ফিলিস্তীন
প্রসঙ্গ বাদ দিলে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোটামুটি স্থিতিশীলই
ছিল গত কয়েক দশক। এ কথা অনস্বীকার্য যে, রাজতন্ত্র আর যাইহোক স্থিতিশীল
রেখেছিল মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে। কিন্তু বিদ্যুৎ চমকের মত দপ করে সারা
মধ্যপ্রাচ্যে গণআন্দোলনের বহ্নিশিখা জ্বলে উঠল। চারিদিকে শুরু হ’ল একই
আওয়াজ- সরকারের পতন চাই, পতন চাই। তিউনিসিয়া, মিশর, লিবিয়া, জর্ডান,
লেবানন, মরক্কো হয়ে বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ে জর্ডান, বাহরাইন, ইয়েমেন
পর্যন্ত। এমনকি খোদ সৌদি আরবেও ছড়িয়ে পড়ে এর রেশ। অতঃপর অভূতপূর্বভাবে
তাসের ঘরের মত পতন ঘটতে থাকে একের পর এক লৌহমানবখ্যাত শাসকদের। এই পতনধারার
সূত্রপাত ঘটে এ বছরের শুরুতে ১৪ই জানুয়ারীতে তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট বেন
আলীকে দিয়ে। তিনি ঐ দিন তার মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দিয়ে স্বদেশ ছেড়ে পালিয়ে
যান। এই সফলতায় উৎসাহিত হয়ে গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে শুরু হয় সরকারবিরোধী
বিক্ষোভ। ক্ষোভের উত্তপ্ত দমকা বাতাসে গোটা মধ্যপ্রাচ্যের মরুবালুকা এখন
গনগনে অগ্নিশিখা হয়ে জ্বলছে। কিন্তু কেন এই আন্দোলন? কেন হঠাৎ ক্ষেপে উঠল
জনগণ। শাসকের শোষণ? নিরবচ্ছিন্ন বঞ্চণার ছাইচাপা দ্রোহ, না কোন ষড়যন্ত্র?
এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে। কারণ বেন আলীর ২৩ বছর, হোসনী মোবারকের ৩০ বছর,
গাদ্দাফীর ৪০ বছরের ক্ষমতাকালীন এই দীর্ঘ সময়ে এমন আন্দোলন তো কখনো কেউ
দেখেনি? হঠাৎ করে জনগণ বিপুল তেজে ফুঁসে উঠল কেন? তবে কেউ কি আড়াল থেকে
জনগণকে ব্যবহার করে আপন স্বার্থ হাছিল করছে? উৎস কোথায় এ আন্দোলনের?
বক্ষমাণ প্রবন্ধে সেটাই বিশ্লেষণের প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
বিশাল মধ্যপ্রাচ্য : একটি বিশাল ভূ-ভাগের সম্মিলিত নাম মধ্যপ্রাচ্য। বিশ্বসভ্যতার এক সুপ্রাচীন গৌরবজ্জ্বল কেন্দ্রভূমি এই অঞ্চল। অতীতে এর বিভিন্ন এলাকা বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। মধ্যপ্রাচ্য নামটি এসেছে ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময়। সে থেকেই এ নামের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। ১ম বিশ্বযুদ্ধের আগে গোটা মধ্যপ্রাচ্য এলাকা ছিল ওছমানীয় সালতানাতের অন্তর্গত। ইউরোপে তখন এ এলাকাকে নিকটপ্রাচ্য বলে অভিহিত করা হ’ত। ১ম বিশ্বযুদ্ধের পর ওছমানীয় সালতানাত ভেঙ্গে বলকান এলাকায় অনেকগুলো স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। তখন নিকটপ্রাচ্য নামটি অপ্রচলিত হয়ে পড়ে। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় পূর্ব ইরান থেকে মিশরের পশ্চিম সীমান্ত পর্যন্ত এলাকাকে সামরিক ও ল্যান্ড লীজ পলিসির দিক দিয়ে এক মনে করা হ’ত। তখনই সামরিক বিশেষজ্ঞরা এর নামকরণ করে মধ্যপ্রাচ্য। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর এ এলাকাকে কেউ দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া আবার কেউ পশ্চিম এশিয়া নামে অভিহিত করে। তবে কালক্রমে মধ্যপ্রাচ্য নামটিই অধিক জনপ্রিয়তা লাভ করে। উল্লেখ্য, অধিকাংশের মতে মুসলিম জাহানের আরবী ভাষাভাষী ২২টি দেশ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য গঠিত।
মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট : মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সকল রাষ্ট্রে রাজতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্রের নামে একেক জন শাসক অনির্দিষ্ট কালের জন্য ক্ষমতা অাঁকড়ে ধরে আছেন দীর্ঘদিন যাবৎ। নিজেকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাজা মনে করে এসব শাসকদের অনেকেই গড়ে তুলেছেন একচেটিয়াভাবে অঢেল সম্পদের পাহাড়। তাঁদের আত্মীয়-স্বজনরা দুর্নীতির মাধ্যমে একেকজন বনে গেছে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ধনকুবের। যাদের টাকায় চলে ইউরোপ-আমেরিকার ব্যাংকগুলো। ফলে স্বভাবতই সাধারণ জনগণের স্বার্থ-চাহিদার প্রতি শাসকদের নযর ছিল শিথিল। এ অবস্থা চলে আসছে দশকের পর দশক ধরে। এতদস্বত্ত্বেও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকার কারণে আরব জনগণ এ শাসনব্যবস্থার সাথে নিজেদের মানিয়ে রেখেছে দীর্ঘকাল ধরেই। কিন্তু হঠাৎই শান্ত মধ্যপ্রাচ্য অশান্ত হয়ে পড়ল। তিউনিসিয়ার রাজধানী থেকে বেশ দূরের সিরি বৌজিদ শহরে বুয়াজিজি নামক এক যুবক কোন চাকুরী জুটাতে না পেরে রাস্তায় ফল বিক্রি করত। একদিন বখরা দাবী করে বসে এক পুলিশ কর্মকর্তা। এই অন্যায় দাবী পূরণে রাযী না হওয়ায় উক্ত কর্মকর্তা তার ফলের গাড়ীটি বাজেয়াপ্ত করে। ন্যায়বিচারের আশায় বুয়াজিজি গিয়েছিল প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে। কিন্তু সেখানেও সে বিচার পায়নি। ফলে সেই অফিস থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমেই সে ক্ষোভে নিজের শরীরে আগুন লাগিয়ে দেয়। দিনটি ছিল ২০১০ সালের ১৭ই ডিসেম্বর। এ তরুণ যখন নিজের শরীরে আগুন লাগিয়ে দিল তখন তিউনিসিয়া, মিশর, লিবিয়া, সুদান, ইয়েমেনের শাসকরা কল্পনাও করতে পারেনি এ আগুনের অাঁচ তাদের গায়ে লাগবে। বুয়াজিজির জ্বলন্ত শরীর থেকে জন্ম নেওয়া দ্রোহের স্ফুলিঙ্গে প্রথমে পুড়ল তার স্বদেশ তিউনিসিয়া। চার সপ্তাহ ধরে চলতে থাকা প্রবল গণ আন্দোলনের মুখে অবশেষে ২৩ বছরের একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটে। যায়নুদ্দীন বিন আলী সপরিবারে পালাতে বাধ্য হন। তারপর গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে শুরু হয় আন্দোলন। আর সেই আন্দোলনে ঘি ঢেলে দেয় অদৃশ্য একটি মহল। ফলে অচিন্তনীয়ভাবে দপদপ করে জ্বলে ওঠে বিক্ষোভের আগুন। যার অভাবনীয় বিস্তার দেখছে বিশ্ববাসী।
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের ঘটনা প্রবাহ : তিউনিসিয়ার মত মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোতেও শুরু হয় গণআন্দোলন। নিম্নে কয়েকটি দেশের পরিস্থিতি আলোচনা করা হ’ল-
মিশর : ইতিহাস-ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক অবস্থানের দিক থেকে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশ মিশর। বৃটিশ শাসনামল থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই মিশর পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর পদলেহী হিসাবে কাজ করে যাচ্ছে। তেল সমৃদ্ধ আরব ভূখন্ডে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের দখলদারিত্ব নিশ্চিত রাখার জন্য পশ্চিমাদের সৃষ্ট জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরাঈলের সঙ্গে মিশর দুই দুইবার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। প্রথমবার ১৯৭৩ সালে এবং দ্বিতীয়বার ১৯৭৬ সালে। ১৯৭৯ সালে এই মিশর সকল মুসলিম রাষ্ট্রের ঐক্যমতকে অগ্রাহ্য করে ইসরাঈলের সাথে শান্তিচুক্তি করে। তখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন আনোয়ার সাদাত। এর খেসারত হিসাবে আততায়ীর হাতে নিহত হন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত। অতঃপর ১৯৮১ সালের অক্টোবর মাসে ক্ষমতায় অভিষিক্ত হন তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট হোসনী মোবারক। ৩০ বছরে হোসনী মোবারক পরিণত হন মার্কিন-ইসরায়েল অপশক্তির পরম বন্ধুতে। তিউনিসিয়ার গণআন্দোলনের অনুসরণে অনেকটা হঠাৎ করেই শুরু হয় মিসরের গণআন্দোলন। দুর্নীতি, বেকারত্ব ও দারিদ্রের বিস্তার প্রভৃতি ইস্যু তুলে হোসনী মোবারকের পদত্যাগের দাবীতে ১২ ফেব্রুয়ারী ’১১ তাহরীর স্কোয়ারে সমবেত হয়েছিল ২০ লক্ষ মানুষ। অবশেষে মাত্র ২ সপ্তাহের আন্দোলনে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন হোসনী মোবারক।
মরক্কো : তিউনিসিয়ার গণবিক্ষোভের ধারাবাহিকতায় মরক্কোতেও তরুণরা রাজপথে নেমে আসে। খাদ্য দ্রব্যের ঊর্ধ্বমূল্য, বেকারত্ব বৃদ্ধি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে। ২১শে জানুয়ারী আন্দোলনকারীদের চারজন শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে আন্দোলনের গতি আরো বৃদ্ধি পায়। পরিশেষে আন্দোলনের রেশ টেনে ধরার জন্য সুলতান মুহাম্মদের সরকার আটা, ময়দা, ভোজ্য তেল, চিনি ও জ্বালানীর উপর ভুর্তুকী প্রদানের ঘোষণা দেন।
আলজেরিয়া : তিউনিসিয়ার সবচেয়ে নিকটবর্তী রাষ্ট্র আলজেরিয়া। জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী মাস জুড়ে ক্ষোভে উত্তাল ছিল পুরো দেশ। মূলতঃ খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে। অন্তত ৮ জন বিক্ষোভকারী শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয় বুয়াজিজির অনুকরণে। সশস্ত্র বাহিনীর সাথে সংঘাতে নিহত হয় পাঁচজন ও আহত হয় শতাধিক। শেষ পর্যন্ত সরকার বাধ্য হয় খাদ্যশস্যের মূল্য হ্রাস ও আমদানী বৃদ্ধি করতে।
জর্দান : জর্দানে বিক্ষোভ শুরু হয় জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহ থেকে। রাজধানী আম্মান সহ গোটা দেশের তরুণরা রাজপথে নেমে আসে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও উন্নত জীবন-যাপনের নিশ্চয়তার দাবীতে। অর্থনৈতিক বিপর্যয়, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারত্বের কারণে ক্ষুদ্ধ ছিল জনসাধারণ। প্রধানমন্ত্রী সামির রিকাইয়ি বিক্ষুদ্ধ তরুণদের বশে আনতে নতুন অর্থনৈতিক প্যাকেজ ঘোষণা করলেও আন্দোলনের গতি বাড়তেই থাকে। শেষ পর্যন্ত বাদশাহ দ্বিতীয় আব্দুল্লাহ সামির রিফায়ির সরকারকে পদচ্যুত করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মারূফ আল-বাকীতকে সরকারপ্রধান হিসাবে নিয়োগ দেন।
ইয়েমেন : আরব বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র এই দেশটির মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেকই বাস করে দারিদ্রসীমার নিচে। প্রেসিডেন্ট আলী আব্দুল্লাহ দালেহ টানা ৩২ বছর ধরে রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন। দুর্নীতি, অদক্ষতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের প্রতিবাদে পুরো ইয়েমেন উত্তাল থাকে জানুয়ারীর দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে। নগরীর এডেনে এক তরুণ শরীরে আগুন লঅগিয়ে দিলে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। আলী আব্দুল্লাহ সরকারের পদত্যাগের দাবীতে ১০ লক্ষ মানুষ রাজধানী সানার রাজপথ দখল করে। সেনাবাহিনীর বেতন-ভাতা বৃদ্ধি, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যে সরকারী ভাতা বাড়ানোর মতো উদ্যোগেও আন্দোলনকারীরা সন্তুষ্ট না হ’লে প্রেসিডেন্ট বাধ্য হন ঘোষণা দিতে যে, পরবর্তী নির্বাচনে তিনি আর রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হবেন না।
লিবিয়া : লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলী এখন রক্তাক্ত প্রান্তর। সেখানে নির্বিচারে চলছে গণহত্যা। বিরোধীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হত্যার শপথ নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফি। সেনাবাহিনী লেলিয়ে দিয়েছেন বিদ্রোহীদের পেছনে। কিন্তু তবু দমেনি লিবিয়ার বিক্ষোভকারীরা। জনগণ একদফা আন্দোলন করছে চার দশকের স্বৈরশাসক কর্ণেল মুয়াম্মার গাদ্দাফীর শাসন অবসানকল্পে। কিন্তু গাদ্দাফিও ছাড়বেন না ক্ষমতা। বহির্বিশ্বের শত হুমকি নিষেধ কিছুরই তোয়াক্কা তিনি করছেন না। ফলে পুরো লিবিয়া সরকারপন্থী আর বিদ্রোহীদের পাল্টাপাল্টি আক্রমণে অগ্নিগর্ভে পরিণত হয়েছে। এই উপযুক্ত মওকা পেয়ে পশ্চিমা শক্তি সামরিক হস্তক্ষেপের নামে গত ১৯ মার্চ তারিখ হ’তে লিবিয়ায় বিমান হামলা শুরু করেছে। প্রতিনিয়ত সেখানে নিহত হচ্ছে হাযার হাযার বেসামরিক লোক।
মধ্যপ্রাচ্য আন্দোলনের উৎস : হঠাৎ ঝড়ে লু হওয়া বইছে মধ্যপ্রাচ্যে! প্রশ্ন উঠতেই পারে, কেন এই আন্দোলন? জনগণ কি রাজতন্ত্রের হাত থেকে মুক্তি পেতে চায়? নাকি প্রায় স্থায়ী ভাবে জেঁকে বসা বঞ্চনা-লাঞ্চনার অবসান চায়? তাহ’লে এতদিন কেন তার আলামত দেখা যায়নি? হঠাৎ কেন এভাবে জেগে উঠল তারা? আন্দোলনের কারণগুলোও দেখা যাচ্ছে প্রায় সবদেশেই এক ও অভিন্ন। তবে এসব অভিযোগ কি সত্যিই এতবড় আন্দোলন গড়ে তোলার পক্ষে খুব উপযুক্ত ইস্যু? এসব রহস্যের গোঁড়া খুঁজতে প্রথমেই আমাদের সামনে আসে আন্তর্জাতিক ইসলাম বিরোধী মহল। যারা সবসময় সুযোগ মত ইসলামের সর্বনাশ সাধনে তৎপর। এদের সর্বদা লক্ষ্য থাকে মুসলমানদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদের সর্বনাশ করা এবং বহু ইসলামী দেশের ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট করা। এমনটিই অনুমান করা যায় মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনা প্রবাহে।
স্পষ্টতঃই অনভূত হচ্ছে যে, ইসলামবিদ্বেষী মহলটি এখানে সুচতুরভাবে পেছনে থেকে অদৃশ্য শক্তি হয়ে কাজ করে যাচ্ছে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে। এ দৃশ্য আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় সাতশত বছর পূর্বের স্পেনীয় মুসলিম শাসনের অবসানের দৃশ্যপটে। তৎকালীন স্পেনের মুসলমানদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদের সর্বনাশ করেছিল ইসলামবিরোধী শক্তি। তারা এমনভাবে ষড়যন্ত্রের বীজ বপন করেছিল যার জন্য মুসলমানরা তাদের সেই তেজদীপ্ত শক্তি ও সাহস নিয়ে গর্জে উঠতে পারেনি। স্পেনে মুসলিম শাসন অবসানের ঠিক আগ মুহূর্তে রাজা ফার্ডিন্যান্ড ও রাণী ইসাবেলা সৈন্যসহ গ্রানাডা নগরী ঘিরে ফেলেছে। বাদশাহ আবু আব্দুল্লাহ তখন তার মন্ত্রীদের নিয়ে রাজদরবারে বসেছেন কর্তব্য-করণীয় আলোচনা করতে। বাদশাহ সবার কাছে জানতে চাইলেন কি করা যায়? তখন তরুণ সেনাপতি মুসা বিন আবী গাস্সান দাঁড়িয়ে বললেন হে বাদশাহ! আমরা মুসলিম জাতি। আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংগ্রাম ও সাহসিকতার। আমাদের শরীরে সেই বীরদের রক্ত প্রবাহিত যারা নিজেদের রক্তকে ইসলামের জন্য ঢেলে দিয়েছিলেন। মুসলিম জাতি চির অজেয়। তাই আমার পরামর্শ জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত ইসলামের জন্য যুদ্ধ করব। আসুন আমরা আমাদের সৈন্যবাহিনী নিয়ে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি...। কিন্তু গাদ্দারে ভরা রাজার দরবারে তার এই তেজোদ্দীপ্ত ভাষণ শোনার কেউ ছিল না। ফলে শত্রুবাহিনীর সাথে সন্ধির পক্ষেই সবাই মত দিল। যা চীরকালের জন্য স্পেনের জনসাধারণের ললাটে লিখে দিল গোলামীর অঙ্গীকারনামা। স্পেন থেকে চিরতরে বিদায় নিল ইসলামী শাসন। আজ ঠিক ঐ মহলই মধ্যপ্রাচ্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। পেছন থাকে তারা জনগণকে উস্কানী দিয়ে নষ্ট করছে ইসলামী রাষ্ট্রসমূহের স্থিতিশীলতা। যার অনিবার্য ভবিষ্যৎ হ’তে পারে মধ্যপ্রাচ্যের ভাঙ্গন। আর মধ্যপ্রাচ্য ভাঙ্গলেই আরো দুর্বল হয়ে যাবে মুসলিম বিশ্ব। সেই সুযোগে মুসলমানদের চিরকালের জন্য কব্জা করে ফেলবে ঐ মহলগুলো। যেমনটি ঘটেছে ইরাক, আফগানিস্তানে। শান্তি রক্ষার দোহাই দিয়ে তারা তছনছ করে দিয়েছে দেশগুলো। হত্যা করেছে লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ মানুষকে। আর ঐ দেশের সরকারকে করেছে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন। তেমনটিই তারা করতে চায় মধ্যপ্রাচ্যে। আর এই ষড়যন্ত্রকারী মহলই এ আন্দোলনের প্রধান উৎস।
কেন এই ষড়যন্ত্র : মধ্যপ্রাচ্যে যে ষড়যন্ত্র চলছে তা কিসের জন্য? কেন এই ষড়যন্ত্র? আসলে ইসলাম বিরোধী মহলটি আপাতত চায় মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিবর্তন। আর এই পরিবর্তন হ’লে উত্থান ঘটবে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির। আর এই রাজনীতির ধারক বাহক হবে পশ্চিমাদের পা-চাটা গোলাম। আর এই অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির সুযোগে জন্ম হবে নতুন নতুন ইরাকের। শান্তিরক্ষার দোহাই দিয়ে সেখানে হাযির হবে পশ্চিমা শক্তি। আর তারা কব্জা করবে দেশগুলোর শাসনক্ষমতা। মুছে দেবে সেখান থেকে ইসলামের নাম ও নিশানা। মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি দেশ তেল সমৃদ্ধ। গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে এসব দেশে একটি নড়বড়ে সরকারের ক্ষমতারোহনের পথ সুগম করে তেল হাতিয়ে নেওয়াও তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য। তাদের সৃষ্ট জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরাঈলকে রক্ষা করতে হ’লে, মধ্যপ্রাচ্যে চাই তাদের অনুগত সরকার। তাদের সকল ষড়যন্ত্রের লক্ষ্য এটাই।
পরিশেষে বলব, মুসলিম জাতি সংগ্রামী জাতি। চিরদিনই তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছে। কিন্তু সব ষড়যন্ত্র চূড়ান্ত পর্যায়ে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা যদি আমাদের ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখতে পারি তাহ’লেই ষড়যন্ত্র যতই হোক তা সফল হ’তে পারবে না। অতএব আসুন হে মুসলিম উম্মাহ! নিজেদের মাঝে অপ্রয়োজনীয় লড়াই বন্ধ করি। নিজেদের ভুল নিজেরাই সংশোধনে প্রয়াসী হই। অন্যের আদর্শ, অন্যের সমাজব্যবস্থার মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজেদের আদর্শের উপর অটল থাকি। মহান আল্লাহর নিকট কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা- আমরা যেন রাসূল (ছাঃ)-এর আদর্শের উপর অটল থেকে সারা পৃথিবীময় ইমারত ও খেলাফতের ভীত মজবুত করতে পারি। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!!
যাকওয়ান হুসাইন
আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।