২০২৪ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও চট্টগ্রামসহ ১১টি যেলা তলিয়ে যায়। লাগাতার প্রবল বর্ষণ ও পার্শ্ববর্তী উজানের দেশ ভারত কর্তৃক সমস্ত বাঁধ খুলে দেওয়ায় প্রবল বেগে ধেয়ে আসা পানিতে সৃষ্টি হয় এই বন্যা। আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে লাখ লাখ মানুষ। পানির তোড়ে ভেসে যায় হাঁস-মুরগী, গবাদীপশু ও পুকুরের মাছ। তলিয়ে যায় ফসলের মাঠ। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনী অংশে সড়কের উপরে বন্যার পানির তীব্র স্রোত থাকায় যান চলাচল ব্যাহত হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে কয়েকদিন। স্থানীয়দের ভাষ্য মতে বিগত কয়েক যুগেও অত্রাঞ্চলের মানুষ এরূপ বন্যা দেখেনি। সর্বশেষ গত ১৭ সেপ্টেম্বরের সরকারী হিসাব মতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১৪ হাযার ২৬৯ কোটি ৬৮ লাখ ৩৩ হাযার ৫২২ টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত যেলা ১১টি। মোট আশ্রয় গ্রহণকারী ৪৫ লাখ ৫৬ হাযার ১১১ জন। ক্ষতিগ্রস্ত লোক সংখ্যা ৯ লাখ ৪২ হাযার ৮২১ জন। মৃত্যুবরণ করেছে ৭৪ জন এবং আহত হয়েছে ৬৮ জন।
‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ ও তার অঙ্গ সংগঠন সমূহ প্রতিবারের ন্যায় এবারও বানভাসী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। ২০শে আগস্ট বন্যা শুরুর দু’দিন পরেই মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব কেন্দ্রীয় ত্রাণ তহবিল থেকে তাৎক্ষণিক কিছু সহযোগিতা সহ ‘যুবসংঘ’-এর কেন্দ্রীয় সভাপতি মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক ফায়ছাল মাহমূদকে কেন্দ্র থেকে কুমিল্লা ও ফেনীর উদ্দেশ্যে পাঠান। তারা কুমিল্লায় পৌঁছে ২৩শে আগস্ট শুক্রবার বাদ আছর ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের নিকটবর্তী আলেখারচর বিশ্বরোড সংলগ্ন হাসান জামে মসজিদ ও ইসলামিক কমপ্লেক্সে ‘আন্দোলন’ ও ‘যুবসংঘে’র যেলা দায়িত্বশীলদের সাথে এক যরূরী বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে ‘যুবসংঘে’র কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ সম্পাদক আহমাদুল্লাহকে (কুমিল্লা) আহবায়ক করে ১১ সদস্য বিশিষ্ট ‘উদ্ধার ও ত্রাণ কমিটি’ গঠন করা হয়। উক্ত কমিটির নেতৃত্বে বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে টানা দুই সপ্তাহব্যাপী একইসাথে উদ্ধার ও ত্রাণ বিতরণ কাজ পরিচালনা করা হয়। শুরুতেই যখন ফেনী শহর তলিয়ে যায়, তখন ‘আহলেহাদীছ পেশাজীবী ফোরাম’-এর কেন্দ্রীয় সভাপতি ডাঃ শওকত হাসানের নেতৃত্বে যেলা ‘যুবসংঘ’ ও ‘পেশাজীবী ফোরামে’র সদস্যগণ ফেনীতে উদ্ধারকাজ পরিচালনা করেন। পরবর্তীতে গোমতী নদীর বাঁধ ভেঙ্গে গেলে কুমিল্লার বুড়িচং উপযেলা প্লাবিত হয়। ফলে সেখানকার স্থানীয় ‘আন্দোলন’ ও ‘যুবসংঘে’র দায়িত্বশীলদের নেতৃত্বে বিভিন্ন গ্রামে উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এ সময়ে সর্বমোট ৬৭০ জন নারী-পুরুষকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার কাজে ট্রাক্টর, নৌকা, স্পীডবোট ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়।
অতঃপর ২৩শে আগস্ট থেকে বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে শুকনা খাবার যেমন চিড়া, মুড়ি, গুড়, বিস্কুট, বাচ্চাদের দুধ, বিস্কুট, পানি, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, কয়েল, মোমবাতি, লাইটার, ওরস্যালাইন, নাপা ট্যাবলেট ইত্যাদির প্যাকেট বিতরণ শুরু হয়। যা একটানা ২৮শে আগস্ট পর্যন্ত চলে। এরপর পানি কিছুটা কমে গেলে ২৯ আগস্ট থেকে ভারী খাবার যেমন চাউল-ডাল, লবণ-তেল, আলু-পেঁয়াজ, হলুদ-মরিচ, পানি ইত্যাদির প্যাকেট বিতরণ শুরু হয়। ৭ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকায় এইভাবে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত থাকে। সুষ্ঠুভাবে ত্রাণ বিতরণ ও দুর্গম এলাকায় গিয়ে প্রকৃত হকদারদের ঘরে ঘরে ত্রাণ পৌছে দেওয়ার লক্ষ্যে এ বছর একটি প্রধান সমন্বয় কেন্দ্র এবং এর অধীনে আরো ১৩টি শাখা-কেন্দ্র করা হয়। কুমিল্লা যেলার আলেখারচর মূল কেন্দ্র থেকে প্যাকেট করে শাখা-কেন্দ্র সমূহের মাধ্যমে বিতরণ কাজ সম্পাদন করা হয়। সাব-কেন্দ্রগুলো হচ্ছে- (১) ফেনী (২) নোয়াখালী (৩) লক্ষ্মীপুর (৪) বুড়িচং (৫) ব্রাহ্মণপাড়া (৬) লাকসাম (৭) মনোহরগঞ্জ (৮) চৌদ্দগ্রাম (৯) লালমাই (১০) কুমিল্লা-সদর দক্ষিণ (১১) বরুড়া (১২) মুরাদনগর ও (১৩) দেবিদ্বার। এছাড়া চট্টগ্রামে প্যাকেট হয়ে যেলা ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি হাফেয শেখ সা‘দীর নেতৃত্বে যেলার বন্যাকবলিত মীরসরাই ও ফটিকছড়িতে ত্রাণ বিতরণ করা হয়।
সংগঠনের ব্যবস্থাপনায় ৭০১৬ পরিবারের মধ্যে শুকনা খাবার এবং ৪৭৪৫ পরিবারের মধ্যে ভারী খাবার বিতরণ করা হয়। এছাড়া ‘আন্দোলন’-এর সুশৃংখল বিতরণ ব্যবস্থা দেখে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থাও ‘আন্দোলন’-এর মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণ করে। ত্রাণ বিতরণ কাজে স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন মূল কেন্দ্রে ২৫০ জন সহ সর্বমোট ৫৪০ জন।
ত্রাণ বিরতণ কার্যে বিভিন্ন দিনে কেন্দ্র থেকে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় সেক্রেটারী জেনারেল অধ্যাপক মাওলানা নূরুল ইসলাম, প্রচার সম্পাদক ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন, শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব, মজলিসে শূরা সদস্য কাযী হারূণুর রশীদ ও তরীকুয্যামান, ‘যুবসংঘে’র কেন্দ্রীয় সভাপতি শরীফুল ইসলাম, সমাজকল্যাণ সম্পাদক ফায়ছাল মাহমূদ, সাংগঠনিক সম্পাদক ড. ইহসান ইলাহী যহীর প্রমুখ।
এছাড়া ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী যেলা ‘আন্দোলন’ ও ‘যুবসংঘে’র দায়িত্বশীলগণ ত্রাণ কাজে সরাসরি যোগদান করেন। ত্রাণ বিতরণে সার্বক্ষণিক উপস্থিত থেকে সার্বিক তদারকী করেন ঢাকা যেলা ‘আন্দোলন’-এর সাবেক সেক্রেটারী জনাব তাসলীম সরকার।
ফ্রী মেডিকেল ক্যাম্প : ৬ই সেপ্টেম্বর শুক্রবার বুড়িচং, কুমিল্লা : অদ্য সকাল ১০-টায় যেলার বুড়িচং উপযেলাধীন আরাগ-আনন্দপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ‘আহলেহাদীছ পেশাজীবী ফোরামে’র উদ্যোগে বন্যা কবলিত মানুষের চিকিৎসার জন্য ফ্রী মেডিকেল ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়। পেশাজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় সভাপতি ডা. শওকত হাসানের নেতৃত্বে উক্ত ক্যাম্পে চিকিৎসা প্রদান করেন পেশাজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ডা. মুহাম্মাদ ছাবিত, কক্সবাজার যেলা সভাপতি ডা. আসাদুল্লাহ আল-গালিব, নারায়ণগঞ্জ যেলা ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি ডা. আবু নাঈম মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম, কুমিল্লা যেলা ‘আল-‘আওনে’র সভাপতি ডা. মুহাম্মাদ শাহেদ প্রমুখ। দু’টি চিকিৎসা বুথের মাধ্যমে মোট ৬৭৬ জন রোগীকে চিকিৎসা প্রদান করা হয়।
খুলনায় ত্রাণ বিতরণ : গত ৩১শে আগস্ট শনিবার ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ সম্পাদক ও সাতক্ষীরা যেলা ‘আন্দোলন’-এর সেক্রেটারী মাওলানা আলতাফ হোসাইনের নেতৃত্বে এবং সাতক্ষীরা যেলা সংগঠনের সার্বিক সহযোগিতায় নতুন করে বন্যাকবলিত খুলনা যেলার পাইকগাছা ও দাকোপ উপযেলার বিভিন্ন গ্রামে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়। সাতক্ষীরা থেকে ট্রাক যোগে খুলনা, সেখান থেকে দু’টি লঞ্চ যোগে বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ পৌঁছে দেয়া হয়। ‘যুবসংঘে’র ৫১ জন স্বেচ্ছাসেবক এ কাজে অংশগ্রহণ করেন। সাতক্ষীরা যেলা ‘আন্দোলন’ ও ‘যুবসংঘে’র দায়িত্বশীলগণ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
দায়িত্বশীল প্রশিক্ষণ
৩রা আগস্ট শনিবার আনন্দনগর, নওগাঁ : অদ্য সকাল ১০-টায় যেলা শহরের আনন্দনগরস্থ আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী মাদ্রাসা জামে মসজিদে যেলা ‘আন্দোলন ও ‘যুবসংঘ’-এর উদ্যোগে এক দায়িত্বশীল প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়। যেলা ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি মাওলানা আব্দুস সাত্তারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত প্রশিক্ষণে কেন্দ্রীয় মেহমান হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মাওলানা নূরুল ইসলাম ও অর্থ সম্পাদক মুহাম্মাদ বাহারুল ইসলাম। অন্যান্যের মধ্যে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন যেলা ‘আন্দোলন’-এর সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক শহীদুল আলম।