হামদ ও ছানার পর কোন ব্যক্তি বা দল সম্পর্কে মন্তব্য করা বা সিদ্ধান্ত প্রদানের দু’টি পদ্ধতি রয়েছে। প্রথমত : গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে উঠে প্রকৃত তথ্য ও তত্ত্বের ভিত্তিতে মন্তব্য করা। এ পদ্ধতিটি স্বয়ং ঈমান ও তাক্বওয়ার দাবী রাখে। দ্বিতীয়ত : শুধু ভুল ধারণাগুলিকে সত্যের মর্যাদা প্রদান করতে গিয়ে স্রেফ গোঁড়ামির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত প্রদান করা। দুর্ভাগ্যবশতঃ অধিকাংশ মানুষকে এই দ্বিতীয় পন্থা অবলম্বন করতে দেখা যায়। অধিকাংশ মানুষ সত্যের পরিবর্তে স্রেফ ধারণার বশবর্তী হয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَمَا يَتَّبِعُ أَكْثَرُهُمْ إِلَّا ظَنًّا إِنَّ الظَّنَّ لَا يُغْنِي مِنَ الْحَقِّ شَيْئًا إِنَّ اللهَ عَلِيمٌ بِمَا يَفْعَلُونَ. ‘ওদের অধিকাংশ কেবল ধারণার অনুসরণ করে। অথচ সত্যের মোকাবেলায় ধারণা কোন কাজে আসে না। নিশ্চয়ই তারা যা কিছু করে, সকল বিষয়ে আল্লাহ সম্যক অবগত’ (ইউনুস ১০/৩৬)।
দিনের আলোকে অন্ধকার বলায় যেমন তা অাঁধার হয়ে যায় না, তেমনি ব্যক্তিগত অনুরাগ ও ধারণা প্রকৃত সত্যকে পরিবর্তন করতে পারে না। ন্যায়নীতির পথ থেকে সরে গিয়ে প্রদত্ত ফায়ছালা সত্যকে বদলাতে পারে না। কিন্তু তা মানুষের চিন্তা-চেতনা, আমল ও পরিণতিকে বরবাদ করে দেয়।
কেউ সামনে দাঁড়ালে একজন মানুষ যদি চোখ বন্ধ করে অনুমান ভিত্তিক তার চেহারা-ছুরত ও পোষাক-পরিচ্ছদ সম্পর্কে বর্ণনা দেয়, তাহ’লে কেউই এটাকে বুদ্ধিমানের কাজ বলবে না। কিন্তু দুঃখের বিষয় হ’ল, যখন আহলেহাদীছ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত প্রদানের সময় আসে, তখন অধিকাংশ মানুষ এ কর্মপদ্ধতির প্রমাণ পেশ করতে শুরু করে।
বহু মানুষ রয়েছে যারা স্রেফ
ভুল ধারণার কারণে আহলেহাদীছদের উপরে অসন্তুষ্ট হয়। এমন মানুষকে যদি জিজ্ঞেস
করা হয় যে, আপনি কি আসলে এ বিষয়টি যাচাই-বাছাই করেছেন? যেসব আক্বীদা ও
মূলনীতিকে আহলেহাদীছদের সাথে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে সেগুলো কি আপনি নিজে
আহলেহাদীছদের মুখ থেকে শুনেছেন বা তাদের বইপুস্তকে পড়েছেন? তখন তার কাছ
থেকে এর ইতিবাচক উত্তর পাওয়া যায় না। বরং তার উত্তর থেকে বুঝা যায় যে, সে
অন্য কারো কাছ থেকে একথা শুনেছে যে, আহলেহাদীছরা এরূপ বলে বা তারা এরূপ কাজ
করে। যদি আসলেই সে সরাসরি কোন আহলেহাদীছকে জিজ্ঞেস করত তাহ’লে আসল বিষয়টি
তার কাছে একেবারে পরিষ্কার হয়ে যেত।
সব ভুল ধারণা ও অসন্তুষ্টির অবসান ঘটত। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হ’ল, মানুষ
এমনটা করার সাহস না করে আলোর পরিবর্তে অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকাকেই প্রাধান্য
দেয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, أَلَا سَأَلُوا إِذْ لَمْ يَعْلَمُوْا
‘যখন তারা জানে না তখন কেন জিজ্ঞেস করে না’?[1]
আহলেহাদীছ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মাঝে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। যা তাদের মনে আহলেহাদীছ সম্পর্কে ঘৃণার উদ্রেক হওয়ার অন্যতম কারণ। তারা আহলেহাদীছ আলেমদের কাছে এসে নিজেরা জিজ্ঞেস করে না। কারণ তাদেরকে ভয় দেখানো হয় যে, তোমরা যদি আহলেহাদীছ আলেমদের ধারে-কাছেও যাও তাহ’লে তোমরা গোমরাহ হয়ে যাবে।
এই পুস্তকটি এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে লেখা হচ্ছে যে, যারা আহলেহাদীছদের দাওয়াত ও মানহাজ (কর্মপদ্ধতি) সম্পর্কে জানতে চায়, তারা যেন সংক্ষিপ্তাকারে কিছু মৌলিক কথা জানতে পারে। যাতে নিজেদের পূর্বের জানা তথ্যগুলিকে পুনরায় বিচার-বিশ্লেষণ করে সঠিক সিদ্ধান্ত প্রদান করা তাদের জন্য সহজসাধ্য হয়।
আহলেহাদীছ সম্পর্কে ভুল ধারণা ও অপবাদের একটি লম্বা তালিকা রয়েছে। সংক্ষিপ্ততার প্রতি খেয়াল রেখে এই পুস্তিকায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংশয় নিরসন করা হচ্ছে। বিস্তারিত আলোচনা ও গবেষণার জন্য আহলেহাদীছ আলেমদের রচিত গ্রন্থসমূহ অথবা আলেমদের শরণাপন্ন হ’তে পারেন।
চলুন দেখি যে, আহলেহাদীছদের সম্পর্কে কি কি ভুল ধারণা রয়েছে এবং এক্ষেত্রে বাস্তবিকই আহলেহাদীছদের অবস্থান কি?
ভুল ধারণা-১ :
আহলেহাদীছ একটি নতুন ফিরক্বা, যা ইংরেজদের সৃষ্টি :
আহলেহাদীছ সম্পর্কে প্রথম ভুল ধারণা এই যে, এটি একটি নতুন ফিরক্বা। অতীতে এই দলের কোন অস্তিত্ব ছিল না। ভারতবর্ষে ইংরেজরা এই দলের গোড়াপত্তন করেছে। এটা স্রেফ ঐতিহাসিক বাস্তবতা সম্পর্কে অজ্ঞতার ফল। আহলেহাদীছ কি অতীতে ছিল না? এটা কি ইংরেজদের সৃষ্ট দ্বীন? আহলেহাদীছের ইতিহাস কি একশ’ বা দুইশ’ বছরের বেশী পুরাতন নয়? আসুন দেখা যাক, সত্য কোন্টি?
(১) নবী করীম (ছাঃ) হ’লেন আহলেহাদীছদের নেতা[2] :
হাফেয
ইবনু কাছীর (রহঃ) আল্লাহ তা‘আলার বাণী, يَوْمَ نَدْعُو كُلَّ أُنَاسٍ
بِإِمَامِهِمْ ‘(স্মরণ কর) যেদিন আমরা প্রত্যেক সম্প্রদায়কে তাদের নেতা
(অর্থাৎ নবী অথবা আমলনামা) সহ আহবান করব’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৭১)-এর
তাফসীরে বলেন,وَقَالَ بَعْضُ السَّلَفِ: هَذَا أَكْبَرُ شَرَفٍ لِأَصْحَابِ
الْحَدِيثِ؛ لِأَنَّ إِمَامَهُمُ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ
وَسَلَّمَ ‘কোন কোন সালাফ বলেন, আহলেহাদীছদের জন্য এটাই সর্বোচচ মর্যাদা
যে, তাদের একমাত্র ইমাম হ’লেন নবী করীম (ছাঃ)’।[3]
তাফসীর ইবনু কাছীর সকলের নিকট একটি নির্ভরযোগ্য তাফসীর।[4] ইবনু কাছীর ৭০১ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৭৭৪ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। না তিনি হিন্দুস্থানের ছিলেন আর না সে সময় ইংরেজদের কোন অস্তিত্ব ছিল। উপরন্তু ইবনু কাছীর আহলেহাদীছদের সম্পর্কে এখানে নিজের কথা নয়; বরং তাঁর পূর্বের বিদ্বানের উক্তি উল্লেখ করেছেন। যার মাধ্যমে একথা প্রতীয়মান হয়েছে যে, সালাফে ছালেহীনের মাঝে ‘আছহাবুল হাদীছ’ নামে বিদ্যমান বিদ্বানগণ আল্লাহর নবী (ছাঃ)-কে তাদের ইমাম বা নেতা মানতেন।
আরোপিত অপবাদ খন্ডনের জন্য কি শুধু এ কথাটুকুই যথেষ্ট নয় যে, আজ থেকে সাতশত বছরেরও বেশী পুরাতন গ্রন্থে একজন নির্ভরযোগ্য মুফাসসির, মুহাদ্দিছ ও ঐতিহাসিক আহলেহাদীছদের মর্যাদা সম্পর্কে কুরআনের আয়াত ও সালাফে ছালেহীনের উক্তি দ্বারা দলীল গ্রহণ করেছেন?
প্রকৃত সত্য এই যে, আহলেহাদীছদের অস্তিত্ব ইবনু কাছীরের চেয়েও প্রাচীন।
(২) ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর অনুসারীদের যুগে আহলেহাদীছদের অস্তিত্ব :
হানাফী
মাযহাবের গ্রন্থ ‘দুররে মুখতার’-এর ব্যাখ্যা ‘রাদ্দুল মুহতার’-এ ইবনু
আবেদীন লিখেছেন, حُكِيَ أَنَّ رَجُلًا مِنْ أَصْحَابِ أَبِي حَنِيفَةَ
خَطَبَ إلَى رَجُلٍ مِنْ أَصْحَابِ الْحَدِيثِ ابْنَتَهُ فِي عَهْدِ أَبِي
بَكْرٍ الْجَوزَجَانِيِّ فَأَبَى إلَّا أَنْ يَتْرُكَ مَذْهَبَهُ
فَيَقْرَأَ خَلْفَ الْإِمَامِ، وَيَرْفَعُ يَدَيْهِ عِنْدَ الِانْحِطَاطِ
وَنَحْوُ ذَلِكَ فَأَجَابَهُ فَزَوَّجَهُ- ‘বর্ণিত আছে যে, আবুবকর
জাওযাজানীর যুগে আবু হানীফার জনৈক অনুসারী একজন আহলেহাদীছ ব্যক্তির মেয়েকে
বিবাহের প্রস্তাব দিলে তিনি (আহলেহাদীছ) তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
তবে এ শর্তে রাযী হ’ন যে, সে তার মাযহাবকে পরিত্যাগ করে ইমামের পিছনে সূরা
ফাতিহা পাঠ করবে এবং রুকূতে যাওয়ার সময় ও অন্যান্য ক্ষেত্রে রাফ‘ঊল
ইয়াদায়েন করবে। অতঃপর সে আহলেহাদীছের শর্তসমূহ মেনে নিলে তিনি তার মেয়ের
সাথে তার (হানাফী) বিবাহ দিয়ে দেন’।[5]
আবুবকর জাওযাজানী ইমাম মুহাম্মাদ বিন হাসান শায়বানীর ছাত্র আবু সুলায়মান জাওযাজানীর ছাত্র। আর ইমাম মুহাম্মাদ স্বয়ং ইমাম হানীফা (রহঃ)-এর ছাত্র।
এ ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর শিষ্যদের যুগেও আহলেহাদীছদের অস্তিত্ব ছিল। শুধু তাই নয়; বরং সে যুগেও আহলেহাদীছগণ কিছু কিছু ফিক্বহী মাসআলা-মাসায়েল যেগুলিকে শাখা-প্রশাখাগত মাসআলা বলে অপ্রমাণিত আখ্যা দেয়া হয়। যেমন ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠ, রাফ‘ঊল ইয়াদায়েন প্রভৃতি বিষয়কে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতেন। এ ঘটনা থেকে এটাও জানা যায় যে, আহলেহাদীছ বিদ্বানগণ দ্বীনের ব্যাপারে অনেক চিন্তাশীল ও পাকাপোক্ত ছিলেন। তাদের নিকটে আত্মীয়তার সম্পর্কের চেয়েও দ্বীন বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নিজেদের কন্যাদের বিবাহ দেওয়ার পূর্বে তারা বিবাহের প্রস্তাব পেশকারীকে রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশ ও সুন্নাতের প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার জন্য রাযী করে নিতেন।
এ ঘটনা থেকে শুধু আহলেহাদীছদের প্রাচীনত্ব প্রমাণিত হয় না, বরং সূচনালগ্ন থেকেই দ্বীনের ব্যাপারে তাদের আপোষহীনতাও প্রমাণিত হয়। যা স্বয়ং দ্বীনী পোক্ততা ও অবিচলতার প্রমাণ। এমনকি আমরা যদি এর চেয়েও পূর্বের যুগ পর্যালোচনা করি তবুও আহলেহাদীছদের অস্তিত্ব পাওয়া যাবে।
(৩) আহলেহাদীছদের প্রতি ইমাম আবু হানীফার শিষ্য আবু ইউসুফ (রহঃ)-এর টান :
ইয়াহ্ইয়া
বিন মাঈন (রহঃ) বলেন,كَانَ أَبُو يوسف القاضي يحب أصحاب الحديث ويميلُ
إليهم. ‘ক্বাযী আবু ইউসুফ আহলেহাদীছদেরকে ভালবাসতেন এবং তাদের প্রতি তাঁর
টান ছিল’।[6]
দেখুন! আহলেহাদীছদের অস্তিত্ব শুধু আবু হানীফা (রহঃ)-এর বিশিষ্ট ছাত্র ইমাম ক্বাযী আবু ইউসুফ (রহঃ)-এর যুগেই ছিল তা প্রমাণিত হয়নি, বরং একথাও জানা গেল যে, স্বয়ং ইমাম আবু ইউসুফ আহলেহাদীছদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। এমনকি তাদের প্রতি তাঁর টান ছিল।
এখানে এ প্রশ্ন দেখা দেয় যে, কোন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে কি আহলেহাদীছদের মধ্যে গণনা করা হয়েছে, যার জ্ঞানগত মর্যাদা বিদ্বানদের নিকটে স্বীকৃত এবং যাকে সাধারণ মানুষও চিনে? আসুন! একথাও হানাফী মাযহাবেরই একটা প্রসিদ্ধ কিতাব থেকে জানা যাক।-
(৪) ইমাম বুখারী (রহঃ) অন্যতম আহলেহাদীছ ছিলেন :
‘আয়নুল হেদায়া’তে লেখা আছে,
ہم نے اجماع كيا كہ شافعي و مالكي و حنبلي بلكه تمام اہل حديث مثل امام بخاري و غيره وابن جرير طبري حتي كہ علماءے ظاهر يه سب اہل السنة والجماعة برحق ہيں اور سب كا تمسك قرآن واحاديث اہل السنة پر عقائد حقہ كے ساتھ ہے-
‘আমরা ইজমা করেছি যে, শাফেঈ, মালেকী, হাম্বলী,
বরং সমস্ত আহলেহাদীছ যেমন ইমাম বুখারী প্রমুখ ও ইবনু জারীর ত্বাবারী এমনকি
যাহেরী আলেমগণ এরা সবাই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ ও সঠিক। তারা সকলেই
সঠিক আক্বীদার সাথে আহলুস সুন্নাহর উপরে প্রতিষ্ঠিত থেকে কুরআন ও সুন্নাহকে
অাঁকড়ে ধরেন’।[7]
এখানে কয়েকটি বিষয় চিন্তার দাবী রাখে যা নিম্নরূপ-
১. হানাফী বিদ্বানগণের ইজমা রয়েছে যে, সকল আহলেহাদীছ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ এবং সবাই সঠিক।
২. আহলেহাদীছরা যাহেরী নন। বরং দু’টা পৃথক।
৩. মুফাসসির ইবনু জারীর ত্বাবারী ও মুহাদ্দিছ ইমাম বুখারী (রহঃ) দু’জনই আহলেহাদীছ ছিলেন।
ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর মত উচ্চ মর্যাদাবান ব্যক্তির নাম ইমাম শাফেঈ, মালেকী, হাম্বলীর পরিবর্তে আহলেহাদীছের উদাহরণে উল্লেখ করা না শুধু আহলেহাদীছদের প্রাচীনত্বের প্রমাণ; বরং মর্যাদাও বটে।
এক্ষণে এটাও দেখা দরকার যে, আহলেহাদীছদের ব্যাপারে স্বয়ং ইমাম শাফেঈ, ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল ও ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর মত কি?
(৫) ইমাম আহমাদ, বুখারী ও ইবনুল মুবারকের নিকটে ‘সাহায্যপ্রাপ্ত দল’ হল আহলেহাদীছ :
বিভিন্ন
শব্দে ও সনদে একটি হাদীছ বুখারী ও মুসলিমসহ অন্যান্য কিতাবে এসেছে, রাসূল
(ছাঃ) বলেছেন,لَا تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي قَائِمَةً بِأَمْرِ
اللهِ، لَا يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ أَوْ خَالَفَهُمْ، حَتَّى يَأْتِيَ
أَمْرُ اللهِ وَهُمْ ظَاهِرُونَ عَلَى النَّاسِ ‘চিরদিন আমার উম্মতের
মধ্যে একটি দল দ্বীনের উপরে প্রতিষ্ঠিত থাকবে। পরিত্যাগকারী বা
বিরোধিতাকারীরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এমতাবস্থায় ক্বিয়ামত এসে
যাবে, অথচ তারা মানুষের উপরে বিজয়ীই থাকবে’।[8]
এই দল কোন্টি? এর উত্তরের জন্য আসুন দেখি উম্মতের সম্মানিত ইমামগণের বক্তব্য কি?
ফযল
বিন যিয়াদ বলেন,سَمِعْتُ أَحْمَدَ بْنَ حَنْبَلٍ، وَذَكَرَ حَدِيثَ: لَا
تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي ظَاهِرِينَ عَلَى الْحَقِّ، فَقَالَ: إِنْ
لَمْ يَكُونُوا أَصْحَابَ الْحَدِيثِ فَلَا أَدْرِي مَنْ هُمْ؟ ‘আমি ইমাম
আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-এর কাছ থেকে শুনেছি, তিনি নিম্নোক্ত হাদীছটি বর্ণনা
করেন ‘চিরদিন আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল হক্বের উপরে বিজয়ী থাকবে’। অতঃপর
তিনি বলেন, তাঁরা যদি আহলেহাদীছ না হন, তবে আমি জানি না তারা কারা’।[9]
অর্থাৎ ইমাম আহমাদের নিকটে এ দল আহলেহাদীছ ব্যতীত অন্য কেউ হ’তেই পারে না।
ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন, يَعْنِي أَصْحَابَ الْحَدِيثِ (হাদীছে উল্লেখিত দল দ্বারা) আহলুল হাদীছ উদ্দেশ্য’।[10]
আব্দুল্লাহ
ইবনুল মুবারক তাবে-তাবেঈদের মধ্যে গণ্য। তাঁর ব্যক্তিত্ব উম্মতের মাঝে
কতটুকু স্বীকৃত তা ইমাম যাহাবী (রহঃ)-এর উক্তি থেকে জানা যায়। ইমাম যাহাবী
বলেন, حديثه حجة بالاجماع ‘আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক বর্ণিত হাদীছ সমূহ
সর্বসম্মতভাবে গ্রহণযোগ্য’।[11]
এ দলের ব্যাপারে আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (রহঃ) বলেন, هُمْ عِنْدِي أَصْحَابُ الْحَدِيثِ ‘আমার নিকটে তারা (অর্থাৎ হক্বের
উপর প্রতিষ্ঠিত দল) আহলুল হাদীছ’।[12]
এখানে
যেন কেউ একথা না বলে যে, উক্ত উদ্ধৃতি সমূহে আছহাবুল হাদীছ শব্দটি এসেছে,
আহলেহাদীছ নয়। স্মরণ রাখা দরকার যে, ‘আহলুলহাদীছ’ ও ‘আছহাবুল হাদীছ’ দু’টি
শব্দের একটিই অর্থ। স্বয়ং মুহাদ্দিছগণ উভয় শব্দই ব্যবহার করতেন। যেমন এই
হাদীছের ব্যাখ্যায় জগদ্বিখ্যাত মুহাদ্দিছ আলী ইবনুল মাদীনী (রহঃ) বলেন,
هُمْ أَهْلُ الْحَدِيثِ ‘তারা (হক্বের উপর টিকে থাকা দল) হ’লেন আহলেহাদীছ’।[13]
এখানে আলী ইবনুল মাদীনী ‘আছহাবুল হাদীছ’-এর পরিবর্তে ‘আহলুলহাদীছ’ শব্দ ব্যবহার করেছেন।
আলী
ইবনুল মাদীনী কে? আলী ইবনুল মাদীনীর মর্যাদা বর্ণনার জন্য ইমাম বুখারী
(রহঃ)-এর উক্তিই যথেষ্ট। ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন, مَا اسْتَصغَرْتُ نَفْسِي
عِنْدَ أَحَدٍ إِلاَّ عِنْدَ عَلِيِّ بنِ المَدِيْنِيِّ. ‘আলী ইবনুল
মাদীনী ব্যতীত আমি নিজেকে আর কারো সামনে ছোট মনে করতাম না’।[14]
এসব উদ্ধৃতি থেকে একথা প্রমাণিত হয় যে, সালাফে ছালেহীনের মাঝে ‘আহলেহাদীছ’ শব্দটি পরিচিত ছিল। আর এটা ঐ দলকে বলা হ’ত, যেটি ক্বিয়ামত পর্যন্ত হকের উপরে প্রতিষ্ঠিত থাকবে।
একটি সংশয় নিরসন :
এখানে একটা ভুল ভেঙ্গে দেওয়া যরূরী। সেটা হ’ল কেউ কেউ এ সংশয় পোষণ করে যে, উক্ত উদ্ধৃতিগুলিতে ‘আহলেহাদীছ’ শব্দটি মুহাদ্দিছদের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। কোন ফিরক্বা বা দলকে বুঝানোর জন্য নয়। তারা বলে যে, তাফসীর শাস্ত্রে অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে যেমন ‘মুফাসসির’ বা ‘আহলে তাফসীর’ বলা হয়, তেমনি হাদীছের জগতে দক্ষ ব্যক্তিকে ‘মুহাদ্দিছ’ বা ‘আহলেহাদীছ’ বলা হয়। কিন্তু এ কথাটি সঠিক নয়। এটা ভুল হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, যদি বাস্তবেই আহলেহাদীছ দ্বারা স্রেফ মুহাদ্দিছগণই উদ্দেশ্য হয় তাহ’লে হাদীছে ক্বিয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকা যেই দলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্য থেকে মুফাসসির ও ফক্বীহগণকে বের করতে হবে। হাদীছের শব্দগুলি ভালভাবে চিন্তা-ভাবনা করলে এ ভুল ধারনাটা আরো স্পষ্ট হয়ে যায়। কেননা হাদীছে আহলে বাতিলের মুকাবিলায় আহলেহাদীছকে উল্লেখ করা হয়েছে। আহলে ফিক্বহ ও আহলে তাফসীরের মুকাবিলায় নয়।
এ কথাটা আরো পরিষ্কার করার জন্য আমরা শায়খ আব্দুল কাদের জীলানী (রহঃ)-এর উক্তিটি পেশ করা যথোপযুক্ত মনে করছি, যা তার ‘গুনইয়াতুত ত্বলেবীন’ গ্রন্থে উদ্বৃত হয়েছে।
(৬) আহলুল হাদীছই আহলুস সুন্নাহ : শায়খ আব্দুল কাদের জীলানী (রহঃ) বলেন,
واعلم أن لأهل البدع علامات يعرفون بها. فعلامة أهل البدعة الوقيعة في أهل الأثر. وعلامة الزنادقة تسميتهم أهل الأثر: بالحشوية، ويريدون إبطال الآثار. وعلامة القدرية تسميتهم أهل الأثر: مجبرة. وعلامة الجهمية تسميتهم أهل السنة مشبهة. وعلامة الرافضة تسميتهم أهل الأثر: ناصبة. وكل ذلك عصبية وغياظ لأهل السنة، ولا اسم لهم إلا اسم واحد، وهو أصحاب الحديث. ولا يلتصق بهم ما لقبهم به أهل البدع، كما لم يلتصق بالنبي صلى الله عليه وسلم تسمية كفار مكة له ساحرًا وشاعرًا ومجنونًا ومفتونًا وكاهنًا، ولم يكن اسمه عند الله وعند ملائكته وعند إنسه وجنه وسائر خلقه إلا رسولًا نبيًا بريًا من العاهات كلها.
‘জেনে রাখ যে, বিদ‘আতীদের কিছু নিদর্শন রয়েছে, যা দেখে
তাদের চেনা যায়। বিদ‘আতীদের লক্ষণ হ’ল আহলেহাদীছদের গালি দেওয়া ও বিভিন্ন
বাজে নামে তাদেরকে সম্বোধন করা। যিনদীক্বদের (নাস্তিক) নিদর্শন হ’ল, তারা
আহলে আছারকে হাশাবিয়া বলে থাকে। এর মাধ্যমে তারা আছারকে বাতিল সাব্যস্ত
করতে চায়। ক্বাদারিয়াদের নিদর্শন হ’ল, তারা আহলেহাদীছদেরকে মুজবেরাহ বলে।
জাহমিয়াদের নিদর্শন হ’ল তারা আহলুস সুন্নাহকে মুশাবিবহা তথা সাদৃশ্য
স্থাপনকারী বলে। রাফেযীদের নিদর্শন হ’ল তারা আহলে আছারকে নাছেবাহ বলে।
এগুলি সুন্নাতপন্থীদের বিরুদ্ধে তাদের দলীয় গোঁড়ামি ও অন্তর্জ্বালার
বহিঃপ্রকাশ ভিন্ন কিছুই নয়। কেননা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অন্য কোন
নাম নেই একটি নাম ব্যতীত। সেটি হল ‘আছহাবুল হাদীছ’ বা ‘আহলেহাদীছ’।
বিদ‘আতীদের এইসব গালি প্রকৃত অর্থে আহলেহাদীছদের জন্য প্রযোজ্য নয়। যেমন
মক্কার কাফিরদের জাদুকর, কবি, পাগল, মাথা খারাপ, গায়েবজান্তা প্রভৃতি গালি
রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য প্রযোজ্য ছিল না। রাসূল (ছাঃ) আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতা
মন্ডলী, মানুষ, জ্বিন ও তাঁর সৃষ্টির নিকটে সকল দোষ-ত্রুটি থেকে পূত-পবিত্র
একজন নবী ও রাসূল ছিলেন’।[15]
উপরোক্ত উদ্ধৃতিতে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো চিন্তা-ভাবনার দাবী রাখে।
(১) শায়খ আব্দুল কাদের জীলানী (রহঃ) ভ্রান্ত ফিরক্বাগুলির বিপরীতে আহলেহাদীছ-এর কথা উল্লেখ করেছেন।
(২) তাঁর নিকটে আহলেহাদীছদের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন কথা বলা বাতিল ফিরক্বাগুলির নিদর্শন।
(৩) তাঁর নিকটে আহলেহাদীছ ও আহলে সুন্নাত একই।
(৪) আহলুস সুন্নাতের একটাই নাম ‘আহলুল হাদীছ’।
এ সকল আলোচনার পর প্রশ্ন হ’ল, এরপরেও কি আহলেহাদীছকে একটি নতুন দল বলে সন্দেহের তীর নিক্ষেপ করা ঠিক হবে? আমরা এর জবাব সম্মানিত পাঠকদের হাতেই ছেড়ে দিলাম।
(ক্রমশঃ)
[1]. আলবানী, তাহক্বীক্ব আবুদাঊদ হা/৩৩৬, সনদ হাসান।
[2]. খত্বীব বাগদাদী (৩৯২-৪৬৩ হিঃ) বলেছেন,وَكُلُّ فِئَةٍ تَتَحَيَّزُ إِلَى هَوًى تَرْجِعُ إِلَيْهِ، أَوْ تَسْتَحْسِنُ رَأَيًا تَعْكُفُ عَلَيْهِ، سِوَى أَصْحَابِ الْحَدِيثِ، فَإِنَّ الْكِتَابَ عُدَّتُهُمْ، وَالسُّنَّةُ حُجَّتُهُمْ، (শারফু আছহাবিল হাদীছ, পৃঃ ৭)।
[3]. তাফসীর ইবনু কাছীর ৫/৯৯ বনী ইসরাঈলের ৭১নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রঃ।
[4]. ইসমাঈল বিন ওমর বিন কাছীর বিন যাও বিন দার‘ কুরাশী বছরী অতঃপর দামেশক্বী আবুল ফিদা ইমাদুদ্দীন। তিনি একজন হাদীছের হাফেয, ঐতিহাসিক ও ফক্বীহ। তদানীন্তন সিরিয়ার অন্তর্ভুক্ত বছরার একটি গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ৭০৬ হিজরীতে তিনি তার এক ভাইয়ের সাথে দামেশক্বে স্থানান্তরিত হন। তিনি ইলম অন্বেষণের জন্য ভ্রমণ করেছেন। তিনি দামেশক্বে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর জীবদ্দশাতেই লোকেরা তাঁর গ্রন্থসমূহ প্রচার-প্রসার করেছেন (খায়রুদ্দীন যিরিকলী, আল-আ‘লাম ১/৩২০)।
[5]. রাদ্দুল মুহতার ৪/৮০, ‘দন্ডবিধি’ অধ্যায়।
[6]. তারীখু বাগদাদ ১৪/২৫৭।
[7]. আয়নুল হেদায়াহ ১/৫৩৮।
[8]. ছহীহ মুসলিম হা/৩৫৪৮,‘ইমারত’ অধ্যায়।
[9]. খত্বীব বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ, পৃঃ ৪২।
[10]. ঐ, পৃঃ ৪৫।
[11]. যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৮/৩৮০।
[12]. শারফু আছহাবিল হাদীছ, পৃঃ ৪১।
[13]. সুনানে তিরমিযী হা/২২২৯; শারফু আছহাবিল হাদীছ, পৃঃ ৯।
[14]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১২/৪২০।
[15]. গুনয়াতুত ত্বলেবীন ১/১৬৬।