদীছের হেফাযতের দায়িত্ব সরাসরি আল্লাহর বান্দা শত চেষ্টা করেও যেমন কুরআনকে মুছে দিতে পারেনি। তেমনি হাদীছ বিরোধীদের শত চেষ্টায়ও ইসলামী আইনের দ্বিতীয় উৎস হাদীছকে মুছে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে তাদের ষড়যন্ত্র যেমন পূর্বেও ছিল, তেমনি আজও রয়েছে। বলা চলে যে, তা ক্বিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। হকপন্থী মুমিন হাযারো চক্রান্তের মধ্যেই ‘হক’ খুঁজে নেবে ও তার অনুসারী হয়ে আখেরাতে জান্নাত লাভে ধন্য হবে ইনশাআল্লাহ। অবিশ্বাসীরা সন্দেহ-দ্বন্দ্বের ঘনঘটায় অন্ধকার পথে আলো-অাঁধারীর লুকোচুরির মাঝে হোচট খেয়ে চলতে চলতে অবশেষে জাহান্নামের অগ্নিগহবরে চিরস্থায়ী আযাবে গ্রেফতার হবে। শী‘আ পন্ডিতরা বর্তমান কুরআন ও হাদীছ সমূহকে সঠিক বলে বিশ্বাস করে না। আহ’লে কুরআনগণ হাদীছের অভ্রান্ততায় বিশ্বাসী নয়। যুক্তিবাদী হবার দাবীদার মু‘তাযিলাগণ যুক্তির বাইরে উক্তি সমূহ মানতে রাযী নয়। ক্বাদিয়ানীরা নতুন নবীতে বিশ্বাসী। তারা মুসলিম হবার দাবী করলেও তারা নিঃসন্দেহে কাফির। তাদের কুফরীতে অবিশ্বাস করাটাও কুফরী হবে। কিন্তু শত অবিশ্বাসীর অবিশ্বাস ও সন্দেহবাদীদের সন্দেহবাদ অভ্রান্ত সত্যের উৎস পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সত্যতা ও অভ্রান্ততাকে কখনোই গ্রাস করতে পারেনি। আজও পারবে না ইনশাআল্লাহ।
সৌভাগ্যক্রমে বাংলাদেশ সুন্নী মুসলমানের দেশ। এখানে শী‘আ, ক্বাদিয়ানী, আহ’লে কুরআন না থাকারই মত। কিন্তু সুন্নী হওয়া সত্ত্বেও এবং হাদীছের প্রতি অগাধ ও অকৃত্রিম ভক্তি থাকা সত্ত্বেও আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে হাদীছ অনুযায়ী জীবন গড়া হ’তে বঞ্চিত।
হাদীছের উপরে আমলে বাধার কারণ :
১. পরবর্তী আলেমদের রচিত কিছু কিছু উছূল বা আইন সূত্র।
২. তাক্বলীদ।
প্রথমোক্ত বিষয়টিতে আমরা ভারতগুরু শাহ অলিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী (১১১৪-৭৬ হি.)-এর সুচিন্তিত মন্তব্য উপহার দিয়েই ক্ষান্ত হব। শাহ ছাহেব আহলুর রায় (হানাফী) বিদ্বানদের রচিত কয়েকটি ‘উছূল’ উল্লেখ করে তার দ্বারা কিভাবে ছহীহ হাদীছের উপরে আমল ব্যাহত হয়েছে, তার উল্লেখ করেছেন। যেমন উদাহরণ স্বরূপ তিনি বলেন, (ক) আহলুর রায়গণ ‘উছূল’ বা আইনসূত্র তৈরী করেছেন যে, الخاص لا يحتمل البيان لكونه بينا অর্থাৎ ‘নিজেই নিজের অর্থ প্রকাশকারী হওয়ার কারণে ‘খাছ’ (অর্থাৎ কুরআনের আয়াত) কোনরূপ ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না’। এই ফিক্বহী মূলনীতি বা উছূল রক্ষা করতে গিয়ে তাঁরা ছহীহ হাদীছে বর্ণিত সুস্থিরভাবে ছালাত আদায় বা তা‘দীলে আরকানকে ছালাতের আবশ্যিক বিষয় হিসাবে গ্রহণ করেননি। কেননা কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,ارْكَعُوا وَاسْجُدُوا ‘তোমরা রুকু কর ও সিজদা কর’ (হজ্জ ২২/৭৭)। এর আভিধানিক অর্থ হ’ল ‘তোমরা দাঁড়ানো অবস্থা থেকে মাথা ঝুঁকাও এবং মাটিতে কপাল ঠেকাও’। অতএব মাথা ঝুঁকালে ও মাটিতে কপাল ঠেকালেই রুকু ও সিজদা আদায় হয়ে যাবে। এর জন্য ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী সুস্থিরভাবে তা‘দীলে আরকান সহ ছালাত আদায় করা (তাঁদের ভাষায়) খবরে ওয়াহিদ (একক সূত্রে বর্ণিত হাদীছ) দ্বারা কুরআনকে ‘মানসূখ’ (হুকুম রহিত) করার শামিল হবে, যেটা সিদ্ধ নয়। অথচ রাসূল (ছাঃ) জনৈক ব্যক্তিকে দ্রুত ছালাত আদায়ের কারণে তিনবার ছালাত আদায় করান।[3]
উক্ত উছূল মানতে গিয়ে ছহীহ হাদীছের উপরে আমল বন্ধ হয়েছে। শুধু তাই নয় বরং ছালাতের রূহ বিনষ্ট হয়েছে। কেননা ছালাত হ’ল শ্রেষ্ঠ ইবাদত এবং শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক ইবাদত। এখানে বান্দা ও আল্লাহর মধ্যে সম্পর্ক তৈরী হয়। এই ইবাদতে যিনি যত আন্তরিক, জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও তিনি তত সৎ ও সফল। হাদীছের ভাষায় كَنَقْرَةِ الْغُرَابِ বা ‘কাকের ঠোকরের মত’ (আবুদাঊদ হা/৮৬২; মিশকাত হা/৯০২) সিজদা করার মাধ্যমে নিশ্চয়ই উক্ত আধ্যাত্মিক সম্পর্ক তৈরী হওয়া সম্ভব নয়। রাসূল (ছাঃ) ও শ্রেষ্ঠ ছাহাবীগণ ছালাত আদায়ের সময় আত্মভোলা হয়ে যেতেন। অধিকক্ষণ আল্লাহর ধ্যানে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে পদযুগল ভারী হয়ে যেত। রুকুতে গেলে, সিজদাতে গেলে অনেক সময় পিছন থেকে ‘লোকমা’ দিতে হ’ত। হাদীছে জিব্রীলে বলা হয়েছে, ‘তুমি ছালাত আদায় কর এমনভাবে যেন তুমি আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছ। যতি এতদূর সম্ভব না হয় তবে মনে করো যে, তিনি তোমাকে দেখছেন’।[4] যুদ্ধের ময়দানে রোম সম্রাটের প্রেরিত গুপ্তচর মুসলিম সেনাবাহিনীর শক্তি সম্পর্কে গোপনে সংবাদ নিয়ে গিয়ে রিপোর্ট দিচ্ছেوهم فى الليل رهبان وفى النار فرسان ‘তারা রাত্রিতে ইবাদত গোযার ও দিবসে ঘোড় সওয়ার’। বলাবাহুল্য ভুখানাঙ্গা ও সাজ-সরঞ্জামহীন মুসলিম বাহিনীর এটিই ছিল মূল শক্তি। এই ঈমানী শক্তিই মুসলিম উম্মাহকে প্রাথমিক যুগে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শক্তিতে পরিণত করেছিল। ছালাত ছিল সেই আত্মিক শক্তির উৎস মূল। রাসূল (ছাঃ) একারণেই জনৈক ব্যক্তিকে তিনবার ছালাত আদায়ে বাধ্য করলেন। অথচ আমরা নিজেদের রচিত উছূলের দোহাই দিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর সেই দূরদর্শী সিদ্ধান্তকে বাদ দিলাম। একবারও ভেবে দেখলাম না যে, ارْكَعُوا وَاسْجُدُوا আয়াতটি যে রাসূল (ছাঃ)-এর উপরে নাযিল হয়েছে, এর ব্যাখ্যাও তাঁর নিকটে নাযিল হয়েছে এবং তাঁর বাস্তব আমল-আচরণই হ’ল এ আয়াতের যথার্থ ও চূড়ান্ত ব্যাখ্যা। এক্ষণে প্রশ্ন দাঁড়ায় যে, উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় আরবী অভিধানের শাব্দিক অর্থ গ্রহণযোগ্য হবে? না রাসূল (ছাঃ)-এর দেওয়া বাস্তব আমল ও আচরণ গত ব্যাখ্যা গৃহীত হবে? একজন মুমিনের নিকটে নিঃসন্দেহে রাসূল (ছাঃ)-এর আচরিত আমলই গ্রহণযোগ্য হবে ও পরবর্তীকালের ফক্বীহদের রচিত উছূল পরিত্যক্ত হবে। যে উছূল বা আইনসূত্র ছহীহ হাদীছ মানতে বাধা সৃষ্টি করে বরং ছালাতের মূল রূহকে হত্যা করে, ঐসব উছূলে ফিক্বহের পঠন-পাঠন নিষিদ্ধ হওয়া উচিত নয় কি? ফলে ছালাত এখন ৫/১০ মিনিটের আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে এবং আজকের ঈমানদার মুসলমানরা ছালাতের মধ্যে রূহানী খোরাক না পেয়ে নিজেদের বানাওয়াট মা‘রেফতী যিকর ও কাশফ আবিষ্কার করে নিয়েছে ও বিভিন্ন শিরক-বিদ‘আতে হাবুডুবু খাচ্ছে।
(খ) অমনিভাবে উছূল রচনা করা হয়েছে العام قطعى كالخاص ‘আম’ বা সাধারণ হুকুম ‘খাছ’-এর ন্যায় অকাট্য’। কুরআনে সাধারণভাবে নির্দেশ এসেছে, فَاقْرَءُوا مَا تَيَسَّرَ مِنَ الْقُرْآنِ ‘তোমরা কুরআন থেকে যা সহজ মনে কর তা পড়’ (মুযযাম্মিল ৭৩/২০)। وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَأَنْصِتُوا ‘আর যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তোমরা তা মনোযোগ দিয়ে শোন এবং চুপ থাকো’ (আ‘রাফ ৭/২০৪)। হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ইমামের পিছনে (জেহরী) ছালাতে তোমরা কিছুই পড়ো না, কেবলমাত্র সূরায়ে ফাতিহা পড়। কেননা لاَ صَلاَةَ لِمَنْ لَمْ يَقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ ‘সূরায়ে ফাতিহা যে পাঠ করে না, তার ছালাত হয় না’।[5] আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, এটা তোমরা মনে মনে পড় (ঐ)। বর্ণিত আয়াতটি যে রাসূল (ছাঃ)-এর উপরে নাযিল হ’ল, তাঁর ব্যাখ্যাই চূড়ান্ত। কিন্তু পরবর্তীকালে মাযহাবী গোঁড়ামী প্রসূত উছূল রচনা করে আমরা উক্ত ছহীহ হাদীছের উপরে আমল বাদ দিলাম ও লাখ লাখ মুছল্লীকে ইমামের পিছনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করলাম ও সূরা ফাতিহার বরকত থেকে তাদের মাহরূম করলাম।
(গ) অমনিভাবে উছূল রচনা করা হ’ল যে,
لا يجب العمل بحديث غير الفقيه إذا أنسد باب الرأى، الراوى وإن عرف بالعدالة والضبط دون الفقه كأنس وأبى هريرة إن وافق حديثه القياس عمل به وإن خالفه لم يةرك إلا بالضرورة-
‘ফক্বীহ নয় এমন রাবী কর্তৃক বর্ণিত হাদীছের উপরে আমল করা ওয়াজিব নয়। যখন তা যুক্তির বিরোধী হবে। অমনিভাবে ন্যায়নিষ্ঠা ও স্মৃতিশক্তিতে প্রসিদ্ধ হ’লেও যদি তিনি ফক্বীহ না হন, যেমন আনাস ও আবু হুরায়রা (রাঃ) যদি তাঁদের বর্ণিত হাদীছ ক্বিয়াসের অনুকূলে হয়, তবে তা আমলযোগ্য। কিন্তু যদি ক্বিয়াসের বরখেলাফ হয়, তবে নিতান্ত প্রয়োজন না হ’লে ক্বিয়াস বর্জন করা যাবে না’।[6]
হযরত আনাস (রাঃ) ও হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) ছিলেন রাসূল (ছাঃ)-এর সবচেয়ে কাছের মানুষ। আনাস (রাঃ) ছিলেন রাসূল (ছাঃ)-এর গোলাম ও আবু হুরায়রা (রাঃ) ছিলেন ‘আছহাবে ছুফফা’ অর্থাৎ ঘর-সংসার বাদ দিয়ে নবীর নিকটে সর্বদা পড়ে থাকা ছাহাবীদের অন্যতম। তদুপরি রাসূল (ছাঃ)-এর খাছ দো‘আ প্রাপ্ত সর্বাধিক হাদীছজ্ঞ ছাহাবী। ইনি পরবর্তীকালে ওমর (রাঃ)-এর সময় বাহরায়েনের ও মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর সময় মদীনার গবর্ণর ছিলেন। যদি তারা ফক্বীহ না হবেন, তবে এতবড় সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় গুরু দায়িত্ব তাঁরা কিভাবে পালন করলেন? আমাদের উছূলবিদরা ছাহাবায়ে কেরামের ফিক্বহী জ্ঞান পরিমাপ করার যোগ্যতা ও অধিকার কোথায় পেলেন? ভাবখানা এই যে, তাঁরাই যেন ছাহাবায়ে কেরামের চাইতে বড় ফক্বীহ নাঊযুবিল্লাহ।
শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ) বলেন,وأمثال ذَلِك أصُول مخرجة على كَلاَم الْأَئِمَّة، وَأَنه لاَ تصح بهَا رِوَايَة عَن أبي حنيفَة وصاحبيه- ‘অনুরূপ আরও বহু উছূল তৈরী হয়েছে ইমামদের কথার উপরে ভিত্তি করে। অথচ এসবের একটি বর্ণনাও আবু হানীফা ও তাঁর দুই শিষ্য থেকে ছহীহ সূত্রে প্রমাণিত নয়’।[7]
উপরোক্ত উছূল সমূহের উপরে ভিত্তি করে ছালাত, ছিয়াম, যাকাত, হজ্জ, বিবাহ-তালাক্ব, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, বিচারনীতি ও অর্থনীতির বহু মাসআলা-মাসায়েল নির্গত হয়েছে এবং আজও বহু ফৎওয়া তৈরী হচ্ছে। যার অধিকাংশের সাথে ছহীহ হাদীছের কোন সম্পর্ক নেই। এমনকি এইসব ফৎওয়া ও মাসায়েল যে সকল মহামতি ইমামের বা তাঁদের মাযহাবের নামে প্রদত্ত হচ্ছে, পরীক্ষায় দেখা যাবে যে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবেও তাঁরা এসবের সাথে জড়িত নন। এ সম্পর্কে শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ)-এর কঠোর মন্তব্য আমরা ইতিপূর্বে শুনেছি। এক্ষণে আরও কয়েকজন প্রথিতযশা বিদ্বানের মন্তব্য শ্রবণ করুন।-
খ্যাতনামা হানাফী পন্ডিত আল্লামা সা‘দুদ্দীন তাফতাযানী (৭২২-৯২ হি.) ‘তালবীহ’-এর মধ্যে ‘সুন্নাহ-এর আলোচনায় হাদীছের রেওয়ায়াত ছহীহ হওয়ার জন্য রাবী ফক্বীহ হওয়া সম্পর্কে যে বর্ণনা দান করেছেন, সেখানে ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর প্রতি উক্ত বিষয়কে যুক্ত করার বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ করে বলেন,
الرابع كما دل العقل على أن فقه الراوى لا أثر له فى صحة الرواية فلا يستند قول ذلك إلى أبى حنيفة، دل النقل من الثقات على أنه قول موضوع مختلق على السلف الصالح ومستحدث من المتأخرين-
‘জ্ঞানের দাবী এটাই যে, রাবীর ফক্বীহ হওয়া তাঁর রেওয়ায়াত ছহীহ হওয়ার উপরে কোন প্রভাব বিস্তার করে না। অতএব উক্ত বিষয়টিকে আবু হানীফা (রহঃ)-এর দিকে সম্বন্ধ করা চলেনা। বিশ্বস্ত বিদ্বানগণ হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, উক্ত কথাটি পুণ্যবান পূর্বসূরীদের নামে রচিত ও বানাওয়াট এবং পরবর্তীদের সৃষ্টি’।[8]
উপরোক্ত উছূল সমূহের ভিত্তিতে গৃহীত এবং বিশ্বস্ত ফিক্বহ গ্রন্থগুলির অমার্জনীয় হাদীছ বিরোধিতা সম্পর্কে খ্যাতনামা হানাফী বিদ্বান আল্লামা আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌবী (১২৬৪-১৩০৪ হি./১৮৪৮-১৮৮৬ খৃ.) বলেন,
كم من كتاب معتمد اعتمد عليه اجلة الفقهاء مملو من الأحاديث الموضوعة ولا سيما الفتاوى، فقد وضح لنا بتوسيع النظر أن أصحابهم وان كانوا من الكاملين لكنهم فى نقل الأخبار من المتساهلين...-
ألا ترى إلى صاحب الهداية من أجلة الحنيفة والرافعى شارح الوجيز من أجلة الشافعية مع كونهما ممن أشار إليه بالأنامل ويعتمد عليه الأماجد والأماثل قد ذكروا فى تصانيفهما ما لم يجد له أثر عند خبير الحديث-
‘কতই না বিশ্বস্ত কিতাব সমূহ রয়েছে বড় বড় ফক্বীহগণ যে সবের উপরে ভরসা করে থাকেন, সেগুলি পরিপূর্ণ হয়ে আছে মওযূ‘ বা জাল হাদীছ সমূহ দ্বারা। বিশেষ করে ঐসব কিতাবের ফৎওয়াসমূহ। গভীরভাবে দৃষ্টি দিলে আমাদের নিকটে পরিস্কার হয়ে ওঠে যে, ঐ সকল গ্রন্থকার যদিও পূর্ণ ইলমের অধিকারী, তথাপি হাদীছ উদ্ধৃতির ব্যাপারে তাঁরা ছিলেন অলসদের অন্তর্ভুক্ত’।[9] ‘আপনি কি দেখেননি হে পাঠক! ‘হেদায়া’ লেখকের দিকে? যিনি হানাফী বিদ্বানদের অন্যতম শিরোমণি! আপনি কি দেখেননি ‘ওয়াজীয’-এর ভাষ্যকার রাফেঈ-র দিকে? যিনি শাফেঈ বিদ্বানদের অন্যতম পুরোধা। এই দু’জন ঐসকল প্রধান ব্যক্তিত্বের অন্তর্ভুক্ত, যাঁদের দিকে আঙুলের ইশারা করা হয়। যাদের উপরে শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম ব্যক্তিগণ ভরসা করে থাকেন। তাঁরা তাঁদের কিতাব সমূহে এমন সব বিষয় উলেলখ করেছেন, হাদীছ শাস্ত্রবিদগণের নিকটে সেসবের কোন চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না’।[10]
(ঘ) অন্যতম উছূল হ’ল إن حديث الآحاد لا ةثبة عقيدة ‘আহাদ পর্যায়ের হাদীছ দ্বারা কোন আক্বীদা সাব্যস্ত হবে না’। একক রাবী কর্তৃক বর্ণিত হাদীছকে ‘খবরে ওয়াহেদ’ বলে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’তে বর্ণিত অধিকাংশ হাদীছই ‘আহাদ’ পর্যায়ভুক্ত এবং তার ভিত্তিতে মুসলিম উম্মাহর আক্বীদা ও আমল নির্ধারিত হয়েছে। যেমন হযরত ওমর (রাঃ) বর্ণিত বিখ্যাত হাদীছإِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ ‘নিশ্চয়ই সকল আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল’।[11] হাদীছটি ইসলামের মৌলিক বিধানের অন্তর্ভুক্ত। অথচ এটি এককভাবে কেবলমাত্র হযরত ওমর (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত খবরে ওয়াহেদ’ পর্যায়ভুক্ত হাদীছ। উক্ত বিষয়ে আরও উছূল রচনা করা হয়েছে, ‘যদি কোন খবরে ওয়াহেদ-এর সাথে এইসব উছূলের বিরোধ ঘটে, তাহ’লে উক্ত খবরে ওয়াহেদ প্রত্যাখ্যাত হবে’। ‘খবরে ওয়াহেদ-এর উপর ক্বিয়াস অগ্রগণ্য হবে’। ‘কুরআনের হুকুমের চাইতে হাদীছে বেশী কিছু থাকলে সেটা মানসূখ অর্থাৎ হুকুম রহিত হিসাবে গণ্য হবে এবং সুন্নাহ কখনো কুরআনকে মানসূখ করবে না’। ‘ছহীহ হাদীছের বিপরীতে মদীনাবাসীদের আমলকে অগ্রগণ্য করা’ ইত্যাদি।
উপরোক্ত উছূল বা আইনসূত্র সমূহ রচিত হওয়ার ফলে রাবী অর্থাৎ হাদীছ বর্ণনাকারী ছাহাবী (রাঃ)-এর উপরে পরোক্ষভাবে মিথ্যারোপ করা হয়। অন্ততঃপক্ষে তাঁকে বা তাঁর বর্ণিত হাদীছকে সন্দেহযুক্ত মনে করা হয়। অথচ ছাহাবায়ে কেরামের বিশ্বস্ততা সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) সত্যায়ন করেছেন। আল্লাহ পাক তাঁদের উপরে রাযী হয়েছেন। কিন্তু কেন যেন আমরা তাঁদের ব্যাপারে নিশ্চিত হ’তে পারলাম না।
আল্লাহ বলেন, إِنْ جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا ‘যখন তোমাদের নিকটে কোন ফাসেক ব্যক্তি কোন খবর নিয়ে আসে, তখন তা যাচাই কর’ (হজুরাত ৪৯/৬)। এক্ষণে প্রশ্ন দাঁড়ায় যে, রাসূল (ছাঃ)-এর নামে কোন হাদীছ যদি কোন ছাহাবী থেকে বর্ণিত হয়, তখন সেটা কি যাচায়ের প্রয়োজন আছে? যদি প্রয়োজন মনে করি তবে ছাহাবীদেরকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছি তা ভেবে দেখেছি কি? হ্যাঁ, ‘সনদ’ বা বর্ণনাসূত্রগুলি আমরা যাচাই করব। কেননা তাঁরা ছাহাবী নন। যদি সনদ ছহীহ হয়, তবে ছাহাবীর মাধ্যমে প্রাপ্ত রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছের উপরে নিঃসন্দেহে আমল করতে বাধা কোথায়? অথচ নিজেদের রচিত ‘উছূল’ ও তার আলোকে রচিত ফিক্বহী বিধান যা ভুল-শুদ্ধ ও পরস্পর বিরোধিতায় পূর্ণ, তার উপরে অন্ধের মত আমল করে যাচ্ছি।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন যে,لاَ تَسُبُّوا أَصْحَابِى، فَلَوْ أَنَّ أَحَدَكُمْ أَنْفَقَ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا مَا بَلَغَ مُدَّ أَحَدِهِمْ وَلاَ نَصِيفَهُ- ‘তোমরা আমার ছাহাবীদেরকে গালি দিয়ো না। যদি তোমাদের কেউ ওহোদ পাহাড়ের সমান স্বর্ণ ব্যয় করে, তবুও তাদের একজনের পরিমাণ বা তার অর্ধেক পরিমাণ পৌঁছতে পারবে না’।[12] অন্য হাদীছে এসেছে, لاَ تَتَّخِذُوهُمْ غَرَضًا بَعْدِى ‘তোমরা আমার পরে আমার ছাহাবীদেরকে শত্রুতার লক্ষ্যে পরিণত কর না’।[13] তিরমিযী হাদীছটিকে ‘হাসান’ ও ইবনে হিববান ‘ছহীহ’ বলেছেন।[14] তিনি বলেন,خَيْرُ أُمَّتِى قَرْنِى ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ- ‘আমার উম্মতের সেরা ব্যক্তিগণ হ’লেন আমার যুগের। অতঃপর তার পরবর্তীদের, অতঃপর তার পরবর্তীদের’।[15] তিনি বলেন,أُوصِيكُمْ بِأَصْحَابِى ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ‘তোমরা আমার ছাহাবীদের সম্মান কর। কেননা তারা তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। অতঃপর তাদের পরবর্তী (তাবেঈগণ)। অতঃপর তাদের পরবর্তী (তাবে তাবেঈগণ)’।[16] নিঃসন্দেহে মুসলিম উম্মাহর আলেম-জাহিল নির্বিশেষে ছাহাবায়ে কেরামকে উম্মতের মধ্যে সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদা দান করে থাকেন। কিন্তু উপরোক্ত উছূল রচনার মাধ্যমে তাঁদের মর্যাদাকে ও বিশ্বস্ততাকে নিঃসন্দেহে ক্ষুন্ন করা হয়েছে। রাসূল (ছাঃ)-এর নামে তাঁদের পক্ষে বানাওয়াট হাদীছ বর্ণনার কল্পনা করতেও গা শিউরে ওঠে। এমনকি একটি হরফ কমবেশী করারও কল্পনা করা যায় না। তাঁরা কেবল হাদীছের বর্ণনাকারী ছিলেন না বরং কুরআনেরও বর্ণনাকারী ছিলেন। কুরআন ও হাদীছ আল্লাহর অহি। এই দুই অহি-র পুংখানুপুংখ হেফাযত আল্লাহ ছাহাবায়ে কেরামের মাধ্যমেই করেছেন। তাঁদের স্মৃতিপটেই এগুলি প্রাথমিকভাবে রক্ষিত হয়েছিল। পরে লিখিতভাবে আমাদের নিকটে পৌঁছেছে। অতএব তাঁদের বর্ণিত হাদীছের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণের অর্থই হ’ল ইসলামী বিধানের সুউচ্চ ইমারতকে ধ্বসিয়ে দেওয়া। এই ধরণের সন্দেহবাদী অন্তর থেকে আমরা আল্লাহর নিকটে পানাহ চাই।
ফলাফল :
উপরোক্ত উছূল সমূহকে অগ্রগণ্য করার ফলে আমরা অসংখ্য ছহীহ হাদীছের বরকত ও তার অনুসরণের নেকী থেকে বঞ্চিত হয়েছি। বরং বলা যেতে পারে আমরা কবীরা গোনাহগার হয়েছি। কেননা আল্লাহর নির্দেশ ছিলوَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا ‘রাসূল তোমাদেরকে যা নির্দেশ দেন তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত হও’ (হাশর ৫৯/৭)। অথচ আমরা আমাদের রচিত উছূলের দোহাই দিয়ে হাদীছের অনুসরণ থেকে বিরত হয়েছি। রাসূল (ছাঃ)-এর কথার উপরে নিজেদের ‘রায়’-কে অগ্রাধিকার দিয়েছি। অতএব তাতে নেকী হওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা। বরং গোনাহের আশংকাই বেশী। নিম্নে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া গেল। যেখানে আমরা ঐসব উছূলের দোহাই দিয়ে হাদীছকে পরিত্যাগ করেছি। যেমন-
(১) ‘হালালকারী ব্যক্তি ও যার জন্য হালাল করা হয় সেই ব্যক্তি দু’জনকেই আল্লাহ পাক লা‘নত করেন’।[17] এই ছহীহ হাদীছকে অগ্রাহ্য করার ফলে আজ সর্বত্র ধর্মের নামে ‘হালালা’ বা ‘হীলা’ করে ‘বিদ‘আতী তালাক্ব’(طلاق بدعى)-এর অসহায় শিকার নিরীহ মহিলাদেরকে ব্যভিচারে বাধ্য করা হচ্ছে। অথচ তিন মাসে তিন তালাক্ববই হ’ল কুরআনী বিধানের (বাক্বারাহ ২/২২৮-২৩০) অনুকূলে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অসংখ্য ছহীহ হাদীছে-এর প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু নিজেদের স্বীকৃত ‘বিদ‘আতী তালাক্বব’ অর্থাৎ এক মজলিসে তিন তালাক্ববকে ‘তিন তালাক্ব বায়েন’ হিসাবে গণ্য করার মর্মান্তিক পরিণামে পুনর্মিলনেচ্ছু স্বামী-স্ত্রীকে ‘হালালা’ নামক নোংরা পন্থা গ্রহণে বাধ্য করা হয় ধর্মীয় বিধানের নামে। অথচ এটা কখনোই বিধান নয়।
(২) ‘অলী ব্যতীত বিবাহ নেই’ ‘যে মহিলা তার অলি বা অভিভাবক ব্যতীত বিবাহ করবে, তার বিবাহ বাতিল, বাতিল, বাতিল’।[18] এই হাদীছকে অগ্রাহ্য করার ফলে মেয়েরা এখন ইচ্ছামত ‘কোর্ট ম্যারেজ’ করছে ও ছয় মাস-এক বছর যেতে না যেতেই তালাক্ব অথবা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
(৩) ‘সকল মাদকদ্রব্য হারমা’।[19] এই হাদীছকে বিভিন্ন অজুহাতে এড়িয়ে যাওয়ার ফলে আজ মুসলমানের ঘরে তামাক, জর্দা ঢুকেছে ও সেই ফাঁকে বিড়ি-সিগারেট, হিরোইন, ফেনসিডিল ঢুকে দেশকে সর্বনাশা ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
(৪) ‘ঐ ব্যক্তির ছালাত পূর্ণাংগ হবে না, যে ব্যক্তি রুকু ও সিজদাতে তার শিরদাড়া সোজা না করবে’। এই হাদীছকে এড়িয়ে যাওয়ায় এখন আমাদের ছালাতগুলি অতি দ্রুতভাবে শেষ হচ্ছে এবং ধীর-স্থির ইবাদতের বদলে মাত্র কয়েক মিনিটের আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। ফলে আমাদের ছালাত আমাদেরকে আল্লাহ ভীতিতে উদ্বুদ্ধ করতে পারছে না। আমাদের হৃদয়গুলি আল্লাহর ভয়ে ভীত হচ্ছে না। বরং ইহূদী-নাছারাদের মত দিন দিন পাথরের মত শক্ত হয়ে যাচ্ছে (বাক্বারাহ ২/২৭৪)।
(৫) ‘রুকুতে যাওয়া ও রুকু হ’তে ওঠার সময় রাফ‘উল ইয়াদায়েন বা দুই হস্ত উত্তোলন করা’।
অন্যূন ৫০ জন ছাহাবী কর্তৃক বর্ণিত এই মর্মের ছহীহ হাদীছগুলিকে এড়িয়ে যাওয়ার কারণে আল্লাহর সম্মুখে হস্ত উত্তোলন পূর্বক আত্মসমর্পন করার নেকী ও ছওয়াব থেকে আমরা প্রতিনিয়ত মাহরূম হচ্ছি।
ইবনু হযম আন্দালুসী (৩৮৪-৪৫৬ হি.) বলেন, এমনি ধরণের উদাহরণের সংখ্যা হাযার হাযার হবে, যেখানে বিভিন্ন অজুহাতে রাসূল (ছাঃ)-এর আদেশ ও নিষেধাবলীকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে’।[20]
২. ‘তাক্বলীদ’ :
‘তাক্বলীদ’ সম্পর্কে আমরা দরসে কুরআন-এর মধ্যে আলোচনা করেছি। ৪র্থ শতাব্দী হিজরীতে এসে তাক্বলীদের আবির্ভাব ঘটে এবং মুসলিম উম্মাহকে হাদীছের অনুসরণের বদলে ব্যক্তির অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করে। অথচ ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) সহ সকল ইমামের বক্তব্য ছিল একটাইإِذَا صَحَّ الْحَدِيْثُ فَهُوَ مَذْهَبُنَا ‘যখন ছহীহ হাদীছ পাবে, জেনো সেটাই আমাদের মাযহাব’।[21] ফলে সর্বত্র মাযহাবী গোঁড়ামী প্রকট আকার ধারণ করে ও পরিশেষে রাজনৈতিক বিপর্যয় ও সামাজিক অশান্তি ও অধঃপতন হয়। যা এখনও চলছে। বলা আবশ্যক যে, চার ইমামের অধিকাংশ পরস্পরের ছাত্র হ’লেও তাঁরা যেমন কেউ কারু মুক্বাল্লিদ ছিলেন না। তেমনি তাঁদের শিষ্যরা স্ব স্ব ওস্তাদের দিকে সম্পর্কিত হ’লেও তাঁরা তাঁদের মুক্বাল্লিদ ছিলেন না। বরং তাঁরা স্ব স্ব ওস্তাদের শিক্ষা অনুযায়ী সাধ্যপক্ষে হাদীছ থেকে মাসআলা সংগ্রহের চেষ্টা করেছেন। এর জন্য স্বীয় ওস্তাদের ফৎওয়ার বিরোধিতা করতেও তাঁরা দ্বিধা করেননি। যদিও পরবর্তী যুগের ফক্বীহ নামধারী মুক্বাল্লিদ বিদ্বানগণ তাদের পূর্বসুরী বিদ্বানদের রীতি এবং ইমামদের মহান শিক্ষা লংঘন করে তাক্বলীদকেই নির্বিঘ্ন চলার পথ হিসাবে বেছে নিয়েছেন। ফলে কুরআন-হাদীছ গবেষণার দুয়ার বন্ধ হয়ে গেছে। নবোদ্ভূত সমস্যাবলীর যুগোপযোগী সমাধান পেতে ব্যর্থ হয়ে আধুনিক যুগমানস ক্রমেই ইসলাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। মুসলিম উম্মাহ এখন আর কেবল বিগত কোন মুজতাহিদের নির্দিষ্ট উছূলের তাক্বলীদ করেই ক্ষান্ত নয়, বরং তারা এখন সরাসরি ইসলাম বিরোধী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় দর্শন ও মতবাদ সমূহের অন্ধ তাক্বলীগ করছে। ফলে একজন মুসলমান ধর্মীয় মতবাদে হানাফী ও চিশতী, রাজনীতিতে গণতন্ত্রী ও অর্থনীতিতে পুঁজিবাদী বা সমাজতন্ত্রী ইত্যাদি হয়ে পড়েছে। অথচ ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈনে এযাম ও আয়েম্মায়ে দ্বীন সকলেরই শিক্ষা ছিল একটাই- সকল বিষয়ে সকল অবস্থায় ব্যক্তি তাক্বলীদ ছেড়ে দিয়ে কুরআন ও সুন্নাহর দিকে ফিরে যাও এবং সরাসরি সেখান থেকেই সমাধান গ্রহণ কর।
এক্ষণে দেশে ইসলামী হুকুমত কায়েম করতে হ’লে সর্বাগ্রে প্রয়োজন কুরআন ও সুন্নাহকে উপরোক্ত শৃংখল সমূহ হ’তে মুক্ত করা। আক্বীদা ও আহকাম সকল বিষয়ে ছহীহ সুন্নাহকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসাবে গ্রহণ করা। নিজেদের রচিত উছূল ও তাক্বলীদের পর্দা হটিয়ে দিয়ে আল্লাহ প্রেরিত অহি-র আলো থেকে সরাসরি আলো গ্রহণ করা। এজন্য সমাজ চেতনাকে মাযহাব ও তরীকার বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে নিরপেক্ষভাবে কুরআন-হাদীছপন্থী করে গড়ে তুলতে হবে। সামাজিক রসম-রেওয়াজ ও সরকারী বাধাকে উপেক্ষা করে সমাজ বিপ্লব সৃষ্টি করার আপোষহীন জিহাদে অবতীর্ণ হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে ময়দানে নামতে হবে। আলেম ও বিদ্বান সমাজকে জাতীয় ও বিজাতীয় সকল প্রকারের তাক্বলীদ ও অন্ধ গোঁড়ামী থেকে মুক্ত হয়ে অহি-র বিধানকে সার্বিক জীবনে কায়েম করার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করতে হবে। জামা‘আতবদ্ধ প্রচেষ্টা চালিয়ে সমাজের মোড় ফিরিয়ে দিতে হবে। নিজেকে ও নিজ সমাজকে আল্লাহর রহমত লাভের যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন!
[1]. আবুদাঊদ হা/৪৬০৪; আহমাদ হা/১৭২১৩; মিশকাত হা/১৬৩ ‘কিতাব ও সুন্নাহকে আকড়ে ধরা’ অধ্যায়।
[2]. মুওয়াত্ত্বা হা/৩৩৩৮; হাকেম হা/৩১৯; মিশকাত হা/১৮৬; ছহীহুল জামে‘ হা/২৯৩৭।
[3]. বুখারী হা/৭৯৩; মুসলিম হা/৩৯৭; মিশকাত হা/৭৯০ ‘ছালাতের বিবরণ’ অনুচ্ছেদ।
[4]. বুখারী হা/৫০; মুসলিম হা/৮; মিশকাত হা/২।
[5]. বুখারী হা/৭৫৬; মুসলিম হা/৩৯৪; মিশকাত হা/৮২২।
[6]. হাফেয আহমাদ ওরফে মোল্লাজিওন (মৃ. ১১৩০ হি./১৭১৭ খৃ.) নূরুল আনওয়ার (ক্বামারুল আক্বামার সহ) (করাচী ছাপা, তাবি), ‘সুন্নাহর প্রকারভেদ’ অধ্যায় ‘রাবীদের অবস্থা বর্ণনা’ অনুচ্ছেদ ১৮২ পৃ.।
[7]. ঐ, হজ্জাতুল্লাহি’ল বালিগাহ (কায়রো : দারুত তুরাছ ১৩৫৫ হি./১৯৩৬ খৃ.) ‘চতুর্থ শতাব্দী হিজরীর পূর্বেকার লোকদের অবস্থা’ অধ্যায় ১/১৬০।
[8]. মোল্লা মুঈন সিন্ধী হানাফী, দিরাসাতুল লাবীব (লাহোর : ১২৮৪ হি./১৮৬৮ খৃ.) ১৮৩ পৃ.।
[9]. জামে ছাগীর-এর ভূমিকা ‘নাফে কাবীর’ (মুছতাফায়ী প্রেস, লাক্ষ্ণৌ ১২৯১ হি.) ১৩ পৃ.।
[10]. ইউসুফ জয়পুরী, হাক্বীক্বাতুল ফিক্বহ, সংশোধনে : দাঊদ রায (বোম্বাই : ইদারা দাওয়াতুল ইসলাম, তাবি) ১৫১ পৃ.।
[11]. বুখারী হা/১; মুসলিম হা/১৯০৭; মিশকাত হা/১।
[12]. বুখারী হা/৩৬৭৩; মুসলিম হা/২৫৪০; মিশকাত হা/৫৯৯৮ ‘মানাক্বিব’ অধ্যায়।
[13]. তিরমিযী হা/৩৮৬২; মিশকাত হা/৬০০৫; যঈফাহ হা/২৯০১।
[14]. ইমাম বাগাভী, শারহুস সুন্নাহ ১৪/৭০-৭১ টীকা দ্রষ্টব্য।
[15]. বুখারী হা/৩৬৫০; মুসলিম হা/২৫৩৫; মিশকাত হা/৬০০১।
[16]. তিরমিযী হা/২১৬৫; আহমাদ হা/১৭৭; হাকেম হা/৩৮৭; মিশকাত হা/৬০০৩।
[17]. দারেমী হা/২২৫৮; মিশকাত হা/৩২৯৬; ইরওয়া হা/১৮৯৭।
[18]. আবুদাঊদ হা/২০৮৫, ২০৮৩; আহমাদ হা/১৯৭৬১, ২৪৪১৭; তিরমিযী হা/১১০১, ১১০২; ইবনু মাজাহ হা/১৮৮১, ১৮৭৯; দারেমী হা/২১৮৩, ২১৮৪; মিশকাত হা/৩১৩০, ৩১৩১।
[19]. মুসলিম হা/২০০৩, ২০০২; মিশকাত হা/৩৬৩৮, ৩৬৩৯ ‘হুদূদ’ অধ্যায়।
[20]. আলবানী, আল-হাদীছ হজ্জিয়াতুন ৫০ পৃ.।
[21]. ইবনু আবেদীন, শামী হাশিয়া রাদ্দুল মুহতার (বৈরূত : দারুল ফিক্র ১৩৯৯/১৯৭৯) ১/৬৭ পৃ.; আব্দুল ওয়াহহাব শা‘রানী, মীযানুল কুবরা (দিল্লী : ১২৮৬ হি.) ১/৩০ পৃ.।