মানুষ সৃষ্টিগতভাবেই ভাল ও মন্দের সমষ্টি। যার মধ্যে যেটার আধিক্য, তার আচরণে সেটাই প্রকাশ পায়। হাদীছের ভাষায়, সে আল্লাহভীরু সৎকর্মশীল অথবা হতভাগ্য পাপাচারী। এই দু’টি মজ্জাগত স্বভাব ও আচরণের মধ্যে সর্বদা দ্বন্দ্ব ও সংঘাত চলছে। কিন্তু উভয় স্বভাবের লোকই স্ব স্ব প্রয়োজনের তাকীদে সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা চায়। প্রথম প্রকারের লোকেরা আল্লাহ প্রেরিত সত্য বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করতে চায়। দ্বিতীয় ভাগের লোকেরা নিজেদের মনগড়া বিধান অনুযায়ী চলতে চায়। উভয় দলের মধ্যে সুবিধাবাদী কিছু লোক চায় দু’দিক ঠিক রেখে মধ্যবর্তী একটা পথ অবলম্বন করতে। যদিও আল্লাহর বিধান সকলের জন্য সহজ এবং মানুষের স্বভাবধর্মের সাথে সামঞ্জস্যশীল। যেকোন চিন্তাশীল জ্ঞানী মানুষ তা স্বীকার করেন। এরপরেও স্বেচ্ছাচারী মানুষ চায় সবকিছু তার ইচ্ছামত চলুক।

বাংলাদেশে চারটি দর্শনের সংঘাত চলছে। (১) ব্যক্তি জীবনে ও বৈষয়িক জীবনে ইসলামী বিধানকে অস্বীকার করেন (২) ব্যক্তিজীবনে স্বীকার করেন ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে মান্য করেন। কিন্তু রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক তথা বৈষয়িক জীবনে ইসলামী বিধানকে অস্বীকার করেন অথবা অমান্য করেন (৩) উভয় জীবনে ইসলামকে স্বীকার করেন। কিন্তু স্ব স্ব মাযহাব ও তরীকা অনুযায়ী তা মান্য করতে চান (৪) যারা উভয় জীবনে ইসলামী বিধান মান্য করাকে অপরিহার্য বলেন এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে কিতাব ও সুন্নাতের  সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার কামনা করেন। এক্ষণে সিদ্ধান্ত নিতে হবে উপরোক্ত চারটি দর্শনের মধ্যে আমরা কোনটাকে বেছে নেব।

ইসলামের মূল আবেদন হ’ল মানুষকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দেওয়া। আর আল্লাহর পথ হ’ল পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের পথ। যার ব্যাখ্যা হবে ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী। কেননা কুরআন রাসূল (ছাঃ)-এর উপরে নাযিল হয়েছে এবং তাঁর কথা, কাজ ও সম্মতির মাধ্যমে এর বাস্তব ব্যাখ্যা তিনিই দান করেছেন। ছাহাবায়ে কেরাম ছিলেন তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী ও সেই রঙে রঞ্জিত। আধুনিক কোন ইসলামী চিন্তাবিদের বুঝ যদি ছাহাবায়ে কেরামের বুঝের বিপরীত হয়, তবে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। অতএব সর্বাগ্রে চাই লক্ষ্য নির্ধারণ ও দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ।

বস্ত্তত যারা ইসলামের বিজয় কামনা করেন, তাদেরকে ইসলামের মৌলিক আদর্শের দিকে ফিরে যেতে হবে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে আমর বিল মা‘রূফ ও নাহি ‘আনিল মুনকার তথা ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ-এর নীতি অনুসরণ করতে হবে। দুনিয়ায় কোন কিছু পাওয়ার উদ্দেশ্যে নয়, কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে একাজ করতে হবে। তবেই ইনশাআল্লাহ মুসলমানের হারানো সুদিন ফিরে আসবে। মনে রাখা আবশ্যক যে, র‌্যাব-পুলিশ আর জনপ্রতিনিধি দিয়ে কখনো সমাজে শান্তি কায়েম করা যায় না। বরং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে আল্লাহভীরু সৎমানুষের নিয়োগের মাধ্যমে সমাজে শান্তি কায়েম করা সম্ভব। তাই নির্বাচনী খেলা বাদ দিয়ে জনগণকে আল্লাহভীরু ও আখেরাতমুখী করার উদ্যোগ নেয়া অধিক যরূরী। যেখানেই নির্বাচন সেখানেই গ্রুপিং ও হানাহানি। তাই  নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ ইসলামী শাসনেই কেবল সুশাসন আশা করা যেতে পারে।

উল্লেখ্য, জান্নাত লাভের উদ্দেশ্যে মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকতে হবে, ক্ষমতা লাভের উদ্দেশ্যে নয়। দাওয়াত ও সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্যে জামা‘আত গঠন করা যাবে, ইলেকশনে জেতার উদ্দেশ্যে দল গঠন নয়। দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া ফরয, দ্বীনকে ক্ষমতায় বসানো ফরয নয়। এ দায়িত্ব আল্লাহর। তিনি কাকে দুনিয়াবী ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আনবেন, কিভাবে আনবেন, সবই তাঁর এখতিয়ারে। যিনিই ক্ষমতায় আসবেন, মুমিন তার সৎকর্মে সমর্থন দিবে ও অসৎকর্মে প্রতিবাদ করবে। কিন্তু ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত হবে না। অথচ আজকাল ব্যালটপন্থী হৌক বা বুলেটপন্থী হৌক সকলের একটাই উদ্দেশ্য, ক্ষমতা দখল করা। যা নবীদের তরীকা বিরোধী এবং যা সমাজে কোন কল্যাণ বয়ে আনেনা।

অতএব সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, মানুষ আল্লাহর বিধান মানবে না প্রবৃত্তির গোলাম হবে। প্রবৃত্তির আরেক নাম শয়তান। শয়তান কখনো আল্লাহর আনুগত্য করে না। সে সর্বদা চাকচিক্যপূর্ণ যুক্তি দেখিয়ে ও দুনিয়াবী স্বার্থের সুঁড়সুড়ি দিয়ে মানুষকে তার দলে ভিড়াতে চায়। যদিও সেগুলি মায়া-মরীচিকা ভিন্ন কিছুই নয়। যার প্রমাণ আজকের অশান্ত বিশ্ব। শয়তানের বড় দুশমন হ’ল ইসলাম। আর ইসলামের বড় দুশমন হ’ল শয়তান। অন্যেরা তো সাথে আছেই। কেবল ইসলামী নেতা ও ইসলামের যথার্থ অনুসারীদের যেকোনভাবে হৌক দলে ভিড়াতে পারলেই শয়তান সফলকাম হবে। সেজন্য আপোষকামী ও সুবিধাবাদী ইসলামী নেতাদের ‘মডারেট’ এবং নিষ্ঠাবান নেতাদের ‘মৌলবাদী’ লকব দেওয়ার জন্য শয়তান সদা প্রস্ত্তত হয়ে বসে আছে।

এক্ষণে আমরা যদি আখেরাতকে লক্ষ্য নির্ধারণ করি, তাহ’লে আল্লাহর পথেই থাকতে হবে। শয়তানের লোভনীয় পথে পা বাড়ানো যাবে না। আল্লাহর পথে থাকলে আল্লাহ আমাদের দুনিয়া ও আখেরাত দু’টিরই কল্যাণ করবেন। কিন্তু শয়তানের পথে গেলে দুনিয়া-আখেরাত দু’টিই হারাতে হবে। দুনিয়া ভোগ করব আগে, তারপর আখেরাত দেখব, এরূপ লোভী মানসিকতা থাকলে সে অবশ্যই আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হবে। কেননা বিজয় কেবল দৃঢ়চিত্ত মুমিনের জন্য, দো’দেল বান্দার জন্য নয়। আর আল্লাহ কারু বুকে দু’টি হৃদয় সৃষ্টি করেননি (আহযাব ৩৩/৪)। আল্লাহ বলেন, হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর (অর্থাৎ তাঁর বিধান মেনে চল), তাহ’লে তিনি তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পদযুগল দৃঢ় করবেন’ (মুহাম্মাদ ৪৭/৭)। মনে রাখতে হবে মুমিনদের জন্য আল্লাহ ব্যতীত কোন আশ্রয় নেই (তওবাহ ৯/১১৯)। তিনি বলেন, আল্লাহ কি তার বান্দার জন্য যথেষ্ট নয়? অথচ তারা তোমাকে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ভয় দেখায়। বস্ত্ততঃ আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তাকে পথ দেখাবার কেউ নেই’ (যুমার ৩৯/৩৬)

পরিশেষে বাংলাদেশে প্রচলিত বিজাতীয় মতবাদ সমূহ এবং ইসলামের নামে প্রচলিত মাযহাবী মতবাদ সমূহের বেড়াজাল ছিন্ন করে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে জীবন গড়ার জন্য জান্নাতপিয়াসী মুমিনকে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাবার আহবান জানাই। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন! (স.স.)

[দেশে অবিরতভাবে হরতাল-অবরোধ থাকায় এবং জিপিও পত্রিকা গ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করায় আমরা জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী’১৪ ৪র্থ-৫ম একত্রে যুগ্ম সংখ্যা বের করতে বাধ্য হই। এজন্য আমরা দুঃখিত।- সম্পাদক] 







বিষয়সমূহ: বিবিধ
সংস্কৃতি দর্শন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
কুরবানীর মাসায়েল - .
ওয়াহহাবী সংস্কার আন্দোলন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের উপায় - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
খোশ আমদেদ মাহে রামাযান - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সালাফী দাওয়াত - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
২০২৩ সালের সিলেবাস - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মানুষকে ভালবাসুন! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
নারী শিক্ষা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
কল্যাণমুখী প্রশাসন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আসামে মুসলিম নিধন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ক্বিয়ামতের গুজব ও বঙ্গবাজারে অগ্নিকান্ড - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.