ভূমিকা :
মানুষ নেক আমল করতে সক্ষম হ’লেও পাপাচার বর্জনে অনেক ক্ষেত্রে অক্ষম হয়ে যায়। অথচ এমন অনেক পাপ আছে, যা মানুষের আমল বিনষ্ট ও নিষ্ফল করে দেয়। এতে সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই নেকী অর্জনের পাশাপাশি পাপ বর্জনের সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। কেননা এটা অনেক নফল ইবাদত অপেক্ষা উত্তম। আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞেস করল,أَيُّمَا أَحَبُّ إلَيْك رَجُلٌ قَلِيلُ الذُّنُوبِ قَلِيلُ الْعَمَلِ، أَوْ رَجُلٌ كَثِيرُ الذُّنُوبِ كَثِيرُ الْعَمَلِ؟ فَقَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ : لَا أَعْدِلُ بِالسَّلَامَةِ شَيْئًا. ‘কোন্ ব্যক্তি আপনার কাছে পসন্দনীয়? যে ব্যক্তি অল্প পাপ করে ও স্বল্প আমল করে সে, নাকি যে ব্যক্তি অধিক পাপ করে ও অধিক আমল করে সে? তিনি বললেন, গোনাহ থেকে নিরাপদ থাকার সমতুল্য আমল আমি কোনটিকে মনে করি না’।[1] হাসান বছরী (রহঃ) বলতেন,مَا عَبَدَ الْعَابِدُونَ بِشَيْءٍ أَفْضَلَ مِنْ تَرْكِ مَا نَهَاهُمُ اللهُ عَنْه ‘আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয়গুলো থেকে বেঁচে থাকা অপেক্ষা উত্তম ইবাদত কোন ইবাদতকারী করতে পারেনি’।[2]
পাপাচার পরিত্যাগ করা ব্যতীত আল্লাহর প্রিয় বান্দা হওয়া যায় না। এজন্য নবী করীম (ছাঃ) বলেন,اتَّقِ المَحَارِمَ تَكُنْ أَعْبَدَ النَّاسِ، ‘তুমি হারাম থেকে বেঁচে থাক সবচেয়ে বড় ইবাদতগুযার হ’তে পারবে’।[3] তাই পাপাচার তথা আল্লাহর অবাধ্যতা ও রাসূলের নাফরমানী থেকে সর্বতোভাবে বিরত থাকার চেষ্টা অব্যাহত রাখা মুমিনের কর্তব্য। নিম্নে পাপ থেকে বেঁচে থাকার কিছু উপায় আলোচনা করা হ’ল।-
১. ঈমানকে সুদৃঢ় করা :
হৃদয়ের গভীরে ঈমানের বীজকে লালন-পালন করে তাকে পত্র-পল্লবে সুশোভিত মহীরূহে পরিণত করার চেষ্টা অব্যাহত রাখা মুমিনের কর্তব্য। কেননা ঈমান যত মযবূত হয়, অন্তরে আল্লাহভীতি তত সুদৃঢ় হয়। ফলে বান্দা পাপাচার থেকে বিরত থাকার শক্তি অর্জন করে। আল্লাহ বলেন,اَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِيْنَ آمَنُوْا اَنْ تَخْشَعَ قُلُوْبُهُمْ لِذِكْرِ اللهِ وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ ‘মুমিনদের কি সে সময় আসেনি যে, তাদের হৃদয় সমূহ বিগলিত হবে আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য নাযিল হয়েছে, তার কারণে? (হাদীদ ৫৭/১৬)। সুতরাং প্রবৃত্তির তাড়নায় পাপে নিমজ্জিত না হয়ে প্রবৃত্তিকে দমন করে পাপ থেকে দূরে থাকার এবং আল্লাহর উপরোক্ত বাণীর কথা চিন্তা করে সকল প্রকার পাপ পরিহার করতে হবে।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِنَّ اللهَ يُدْنِى الْمُؤْمِنَ فَيَضَعُ عَلَيْهِ كَنَفَهُ، وَيَسْتُرُهُ فَيَقُولُ أَتَعْرِفُ ذَنْبَ كَذَا، أَتَعْرِفُ ذَنْبَ كَذَا فَيَقُولُ نَعَمْ أَىْ رَبِّ. حَتَّى إِذَا قَرَّرَهُ بِذُنُوبِهِ وَرَأَى فِى نَفْسِهِ أَنَّهُ هَلَكَ، قَالَ سَتَرْتُهَا عَلَيْكَ فِى الدُّنْيَا، وَأَنَا أَغْفِرُهَا لَكَ الْيَوْمَ. فَيُعْطَى كِتَابَ حَسَنَاتِهِ، ‘আল্লাহ মুমিন ব্যক্তিকে নিজের কাছে নিয়ে আসবেন এবং তার উপর স্বীয় আবরণ দ্বারা তাকে ঢেকে নিবেন। তারপর বলবেন, অমুক অমুক পাপের কথা কি তুমি জান? তখন সে বলবে, হ্যাঁ, হে আমার প্রতিপালক! এভাবে তিনি তার কাছ হ’তে তার পাপগুলো স্বীকার করিয়ে নিবেন। আর সে মনে করবে যে, তার ধ্বংস অনিবার্য। তখন আল্লাহ বলবেন, আমি পৃথিবীতে তোমার পাপ গোপন করে রেখেছিলাম। আর আজ আমি তা মাফ করে দিব। তারপর তার সৎকর্মের আমলনামা তাকে দেয়া হবে’।[4] প্রকৃত মুমিন হ’লেই কেবল উক্ত মর্যাদা পাওয়া যাবে, নইলে নয়।
২. আল্লাহর নযরদারীতে থাকা :
বান্দা আল্লাহর দৃষ্টিসীমার বাইরে যাওয়ার আদৌ কোন ক্ষমতা রাখে না। তার প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সব বিষয় মহান আল্লাহর গোচরীভূত। তাঁর থেকে কোন কিছু লুকানোর কোন সুযোগ বান্দার নেই এবং এটা করতে সে সক্ষম নয়। আল্লাহ বলেন, وَاعْلَمُوا أَنَّ اللهَ يَعْلَمُ مَا فِي أَنْفُسِكُمْ فَاحْذَرُوهُ ‘আর জেনে রেখ যে, আল্লাহ তোমাদের অন্তরের খবর রাখেন। অতএব তাঁকে ভয় কর’ (বাক্বারাহ ২/২৩৫)। তিনি আরো বলেন,وَكَانَ اللهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ رَقِيبًا ‘বস্ত্ততঃ আল্লাহ সবকিছুর উপরে পর্যবেক্ষক’ (আহযাব ৩৩/৫২)। ইমাম আহমাদ (রহঃ) বলেন,
إِذَا مَا خَلَوْتَ الدَّهْرَ يَوْمًا فلا تقل * خلوت ولكن في الخلاء رَقِيبُ
وَلَا تَحْسَبَنَّ اللهَ يَغْفَلُ سَاعَةً * وَلَا آثما يخفى عليه يغيب
‘যদি জীবনে এক দিনও একাকী হও, তখন বল না আমি নির্জনে আছি। বরং নির্জনেও তত্ত্বাবধায়ক আছেন। আর তুমি ভেবো না যে, আল্লাহ মুহূর্তের জন্যও অমনোযোগী হন। কোন গোপন পাপীও তাঁর থেকে অদৃশ্য হ’তে পারে না’।[5]
অতএব প্রত্যেকের জানা উচিৎ যে, আমরা সকলেই আল্লাহর নযরদারীতে আছি। তাঁর থেকে কোন কিছু গোপন করার কোন সুযোগ বা ক্ষমতা কারো নেই। আল্লাহ বলেন,أَلَمْ يَعْلَمْ بِأَنَّ اللهَ يَرَى، ‘সে কি জানে না যে, আল্লাহ তার সব কিছুই দেখেন? (আলাক্ব ৯৬/১৪)। তিনি আরো বলেন,أَلَا يَعْلَمُ مَنْ خَلَقَ وَهُوَ اللَّطِيفُ الْخَبِيرُ، ‘তিনি কি জানবেন না, যিনি সৃষ্টি করেছেন? বস্ত্ততঃ তিনি অতীব সূক্ষ্মদর্শী ও সবকিছু সম্যক অবহিত’ (মুলক ৬৭/১৪)।
মহান আল্লাহ অতীব সূক্ষ্মদর্শী, কোন কিছুই তাঁর দৃষ্টি এড়ায় না। তিনি বলেন, يَعْلَمُ خَائِنَةَ الْأَعْيُنِ وَمَا تُخْفِي الصُّدُورُ ‘তিনি জানেন তোমাদের চোখের চোরাচাহনি এবং অন্তর সমূহ যা লুকিয়ে রাখে’ (মুমিন ৪০/১৯)। অন্যত্র তিনি বলেন,وَاتَّقُوا اللهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا، ‘আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যার দোহাই দিয়ে তোমরা পরস্পরের নিকট প্রার্থনা করে থাক এবং রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তা সম্পর্কে সতর্ক থাক। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের উপর সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষক’ (নিসা ৪/১)। সুতরাং আল্লাহর দৃষ্টি থেকে যেহেতু পালানোর সুযোগ নেই, সেহেতু যাবতীয় গোনাহ থেকে দূরে থাকা কর্তব্য। মানুষকে সাবধান করে আল্লাহ বলেন, وَيُحَذِّرُكُمُ اللهُ نَفْسَهُ وَإِلَى اللهِ الْمَصِيرُ ‘আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর (প্রতিশোধ গ্রহণ) সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছেন। আর আল্লাহর কাছেই সকলের প্রত্যাবর্তনস্থল’ (আলে ইমরান ৩/২৮)। বান্দা যখন আল্লাহর নযরদারীকে ভয় করবে এবং তা থেকে সতর্ক হবে তখন সে যাবতীয় গোনাহ থেকে দূরে থাকতে সক্ষম হবে।
৩. আত্মসমালোচনা করা :
মুহাসাবাহ বা আত্মসমালোচনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যা মানুষকে সদা-সর্বদা সীমালংঘন ও পাপাচার পরিহারে সহায়তা করে। ব্যক্তির ভাল-মন্দ কাজ-কর্ম সম্পর্কে নিজেই চিন্তা-ভাবনা করাই হচ্ছে ‘আত্মসমালোচনা’। মহান আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَلْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَا قَدَّمَتْ لِغَدٍ وَاتَّقُوا اللهَ إِنَّ اللهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ، وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ نَسُوا اللهَ فَأَنْسَاهُمْ أَنْفُسَهُمْ أُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ- ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আর প্রত্যেক ব্যক্তির উচিৎ এ বিষয়ে ভেবে দেখা যে, সে আগামী দিনের জন্য কি অগ্রিম প্রেরণ করছে? আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে সম্যক অবহিত। আর তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে। অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে আত্মভোলা করে দিয়েছেন। ওরাই হ’ল অবাধ্য’ (হাশর ৫৯/১৮-১৯)।
পরকালে মহান আল্লাহ বান্দাকে তার কৃতকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন এবং তাকে তার আমলের কারণে শাস্তি দিবেন অথবা শান্তি দিবেন। আল্লাহ বলেন,فَوَرَبِّكَ لَنَسْأَلَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ، عَمَّا كَانُوا يَعْمَلُونَ، ‘অতএব তোমার প্রতিপালকের শপথ! অবশ্যই আমরা তাদের সকলকে প্রশ্ন করব সেই সব বিষয়ে যা তারা করত’ (হিজর ১৫/৯২-৯৩)। এ আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আমাদের প্রত্যেককে ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে স্ব স্ব কর্মের ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে। সুতরাং সেদিনের পূর্বে দুনিয়াতেই আমাদের প্রত্যেককে নিজেদের আমল হিসাব করে সাবধানতা অবলম্বন করা যরূরী।
ইবনু মাসউদ (রাঃ) নবী (ছাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন,لَا تَزُولُ قَدَمُ ابْنِ آدَمَ يَوْمَ القِيَامَةِ مِنْ عِنْدِ رَبِّهِ حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ خَمْسٍ، عَنْ عُمُرِهِ فِيمَ أَفْنَاهُ، وَعَنْ شَبَابِهِ فِيمَ أَبْلَاهُ، وَمَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَ أَنْفَقَهُ، وَمَاذَا عَمِلَ فِيمَا عَلِمَ ‘ক্বিয়ামতের দিন আদম সন্তানের পদদ্বয় একটুও নড়াতে পারবে না যতক্ষণ না তাকে পাঁচটি বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে- ১. তার বয়স সম্পর্কে, সে তা কী কাজে ব্যয় করেছে? ২. তার যৌবন সম্পর্কে, সে তা কী কাজে ক্ষয় করেছে? ৩. তার ধন-সম্পদ সম্পর্কে, সে তা কোথা হতে উপার্জন করেছে? ৪. আর তা কোথায় ব্যয় করেছে? এবং ৫. যে জ্ঞানার্জন করেছে, সে অনুযায়ী আমল করেছে কি-না’?[6]
ওমর ফারূক (রাঃ) বলেন,حاسبوا أنفسكم قبل أن تحاسبوا، وزنوها أنفسكم قبل أن توزنوا، ‘তোমরা আল্লাহর নিকট হিসাব দেওয়ার আগে নিজেদের হিসাব গ্রহণ কর’।[7]
হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন,حاسبوا أنفسكم قبل أن تحاسبوا، وانظروا ماذا ادخرتم لأنفسكم من الأعمال الصالحة ليوم معادكم وعرضكم على ربكم. ‘তোমরা নিজেরা তোমাদের আমলের হিসাব করে নেও, তোমাদের হিসাব দেওয়ার পূর্বে। তোমরা তোমাদের নিজেদের জন্য যা সৎকর্ম জমা করেছ পুনরুত্থান দিবসে তোমাদের রবের সামনে পেশ করার জন্য, তার প্রতি লক্ষ্য কর’।[8]
মায়মূন ইবনে মিহরান (রহঃ) বলেন,لا يكون العبد تقياً حتى يكون لنفسه أشد محاسبة من الشريك لشريكه، ‘কোন বান্দা ততক্ষণ পর্যন্ত তাক্বওয়াশীল হ’তে পারে না যতক্ষণ না সে অত্যধিক আত্মসমালোচনাকারী হয় নফসের ব্যাপারে তার শরীকের মতো’।[9]
হাসান বাছরী (রহঃ) বলেন,الْمُؤْمِنُ قَوَّامٌ عَلَى نَفْسِهِ يُحَاسِبُ نَفْسَهُ لِلَّهِ عَزَّ وَجَلَّ، وَإِنَّمَا خَفَّ الْحِسَابُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَى قَوْمٍ حَاسَبُوا أَنْفُسَهُمْ فِي الدُّنْيَا، وَإِنَّمَا شَقَّ الْحِسَابُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَى قَوْمٍ أَخَذُوا هَذَا الْأَمْرَ مِنْ غَيْرِ مُحَاسَبَةٍ، ‘মুমিন নফসের বিরুদ্ধে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, সে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আত্মসমালোচনা করে। আর ক্বিয়ামতের দিন তাদের হিসাব হালকা হয় যারা দুনিয়াতে নিজেদের (আমলের) হিসাব করে নেয়। পক্ষান্তরে ক্বিয়ামতের দিন তাদের হিসাব কঠিন হয় যারা দুনিয়াতে আত্মসমালোচনা বিহিন কাজ করে’।[10]
অতএব বান্দা নিজের ভাল-মন্দ কর্ম সম্পর্কে চিন্তা করবে তথা আত্মসমালোচনা করবে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে থাকলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবে এবং তা আরো বেশী করার জন্য আল্লাহর নিকটে তাওফীক কামনা করবে। পক্ষান্তরে পাপকাজ হয়ে গেলে অনুতপ্ত হবে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। অতঃপর তা হ’তে দূরে থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। তাই মুহাসাবাহ বা আত্মসমালোচনা বান্দার জন্য অতি যরূরী বিষয়।
৪. সৎকর্মে লিপ্ত থাকা :
মানুষ কোন সৎকাজে ব্যস্ত থাকলে শয়তান তাকে কুমন্ত্রণা দিতে পারে না। ফলে সে পাপাচার থেকে মুক্ত থাকার সুযোগ লাভ করে। তাছাড়া অনেক নেক আমল গোনাহ মিটিয়ে দেয়। আল্লাহ বলেন,إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ ذَلِكَ ذِكْرَى لِلذَّاكِرِينَ، ‘নিশ্চয়ই সৎকর্মসমূহ মন্দ কর্মসমূহকে বিদূরিত করে। আর এটি (কুরআন) হ’ল উপদেশ গ্রহণকারীদের জন্য (সর্বোত্তম) উপদেশ’ (হূদ ১১/১১৪)। হাদীছে এসেছে, আবূ যার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, قَالَ لِي رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: اتَّقِ اللهِ حَيْثُمَا كُنْتَ، وَأَتْبِعِ السَّيِّئَةَ الحَسَنَةَ تَمْحُهَا، وَخَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ، ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বলেছেন, তুমি যেখানেই থাক আল্লাহকে ভয় কর, পাপকাজের পরপরই সৎকাজ কর, তাতে পাপ দূরীভূত হয়ে যাবে। আর মানুষের সাথে উত্তম আচরণ কর’।[11]
সৎকর্ম করতে থাকলে তার সাথে আরো নেক আমল করার সুযোগ হয়। আর যাকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে, সে কাজ তার জন্য করা সহজ হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,أَمَّا أَهْلُ السَّعَادَةِ فَيُيَسَّرُونَ لِعَمَلِ السَّعَادَةِ، وَأَمَّا أَهْلُ الشَّقَاوَةِ فَيُيَسَّرُونَ لِعَمَلِ الشَّقَاوَةِ، ‘যারা সৌভাগ্যবান, তাদের জন্য সৌভাগ্যের আমল সহজ করে দেওয়া হয়। আর ভাগ্যাহতদের জন্য দুর্ভাগ্যের আমল সহজ করে দেওয়া হয়। এরপর তিনি এ আয়াত তেলাওয়াত করলেন, فَأَمَّا مَنْ أَعْطَى وَاتَّقَى، وَصَدَّقَ بِالْحُسْنَى، فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْيُسْرَى، وَأَمَّا مَنْ بَخِلَ وَاسْتَغْنَى، وَكَذَّبَ بِالْحُسْنَى، فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْعُسْرَى- ‘অতঃপর যে ব্যক্তি দান করে ও আল্লাহভীরু হয় এবং উত্তম বিষয়কে সত্য বলে বিশ্বাস করে, অচিরেই আমরা তাকে সরল পথের জন্য সহজ করে দেব। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কৃপণতা করে ও বেপরওয়া হয় এবং উত্তম বিষয়কে মিথ্যা মনে করে, অচিরেই আমরা তাকে কঠিন পথের জন্য সহজ করে দেব’ (লায়ল ৯২/৫-১০)।[12]
৫. আল্লাহর যিকরে মশগূল থাকা :
যিকর মুমিন জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। যে ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া প্রত্যেকের জন্য যরূরী। কেননা আল্লাহর স্মরণ বেশী করা হৃদয়ের সঞ্জীবনী, তার সৌভাগ্য ও প্রশান্তি লাভের মাধ্যম। আল্লাহ বলেন,الَّذِينَ آمَنُوا وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُمْ بِذِكْرِ اللهِ أَلَا بِذِكْرِ اللهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ، ‘যারা আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং আল্লাহকে স্মরণ করলে যাদের অন্তরে প্রশান্তি আসে। মনে রেখো, আল্লাহর স্মরণেই কেবল হৃদয় প্রশান্ত হয়’ (রা‘দ ১৩/২৮)।
আবূদদারদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,أَلَا أُنَبِّئُكُمْ بِخَيْرِ أَعْمَالِكُمْ، وَأَزْكَاهَا عِنْدَ مَلِيكِكُمْ، وَأَرْفَعِهَا فِي دَرَجَاتِكُمْ وَخَيْرٌ لَكُمْ مِنْ إِنْفَاقِ الذَّهَبِ وَالوَرِقِ، وَخَيْرٌ لَكُمْ مِنْ أَنْ تَلْقَوْا عَدُوَّكُمْ فَتَضْرِبُوا أَعْنَاقَهُمْ وَيَضْرِبُوا أَعْنَاقَكُمْ؟ قَالُوا: بَلَى. قَالَ: ذِكْرُ اللهِ تَعَالَى، قَالَ مُعَاذُ بْنُ جَبَلٍ: مَا شَيْءٌ أَنْجَى مِنْ عَذَابِ اللهِ مِنْ ذِكْرِ اللهِ، ‘আমি তোমাদেরকে কি তোমাদের অধিক উত্তম কাজ প্রসঙ্গে জানাব না, যা তোমাদের মনিবের নিকট সবচেয়ে পবিত্র, তোমাদের সম্মানের দিক হ’তে সবচেয়ে উঁচু, স্বর্ণ ও রৌপ্য দান-ছাদাক্বাহ করার চেয়েও অতি উত্তম এবং তোমাদের শত্রুর মুকাবিলায় অবতীর্ণ হয়ে তাদেরকে তোমাদের সংহার করা ও তোমাদেরকে তাদের সংহার করার চাইতেও ভাল? তারা বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেন, আল্লাহ তা‘আলার যিকর। মু‘আয ইবনু জাবাল (রাঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলার শাস্তি হ’তে মুক্তি পাওয়ার জন্য আল্লাহর যিকরের তুলনায় অগ্রগণ্য কোন জিনিস নেই’।[13] অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَثَلُ الَّذِى يَذْكُرُ رَبَّهُ وَالَّذِى لاَ يَذْكُرُ مَثَلُ الْحَىِّ وَالْمَيِّتِ. ‘যে তার প্রতিপালকের যিকর করে, আর যে যিকর করে না, তাদের উপমা হ’ল জীবিত ও মৃত ব্যক্তি’।[14]
যিকির শয়তান থেকে আত্মরক্ষার শক্তিশালী দুর্গ। আল্লাহ বলেন,اسْتَحْوَذَ عَلَيْهِمُ الشَّيْطَانُ فَأَنسَاهُمْ ذِكْرَ اللهِ أُوْلَئِكَ حِزْبُ الشَّيْطَانِ أَلَا إِنَّ حِزْبَ الشَّيْطَانِ هُمُ الْخَاسِرُونَ ‘শয়তান তাদের উপর বিজয়ী হয়েছে। ফলে সে তাদেরকে আল্লাহর স্মরণ ভুলিয়ে দিয়েছে। ওরা হ’ল শয়তানের দল। জেনে রেখ, নিশ্চয়ই শয়তানের দলই ক্ষতিগ্রস্ত’ (মুজাদালাহ ৫৮/১৯)। অতএব নিয়মিত যিকির করতে পারলে ধীরে ধীরে আল্লাহর সান্নিধ্যের সার্বক্ষণিক অনুভূতি অন্তরে গ্রথিত হবে এবং গুনাহ থেকে বের হওয়া সহজ হয়ে যাবে।
রাস্তা-ঘাটে চলাফেরার সময়ও যিকির করার চেষ্টা করা কর্তব্য। আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِينَ اتَّقَوْا إِذَا مَسَّهُمْ طَائِفٌ مِنَ الشَّيْطَانِ تَذَكَّرُوا فَإِذَا هُمْ مُبْصِرُونَ، ‘নিশ্চয়ই যারা আল্লাহকে ভয় করে, শয়তানের কুমন্ত্রণা স্পর্শ করার সাথে সাথে তারা সচেতন হয়ে যায় এবং তাদের জ্ঞানচক্ষু খুলে যায়’ (আ‘রাফ ৭/২০১)। এ আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, গাফেল অন্তরে শয়তান কুমন্ত্রণা দেয়। আর যিকরের মাধ্যমে তা প্রতিহত করা যায়।
হারেছ আল-আশ‘আরী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,آمُرُكُمْ أَنْ تَذْكُرُوا اللهَ، فَإِنَّ مَثَلَ ذَلِكَ كَمَثَلِ رَجُلٍ خَرَجَ العَدُوُّ فِي أَثَرِهِ سِرَاعًا حَتَّى إِذَا أَتَى عَلَى حِصْنٍ حَصِينٍ فَأَحْرَزَ نَفْسَهُ مِنْهُمْ، كَذَلِكَ العَبْدُ لَا يُحْرِزُ نَفْسَهُ مِنَ الشَّيْطَانِ إِلَّا بِذِكْرِ اللهِ، ‘আমি তোমাদেরকে আল্লাহর যিক্র করার নির্দেশ দিচ্ছি। এর উদাহরণ হ’ল ঐ ব্যক্তির মত, যাকে তার দুশমন দ্রুতবেগে পিছু ধাওয়া করল। অতঃপর সে একটি সুরক্ষিত দুর্গের ভিতরে ঢুকল এবং নিজেকে শত্রুদের থেকে রক্ষা করে নিল। এমনিভাবে বান্দা আল্লাহর যিক্র ছাড়া নিজেকে শয়তান থেকে রক্ষা করতে পারে না’।[15] ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়াহ (৭৫১হিঃ) বলেন, ‘সর্বদা মহান আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা‘আলার যিকরে লিপ্ত থাকা আল্লাহ কর্তৃক বান্দাকে ভুলে যাওয়া থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। আর এটা (বান্দাকে ভুলে যাওয়া) ইহকাল ও পরকালীন জীবনে বান্দার দুর্ভাগ্যের কারণ হয়। অপরদিকে বান্দাকে আল্লাহর ভুলে যাওয়ার কারণে সে নিজেকে ও নিজের কল্যাণকারিতা ভুলে যায়। আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে। অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে আত্মভোলা করে দিয়েছেন। ওরাই হ’ল অবাধ্য’ (হাশর ৫৯/১৯)। আর বান্দা যখন আত্মভোলা হয় তখন নিজের কল্যাণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, সে তা ভুলে যায় এবং তা থেকে দূরে থাকে। ফলে সে ধ্বংস ও বিনাশ হয়ে যায়’।[16]
মহান আল্লাহ বান্দাকে যিকর থেকে গাফেল না হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন এবং গাফেল হওয়ার পরিণতিও বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন না করে। যারা এরূপ করবে (অর্থাৎ উদাসীন হবে), তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত’ (মুনাফিকূন ৬৩/৯)। অন্যত্র তিনি বলেন,وَمَنْ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنْكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَى ‘আর যে ব্যক্তি আমার কুরআন হ’তে মুখ ফিরিয়ে নিবে, তার জীবিকা হবে সংকুচিত এবং ক্বিয়ামতের দিন আমরা তাকে উঠাব অন্ধ অবস্থায়’ (তোয়াহা ২০/১২৪)।
যারা আল্লাহর যিকর করে মহান আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে দেন। তিনি বলেন,وَالذَّاكِرِينَ اللهَ كَثِيرًا وَالذَّاكِرَاتِ أَعَدَّ اللهُ لَهُمْ مَغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيمًا- ‘আল্লাহকে অধিকহারে স্মরণকারী পুরুষ ও নারী, এদের জন্য আল্লাহ প্রস্ত্তত রেখেছেন ক্ষমা ও মহা পুরস্কার’ (আহযাব ৩৩/৩৫)।
৬. গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করা :
পাপ থেকে বেঁচে থাকা কঠিন হ’লেও অসম্ভব নয়। তাই এই কষ্টসাধ্য বিষয়ের জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশা নিয়ে চেষ্টা করলে সফলতা অনিবার্য। তবে মনে রাখতে হবে যে, এক দিনে কিংবা এক রাতেই মানুষ গোনাহ ছেড়ে দিয়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে উঠবে, এমন নয়। বরং এজন্য কষ্ট করতে হবে এবং গোনাহ পরিত্যাগের ব্যাপারে আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। তাহ’লে আল্লাহর সাহায্যও মিলবে। আল্লাহ বলেন,وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ اللهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِينَ، ‘আর যারা আমাদের রাস্তায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, আমরা অবশ্যই তাদেরকে আমাদের রাস্তা সমূহের দিকে পরিচালিত করব। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সাথে থাকেন’ (আনকাবূত ২৯/৬৯)। সুতরাং নফসে আম্মারাহ (কুপ্রবৃত্তি) যাতে গোনাহে লিপ্ত করাতে না পারে সেজন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা ধৈর্যধারণ কর ও ধৈর্যের প্রতিযোগিতা কর এবং সদা প্রস্ত্তত থাক। আর আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা সফলকাম হ’তে পার’ (আলে ইমরান ৩/২০০)। পাপ বর্জনে ধৈর্যের সাথে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ومن يتصبَّر يُصبِّره الله ‘যে ধৈর্য ধারণ করতে চায়, আল্লাহ তাকে তাই দান করেন’।[17] আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত,أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ دَخَلَ عَلَى شَابٍّ وَهُوَ فِي المَوْتِ، فَقَالَ: كَيْفَ تَجِدُكَ؟ قَالَ: وَاللهِ يَا رَسُولَ اللهِ، إِنِّي أَرْجُو اللهَ، وَإِنِّي أَخَافُ ذُنُوبِي، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا يَجْتَمِعَانِ فِي قَلْبِ عَبْدٍ فِي مِثْلِ هَذَا الْمَوْطِنِ إِلَّا أَعْطَاهُ اللهُ مَا يَرْجُو وَآمَنَهُ مِمَّا يَخَافُ، ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এক যুবকের নিকট গেলেন। তখন সে মুমূর্ষ অবস্থায় ছিল। তিনি বললেন, তোমার কেমন অনুভূত হচ্ছে? যুবকটি বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আল্লাহর শপথ! আল্লাহ তা‘আলার রহমতের আশা করছি, কিন্তু আবার ভয়ও পাচ্ছি আমার গুনাহগুলোর কারণে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, যে বান্দার হৃদয়ে এরকম সময়ে এরূপ দু’জিনিস (ভয় ও আশা) একত্র হয়, আল্লাহ তা‘আলা অবশ্যই তার কাঙ্ক্ষিত জিনিস তাকে দান করেন এবং তাকে তার শংকা হ’তে নিরাপদ রাখেন’।[18]
সর্বোপরি অহি-র বিধান মেনে চললে তথা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করলে পাপের পথ থেকে দূরে থাকা সম্ভব হবে। আল্লাহ বলেন,فَاسْتَمْسِكْ بِالَّذِي أُوحِيَ إِلَيْكَ إِنَّكَ عَلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ، ‘অতএব তুমি দৃঢ়ভাবে ধারণ কর যা তোমার প্রতি অহি করা হয়। নিশ্চয়ই তুমি সরল পথের উপর প্রতিষ্ঠিত’ (যুখরুফ ৪৩/৪৩)।
৭. প্রবৃত্তির অনুসারী না হওয়া :
প্রবৃত্তির পূজারী হওয়ার কারণে মানুষ নানা পাপাচার ও নাফরমানীতে লিপ্ত হয়ে পড়ে। সেজন্য মহান আল্লাহ বান্দাকে প্রবৃত্তির অনুসারী হ’তে নিষেধ করেছেন এবং প্রবৃত্তি- পূজারীদের থেকে দূরে থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন। কেননা তাদের সাথে থাকলে তাদের রীতিনীতির অনুসারী হয়ে পড়বে। আল্লাহ বলেন,وَإِنَّ كَثِيرًا لَيُضِلُّونَ بِأَهْوَائِهِمْ بِغَيْرِ عِلْمٍ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِالْمُعْتَدِينَ، ‘নিশ্চয়ই বহু লোক অজ্ঞতাবশে নিজেদের প্রবৃত্তি দ্বারা তাড়িত হয়ে লোকদের পথভ্রষ্ট করে। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক সীমালংঘন-কারীদের বিষয়ে ভালভাবেই অবগত’ (আন‘আম ৬/১১৯)। অন্যত্র তিনি বলেন,وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ وَاحْذَرْهُمْ أَنْ يَفْتِنُوكَ عَنْ بَعْضِ مَا أَنْزَلَ اللهُ إِلَيْكَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَاعْلَمْ أَنَّمَا يُرِيدُ اللهُ أَنْ يُصِيبَهُمْ بِبَعْضِ ذُنُوبِهِمْ وَإِنَّ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ لَفَاسِقُونَ، ‘আর তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করবে না। আর তাদের ব্যাপারে সতর্ক থেকো, যেন তারা তোমাকে আল্লাহ প্রেরিত কোন বিধানের ব্যাপারে বিভ্রান্তিতে না ফেলে। কিন্তু তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে জেনে রেখ যে, আল্লাহ চান তাদেরকে তাদের কিছু কিছু পাপের দরুন (পার্থিব জীবনে) শাস্তি প্রদান করতে। বস্ত্ততঃ লোকদের মধ্যে অনেকেই আছে পাপাচারী’ (মায়েদাহ ৫/৪৯)। সুতরাং মহান আল্লাহ স্বীয় রাসূল ও তাঁর বান্দাদেরকে প্রবৃত্তি ও প্রবৃত্তিপূজারীদের অনুসারী হওয়া থেকে সতর্ক করেছেন।
আল্লাহ প্রবৃত্তিপূজারীদের উদাহরণ পবিত্র কুরআনে এভাবে উল্লেখ করেছেন,وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ الَّذِي آتَيْنَاهُ آيَاتِنَا فَانْسَلَخَ مِنْهَا فَأَتْبَعَهُ الشَّيْطَانُ فَكَانَ مِنَ الْغَاوِينَ، وَلَوْ شِئْنَا لَرَفَعْنَاهُ بِهَا وَلَكِنَّهُ أَخْلَدَ إِلَى الْأَرْضِ وَاتَّبَعَ هَوَاهُ فَمَثَلُهُ كَمَثَلِ الْكَلْبِ إِنْ تَحْمِلْ عَلَيْهِ يَلْهَثْ أَوْ تَتْرُكْهُ يَلْهَثْ ذَلِكَ مَثَلُ الْقَوْمِ الَّذِينَ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا فَاقْصُصِ الْقَصَصَ لَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ، ‘আর তুমি তাদেরকে সেই ব্যক্তির কথা শুনিয়ে দাও, যাকে আমরা আমাদের অনেক নিদর্শন (নে‘মত) প্রদান করেছিলাম। কিন্তু সে তা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। ফলে শয়তান তার পিছু নেয় এবং সে পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। যদি আমরা চাইতাম তাহ’লে উক্ত নিদর্শনাবলী অনুযায়ী কাজ করার মাধ্যমে অবশ্যই তার মর্যাদা আরও উন্নত করতে পারতাম। কিন্তু সে মাটি আঁকড়ে রইল ও নিজ প্রবৃত্তির অনুসারী হ’ল। তার দৃষ্টান্ত হ’ল কুকুরের মত। যদি তুমি তাকে তাড়িয়ে দাও তবুও হাঁপাবে, আর যদি ছেড়ে দাও তবুও হাঁপাবে। এটি হ’ল সেই সব লোকদের উদাহরণ যারা আমাদের আয়াত সমূহে মিথ্যারোপ করে। অতএব তুমি এদের কাহিনী বর্ণনা কর, যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে’ (আ‘রাফ ৭/১৭৫-৭৬)। এ আয়াতে খেয়াল-খুশির অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন। কেননা মহান আল্লাহ ঐসব মানুষকে হেদায়াত করেন না। তিনি বলেন,أَنَّمَا يَتَّبِعُونَ أَهْوَاءَهُمْ وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنِ اتَّبَعَ هَوَاهُ بِغَيْرِ هُدًى مِنَ اللهِ إِنَّ اللهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ، ‘তারা কেবল তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর হেদায়াতকে অগ্রাহ্য করে নিজের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে, তার চাইতে বড় পথভ্রষ্ট আর কে আছে? নিশ্চয়ই আল্লাহ যালেম সম্প্রদায়কে সুপথ প্রদর্শন করেন না (ক্বাছাছ ২৮/৫০)।
মহান আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে ধমক দিয়ে বলেন,أَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ أَفَأَنْتَ تَكُونُ عَلَيْهِ وَكِيلاً؟ ‘তুমি কি তাকে দেখেছ, যে তার প্রবৃত্তিকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছে? তুমি কি তার যিম্মাদার হবে?’ (ফুরক্বান ২৫/৪৩)। তিনি রাসূলকে তাদের অনুসারী হ’তে নিষেধ করে বলেন, ‘তুমি ঐ ব্যক্তির আনুগত্য করো না যার অন্তরকে আমরা আমাদের স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি এবং সে তার খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে ও তার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে গেছে’। ‘তুমি বলে দাও যে, সত্য এসেছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে। অতএব যে চায় তাতে বিশ্বাস স্থাপন করুক। আর যে চায় তাতে অবিশ্বাস করুক; আমরা সীমালংঘনকারীদের জন্য আগুন প্রস্ত্তত করে রেখেছি’ (কাহ্ফ ১৮/২৮-২৯)। এই নিষেধাজ্ঞা রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর উম্মতের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য।
অপরদিকে বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) প্রবৃত্তি পূজাকে ধ্বংসকারী আখ্যায়িত করে বলেন,وَأَمَّا الْمُهْلِكَاتُ : فَهَوًى مُتَّبَعٌ، وَشُحٌّ مُطَاعٌ، وَإِعْجَابُ الْمَرْءِ بِنَفْسِهِ، وَهِيَ أَشَدُّهُنَّ- ‘আর ধ্বংসকারী তিনটি বস্ত্ত হ’ল (১) প্রবৃত্তি পূজারী হওয়া (২) লোভের দাস হওয়া এবং (৩) আত্ম অহংকারী হওয়া। আর এটিই হ’ল সবচেয়ে মারাত্মক’।[19]
স্মর্তব্য যে, প্রবৃত্তি পূজা বা খেয়াল-খুশীর অনুসারী হয়ে মানুষ স্বজ্ঞানে বা অজ্ঞাতে পাপের চোরাগলিতে ঢুকে পড়ে অন্ধকারেই পথ হাতড়াতে থাকে। অতঃপর কখনও সফল হয়, কখনও বিফল হয়। তাই খেয়ালীপনা ছেড়ে দিয়ে পৃথিবীর কর্মক্ষেত্রে আমলে ছালেহ সম্পাদন করে নেকী অর্জনের সর্বাত্মক চেষ্টাই হবে মুমিনের সতত সাধনা।
৮. মুমিন-মুত্তাক্বীকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করা :
মানুষ সাধারণত সঙ্গী-সাথী ব্যতিরেকে একাকী থাকতে পারে না। আবার যাদের সে চলা-ফেরা করে তাদের রীতি-নীতি, আচার-আচরণের অনেক কিছুই তার মধ্যে পরিস্ফূট হয়ে ওঠে। বন্ধু বা সঙ্গীর দ্বারা সে প্রভাবিত হয়।[20] এজন্য প্রত্যেককে ঈমানদার, মুত্তাক্বী ও সৎকর্মশীল বন্ধু নির্বাচন করা কর্তব্য। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,لَا تُصَاحِبْ إِلَّا مُؤْمِنًا، وَلَا يَأْكُلْ طَعَامَكَ إِلَّا تَقِيٌّ، ‘তুমি মুমিন ব্যতীত অন্য কারো সঙ্গী হবে না এবং তোমার খাদ্য যেন কেবল পরহেযগার লোকে খায়’।[21] ইবনে খালদূন বলেন,فلابدَّ له من صاحبٍ أو صديق، هذا الصديق ينبغي أن يكون صالحا، ‘প্রত্যেক সঙ্গী বা বন্ধুর জন্য আবশ্যক হ’ল, এই বন্ধু যেন সৎ-ন্যায়পরায়ণ হ’তে হয়’।
কথায় বলে, ‘সৎসঙ্গে স্বর্গবাস অসৎসঙ্গে সর্বনাশ’। এক্ষেত্রে ফার্সী কবি শেখ সাদী রচিত ‘সৎ সঙ্গ’ কবিতা (বঙ্গানুবাদ) প্রণিধানযোগ্য,
গন্ধ মধুর কর্দম মোরে একদা
দিলেন বন্ধু, ছিলাম যখন নাইতে।
কহিলাম তারে, কসুতরী কিবা কি তুমি?
সুবাসে তোমার পাগল এমন তাইতে
কহিল সে মোরে, তুচ্ছ কর্দম আমি গো,
ফুলসহ ছিনু কতকাল এক ঠাইতে;
সংগীর গুণ পশিয়াছে মম মাঝে গো,
নইলে কাদায় সুবাতাস কি এতো পাইতে?
সুতরাং বন্ধু সদা দ্বীনদার ও মুত্তাক্বী-পরহেযগার হওয়া যরূরী। কেননা তাক্বওয়াহীনের সাহচর্য দ্বীন থেকে বিচ্যুত করে, ব্যক্তিত্ব হ্রাস করে, সন্দেহ ও নিষিদ্ধ বিষয়ে পতিত করে। তার মন্দকর্মের ফিৎনা থেকে নিরাপদ করে না, গর্হিত বস্ত্তর দিকে দৃষ্টিপাত থেকে দূরে রাখে না। ধীরে ধীরে চৌর্যবৃত্তি, মাদকাসক্তিসহ অন্যান্য হীন কর্মে জড়িয়ে পড়তে উৎসাহ যোগায়। কোন মানুষকে তার বন্ধুবান্ধব যতদ্রুত ফিৎনায় নিপতিত করে অন্য কোন জিনিস ততটা করে না। তদ্রূপ সে তার সঙ্গী-সাথীদের ব্যাপারে যতটা চিন্তা করে ততটা অন্য বিষয়ে খুব কমই করে। ফলে বন্ধুদের দ্বারাই সে অধিক প্রভাবিত হয়।
অপরদিকে মুমিন বন্ধু তাকে পরিশীলিত করে, তার মান-মর্যাদা বৃদ্ধি করে। সে সদা বন্ধুকে উপদেশ দেয়, তাকে ধোঁকা দেয় না। সে আন্তরিক হয়, মোসাহেব হয় না; সে সাহায্য করে, ছেড়ে যায় না। সে সদা বন্ধুর দ্বীনদারীর ব্যাপারে সতর্ক থাকে যেভাবে নিজের দ্বীনের ব্যাপারে থাকে হুঁশিয়ার। সে নিজের জন্য যা পসন্দ করে বন্ধুর জন্যও তাই পসন্দ করে। সুতরাং দ্বীনদার বন্ধু বিপদে সাহায্যকারী-সহযোগী হয় এবং সুখ-সাচ্ছন্দ্যে সুহৃদ হিসাবে সুখকে ভাগাভাগি করে নেয়। [ক্রমশঃ]
[1]. আবুল হাসান আল-মাওয়ার্দী, আদাবুদ দুনিয়া ওয়াদ দ্বীন (দারু মাকতাবাতিল হায়াত, ১৯৮৬ খ্রিঃ), ৯৮; ইবনুল মুবারাক, আয-যুহদ, ১/২২ পৃঃ।
[2]. জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম, পৃঃ ২৯৬।
[3]. তিরমিযী হা/২৩০৫; ছহীহাহ হা/৯৩০; ছহীহুল জামে‘ হা/১০০।
[4]. বুখারী হা/২৪৪১, ৪৬৮৫, ৬০৭০, ৭৫১৪; মিশকাত হা/৫৫৫১।
[5]. হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ), আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ (বৈরূত : দারুল ফিকর, ১৪০৭ হিঃ/১৯৮৬ খ্রিঃ), ১০/২৩৩ পৃঃ।
[6]. তিরমিযী হা/২৪১৬; ছহীহাহ হা/৯৪৬; ছহীহুল জামি‘ হা/৭২৯৯; ছহীহুত তারগীব হা/১২৮; মিশকাত হা/৫১৯৭।
[7]. তিরমিযী হা/২৪৫৯, মওকূফ।
[8]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ৪/৪০৪ পৃঃ।
[9]. ইবনুল ক্বাইয়িম, ইগাছাতুল লাহফান, ১/৩৩; ওয়াকী‘, আয-যুহদ পৃঃ ২৩৯; ইবনু আবিদ দুনিয়া, মুহাসাবাতুন নাফস, (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, তাবি) পৃঃ ৭; ইবনু আবী শায়বা ৭/১৭৯, ২৩৫।
[10]. মুহাসাবাতুন নাফস, পৃঃ ৬০।
[11]. তিরমিযী হা/১৯৮৭; মিশকাত হা/৫০৮৩; ছহীহুল জামে‘ হা/৯৭।
[12]. বুখারী হা/১৩৬২; মিশকাত হা/৮৫।
[13]. তিরমিযী হা/৩৩৭৭; ইবনু মাজাহ হা/৩৭৯০; মিশকাত হা/২২৬৯।
[14]. বুখারী হা/৬৪০৭; মুসলিম হা/৭৭৯; মিশকাত হা/২২৬৩।
[15]. তিরমিযী হা/২৮৬৩; ছহীহুত তারগীব হা/৫, সনদ ছহীহ।
[16]. ইবনুল কাইয়েম আল-জাওযিয়াহ, আল-ওয়াবিলুছ ছাইয়িবি মিনাল কালিমিত তাইয়িব, (কায়রো : দারুল হাদীছ, ৩য় সংস্করণ, ১৯৯৯ খ্রিঃ), পৃঃ ৪৬।
[17]. বুখারী হা/১৪৬৯; মুসলিম ‘যাকাত’ অধ্যায়; আবু দাউদ হা/১৬৪৪।
[18]. তিরমিযী হা/৯৮৩; ইবনু মাজাহ হা/৪২৬১; মিশকাত হা/১৬১২, সনদ হাসান।
[19]. বায়হাক্বী শো‘আব হা/৬৮৬৫; মিশকাত হা/৫১২২ ‘শিষ্টাচার সমূহ’ অধ্যায় ‘ক্রোধ ও অহংকার’ অনুচ্ছেদ; ছহীহাহ হা/১৮০২।
[20]. আবু দাউদ হা/৪৮৩৩; মিশকাত হা/৫০১৯; ছহীহাহ হা/১৯২৭।
[21]. আবু দাউদ হা/৪৮৩২; তিরমিযী হা/২৩৯৫; ছহীহুল জামে‘ হা/৭৩৪১।