ছালাতে অনুপম একাগ্রতা

ছাহাবায়ে কেরাম ছিলেন জান্নাত পিয়াসী মানুষ। জান্নাত লাভের জন্য জীবন বিলিয়ে দিতেও তাঁরা কুণ্ঠিত হ’তেন না। এজন্য জীবন দিয়ে হ’লেও রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশ প্রতিপালন করতেন। আর ইসলামের খেদমতে জীবন বাজি রেখে তাঁরা জিহাদে অংশগ্রহণ করতেন। অভিযানে গমনাগমনের পথে ইবাদতের সুযোগ পেলে তাঁরা সে সুযোগ কাজে লাগাতেন। বাড়ীতে কিংবা সফরে যখনই তাঁরা কুরআন তেলাওয়াত করতেন কিংবা ছালাতে দাঁড়াতেন তখন এতটাই একাগ্র হ’তেন যে, অন্য কোন খেয়াল তাদের থাকতো না। এমনকি শরীরে তীর বিদ্ধ হওয়ার মত ঘটনা ঘটলেও তারা ছালাত ছেড়ে দিতেন না বরং হিমাদ্রি শিখরের ন্যায় অবিচল থাকতেন। এ সম্পর্কেই নিম্নোক্ত হাদীছ :

জাবের ইব‌নু আব্দিল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথী হয়ে যাতুর রিকা‘ অভিযানে বের হ’লাম। ‘যাতুর রিকা‘ অঞ্চলটি ছিল প্রচুর খেজুর বৃক্ষবিশিষ্ট। জনৈক ছাহাবী এক মুশরিকের স্ত্রীকে বন্দী করেন। অভিযান শেষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন মদীনায় ফেরার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন তখন ঐ মুশরিক ব্যক্তি বাড়ি আসে। মহিলাটিকে বন্দী করার সময় সে বাড়িতে ছিল না। বাড়িতে এসে সে তার স্ত্রী বন্দী হওয়ার ঘটনা শুনতে পায়। তখন সে শপথ করে বলে, ঘটনার প্রতিশোধ হিসাবে সে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর ছাহাবীদের মধ্যে কারো না কারো রক্তপাত ঘটাবে। সে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পদচিহ্ন অনুসরণ করে অগ্রসর হয়।

এদিকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এক জায়গায় এসে যাত্রা বিরতি করেন। ছাহাবীগণের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, কে আছ আজ রাতে আমাদেরকে পাহারা দিবে? সাথে সাথে একজন মুহাজির ও একজন আনছার ছাহাবী বললেন, হে আললাহর রাসূল (ছাঃ)! আমরা পাহারা দেব। তিনি নির্দেশ দিয়ে বললেন, তোমরা গিরিপথের প্রবেশদ্বারে গিয়ে অবস্থান গ্রহণ কর। ছাহাবী দু’জন ছিলেন আম্মার ইবনু ইয়াসির ও আববাদ ইব‌নু বিশর। গিরিপথের প্রবেশদ্বারে গিয়ে আনছার ছাহাবী তার মুহাজির ভাইকে বললেন, আপনি রাতের কোন্ অংশে বিশ্রামের সুযোগ নিবেন আর আমি দায়িত্ব পালন করব? মুহাজির ছাহাবী বললেন, রাতের প্রথম অংশে আপনি আমাকে বিশ্রামের সুযোগ দিবেন। তারপর তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। অতঃপর আনছার ছাহাবী ছালাতে দাঁড়ালেন। উক্ত মুশরিক ব্যক্তি সেখানে এসে ছালাতরত ছাহাবীকে দেখে বুঝে নিয়েছিল যে, এ ব্যক্তি পাহারাদার। সে তাঁকে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করলে। তীর তাঁর গায়ে বিদ্ধ হল। তিনি দেহ থেকে তীরটি খুলে ফেলে দেন এবং ছালাতেই দাঁড়িয়ে থাকেন। ঐ ব্যক্তি তাঁকে লক্ষ্য করে দ্বিতীয়বার তীর নিক্ষেপ করল। তীরটি ছাহাবীর দেহে বিদ্ধ হল। এবারও তিনি তীর খুলে পাশে রেখে দিলেন এবং যথারীতি দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করতে থাকলেন। মুশরিক ব্যক্তিটি তাঁকে লক্ষ্য করে তৃতীয়বার তীর নিক্ষেপ করল। সেটি তাঁর শরীরে বিদ্ধ হ’ল। এবারও তিনি তীরটি খুলে পাশে রেখে দেন এবং যথারীতি রুকূ-সিজদা করে ছালাত শেষ করেন।

তারপর তাঁর সাথী আনছার ছাহাবীকে ঘুম থেকে তুলে বললেন, উঠুন, আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। তাদের দু’জনকে কথা বলতে দেখে মুশরিক ব্যক্তি ধারণা করল যে, তাঁরা তাকে ধরার জন্যে পরামর্শ করছেন। ফলে সে দ্রুত পালিয়ে গেল। যখন আনছার ছাহাবী দেখলেন যে, মুহাজির ছাহাবীর দেহ থেকে রক্ত ঝরছে, তখন তিনি বললেন, সুবহানাল্লাহ! আপনি আমাকে প্রথম তীর বিদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে ঘুম থেকে জাগাননি কেন? মুহাজির ছাহাবী বললেন, আমি একটি বিশেষ সূরা পাঠ করছিলাম। সূরাটি শেষ না করে তিলাওয়াত ছেড়ে দিতে আমার মন চায়নি। কিন্তু সে বারবার তীর নিক্ষেপ করছিল। ফলে আমি রুকূ-সিজদার মাধ্যমে ছালাত শেষ করে ফেলি। আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে গিরিপথ পাহারার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তা পালনে ত্রুটি হবার আশঙ্কা না থাকলে আমি ছালাত আদায় করেই যেতাম এবং সূরাটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিলাওয়াত বন্ধ করতাম না। তাতে আমার মৃত্যু হ’লেও কোন পরোয়া ছিল না’ (হাকেম হা/৫৫৭; ছহীহ ইবনে খুযাইমাহ হা/৩৬; দারাকুৎনী হা/৮৬৯; আবু দাউদ হা/১৯৮, সনদ হাসান)

শিক্ষা :

১. শত্রুদের আক্রমণ থেকে নিরাপত্তার জন্য পাহারাদার নিযুক্ত করা যায়।

২. দায়িত্বশীল একাধিক হ’লে সময় ভাগ করে নিয়ে পর্যায়ক্রমে দায়িত্ব পালন করা যায়।

৩. দায়িত্ব পালনে ত্রুটি না হ’লে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নফল ইবাদত করা যায়।

৪. ছালাতরত অবস্থায় শরীর থেকে রক্ত বের হ’লেও ছালাত বিনষ্ট হয় না।

৫. আরবরা এত প্রখর মেধার অধিকারী ছিল যে, পদচিহ্ন দেখে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির অনুসরণ করতে পারত।

৬. সুযোগ থাকলে সফরেও নফল ছালাত আদায় করা যায়।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে উক্ত হাদীছ অনুযায়ী জীবন গড়ার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার

পিঞ্জুরী, কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জ।






ওযূবিহীন ছালাত আদায়ের শাস্তি - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
সৎ লোকের দো‘আ - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
কাউকে জান্নাতী বা জাহান্নামী বলা যাবে না - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
জন্মভূমি থেকে আবুবকর (রাঃ)-কে বহিষ্কার ও তাঁর অসীম ধৈর্য - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
কুরআন তেলাওয়াতকারীর পিতা-মাতার মর্যাদা - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
হযরত ওছমান (রাঃ) যেভাবে খলীফা মনোনীত হয়েছিলেন - আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ
হাদীছের গল্প - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
নেতা কর্তৃক কর্মীর পরিচর্যা - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
মহামারী আক্রান্ত এলাকায় না যাওয়া - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
ইয়ামামাবাসীর নেতা ছুমামাহ বিন উছাল (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণের কাহিনী - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
দাজ্জাল ও ইয়াজূজ-মাজূজের নৃশংসতা - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
যে পরিমাণ সম্পদ থাকলে মেহমান আপ্যায়ন আবশ্যিক হয় - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
আরও
আরও
.