মাসিক আত-তাহরীক-এর ৪র্থ বর্ষের প্রথম সম্পাদকীয় লিখতে হচ্ছে এমন এক সময় যখন আকস্মিক প্রলয়ংকরী বন্যায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৭টি যেলা বিশেষ করে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত যশোরের শার্শা উপযেলা ও ‘বন্যামুক্ত এলাকা’ বলে পরিচিত সাতক্ষীরা যেলা উজানের দেশ থেকে আসা অথৈ প্লাবনে ডুবে আছে। বন্যা ভাসিয়ে নিয়ে গেছে তাদের ভিটেমাটি, বাড়ী-ঘর ও মূল্যবান তৈজসপত্র, অতি আদরের গবাদিপশু এমনকি কোলের সন্তানটিকেও। ভেসে গেছে বাড়ির হাঁস-মুরগী, পুকুরের পোষা মাছ ও ঘেরের কোটি কোটি টাকার মৎস্য সম্পদ। একই গ্রামের একই মা-বাবার কাছ থেকে নিষ্ঠুর বন্যা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে ১৫, ৭ ও ৩ বছরের তিন তিনটি নাবালক সন্তানকে। বোবা হয়ে গেছে বাপ, বিলাপ করছে মা। কালকে যাদের সব ছিল, আজকে তারা নিঃস্ব বানভাসি। কাল যারা ভিক্ষা দিত, আজ তারা ভিক্ষাপ্রার্থী। কাল যাদের ঘরে ছিল হাসি-কান্না ও আনন্দের কলরোল, আজ তাদের সেই সাজানো বাড়ি, গোছানো সংসারের চিহ্ন মাত্র নেই। হারিয়ে গেছে তাদের মুখের হাসি, হারিয়ে গেছে ভাষা, ভেসে গেছে তাদের সকল স্বপ্নসাধ। বিধ্বস্ত ঘর-বাড়ি, বিনষ্ট ফসলাদি, ক্ষুধার্ত গবাদিপশু ও দিশেহারা মানবতার আহাজারিতে ক্রমেই ভারী হয়ে উঠছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আকাশ-বাতাস।

কিন্তু কেন হঠাৎ এ বন্যা? কেউ বলছেন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কেউ বলছেন ‘মা গঙ্গার ক্রোধ’ কেউ বলছেন ভৌগলিক কারণেই এটা হয়েছে। অর্থাৎ উজানের দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বন্যা হয়েছে। সেকারণ বাংলাদেশেও বন্যা হয়েছে। এতে আর বিস্ময়ের কি আছে। যদি বলা হয়, তাহ’লে এতদঞ্চলে গত দু’শো বছরে এমন বন্যা হয়নি কেন? ভূগোলবিদগণ এ প্রশ্নের জবাব কি দিবেন জানিনা। তবে এবিষয়ে দলমত নির্বিশেষে সবাই একমত যে, আকস্মিক এ বন্যা উজান দেশ থেকে আসা বিপুল পানিরাশির ফল। গত ১৭ হ’তে ২১শে সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে একই সময়ে ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়। সে পানির তোড় সামাল দিতে না পেরে ফারাক্কা বাঁধের সকল গেইট খুলে দেওয়া হয়। নীচে পলিমাটি জমে যাওয়াতে ফারাক্কা বাঁধের মোট ১০৯টি স্লুইস গেইট-এর ৫২টি খোলা যায়নি। বাকী ৫৭টি গেইট দিয়ে অন্ততঃ ১৪ লাখ কিউসেক পানি একসাথে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ায় চাপাই নবাবগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ প্রভৃতি যেলা বন্যাকবলিত হয়। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, যদি ১০৯টি গেইটের সব ক’টি খুলে দেওয়া সম্ভব হ’ত, তাহ’লে ১৯৮৮ সালের মত ভয়াবহ বন্যায় ঢাকাসহ বাংলাদেশের ৩০টি যেলা বন্যাকবলিত হয়ে মহাবিপর্যয় ডেকে আনত। ফারাক্কার সকল গেইট একসঙ্গে খুলে দেওয়া সম্ভব না হওয়ায় বাধাগ্রস্ত ভীষণ স্রোত রুদ্র রোষে ফুঁসে উঠে গঙ্গার অন্যান্য শাখা-প্রশাখা যেমন ভাগীরথী ও তৎসংলগ্ন জলঙ্গী, মহানন্দা, সাপার, ভৈরব, চুন্নী, কোদলা, ধরলা, বেতনা, ইছামতি, সোনাই প্রভৃতি মরা ও আধামরা নদীর বাঁধভাঙ্গা পানি পশ্চিমবঙ্গের মালদহ, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বাঁকুড়া, বর্ধমান, মেদিনীপুর, চবিবশ পরগনা প্রভৃতি যেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল ডুবিয়ে দেয় ও অন্ততঃ দেড় কোটি মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমতাবস্থায় ১৮ই সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথী, জলঙ্গী, মহানন্দা, ইছামতি ও ধরলা নদী ও পরবর্তীতে সোনাই নদীর বাঁধসমূহ কেটে দেওয়া হয়। ফলে প্রবল স্রোতে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মাগুরা, যশোর ও সাতক্ষীরার ভারত সীমান্তবর্তী এলাকাগুলি চোখের পলকে তলিয়ে যায়। তাই এ বন্যা প্রাকৃতিক নয়, বরং মনুষ্যসৃষ্ট বন্যা। যাদের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দ করার ক্ষমতা আমাদের নেই। বর্তমানে অন্য যেলাগুলিতে পানি যত কমছে, বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী যেলা সাতক্ষীরাতে পানি তত বাড়ছে। ফলে সমস্ত সাতক্ষীরা যেলা বর্তমানে বন্যায় তলিয়ে গেছে। নদী-নালা কম অথবা ভরাট এবং রাস্তা ও বাঁধের সংখ্যা বেশী হওয়ায় দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হ’তে যাচ্ছে। ফলে লাখ লাখ পানিবন্দী, ক্ষুধার্ত, অর্ধমৃত, আর্তমানবতার করুণ আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ক্রমে ভারী হয়ে উঠছে।

মূলতঃ প্রথমে চাপাই নবাবগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ এবং পরে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৭টি যেলাসহ মোট ১১টি যেলা এই ভয়াবহ প্লাবনের করাল গ্রাসে পতিত হয়েছে। প্রায় আড়াই কোটির বেশী মানুষ এই ভয়াবহ বন্যায় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ও নিশ্চিহ্ন হয়েছে লাখ লাখ ঘরবাড়ি ও ফলনোন্মুখ সোনার ধান ও অন্যান্য ফসলাদি। মারা গেছে অসংখ্য গবাদি পশু, হাস-মুরগী ইত্যাদি। অনাহারে, সাপের কামড়ে, ডাকাতের হামলায় ও পানিতে ডুবে মারা গেছে অসংখ্য। যারা বেঁচে আছে বাঁধের টোলে, গাছের ডালে, রাস্তার মাচায় বা কলাগাছের ভেলায়, তারা রোগ ও ক্ষুধার যন্ত্রণায় আশ্রয়ের অভাবে অসহায়ভাবে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। আসছে দুরন্ত শীত মৌসুম। মাঠে নেই ফসল, গোয়ালে নেই গরু-ছাগল, ডোবে নেই হাঁস-মুরগী, পুকুরে নেই মাছ, কি দিয়ে মানুষ জীবিকা নির্বাহ করবে...।

এক্ষণে প্রশ্ন : পশ্চিমবঙ্গের দেড় কোটি ও বাংলাদেশের আড়াই কোটি অন্যূন চার কোটি বনু আদমের উপরে কেন নেমে এল এই আকস্মিক মহাপ্লাবন? এর একমাত্র জবাব : ফারাক্কা। ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে গঙ্গার স্বাভাবিক স্রোতধারাকে বাধাগ্রস্ত করার ফলশ্রুতিতে গঙ্গা ও তার শাখা নদী সমূহে পলিমাটি জমে গভীরতা হারিয়েছে। ফলে স্থলভাগের বৃষ্টিপাতের পানি এবং হিমালয়ের বরফগলা পানি ধারণের ক্ষমতা হারিয়ে সেখানে সর্বদা বন্যা প্রবণতা বিরাজ করছে। ফলে একটুতেই Over flow হয়ে পানি উপচে পড়ে ও একদিকে বন্যা অন্যদিকে নদীভাঙ্গন চলে সমানে। সেই সঙ্গে এবারে যোগ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম কিনারে অবস্থিত বিহার ও উড়িষ্যা রাজ্যের বাঁধভাঙ্গা পানির স্রোত। ফলে ডুবছে মানুষ, ভাঙ্গছে ঘর-বাড়ি। বাজার-ঘাট, মসজিদ-মন্দির সবকিছু। এভাবে ফারাক্কার কারণে গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকা অঞ্চলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে গ্রাম ও জনপদ। শুরু হয়েছে এক মহা মানব বিপর্যয়। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মানুষের আজ অভিন্ন সমস্যা হ’ল ফারাক্কা। অতএব গঙ্গা ও পদ্মার স্বাভাবিক স্রোতধারাকে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট নদী গবেষক কপিল ভট্টাচার্য ফারাক্কা বাঁধের ঘোর বিরোধী ছিলেন। যার জন্য তাকে ভারত সরকারের নানা প্রকার নিগ্রহের শিকার হ’তে হয়। এতদিনে তার কথাই সত্য প্রমাণিত হ’ল। প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এ ব-দ্বীপ এলাকায় প্রতিবছর বান-বর্ষা হয়েই থাকে। কিন্তু ফারাক্কার কারণে বন্যার এ ভয়াল রূপ প্রতিবছরই আঘাত হানবে বলে ধরে নেওয়া যায়।

উত্তরণের উপায় : ভারতের নেতাদের উদার হ’তে হবে। ভাটির দেশের মানুষ হিসাবে বাংলাদেশের মানুষকে মানুষ হিসাবে মূল্যায়ন করতে হবে। সাথে সাথে পশ্চিমবঙ্গের জনগণকে তাদের বাঁচার স্বার্থে তাদের কেন্দ্রীয় সরকারের উপরে চাপ সৃষ্টি করে এই মরণ বাঁধ ফারাক্কা, গোজলডোবা, বরাক সহ ৫৪টি অভিন্ন নদীতে দেওয়া বাঁধগুলি গুঁড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। অতঃপর নদীসমূহের স্বাভাবিক স্রোতধারা থেকে ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ের সহযোগিতায় ‘পানি বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট’ চালু করতে হবে। ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মাণের বেশ কয়েক বছর পূর্বে জনৈক মার্কিন বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র দিয়ে প্রতি বছর প্রায় ১০০ কেটি একর ফিট পানি প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। এই পানিকে কাজে লাগিয়ে ভারত ও পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) উভয়েই লাভবান হ’তে পারে। কেবল মৌসুমী বৃষ্টিপাতের উপরে এখন যেভাবে তাদের নির্ভর করতে হয়, পদ্মার এই বিপুল পানিরাশির ব্যবহার তাদের সেই বৃষ্টি নির্ভরতাকে বিশেষভাবে কমিয়ে দিতে পারে। .. এই বিপুল পরিমাণ পানি দিয়ে প্রতিবছর প্রায় ৭ কোটি একর জমিতে পানি সেচ করা সম্ভব হবে’। এক্ষণে আমাদের প্রশ্ন : ভারতে কি কোন ঠান্ডা মাথার ও জনদরদী নেতা নেই? যাঁরা পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মানুষের প্রতি সত্যিকারের দরদী হয়ে উপরোক্ত পানি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে পারেন?

পরিশেষে আমরা মনে করি, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বর্তমানে প্রলয়ংকরী বন্যা আমাদের অন্যায় কর্মের ফল হিসাবে আল্লাহর পক্ষ হ’তে নাযিলকৃত গযব স্বরূপ (রূম ৩০/৪১)। রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনে কিছুসংখ্যক লোকের চরম বিলাসিতা ও পাপাচার এবং সীমাহীন দুর্নীতি ও সর্বগ্রাসী দুষ্কৃতির ফলে ভাল-মন্দ সকল পর্যায়ের মানুষ, পশু-পক্ষী ও প্রাণীকুল আজ আল্লাহর কঠিন গযবের শিকার হয়েছে। এমতাবস্থায় জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বন্যাদুর্গত সকল বনী আদমের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো ও এক মুঠো অন্ন হ’লেও তাদের সামনে তুলে ধরা এবং বন্যাপরবর্তী পুনর্বাসনে সহযোগিতা করা আমাদের সকলের নৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব। আল্লাহ কবুল করলে আপনার-আমার দরদী মনের সামান্য দান আমাদের জাহান্নাম থেকে বাঁচার অসীলা হ’তে পারে। অতএব আসুন! আমাদের যার যা আছে, তাই নিয়ে বন্যাদুর্গত ভাই-বোনদের পাশে দাঁড়াই ও এর মাধ্যমে আখেরাতের পাথেয় সঞ্চয় করি। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন!






বাঁচার পথ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বর্ণবাদী আমেরিকার মুক্তির পথ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ভালোবাসি - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বিব্রত সরকার বিব্রত দেশবাসী - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
নারীর উপর সহিংসতা : কারণ ও প্রতিকার - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
জীবন দর্শন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
পুঁজিবাদের চূড়ায় ধ্বস - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আন্তঃধর্ম শান্তি সম্মেলন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
২০২৩ সালের সিলেবাস - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
স্বভাবধর্মের বিকাশ চাই! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
শান্তির ধর্ম ইসলাম - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.