দ্বীন প্রতিষ্ঠায় রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের ত্যাগ ছিল অনন্য। বিভিন্ন জিহাদে যার নিদর্শন ফুটে উঠেছে। তেমনি বিভিন্ন সময়ে রাসূল (ছাঃ)-এর নানা মু‘জেযা প্রকাশ পেয়েছে। হোদায়বিয়ার সন্ধিকালে যেমনটি প্রকাশ পেয়েছিল। হোদায়বিয়ায় ও মদীনা প্রত্যাবর্তনকালে সালামাহ বিন আকওয়া (রাঃ)-এর বীরত্বের কারণে কাফেররা পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল। এ সম্পর্কেই নিম্নোক্ত হাদীছটি বর্ণিত হয়েছে।-
ইয়াস ইবনু সালামাহ (রাঃ) তাঁর পিতা হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে হোদায়বিয়ায় পৌঁছলাম। তখন আমাদের সংখ্যা ছিল চৌদ্দশ’। আর সেখানে ছিল পঞ্চাশটি বকরী। সকলের পান করার মত পর্যাপ্ত পানি ছিল না। রাবী বলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কূয়ার কিনারায় বসলেন এবং দো‘আ করলেন অথবা তাতে থুথু দিলেন। এতে পানি উথলে উঠল। তখন আমরা পানি পান করলাম এবং (পশুদেরকেও) পান করালাম। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের বায়‘আতের জন্য বৃক্ষমূলে ডাকলেন। লোকদের মধ্যে আমি সর্বাগ্রে বায়‘আত নিলাম। তারপর একে একে অন্যান্য লোকেরাও বায়‘আত নিল।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন বায়‘আত গ্রহণ করতে করতে লোকজনের মধ্যবর্তী স্থানে পৌঁছলেন, তখন বললেন, হে সালামাহ! তুমি বায়‘আত গ্রহণ কর। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি লোকদের মধ্যে প্রথমেই বায়‘আত গ্রহণ করেছি। তিনি বললেন, আবারও বায়‘আত গ্রহণ কর? রাবী বলেন, এসময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে অস্ত্রহীন অবস্থায় দেখতে পেয়ে একটি ঢাল দান করলেন।
অতঃপর তিনি বায়‘আত নিতে নিতে লোকদের শেষ প্রান্তে পৌঁছলেন এবং আবার আমাকে বললেন, হে সালামাহ! তুমি কি আমার কাছে বায়‘আত নিবে না? রাবী বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমি তো লোকদের মধ্যে প্রথমভাগে এবং মধ্যভাগে (দু’বার) আপনার কাছে বায়‘আত গ্রহণ করেছি। তিনি বললেন, আবারও গ্রহণ কর। তখন আমি তৃতীয়বার বায়‘আত গ্রহণ করলাম।
এরপর তিনি আমাকে বললেন, হে সালামাহ! তোমার সে বড় ঢালটি বা ছোট ঢালটি কোথায়, যা আমি তোমাকে দিয়েছিলাম? রাবী (সালামাহ) বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমার চাচা আমির আমার সাথে নিরঅস্ত্র অবস্থায় দেখা করেছিলেন। তখন আমি তাকে তা দিয়ে দিয়েছি। এতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হেসে দিলেন এবং বললেন, তুমি দেখছি পূর্ববর্তী যুগের সে লোকের মত, যে বলেছিল, হে আল্লাহ! আমি এমন একজন বন্ধু চাই, যে আমার প্রাণের চাইতেও আমার নিকট অধিক প্রিয় হবে’। এরপরে মুশরিকরা আমাদের কাছে প্রস্তাব পাঠালো। আমাদের এক পক্ষের লোকজন অন্য পক্ষের শিবিরে যাতায়াত করতে লাগল এবং শেষ পর্যন্ত আমরা উভয়পক্ষ পরস্পরে চুক্তিবন্ধ হ’লাম। রাবী (সালামাহ রাঃ) বলেন, আমি তালহা ইবনু ওবায়দুল্লাহর খিদমতে নিয়োজিত ছিলাম। আমি তার ঘোড়াকে পানি পান করাতাম, তার পিঠ মালিশ করতাম এবং তার অন্যান্য খিদমতও করতাম। আমি তার ওখানে খাওয়া-দাওয়া করতাম। নিজের পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদ পরিত্যাগ করে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের রাহে মুহাজির হয়ে ছিলাম।
অতঃপর যখন আমরা ও মক্কাবাসীরা সন্ধিতে আবদ্ধ হ’লাম এবং আমাদের একপক্ষ অপরপক্ষের সাথে মিলেমিশে থাকতে লাগলাম, তখন আমি একটি গাছতলায় গিয়ে তার নীচের কাটা প্রভৃতি পরিস্কার করে তার গোড়ায় একটু শুয়ে পড়লাম। এমন সময় মক্কাবাসী চারজন মুশরিক এসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলতে লাগল। আমার কাছে ওদের কথাবার্তা অত্যন্ত খারাপ লাগল এবং আমি স্থান পরিবর্তন করে আরেকটি গাছের তলায় চলে গেলাম। তারা তাদের অস্ত্রগুলো গাছের সাথে ঝুলিয়ে রেখে শুয়ে পড়ল।
এমন সময় প্রান্তরের নিম্নাঞ্চল থেকে কে যেন চিৎকার করে বলল, হে মুহাজিরগণ! ইবনু যুনায়মকে কতল কর। আমি তৎক্ষণাৎ আমার তরবারি উঠিয়ে ধরলাম এবং ঐ চারজনের উপর চড়াও হ’লাম। তখন তারা ঘুমিয়ে ছিল। আমি তাদের অস্ত্রগুলো হস্তগত করে তা আঁটি বেঁধে আমার আয়ত্তে নিলাম। এরপর বললাম, যে মহান সত্তা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে সম্মানিত করেছেন তাঁর কসম! তোমাদের মধ্যে কেউ যদি মাথা তোল, তবে যেখানে তার চোখ দু’টো রয়েছে সেখানে আঘাত করব।
রাবী বলেন, তারপর তাদেরকে আমি হাকিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে নিয়ে গেলাম। এমন সময় আমার চাচা আমির আবালাত গোত্রের একজনকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে নিয়ে আসলেন। তার নাম মিকরিয। সে বর্ম সজ্জিত ও ঘোড়ায় আসীন ছিল। আর তার সাথে ছিল সত্তর জন মুশরিক। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের দিকে তাকালেন এবং বললেন, ‘ওদেরকে ছেড়ে দাও, যাতে আক্রমণ ওদের পক্ষ থেকেই হয় এবং দ্বিতীয়বার তারাই অপরাধী সাব্যস্ত হয়’।
এ কথা বলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের ক্ষমা করে দিলেন। তখন আল্লাহ নাযিল করলেন,وَهُوَ الَّذِي كَفَّ أَيْدِيَهُمْ عَنْكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ عَنْهُمْ بِبَطْنِ مَكَّةَ مِنْ بَعْدِ أَنْ أَظْفَرَكُمْ عَلَيْهِمْ، ‘তিনিই সেই সত্তা যিনি তাদেরকে তোমাদের থেকে এবং তোমাদেরকে তাদের থেকে বিরত রাখেন মক্কা উপত্যকায়, তাদের উপর তোমাদের বিজয়ী করার পর’ (ফাৎহ ৪৮/২৪) আয়াতের শেষ পর্যন্ত।
রাবী বলেন, তারপর আমরা মদীনায় প্রত্যাবর্তনের জন্য বেরিয়ে পড়লাম। পথে এমন একটি মনযিলে আমরা অবতরণ করলাম যেখানে আমাদের ও লেহিয়ান গোত্রের মধ্যে কেবল একটি পাহাড়ের ব্যবধান ছিল। আর তারা ছিল মুশরিক। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রাতে নবী করীম (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীদেরকে পাহারা দেয়ার জন্য পাহাড়ে আরোহণকারীর জন্য আল্লাহর দরবারে দো‘আ করলেন। সালামাহ বলেন, সে রাতে আমি দুই কি তিনবার ঐ পাহাড়ে আরোহণ করেছিলাম। তারপর আমরা মদীনায় এলাম।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর গোলাম রাবাহকে দিয়ে তাঁর উটগুলো পাঠালেন। আর আমি তালহার ঘোড়ায় চড়ে তার সাথে সাথে উটগুলো হাকিয়ে চারণ ভূমির দিকে নিয়ে গেলাম। অতঃপর যখন ভোর হ’ল, আব্দুর রহমান ফাজারী চড়াও হয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সমস্ত উট ছিনিয়ে নিয়ে গেল এবং পশুপালের রাখালকে হত্যা করল। আমি তখন রাবাহকে বললাম, হে রাবাহ! এ ঘোড়া নিয়ে তুমি তালহা ইবনু ওবায়দুল্লাহকে পৌঁছে দিয়ো আর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে সংবাদ দিয়ো যে, মুশরিকরা তার উটগুলো লুট করে নিয়ে গেছে। তিনি বলেন, তখন আমি একটি টিলার উপর দাঁড়ালাম। তারপর মদীনার দিকে মুখ করে তিনবার চিৎকার দিলাম, ইয়া ছাবাহা! তারপর আমি লুটেরাদের পিছু ধাওয়া করলাম ও তাদের উপর তীর নিক্ষেপ করতে লাগলাম। এসময় আমি আবৃত্তি করছিলাম,
خُذْهَا وَأَنَا ابْنُ الأَكْوَعِ + وَالْيَوْمُ يَوْمُ الرُّضَّعِ
‘এটা (আঘাত) গ্রহণ কর! আমি আকওয়ার পুত্র। আজ তো সেই দিন, যেদিন মায়ের দুধ (কতখানি খেয়েছে তা) স্মরণের দিন’।
আমি যখনই তাদের কাউকে পেয়েছি, তার উপর এমনভাবে তীর নিক্ষেপ করেছি যে, তীরের অগ্রভাগ তার কাঁধ ছেদ করে বেরিয়ে গেছে।
তিনি বলেন, আল্লাহর কসম! আমি তীর নিক্ষেপ করতে থাকলাম এবং ঘায়েল করতে লাগলাম। যখনই কোন ঘোড় সওয়ার আমার দিকে ফিরত তখনই আমি গাছের আড়ালে এসে তার গোড়ায় বসে তার প্রতি তীর নিক্ষেপ করতাম। আর তাকে যখম করে ফেলতাম। অবশেষে যখন তারা পাহাড়ের সংকীর্ণ পথে প্রবেশ করল তখন আমি পাহাড়ের উপর উঠে সেখান থেকে অবিরাম তাদের উপর পাথর নিক্ষেপ করতে থাকলাম। রাবী বলেন, এভাবে আমি তাদের পশ্চাদ্ধাবন করতে থাকলাম যে পর্যন্ত না তারা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ভারবাহী উটগুলো আমার পেছনে রেখে যায়। অবশেষে তারা এগুলো আমার আওতায় ফেলে চলে গেল। তারপরও আমি তাদের অনুসরণ করে তাদের উপর তীর নিক্ষেপ করতে থাকলাম। এমনকি তারা ত্রিশটির বেশী চাদর এবং ত্রিশটি বল্লম নিজেদের বোঝা হালকা করার উদ্দেশ্যে ফেলে গেল।
তারা যেসব বস্ত্ত ফেলে যাচ্ছিল আমি তার প্রত্যেকটিকে পাথর দ্বারা চিহ্নিত করে যাচ্ছিলাম যাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণ তা দেখে চিনতে পারেন। অবশেষে তারা পাহাড়ের একটি সংকীর্ণ স্থানে গিয়ে পৌঁছল। এমন সময় বদর ফাজারীর জনৈক পুত্র এসে তাদের সাথে মিলিত হ’ল। এবার তারা সকলে মিলে সকালের খাবার খেতে বসল। আমি পাহাড়ের একটি শৃঙ্গে বসে পড়লাম। তখন ফাজারী বলল, ঐ যে লোকটিকে দেখছি সে কে? তারা বলল, লোকটির হাতে আমরা অনেক দুর্ভোগের শিকার হয়েছি। আল্লাহর কসম! রাতের আঁধার থেকে এ পর্যন্ত লোকটি আমাদের পিছন থেকে সরছে না। সে আমাদের প্রতি অবিরত তীর নিক্ষেপ করছে। এমনকি আমাদের সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে। তখন সে বলল, তোমাদের মধ্যকার চারজন উঠে গিয়ে তার উপর চড়াও হও।
তখন তাদের চার ব্যক্তি পাহাড়ে উঠে আমার দিকে এগিয়ে এলো। তারপর তারা যখন আমার কথা শোনার মত নিকটবর্তী স্থানে এসে পৌঁছল, তখন আমি বললাম, তোমরা কি আমাকে চেন? তারা বলল, না। আমি বললাম, আমি সালামাহ ইবনু আকওয়া। সে পবিত্র সত্তার কসম, যিনি মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে সম্মানিত করেছেন! আমি তোমাদের যাকেই পাব, তাকে ধরে ফেলব। কিন্তু তোমাদের কেউ চাইলেও আমাকে ধরতে পারবে না। তখন তাদের একজন বলল, আমিও তাই মনে করি। তিনি বলেন, তারপর তারা ফিরে গেল। আর আমি সে স্থানেই বসে থাকলাম। অবশেষে আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অশ্বারোহীদের গাছ-পালার মাঝ দিয়ে অগ্রসর হ’তে দেখলাম। তিনি বলেন, তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে ছিলেন আখরাম আসাদী। তাঁর পিছনে আবূ কাতাদাহ আনছারী এবং তার পিছনে মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদ কিন্দী। আমি তখন আখরামের ঘোড়ার লাগাম ধরলাম। এ সময় লুটেরা বাহিনী (শত্রুরা) পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পালিয়ে গেল। আমি বললাম, হে আখরাম! ওদের থেকে সতর্ক থাকবে। তারা যেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণ এসে মিলিত হওয়ার পূর্বেই তোমাদের আলাদা করে না ফেলে।
আখরাম বললেন, হে সালামাহ! তুমি যদি আল্লাহ ও ক্বিয়ামতের দিনের প্রতি বিশ্বাসী হও এবং জান্নাত ও জাহান্নামকে সত্য মনে কর, তবে আমার এবং শাহাদতের মধ্যে বাধা হয়ো না। সালামাহ বলেন, আমি তার পথ ছেড়ে দিলাম। তখন তিনি আব্দুর রহমানের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হ’লেন। আখরাম আব্দুর রহমানের ঘোড়াকে আহত করলেন। আর আব্দুর রহমান বর্শার আঘাতে তাকে কতল করে দিল এবং আখরামের ঘোড়ার উপর চড়ে বসল। ইতিমধ্যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ঘোড়সওয়ার আবূ কাতাদাহ (রাঃ) এসে পৌঁছলেন। তিনি আবদুর রহমানকে বর্শার আঘাতে হত্যা করলেন (মুসলিম হা/১৮০৭; ইসলামিক ফাউন্ডেশন হা/৪৫২৭; ইসলামিক সেন্টার হা/৪৫২৯)।
শিক্ষা :
১. একাধিকবার বায়‘আত গ্রহণ করা যায়। কারণ একাধিকবার বায়‘আত করলে অঙ্গীকারের বিষয়গুলো বার বার স্মরণ হয় এবং সেগুলো পালন করার ব্যাপারে সচেতন ও সচেষ্ট হওয়া যায়।
২. নিজের প্রয়োজনীয় বস্ত্ত অন্যকে দান করা যায়। নিজের প্রয়োজনকে ছোট করে দেখে অপর ভাইয়ের প্রয়োজনকে বড় করে দেখা আবশ্যক।
৩. শত্রুকে কবজায় পেয়েও ক্ষমা করে দেওয়া মহত্ত্বের পরিচয়। যার মাধ্যমে শত্রুর মন জয় করা যায়। রাসূল (ছাঃ)-এর এই উদারতার কারণে বহু মানুষ ইসলামে দীক্ষিত হয়।
৪. দ্বীনের পথে কিংবা জিহাদের ময়দানে নিজেকে বা সহকর্মীদের উৎসাহ-অনুপ্রেরণা প্রদানের জন্য কবিতা আবৃত্তি করা যায়।
মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
পিঞ্জুরী, কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জ।