[ইসলাম দাওয়াত ও তাবলীগের মাধ্যমে প্রসার লাভ করেছে। বিধায় দ্বীন কায়েমে দাওয়াতের গুরুত্ব অপরিসীম। আলেম-ওলামা নবীগণের উত্তরাধিকারী হিসাবে প্রত্যেকেই দ্বীনের একজন দাঈ বা আহবানকারী। কিন্তু সকল দাঈর দাওয়াত কার্যকর হয় না বা সকল দাঈ তার দাওয়াতের ক্ষেত্রে সফলতা লাভ করে না। এর কারণ দাওয়াতের ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে যেগুলো অনুসরণ না করা। এই গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি শায়খ ফাহদ বিন সুলাইমান বিন আব্দুল্লাহ আত-তুয়াজরী লিখিত نجاح الداعية শীর্ষক প্রবন্ধে সুন্দরভাবে বিধৃত হয়েছে। ভারতের জামে‘আ সালাফিয়া, বেনারস থেকে প্রকাশিত আরবী পত্রিকা صوة الأمة (জুন ২০০৭, সংখ্যা ৬, খন্ড ৩৯) থেকে উক্ত প্রবন্ধটি বঙ্গানুবাদ করে ‘দাঈর সফলতা লাভের উপায়’ শিরোনামে পত্রস্থ করা হ’ল। -অনুবাদক]
আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়া এক মহান ইবাদত, যার মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর সৌভাগ্যবান বান্দাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। আল্লাহর দিকে দাওয়াতের মর্যাদা ও সম্মান সম্পর্কে কুরআন-হাদীছের জ্ঞানসম্পন্ন সকলেই অবগত। কুরআন ও হাদীছে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দানের প্রতি উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দান করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, أُدْعُ إِلَى سَبِيْلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِيْ هِيَ أَحْسَنُ - ‘তোমার পালনকর্তার পথের দিকে আহবান কর হিকমত সহকারে ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে এবং তাদের সাথে বিতর্ক কর পসন্দযুক্ত পন্থায়’ (নাহল ১৬/১২৫)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, بَلِّغُوْا عَنِّىْ وَلَوْ آيَةً ‘একটি আয়াত হ’লেও আমার পক্ষ থেকে পৌঁছে দাও’ (বুখারী; মিশকাত হা/১৯৮)। আল্লাহর দিকে আহবানকারী (দাঈ)-র দাওয়াতের সফলতার জন্য কিছু নির্দিষ্ট উপায় বা মাধ্যম রয়েছে। সুতরাং এ সফলতা দাঈর প্রসিদ্ধি বা খ্যাতি, তার অনুসারীর আধিক্য, মানুষের নিকটে তার কথার গ্রহণযোগ্যতা, তার লেখনির আধিক্য, শ্রুতিমধুর কথা, ভাষার লালিত্যের কারণে হয় না। এখানে আল্লাহর দিকে আহবানকারীর সফলতার কতিপয় মাধ্যম আমরা উপস্থাপন করব ইনশাআল্লাহ।-
প্রথমতঃ ইখলাছ
এটা একটি স্বতঃসিদ্ধ বিষয়। কেননা এক্ষেত্রে দাঈর কোন ক্ষমতা ও সামর্থ্য নেই, তার লেখনি বা গ্রন্থ যতই প্রচার-প্রসার লাভ করুক এবং তার বক্তব্যের ক্যাসেট সমূহ যতই অধিক হোক না কেন এবং নিকট ও দূরের লোকেরা তাকে চিনুক না কেন ইখলাছ বা একনিষ্ঠতা ব্যতীত তার কোন সফলতা-কৃতকার্যতা নেই। আর ইখলাছ হচ্ছে কোন কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত হওয়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قُلْ إِنِّيْ أُمِرْتُ أَنْ أَعْبُدَ اللَّهَ مُخْلِصاً لَّهُ الدِّيْنَ ‘বলুন, আমি নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর ইবাদত করতে আদিষ্ট হয়েছি’ (যুমার ৩৯/১১)। বড় দাঈ নূহ (আঃ) সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, وَيَا قَوْمِ لاَ أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ مَالاً إِنْ أَجْرِيَ إِلاَّ عَلَى اللّهِ ‘আর হে আমার জাতি! আমি তো এজন্য তোমাদের কাছে কোন অর্থ চাই না; আমার পারিশ্রমিক তো আল্লাহর নিকট রয়েছে’ (হূদ ১১/২৯)।
সুতরাং দাঈকে হুঁশিয়ার হ’তে হবে যে, তার দাওয়াতের মাধ্যমে অর্থোপার্জন বা সম্পদ লাভ, খ্যাতি বা প্রসিদ্ধি অর্জন অথবা কোন কাজে অগ্রগণ্য হওয়া তার উদ্দেশ্য হবে না। কিন্তু দাওয়াতী কার্যক্রমের মাধ্যমে উপরোক্ত পার্থিব বিষয়গুলি অর্জন মূল উদ্দেশ্য না হয়েও যদি আপনা আপনি ঐসবের কিছু অর্জিত হয় তাতে কোন সমস্যা নেই।
দ্বিতীয়তঃ কথা ও দাওয়াতের মাঝে সমন্বয় সাধন
দাঈর সফলতার প্রধান মাধ্যম হচ্ছে (কথা-কর্মে) সমন্বয় সাধন। দাঈ যদি মানুষকে শিক্ষা দেয় যে, ছাদাক্বা করা মুস্তাহাব, ছালাত আদায় করা ওয়াজিব, পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করা গুরুত্বপূর্ণ কাজ, মুসলিম জামা‘আত অাঁকড়ে ধরে থাকা প্রত্যেক মুসলিমের উপর আবশ্যিক কর্তব্য, কিন্তু বাস্তবে সে এসবের বিরোধিতা করে, তাহ’লে তা হবে তার জন্য ব্যর্থ, অকার্যকর। শু‘আইব (আঃ) সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করা উচিত। তিনি একটি পদ্ধতি চালু করেন, একটি তরীকা বর্ণনা করেন, যা তিনি তাঁর কওম ও উম্মতদেরকে এবং যারা এ আয়াত পাঠ করবে তাদেরকে বলেছেন,
وَمَا أُرِيْدُ أَنْ أُخَالِفَكُمْ إِلَى مَا أَنْهَاكُمْ عَنْهُ إِنْ أُرِيْدُ إِلاَّ الْإِصْلاَحَ مَا اسْتَطَعْتُ وَمَا تَوْفِيْقِيْ إِلاَّ بِاللّهِ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَإِلَيْهِ أُنِيْبُ،
‘আর আমি চাই না যে, তোমাদেরকে যে কাজ করতে নিষেধ করি সে কাজে পরে নিজেই লিপ্ত হব। আমি তো যথাসাধ্য সংশোধন করতে চাই। আল্লাহর মদদ দ্বারাই কিন্তু কাজ হয়ে থাকে। আমি তাঁর উপরই নির্ভর করি এবং তাঁরই প্রতি ফিরে যাই’ (হূদ ১১/৮৮)।
আল-কাসিম ইবনু মুহাম্মাদ বলেন, أدركت الناس وما يعجبهم القول إنما يعجبهم العمل ‘আমি এমন কিছু মানুষকে এ অবস্থায় পেয়েছি যে, বক্তব্য তাদেরকে আকর্ষণ করেনি, নিশ্চয়ই আমল বা কর্মই তাদেরকে আকর্ষণ করেছে’। কোন কোন সালাফে ছালেহীন বলেন, من عمل بما علم أورثه الله علم مالم يعلم. ‘যে ব্যক্তি তার ইলম অনুযায়ী আমল করবে, আল্লাহ তাকে এমন ইলমের অধিকারী করবেন যা সে জানত না’।
তৃতীয়তঃ আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা
বর্তমান সময়ে অনেক দাঈর ভুল পদ্ধতি হচ্ছে, বাহ্যিক সফলতার উপর সর্বতোভাবে নির্ভর করা। সুতরাং দাঈ গ্রন্থ ও পুস্তিকা প্রকাশ এবং দারস দান ও বক্তব্য উপস্থাপনে সচেষ্ট হয়। আর ভুলে যায় এবং ভুলে যাওয়ার ভান করে আল্লাহর নিকট আশ্রয় গ্রহণ করতে এবং দাওয়াতের তাওফীক কামনা করতে। যেহেতু সে বাহ্যিক কর্মপরিকল্পনার উপর নির্ভর করে, তাই দাওয়াত দানের ক্ষেত্রে তাওফীক্ব কামনা করে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করতে শয়তান তাকে ভুলিয়ে দেয়।
দাঈর জন্য আবশ্যক হ’ল আল্লাহর দিকে দাওয়াতের ক্ষেত্রে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর নির্দেশনা সম্বন্ধে চিন্তা-গবেষণা করা। দাওয়াত, শিক্ষাদান, শিক্ষার্জন, জিহাদের ক্ষেত্রে আল্লাহর তাওফীক্ব কামনার মাধ্যমে তাঁর নিকট আশ্রয় গ্রহণই ছিল রাসূলের নিকট প্রথম ও শেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর তিনি দো‘আ করতেন,
يَاحَىُّ يَاقَيُّوْمُ بِرَحْمَتِكَ أَسْتَغِيْثُ فَأَصْلِحْ لِىْ شَأْنِىْ كُلَّهَ وَلاَتَكِلْنِىْ إلِىَ نَفْسِىْ طَرْفَةَ عَيْنٍ،
‘হে চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী! তোমার রহমতে তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। সুতরাং তুমি আমার সকল কর্মকান্ডকে সংশোধন করে দাও এবং তুমি আমার চোখের পলককেও আমার দিকে সোপর্দ করে দিও না’।
চতুর্থতঃ শারঈ জ্ঞানে পারদর্শী হওয়া
এটা এমন একটি বিষয় যে সম্পর্কে সাম্প্রতিককালের অনেক ইসলামী দলই উদাসীন। বর্তমানে অনেক দল যারা (দাওয়াতের) এক্ষেত্রে প্রবেশ করে তারা গুরুত্বপূর্ণ এ মাধ্যম বা হাতিয়ারকে ভুলে যায় ও ভুলে যাওয়ার ভান করে বা অবজ্ঞা, অবহেলা করে। অথচ ইলম তথা জ্ঞানই হচ্ছে শক্তিশালী ও কার্যকর মাধ্যম। বর্তমানে অনেক দল আছে, যারা দাওয়াতের ময়দানে বিকাশমান এবং যারা দাওয়াতের সাথে সম্পৃক্ততার দাবীদার, তারা আল্লাহর দিকে দাওয়াতের আকৃতি-প্রকৃতি বিকৃত করে দিয়েছে। তারা একে বিকৃত করেছে, কেননা তারা দাওয়াত দিতে শুরু করেছে জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা, দূরদৃষ্টি, ভিত্তিমূল ও শক্তিশালী উৎস ব্যতিরেকে। ফলে নিজেরা গোমরাহ ও বিভ্রান্ত হয়েছে এবং অপরকেও পথভ্রষ্ট করেছে।
একারণেই মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে তাঁর প্রভু বলেন,
مَا كُنْتَ تَدْرِيْ مَا الْكِتَابُ وَلاَ الْإِيْمَانُ وَلَكِنْ جَعَلْنَاهُ نُوْراً نَّهْدِي بِهِ مَنْ نَّشَاءُ مِنْ عِبَادِنَا وَإِنَّكَ لَتَهْدِيْ إِلَى صِرَاطٍ مُّسْتَقِيْمٍ-
‘আপনি জানতেন না, কিতাব কি এবং ঈমান কি? কিন্তু আমি একে করেছি নূর, যদ্বারা আমি আমার বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা পথ প্রদর্শন করি। নিশ্চয়ই আপনি সরল পথ প্রদর্শন করেন’ (শূরা ৪২/৫২)।
পঞ্চমতঃ বিদ‘আত, পাপাচার ও গোমরাহীর মজলিস পরিহার করা
যখন দাঈ ইচ্ছা পোষণ করবে দাওয়াতের কাজে সম্পৃক্ত হয়ে কথা ও কর্মে কৃতকার্য হ’তে, তখন তাকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য মন্ডিত ও প্রকাশ্য হ’তে হবে এবং তাকে সুস্পষ্ট হ’তে হবে যে, সে কাদের বৈঠকে বা মজলিসে বসবে। দাঈর জন্য আবশ্যক হ’ল বিদ‘আত, পাপাচার ও গোমরাহীর বৈঠক সর্বতোভাবে পরিহার করা। সুতরাং সে বিদ‘আতপন্থীদের সাথে একই স্থানে, একই বিশ্রামাগারে, একই সমাবেশস্থলে, একই কনফারেন্সে কিংবা একই সভা-সেমিনারে সমবেত হবে না। কিন্তু যখন (বিদ‘আত সংক্রান্ত) বিতর্কে তাদের বিরুদ্ধে দলীল প্রমাণ উপস্থাপন উদ্দেশ্য হবে, তখন তাদের সাথে একত্রে বসতে অসুবিধা নেই। আর যখন তাদের সাথে ঐকমত্য পোষণ করে বৈঠকে বসবে এমনকি যদি বলে, আমি তাদের সাথে বাহ্যিকভাবে ঐকমত্য পোষণ করব, তাহ’লে এরূপ বৈঠকে বসা সমীচীন হবে না।
আল্লাহর পথের শ্রেষ্ঠ দাঈ নবী-রাসূলগণের প্রতি গভীরভাবে লক্ষ্য করুন। তাঁরা তাঁদের কওমকে পরিত্যাগ করেছেন। ফলে তাদের জন্য কৃতকার্যতা, সফলতা ও সৌভাগ্যের তরীকা-পদ্ধতি অবারিত হয়ে গেছে। অতএব এক্ষেত্রে ইবরাহীম (আঃ) এক অনুপম দৃষ্টান্ত। যেমন আল্লাহ বলেন,
فَلَمَّا اعْتَزَلَهُمْ وَمَا يَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللَّهِ وَهَبْنَا لَهُ إِسْحَاقَ وَيَعْقُوْبَ وَكُلًّا جَعَلْنَا نَبِيًّا-
‘অতঃপর তিনি যখন তাদেরকে এবং তারা আল্লাহ ব্যতীত যাদের ইবাদত করত, তাদের সবাইকে পরিত্যাগ করলেন, তখন আমি তাকে দান করলাম ইসহাক্ব ও ইয়াকূবকে এবং প্রত্যেককে নবী করলাম’ (মারইয়াম ১৯/৪৯)।
আল্লাহ আরো বলেন, فَلاَ تَقْعُدُوْا مَعَهُمْ حَتَّى يَخُوْضُوْا فِيْ حَدِيْثٍ غَيْرِهِ ‘তখন তোমরা তাদের সাথে বসবে না, যতক্ষণ না তারা প্রসঙ্গান্তরে চলে যায়’ (নিসা ৪/১৪০)। এখানে আল্লাহ বিরোধীদের সাথে বসতে নিষেধ করেছেন। অতঃপর তিনি বলেন, إِنَّكُمْ إِذاً مِّثْلُهُمْ ‘অন্যথা তোমরাও তাদের মত হয়ে যাবে’ (নিসা ৪/১৪০)।
দাওয়াতের প্রতি আগ্রহী এমন অনেক লোক আছে যারা দাঈদের পাপাচারী ও পথভ্রষ্ট লোকদের মজলিসে বসায় এবং তারা যা বলে তার সাথে সাদৃশ্য করার চেষ্টা করে। তাদের সাথে ও পার্শ্বে উপবেশন করে, যদিও গোপনে তাদের বিরোধিতা করে।
ষষ্ঠতঃ সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দ্বারা সূচনা করা
দাঈ তার দাওয়াতের ক্ষেত্রে একটি পরিকল্পনা করবে বা একটি পদ্ধতি চালু করবে। হোক সেটা দরসের ক্ষেত্রে, বক্তব্যের ক্ষেত্রে অথবা লিখিত গ্রন্থের ক্ষেত্রে। তার এ পদ্ধতি হ’তে হবে সুস্পষ্ট ও সুদৃঢ় এবং তার অনুসৃত তরীকাও হ’তে হবে প্রকাশ্য। অতঃপর সে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কোনটার প্রতি গুরুত্বারোপ করবে। যদি সে লেখক, প্রভাষক, বক্তা বা শিক্ষক হয় তাহ’লে সে প্রথমে শিরক থেকে সতর্ক করবে এবং তাওহীদ তথা একত্ববাদের দিকে দাওয়াত দিবে। সুতরাং সে এমন বিষয় দ্বারা আরম্ভ করবে, যা তাওহীদকে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করবে।
দাঈ নবীগণের দাওয়াতের বিষয়ে চিন্তা করলে দেখতে পাবে যে, তাঁরা তাঁদের সময় ও জীবনকালকে দাওয়াতের মাধ্যমে মানুষের অন্তর সংশোধনের কাজে ব্যয় করেছেন। যেমন মুহাম্মাদ (ছাঃ) বলেন,
أَلاَ وَإِنَّ فِى الْجَسَدِ مُضْغَةً إِذَا صَلُحَتْ صَلُحَ الْجَسَدُ كُلَُّهُ وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الْجَسَدُ كُلُّهُ أَلاَ وَهِىَ الْقَلْبُ،
‘সাবধান! নিশ্চয়ই শরীরের মাঝে একটা গোশতপিন্ড আছে। সেটা যদি পরিশুদ্ধ হয়, তাহ’লে সমস্ত শরীর পরিশুদ্ধ হয়। আর সেটা যখন বিপর্যস্ত হয়, তখন সমস্ত শরীর বিশৃংখল-বিপর্যস্ত হয়। আর সেটা হ’ল কলব বা অন্তর’ (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/২৭৬২ ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়)।
দাঈর উচিত আমাদের নিকটবর্তী সময়ের মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাব (রহঃ)-এর দাওয়াত সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করা। তিনি তাঁর দাওয়াতের ময়দানে কৃতকার্য হয়েছিলেন বিত্ত-বৈভব, অনুপম বাচনভঙ্গি বা সম্ভ্রান্ত বংশ মর্যাদা কিংবা তাঁর সহযোগী ও সাহায্যকারীদের কারণে নয়। তিনি সফলতা লাভ করেছিলেন এজন্য যে, তিনি একটি পরিকল্পনা তৈরী করেছিলেন, একটি তরীকা বের করেছিলেন। আর তিনি অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে শুরু করেছিলেন। সেটা হ’ল আল্লাহর একত্ববাদ। ফলে তিনি ثلاثة الاصول ‘তিনটি মূলনীতি’ নামে একটি মূল্যবান গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। যে গ্রন্থটি বিভিন্ন যুগ ও এলাকার লোকজন ব্যাপকভাবে পড়তে শুরু করে।
সপ্তমতঃ নিকটাত্মীয়দের থেকে শুরু করা
সফল দাঈ হচ্ছেন তিনি, যিনি তার নিকটাত্মীয়দের থেকে তথা পরিবার থেকে দাওয়াত শুরু করেন। অতঃপর পিতা-মাতা, প্রতিবেশী প্রমুখকে দাওয়াত দেন। সফল দাঈ প্রথমতঃ নিজ পরিবারের সদস্যদের ভুল-ত্রুটি সংশোধনের চেষ্টা করেন। অতঃপর পর্যায়ক্রমে প্রতিবেশীদের দিকে, মসজিদের জামা‘আতের দিকে এবং যারা তাদের সাথে বসেন তাদের দিকে মনোনিবেশ করেন।
ঐসকল লোকদের সম্পর্কে চিন্তা করুন, যারা মসজিদে ইমামতি করেন। তিনি মহল্লার মসজিদকে পরবর্তীতে একটি ইসলামিক কেন্দ্রে পরিণত করে ফেলেন। তিনি প্রতিবেশীদেরকে দাওয়াত দেয়া শুরু করেন, তাদের সাথে বসেন এবং তাদের প্রতি ইহসান করেন, যদিও কখনো তিনি তার শহর থেকে না বের হন। এর মাধ্যমে তিনি এ আয়াতের প্রতি আমল করেন। আল্লাহ বলেন, وَأَنْذِرْ عَشِيْرَتَكَ الْأَقْرَبِيْنَ- ‘তুমি তোমার নিকটাত্মীয়দের সতর্ক কর’ (শু‘আরা ২৬/২১৪)। এ আয়াত নাযিলের পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আববাস ইবনু আব্দুল মুত্তালিব ও ফাতিমা বিনতু মুহাম্মাদ (রাঃ)-কে ডাকতে লাগলেন এবং তাঁর চাচাদেরকেও সতর্ক করতে লাগলেন। এটাই হচ্ছে সঠিক পদ্ধতি, যার উপর চলা দাঈর জন্য আবশ্যক। এটা একটা সুস্পষ্ট বিষয়।
অষ্টমতঃ আল্লাহর দিকে দাওয়াতে অধিকাংশ সময় ব্যয় করা
নিশ্চয়ই দাঈ যখন জানবে যে, দাওয়াত দেওয়া একটি সম্মানিত, মর্যাদাপূর্ণ দায়িত্ব, একটি গৌরবময় ইবাদত এবং তাকে তার কর্মের ভিত্তিমূল ও মূল দায়িত্বে পরিণত করবে এবং তাকে নিজের উপর আবশ্যকীয় কাজ হিসাবে ফরয করে নিবে, তখন সে মানুষকে দাওয়াত দেওয়ার শক্তি-সামর্থ্য তথা তাওফীক্ব পাবে। তখন সে এ কাজকে অবসর সময় বা উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় ফেলে রাখবে না। কেননা অবসর ও উপযুক্ত সময়ে দাওয়াত দানের অপেক্ষায় থাকলে অবসর ও সুযোগের পরে তা বর্জন করবে। উদাহরণ স্বরূপ সে রামাযান মাসেই কেবল দাওয়াত দিবে, বক্তব্য দিবে ও দাওয়াত দানের চেষ্টা করবে, যখন রামাযান চলে যাবে, দাওয়াত দান পরিহার করবে। হয়তো তার এই বর্জন ও অবকাশ পরবর্তী রামাযান পর্যন্ত প্রলম্বিত হবে। এমনকি পরবর্তী বছরে রামাযান আসা পর্যন্ত সে অক্ষম ও অলস হয়ে বসে থাকবে। কিন্তু আমরা যদি দাওয়াতকে আমাদের দিবা-রাত্রি বা দৈনন্দিন আবশ্যকীয় কাজের অন্তর্ভুক্ত করে নেই তাহ’লে ঐ কাজ করতে আমরা সমর্থ হব। এখানে দাওয়াত বলতে শুধু ভাষণ ও বক্তৃতা প্রদানকে বুঝাতে চাইনি; বরং দাওয়াতের সাথে পারস্পরিক সাক্ষাৎ, হাদিয়া, উপঢৌকন বিনিময় প্রভৃতিও অন্তর্ভুক্ত। যেমন আল্লাহ বলেন,
قُلْ هَـذِهِ سَبِيْلِيْ أَدْعُوْ إِلَى اللّهِ عَلَى بَصِيْرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِيْ ু
‘বলুন, এটাই আমার পথ, আমি এবং আমার অনুসারীগণ ডাকি আল্লাহর দিকে জাগ্রত জ্ঞান সহকারে’ (ইউসুফ ১২/১০৮)।
নবমতঃ একটি নির্দিষ্ট এলাকা বা স্তরের জন্য দাওয়াতকে সীমাবদ্ধ না করা
এর অর্থ হচ্ছে দাঈ সবাইকে দাওয়াত দিবে। সে হয়তো এমন মহল্লায় বসবাস করে, যার আশপাশে আছে অনারব প্রতিবেশী বা মূর্খ, নিরক্ষর সাধারণ লোক কিংবা স্বল্প শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, শিক্ষিত, ছোট-বড়, পুরুষ ও মহিলা। সুতরাং কেবল যুবকদের জন্য কিংবা নারীদের জন্য অথবা শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ, আমীর-ওমারার জন্য দাওয়াতকে নির্দিষ্ট করা ভুল। কেননা এটা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নির্দেশিত পন্থা নয়। সুতরাং দাওয়াত সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের জন্য অবারিত হ’তে হবে। আর এক্ষেত্রে মূলভিত্তি হ’ল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাদীছ,
لَأَنْ يَّهْدِىَ اللهُ بِكَ رَجُلاً وَاحِدًا خَيْرٌ لَكَ مِنْ حُمُرِ النَّعَمِ
‘যদি তোমার (দাওয়াতের) মাধ্যমে আল্লাহ একজন লোককেও হেদায়াত (সঠিক পথ) দান করেন, তাহ’লে তা তোমার জন্য লাল উটের চেয়ে অতি উত্তম হবে’।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
عَبَسَ وَتَوَلَّى- أَنْ جَاءهُ الْأَعْمَى- وَمَا يُدْرِيْكَ لَعَلَّهُ يَزَّكَّى- أَوْ يَذَّكَّرُ فَتَنْفَعَهُ الذِّكْرَى- أَمَّا مَنِ اسْتَغْنَى- فَأَنْتَ لَهُ تَصَدَّى- وَمَا عَلَيْكَ أَلَّا يَزَّكَّى- وَأَمَّا مَنْ جَاءَكَ يَسْعَى- وَهُوَ يَخْشَى- فَأَنْتَ عَنْهُ تَلَهَّى- كَلَّا إِنَّهَا تَذْكِرَةٌ- فَمَنْ شَاءَ ذَكَرَهُ-
‘তিনি ভ্রূকুঞ্চিত করলেন এবং মুখ ফিরিয়ে নিলেন। কারণ তাঁর কাছে এক অন্ধ আগমন করল। আপনি কি জানেন, সে হয়ত পরিশুদ্ধ হ’ত অথবা উপদেশ গ্রহণ করত এবং উপদেশে তার উপকার হ’ত। পরন্তু যে বেপরোয়া, আপনি তার চিন্তায় মশগূল। সে শুদ্ধ না হ’লে আপনার কোন দোষ নেই। যে আপনার কাছে দৌড়ে আসল, এমতাবস্থায় যে, সে ভয় করে। আপনি তাকে অবজ্ঞা করলেন! কখনও এরূপ করবেন না, এটা উপদেশবাণী। অতএব যে ইচ্ছা করবে, সে একে গ্রহণ করবে’ (আবাসা ৮০/১২)।
দশমতঃ দাওয়াত প্রকাশ্য ও সুস্পষ্ট হওয়া
দাঈ কখনোই সফলতা লাভ করতে পারবে না, যতক্ষণ তার দাওয়াত সুস্পষ্ট না হবে। সুস্পষ্ট বলতে আল্লাহর কিতাব আল-কুরআন ও রাসূলের সুন্নাত হাদীছের দিকে দাওয়াত দেওয়া বুঝানো হয়েছে। সুতরাং দাওয়াত কোন অস্পষ্ট, দুর্বোধ্য কিংবা হেয়ালী ও ধূম্রজাল সৃষ্টিকারী বিষয়ের প্রতি হবে না। বরং প্রকাশ্য পদ্ধতিতে প্রকাশ্য রূপেই দাওয়াত হ’তে হবে। যারা এ বলে দলীল সাব্যস্ত করে থাকেন যে, নবীগণ গোপনে দাওয়াতী কাজে ব্যাপৃত থেকেছেন, তারা ভুল বলেন। কেননা নূহ (আঃ) যেমন বলেছেন,
ثُمَّ إِنِّيْ دَعَوْتُهُمْ جِهَاراً- ثُمَّ إِنِّيْ أَعْلَنْتُ لَهُمْ وَأَسْرَرْتُ لَهُمْ إِسْرَاراً- فَقُلْتُ اسْتَغْفِرُوْا رَبَّكُمْ إِنَّهُ كَانَ غَفَّاراً-
‘অতঃপর আমি তাদেরকে প্রকাশ্যে দাওয়াত দিয়েছি। অতঃপর আমি ঘোষণা সহকারে প্রচার করেছি এবং গোপনে চুপিসারে বলেছি’ (নূহ ৭১/৮-১০)।
এভাবে সূরা নূহের শেষ আয়াত পর্যন্ত বলা হয়েছে যে, নূহ (আঃ)-এর দাওয়াত ছিল প্রকাশ্য। আর তাঁর দাওয়াত যে প্রকাশ্য ছিল তার প্রমাণ হ’ল তিনি দিনে-রাত্রে, প্রকাশ্যে-গোপনে দাওয়াত দিয়েছেন। এখানে ‘গোপনে’র (الإسرار) অর্থ হচ্ছে আমি তাদেরকে সমবেত অবস্থায় এবং পৃথক পৃথক অবস্থায় দাওয়াত দিয়েছি। নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)ও তিন বছর গোপনে দাওয়াত দিয়েছিলেন।
যদি দাঈ কোন কাফির দেশে বসবাস করে এবং আশংকা করে যে, মানুষকে কল্যাণের দিকে আহবান করলে, হকের দিকে দাওয়াত দিলে লাঞ্ছিত-অপমানিত হ’তে হবে অথবা প্রাণদন্ডে দন্ডিত হ’তে হবে তাহ’লে ভিন্ন কথা। কিন্তু কোন মুসলিম ভূ-খন্ডে কিংবা মুসলিম দেশে বসবাস করলে উচিত হবে প্রকাশ্যভাবে দাওয়াত দেওয়া এবং দাঈর উচিত হবে প্রকাশ্য হওয়া। কেননা দাঈ যদি অপ্রকাশ্য বা আড়ালে থাকে অতঃপর আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে এবং মানুষের কাছে নিজের আবরণ খুলে দেয়, তখন মানুষ তাকে অপসন্দ করবে, এমনকি তার নিকটের লোকও।
[চলবে]