রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণ অতি সাধারণ জীবন-যাপন করতেন। এমনকি অনেক সময় তাদের বাড়ীতে খাবারও থাকতো না। কারণ তাদের সার্বক্ষণিক চিন্তা ছিল আখেরাত নিয়ে। যাতে পরকালে মুক্তি মেলে এবং জান্নাত লাভ করা যায়। কিন্তু যখন ক্ষুধার তাড়না অসহনীয় হয়ে যেত তখন তারা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে আসতেন। রাসূল (ছাঃ)ও এমন পরিস্থিতিতে কোন ছাহাবীর মেহমান হ’তেন। এমনই একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে নিম্নের হাদীছে।

আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, কোন একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এমন সময় ঘর হ’তে বের হ’লেন, যে সময়ে তিনি সচরাচর বের হন না এবং এ সময় কেউ তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেও আসে না। (এ মুহূর্তে) আবূবকর (রাঃ) এসে উপস্থিত হ’লেন। তিনি প্রশ্ন করেলেন, হে আবূ বকর! আপনি কি মনে করে এলেন? তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে দেখা করতে, তাঁর বরকতময় মুখমন্ডল দেখতে ও তাঁকে সালাম প্রদানের উদ্দেশ্যে এসেছি। এরপর ওমর (রাঃ)ও এসে উপস্থিত হ’লেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রশ্ন করলেন, হে ওমর! আপনার এ সময় আসার কারণ কি? তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! ক্ষুধার তাড়নায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আমিও এরূপ কিছু অনুভব করছি। এই বলে তারা আবূল হায়ছাম ইবনু আত-তায়হান আল-আনছারী (রাঃ)-এর বাড়ীর দিকে যাত্রা শুরু করলেন।

আবূ হায়ছাম ছিলেন প্রচুর খেজুরগাছ ও বকরীর মালিক। তার কোন খাদেম ছিল না। তারা তাকে বাড়ীতে না পেয়ে তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার সাথী কোথায়? তিনি বললেন, তিনি আমাদের জন্য মিঠা পানি আনতে গেছেন। ইতিমধ্যে আবূল হায়ছাম (রাঃ) পানিভর্তি মশক নিয়ে ফিরে আসলেন এবং সেটা রেখেই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হোক! তারপর তিনি তাদেরকে নিয়ে তার বাগানে গেলেন এবং তাদের জন্য বিছানা বিছিয়ে দিলেন। অতঃপর খেজুরগাছ হ’তে কয়েক গুচ্ছ খেজুর নামিয়ে এনে তাদের সামনে রাখলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে বললেন, আমাদের জন্য পাকা খেজুর বেছে আলাদা করে নিয়ে আসলে না কেন? তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমি ভাবলাম যে, আপনারা নিজেদের ইচ্ছামতো তাজা কিংবা পাকা খেজুর বেছে খাবেন (এজন্য দু’রকম খেজুরই পেশ করলাম)।

তারা খেজুর খেয়ে সেই পানি পান করলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, যাঁর হাতে আমার প্রাণ সেই মহান সত্তার শপথ! ক্বিয়ামত দিবসে এসব নে‘মত প্রসঙ্গেও তোমাদেরকে প্রশ্ন করা হবে। এই সুশীতল ছায়া, সুস্বাদু কাঁচা-পাকা খেজুর ও ঠান্ডা পানি (কতই না সুন্দর নে‘মত)।

এরপর আবূল হায়ছাম (রাঃ) তাদের জন্য খাবার তৈরী করতে চলে গেলেন। নবী করীম (ছাঃ) তাকে বলে দিলেন, কোন অবস্থাতেই দুধেল পশু যবহ করবে না। কাজেই তিনি নবীন একটি নর ছাগল যবহ করলেন এবং রান্না করে তাঁদের জন্য নিয়ে আসলেন। তাঁরা তা খেলেন। এ সময় নবী করীম (ছাঃ) তাকে প্রশ্ন করলেন, তোমার কি কোন খাদেম আছে? তিনি বললেন, না।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, যখন আমার নিকট বন্দী আসবে তখন তুমি এসো। পরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট দু’টি গোলাম আসে। তাদের সাথে তৃতীয় কোন গোলাম ছিল না। আবূল হায়ছাম (রাঃ) নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকটে গেলে তিনি তাকে বললেন, এদের মধ্যে যাকে ভালো লাগে বেছে নাও। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনিই আমাকে পসন্দ করে দেন। তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, যার কাছে পরামর্শ চাওয়া হয় তাকে আমানতদার হ’তে হয়। ঠিক আছে, তুমি একেই নাও। কেননা আমি একে ছালাত আদায় করতে দেখেছি।

(এরপর তিনি বললেন) আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি তার সাথে উত্তম আচরণ করার জন্য। আবূল হায়ছাম (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপদেশ প্রসঙ্গে তার স্ত্রীর নিকট গিয়ে তাকে জানিয়ে দেন। তার স্ত্রী বললেন, একে মুক্ত করা ব্যতীত আপনি নবী করীম (ছাঃ)-এর বক্তব্যের মর্ম পর্যন্ত পৌঁছতে পারবেন না। তিনি বললেন, ঠিক আছে, সে এখন মুক্ত।

নবী করীম (ছাঃ) বললেন, আল্লাহ তা‘আলা যত নবী ও খালীফা প্রেরণ করেছেন, তাদের সকলকেই দু’জন করে একান্ত পরামর্শক দিয়েছেন। একজন সাথীতো তাকে ভালো কাজের আদেশ দিতে থাকে এবং অন্যায় কাজে প্রতিহত করে। আর অন্যজন তাকে ধ্বংস করার কোন সুযোগই ছাড়ে না। যাকে এই অসৎ পরামর্শক হ’তে হেফাযত করা হয়েছে তাকেই বাঁচানো হয়েছে’ (তিরমিযী হা/২৩৬৯; ছহীহাহ হা/১৬৪১)

শিক্ষা :

১. রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর দুই ছাহাবী ক্ষুধার্ত ছিলেন। তাঁরা ক্ষুধা নিবারণের জন্য শারঈ পদ্ধতিতে চেষ্টা করেন।

২. কোন সাথী-বন্ধুর সচ্ছল অবস্থা ও উত্তম মানসিকতার বিষয় জানা থাকলে তার বাড়ীতে বিনা দাওয়াতে খাবার গ্রহণের উদ্দেশ্যে যাওয়া যায়।

৩. আল্লাহর নে‘মত লাভ করে ও তা ভক্ষণ করে তাঁর শুকরিয়া আদায় করা যরূরী।

৪. মেহমানদেরকে অত্যধিক সম্মান করতে দেখলে মেজবানকে সতর্ক করতে নছীহত করা যায়, যাতে সে অতি আবেগে মূল্যবান বস্ত্ত নষ্ট করে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

৫. উত্তম আচরণের প্রতিদান প্রদান করা যায়। যেমন রাসূল (ছাঃ) আবুল হায়ছামকে খাদেম দিয়েছিলেন তার স্বতঃস্ফূর্ত আপ্যায়নের জন্য।

৬. প্রকৃত জ্ঞানী সেই ব্যক্তি যে দূরদর্শী লোকের নিকট থেকে পরামর্শ নেয়।

৭. ছালাত আদায় করা তাক্বওয়ার পরিচায়ক। যেমন রাসূল (ছাঃ) আবুল হায়ছামকে ছালাত আদায়কারী খাদেমকে গ্রহণ করার পরামর্শ দিলেন।

৮. সফর থেকে প্রত্যাবর্তন ছাড়াও কোলাকুলি করা যায়। যেরূপ আবুল হায়ছাম রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে করলেন।

পরিশেষে, মহান আল্লাহর নিকটে বিনীত প্রার্থনা তিনি যেন, আমাদেরকে উক্ত হাদীছের উপরে আমল করার এবং সেই মোতাবেক জীবন পরিচালনার তাওফীক দান করেন-আমীন!

মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার

পিঞ্জুরী, কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জ।






মহামারী আক্রান্ত এলাকায় না যাওয়া - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
কুরআন তেলাওয়াতকারীর পিতা-মাতার মর্যাদা - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
জান্নাতে প্রবেশকারী বান্দার সাথে আল্লাহর কথোপকথন - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
উওয়াইস আল-কারানী (রহঃ)-এর মর্যাদা - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
জাবের ইবনু আব্দিল্লাহ (রাঃ)-এর উটের ঘটনা - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
উপকারীকে প্রতিদান দেওয়া - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
আমর ইবনু আবাসা (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণ - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
ছালাত-ছিয়াম ও দান-ছাদাক্বার উপমা - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
রূহ কবয ও মৃত্যুকাল মুসলিম ও কাফিরের অবস্থা - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
ভালোর বিনিময়ে ভালো দেওয়া উচিত - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
মদীনার পথে - মুসাম্মাৎ শারমিন আখতার
আব্দুল্লাহ ইবনু সালামের ইসলাম গ্রহণ
আরও
আরও
.