ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় জীবনে আদল বা সুবিচার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আদল হ’ল মানবীয় সর্বোত্তম গুণের অন্যতম। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ও যুলুম- নিপীড়নমুক্ত সমাজ গঠনে আদল বা সুবিচারের কোন বিকল্প নেই। দ্বীন ইসলামকে সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করতে হ’লে সমাজ ও রাষ্ট্রে আদল প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। সমগ্র সৃষ্টিজগতকে আল্লাহ তা‘আলা আদল বা সুবিচারের সাথে পরিচালনা করছেন। তাঁর কাজে কোথাও অন্যায়-অবিচার বা সত্যের পরিপন্থী কিছু নেই। আল্লাহ তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষকেও আদল প্রতিষ্ঠিত করার জোর তাকীদ দিয়েছেন। আদল বা ইনছাফ ব্যক্তি ও আদর্শ সমাজের অনন্য বৈশিষ্ট্য।

‘আদল’ আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হ’ল সুবিচার করা, সমান করা, নিরপেক্ষতা, বিনিময় প্রভৃতি। আদলের সমার্থক শব্দ হচ্ছে ‘ইনছাফ’ ও ‘কিসত’। আদলের বাংলা প্রতিশব্দরূপে সুবিচার, ন্যায়বিচার ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হয়।

ইসলামী শরী‘আতের পরিভাষায় সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলামী জীবন বিধান অনুযায়ী যার যে হক বা অধিকার ও প্রাপ্য তা আদায়ের সুব্যবস্থাকেই আদল বলা হয়। বস্ত্তত মানুষের জীবনের সামগ্রিক ক্ষেত্রে তথা কাজ-কর্ম, চলাচল, আচার-আচরণ, লেনদেন, বেচা-কেনা, বিনিয়োগ ব্যবস্থা, সমাজ-রাষ্ট্র পরিচালনা, যুদ্ধ, সন্ধি, সঞ্চয়, ভোগ, বিচার ব্যবস্থায় ইনছাফ ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার নামই আদল। আল-কুরআনে ‘আদল’ ১৪ বার এবং ‘কিসত’ ১৫ বার ব্যবহৃত হয়েছে।[1] আর ‘আদল’ ও ‘কিসত’ সমার্থজ্ঞাপক পদবাচ্য।

আদল বা ইনছাফকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন- ব্যক্তিগত ইনছাফ ও সামাজিক ইনছাফ।

ব্যক্তিগত ইনছাফ :

নিজের হক ও অধিকারকে পূর্ণরূপে আদায় করা এবং অন্যের প্রাপ্য ও অধিকারকে পূর্ণরূপে প্রদান করার নাম ব্যক্তিগত ইনছাফ। যেহেতু প্রত্যেক ব্যক্তি তার সমাজের একজন সদস্য, তাই সামাজিক প্রতিটি খাত থেকে তার উপকৃত হওয়ার অধিকার রয়েছে। সামাজিক খাত থেকে তার নিজের প্রাপ্য যথাযথভাবে বুঝে নেওয়া এবং অন্যের প্রাপ্য সঠিকভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার নামই আদল বা ইনছাফ। এ কারণেই চুরি-ডাকাতি, হাইজ্যাক-ছিনতাই, চাঁদাবাজি ইত্যাদি অত্যাচার বলে বিবেচিত। কেননা এতে অন্যকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। যে ব্যবসায়ী নির্ধারিত ওযনের চেয়ে মাপে কম দেয়, সে অত্যাচারী। কেননা সে অন্যের হক বিনষ্ট করে।

সামাজিক ইনছাফ :

সমাজের প্রত্যেক সদস্যকে তার প্রাপ্য সামাজিকভাবে যথাযথভাবে প্রদান করাই হচ্ছে সামাজিক ইনছাফ। সুতরাং ইনছাফভিত্তিক সমাজ বলতে সে সমাজকে বুঝায় যার নিয়ম-নীতি ও আইন-কানূন এত সরল-সহজ যে, সমাজের প্রতেক ব্যক্তি নিজের যোগ্যতানুসারে কোনরূপ প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই নিজের ও সমাজের উন্নতি সাধন করতে পারে। সুতরাং কোন সমাজকে ততক্ষণ পর্যন্ত ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বলা যাবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে সমাজে সকল শ্রেণীর মানুষের উন্নতির উপায়-উপকরণ পর্যাপ্ত পরিমাণে বিদ্যমান না থাকবে।

আদল কায়েমের পথে প্রতিবন্ধকতা :

আদল-ইনছাফের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হ’ল পক্ষপাতিত্ব। পক্ষপাতিত্ব বলতে মানুষের সে আকর্ষণকে বুঝায় যা তাকে দু’টি বিষয়ের মধ্যে একটির প্রতি অন্ধভাবে ঝুঁকিয়ে দেয়, ফলে সে দু’জন ব্যক্তির একজনকে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে এবং অন্যজনকে তার প্রাপ্যের চেয়ে অধিক দিয়ে দেয়। মহানবী (ছাঃ) বলেন, ‘তোমাদের পূর্ববর্তীরা এ কারণে ধ্বংস হয়েছে যে, যখন তাদের মধ্যকার কোন সম্ভ্রান্ত লোক চুরি করত, তখন তারা তাকে ছেড়ে দিত। আর যখন দুর্বল কেউ চুরি করত, তখন তার উপর দন্ড কার্যকর করত। যেই সত্ত্বার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ রয়েছে তাঁর কসম, মুহাম্মাদের মেয়ে ফাতিমাও যদি চুরি করত তাহ’লে আমি তার হাত কেটে দিতাম’।[2]

ইসলামী সমাজে আদল :

মানুষের জীবনে আদল একটি মহৎ গুণ। আল্লাহ এ গুণটি খুবই পসন্দ করেন। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সুখ-শান্তি ও আল্লাহর সাহায্য লাভের মূল ভিত্তিই হ’ল আদল বা ন্যায়বিচার। ইমাম ইবনু তাইমিয়া (রহঃ) কত সুন্দরই না বলেছেন- الله ينصر الدولة العادلة وإن كانت كافرة ولا ينصر الدولة الظالمة ولو كانة مؤمنة. ‘আল্লাহ ন্যায়-নীতিপূর্ণ রাষ্ট্রকে সাহায্য করেন। যদিও সেটি অমুসলিম রাষ্ট্র হয়। আর মুসলিম রাষ্ট্র হ’লেও অত্যাচারী রাষ্ট্রকে তিনি সাহায্য করেন না’।[3] জীবনের সকল ক্ষেত্রেই আদলের প্রয়োজন। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র যেখানেই আদল অনুপস্থিত থাকবে, সেখানে যুলুম, অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়বে। সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণে আদলের গুরুত্ব অপরিসীম। এজন্যই বলা হয়, No Justice no Peace. ‘ন্যায়বিচার নেই তো শান্তি নেই’। নিম্নে ইসলামী সমাজে আদলের গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরা হ’ল-

১. সুবিচার প্রতিষ্ঠায় আদল : আদলের মানদন্ড আল্লাহ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। মানব জাতিকে যে পরিমাণ বিবেক-বুদ্ধি ও বিচারশক্তি প্রদান করেছেন, তার সাহায্যে কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে মানুষ এমনভাবে আদল প্রতিষ্ঠিত করবে যেন কারও প্রতি কোনরূপ পক্ষপাতিত্ব না হয়। আল্লাহ বলেন, ‘আপনি তাদের পারস্পরিক ব্যাপারাদিতে আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফয়ছালা করুন এবং আপনার কাছে যে সৎপথ এসেছে, তা ছেড়ে তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না’ (মায়েদাহ ৫/৪৮)। কোনরূপ করুণার বশবর্তী হয়ে আল্লাহ প্রদত্ত ন্যায়ের মানদন্ডের সামান্যতম হেরফের করা যাবে না। ন্যায়বিচারের ব্যাপারে পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন কিংবা ধনী-দরিদ্র, রাজা-প্রজা যেই ক্ষতিগ্রস্ত হোক না কেন ন্যায়ের মানদন্ড অবশ্যই স্থির রাখতে হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর কঠোর সাবধান বাণী হ’ল- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা ন্যায়ের উপরে প্রতিষ্ঠিত থাক, আল্লাহর জন্য তোমরা ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্য দান কর। তাতে যদি তোমাদের নিজেদের কিংবা তোমাদের মাতা-পিতার অথবা আত্মীয়-স্বজনের ক্ষতি হয় তবুও। কেউ যদি ধনী বা দরিদ্র হয় তবে জেনে রেখ, আল্লাহ তোমাদের চাইতে তাদের অধিকতর শুভাকাঙ্খী। অতএব তোমরা ন্যায়বিচার করতে গিয়ে প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা বল কিংবা এড়িয়ে যাও, তবে মনে রেখ, আল্লাহ তোমাদের সকল কাজকর্ম সম্পর্কে অবহিত’ (নিসা ৪/১৩৫)

মানুষ প্রবৃত্তির তাড়নায় অনেক সময় অন্যায় কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। ঝগড়া-বিবাদ ও সন্ত্রাসে লিপ্ত হয়। এতে মানুষের জান-মাল, মান-সম্মান ও অধিকার ইত্যাদি হুমকির সম্মুখীন হয়। কিন্তু সমাজে যদি অন্যায়কারীর পক্ষপাতহীন ও যথোপযুক্ত বিচার-ফায়ছালা করা হয় এবং তাতে যদি সুবিচার ও আদল থাকে, তাহ’লে সমাজে অবশ্যই আইন ও ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের আদেশ দেন আমানত তার হকদারকে প্রত্যর্পণ করতে এবং যখন তোমরা মানুষের মাঝে বিচারকার্য পরিচালনা করবে, তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করবে’ (নিসা ৪/৫৮)। তিনি আরো বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে সত্য সাক্ষ্য দানের ব্যাপারে অবিচল থাক এবং কোন দলের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে অবিচারে প্ররোচিত না করে। সুবিচার করবে, এটাই তাক্বওয়ার অধিক নিকটবর্তী। আর আল্লাহকে ভয় কর। তোমাদের কর্ম সম্পর্কে আল্লাহ জ্ঞাত’ (মায়েদাহ ৫/৮)। ন্যায়বিচারের একটি সঠিক ও নির্ভুল রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতে- ‘নিশ্চয়ই আমি আমার রাসূলগণকে স্পষ্ট প্রমাণাদিসহ প্রেরণ করেছি এবং তাঁদের সাথে কিতাব ও ন্যায়নীতি নাযিল করেছি, যাতে মানুষ ইনছাফ প্রতিষ্ঠা করে’ (হাদীদ ৫৭/২৫)

ন্যায় ও পক্ষপাতহীন বিচার করা সমাজ জীবনের এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ দিক। আলী (রাঃ) মিসরের গভর্ণর মালিক ইবনু হারিছ আশতারকে লিখিত এক পত্রে বলেন, ‘একজন শাসকের জন্য এটাই সবচাইতে একমাত্র বড় আনন্দ ও তৃপ্তি যে, তাঁর দেশ ন্যায়নীতি, সুবিচার ও ইনছাফের ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে এবং শাসকের প্রতি নাগরিকদের মনে আস্থা ও ভালবাসার মনোভাব বিরাজ করছে’। তিনি আরো বলেন, ‘যথাযোগ্য ন্যায়বিচার কর। যারা শাস্তির উপযুক্ত তাদের শাস্তি দাও। তারা তোমার আত্মীয়ই হোক বা ঘনিষ্ঠ বন্ধুই হোক, তোমাকে অবশ্যই দৃঢ় ও সতর্ক থাকতে হবে, অন্যদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যদি তোমার আপন লোকজনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাতে ভ্রূক্ষেপও করো না। এ ধরনের কাজ তোমার জন্য বেদনাদায়ক হ’তে পারে। এ ধরনের দুঃখ ও বেদনা সহ্য কর এবং পরবর্তী জগতে যে কল্যাণ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে তার প্রত্যাশা করতে থাক। এগুলো কষ্টকর ঠেকতে পারে কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটাই তোমার জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে’।[4] মানুষ অত্যাচারিত হয়েই বিচারকের দ্বারস্থ হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে বিচারকের দায়িত্ব অপরিসীম। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী-সম্প্রদায়, উঁচু-নীচু নির্বিশেষে ন্যায়বিচার করা বিচারকের দায়িত্ব। মহানবী (ছাঃ)-এর বাণী থেকে আমরা এ ব্যাপারে নির্দেশ পাই। কিয়ামতের ভয়াবহ দিনে আদল প্রতিষ্ঠাকারী আল্লাহর আরশের নীচে আশ্রয় পাবেন। মহানবী (ছাঃ) বলেন, ‘হাশরের মাঠে সাত শ্রেণীর মানুষকে আল্লাহ পাক তাঁর আরশের ছায়াতলে স্থান দিবেন’। তন্মধ্যে প্রথমেই তিনি ন্যায়পরায়ণ শাসকের কথা উল্লেখ করেছেন।[5] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, أَهْلُ الْجَنَّةِ ثَلاَثَةٌ : ذُوْ سُلْطَانٍ مُقْسِطٌ مُوَفَّقٌ، وَرَجُلٌ رَحِيْمٌ رَقِيْقُ الْقَلْبِ لِكُلِّ ذِىْ قُرْبَى وَمُسْلِمٍ، وعَفِيْفٌ وَمُتَعَفِّفٌ ذُوْ عِيَالٍ. ‘তিন শ্রেণীর লোক জান্নাতের অধিবাসী হবে। ১. ন্যায়বিচারক শাসক, যাকে সৎ কাজের যোগ্যতা দেয়া হয়েছে। ২. যে ব্যক্তি আত্মীয়-স্বজন ও মুসলিম ভাইদের প্রতি দয়ার্দ্র ও বিগলিতপ্রাণ। ৩. যে সৎ চরিত্রের অধিকারী এবং পারিবারিক দায়িত্ব থাকা সত্ত্বেও ভিক্ষাবৃত্তি থেকে বেঁচে থাকে’।[6] তিনি আরো বলেন, إِنَّ اللهَ مَعَ الْقَاضِىْ مَالَمْ يَجُرْ، فَإِذَا جَارَ تَخَلَّى عَنْهُ وَلَزِمَهُ الشَّيْطَانُ. ‘আল্লাহ তা‘আলা ততক্ষণ বিচারকের সাথে থাকেন, যতক্ষণ সে অন্যায়-অবিচার না করে। আর যখন সে অবিচার করে, তখন আল্লাহ তাকে পরিত্যাগ করেন এবং শয়তান তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে’।[7] অন্য বর্ণনায় এসেছে, فَإِذَا جَارَ وَكَلَهُ إِلَى نَفْسِهِ. ‘যখন সে অবিচার করে তখন তার দিকে সেটিকে সোপর্দ করা হয়’।[8] দু’জন বিবাদমান ব্যক্তির মধ্যে ন্যায়বিচার করা ছাদাক্বা স্বরূপ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, كُلُّ نَفْسٍ كُتِبَ عَلَيْهَا الصَّدَقَةُ كُلَّ يَوْمٍ طَلَعَتْ فِيْهِ الشَّمْسُ، فَمِنْ ذَلِكَ أَنْ يَّعْدِلَ بَيْنَ الْإِثْنَيْنِ صَدَقَةٌ. ‘প্রত্যেক দিন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য ছাদাক্বা লিপিবদ্ধ করা হয়। তন্মধ্যে দু’জন বিবাদমান ব্যক্তির মধ্যে ন্যায়বিচার করাও ছাদাক্বা হিসাবে গণ্য হয়’।[9]

২. সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় আদল : ব্যক্তিগত জীবনের ন্যায় মানুষের সামাজিক জীবনেও আদল বা ন্যায়বিচারের গুরুত্ব অপরিসীম। সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে গিয়ে মানুষকে বহুবিধ সমস্যার সম্মুখীন হ’তে হয়। সমাজের স্থিতিশীলতা নষ্টকারী তৎপরতা যেমন চুরি-ডাকাতি, সন্ত্রাস, হাইজ্যাক, লুণ্ঠন, শোষণ, যুলুম, কালোবাজারী, চোরাচালানী, মুনাফাখোরী, অত্যাচার, নারী নির্যাতন, মাদকাসক্তি, বখাটেপনা, ইভটিজিং ইত্যাদি সমাজবিরোধী আচরণের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা আদলের সাথে গ্রহণ করা হ’লে সমাজে শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা সুনিশ্চিত হবে।

মানুষের সৃষ্ট ন্যায়দন্ড মানুষের সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। এটি সৃষ্টিগতভাবেই মানবিক সীমাবদ্ধতার কারণে অসম্ভব। একমাত্র স্রষ্টা তথা আল্লাহর বিধানই তাঁর সৃষ্ট মানব সমাজ জীবনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। আল্লাহ বলেন, إِنَّ اللهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ. ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আদল ও ইহসান প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছেন’ (নাহল ১৬/৯০)। বস্ত্তত সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা ও সুখ-সমৃদ্ধির জন্য আদল প্রতিষ্ঠা একান্ত অপরিহার্য।

৩. মযলুমের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আদল : সমাজের প্রভাবশালীরা যাতে দুর্বলদের উপর যুলুম করতে না পারে, তাদেরকে যাতে অবদমিত করে রাখতে না পারে, নিজেদের প্রতিভা ও যোগ্যতা বিকাশের ক্ষেত্রে দুর্বল জনগোষ্ঠী যেন সমান সুযোগ পায় সেজন্য সমাজে আদল প্রতিষ্ঠা একান্ত প্রয়োজন।

৪. ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কর্মকান্ডে শৃঙ্খলা বিধানে আদল : মানুষের অর্থনৈতিক জীবন তথা ব্যবসা-বাণিজ্য ও লেনদেনে সুষ্ঠু অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় আদলের গুরুত্ব সীমাহীন। দ্রব্য সামগ্রীতে ভেজাল, ওযনে কম-বেশী করা, পণ্যের ত্রুটি গোপন করে বাজারজাত করা ইত্যাকার ব্যবসায়িক অসাধুতা সুষ্ঠু অর্থ ব্যবস্থার অন্তরায় এবং আদলের পরিপন্থী।

মানুষ জীবিকার জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিভিন্ন উৎপাদনকারী কর্মকান্ডে জড়িত হয়। এক্ষেত্রেও আদলের গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ আরো বলেন, ‘মেপে দেয়ার সময় পূর্ণ মাপ দেবে এবং সঠিক দাঁড়িপাল্লায় ওযন করবে। এটা উত্তম; এর পরিণাম শুভ’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৩৫)। তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা ন্যায্য ওযন কায়েম কর এবং ওযনে কম দিয়ো না’ (আর-রহমান ৭৮/৯)। ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কর্মকান্ডে আদলের পরিপন্থী কাজ হ’লে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির সীমা থাকে না। তাই এক্ষেত্রে আদল তথা ইনছাফের গুরুত্ব অপরিসীম।

৫. প্রশাসনিক কর্মকান্ডে আদল : সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কর্মকান্ডকে গণমুখী, মযবূত ও সুসংহতকরণে আদলের গুরুত্ব অত্যধিক। প্রশাসনিক প্রতিটি বিষয় আদল ও সুবিচারের সাথে ফায়ছালা করতে হবে। প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় আদল বা ইনছাফের পরিপন্থী কাজ হ’লে সে প্রশাসনের প্রতি গণমানুষের আস্থা লোপ পায়। এতে গণঅসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। শাসক ও শাসিতের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। প্রশাসনিক শৃঙ্খলা শিথিল হয়ে পড়ে। ‘চেইন অব কমান্ড’ ভেঙে যায়। তাই প্রশাসনিক কর্মকান্ডে শৃঙ্খলা, গতিশীলতা ও জবাবদিহিতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে আদলের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

[চলবে]

ড. মুহাম্মাদ আজিবার রহমান

বিভাগীয় প্রধান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী সিটি ক্যাম্পাস।


[1]. মুহাম্মাদ ফুওয়াদ আব্দুল বাকী, আল-মু‘জামুল মুফাহরাস লি আলফাযিল কুরআনিল কারীম (কায়রো : দারুল হাদীছ, ১৯৯৬), পৃঃ ৫৫১, ৬৫৩-৫৪

[2]. বুখারী হা/৪৩০৪; মুসলিম হা/১৬৮৮

[3]. মাওলানা আব্দুর রঊফ ঝান্ডানগরী, আইয়ামে খিলাফতে রাশেদা (ঝান্ডানগর, নেপাল : জামি‘আ সিরাজুল উলূম আস-সালফিয়া, ১৯৮৩), পৃঃ ৩৫৭। গৃহীত: ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ, আল-হিসবাহ ফিল ইসলাম, পৃঃ ৪

[4]. হযরত আলী (রাঃ)-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক চিঠি (ঢাকা : ইফাবা, ৩য় সংস্করণ, ২০০৮), পৃঃ ১৬, ২৭

[5]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ; মিশকাত হা/৭০১; নাসাঈ হা/৫৩৮০

[6]. মুসলিম; মিশকাত হা/৪৯৬০; রিয়াযুছ ছালেহীন হা/৬৬২

[7]. তিরমিযী হা/১৩৩০ ‘আহকাম’ অধ্যায়, হাদীছ হাসান; মিশকাত হা/৩৭৪১

[8]. ইবনু মাজাহ হা/২৩১২, ‘আহকাম’ অধ্যায়, হাদীছ হাসান

[9]. মুসনাদে আহমাদ হা/৮৫৯৩; সিলসিলা ছহীহা হা/১০২৫, হাদীছ হাসান






বিষয়সমূহ: জীবন কথা
অহীভিত্তিক তাওহীদী চেতনা - আব্দুল মান্নান-এম.এম. এম.এ, মান্দা, নওগাঁ।
আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে কতিপয় ভ্রান্ত আক্বীদা (শেষ কিস্তি) - হাফেয আব্দুল মতীন - পিএইচ.ডি গবেষক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া
তাক্বলীদের বিরুদ্ধে ৮১টি দলীল (৫ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
ইসলামে শিষ্টাচারের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
জুম‘আর পূর্বে সুন্নাতে রাতেবা : একটি পর্যালোচনা (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
আতিথেয়তার আদব সমূহ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
ওযূতে ঘাড় মাসাহ করা সুন্নাত নাকি বিদ‘আত
(পূর্ব প্রকাশিতের পর) - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
এক নযরে হজ্জ - আত-তাহরীক ডেস্ক
অতি ধনীর সংখ্যা এত দ্রুত বাড়ছে কেন? - আলী রিয়ায, প্রফেসর, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র
জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপনের আবশ্যকতা (৫ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
মাদ্রাসার পাঠ্যবই সমূহের অন্তরালে (৪র্থ কিস্তি) - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ঈমান (৪র্থ কিস্তি) - হাফেয আব্দুল মতীন - পিএইচ.ডি গবেষক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া
আরও
আরও
.