[মাওলানা মুহাম্মাদ ইসহাক ভাট্টি (জন্ম : ১৫ই মার্চ ১৯২৫) পাকিস্তানের একজন খ্যাতিমান আহলেহাদীছ আলেম, লেখক ও আহলেহাদীছ ঐতিহ্যের শেকড়সন্ধানী গবেষক। এই কলমসৈনিক আহলেহাদীছ মনীষীদের জীবনী ও আহলেহাদীছ ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে অবিরাম লিখে চলেছেন। সমকালীন ভারতীয় উপমহাদেশে এ সম্পর্কে এতো বেশী কেউ লিখেছেন বলে আমাদের জানা নেই। সঙ্গতকারণেই তিনি ‘মুওয়াররিখে আহলেহাদীছ’ (আহলেহাদীছদের ঐতিহাসিক) উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর রচিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে ‘বার্রে ছাগীর মেঁ আহলেহাদীছ কী আওয়ালিয়্যাত’ এক অনন্য বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর। কুরআন মাজীদের অনুবাদ ও তাফসীর, হাদীছের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা, বাহাছ-মুনাযারা, কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, আরবী সাহিত্য চর্চা, উর্দূ থেকে বিভিন্ন গ্রন্থ আরবীতে অনুবাদ, কুরআন ও হাদীছের হিন্দী অনুবাদ প্রভৃতি ক্ষেত্রে ভারতীয় উপমহাদেশের আহলেহাদীছদের অগ্রণী ভূমিকাই এ বইয়ের প্রতিপাদ্য বিষয়। লেখকের ভাষ্য অনুযায়ী এতদ্বিষয়ে এটিই প্রথম গ্রন্থ (মূল উর্দূ গ্রন্থের ভূমিকা পৃঃ ২৭ দ্র.)। যারা বলেন, ভারতীয় উপমহাদেশে আহলেহাদীছদের কোন অবদান নেই- এই গ্রন্থের প্রতিটি লাইন তাদেরকে নির্বাক করে দিবে। আমরা ‘আত-তাহরীক’-এর পাঠকদের খিদমতে পর্যায়ক্রমে প্রবন্ধাকারে এ গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থটির অনুবাদ পেশ করব ইনশাআল্লাহ। আশা করি বিদগ্ধ পাঠক আহলেহাদীছদের কৃতিত্বের স্মারক অনেক অজানা ইতিহাস জেনে ঋদ্ধ হবেন।-অনুবাদক]

এই জনাকীর্ণ পৃথিবীতে ভৌগলিক দৃষ্টিকোণ থেকে তিনটি দেশকে (পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশ) একসাথে ‘বার্রে ছাগীর’ (উপমহাদেশ) নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এই তিনটি দেশ অসংখ্য মাযহাবের চিত্তাকর্ষক স্থান। এখানে প্রত্যেক মাযহাবের লোকজন নিজ নিজ তরীকা অনুযায়ী ইবাদত করার ব্যাপারে স্বাধীন। এ উপমহাদেশে মুসলমানদের সংখ্যা ৬০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। ২৫ কোটির মতো ভারতে, ২০ কোটির কাছাকাছি বাংলাদেশে এবং ১৮ কোটি মুসলমান পাকিস্তানে বসবাস করছে। মুসলমানদের মধ্যে আহলেহাদীছ, হানাফী (দেওবন্দী, ব্রেলভী), মালেকী, শাফেঈ, হাম্বলী, শী‘আ সব মাযহাবের মানুষই শামিল আছে এবং নিজেদের আক্বীদা ও ধ্যান-ধারণা অনুযায়ী পাঠদান ও গ্রন্থ রচনার খিদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে। আমি এই প্রবন্ধে আহলেহাদীছদের খিদমত সম্পর্কে কিছু কথা পেশ করতে চাচ্ছি এবং বলতে চাচ্ছি যে, ভারতীয় উপমহাদেশে জ্ঞান-গবেষণা ও গ্রন্থ রচনায় তাদের কী কী অগ্রগণ্য কৃতিত্ব রয়েছে এবং এক্ষেত্রে তাদের প্রচেষ্টার পরিধি কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে আছে।

সর্বাগ্রে কুরআন মাজীদ সম্পর্কে তাদের অবদান আলোচনা করছি এবং এটা স্পষ্ট করার চেষ্টা করছি যে, ভারতীয় উপমহাদেশে এই হেদায়াতের গ্রন্থের অনুবাদ ও তাফসীরে আহলেহাদীছ আলেমগণ কী খিদমত আঞ্জাম দিয়েছেন এবং এক্ষেত্রে তাদের কী অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। তবে এটা স্পষ্ট করার পূর্বে সামান্য ভূমিকা।

কুরআন মাজীদের তাফসীরের সূচনা :

ছাহাবীদের যুগে আরবী ভাষায় কুরআন মাজীদের তাফসীরের সূচনা হয়। সূচনালগ্নে সংক্ষিপ্তাকারে তাফসীর করা হ’ত। পরবর্তীতে এ বিষয়ে অসংখ্য বড় বড় তাফসীর গ্রন্থ লেখা হয়েছে। কিন্তু বর্ণনা করা হয়ে থাকে যে, ফার্সীই প্রথম অনারব ভাষা যাতে ছাহাবীদের যুগে কুরআন মাজীদ অনুবাদের সিলসিলা শুরু হয়েছিল। আল্লামা সারাখসীর অভিমত হল হযরত সালমান ফারেসী (রাঃ) পারস্যবাসীদের জন্য প্রথম সূরা ফাতিহার ফার্সী অনুবাদ করেন।[1] তবে ভারতীয় উপমহাদেশে কুরআন মাজীদের কিছু সূরার (যেমন সূরা ইয়াসীন) সর্বপ্রথম অনুবাদ সিন্ধী ভাষায় হয়।[2]

শায়খ শিহাবুদ্দীন দৌলতাবাদী (মৃঃ ৮৪৯ হিঃ/১৪৪৫ খ্রিঃ) ‘বাহরে মাওওয়াজ’ (بحر موَّاج) নামে ফার্সী ভাষায় কুরআন মাজীদের অনুবাদ করেন ও তাফসীর লিখেন। কিন্তু এটা কুরআনের বিভিন্ন অংশের অনুবাদ ও তাফসীর ছিল। পুরা কুরআনের অনুবাদ ও তাফসীর ছিল না।

শায়খ আলী মুত্তাকী (মৃঃ ২রা জুমাদাল উলা ৯৭৫ হিঃ/৪ঠা নভেম্বর ১৫৮৭ খ্রিঃ) উপমহাদেশের অনেক বড় আলেম ও লেখক ছিলেন। তিনি তাঁর ‘শুউনুল মুনায্যালাত’(شئون المنزلات) গ্রন্থে কুরআনের বিভিন্ন আয়াত অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট ও স্থান উল্লেখ করেছেন। তাছাড়া বৈয়াকরণ ও ভাষাতাত্ত্বিক দিক থেকে কিছু শব্দ ও আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন। এই গ্রন্থটি পুরা কুরআনের অনুবাদ ও তাফসীরের মর্যাদা লাভ করেনি।

ভারতবর্ষের চতুর্থ মোগল বাদশাহ নূরুদ্দীন মুহাম্মাদ জাহাঙ্গীর গুজরাটের কাঠিওয়াড়ের মুহাম্মাদ বিন জালালুদ্দীন হাসানী গুজরাটী নামের এক আলেমকে কুরআন মাজীদের ফার্সী অনুবাদ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে, শাব্দিক ও বোধগম্য অনুবাদ হ’তে হবে। অনুবাদের কোন শব্দ যেন কুরআনের শব্দের চেয়ে বেশী না হয়।[3] বাদশাহর নির্দেশ মোতাবেক অনুবাদ হয়েছিল কি-না তা জানা যায় না। যদি হয়েই থাকে তাহলে এই অনুবাদ কোথাও মওজুদ আছে, না নাই? আমাদের জানা মতে এই অনুবাদটি কোথাও নেই।

ভূমিকামূলক একথাটুকুর পর এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করা হবে যে, উপমহাদেশে পুরা কুরআন মাজীদের অনুবাদ ও তাফসীর সর্বপ্রথম কোন আলেমগণ করেছিলেন। আর সেগুলো প্রকাশিতও হয়েছিল এবং অদ্যাবধি প্রকাশনার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। যার মাধ্যমে মানুষেরা সীমাহীন উপকৃত হয়েছেন এবং হচ্ছেন। নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হল।-

কুরআন মাজীদের ফার্সী অনুবাদ :

শায়খ নূহ বিন নে‘মতুল্লাহ সিন্ধী ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম আলেম, যিনি পুরা কুরআন মাজীদের ফার্সী অনুবাদ করেন ও তাফসীর লিখেন। তিনি সিন্ধু প্রদেশের হালাকান্দী গ্রামের বাসিন্দা এবং সমকালীন খ্যাতিমান আলেম ছিলেন। তিনি ৯৯৮ হিজরীর ২৬শে যুলকা‘দায় (১৫ই সেপ্টেম্বর ১৫৯০ খ্রিঃ) স্বীয় বাসস্থান হালাকান্দীতে মৃত্যুবরণ করেন। পনেরশত হিজরী উপলক্ষে ১৪০১ হিজরীতে এই ফার্সী অনুবাদটি সিন্ধী সাহিত্য পরিষদ, হায়দারাবাদ, জামশুরু (সিন্ধু) প্রকাশ করে।

দ্বিতীয় ফার্সী অনুবাদক হলেন শাহ অলিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী। তাঁর অনুবাদ ও তাফসীরের নাম ‘ফাতহুর রহমান’ (فتح الرحمن)।[4] উপমহাদেশের অগণিত প্রকাশক অসংখ্যবার এই অনুবাদটি প্রকাশ করেছে। ওলামায়ে কেরামের মাঝে এটি দারুণ গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে এবং বহুলপঠিত হয়েছে। উপমহাদেশের সমগ্র মুসলিম উম্মাহ এটাকে বিশুদ্ধতম অনুবাদ হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে এবং সর্বশ্রেণীর আলেমগণ এর দ্বারা উপকৃত হয়েছেন।

উপমহাদেশে উছূলে তাফসীর বিষয়েও ‘আল-ফাওযুল কাবীর’ নামে ফার্সী ভাষায় শাহ অলিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভীই সর্বপ্রথম গ্রন্থ লিখেন।[5] এই গ্রন্থটি চারটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত। এই অধ্যায় সমূহে শরী‘আতের বিধি-বিধান, মুশরিক, মুনাফিক, ইহুদী ও নাছারাদের সাথে বিতর্ক, আল্লাহর নে‘মত সমূহ, ঘটনাসমূহ, মৃত্যু ও তৎপরবর্তী অবস্থা সম্পর্কিত বিদ্যা, সূরা সমূহ অবতীর্ণের ধারাবাহিকতা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করা হয়েছে।

‘আল-ফাওযুল কাবীর’ গ্রন্থটি রচনার কারণ সম্পর্কে শাহ ছাহেব বলেন, যখন এই ফকীরের (অলিউল্লাহ) জন্য আল্লাহ কুরআন মাজীদ অনুধাবনের দ্বার উন্মুক্ত করে দিলেন তখন মনের মধ্যে এই ইচ্ছা জাগল যে, কিছু উপকারী এমন সূক্ষ্ম বিষয় বর্ণনা করব যা কুরআন মাজীদ অনুধাবন ও গবেষণার ক্ষেত্রে মানুষদের জন্য উপকারী বিবেচিত হবে। মূলতঃ এই সংক্ষিপ্ত পুস্তিকায় ঐ সমস্ত সূক্ষ্ম বিষয় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

শাহ ছাহেবের আরবী ভাষায় রচিত একটি গ্রন্থের নাম ‘ফাতহুল খাবীর’ (فتح الخبير)। এটি কুরআন মাজীদের কঠিন ও বিরল শব্দের ব্যাখ্যা। এতে ঐ সমস্ত প্রায় সকল বিষয় পরিপূর্ণরূপে একত্রিত করা হয়েছে যেগুলো রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে তাফসীর সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। এটিও উপমহাদেশের এই মহান লেখকের এই বিষয়ে প্রথম গ্রন্থ। তিনি ১১১৪ হিজরীর ৪ঠা শাওয়াল (২১শে ফেব্রুয়ারী ১৭০৩ খ্রিঃ) দিল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১১৭২ হিজরীর ২৯শে মুহাররম (২০শে আগস্ট ১৭৬২ খ্রিঃ) মৃত্যুবরণ করেন।

শাহ অলিউল্লাহর পুত্র শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিছ দেহলভী ‘তাফসীরে ফাতহুল আযীয’ নামে ফার্সীতে কুরআন মাজীদের তাফসীর লিখেছেন। যেটি ‘তাফসীরে আযীযী’ (تفسير عزيزى) নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এটি কয়েক খন্ডে বিভক্ত ছিল। কিন্তু ১৮৫৭ সালের গন্ডগোলের সময় হারিয়ে গেছে। স্রেফ ১ম ও শেষ খন্ড দু’টি অবশিষ্ট রয়ে গেছে।[6] প্রথম খন্ডটি সূরা ফাতেহা থেকে সূরা বাকারার শেষ পর্যন্ত সোয়া দুই পারার এবং অন্য খন্ডটি শেষ দুই পারার (ঊনত্রিশ ও ত্রিশ) তাফসীরকে শামিল করেছে। ভারতীয় উপমহাদেশে ফার্সী ভাষায় এটিই প্রথম বিস্তারিত তাফসীর ছিল। দুঃখের বিষয় হ’ল এটি কালের লুটতরাজের শিকার হয়েছে। শাহ আব্দুল আযীযের এই কুরআনী খিদমত ছাড়াও তাঁর এক ছাত্র তাঁর দরসে কুরআনকে লিপিবদ্ধ করে সূরা মুমিনূন থেকে সূরা ইয়াসীন পর্যন্ত প্রায় পাঁচ পারার তাফসীর সংকলন করেছেন।[7] যা ‘পাঞ্জে পারা’ নামে প্রকাশিত হয়েছে।

শাহ আব্দুল আযীয ১১৫৯ হিজরীর ২২শে রামাযানে (২৭শে নভেম্বর ১৭৪৬) জন্মগ্রহণ করেন এবং ৭৯ বছর বয়সে ১২৩৮ হিজরীর ৭ই শাওয়ালে (১৭ই জুলাই ১৮২৩) দিল্লীতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে এত লোক সমাগম হয়েছিল যে, ৫৫ বার তাঁর জানাযা পড়া হয়। এটাও সম্ভবত উপমহাদেশের এক আহলেহাদীছ আলেমের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ। আমার জানা নেই যে, এর পূর্বে বা পরে কোন আলেমের জানাযা এতবার পড়া হয়েছে।

উপমহাদেশে পাঞ্জাব প্রদেশের যেই আলেম পুরা কুরআন মাজীদের ফার্সী অনুবাদ করেন তিনি হলেন হাফেয মুহাম্মাদ লাক্ষাবী। ধারাবাহিকতার দিক থেকে হাফেয ছাহেব উপমহাদেশে কুরআন মাজীদের তৃতীয় ফার্সী অনুবাদক ও মুফাসসির। ‘তাফসীরে মুহাম্মাদী’ (تفسير محمدي) নামে তিনি এই খিদমত আঞ্জাম দেন। এটি বড় সাইজের আড়াই হাযার পৃষ্ঠাব্যাপী। ১২৮৬ হিজরীতে তিনি এই তাফসীর লিখা শুরু করেন এবং ১২৯৬ হিজরীর শাওয়াল মাসে তা সমাপ্ত হয়। পুরা দশ বছর (১৮৬৯-১৮৭৯ খ্রিঃ) তিনি এই কল্যাণকর কাজে নিমগ্ন ছিলেন।

হাফেয লাক্ষাবীর রচনা পদ্ধতি ছিল এরূপ- তিনি প্রথমে কুরআন মাজীদের আয়াত উল্লেখ করেছেন। অতঃপর তার নীচে পাঞ্জাবী অনুবাদ এবং তার নীচে ফার্সী অনুবাদ লিপিবদ্ধ করেছেন। অনুবাদের ক্ষেত্রে শাব্দিক পরিবর্তন করা সত্ত্বেও সেটিকে শাহ অলিউল্লাহর অনুবাদ বলে আখ্যা দিতেন। অথচ সবাই জানে যে, শব্দের পরিবর্তনের নামই অনুবাদ। একটি অনুবাদের শব্দ পরিবর্তনের ফলে আরেকটি অনুবাদের মর্যাদা লাভ করেছে। যেকোন ভাষায় যত অনুবাদ হয়েছে তা সব শাব্দিক পরিবর্তনেরই ফসল। শাহ ছাহেবের অনুবাদের শাব্দিক পরিবর্তনের ফলে তা হাফেয লাক্ষাবীর অনুবাদে পরিণত হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি সেটিকে নিজের (ফার্সী) অনুবাদ বলে দাবী করতেন না; বরং শাহ ছাহেবের অনুবাদ বলে আখ্যা দিতেন। এটা তাঁর নম্রতা বৈকি!

পাঞ্জাবী অনুবাদের ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য হল, এটা শাহ রফীউদ্দীনের উর্দূ তরজমার পাঞ্জাবী তরজমা। এটাকেও তাঁর নম্রতাই বলা চলে। মূলত ঘটনা এই যে, হাফেয মুহাম্মাদ লাক্ষাবী দুই ভাষায় কুরআন মাজীদের অনুবাদ করেছেন। একটি ফার্সী এবং একটি পাঞ্জাবী ভাষায়। এভাবে তিনি ভারতবর্ষের তৃতীয় এবং অবিভক্ত পাঞ্জাবের প্রথম আলেম, যিনি কুরআন মাজীদ সম্পর্কে তিন ধরনের খিদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। ১. ফার্সী অনুবাদ ২. পাঞ্জাবী অনুবাদ ও ৩. পাঞ্জাবী পদ্যে কুরআনের তাফসীর। যা বড় সাইজের ৭টি বৃহৎ খন্ডে বিভক্ত এবং আড়াই হাযার পৃষ্ঠাব্যাপী।

হাফেয মুহাম্মাদ লাক্ষাবী বর্তমান ভৌগলিক মানচিত্র অনুযায়ী ভারতের ফিরোযপুর (পূর্ব পাঞ্জাব) যেলার ছোট্ট গ্রাম ‘লাক্ষৌকে’তে ১২২১ হিজরীর (১৮০৭ খ্রিঃ) কাছাকাছি জন্মগ্রহণ করেন এবং উপমহাদেশের খ্যাতিমান আলেমদের কাছ থেকে জ্ঞানার্জন করেন। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ও অসাধারণ ধীশক্তির অধিকারী ছিলেন। পড়াশোনার গভীরতা এত ব্যাপক ছিল যে, মিয়াঁ নাযীর হুসাইন দেহলভী তাঁকে ‘লাইব্রেরী’ বলে ডাকতেন। হাফেয মুহাম্মাদের দাদা হাফেয আহমাদ নিজ ছোট্ট গ্রাম ‘লাক্ষৌকেতে’ ‘দারুল উলূম’ নামে একটি মাদরাসা চালু করেছিলেন। হাফেয মুহাম্মাদ ১৮৪০ সালের দিকে এর নাম রাখেন ‘মাদরাসা মুহাম্মাদিয়া’। যেখানে অসংখ্য আলেম ও ছাত্র জ্ঞানার্জন করেছে। দেশ বিভাগের পর এই মাদরাসাটি ‘জামে‘আ মুহাম্মাদিয়া’ নামে উকাড়াতে স্থানান্তরিত হয়। এর অধ্যক্ষ ও সেক্রেটারী ছিলেন হাফেয ছাহেবের প্রপৌত্র মাওলানা মঈনুদ্দীন লাক্ষাবী (মৃঃ ৯ই ডিসেম্বর ২০১১/১৩ই মুহাররম ১৪৩৩ হিঃ)। হাফেয মুহাম্মাদ লাক্ষাবী অনেক গ্রন্থের লেখক ছিলেন। ১৩১১ হিজরীর ছফর মাসের শেষের দিকে (সেপ্টেম্বর ১৮৯৩) তিনি নিজ বাসস্থান লাক্ষৌকেতে ইন্তেকাল করেন।

ফার্সী ভাষায় কুরআন মাজীদ সম্পর্কিত একটি কাজ জামে‘আ দারুল উলূম গাওয়াড়ী (বেলুচিস্তান)-এর হাজী খলীলুর রহমান করেছেন। তিনি ৬২টি ফার্সী কবিতায় কুরআন মাজীদের ১১৪টি সূরার পরিচয় বর্ণনা করেছেন। এ বিষয়ে এটা এমন একটি কাজ যা ইতিপূর্বে কেউ করেনি। তিনি ১৩২৩ হিজরীর ২০শে জুমাদাল আখেরাহ (২২শে আগস্ট ১৯০৫) বেলুচিস্তানের বালগার নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন এবং কিছুদিন অসুস্থ থাকার পর ৭১ বছর বয়সে ১৩৯৬ হিজরীতে (১৯৭৬ খ্রিঃ) মৃত্যুবরণ করেন।

উর্দূ অনুবাদ ও তাফসীর :

এবার কুরআন মাজীদের উর্দূ অনুবাদ ও তাফসীর সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। শাহ অলিউল্লাহ দেহলভীর স্বনামধন্য পুত্র শাহ আব্দুল কাদের দেহলভী কুরআন মাজীদের প্রথম উর্দূ অনুবাদ করেন এবং ‘মুওয়ায্যিহুল কুরআন’ (موضح القرآن) নামে তাফসীর লিখেন। ১২০৫ হিজরীতে তিনি এটি সমাপ্ত করেন। সাইয়িদ আব্দুল হাই হাসানী স্বীয় পিতা সাইয়িদ ফখরুদ্দীন হাসানীর কিতাব ‘সেপাহর জাহা তাব’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, শাহ আব্দুল কাদের দেহলভী স্বপ্নে দেখেন তার উপর কুরআন নাযিল হয়েছে। তিনি বড় ভাই শাহ আব্দুল আযীযের নিকট এ স্বপ্নের কথা ব্যক্ত করেন। শাহ আব্দুল আযীয বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পরে অহী অবতীর্ণের সিলসিলা খতম হয়ে গেছে। তবে নিঃসন্দেহে স্বপ্ন সত্য। তোমার স্বপ্নের ব্যাখ্যা এই যে, আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে কুরআন মাজীদের খিদমত করার এমন তৌফিক দান করবেন যা ইতিপূর্বে কারো ভাগ্যে জোটেনি।[8] বস্ত্তত আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে কুরআন মাজীদের অনুবাদ ও তাফসীর ‘মুওয়ায্যিহুল কুরআন’ লেখার তৌফিক দেন। যার দ্বারা লক্ষ কোটি মানুষ উপকৃত হয়েছেন এবং হচ্ছেন। ইনশাআল্লাহ উপকৃত হওয়ার এই সিলসিলা সর্বদা অব্যাহত থাকবে।

কোন কোন গবেষক শাহ রফীউদ্দীন দেহলভীকৃত অনুবাদকে কুরআনের প্রথম উর্দূ অনুবাদ হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। কিন্তু প্রকৃত তথ্য হল প্রথম উর্দূ অনুবাদ শাহ আব্দুল কাদের কৃত। যার একটি প্রমাণ তাঁর এই স্বপ্ন ও এর ব্যাখ্যা।

শাহ আব্দুল কাদের ১১৬৩ বা ১১৬৪ হিজরীতে (১৭৫০ বা ১৭৫১ খ্রিঃ) জন্মগ্রহণ করেন এবং ১২৩০ হিজরীর ১৯শে রজব (২৭শে জুন ১৮১৫) মৃত্যুবরণ করেন।

উর্দূ ভাষায় কুরআন মাজীদের দ্বিতীয় অনুবাদ করেন শাহ আব্দুল কাদেরের বড় ভাই শাহ রফীউদ্দীন। শাহ আব্দুল কাদেরের অনুবাদের মতো এই অনুবাদও দারুণ গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। তাঁর সময় উর্দূ ভাষা একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল এবং সেই সময় অন্য কোন ভাষার গ্রন্থকে উর্দূতে রূপান্তর করা খুবই কঠিন ছিল। বিশেষত কুরআন মাজীদের অনুবাদ ছিল খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা এই বুযুর্গানে দ্বীনকে তৌফিক দেন এবং এই কঠিনতম পর্বের অবসান ঘটে। শাহ রফীউদ্দীন মা‘কূলাত ও মানকূলাতে পূর্ণ দক্ষতার অধিকারী ও বহু গ্রন্থের রচয়িতা ছিলেন। কবিতা ও কাব্যচর্চার সাথেও তাঁর সম্পর্ক ছিল। তিনি ১১৬২ হিজরীতে (১৭৪৯ খ্রিঃ) জন্মগ্রহণ করেন এবং ১২৩৩ হিজরীর ৬ই শাওয়াল (৯ই আগস্ট ১৮১৮) ইন্তেকাল করেন।

শাহ রফীউদ্দীনের মৃত্যুর ২২ বছর পর তদীয় কুরআনের অনুবাদ ১২৫২ হিজরীতে (১৮৪০ খ্রিঃ) প্রথমবারের মতো কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। এরপর অনেক প্রকাশক একাধিকবার এটি প্রকাশ করেছেন এবং এখনো প্রকাশ করছেন। কেউ কেউ এটিকে কুরআন মাজীদের আয়াতের সাথে আলাদাভাবে প্রকাশ করেছেন এবং কেউ কেউ অন্য কোন অনুবাদকের অনুবাদের সাথে প্রকাশ করেছেন।

কোন এক সময়ে বড় সাইজে তিনটি অনুবাদ একত্রে প্রকাশিত হয়েছিল।[9] কুরআন মাজীদের আয়াতের সাথে প্রথমত শাহ অলিউল্লাহর ফার্সী অনুবাদ, দ্বিতীয়ত শাহ রফীউদ্দীনের উর্দূ অনুবাদ এবং তৃতীয়ত শাহ আব্দুল কাদেরের উর্দূ অনুবাদ ছিল। এভাবে তিন পিতা-পুত্রের একত্রিত অনুবাদ প্রকাশিত হয় এবং এটাকে ‘তিন তরজমাওয়ালা কুরআন মাজীদ’ বলা হত। এই কুরআন মাজীদ আমার দাদার (মিয়াঁ মুহাম্মাদ) নিকট ছিল এবং তিনি প্রত্যেকদিন সকাল বেলায় কুরআনের ঐ কপিই তেলাওয়াত করতেন।

মূলত ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম প্রসিদ্ধ ও প্রচলিত ফার্সী অনুবাদ শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী এবং প্রথম উর্দূ অনুবাদ তাঁর পুত্রদ্বয় করেছিলেন। তাঁদের পরে অনেক আলেম কুরআনের অনুবাদ করেছেন। ডেপুটি নাযীর আহমাদ স্বীয় অনূদিত কুরআনের ভূমিকায় লিখছেন-

‘যখন এক সাথে একটি বংশের তিন তিনটি অনুবাদ মানুষেরা পেয়ে গেল। একটি শাহ অলিউল্লাহকৃত ফার্সী অনুবাদ এবং শাহ আব্দুল কাদের ও শাহ রফীউদ্দীন কৃত দু’দুটি উর্দূ অনুবাদ, তখন সবার অনুবাদ করার সাহস সৃষ্টি হল। কিন্তু অলিউল্লাহ পরিবার ছাড়া কোন ব্যক্তি কুরআনের অনুবাদক হওয়ার দাবী করতে পারে না। তারা কস্মিনকালেও কুরআনের অনুবাদক নন; বরং শাহ অলিউল্লাহ ও তাঁর পুত্রদের অনুবাদের অনুবাদক। তারা তাদের অনুবাদে পরিবর্তন-পরিবর্ধন ও আগপিছ করে নতুন অনুবাদের নাম দিয়ে দিয়েছে’।

নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খানের কুরআনী খিদমত :

নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খান ভারতীয় উপমহাদেশের বহু গ্রন্থ প্রণেতা আলেম ছিলেন। তিনি আরবী, ফার্সী ও উর্দূ তিন ভাষাতেই লিখেছেন। তাফসীর, হাদীছ, ফিকহ, ইতিহাস, আক্বাইদ, কবিতা ও কাব্যচর্চা, সাহিত্য, নৈতিকতা, তাছাওউফ প্রভৃতি বিষয়ে তিনি বিভিন্ন শিরোনামে ৩২৩টি গ্রন্থ লিপিবদ্ধ করেছেন। শুধুমাত্র কুরআন মাজীদ সম্পর্কিত বিষয়ে তাঁর ৭টি গ্রন্থ আছে। যা নিম্নে উল্লেখ করা হল :

১. ফাতহুল বায়ান ফী মাকাছিদিল কুরআন : এটি আরবী ভাষায় কুরআন মাজীদের তাফসীর। প্রথমে এটি ৪ খন্ডে বিভক্ত ছিল এবং নওয়াব ছাহেবের জীবদ্দশাতেই ভূপালে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রকাশিত হওয়ার পর নওয়াব ছাহেব এর বিভিন্ন জায়গায় বহু পরিবর্তন-পরিবর্ধন করেন। ফলে এ তাফসীরের পরিধি গিয়ে দাঁড়ায় ১০ খন্ডে। অতঃপর নিজেই এটিকে মিসর থেকে ছাপান। এটি বড় সাইজের চার হাযার পৃষ্ঠার অধিক।

২. তারজুমানুল কুরআন বিলাতায়িফিল বায়ান : এই তাফসীরটি উর্দূ ভাষায় রচিত ও ১৫ খন্ডে সমাপ্ত।

৩. তাযকীরুল কুল বিতাফসীরিল ফাতিহা ও আরবা‘ কুল : এটি উর্দূ ভাষায় সূরা ফাতিহা, সূরা কাফিরূণ, সূরা ইখলাছ, সূরা ফালাক ও সূরা নাসের তাফসীর।

৪. নায়লুল মারাম মিন তাফসীরি আয়াতিল আহকাম : এটি আরবী ভাষায় রচিত এবং কুরআন মাজীদের শারঈ বিধি-বিধান সম্পর্কিত ২৩৬টি আয়াতের তাফসীর।

৫. ফাছলুল খিতাব ফী ফাযলিল কিতাব : এটি উর্দূ ভাষায় রচিত। এতে কুরআন মাজীদের ফযীলত বর্ণনা করা হয়েছে। এতদ্বিষয়ে এটি এক অনন্য গ্রন্থ।

৬. ইকসীর ফী উছূলিত তাফসীর : এই গ্রন্থটি দুই খন্ডে ফার্সী ভাষায় রচিত।[10] প্রথম খন্ডে তাফসীর গ্রন্থাবলীর পরিচয় পেশ করা হয়েছে এবং দ্বিতীয় খন্ডে মুফাসসিরদের জীবনী বর্ণনা করা হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের একজন আহলেহাদীছ লেখক রচিত এ বিষয়ে এটিই প্রথম গ্রন্থ।

৭. ইফাদাতুশ শুয়ূখ বিমিকদারিন নাসিখ ওয়াল মানসূখ : এটিও ফার্সী ভাষায় রচিত এবং দুই খন্ডে বিভক্ত। প্রথম খন্ডে কুরআনের আয়াত সমূহের নাসিখ (রহিতকারী) ও মানসূখ (রহিত) এবং দ্বিতীয় খন্ডে হাদীছের নাসিখ-মানসূখ উল্লেখ করা হয়েছে।

কুরআন বিষয়ে নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খানের এই ৭টি গ্রন্থের মধ্যে কিছু আরবীতে, কিছু ফার্সীতে এবং কিছু উর্দূতে রচিত। অর্থাৎ কুরআন সম্পর্কিত বিষয়ে নওয়াব ছাহেব তিন ভাষাতেই লিখেছেন এবং অত্যন্ত গবেষণা করে লিখেছেন। এই ৭টি গ্রন্থ কলেবরের দিক থেকে ১০ হাযার পৃষ্ঠাব্যাপী। কুরআন সম্পর্কে নওয়াব ছাহেবের এটি বড় খিদমত, যা তিনি আঞ্জাম দিয়েছেন। তিনি সমকালীন ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম আলেম ছিলেন, যিনি কুরআন মাজীদ সম্পর্কে এত বিস্তারিত লিখেছেন।

নওয়াব ছাহেব ১২৪৮ হিজরীর ১৯শে জুমাদাল উলাতে (১৩ই নভেম্বর ১৯৩২) জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৩০৭ হিজরীর ২৯শে জুমাদাল আখেরায় (১৭ই ফেব্রুয়ারী ১৮৯০) মৃত্যুবরণ করেন।

সাইয়িদ আমীর আলী মালীহাবাদীর তাফসীর :

ভারতের ইউপি’র (উত্তর প্রদেশ) বিভিন্ন শহর-নগর ও গ্রাম-গঞ্জে অসংখ্য আলেম জন্মগ্রহণ করেছেন। যারা সর্বদা নিজেদেরকে জ্ঞান-গবেষণায় উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন এই আলেমদের মধ্যে সাইয়িদ আমীর আলী মালীহাবাদীর নামও শামিল রয়েছে। যিনি লক্ষ্ণৌ থেকে কিছু দূরে অবস্থিত মালীহাবাদ নামক এক গ্রামে ১২৭৪ হিজরীতে (১৮৫৮ খ্রিঃ) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ‘তাফসীরে মাওয়াহিবুর রহমান’ (تفسير مواهب الرحمن) নামে ৩০ খন্ডে কুরআন মাজীদের ত্রিশ পারার তাফসীর লিখেন। যা প্রথমবার নওলকিশোর প্রেস, লক্ষ্ণৌ থেকে প্রকাশিত হয়।[11] অতঃপর ১০টি বৃহৎ খন্ডে এটি ছাপানো হয়। এই খন্ডগুলোর পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮৮১২। ইউপির (উত্তর প্রদেশ) তিনিই প্রথম আলেম, যাকে আল্লাহ তা‘আলা এই গুরুত্বপূর্ণ খিদমত আঞ্জাম দেয়ার তৌফিক দিয়েছেন।

সাইয়িদ আমীর আলী মালীহাবাদী ‘তাফসীরে মাওয়াহিবুর রহমান’ ছাড়াও ফায়যীর নুকতাবিহীন তাফসীর ‘সাওয়াতিউল ইলহাম’ (سواطع الإلهام)-এর উপর নুকতাবিহীন ভূমিকা লিখেছেন। তিনিই প্রথম আলেম যিনি এই পান্ডিত্যপূর্ণ কাজ করেছেন। ‘তাফসীরে মাওয়াহিবুর রহমান’ ও ‘সাওয়াতিউল ইলহাম’ দু’টিই নওলকিশোর প্রেস, লক্ষ্ণৌ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। সাইয়িদ আমীর আলী মালীহাবাদী ১৩৩৭ হিজরীতে (১৯১৯ খ্রিঃ) মৃত্যুবরণ করেন।

সাইয়িদ আহমাদ হাসান দেহলভী :

ডেপুটি সাইয়িদ আহমাদ হাসান দেহলভী ১২৫৮ হিজরীতে (১৮৪২ খ্রিঃ) দিল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন। স্বীয় যুগের প্রসিদ্ধ শিক্ষকদের কাছ থেকে জ্ঞানার্জন করেন এবং গ্রন্থ রচনা ও দ্বীনী খিদমতে দারুণ খ্যাতি অর্জন করেন। দিল্লীর তিনিই প্রথম আলেম, যিনি উর্দূ ভাষায় ‘আহসানুত তাফাসীর’ (أحسن التفاسير) নামে ৭ খন্ডে কুরআন মাজীদের তাফসীর লিপিবদ্ধ করেছেন। যা দুই হাযার ৫৬২ পৃষ্ঠা ব্যাপী। সম্মানিত মুফাসসিরের জীবদ্দশায় ১৩২৫ হিজরীতে (১৯০৮ খ্রিঃ) প্রথমবার এটি দিল্লীর ফারূকী প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। কুরআন মাজীদের আয়াতের অর্থ শাহ আব্দুল কাদের দেহলভী কৃত অনুবাদ থেকে গৃহীত।

১৪১৬ হিজরীতে (১৯৯৬ খ্রিঃ) এই তাফসীরটি মাকতাবা সালাফিয়া, শীশমহল রোড, লাহোর থেকে প্রকাশিত হয়। এই প্রকাশনার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল, এতে উল্লিখিত হাদীছগুলোর তাখরীজ করে দেয়া হয়েছে। উপরন্তু হাদীছ বর্ণনাকারী ছাহাবীদের নির্ঘণ্ট তৈরী করা হয়েছে। যা প্রত্যেক খন্ডের শেষে সন্নিবেশিত আছে। ডেপুটি সাইয়িদ আহমাদ হাসান দেহলভী প্রায় ৮০ বছর বয়সে ১৩৩৮ হিজরীর ১৮ই জুমাদাল আখেরায় (৯ই মার্চ ১৯২০ খ্রিঃ) এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে স্থায়ী জগতে পাড়ি জমান।

মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর কুরআনী খিদমত :

মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী অবিভক্ত পাঞ্জাবের প্রথম আলেমে দ্বীন, যিনি উর্দূ ভাষায় ‘তাফসীরে ছানাঈ’(تفسير ثنائى) নামে পুরা কুরআন মাজীদের তাফসীর লিখেন। এই তাফসীরটি ৮ খন্ডে সমাপ্ত। ১৮৯৫ সালে (১৩১৩ হিঃ) এর ১ম খন্ড প্রকাশিত হয় এবং শেষ খন্ড ১৯৩১ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারীতে (২৯শে রামাযান ১৩৪৯ হিঃ) সমাপ্ত হয়।[12] এতে উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন মুফাসসির উপযুক্ত স্থান সমূহে স্বীয় যুগের বিভিন্ন সম্প্রদায়কে (খ্রিস্টান, আর্য সমাজ, কাদিয়ানী, শী‘আ, প্রকৃতিবাদী, হাদীছ অস্বীকারকারী প্রভৃতি) সমালোচনার লক্ষ্যবস্ত্ততে পরিণত করেন। অন্য কথায়, মাওলানা তাঁর তাফসীরে নিজস্ব খাছ তার্কিক ধাঁচ বজায় রেখেছেন এবং মানুষদেরকে কুরআনী বিধি-বিধান ও ইসলামের মূলনীতি সমূহ বুঝানোর পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে অমুসলিমদের পক্ষ থেকে কুরআন, হাদীছ ও ইসলামী বিধি-বিধানের উপর আরোপিত অভিযোগ সমূহের জবাব দিয়েছেন।

দেশ বিভাগের পূর্বে মাওলানা অমৃতসরী আরবী ভাষায় দু’টি তাফসীর লিখেন। একটি আরবী তাফসীরের নাম ‘তাফসীরুল কুরআন বিকালামির রহমান’ (تفسير القرآن بكلام الرحمن) অর্থাৎ কুরআনের আয়াত দিয়ে কুরআনের তাফসীর। এ বিষয়ে এটি এক অনন্য তাফসীর, যা ১৯০৩ সালে (১৩২১ হিঃ) প্রকাশিত হয়।[13] এটি প্রথম আরবী তাফসীর, যা অবিভক্ত পাঞ্জাবের একজন আলেম লিখেন। দ্বিতীয় আরবী তাফসীরের নাম হল ‘বায়ানুল ফুরকান আলা ইলমিল বায়ান’ (بيان الفرقان على علم البيان)। এই তাফসীরটি মাওলানা ইলমে মা‘আনী ও বায়ানের (অলংকারশাস্ত্র) আলোকে লিখা শুরু করেছিলেন। এর প্রথম খন্ড সূরা বাকারায় গিয়ে ঠেকেছিল। এ খন্ডের শেষে দ্বিতীয় খন্ড লেখার কথা বলেছিলেন। কিন্তু লেখা হয়নি। প্রথম খন্ডের প্রকাশকাল ১৯৩৪ সাল (১৩৫৩ হিঃ)। তিনি ১৮৬৮ সালে অমৃতসরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৪৮ সালের ১৫ই মার্চ সারগোধাতে ইন্তেকাল করেন।

মাওলানা মুহাম্মাদ হানীফ নাদভী :

অবিভক্ত পাঞ্জাবে উর্দূ ভাষায় পুরা কুরআন মাজীদের তাফসীর লেখক দ্বিতীয় আহলেহাদীছ আলেম হলেন মাওলানা মুহাম্মাদ হানীফ নাদভী। তাঁর তাফসীরের নাম ‘সিরাজুল বায়ান’ (سراج البيان)। এই তাফসীরটি প্রথমবার ১৯৩৪ সালে মুদ্রিত হয়। ভাষা ও বর্ণনাভঙ্গির দিক থেকে এটি খুবই সুন্দর তাফসীর।

মাওলানা হানীফ নাদভীর কুরআন ও কুরআন সম্পর্কিত জ্ঞানের সাথে বিশেষ সম্পর্ক ছিল। ১৯২৫-১৯৩০ সাল পর্যন্ত দারুল উলূম নাদওয়াতুল ওলামা, লক্ষ্ণৌতে জ্ঞানার্জন করা অবস্থায় তিনি কুরআনের বিভিন্ন তাফসীর সম্পূর্ণ অধ্যয়ন করেন এবং এ বিষয়ে বিশেষ সনদ লাভ করেন। তিনি ১৯০৮ সালের ১০শে জুন গুজরানওয়ালাতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৮৭ সালের ১২ই জুলাই লাহোরে মৃত্যুবরণ করেন।

মাওলানা আবুল কাসেম বেনারসী :

মাওলানা আবুল কাসেম বেনারসী প্রথম লেখক, যিনি উর্দূ ভাষায় ‘জামউল কুরআন ওয়াল হাদীছ’ (جمع القرآن والحديث) নামে গ্রন্থ লিখেন এবং প্রমাণ করেন যে, বর্তমানে যেই ধারাবাহিকতায় কুরআন মাজীদ মওজুদ রয়েছে এবং যেভাবে মানুষ তেলাওয়াত করে, ঠিক সেই ধারাবাহিকতায়-ই নবী করীম (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় কুরআন মাজীদ সংকলিত হয়েছিল। অনুরূপভাবে নবী করীম (ছাঃ)-এর বরকতময় যুগে হাদীছের সংগ্রহ ও সংকলনের সূচনাও ছাহাবীগণ করেছিলেন এবং অসংখ্য হাদীছ সংগৃহীত হয়ে গিয়েছিল। এই গ্রন্থটি প্রথমবার আঞ্জুমানে আহলেহাদীছ, মসজিদে মুবারক, লাহোর প্রকাশ করেছিল। তিনি ১৩০৭ হিজরীর ১লা শাওয়ালে (২১শে মে ১৮৯০) বেনারসে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৩৬৯ হিজরীর ৩রা ছফরে (২৫শে নভেম্বর ১৯৪৯) তাঁর মৃত্যু হয়।

মাওলানা আবুল কালাম আযাদ :

মাওলানা আবুল কালাম আযাদ উপমহাদেশের এমন উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, যিনি নিজের জ্ঞানগত মর্যাদা ও বিচিত্র বৈশিষ্ট্যের কারণে গোটা পৃথিবীতে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিলেন। কুরআন মাজীদের মাধ্যমেই তিনি নিয়ম মাফিক লেখনী ও বক্তব্যের সূচনা করেছিলেন। এই হেদায়াতের গ্রন্থের সাথে তাঁর সীমাহীন আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। ‘তারজুমানুল কুরআন’ (ترجمان القرآن) নামে তিনি অনুবাদ ও তাফসীর শুরু করেছিলেন। এই তাফসীরটি সূরা ফাতিহা থেকে সূরা নূরের শেষ পর্যন্ত চার খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে।[14] দুঃখের বিষয় বাকী পান্ডুলিপিগুলো হারিয়ে গেছে। তাঁর এই তাফসীরের মধ্য থেকে বিশেষভাবে সূরা ফাতিহা, সূরা ইউসুফ ও সূরা কাহফের তাফসীর বেশ বিস্তারিত এবং তাহকীকী দৃষ্টিকোণ থেকে জবরদস্ত তাফসীর। যা পৃথক পৃথকভাবে গ্রন্থকারেও প্রকাশিত হয়েছে। শুধু উর্দূ ভাষাতেই নয় বরং কোন ভাষাতেই এরূপ পান্ডিত্যপূর্ণ ও গবেষণাধর্মী তাফসীর লিখা হয়নি।

মাওলানা আবুল কালাম আযাদ উপমহাদেশের প্রথম আলেম, যিনি কুরআন মাজীদের আলোকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবনীও লিপিবদ্ধ করেছেন। ‘আমছালুল কুরআন’ (কুরআনের উপমাসমূহ) নামেও একটি গ্রন্থ লিখেছেন। উপরন্তু কুরআনের আলোকে তিনি আল-কালিমুত তাইয়িব, আদ-দ্বীনুল খালেছ, আল-বুরহান, কানূনে নশব ওয়া ইরতিকা (বিবর্তনবাদ তত্ত্ব), হাকীকাতে ঈমান, কুফর ওয়া নিফাক, খাছায়িছে মুসলিম প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেছেন। যেগুলো স্ব স্ব বিষয়ে অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। কুরআন মাজীদের আলোকে তাঁর সকল দাওয়াতী কর্মকান্ড অব্যাহত ছিল। উপমহাদেশের আলেমগণ তাঁকে ‘ভারতবর্ষের ইবনে তায়মিয়া’ বলে অভিহিত করতেন।

কালের এই অসামান্য প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব ১৩০৫ হিজরীর ১লা যুলহিজ্জাহ (৯ই আগস্ট ১৮৮৮) মক্কা মুকাররমায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৫৮ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারী (১৩৭৭ হিজরীর ২রা শা‘বান) দিল্লীতে মৃত্যুবরণ করেন।

উর্দূ পদ্যে কুরআনের অনুবাদ :

আব্দুল আযীয খালেদ আরবী, ফার্সী, উর্দূ, ইংরেজী, হিন্দী প্রভৃতি ভাষায় পান্ডিত্যপূর্ণ দখল রাখতেন। উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন কবি ছিলেন। তিনি ৩৩টি গ্রন্থের রচয়িতা ছিলেন, যার মধ্যে ৩টি গ্রন্থ গদ্যে এবং ৩০টি তাঁর কাব্য সংকলন। তাঁকে পাকিস্তানের বড় সরকারী অফিসারদের মধ্যে গণ্য করা হ’ত। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি সম্পূর্ণ কুরআন মাজীদের উর্দূ পদ্যানুবাদ করেন এবং সেই অনুবাদ পন্ডিত মহলে সাদরে গৃহীত হয়। তিনি মাওলানা মুহাম্মাদ হানীফ নাদভীর দারুণ ভক্ত ছিলেন এবং উলূমে কুরআনে তাঁকে (নাদভী) নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি হিসাবে মনে করতেন।

আব্দুল আযীয খালেদ ১৯২৭ সালের ১৫ই জানুয়ারী (১৩৪৫ হিজরীর ১০শে রজব) জালন্ধর যেলার (পূর্ব পাঞ্জাব) পরজিয়া নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০১০ সালের ২৮শে জানুয়ারী (১২ই ছফর ১৪৩১) লাহোরে মৃত্যুবরণ করেন।

পাঞ্জাবী, সিন্ধী, বালুচী ও পশতু অনুবাদ :

কুরআন মাজীদের ফার্সী অনুবাদের আলোচনায় শাহ অলিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভীর পরে হাফেয মুহাম্মাদ লাক্ষাবীর ফার্সী অনুবাদ এবং তাঁর পাঞ্জাবী পদ্যে লিখিত ‘তাফসীরে মুহাম্মাদী’ ও পাঞ্জাবী অনুবাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এখন কুরআনের আরেকটি পাঞ্জাবী অনুবাদ সম্পর্কে শুনুন! এই অনুবাদটি খ্যাতিমান আলেম মাওলানা হেদায়াতুল্লাহ নওশাহরাবীর। তিনি শিয়ালকোট যেলার ‘নওশাহরাহ কাকে যিয়া’ গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন এবং কাকেযী বংশের লোক ছিলেন। নিজ গ্রামের কতিপয় শিক্ষকের নিকট কিছু কিতাব পড়ার পর শিয়ালকোটে আসেন এবং সেখানকার আলেমদের কাছ থেকে উপকৃত হন। এরপর দৃঢ় সংকল্প নিয়ে লাহোর যাত্রা করেন এবং এই শহরের আলেমদের কাছ থেকে জ্ঞানার্জন করেন। ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের কিছুদিন পর লাহোর থেকে পায়ে হেঁটে দিল্লী পৌঁছেন এবং সেখানে মিয়াঁ নাযীর হুসাইনের কাছ থেকে জ্ঞানার্জন করেন। দিল্লীতে হেকিমি বিদ্যাও পড়েন। দীর্ঘ সময় তিনি এখানে কাটান। দিল্লী থেকে প্রস্থান করে অমৃতসরে আসেন এবং সাইয়িদ আব্দুল্লাহ গযনভীর নিকট বায়‘আত গ্রহণ করেন। ১৮৮২ সালের পর (১২৯৯ হিঃ) নিজ গ্রাম ‘নওশাহরাহ কাকে যিয়া’তে আসেন। সেখানে অল্প কিছুদিন অবস্থান করে রাওয়ালপিন্ডিতে চলে যান এবং সেখানে হেকিমি চিকিৎসা শুরু করেন। রাওয়ালপিন্ডির আহলেহাদীছ মসজিদে ইমামতি ও খতীবের দায়িত্বও পালন করতেন। তিনি পাঞ্জাবী ভাষায় কুরআন মাজীদের অনুবাদ করেন এবং পাঞ্জাবীতে সূরা ফাতিহার তাফসীর লিখেন। ১৯১১ সালে (১৩২৯ হিঃ) কোন কাজের সূত্রে রাওয়ালপিন্ডি থেকে শিয়ালকোটে আসেন এবং অসুস্থ হয়ে পড়েন। তৃতীয় দিন শিয়ালকোটে তাঁর মৃত্যু হয়। মাওলানা মুহাম্মাদ ইবরাহীম শিয়ালকোটী তাঁকে গোসল দেন এবং জানাযার ছালাত পড়ান। সেখানে মঙ্গা শাহের কবরস্থানে ঈদগাহের দেয়ালের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়।

আমার জানা মতে খাঁটি পাঞ্জাবী ভাষায় কুরআন মাজীদের দু’টি অনুবাদ হয়েছে, যা আহলেহাদীছ আলেমগণ করেছেন। একটি অনুবাদ করেছেন হাফেয মুহাম্মাদ লাক্ষাবী (মৃঃ ছফর ১৩৩১ হিঃ/সেপ্টেম্বর ১৮৯৩ খ্রিঃ) এবং অন্যটি করেছেন মাওলানা হেদায়াতুল্লাহ নওশাহরাবী (মৃঃ ১৩২৯ হিঃ/১৯১১ খ্রিঃ)।

মাওলানা আব্দুত তাওয়াব মুলতানীকে উপমহাদেশের উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন আলেমদের মধ্যে গণ্য করা হয়। তিনি নিজ শহর মুলতানে ‘মাকতাবা সালাফিয়া’ নামে গ্রন্থ রচনা ও মুদ্রণের সিলসিলা শুরু করেছিলেন এবং মাদরাসাও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যেখানে তাঁর কাছ থেকে অসংখ্য আলেম ও ছাত্র জ্ঞানার্জন করেন। তিনিই প্রথম আলেম যিনি সারায়েকী (বা মুলতানী) ভাষায় কুরআন মাজীদের অনুবাদ করেন এবং টীকা লিখেন। এর সাথে শাহ রফীউদ্দীন দেহলভীর উর্দূ অনুবাদ ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, এই অনুবাদটি হারিয়ে গেছে। শুধু ১ম ও ত্রিশ পারার অনুবাদ সংরক্ষিত ছিল, যা প্রকাশ করা হয়েছে। মাওলানা আব্দুত তাওয়াব মুলতানী মিয়াঁ নাযীর হুসাইন দেহলভীর ছাত্রত্ব গ্রহণের মর্যাদা অর্জন করেছিলেন। তিনি ১৮৭১ সালের ৩১শে আগস্ট (১২৮৮ হিজরীর ১৪ই জুমাদাল আখেরাহ) মুলতানে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৪৭ সালের ২৯শে মে (১৩৬৬ হিজরীর ৯ই রজব) সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।

মাওলানা মুহাম্মাদ হাফীযুর রহমান হাফীয ভাওয়ালপুরের রিয়াসাতী ভাষায় কুরআন মাজীদের অনুবাদ করেন। ১৩৭২ হিজরীতে (১৯৫৩ খ্রিঃ) ভাওয়ালপুরের আযীযুল মাতাবে প্রেস থেকে যেটি প্রকাশিত হয়। এই ভাষাটি মুলতানী ভাষার সাথে মিলে যায়। মাওলানা মুহাম্মাদ হাফীযুর রহমান হাফীযের জীবনী আমি জানতে পারিনি। রিয়াসাতী ভাষায় অনূদিত কুরআন মাওলানা আবু হামযা আব্দুল হামীদ সালাফী (মুসলিম কলোনী, রোড নং ২, খায়েরপুর সাদাত, আলীপুর, যেলা মুযাফ্ফরগড়) আমাকে প্রদান করেছেন। এজন্য আমি তাঁর কৃতজ্ঞভাজন।

মাওলানা আব্দুল গাফফার যামেরানী ছিলেন প্রথম আলেম যিনি বালুচী ভাষায় কুরআন অনুবাদের সূচনা করেছিলেন। এই সিলসিলা ২৫ পারা পর্যন্ত গিয়ে ঠেকার পর তাঁর হার্ট এ্যাটাক হয় এবং করাচীর এক হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মাওলানা বেলুচিস্তান প্রদেশের মুকরান এলাকার এক পাহাড়ী স্থান ‘যামেরানে’ ১৯৩৪ সালে (১৩৫২ হিঃ) জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০০৪ সালের ৩১শে মে (১৪২৫ হিজরীর ১১ই রবীউছ ছানী) মৃত্যুবরণ করেন।

মাওলানা আব্দুস সালাম রুস্তমী ১৩৫৯ হিজরীর রামাযান মাসে (নভেম্বর ১৯৪০) সারহাদ প্রদেশের মারদান যেলার রুস্তম নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। প্রথমে দেওবন্দী হানাফী ছিলেন এবং হানাফী মাদরাসাগুলিতে জ্ঞানার্জন করেন। অতঃপর আহলেহাদীছ হন এবং দরস-তাদরীস ও লেখনীতে সীমাহীন খিদমত আঞ্জাম দেন। পশতু ভাষায় কুরআন মাজীদের অনুবাদ করেন এবং তাফসীরও লিখেন। যেটি ১৬৬৬ পৃষ্ঠাব্যাপী। এর নাম ‘তাফসীরুল কুরআনিল কারীম’ (تفسير القرآن الكريم)। মাওলানা আব্দুল মালেক মুজাহিদ প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনা সংস্থা ‘দারুস সালাম’ এই তাফসীরটি প্রকাশ করার গৌরব অর্জন করেছে। উন্নত কাগজ, চমৎকার ছাপা এবং দৃষ্টিনন্দন বাঁধাইয়ের পশতু ভাষার এই অনুবাদ ও তাফসীর এক চমৎকার উপহার। যা প্রথমবারের মতো কুরআন প্রেমিকরা লাভ করেছে। দো‘আ রইল আল্লাহ যেন তাকে (আব্দুল মালেক) দ্বীনের বেশী বেশী খিদমত করার তৌফিক দেন।

পাকিস্তানী আলেম মাওলানা আহমাদ মাল্লাহ সিন্ধু প্রদেশের তহসিল বাদীনের কুন্ডী নামক গ্রামে ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে (১২৮৪ হিঃ) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দরিদ্র বংশের সন্তান ছিলেন। ধীরে ধীরে জ্ঞানার্জন করেন। রাজনীতির প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হলে তিনি খেলাফত আনেদালন সহ অন্যান্য স্বাধীনতা আন্দোলন সমূহে অংশগ্রহণ করেন এবং বন্দী হন। ১৯৩২ সালে তিনি আহলেহাদীছ হন। অতঃপর আল্লাহ তৌফিক দিলে সিন্ধী পদ্যে কুরআন মাজীদের অনুবাদ করেন। এর পূর্বে সিন্ধী পদ্যে কুরআনের অনুবাদের কোন দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায় না। সিন্ধী ভাষার এই পদ্যানুবাদ ১৩ বছরে সমাপ্ত হয়। তিনি এর নাম রাখেন ‘নূরুল কুরআন মানযূম তারজামাতুল কুরআন’ (نور القرآن منظوم ترجمة القرآن)। ১৪১৫ হিজরীতে (১৯৯৪ খ্রিঃ) এই অনুবাদটি সঊদী সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়েছে।

মাওলানা আহমাদ মাল্লাহর সময়ে সিন্ধুতে একটি বড় ফিতনা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। বাদীনের নিকটবর্তী স্থানে ‘লাওয়ারী’ নামে একটি খানকা আছে। যেখানে প্রথম দিকে ওরস ও মেলা বসত। কিন্তু ১৯৩৮ সালে যথারীতি ঘোষণা করা হয় যে, আগামী ৯ই যিলহজ্জ লাওয়ারীতে গরীবদের জন্য হজ্জের খুৎবা পড়া হবে। তাছাড়া প্রচার করা হয় যে, যে ব্যক্তি হজ্জের দিনগুলোতে হজ্জের নিয়তে লাওয়ারী দরগায় উপস্থিত হবে, সে আল্লাহর নিকট হাজী ও মুক্তিপ্রাপ্ত বলে গণ্য হবে। দরগার বাইরে একটি সাইনবোর্ডে এই কথাগুলো লেখা হয়েছিল- ‘হাজী, নাজী, গাযীকে শত শত মুবারক ও সালাম। ৩-টার সময় হজ্জের খুৎবা প্রদান করা হবে’। এমনকি লাওয়ারীর মাটিকে মক্কা-মদীনার সাথে তুলনা করা হয় (নাঊযুবিল্লাহ)। যমযমের পানি, আরাফাত এবং বাকী কবরস্থানের নামও নির্বাচন করা হয়।

এই মুশরিকী ও ইসলাম বিরোধী ষড়যন্ত্রের কথা শুনে শুধু সিন্ধু প্রদেশই নয় বরং যেখানে যেখানে এই প্রাণঘাতী খবর পৌঁছেছিল, সেখান থেকে তাওহীদপন্থীদের কাফেলা একের পর এক বাদীনে পৌঁছতে শুরু করে। তাদের মধ্যে আফগানী, সিন্ধী, বালুচী, পাঞ্জাবী সবাই ছিল। ঐ তাওহীদী কাফেলার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন মাওলানা আহমাদ মাল্লাহ। তিনি সেখানে পৌঁছা মাত্রই ঘোষণা করেন, হজ্জের জন্য আল্লাহ শুধুমাত্র মক্কা মুকাররমাকে নির্বাচন করেছেন। আমরা মৃত্যুবরণ করব, কিন্তু লাওয়ারী বা অন্য কোন জায়গায় তোমরা যা করতে চাচ্ছ তা করতে দিব না। ইংরেজ শাসনের সময় ছিল। মাওলানাকে গ্রেফতার করা হল। জনগণ এর তীব্র প্রতিবাদ করল। অবশেষে মাওলানা আহমাদ মাল্লাহ সফলকাম হলেন এবং লাওয়ারীতে হজ্জ করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিরা ব্যর্থকাম হল। বৃটিশ সরকারও অস্ত্র প্রত্যাহার করে নিল। এটি ছিল অনেক বড় ফিতনা, যা ১৯৩৮ সালে আত্মপ্রকাশ করে এবং মাওলানা আহমাদ মাল্লাহর দুঃসাহসী আন্দোলনের ফলে তা বন্ধ হয়ে যায়। তিনি ১০০ বছর বয়স পেয়ে ১৯৬৮ সালের ১৯শে জুলাই (১৩৮৮ হিজরীর ২২শে রবীউছ ছানী) মৃত্যুবরণ করেন।

সাইয়িদ বদীউদ্দীন শাহ রাশেদী সিন্ধু প্রদেশের অনেক বড় আলেম পরিবারের উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন আলেম ছিলেন। তিনি আরবী, উর্দূ ও সিন্ধীতে ১০৮টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি স্বীয় যুগের অনেক বড় বক্তাও ছিলেন। রিজাল শাস্ত্রে অসামান্য পান্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। কুরআন-হাদীছের সকল দিক ও বিভাগে তিনি দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। তিনি উপমহাদেশের একমাত্র আলেম, যিনি সিন্ধী ভাষায় ‘বাদীউত তাফাসীর’ (بديع التفاسير) নামে কুরআন মাজীদের তাফসীর লিখেছেন। যেটি কয়েক খন্ডে বিভক্ত। সিন্ধু এলাকায় এই তাফসীরটি অপরিসীম গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে। তিনি ১৯২৫ সালের ১০শে জুলাই (১৯শে যুলহিজ্জা ১৩৪৩ হিঃ) ঝান্ডাপীর গ্রামে (যেলা হায়দারাবাদ, সিন্ধু) জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৯৬ সালের ৮ই জানুয়ারী (১৬ই শা‘বান ১৪১৪ হিঃ) মৃত্যুবরণ করেন।

বাংলা ভাষায় কুরআনের অনুবাদ ও তাফসীর :

এখন বাংলা ভাষার অনুবাদ ও তাফসীর সম্পর্কে শুনুন! বাংলা ভাষায় অনেক আলেম কুরআন মাজীদ সম্পর্কে খিদমত আঞ্জাম দিয়েছেন এবং এর কিছু সূরার অনুবাদ করেছেন ও তাফসীর লিখেছেন। সম্ভবত পূর্ণাঙ্গ কুরআন মাজীদের প্রথম বাংলা অনুবাদ করেছেন মাওলানা আববাস আলী। তিনি ১৮৫৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম ছিল মুনশী তমীযুদ্দীন। তিনি চন্ডীপুর, বশীরহাট, চবিবশ পরগনার বাসিন্দা ছিলেন। তিনি ১৯০৭ সালের অক্টোবরে প্রথমত কুরআন মাজীদের শেষ পারার অনুবাদ করে কলকাতা থেকে প্রকাশ করেন। যা কয়েকদিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। এর দুই মাস পর ১৯০৭ সালের ডিসেম্বর মাসে উক্ত অনুবাদের ২য় সংস্করণ প্রকাশ করা হয়। এটাও লোকেরা খুব আগ্রহভরে ক্রয় করে এবং পড়ে। এরপর ১৯০৯ সালে তিনি পুরা কুরআন মাজীদের টীকাসহ অনুবাদ আলতাফী প্রেস, কলকাতা থেকে প্রকাশ করেন। এই অনুবাদটি ৯৬৭ পৃষ্ঠায় পরিব্যাপ্ত ছিল। কুরআন মাজীদের আয়াতের সাথে প্রথমে ছিল শাহ রফীউদ্দীন দেহলভীর উর্দূ অনুবাদ, তারপর আববাস আলীর বাংলা অনুবাদ। বাংলা ও উর্দূ ভাষায় সংক্ষিপ্ত তাফসীরও ছিল। এই অনুবাদটি বঙ্গদেশে খুবই গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে এবং বহুলভাবে পঠিত হয়। অল্পদিনের ব্যবধানে এটির ৬ষ্ঠ সংস্করণ প্রকাশিত হয়। তারপর কলকাতা থেকে একাধিকবার ছাপানো হয়। তিনি ১৯৩২ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ বাংলার প্রসিদ্ধ আলেম ছিলেন। তিনি উপমহাদেশের স্বাধীনতার জন্য সীমাহীন প্রচেষ্টা চালান এবং অবস্থাভেদে স্বীয় যুগের রাজনৈতিক দল কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, অল ইন্ডিয়া খেলাফত মজলিস, জমঈয়তে ওলামায়ে হিন্দ প্রভৃতিতে অংশগ্রহণ করেন এবং এগুলোর প্লাটফর্মে সোৎসাহে সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন। দেশের স্বাধীনতার জন্য কয়েক বছর জেলে ছিলেন। সাংবাদিকতার ময়দানেও দারুণ সুখ্যাতি অর্জন করেন এবং বাংলা ভাষায় তিনটি পত্রিকা চালু করেন। সেগুলো ছিল ১. সেবক ২. যামানা[15] ও ৩. দৈনিক আজাদ। বাংলা ভাষায় তাঁর সাপ্তাহিক ‘মোহাম্মদী’ নামেও একটি পত্রিকা ছিল। এ সকল পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব তাঁর উপরেই ন্যস্ত ছিল। তাঁর পিতার নাম ছিল মাওলানা আব্দুল বারী। পিতা-পুত্র দু’জনই মিয়াঁ নাযীর হুসাইন দেহলভীর ছাত্র ছিলেন। মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ জেলে থাকাবস্থায় কুরআন মাজীদের বঙ্গানুবাদ করেন।[16] তিনি ১৮৬৭ সালের দিকে জন্মগ্রহণ করেন এবং একশ বছরের কাছাকাছি বয়স পেয়ে ১৯৬৮ সালের ১৮ই আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন।

উপমহাদেশে কুরআনের ইংরেজী অনুবাদ :

ইংরেজী অনুবাদ সম্পর্কেও পড়ুন! ১৯০৫ সালে ড. আব্দুল হাকীম খান প্রথম কুরআন মাজীদের ইংরেজী অনুবাদ করেন। যিনি বর্তমান পূর্ব পাঞ্জাবের পাটিয়ালা শহরের বাসিন্দা। তিনি কিছুকাল কাদিয়ানীদের সাথে ছিলেন। অতঃপর আল্লাহর রহমতে কাদিয়ানী মতবাদ থেকে তওবা করেন। ইংরেজী ছাড়া তিনি কুরআনের উর্দূ অনুবাদও করেছিলেন। ড. আব্দুল হাকীম খানের ইংরেজী অনুবাদের পূর্বে ইউরোপীয় ভাষায় অমুসলিমরাই কুরআন মাজীদের অনুবাদ করত। অনুবাদের বিশুদ্ধতার কোন বাধ্য-বাধকতা ছিল না।[17] তিনি ১৩৫৯ হিজরীতে (১৯৪০ খ্রিঃ) মৃত্যুবরণ করেন।

কুরআন মাজীদের একটি ইংরেজী অনুবাদ মির্যা হায়রাত দেহলভী করেছিলেন। তাঁর নাম ছিল মুহাম্মাদ উমরাও বেগ। মির্যা হায়রাত দেহলভী নামে তিনি পরিচিত ছিলেন। তিনি অনেক গ্রন্থের রচয়িতা ও অনুবাদক ছিলেন। ১৮৬৮ সালের ১লা জানুয়ারী তিনি দিল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯২৮ সালে (১৩৪৬ হিঃ) সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। উপমহাদেশে কুরআনের প্রথম ইংরেজী অনুবাদ করার মর্যাদাও আহলেহাদীছগণ লাভ করেন।

[1]. আল-মাবসূত (১/৩৭, মিসরীয় ছাপা)-এর বরাতে মুওয়ায্যিহুল কুরআন-এর টীকা, পৃঃ ১২

[2]. বিস্তারিত দেখুন : ফুকাহায়ে হিন্দ ১/৮৯-৯১

[3]. নুযহাতুল খাওয়াতির ৫/১২১

[4]. এই অনুবাদ করার অপরাধে (!) দিল্লীর দুষ্ট আলেমরা তাঁকে কাফের আখ্যা দিয়ে হত্যার ফৎওয়া জারি করে এবং লোকজনকে তাঁর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয় (দ্র. ড. আব্দুর রহমান ফিরিওয়াঈ, জুহূদু আহলিল হাদীছ ফী খিদমাতিল কুরআনিল কারীম (বেনারস : জামে‘আ সালাফিয়া, ১ম প্রকাশ, ১৪০০ হিঃ/১৯৮০ খ্রিঃ), পৃঃ ১১, আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ২৪৬)।-অনুবাদক

[5]. আযহারী আলেম আল্লামা মুহাম্মাদ মুনীর দামেশকী এটিকে আরবীতে রূপান্তর করেন। তবে চতুর্থ অধ্যায়ের ৫ম অনুচ্ছেদ المقطعاة القرآنية বা ‘কুরআনের বিচ্ছিন্ন অক্ষর সমূহ’ অংশটুকুর আরবী অনুবাদ করেন মাওলানা ই‘যায আলী দেওবন্দী (দ্র. জুহূদু আহলিল হাদীছ ফী খিদমাতিল কুরআনিল কারীম, পৃঃ ৭)।-অনুবাদক

[6]. নুযহাতুল খাওয়াতির ৭/২৭৩

[7]. শাহ আব্দুল আযীযের ছাত্র রফীউদ্দীন মুরাদাবাদী ‘আল-ইফাদাত আল-আযীযিয়া ওয়াত তাহকীকাত আন-নাফীসাহ’ নামে এটি সংকলন করেন (দ্র. জুহূদু আহলিল হাদীছ ফী খিদমাতিল কুরআনিল কারীম, পৃঃ ১৩)।-অনুবাদক

[8]. নুযহাতুল খাওয়াতির ৭/২৯৫

[9]. এই তিনটি অনুবাদের মূল পান্ডুলিপি শাহ মুহাম্মাদ ইসহাক দেহলভীর নিকট সংরক্ষিত ছিল। বৃটিশ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সিপাহসালার মাওলানা বেলায়াত আলী ছাদেকপুরী তাঁর নিকট উক্ত অনুবাদত্রয় প্রকাশ করার অনুমতি প্রার্থনা করেন এবং ইসহাক দেহলভীর ছাত্র রফীউদ্দীন বারদোআনীকে তা প্রকাশ করার ব্যাপারে রাযী করান। ফলে বারদোআনী ১০ হাযার রূপী দিয়ে একটি নতুন প্রেস ক্রয় করে নিজ খরচে উক্ত অনুবাদ তিনটি প্রকাশ করেন (দ্র. গোলাম রসূল মেহের, জামা‘আতে মুজাহিদীন, পৃঃ ২৯৭-৩০১; জুহূদু আহলিল হাদীছ ফী খিদমাতিল কুরআনিল কারীম, পৃঃ ১৮-১৯)।-অনুবাদক

[10]. সাইয়িদ নূরুল হাসান হুসাইনী এটিকে আরবীতে রূপান্তর করেছেন (দ্র. জুহূদু আহলিল হাদীছ ফী খিদমাতিল কুরআনিল কারীম, পৃঃ ২৪)।-অনুবাদক

[11]. তিনি নওলকিশোর নামক এক হিন্দু ব্যক্তির অনুরোধে এই তাফসীরটি রচনা করেন। ১৯০২ সালে এটি প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য, উক্ত হিন্দুর নামেই প্রতিষ্ঠিত নওলকিশোর প্রেস ভারতীয় উপমহাদেশে বেশ প্রসিদ্ধ। তিনি এই প্রেস থেকে হাদীছ, ফিকহ ও তাফসীরের শত শত গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। মালীহাবাদীর তাফসীরটি ছাপতে পারার কারণে প্রেস মালিক নওলকিশোর গর্ববোধ করতেন। কারণ তার ধারণা এর মাধ্যমে তিনি ইসলাম ও মুসলমানদের দারুণ উপকার করেছেন (দ্র. জুহূদু আহলিল হাদীছ ফী খিদমাতিল কুরআনিল কারীম, পৃঃ ৩৫)।-অনুবাদক

[12]. এই তাফসীরের ভূমিকায় মাওলানা অমৃতসরী ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, তাঁর তাফসীর প্রকাশিত হওয়ার পর মাওলানা আশরাফ আলী থানবী ‘বায়ানুল কুরআন’ লিখেন এবং তাঁর তাফসীর দ্বারা প্রভাবিত হন (দ্র. জুহূদু আহলিল হাদীছ ফী খিদমাতিল কুরআনিল কারীম, পৃঃ ৪১)।-অনুবাদক

[13]. এই তাফসীরটি প্রকাশিত হওয়ার পর মিসরের ‘আল-আহরাম’ ও ‘আল-মানার’ পত্রিকা দু’টি অমৃতসরীকে ভারতের একজন অন্যতম বড় ইসলামী চিন্তাবিদ হিসাবে আখ্যায়িত করে। তাছাড়া শিবলী একাডেমী (আযমগড়, ইউপি) থেকে প্রকাশিত ‘মা‘আরিফ’ (উর্দূ) পত্রিকা এটিকে পাঠ্যসূচীভুক্ত করার পক্ষে মত প্রকাশ করে (দ্র. জুহূদু আহলিল হাদীছ ফী খিদমাতিল কুরআনিল কারীম, পৃঃ ৪১-৪২)।-অনুবাদক

[14]. মাওলানা আবুল কালাম আযাদ সর্বপ্রথম ‘বুরহান ওয়া বাছায়ির’ নামে কুরআন মাজীদের তাফসীর লেখা শুরু করেছিলেন। কিন্তু সিআইডি তাঁর কাগজপত্র তল্লাশি করার সময় ঐ তাফসীরের পান্ডুলিপিও নিয়ে যায়। পরবর্তীতে তিনি এর একটি পৃষ্ঠাও পাননি। এরপর তিনি ‘তারজুমানুল কুরআন’ লেখা শুরু করেন। যার অধিকাংশ রাঁচী ও মীরাঠের সেন্ট্রাল জেলে লিখেন। মাওলানার ভাষ্য অনুযায়ী ২৭ বছরের অধিক সময় ব্যাপী তিনি ‘তারজুমানুল কুরআন’ লিপিবদ্ধ করেন (দ্র. মাওলানা আব্দুল মজীদ খাদেম সোহদারাভী, সীরাতে আযাদ (লাহোর : মুসলিম পাবলিকেশন্স, তা.বি), পৃঃ ৬৪)। ‘ছাকাফাতুল হিন্দ’ পত্রিকায় মাওলানার এই তাফসীরের আরবী অনুবাদ কয়েক কিস্তিতে প্রকাশিত হয়। অনুরূপভাবে ড. সাইয়িদ আব্দুল খতীফ হায়দারাবাদী এর ইংরেজী অনুবাদ করেন। ঐতিহাসিক গোলাম রসূল মেহের মাওলানার প্রবন্ধ ও গ্রন্থাবলীতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কতিপয় আয়াতের অনুবাদ ও তাফসীর ‘বাকিয়াতে তারজুমানুল কুরআন’ নামে প্রকাশ করেন। তাছাড়া ‘আল-কাওলুন মাতীন ফী তাফসীরে সূরা ওয়াত-তীন’ নামে তিনি সূরা তীনের তাফসীর লিখেন। যেটি ১৩৪০ হিজরীতে লাহোরের কারীমী প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় (দ্র. জুহূদু আহলিল হাদীছ ফী খিদমাতিল কুরআনিল কারীম, পৃঃ ৫৩-৫৪)।- অনুবাদক

[15]. এটি ছিল উর্দূ দৈনিক, বাংলা নয়।-অনুবাদক

[16]. মাওলানা আকরম খাঁ তাঁর প্রতিষ্ঠিত দৈনিক ‘সেবক’ পত্রিকায় ১৯২১ সালে ‘অগ্রসর! অগ্রসর!!’ শিরোনামে একটি জ্বালাময়ী সম্পাদকীয় লিখলে তদানীন্তন বৃটিশ সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে ১ বছর বন্দী করে রাখে। এ সময় তিনি কুরআন মাজীদের ৩০তম পারার বঙ্গানুবাদ ও তাফসীর করেন। ১৯২২ সাথে এটি প্রথম প্রকাশিত হয় (দ্র. ড. মুহাম্মাদ মুজীবুর রহমান, বাংলা ভাষায় কুরআন চর্চা (ঢাকা : ইফাবা, ২য় সংস্করণ, ২০০৯), পৃঃ ১১১, ১১৩; আবু জাফর সম্পাদিত, মাওলানা আকরম খাঁ (ঢাকা : ইফাবা, ২য় সংস্করণ, ১০০৭, পৃঃ ১৬৯)।তাছাড়া তিনি ৬ খন্ডে ‘তাফসীরুল কোরআন’ নামে বাংলা ভাষায় কুরআন মাজীদের প্রথম পূর্ণাঙ্গ তাফসীর লিখেছেন।-অনুবাদক

[17]. আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলীর ইংরেজী অনুবাদের ভূমিকা, পৃঃ ১৩






আল্লাহর উপর ভরসা - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
ঘোড়ার গোশত : হালাল নাকি হারাম? একটি পর্যালোচনা - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (রহঃ)-এর জীবনের কতিপয় শিক্ষণীয় ঘটনা - ড. নূরুল ইসলাম
ওয়াহ্হাবী আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ; মুসলিম বিশ্বে এর প্রভাব (৪র্থ কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
ক্ষমা প্রার্থনা : এক অনন্য ইবাদত - ইহসান ইলাহী যহীর
ঈদে মীলাদুন্নবী - আত-তাহরীক ডেস্ক
বিদায়ের আগে রেখে যাও কিছু পদচিহ্ন (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
খতমে নবুঅত আন্দোলন ও আহলেহাদীছ ওলামায়ে কেরাম - ড. নূরুল ইসলাম
খেয়াল-খুশির অনুসরণ (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
পুনরুত্থান - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
ঈছালে ছওয়াব : একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
কুরআন ও হাদীছের আলোকে ‘সোনামণি’র ৫টি নীতিবাক্য - ড. মুহাম্মাদ আব্দুল হালীম
আরও
আরও
.