‘মুসলিম’-এর পারিভাষিক অর্থ ‘আল্লাহর আজ্ঞাবহ’। ‘আহলেহাদীছ’ অর্থ ‘কুরআন ও হাদীছের অনুসারী’। ‘আল্লাহর আজ্ঞাবহ’ হ’তে হ’লে তাকে অবশ্যই কুরআন ও হাদীছের অনুসারী হ’তে হবে। এর বাইরে গিয়ে ‘মুসলিম’ হওয়ার সুযোগ নেই। ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুসলমানদের মধ্যে কোন শিরক ও বিদ‘আত ছিল না। সকলেই কুরআন ও হাদীছের অনুসারী ছিল। সেকারণ ছাহাবায়ে কেরামের জামা‘আত এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত তাঁদের সনিষ্ঠ অনুসারী ত্বায়েফাহ মানছূরাহ বা আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্ত দলকে সালাফে ছালেহীন বিদ্বানগণ ‘আহলুল হাদীছ’ বলেছেন এবং এ ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে কোন মতভেদ নেই। হযরত ওছমান (রাঃ)-এর খেলাফতের শেষদিকে প্রধানতঃ ইহূদী চক্রান্তের কারণে রাজনৈতিক গোলযোগের সূত্র ধরে বিশেষ করে নওমুসলিমদের মাধ্যমে নানাবিধ বিদ‘আতী আক্বীদা ও আমলের সূচনা হয়। ফলে সমাজে আহলেহাদীছ ও বিদ‘আতী দু’টি দল চিহ্নিত হয়ে যায়। যা আজও আছে এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। আল্লাহ যাদেরকে স্বীয় রহমতে ধন্য করবেন, তারা সবকিছু ত্যাগ করে হ’লেও আহলেহাদীছ হবেন ও এর জন্য জীবন উৎসর্গ করবেন। কারণ এটা পরিষ্কার যে, শিরক ও বিদ‘আত করে কেউ জান্নাত পাবে না। হাউয কাওছারের পানি চাইতে গেলে রাসূল (ছাঃ)-কে পানি দিতে নিষেধ করা হবে এবং বলা হবে, তুমি জানো না তোমার মৃত্যুর পরে ওরা কত অসংখ্য বিদ‘আত সৃষ্টি করেছিল। তখন রাসূল (ছাঃ) বলবেন, দূর হও, দূর হও, যারা আমার পরে আমার দ্বীনকে পরিবর্তন করেছে’ (বুখারী হা/৬৫৮৩-৮৪; মিশকাত হা/৫৫৭১)। অতএব একজন বিদ‘আতী কালেমা শাহাদাত পাঠের কারণে মুসলিম হ’লেও সে আহলেহাদীছ নয়। মুখে যত দাবীই সে করুক, বিদ‘আতী কখনোই সুন্নী নয়। সে কখনোই ছাহাবায়ে কেরামের জামা‘আতের অনুসারী নয়। সে কখনোই নাজী ফেরক্বা নয়। অতএব যে আমলটুকুই মাত্র কবরে ও হাশরে আমাদের সাথী হবে, সেটাকে যেকোন মূল্যে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী ঢেলে সাজিয়ে নেওয়াটাই হবে যেকোন বুদ্ধিমান মুমিনের কর্তব্য। যারা বৈষয়িক জীবনে কুফরী আক্বীদা ও আমলের অনুসারী কিংবা চরমপন্থী বা শৈথিল্যবাদী, কিন্তু ছালাতে আহলেহাদীছ, তারা সার্বিক জীবনে আহলেহাদীছ নন। অথচ একজন মুমিনকে জান্নাত পেতে গেলে সার্বিক জীবনে আহলেহাদীছ হ’তে হয়। যারা জেনে-শুনে ছহীহ হাদীছ মানেন না বরং কারু অন্ধ আনুগত্যের মধ্যে বা নিজ খেয়াল-খুশীর মধ্যে জীবন কাটান, তারা হবেন হাউয কাওছার থেকে বিতাড়িত মুমিনদের অন্তর্ভুক্ত। যাদের ওযূর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেখে সেদিন রাসূল (ছাঃ) বলবেন, ওদের আমি চিনি, ওরাও আমাকে চিনে’ (ঐ)

এক্ষণে সামাজিক ঐক্যের ক্ষেত্রে আমাদের প্রথম পরিচয় আমরা ‘মানুষ’। তাই প্রত্যেক মানুষের প্রতি সর্বোচ্চ মানবতা প্রদর্শন করাই হ’ল ইসলামের বিধান। রাসূল (ছাঃ) বলেন, তোমরা যমীনবাসীর উপর দয়া কর, আসমানবাসী (আল্লাহ) তোমাদের উপর দয়া করবেন’ (ছহীহাহ হা/৯২২)। অতঃপর ধর্মীয় পরিচয়ে আমরা ‘মুসলিম’। কাফির ও মুসলিম একত্রে থাকলে সেখানে অবশ্যই ‘মুসলিম’ আমাদের ভাই। কারণ আল্লাহ, রাসূল ও আখেরাতে বিশ্বাসের কারণে তারা ও আমরা এক। আল্লাহ বলেন, মুমিনগণ সকলে ভাই ভাই (হুজুরাত ৪৯/১০)। অতঃপর শুধু মুসলিমগণ একত্রে থাকলে সেখানে অবশ্যই আমি স্পষ্টভাবে একজন ‘আহলেহাদীছ’ (মুক্বাদ্দামা মুসলিম ১৫ পৃঃ)। এটা আমাদের বৈশিষ্ট্যগত পরিচয় এবং এটাই আমাদের গর্ব। জীবনের সর্বত্র ভাল ও মন্দের পৃথক বৈশিষ্ট্য ও তারতম্য রয়েছে। এমনকি নিজ সন্তানদের মধ্যে উত্তম সন্তান পিতা-মাতার নিকট সবচেয়ে প্রিয় হয়ে থাকে। আমরাও আমাদের পালনকর্তা আল্লাহর নিকট প্রিয় বান্দা হ’তে চাই। আমরা প্রথমেই জান্নাতে যেতে চাই। জাহান্নাম ভোগ করার পরে নয়’ (বুখারী হা/৭৪৫০)

অতঃপর সামাজিক জীবনে একজন প্রকৃত আহলেহাদীছের অন্যতম নিদর্শন হ’ল, তিনি একজন আল্লাহভীরু ও যোগ্য আমীরের অধীনে আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী পরিচালিত হবেন (মুসলিম হা/১২৯৮)। এজন্য তিনি আল্লাহর নামে আখেরাতে নেকী লাভের আকাঙ্ক্ষায় স্পষ্ট অঙ্গীকার তথা বায়‘আতের মাধ্যমে আনুগত্যশীল হবেন (মুসলিম হা/১৮৫১)। কোন বিষয়ে মতভেদ হ’লে বা অপসন্দনীয় হ’লে সেক্ষেত্রে আমীরের নির্দেশ কার্যকর হবে এবং ছবর করতে হবে (বুখারী হা/৭০৫৩)। যদি তা শিরক ও কুফরের পর্যায়ে না যায় (লোকমান ৩১/১৫)। এভাবে আহলেহাদীছের সমাজ সুশৃংখল সমাজে পরিণত হবে। প্রকৃত আহলেহাদীছের জন্য তাই বিচ্ছিন্ন জীবনের সুযোগ নেই। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, তোমাদের উপর জামা‘আতবদ্ধ জীবন অপরিহার্য করা হ’ল এবং বিচ্ছিন্ন জীবন নিষিদ্ধ করা হ’ল (তিরমিযী হা/২১৬৫)। বিশেষ করে শিরক ও বিদ‘আতপন্থীরা যেখানে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সেখানে আহলেহাদীছদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার বা পৃথকভাবে দলাদলি করার কোন সুযোগ নেই। সংগঠনই শক্তি। সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় সংঘবদ্ধ হয়ে যারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে, তিনি তাদেরকে ভালবাসেন’ (ছফ ৬১/৪)

‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে সমাজ সংস্কারের আন্দোলন। যারা এ আন্দোলনে জান-মাল উৎসর্গ করবেন, তারা অবশ্যই ‘আহলেহাদীছ’ নামে পরিচিত হবেন। তারা অবশ্যই বাতিল থেকে পৃথক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবেন। ঐক্যের নামে তারা কখনোই বাতিলের মিছিলে হারিয়ে যাবেন না। হকপন্থী ভাই-বোনেরা অবশ্যই আল্লাহর রহমতে তাদের সাথী হবেন। এর অর্থ এটা নয় যে, অন্যদের প্রতি তাদের বিদ্বেষ থাকবে। বরং অন্যদের প্রতি তাদের সর্বাধিক আগ্রহ ও উদারতা থাকবে তাদেরকে হক-এর দাওয়াত দেওয়ার জন্য ও তাদেরকে হক-এর পথে ফিরিয়ে আনার জন্য। যে দরদ নিয়ে রাসূল (ছাঃ) মানুষকে দাওয়াত দিয়েছেন সেই দরদ নিয়ে আহলেহাদীছ আন্দোলনের কর্মীগণ মানুষকে দাওয়াত দিবেন কেবল নেকীর আশায়। কিন্তু নিজে কখনো বাতিলের সঙ্গে আপোষ করবেন না। একইভাবে আহলেহাদীছগণ পারস্পরিক মতভেদকে লঘু করে দেখেন ও জামা‘আতবদ্ধ জীবনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন-আমীন! (স.স.)

[পবিত্র রামাযান ও ঈদুল ফিৎর উপলক্ষ্যে আমরা আমাদের সম্মানিত লেখক-লেখিকা, পাঠক-পাঠিকা,  এজেন্ট এবং দেশী ও প্রবাসী শুভানুধ্যায়ী ভাই-বোনদের প্রতি আন্তরিক মুবারকবাদ জানাচ্ছি এবং সকলের আমলনামা যাতে নেকী দ্বারা পূর্ণ হয়, সেজন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করছি। -সম্পাদক]






বিষয়সমূহ: সংগঠন
নৃশংসতার প্রাদুর্ভাব : কারণ ও প্রতিকার - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বাঁচার পথ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মানবাধিকার দর্শন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
২০২৩ সালের সিলেবাস - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বিশ্বকাপ না বিশ্বনাশ? - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বিশ্বায়ন ও আত্মনিয়ন্ত্রণ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
হজ্জ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রতি ব্যঙ্গোক্তি - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
নেতৃবৃন্দের সমীপে - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে পরামর্শ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
উন্মত্ত হিংসার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মুরসির বিদায় - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.