দেশের প্রখ্যাত আইনজীবী ও সাবেক অ্যাটর্নী জেনারেল রফীকুল হক গত ২৪শে অক্টোবর বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। সুপ্রীম কোর্ট প্রাঙ্গনে জানাযা শেষে রাজধানীর বনানীস্থ কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।

ব্যারিস্টার রফীকুল হক ১৯৩৫ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৬২ সালে যুক্তরাজ্য থেকে বার এট-ল’ সম্পন্ন করেন। ১৯৬৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের এবং ১৯৭৩ সালে আপিল বিভাগে আইনজীবী হিসাবে আইন পেশা শুরু করেন। বর্ণাঢ্য জীবনে আইন পেশায় দীর্ঘ প্রায় ৬০ বছর পার করেছেন। তিনি ১৯৯০ সালের ৭ই এপ্রিল থেকে ১৭ই ডিসেম্বর ৮ মাস ১০ দিন বাংলাদেশের ৬ষ্ঠ অ্যাটর্নী জেনারেল তথা সরকারের প্রধান আইন কর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।  

পেশাগত জীবনে তিনি কখনো কোন রাজনৈতিক দল করেননি। ফলে সর্বস্তরের মানুষের জন্য যেমন কাজ করতে পেরেছেন, তেমনি দল-মত নির্বিশেষে সকল মানুষের নিকটে পেয়েছেন প্রভূত সম্মান-মর্যাদা। স্বাধীনতার পর প্রায় সব সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। বিভিন্ন সময়ে দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক ও আইনী বিষয় নিয়ে সরকারকে সহযোগিতা করেছেন। তিনি ২০০৭-০৮ সালে বিগত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একই সাথে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবী হিসাবে তাদের পক্ষে আইনী লড়াই করেন।

উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের ১৯তম প্রেসিডেণ্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রফেসর ড. ইয়াজুদ্দীন আহমদ, মুন্সীগঞ্জ (২০০২-২০০৭) ২০০৭ সালের ১২ই জানুয়ারী বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর ড. ফখরুদ্দীন আহমদ, মুন্সীগঞ্জ-এর নেতৃত্বে ১৩ সদস্যের একটি উপদেষ্টা পরিষদের হাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব অর্পণ করেন। ২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হ’লে ৩০শে ডিসেম্বর তিনি তার নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ১৭তম এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কার্যকাল ছিল ১ বছর ১১ মাস ১৮ দিন।

ব্যারিস্টার রফীকুল হক সবসময় সততা, দায়িত্বশীলতা, নিষ্ঠা ও সমতার পরিচয় দিয়েছেন। রাষ্ট্রপক্ষের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা থাকা অবস্থাতেও রিট পিটিশনের ক্ষেত্রে তিনি যদি দেখতেন যে সরকারী আদেশ বেআইনী, সেখানে তিনি আদালতে কোনরকম পক্ষপাতিত্ব না করে তা স্বীকার করে নিতেন। এরকম স্বচ্ছতা অন্য কোন অ্যাটর্নী জেনারেল দেখাতে পারেননি। অ্যাটর্নী জেনারেল হিসাবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি তার যে প্রাপ্য বেতন ছিল, তাও গ্রহণ করেননি। এছাড়া বহু মানুষের মামলা তিনি বিনা খরচে পরিচালনা করতেন।

আইন পেশায় প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার সুযোগ থাকলেও বস্ত্তগত বিষয়ে কখনোই আগ্রহ ছিল না ব্যারিস্টার রফীকুল হক-এর। ফলে ৬০ বছরের নিজের ও স্ত্রীর উপার্জিত অর্থের অধিকাংশই ব্যয় করেছেন মানুষের কল্যাণ ও সমাজসেবায়। প্রতিষ্ঠা করেছেন বেশ কয়েকটি হাসপাতাল, ইয়াতীমখানা, মসজিদ, হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ। ১৯৯৫ সালে তিনি গাযীপুরের কালিয়াকৈরে প্রতিষ্ঠা করেন সুবর্ণ ক্লিনিক ও মসজিদ।  আদ-দ্বীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ ২৫টিরও বেশী সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি সরাসরি জড়িত ছিলেন। তিনি ছিলেন বারডেম হাসপাতালের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি। এসব প্রতিষ্ঠানে আর্থিক অনুদানসহ নানা সহযোগিতা করে গিয়েছেন নিয়মিত।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মানযূর হোসাইন বলেন, এই হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠায় বড় ভূমিকা ছিল ব্যারিস্টার রফীকের। একসময় তিনি হাসপাতালটির সেক্রেটারীও ছিলেন। কিন্তু তাঁর অবদানের কোন চিহ্ন এখন হাসপাতালে নেই। কারণ তিনি নিজেই কখনো চাইতেন না কোথাও তাঁর নাম থাকুক। দান করে নিজের নাম প্রচারের পক্ষে ছিলেন না তিনি।






আরও
আরও
.