ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা
ওমর ফারূক (রাঃ) জীবনের শেষ হজ্জ সমাপনের পর মসজিদে নববীতে এক ঐতিহাসিক
ভাষণ প্রদান করেন। এ সম্পর্কে নিম্নোক্ত হাদীছ।-
ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি মুহাজিরদের কতক লোককে পড়াতাম। তাদের মধ্যে আব্দুর রহমান ইবনু আওফ (রাঃ) ছিলেন অন্যতম। একবার আমি তার মিনার বাড়িতে ছিলাম। তখন তিনি ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর সঙ্গে হজ্জে ছিলেন। এমন সময় আব্দুর রহমান (রাঃ) আমার কাছে ফিরে এসে বললেন, যদি আপনি ঐ লোকটিকে দেখতেন, যে লোকটি আজ আমীরুল মুমিনীন-এর কাছে এসেছিল এবং বলেছিল, হে আমীরুল মুমিনীন! অমুক ব্যক্তির ব্যাপারে আপনার কিছু করার আছে কি? যে লোকটি বলে থাকে যে, যদি ওমর মারা যান তাহ’লে অবশ্যই অমুকের হাতে বায়‘আত করব। আল্লাহর কসম! আবূবকরের বায়‘আত আকস্মিক ব্যাপারই ছিল। ফলে তা হয়ে যায়। এ কথা শুনে তিনি ভীষণভাবে রাগান্বিত হ’লেন। তারপর বললেন, ইনশাআল্লাহ সন্ধ্যায় আমি অবশ্যই লোকদের মধ্যে দাঁড়াব আর তাদেরকে ঐসব লোক থেকে সতর্ক করে দিব, যারা তাদের বিষয়াদি আত্মসাৎ করতে চায়।
আব্দুর রহমান (রাঃ) বলেন, তখন আমি বললাম, হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি এমনটা করবেন না। কারণ হজ্জের মওসুম নিম্নস্তরের ও নির্বোধ লোকদেরকে একত্রিত করে। আর এরাই আপনার নৈকট্যের সুযোগে প্রাধান্য বিস্তার করে ফেলবে, যখন আপনি লোকদের মধ্যে দাঁড়াবেন। আমার ভয় হচ্ছে, আপনি যখন দাঁড়িয়ে কোন কথা বলবেন, তখন তা সব জায়গায় তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়বে। আর তারা তা ঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারবে না। আর সঠিক রাখতেও পারবে না। সুতরাং মদীনায় পৌঁছা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। আর তা হ’ল হিজরত ও সুন্নাতের কেন্দ্রস্থল। ফলে সেখানে জ্ঞানী ও সুধীবর্গের সঙ্গে মিলিত হবেন। আর যা বলার তা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারবেন। জ্ঞানী ব্যক্তিরা আপনার কথাকে সঠিকভাবে বুঝতে পারবে ও সঠিক ব্যবহার করবে। তখন ওমর (রাঃ) বললেন, জেনে রেখো! আল্লাহর কসম! ইনশাআল্লাহ আমি মদীনায় পৌঁছার পর সর্বপ্রথম এ কাজটি নিয়ে ভাষণের জন্য দাঁড়াব।
ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, আমরা যিলহজ্জ মাসের শেষ দিকে মদীনায় ফিরলাম। যখন জুম‘আর দিন এল, সূর্য অস্ত যাওয়ার উপক্রম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি মসজিদে গেলাম। পৌঁছে দেখি, সাঈদ ইবনু যায়েদ ইবনে আমর ইবনে নুফায়েল (রাঃ) মিম্বরের গোড়ায় বসে আছেন, আমিও তার পাশে এমনভাবে বসলাম যেন আমার হাঁটু তার হাঁটু স্পর্শ করছে। অল্পক্ষণের মধ্যে ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বেরিয়ে আসলেন। আমি যখন তাঁকে সামনের দিকে আসতে দেখলাম, তখন সাঈদ ইবনু যায়েদ ইবনে আমর ইবনে নুফায়েলকে বললাম, আজ সন্ধ্যায় অবশ্যই তিনি এমন কিছু কথা বলবেন, যা তিনি খলীফা হওয়া থেকে আজ পর্যন্ত বলেননি। কিন্তু তিনি আমার কথাটি উড়িয়ে দিলেন এবং বললেন, আমার মনে হয় না যে, তিনি এমন কোন কথা বলবেন, যা এর আগে বলেননি। এরপর ওমর (রাঃ) মিম্বরের উপরে বসলেন। যখন মুয়াযযিন আযান থেকে ফারেগ হয়ে গেলেন তখন তিনি দাঁড়ালেন। আর আল্লাহর যথোপযুক্ত প্রশংসা করলেন। তারপর বললেন, ‘আম্মাবা‘দ। আজ আমি তোমাদেরকে এমন কথা বলতে চাই, যা আমারই বলা কর্তব্য। হয়তবা কথাটি আমার মৃত্যুর নিকটবর্তী সময়ে হচ্ছে। তাই যে ব্যক্তি কথাগুলো ঠিকভাবে বুঝে সংরক্ষণ করবে সে যেন কথাগুলো ঐসব স্থানে পৌঁছে দেয় যেখানে তার সওয়ারী পৌঁছবে। আর যে ব্যক্তি কথাগুলো ঠিকভাবে বুঝতে আশংকাবোধ করছে আমি তার জন্য আমার ওপর মিথ্যা আরোপ করা ঠিক মনে করছি না। নিশ্চয়ই আল্লাহ মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে সত্য সহকারে পাঠিয়েছেন। আর তাঁর উপর কিতাব অবতীর্ণ করেছেন এবং আল্লাহর অবতীর্ণ বিষয়াদির একটি ছিল রজমের আয়াত। আমরা সে আয়াত পড়েছি, বুঝেছি, আয়ত্ত করেছি।
আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) পাথর মেরে হত্যা করেছেন। আমরাও তাঁর পরে পাথর মেরে হত্যা করেছি। আমি আশংকা করছি যে, দীর্ঘকাল অতিবাহিত হবার পর কোন লোক এ কথা বলে ফেলতে পারে যে, আল্লাহর কসম! আমরা আল্লাহর কিতাবে পাথর মেরে হত্যার আয়াত পাচ্ছি না। ফলে তারা এমন একটি ফরয ত্যাগের কারণে পথভ্রষ্ট হবে, যা আল্লাহ অবতীর্ণ করেছেন। আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী ঐ ব্যক্তির উপর পাথর মেরে হত্যা অবধারিত, যে বিবাহিত হবার পর যেনা করবে, সে পুরুষ হোক বা নারী। যখন সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাবে অথবা গর্ভ বা স্বীকারোক্তি পাওয়া যাবে। তেমনি আমরা আল্লাহর কিতাবে এও পড়তাম যে, তোমরা তোমাদের বাপ-দাদা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না। এটি তোমাদের জন্য কুফরী যে, তোমরা স্বীয় বাপ-দাদা থেকে বিমুখ হবে। জেনে রেখো! রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, তোমরা সীমা ছাড়িয়ে আমার প্রশংসা করো না, যেভাবে ঈসা ইবনু মারিয়ামের সীমা ছাড়িয়ে প্রশংসা করা হয়েছে। তোমরা বল, আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। এরপর আমার কাছে এ কথা পৌঁছেছে যে, তোমাদের কেউ এ কথা বলছে যে, আল্লাহর কসম! যদি ওমর মারা যায় তাহ’লে আমি অমুকের হাতে বায়‘আত করব। কেউ যেন এ কথা বলে ধোঁকায় না পড়ে যে আবূবকরের বায়‘আত ছিল আকস্মিক ঘটনা। ফলে তা সংঘটিত হয়ে যায়। জেনে রেখো! তা অবশ্যই এমন ছিল। তবে আল্লাহ আকস্মিক বায়‘আতের ক্ষতি প্রতিহত করেছেন। সফর করে সওয়ারীগুলোর ঘাড় ভেঙ্গে যায়- এমন স্থান পর্যন্ত মানুষের মাঝে আবূবকরের মত কে আছে? যে কেউ মুসলিমদের পরামর্শ ছাড়া কোন লোকের হাতে বায়‘আত করবে, তার অনুসরণ করা যাবে না এবং ঐ লোকেরও না, যে তার অনুসরণ করবে। কেননা উভয়েরই হত্যার শিকার হবার আশংকা রয়েছে। যখন আল্লাহ তাঁর নবী (ছাঃ)-কে ওফাত দিলেন, তখন আবূবকর (রাঃ) ছিলেন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। অবশ্য আনছারগণ আমাদের বিরোধিতা করেছেন। তারা সকলে বাণী সা‘ঈদার চত্বরে মিলিত হয়েছেন। আমাদের থেকে বিমুখ হয়ে আলী, যুবায়ের ও তাঁদের সাথীরাও বিরোধিতা করেছেন। অপরদিকে মুহাজিরগণ আবূবকরের কাছে সমবেত হ’লেন। তখন আমি আবূবকরকে বললাম, হে আবূবকর! আমাদেরকে নিয়ে আমাদের ঐ আনছার ভাইদের কাছে চলুন। আমরা তাদের উদ্দেশ্যে রওনা হ’লাম। যখন আমরা তাদের নিকটবর্তী হ’লাম তখন আমাদের সঙ্গে তাদের দু’জন পুণ্যবান ব্যক্তির সাক্ষাৎ হ’ল। তারা উভয়েই এ বিষয়ে আলোচনা করলেন, যে বিষয়ে লোকেরা ঐকমত্য হয়েছিল। এরপর তারা বললেন, হে মুহাজির দল! আপনারা কোথায় যাচ্ছেন? তখন আমরা বললাম, আমরা আমাদের ঐ আনছার ভাইদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছি। তারা বললেন, না, আপনাদের তাদের নিকট না যাওয়াই উচিত। আপনারা আপনাদের বিষয় সমাপ্ত করে নিন। তখন আমি বললাম, আল্লাহর কসম! আমরা অবশ্যই তাদের কাছে যাব। আমরা চললাম। অবশেষে বাণী সা‘ঈদার চত্বরে তাদের কাছে আসলাম। আমরা দেখতে পেলাম তাদের মাঝখানে এক লোক বস্ত্রাবৃত অবস্থায় রয়েছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ঐ লোক কে? তারা জবাব দিল ইনি সা‘দ ইবনু ওবাদাহ। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তার কী হয়েছে? তারা বলল, তিনি জ্বরে আক্রান্ত। আমরা কিছুক্ষণ বসার পরই তাদের খত্বীব উঠে দাঁড়িয়ে কালিমায়ে শাহাদাত পড়লেন এবং আল্লাহর যথোপযুক্ত প্রশংসা করলেন। তারপর বললেন, আম্মাবা‘দ। আমরা আল্লাহর (দ্বীনের) সাহায্যকারী ও ইসলামের সেনাদল এবং তোমরা হে মুহাজির দল! একটি ছোট দল মাত্র, যে দলটি তোমাদের গোত্র থেকে আলাদা হয়ে আমাদের কাছে পৌঁছেছে। অথচ এরা এখন আমাদেরকে মূল থেকে সরিয়ে দিতে এবং খিলাফত থেকে বঞ্চিত করে দিতে চাচ্ছে। যখন তিনি নিশ্চুপ হ’লেন তখন আমি কিছু বলার ইচ্ছা করলাম। আর আমি আগে থেকেই কিছু কথা সাজিয়ে রেখেছিলাম, যা আমার কাছে ভাল লাগছিল। আমি ইচ্ছা করলাম যে, আবূবকর (রাঃ)-এর সামনে কথাটি পেশ করব। আমি তাঁর ভাষণ থেকে সৃষ্ট রাগকে কিছুটা ঠান্ডা করতে চাইলাম। আমি যখন কথা বলতে চাইলাম তখন আবূবকর (রাঃ) বললেন, তুমি থাম। আমি তাঁকে রাগান্বিত করাটা পসন্দ করলাম না। তাই আবূবকর (রাঃ) কথা বললেন, আর তিনি ছিলেন আমার চেয়ে সহনশীল ও গম্ভীর। আল্লাহর কসম! তিনি এমন কোন কথা বাদ দেননি যা আমি সাজিয়ে রেখেছিলাম। অথচ তিনি তাৎক্ষণিকভাবে ঐরকম বরং তার থেকেও উত্তম কথা বললেন। অবশেষে তিনি কথা বন্ধ করে দিলেন।
এরপর আবার বললেন, তোমরা তোমাদের ব্যাপারে যেসব উত্তম কাজের কথা বলেছ আসলে তোমরা এর উপযুক্ত। তবে খিলাফতের ব্যাপারটি কেবল এই কুরাইশ বংশের জন্য নির্দিষ্ট। তারা হচ্ছে বংশ ও আবাসভূমির দিক দিয়ে সর্বোত্তম আরব। আর আমি এ দু’জন হ’তে যে কোন একজনকে তোমাদের জন্য নির্ধারিত করলাম। তোমরা যে কোন একজনের হাতে ইচ্ছা বায়‘আত করে নাও। এরপর তিনি আমার ও আবূ ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহ (রাঃ)-এর হাত ধরলেন। তিনি আমাদের মাঝখানেই বসা ছিলেন। আমি তাঁর এ কথা ব্যতীত যত কথা বলেছেন কোনটাকে অপসন্দ করিনি। আল্লাহর কসম! আবূবকর যে জাতির মধ্যে বর্তমান আছেন সে জাতির উপর আমি শাসক নিযুক্ত হবার চেয়ে এটাই শ্রেয় যে, আমাকে পেশ করে আমার ঘাড় ভেঙ্গে দেয়া হবে, ফলে তা আমাকে কোন গুনাহের কাছে আর নিয়ে যেতে পারবে না। হে আল্লাহ! হয়ত আমার আত্মা আমার মৃত্যুর সময় এমন কিছু আকাঙ্ক্ষা করতে পারে, যা এখন আমি পাচ্ছি না। তখন আনছারদের এক ব্যক্তি বলে উঠল, আমি এ জাতির অভিজ্ঞ ও বংশগত সম্ভ্রান্ত। হে কুরাইশগণ! আমাদের হ’তে হবে এক আমীর আর তোমাদের হ’তে হবে এক আমীর। এ সময় অনেক কথা ও হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল। আমি এ মতবিরোধের দরুন শংকিত হয়ে পড়লাম। তাই আমি বললাম, হে আবূবকর! আপনি হাত বাড়ান। তিনি হাত বাড়ালেন। আমি তাঁর হাতে বায়‘আত করলাম। মুহাজিরগণও তাঁর হাতে বায়‘আত করলেন। অতঃপর আনছারগণও তাঁর হাতে বায়‘আত করলেন। আর আমরা সা‘দ ইবনু ওবাদাহ (রাঃ)-এর দিকে অগ্রসর হ’লাম। তখন তাদের এক লোক বলে উঠল, তোমরা সা‘দ ইবনু ওবাদাকে জানে মেরে ফেলেছ। তখন আমি বললাম, আল্লাহ সা‘দ ইবনু ওবাদাকে হত্যা করেছেন। ওমর (রাঃ) বলেন, আল্লাহর কসম! আমরা সে সময়ের যরূরী বিষয়ের মধ্যে আবূবকরের বায়‘আতের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোন কিছুকে মনে করিনি। আমাদের ভয় ছিল যে, যদি বায়‘আতের কাজ অসম্পন্ন থাকে, আর এ জাতি থেকে আলাদা হয়ে যাই তাহ’লে তারা আমাদের পরে তাদের কারো হাতে বায়‘আত করে নিতে পারে। তারপর হয়ত আমাদেরকে নিজ ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের অনুসরণ করতে হ’ত, না হয় তাদের বিরোধিতা করতে হ’ত। ফলে তা মারাত্মক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াত। অতএব যে ব্যক্তি মুসলিমদের পরামর্শ ছাড়া কোন ব্যক্তির হাতে বায়‘আত করবে তার অনুসরণ করা যাবে না। আর ঐ লোকেরও না, যে তার অনুসরণ করবে। কেননা উভয়েরই নিহত হওয়ার আশংকা আছে (বুখারী হা/৬৮৩০ ‘দন্ডবিধি’ অধ্যায়)।
এ হাদীছে আবূবকর (রাঃ)-এর বায়‘আত গ্রহণের পূর্বের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। আর এ বায়‘আত গ্রহণের মধ্য দিয়ে আনছার ও মুহাজিরদের মাঝে বিবদমান বাকবিতন্ডার অবসান ঘটে। এ হাদীছে একে অপরকে মেনে নেওয়ার যে দৃষ্টান্ত বিধৃত হয়েছে, তা থেকে আমাদেরকে শিক্ষা নিতে হবে। আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
মুসাম্মাৎ শারমীন আখতার
পিঞ্জুরী, কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জ।