ভূমিকা :
আল্লাহ তাঁর ইবাদতের জন্য মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। মুসলিম জীবনের আবশ্যিক কর্তব্য হ’ল আল্লাহর দাসত্ব করা। ইবাদতের প্রসঙ্গ এলে আমাদের কল্পনার দেয়ালে ভেসে ওঠে ছালাত, ছিয়াম, যাকাত, হজ্জ, কুরআন তেলাওয়াত, তাহাজ্জুদ ছালাত প্রভৃতি ইবাদতের কথা। নিঃসন্দেহে এগুলো সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। তবে প্রত্যাহিক জীবনের অন্যান্য কাজগুলোকে ইবাদত মনে করতে আমরা অভ্যস্ত নই। কিন্তু আমরা একটু সচেতন হ’লেই আমাদের জীবনের অভ্যাসমূলক কাজকেও ইবাদতে পরিণত করে নেকীর পাল্লাকে ভারী করতে পারি। আলোচ্য নিবন্ধে আভ্যাসকে ইবাদতে পরিণত করার কতিপয় উপায় আলোকপাত করা হ’ল।-
১. সাধারণ জায়েয কাজ যখন ইবাদত :
বান্দা যখন তার নিত্যকার বৈধ[1] ও অভ্যাসমূলক কাজে আল্লাহর নৈকট্য লাভের নিয়ত করেন, তখন সেই সকল কাজের মাধ্যমেও তিনি মহা পুরস্কার ও প্রচুর ছওয়াবের অধিকারী হ’তে পারেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ لَكَ مَا احْتَسَبْتَ، ‘তুমি (কোন কাজে) নেকীর প্রত্যাশা করলে তা অবশ্যই তোমার জন্য নির্ধারিত হবে’।[2] ইবনুল হাজ্জ (রহঃ) বলেন, المباح ينتقل بالنية إلى الندب، ‘মুবাহ কাজ নিয়তের মধ্যমে মুস্তাহাব আমলে পরিণত হয়’।[3] ইমাম নববী বলেন, أنَّ الْمُبَاحَ إِذَا قُصِدَ بِهِ وَجْهُ اللهِ تَعَالَى صَارَ طَاعَةً وَيُثَابُ عَلَيْهِ، ‘যে মুবাহ কাজের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের ইচ্ছা করা হয়, সেই কাজটি ইবাদতে পরিণত হয়ে যায় এবং সেই কাজের জন্য নেকী প্রদান করা হয়’।[4] তবে মুবাহ কাজের মাধ্যমে পাপ কাজের নিয়ত করলে, সেই কাজ পাপে পরিণত হয়। ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ (রহঃ) বলেন,المباحُ بالنيةِ الحسنةِ يكون خيرًا، وبالنيةِ السيئةِ يكون شرًّا، ‘নেকীর নিয়ত করলে মুবাহ কাজ নেক আমলে পরিণত হয়, আর পাপের নিয়ত করলে মন্দ কাজে পরিণত হয়’।[5] মূলত খালেছ নিয়তের কারণেই বান্দা সেই সকল কাজে নেকীপ্রাপ্ত হবে। কেননা বান্দার সব আমলের নেকী নিয়তের উপরে নির্ভরশীল।[6] একনিষ্ঠ নিয়তের এই বিষয়গুলো আমাদের প্রাত্যহিত জীবনে নানাভাবে প্রতিফলিত হ’তে পারে। যেমন-
(ক) অনেকের আতর ব্যবহার করার অভ্যাস আছে। তিনি যদি মসজিদে যাওয়ার আগে আতর মাখার সময় আল্লাহর ঘরেকে সম্মান করা এবং মানুষ ও ফেরেশতাদের তার মুখ ও দেহের গন্ধ দ্বারা কষ্ট দেওয়া থেকে হেফাযত করার নিয়ত করে, তাহ’লে তার নিয়তের গুণে সেই আতর ব্যবহারও ইবাদত হিসাবে গণ্য হবে এবং প্রভুত নেকী অর্জিত হবে।
(খ) কেউ কেউ সকাল বেলা হাঁটাহাটি করতে বা বিকেলে খেলাধুলা করতে অভ্যস্ত। তিনি যদি এই নিয়তে শরীর চর্চার করেন যে, এই হাঁটাহাটি, ব্যায়াম, খেলাধুলা, শরীর চর্চা প্রভৃতির মাধ্যমে আমার দেহ সুস্থ থাকবে এবং সেই সুস্থ শরীরে আমি আল্লাহর ইবাদত করব, আল্লাহর পথে শ্রম দিব, তাহ’লে এই শরীর চর্চাও ইবাদত রূপে গণ্য হবে।
(গ) অনেক সময় আমরা শিক্ষা সফরে যাই। আবার কখনো কখনো ভ্রমণে বের হয়ে পড়ি। এই ভ্রমণের সময় যদি আমরা এই নিয়ত করি যে, আমরা ভ্রমণের মাধ্যমে আল্লাহর সৃষ্টি অবলোকন করব এবং চিন্তা-গবেষণার করে এর মাধ্যমে উপদেশ হাছিল করব, অথবা সুযোগ পেলে সফর করার পাশাপাশি দাওয়াতী কাজ করব, তাহ’লে এই ভ্রমণ করার মাধ্যমেও আমরা ইবাদতের নেকী লাভ করতে পারি।
(ঘ) শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় খালেছ নিয়তের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। যদি কোন মেডিকেলের ছাত্র তার অধ্যয়নের মাধ্যমে ভবিষ্যতে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার উদ্দেশ্যে পড়ালেখা করেন, অনুরূপ ইঞ্জিনিয়ারিং বা অন্যান্য শাখার শিক্ষার্থীরা যদি তাদের বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের জ্ঞান দ্বারা ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর সেবা করার নিয়ত করেন, তাহ’লে তাদের সেই পড়াশোনা ইবাদত হিসাবে গণ্য হবে। কিন্তু কেউ যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি ব্যতিরেকে পার্থিব কোন উদ্দেশ্যে বা দুনিয়ার কোন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য কুরআন-হাদীছের জ্ঞানও অর্জন করে, তাহ’লে জান্নাতে প্রবেশ করা তো দূরের কথা জান্নাতের সুগন্ধিও সে পাবে না।[7] সুতরাং বোঝা গেল নিয়তের বিশুদ্ধতার কারণে সাধারণ জ্ঞানার্জনও ইবাদত হিসাবে গণ্য হবে, আবার নিয়তের অশুদ্ধতার কারণে দ্বীনি জ্ঞান অর্জন করা জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হ’তে পারে। মহান আল্লাহ আমাদের নিয়তগুলো কেবল তাঁর জন্য একনিষ্ঠ করার তাওফীক্ব দান করুন।
এভাবে বিশুদ্ধ নিয়তের মাধ্যমে অভ্যাসমূলক ও মুবাহ কাজগুলোকে ইবাদতে রূপান্তরিত করা যায়।
২. ঘুম যখন ইবাদত :
ঘুম মনবজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানুষের চিরায়ত অভ্যাস। জীবনের এক-তৃতীয়াংশ সময় আমরা ঘুমে কাটিয়ে দেই। গভীর রাতে এপাশ-ওপাশ করেও যার চোখে ঘুম আসে না, সে-ই ঘুমের গুরুত্ব বোঝে। একজন মুমিনের জীবনে ঘুম আলাদা তাৎপর্য পরিগ্রহ করে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোন নযীর পাওয়া যাবে না যে, ঘুম পাড়ার কারণে কোন কর্মচারীকে বেতন দেওয়া হয়। কিন্তু কোন মুমিন বান্দা তার ঘুমকে আল্লাহর দাসত্বে পরিণত করতে পারেন। সে সুখ নিদ্রায় বিভোর থাকে, আর ফেরেশতারা তার আমলের খাতায় নেকী লিখতে থাকেন। ঘুমকে ইবাদতে পরিণত করার কতিপয় পদ্ধতি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের শিখিয়েছেন। যেমন-
(ক) ঘুমানোর আগে ওযূ করে ঘুমানো : ওযূ করে ঘুমাতে গেলে, সেই ঘুম ইবাদতে রূপান্তরিত হয় এবং ফেরেশতারা ঘুমন্ত ব্যক্তির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ)-এর বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ بَاتَ طَاهِرًا بَاتَ فِي شِعَارِهِ مَلَكٌ فَلَمْ يَسْتَيْقِظْ إِلَّا قَالَ الْمَلَكُ: اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِعَبْدِكَ فُلَانٍ، فَإِنَّهُ بَاتَ طَاهِرًا- ‘যে ব্যক্তি পবিত্র হয়ে (ওযূ করে) রাত্রি যাপন করে, তার কাছাকাছি একজন ফেরেশতা রাত্রি যাপন করেন। সে ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সেই ফেরেশতা তার জন্য এই বলে দো‘আ করতে থাকে হে আল্লাহ! আপনার এই বান্দাকে ক্ষমা করে দিন। কেননা সে পবিত্রতা অর্জন করে রাত্রি যাপন করেছে’।[8]
(খ) তাহাজ্জুদের নিয়তে ঘুমিয়ে পড়া : যে বান্দা তাহাজ্জুদের নিয়তে রাতে ঘুমিয়ে পড়ে, নিয়তের কারণে তিনি তাহাজ্জুদের নেকী লাভ করেন এবং তার ঘুম আল্লাহর নিকটে ছাদাক্বাহ হিসাবে গণ্য হয়। আবুদ্দারদা (রাঃ)-এর বর্ণনায় রাসূল (ছাঃ) ইরশাদ করেছেন, مَنْ أَتَى فِرَاشَهُ وَهُوَ يَنْوِي أَنْ يَقُومَ يُصَلِّي مِنَ اللَّيْلِ، فَغَلَبَتْهُ عَيْنَاهُ حَتَّى أَصْبَحَ كُتِبَ لَهُ مَا نَوَى، وَكَانَ نَوْمُهُ صَدَقَةً عَلَيْهِ مِنْ رَبِّهِ عَزَّ وَجَلَّ، ‘যে ব্যক্তি বিছানায় শয়নকালে এই নিয়ত করবে যে, সে ঘুম থেকে জেগে রাতের ছালাত (তাহাজ্জুদ) আদায় করবে, অতঃপর ঘুমের আধিক্যের কারণে যদি সকাল হয়ে যায়, তবুও সে যার নিয়ত করেছে, তার নেকী পেয়ে যাবে। আর আল্লাহর কাছে তার সেই ঘুম ছাদাক্বাহ হিসাবে গৃহীত হবে’।[9]
(গ)ইবাদতের শক্তি সঞ্চয়ের জন্য ঘুমানো : ক্লান্ত দেহকে উদ্দীপিত করতে এবং পরিশ্রান্ত শরীরে কর্মোদ্দীপনা সঞ্চারিত করার জন্য ঘুমানো ইবাদত হিসাবে গণ্য হ’তে পারে। মু‘আয ইবনু জাবাল (রাঃ) ইয়ামানের এক সফরে আবূ মূসা আশ‘আরী (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেন ‘আপনি কিভাবে কুরআন তেলাওয়াত করেন?’ আবূ মূসা (রাঃ) উত্তরে বলেন, ‘আমি দাঁড়িয়ে, বসে, সওয়ারীর পিঠে আরোহী অবস্থায় এবং কিছুক্ষণ পর পর কুরআন তেলাওয়াত করি। জবাব শুনে মু‘আয (রাঃ) বলেন,أَمَّا أَنَا فَأَنَامُ وَأَقُوْمُ، فَأَحْتَسِبُ نَوْمَتِى كَمَا أَحْتَسِبُ قَوْمَتِى، ‘আমি রাতের প্রথম দিকে ঘুমিয়ে পড়ি, তারপর (শেষভাগে কুরআন তেলাওয়াতের জন্য) দাঁড়িয়ে যাই। এভাবেই আমি আমার নিদ্রার সময়কেও ছালাতে দাঁড়ানোর মতই ছওয়াবের বিষয় মনে করি’।[10] অর্থাৎ মু‘আয (রাঃ) রাতের তাহাজ্জুদ ছালাত যেমন ইবাদত মনে করেন, অনুরূপ তার ঘুমকেও ইবাদত মনে করেন। কেননা সতেজ মনে ইবাদত করার জন্য ঘুম দেহকে উপযোগী করে তোলে এবং ইবাদতে মনোনিবেশ করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ছাহেবে মির‘আত ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (রহঃ) বলেন, إذا قصد بالنوم زوال التعب للقيام إلى العبادة عن نشاط كان النوم طاعة، ‘যদি ঘুমের মাধ্যমে ক্লান্তি দূর করে প্রফুল্লতা নিয়ে ইবাদত করার নিয়ত করা হয়, তাহ’লে সেই ঘুমও ইবাদত’।[11] তবে কেউ যদি পাপ করার নিয়ত নিয়ে ঘুমায়, তাহ’লে তার ঘুম পাপ হিসাবে পরিগণিত হবে। যেমন ফজর ছালাত না পড়ার নিয়তে ঘুমালে, সেই নিদ্রা পাপ বলে সাব্যস্ত হবে।
৩. খানাপিনা করা যখন ইবাদত :
বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যের প্রয়োজন। পৃথিবীর সকল প্রাণীকে খানাপিনা করতে হয়। এটা তাদের চিরায়ত অভ্যাস। খাদ্য ছাড়া প্রাণীর অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। পশু-প্রাণী থেকে শুরু করে কাফের-মুশরিক, মুমিন-মুসলিম সবাই খানাপিনা করে। কিন্তু একটু সচেতন হ’লেই একজন মুমিন বান্দা তার এই খানাপিনাকে ইবাদতে পরিণত করতে পারেন। সে গ্রাসে গ্রাসে পরম তৃপ্তিভরে খাবার খাবে, পান করবে। আর আল্লাহর ফেরেশতারা এর নেকী লিপিবদ্ধ করতে থাকবে। কারণ সে খাবার গ্রহণের মাধ্যমে শুধু ক্ষুধাই নিবারণ করছে না, বরং আল্লাহর ইবাদত করছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, الْمُسْلِمُ يُؤْجَرُ فِيْ كُلِّ شَيْءٍ حَتَّى فِي اللُّقْمَةِ يَرْفَعُهَا إِلَى فِيْهِ، ‘মুসলিম ব্যক্তির প্রত্যেক কাজের জন্য প্রতিদান দেওয়া হয়, এমনকি নিজের মুখে খাবারের লোকমা তুলে নেওয়ার সময়েও (তাকে নেকী প্রদান করা হয়)’।[12] যুবাইদ আল-ইয়ামী (রহঃ) বলেন, ‘প্রতিটি কথায় ও কাজে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার নিয়ত থাকা আমি খুব পসন্দ করি, এমনকি খাদ্য-পানীয় গ্রহণের ক্ষেত্রেও’।[13] অর্থাৎ কোন মুসলিম যদি এই উদ্দেশ্যে খানাপিনা করে যে, এই খাদ্য তার শরীরকে পরিপুষ্ট করবে, তাকে দৈহিক ও মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখবে, তনু-মন আল্লাহর ইবাদতের উপযোগী হবে তাহ’লে তার খাওয়া, পান করা এবং খানাপিনার জন্য ব্যয়িত সময় সবকিছু আল্লাহর ইবাদত হিসাবে গণ্য হবে। এমনকি এই খানাপিনা তার পাপ মোচনের মাধ্যম হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি খাবার গ্রহণের পরে, নিমেণর দো’টি পাঠ করবে, তার বিগত জীবনের সকল ছগীরা গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। দো‘আটি হ’ল- الحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَطْعَمَنِي هَذَا وَرَزَقَنِيْهِ مِنْ غَيْرِ حَوْلٍ مِنِّي وَلَا قُوَّةٍ، ‘সকল প্রসংশা তাঁর যিনি আমাকে এই খাবার খাইয়েছেন, আমার নিজের পক্ষ থেকে কোন শক্তি ও ক্ষমতা ছাড়াই আমাকে রিযিক প্রদান করেছেন’।[14] তবে খানাপিনাকে ইবাদতে পরিণত করার জন্য চারটি শর্ত প্রযোজ্য-
(১) অবশ্যই সেই খাদ্য ও পানীয় হালাল হ’তে হবে। সেটা সত্তাগত দিক থেকে যেমন হারাম হবে না, তেমনি হারাম উপার্জনে সংগৃহীতও হবে না। কেননা ইবাদত কবুলের অন্যতম শর্ত হ’ল হালাল খাদ্য ভক্ষণ করা।
(২) আল্লাহর অনুগত্যের নিয়তে অপচয় না করে প্রয়োজন মাফিক খাদ্য গ্রহণ করা।
(৩) খাওয়ার শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলা এবং খাওয়ার শেষে আলহামদুলিল্লাহ বলা।
(৪) খানাপিনার তাওফীক্ব লাভের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত রিযিকের প্রসংশা করা এবং শুকরিয়া আদায় করা।
তবে কেউ যদি হারাম খাদ্য খায় এবং হারাম পানীয় পান করে, তাহ’লে তার এই খানাপিনা পাপ হিসাবে গণ্য হবে। অনুরূপভাবে খাওয়ার শুরুতে ও শেষে আল্লাহকে স্মরণ না করলে এবং খাবার গ্রহণ শেষে আল্লাহর প্রশংসা ও শুকরিয়া আদায় না করলে সেই খাদ্য তার গুনাহের পাল্লাকে ক্রমান্বয়ে ভারী করে তুলবে।
৪. পরিবারের ভরণ-পোষণ করা যখন ইবাদত :
মানুষ সামাজিক জীব। এই সমাজ জীবনের প্রথম ইউনিট হ’ল পরিবার। পিতা-মাতা, ভাই-বোন, সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে নিয়ে আমরা বসবাস করি। গৃহকর্তা তার পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য যা কিছু ব্যয় করেন, এর মাধ্যমে তিনি আল্লাহর কাছ থেকে দান-ছাদাক্বাহ করার নেকী লাভ করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِنَّ الْمُسْلِمَ إِذَا أَنْفَقَ عَلَى أَهْلِهِ نَفَقَةً، وَهُوَ يَحْتَسِبُهَا، كَانَتْ لَهُ صَدَقَةً، ‘যখন মুসলিম বান্দা নেকীর আশায় স্বীয় পরিবারের জন্য কোন খরচ করে, তখন তার জন্য ছাদাক্বাহ করার সমতুল্য ছওয়াব নির্ধারণ করা হয়’।[15] অন্যত্র তিনি বলেছেন,إِنَّ صَدَقَتَكَ مِنْ مَالِكَ صَدَقَةٌ، وَإِنَّ نَفَقَتَكَ عَلَى عِيَالِكَ صَدَقَةٌ، وَإِنَّ مَا تَأْكُلُ امْرَأَتُكَ مِنْ مَالِكَ صَدَقَةٌ، ‘তোমার সম্পদ থেকে তুমি যা দান কর তা তো ছাদাক্বাহ-ই। তুমি তোমার পরিবার-পরিজনের জন্য যেটা খরচ কর, সেটাও ছাদাক্বাহ। এমনকি তোমার স্ত্রী তোমার মাল থেকে যা কিছু ভক্ষণ করে, সেটাও তোমার জন্য ছাদাক্বাহ হিসাবে গণ্য হয়’।[16]
পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য প্রত্যেক গৃহকর্তাকে নানা রকম খরচপাতি করতে হয়। এটা তাদের দায়িত্ব। মুসলিম-অমুসলিম, মুমিন-ফাসেক সবাই নির্দ্বিধায় এই দায়িত্বের জোয়াল নিজের কাঁধে বয়ে নিয়ে বেড়ান। কিন্তু একজন মুসলিম যদি নিয়তকে পরিশুদ্ধ করে আল্লাহর সন্তুষ্টির বাসনা নিয়ে পরিবারের খোরপোশের জোগান দেন, তাহ’লে তিনি প্রত্যেকটি খরচ ও ব্যয়ের মাধ্যমে দান-ছাদাক্বাহ করার মতো একটি বড় ইবাদতের নেকী লাভ করতে পারবেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّكَ لَنْ تُنْفِقَ نَفَقَةً تَبْتَغِيْ بِهَا وَجْهَ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ إِلَّا أُجِرْتَ بِهَا، حَتَّى مَا تَجْعَلُ فِيْ فَمِ امْرَأَتِكَ، ‘তুমি আল্লাহর নৈকট্য হাছিলের জন্য যা কিছু দান করো না কেন, তোমাকে তার প্রতিদান নিশ্চিতরূপে প্রদান করা হবে। এমনটি তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে যা তুলে দাও, তার বিনিময়েও’।[17] আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,دِيْنَارٌ أَنْفَقْتَهُ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ وَدِيْنَارٌ أَنْفَقْتَهُ فِيْ رَقَبَةٍ، وَدِيْنَارٌ تَصَدَّقْتَ بِهِ عَلَى مِسْكِيْنٍ، وَدِيْنَارٌ أَنْفَقْتَهُ عَلَى أَهْلِكَ، أَعْظَمُهَا أَجْرًا الَّذِيْ أَنْفَقْتَهُ عَلَى أَهْلِكَ، ‘কোন একটি দীনার তুমি আল্লাহর পথে ব্যয় করেছ, একটি দীনার তুমি ব্যয় করেছ ক্রীতদাসকে মুক্ত করার জন্য, একটি দীনার তুমি ছাদাক্বাহ করেছ মিসকীনের জন্য এবং একটি দীনার তুমি তোমার পরিবার-পরিজনের জন্য ব্যয় করেছ। এর মাঝে ছওয়াবের দিক সর্বোত্তম হ’ল সেটি, যা তুমি তোমার পরিবারের জন্য খরচ করেছ’।[18]
ইমাম ত্বীবী (রহঃ) বলেন,فيه دليل على أن إنفاق الرجل على أهله أفضله من الإنفاق في سبيل الله، ومن الإنفاق في الرقاب ومن التصدق على المساكين، ‘এই হাদীছে দলীল রয়েছে যে, আল্লাহর পথে ব্যয় করা, দাস মুক্তির জন্য দান করা এবং মিসকীনদেরকে ছাদাক্বাহ করার চেয়েও কোন ব্যক্তির জন্য ফযীলতপূর্ণ আমল হ’ল পরিবার-পরিজনের জন্য খরচ করা’।[19]
আবূ ক্বিলাবাহ (রহঃ) বলেন,أَيُّ رَجُلٍ أَعْظَمُ أَجْرًا، مِنْ رَجُلٍ يُنْفِقُ عَلَى عِيَالٍ صِغَارٍ، يُعِفُّهُمْ أَوْ يَنْفَعُهُمُ اللهُ بِهِ وَيُغْنِيهِمْ، ‘সেই ব্যক্তির চেয়ে অধিক ছাওয়াবের অধিকারী আর কে হবে, যে তার ছোট ছোট সন্তানদের জন্য খরচ করে? কেননা আল্লাহ এর বিনিময়ে তাদেরকে পবিত্র রাখেন, উপকৃত করেন এবং অভাবমুক্ত রাখেন’।[20] সুতরাং বুঝা গেল, কোন মুসলিম ব্যক্তির জন্য পরিবার-পরিজনের খোরপোষের ব্যবস্থা করাও ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। তবে খেয়াল রাখতে হবে পরিবারের জন্য এই খরচপাতি যেন অপচয়-অপব্যয়ের পর্যায়ে না যায় এবং সেই সম্পদ যেন হালাল পন্থায় উপার্জিত হয়। নচেৎ তিনি ইবাদতের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হবেন এবং আল্লাহর আযাবের সম্মুখীন হবেন।
৫. চাকুরি-ব্যবসা-কৃষি কাজও যখন ইবাদত :
জীবন নির্বাহের জন্য মানুষ বহুমুখী পেশায় আত্মনিয়োগ করে। জীবিকার তাকীতে শিক্ষক, চাকুরিজীবী, ব্যবসায়ী, ড্রাইভার, মৎসজীবী, নাপিত, কামার, কুমার, মিস্ত্রি, কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর প্রমুখ পেশাজীবী মানুষ জীবন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম ও মেহনতের জ্বালানী দিয়েই সংসারের চাকা গতিশীল থাকে। তাদের আয়-রোজগার থেকেই পরিবার-পরিজনের বেঁচে থাকার রসদ সংগৃহীত হয়। পরিবারের প্রিয় মানুষদের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটানোর জন্য এই সকল লড়াকু পেশাজীবীদের মেহনত কখনো বৃথা যায় না। সকালের কনকনে শীত উপেক্ষা করে লাঙ্গল-জোয়াল কাঁধে নিয়ে ছুটে চলা কৃষক, ঘর্মসিক্ত শ্রমিক-রিক্সাচালক, দায়িত্বের ভারবাহী শহুরে-গ্রামীণ চাকুরিজীবীরা-ব্যবসায়ীরা তাদের এই পেশাগুলোর সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়, অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। তারা তাদের কাজগুলোকে নিছক নিজেদের কর্তব্য মনে করলেও, আল্লাহর কাছে রয়েছে এর সীমাহীন পুরস্কার। কা‘ব ইবনে উজরা (রাঃ) বলেন, مَرَّ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَجُلٌ، فَرَأَى أَصْحَابُ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ جِلْدِهِ وَنَشَاطِهِ، فَقَالُوا: يَا رَسُولَ اللهِ: لَوْ كَانَ هَذَا فِي سَبِيلِ اللهِ؟، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنْ كَانَ خَرَجَ يَسْعَى عَلَى وَلَدِهِ صِغَارًا فَهُوَ فِي سَبِيلِ اللهِ، وَإِنْ كَانَ خَرَجَ يَسْعَى عَلَى أَبَوَيْنِ شَيْخَيْنِ كَبِيرَيْنِ فَهُوَ فِي سَبِيلِ اللهِ، وَإِنْ كَانَ يَسْعَى عَلَى نَفْسِهِ يُعِفُّهَا فَهُوَ فِي سَبِيلِ اللهِ، وَإِنْ كَانَ خَرَجَ رِيَاءً وَمُفَاخَرَةً فَهُوَ فِي سَبِيلِ الشَّيْطَانِ. ‘এক ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-এর পাশ দিয়ে চলে গেল। রাসূল (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণ সেই লোকের কায়িক পরিশ্রম ও কর্মোদ্যম দেখে বললেন, হে আল্লাহ রাসূল! সে যদি আল্লাহর পথে এই পরিশ্রম করত (তাহ’লে কতই না ভালো হত)। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, সে যদি তার ছোট্ট সন্তাদের জন্য উপার্জনে বের হয়, তাহ’লে সে আল্লাহর পথেই ব্যস্ত আছে। সে যদি তার বৃদ্ধ পিতামাতার জন্য রোজগারে বের হয়, তাহ’লে সে আল্লাহর পথেই কষ্ট স্বীকার করছে। সে যদি নিজেকে সংযম রাখার জন্য আয়-উপার্জনে বের হয়, তাহ’লে সে আল্লাহর পথেই কাজ করছে। তবে সে যদি লৌকিকতা এবং অহংকারের জন্য উপার্জনে বের হয়, তাহ’লে সে শয়তানের পথে কাজ করছে’।[21] অপর বর্ণনায় এসেছে, আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন,بَيْنَمَا نَحْنُ جُلُوسٌ مَعَ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِذْ طَلَعَ عَلَيْنَا شَابٌّ مِنَ الثَّنِيَّةِ فَلَمَّا رَأَيْنَاهُ بِأَبْصَارِنَا قُلْنَا : لَوْ أَنَّ هَذَا الشَّابَ جَعَلَ شَبَابَهُ وَنَشَاطَهُ وَقُوَّتَهُ فِى سَبِيلِ اللهِ قَالَ فَسَمِعَ مَقَالَتَنَا رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ : وَمَا سَبِيلُ اللهِ إِلاَّ مَنْ قُتِلَ؟ مَنْ سَعَى عَلَى وَالِدَيْهِ فَفِى سَبِيلِ اللهِ وَمَنْ سَعَى عَلَى عِيَالِهِ فَفِى سَبِيلِ اللهِ وَمَنْ سَعَى عَلَى نَفْسِهِ لِيُعِفَّهَا فَفِى سَبِيلِ اللهِ وَمَنْ سَعَى عَلَى التَّكَاثُرِ فَهُوَ فِى سَبِيلِ الشَّيْطَانِ. ‘একদিন আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে বসেছিলাম। হঠাৎ আমাদের সামনের সামনের দিক থেকে এক যুবকের আগমন ঘটল। আমরা তাকে দেখে বললাম, ‘যদি এই যুবক তার যৌবন, উদ্দীপনা ও শক্তিমত্তা দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করত! (তাহ’লে কতই না উত্তম হ’ত)। রাবী বলেন, রাসূল (ছাঃ) আমাদের কথাবার্তা শুনে বললেন, ‘নিহত হওয়া হওয়া ছাড়া কি আল্লাহ পথে সংগ্রামের কোন রাস্তা নেই? (শুনে রাখ!) যে ব্যক্তি তার পিতামাতার জন্য কাজ করে, সে আল্লাহর পথেই কাজ করছে। যে তার পরিবারে জন্য শ্রম ব্যয় করছে, সে আল্লাহর পথেই পরিশ্রম করছে। আর যে ব্যক্তি নিজেকে নিষ্কলুষ রাখার জন্য মেহনত করছে, সে আল্লাহর পথেই মেহনত করছে। কিন্তু যে ব্যক্তি কেবল সম্পদ বৃদ্ধির জন্য পরিশ্রম করে, সে শয়তানের পথে পরিশ্রম করে’।[22]
অত্র হাদীছদ্বয়ের মাধ্যমে বোঝা গেল- চাকুরি, ব্যবসা, কৃষি বা যে কোন পেশা অবলম্বন করে আয়-রোজগার করা ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে সেটা হবে আল্লাহর পথে জিহাদ করার ন্যায় ফযীলতপূর্ণ ইবাদত। কিন্তু সেই পেশা বা কাজ ইবাদত হওয়ার জন্য তিনটি শর্ত প্রযোজ্য হবে। আর তা হ’ল-
(১) সেই চাকুরি বা পেশা অবশ্যই হালাল হ’তে হবে। কোন হারাম পেশা অবলম্বন করলে ইবাদত তো দূরের কথা আরো গোনাহগার হ’তে হবে।
(২) সেই পেশা অবলম্বন করে যেন আল্লাহর কোন ফরয-ওয়াজিব বিধান ছুটে না যায়। যেমন ছালাত ত্যাগ করা, মেয়েদের পর্দা না করা, ছেলেদের টাখনুর নিচে কাপড় পরিধান করা, দাড়ি মুন্ডন করা ইত্যাদি বিধান লঙ্ঘিত হওয়া যাবে না।
(৩) এই পেশার মাধ্যমে আয়-রোজগার করে পবিরার ও নিজের সচ্ছলতা, আল্লাহর পথে দান-ছাদাক্বাহ, মুসলিমদের সহায়তা করার নিয়ত থাকতে হবে। কিন্তু শুধু সম্পদশালী হওয়া বা অন্যের উপর প্রাধান্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে থাকলে সেই আয়-রোজগার হারাম হিসাবে গণ্য হবে।
সুতরাং উপরিউক্ত তিনটি শর্ত পূরণ করলেই কেবল পেশা অবলম্বনের চিরায়ত অভ্যাসকে ইবাদতে রূপান্তরিত করা সম্ভব হবে, নচেৎ নয়।
৬. জৈবিক চাহিদা পূরণ করা যখন ইবাদত :
মানবিক প্রবৃত্তির যত চাহিদা আছে তন্মধ্যে জৈবিক চাহিদা প্রধান। আল্লাহ নর-নারীর জন্য হালাল পথে এই চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করেছেন। আর সেটা হ’ল বিবাহ। যখন কোন ছেলে-মেয়ের মাঝে বিবাহের মাধ্যমে পবিত্র বন্ধন তৈরী হয়, তখন সেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার খুনসুটি, প্রেমালাপ, মধুর মিলন সব কিছুই আল্লাহর দরবারে ইবাদত হিসাবে পরিগণিত হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, فِي بُضْعِ أَحَدِكُمْ صَدَقَةٌ، ‘স্ত্রীর সাথে মিলন করাও তোমাদের জন্য ছাদাক্বাহ স্বরূপ’। ছাহাবীগণ বললেন,يَا رَسُولَ اللهِ، أَيَأتِي أَحَدُنَا شَهْوَتَهُ وَيَكُونُ لَهُ فِيهَا أَجْرٌ؟ ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের কেউ যদি স্ত্রী সংগম করে, তাতেও কি সে ছওয়াব পাবে?’ তিনি বললেন,أَرَأَيْتُمْ لَوْ وَضَعَهَا فِيْ حَرَامٍ أَكَانَ عَلَيْهِ فِيْهَا وِزْرٌ؟ فَكَذَلِكَ إِذَا وَضَعَهَا فِي الْحَلَالِ كَانَ لَهُ أَجْرٌ، ‘তোমাদের কী মনে হয়, যদি সে হারাম পথে কামাচারে লিপ্ত হ’ত, তাহ’লে কি তার পাপ হ’ত না? অনুরূপভাবে যদি সে হালাল পথে যৌনসংগম করে, তাতে সে ছওয়াব পাবে’।[23] ইমাম নববী (রহঃ) বলেন,الْجِمَاعُ يَكُونُ عِبَادَةً إِذَا نَوَى بِهِ قَضَاءَ حَقِّ الزَّوْجَةِ وَمُعَاشَرَتَهَا بِالْمَعْرُوفِ الَّذِي أَمَرَ اللهُ تَعَالَى بِهِ أَوْ طَلَبَ وَلَدٍ صَالِحٍ أَوْ إِعْفَافَ نَفْسِهِ أَوْ إِعْفَافَ الزَّوْجَةِ، ‘স্বামী-স্ত্রীর সহবাসও ইবাদত হিসাবে গণ্য হবে, যদি স্ত্রীর অধিকার আদায়ের নিয়ত করা হয়, আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় স্ত্রীর সাথে ন্যায়সঙ্গতভাবে মেলামেশা করা হয়, নেক সন্তান কামনা করা হয় এবং স্বামী-স্ত্রী উভয়ের চরিত্রের হেফাযতের জন্য এটা করা হয়’।[24]
৭. কাপড় পরিধান করা যখন ইবাদত :
আমরা প্রতিদিন কাপড় পরিধান করি। পোষাক আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। নারী-পুরুষ সবাই কাপড়ের মুখাপেক্ষী। বান্দা যদি আল্লাহর নির্দেশ পালন করে পোষাক পরিধান করে, তাহ’লে পোষাক পরিধানও ইবাদত হবে পারে। যেমন আমরা যদি প্রতিদিন কাপড় পরিধান করার শুরুতে দো‘আ পড়ি, তাহ’লে এই পোষাক পরিধানও জীবনের পাপ মোচনের মাধ্যম হ’তে পারে। দো‘আটি হ’ল الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِيْ كَسَانِي هَذَا الثَّوْبَ وَرَزَقَنِيهِ مِنْ غَيْرِ حَوْلٍ مِنِّي، وَلَا قُوَّةٍ، ‘সমস্ত প্রসংসা আল্লাহর জন্য যিনি আমাকে আমার কেনা শক্তি ও ক্ষমতা ছাড়াই এই কাপড় পরিধান করিয়েছেন এবং আমাকে তা রিযিক রূপে দান কররেছেন’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কাপড় পরিধানের সময় এই দো‘আটি পাঠ করবে, তার পূর্বের (ছগীরা) গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে’।[25] সুতরাং বোঝা গেল কাপড় পরিধান করাও ইবাদত হ’তে পারে। কেননা ইবাদতের অন্যতম পুরস্কার হ’ল এর মাধ্যমে বান্দার গোনাহ মাফ করা হয়। তবে কাপড় পরিধানকে ইবাদতে পরিণত করার জন্য কয়েকটি অবশ্যিক শর্ত থাকতে হবে। যেমন-
(১) পোষাক পরিধানের সময় আল্লাহকে স্মরণ করা।
(২) সেই পোষাক অবশ্যই সতর আবৃতকারী এবং ঢিলেঢালা হ’তে হবে। যেন শরীরের গোনীয় অঙ্গসমূহ প্রকাশ না পায় এবং প্রকট হয়ে দেখা না যায়। পোষাকের মাধ্যমে যেন তাক্বওয়ার ভাব প্রস্ফূটিত হয়; অশ্লীলতা প্রকাশ না পায়।
(৩) পোষাক যেন বিধর্মী ও বিপরীত লিঙ্গের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ না হয়।
(৪) পোষাক পড়তে হবে শরী‘আতের বিধান অনুযায়ী। যেমন পুরুষদের টাখনুর উপরে কাপড় পড়া, রেশমী পোষাক পরিধান না করা, মেয়েদের শরঈ পর্দা করা ইত্যাদি।
উল্লিখিত শর্ত সাপেক্ষে পোষাক পরিধান করলে সেটা ইবাদতে রূপান্তরিত হয়, নচেৎ পোষাকও জাহান্নামের যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
৮. মহিলাদের গৃহস্থালী কাজও যখন ইবাদত :
বাড়ির অভ্যন্তরীণ কার্যাবলী সম্পাদন করেন মহিলাগণ। সন্তানদের দেখ-ভাল করা, শিশু সন্তানদের ময়লা পরিস্কার করা, রান্না-বান্না করা, ঘর-দুয়ার পরিস্কার রাখা, কাপড় কাচা, স্বামী বা পিতার হাতের কাজ এগিয়ে দেওয়া এবং সাংসারিক আরোও নানা ধরনের কাজে মহিলাগণ নিত্যদিন ব্যস্ত সময় পার করেন। আবার গ্রামের অনেক গৃহীনী সুযোগ পেলে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগী ইত্যাদি প্রতিপালন করেন। কায়িক পরিশ্রম ও সময়ের কুরবানী দিয়ে তারা গড়ে তোলেন তিলতিল করে একটি সংসার। গৃহস্থালী এই কাজগুলোকে তারা হয়ত নিজেদের দায়িত্ব-কর্তব্য হিসাবে দেখতেই অভ্যস্ত। কিন্তু তারা যদি নিয়ত খালেছ করতে পারেন, তাহ’লে তারা তাদের এই কাজগুলোকে ইবাদতে পরিণত করতে পারেন এবং প্রতিটি কাজ ও শ্রমের বিনিময়ে আল্লাহর কাছ থেকে দান-ছাদাক্বাহ করার নেকী লাভ করতে পারেন। একবার উম্মে সালামা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলেন,يَا رَسُولَ اللهِ، هَلْ لِي أَجْرٌ فِي بَنِي أَبِي سَلَمَةَ؟ أُنْفِقُ عَلَيْهِمْ، وَلَسْتُ بِتَارِكَتِهِمْ هَكَذَا وَهَكَذَا، إِنَّمَا هُمْ بَنِيَّ؟ ‘হে আল্লাহর রাসূল! (আমার প্রথম স্বামী) আবূ সালামার সন্তানদের জন্য আমি খরচ করি, তাতে কি আমি ছওয়াব পাব? আমি তাদের এভাবে ছেড়ে দিতে পারি না, তারা তো আমারই সন্তান?। রাসূল (ছাঃ) বললেন, نَعَمْ، لَكِ فِيْهِمْ أَجْرُ مَا أَنْفَقْتِ عَلَيْهِمْ، ‘হ্যাঁ! তুমি তাদের জন্য যা কিছু দান করবে, তার বিনিময়ে ছওয়াব পাবে’।[26] অন্যত্র তিনি বলেন,إِنَّ الْمُسْلِمَ إِذَا أَنْفَقَ عَلَى أَهْلِهِ نَفَقَةً وَهُوَ يَحْتَسِبُهَا كَانَتْ لَهُ صَدَقَةً، ‘যখন মুসলিম ব্যক্তি তার পরিবারের জন্য কোন কিছু ব্যয় করে এবং নেকীর লাভের আশা করে, তাহ’লে সে ছাদাক্বার নেকী অর্জন করে’।[27] উল্লিখিত এই ব্যয় বিভিন্ন ব্যয়কে শামিল করে।
তন্মধ্যে পরিবারের জন্য অর্থ ব্যয়, শ্রম ব্যয়, অনুভূতি ব্যয় ইত্যাদি। সুতরাং একজন নারী আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের নিয়তে তার সংসারিক কাজে যে শ্রম ব্যয় করেন, রান্না-বান্না, ঘর-দরজা ধোয়া-মোছার কাজে যে পরিশ্রম করেন, স্বামী-সন্তানদেকে যে প্রেম-ভালোবাসা দান করেন, এসব কিছু তার কাছে নিছক দুনিয়াবী কাজ মনে হ’লেও এগুলোর বিনিময়ে তিনি ছাদাক্বার মতো মহান ইবাদতের নেকী লাভ করেন।
উপসংহার :
বিশুদ্ধ নিয়তের মাধ্যমে অনেক ছোট কাজও বড় আমলে পরিণত হয়। আবার অশুদ্ধ নিয়তের কারণে অনেক বড় আমল করেও নেকী থেকে বঞ্চিত হ’তে হয়। সেজন্য জীবনের পরতে পরতে সময়ের বাঁকে বাঁকে নিয়ত একনিষ্ঠ হওয়া যরূরী। ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাত, দান-ছাদাক্বাহ প্রভৃতি ইবদতের পাশাপশি প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যাস সমূহেও আল্লাহর নৈকট্য লাভের নিয়ত থাকা বাঞ্ছনীয়। তাহ’লে সেই কাজগুলোও আমাদের আমলনামায় ইবাদত হিসাবে লিপিবব্ধ হবে। আমরা যেন আমাদের অভ্যাসগুলোকে ইবাদতে পরিণত করাতে পারি, জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর দাসত্ব প্রতিষ্ঠা করাতে পারি এবং তাঁর ইবাদতের সোপান পেরিয়ে জান্নাতুল ফেরদাউসে পৌঁছে যেতে পারি। আল্লাহ আমাদের সেই আমাদের তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
এম.এ (অধ্যয়নরত), আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[1]. ‘মুবাহ’ সেই সকল কাজকে বলা হয়, শরী‘আতে যেই কাজ করার নির্দেশ দেয়া হয়নি আবার তা থেকে নিষেধও করা হয়নি; রবং বান্দা তার ইচ্ছানুযায়ী তা করতে পারে অথবা বর্জন করতে পারে। কেননা তা করলে নেকী হয়না আবার না করলে পাপ হয় না। মুবাহকে ‘জায়েয’ বা ‘হালাল’ শব্দেও নামাঙ্কিত করা হয় (আত-তালখীছ ফী উছূলিল ফিক্বহ ১/২০৮; শারহু কাওকাবিল মুনীর ১/৪২৮)।
[2]. মুসলিম হা/৬৬৩; ইবনু মাজাহ হা/৭৮৩।
[3]. ইবনুল হাজ্জ, আল-মাদখাল ১/২১।
[4]. শরহে নববী আল মুসলিম ১১/৭৭।
[5]. মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ৭/৪৩।
[6]. বুখারী হা/১; মুসলিম হা/১৯০৭; মিশকাত হা/১।
[7]. আবূদাঊদ হা/৩৬৬৪; ইবনু মাজাহ হা/২৫২; মিশকাত হা/২২৭।
[8]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/১০৫১; ছহীহুত তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৫৯৭, সনদ ছহীহ।
[9]. নাসাঈ হা/১৭৪৭; ইবনু মাজাহ হা/১৩৪৪; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৯৪১, সনদ হাসান
[10]. বুখারী হা/৪৩৪৪।
[11]. মির‘আতুল মাফাতীহ ৫/৪৭৫।
[12]. মুসনাদে আহমাদ হা/১৫৩১; বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৯৪৭৭; সনদ হাসান।
[13]. ইবনু আবিদ্দুনয়া, আল-ইখলাছ ওয়ান নিয়্যাহ, পৃ. ৬২।
[14]. তিরমিযী হা/ ৩৪৫৮; ইবনু মাজাহ হা/৩২৮৫; মিশকাত হা/ ৪৩৪৩; সনদ হাসান।
[15]. মুসলিম হা/১০০২; তিরমিযী হা/১৯৬৫; নাসাঈ হা/২৫৪৫।
[16]. মুসলিম হা/১৬২৮; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৫২০।
[17]. বুখারী হা/৫৬; আবূদাঊদ হা/২৮৬৪; তিরমিযী হা/২১১৬; মিশকাত হা/৩০৭১।
[18]. মুসলিম হা/৯৯৫; মিশকাত হা/১৯৩১।
[19]. মির‘আতুল মাফাতীহ্, ৬/৩৬৭ পৃ.।
[20]. মুসলিম হা/৯৯৪।
[21]. তাবারাণী, মু‘জামুল কাবীর হা/২৮২; ছহীহুত তারগীব ওয়াত তারহীব হা/; ছহীহুল জামে’ হা/১৪২৮; ছহীহ হাদীছ।
[22]. বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা হা/১৮২৮০; শু‘আবুল ঈমান হা/৯৮৯২; তাবারাণী, মু‘জামুল আওসাত্ব হা/৪২১৪; ছহীহাহ্ হা/৩২৪৮।
[23]. মুসলিম হা/১০০৬; মিশকাত হা/১৮৯৮।
[24]. শারহুন নববী আলা মুসলিম ৭/৯২।
[25]. আবূদাঊদ হা/ ৪০২৩; মিশকাত হা/৪৩৪৩, সনদ হাসান।
[26]. বুখারী হা/১৪৬৭; মুসলিম হা/১০০১।
[27]. বুখারী হা/৫৫; মুসলিম হা/১০০২; তিরমিযী হা/১৯৬৫; নাসাঈ হা/২৫৪৫।