সুদীর্ঘ পাঁচশত বছর ধরে চলে আসা বাবরি মসজিদ রামমন্দির বিতর্ক ভারতের জাতীয় জীবনে সর্বাধিক সমালোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম। পলাশীর যুদ্ধ ও ভারতে ইংরেজ শাসনের সূত্রপাত, বঙ্গভঙ্গ, ’৪৭-এর ভারতবিভাগ ইত্যাদি থেকে এ বিতর্ক কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ভারতের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক এমনকি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল, গত মাসের এলাহাবাদ হাইকোর্টের এক উদ্ভট রায়ে তা অমরতা লাভ করেছে। রায়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘যেহেতু বাবরি মসজিদের ভূমিতে রাম জন্মগ্রহণ করেন এবং ঐ স্থানে প্রতিষ্ঠিত রামমন্দির ভেঙ্গে সম্রাট বাবরের সেনাপতি মীর বাকী ১৫২৮ খ্রিষ্টাব্দে বাবরি মসজিদ নির্মাণ করেন, সেহেতু এ মসজিদ নির্মাণ হিন্দু সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতে অবৈধ। হিন্দু মহাসভা ও নির্মোহী আখড়া নামের দু’টি সংগঠন উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদ হাইকোর্টে রামমন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য জমি স্বত্ব চেয়ে মামলা করে। অন্যদিকে উত্তর প্রদেশের সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড মসজিদের স্বত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য একই আদালতে মামলা (Title suit) করে। কারণ ১৯৩৬ সালে মসজিদ এবং তৎসংলগ্ন জমি ওয়াকফ সম্পত্তি হিসাবে এ বোর্ডের নামে নিবন্ধন করা হয়। গত ৩০ সেপ্টেম্বর সে মামলার এক ঐতিহাসিক রায় প্রদান করা হয়।
এ রায়ে বিরোধপূর্ণ ২.৭৭ একর জমি তিন ভাগে ভাগ করে দেয়া হয়। যার দুই ভাগ পাবে হিন্দু সংগঠন দু’টি এবং অবশিষ্ট এক ভাগ পাবে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড অর্থাৎ জমিটি আদালত ২:১ অনুপাতে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ভাগ করে দেন। তবে রায়টির প্রাতিস্বিকতা এখানে নয়, বরং ভিন্ন তিনটি কারণে রায়টি বহুমাত্রিক প্রাসঙ্গিকতা লাভ করেছে। কারণগুলো হ’ল-
১. প্রায় ৬০ বছর পরে রায়টি প্রদান করা হয় এবং ৮ হাযার ৫০০ পৃষ্ঠার এক মহাকাব্যিক রায় তৈরী করা হয়। (১৯৪৯ সালে হিন্দু-মুসলিম উভয়ে প্রথম আদালতে মামলা করে বাবরি মসজিদ নিয়ে)।
২. যুক্তি-প্রমাণ নয়, হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাস, মিথ ও সংখ্যাগরিষ্ঠের আবেগের ওপর নির্ভর করে এ রায় দেয়া হয়।
৩. এ রায়টি সর্বাধিক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
এলাহাবাদ হাইকোর্টের লক্ষ্মৌ বেঞ্চ বাবরি মসজিদের যে বিতর্কিত রায় দেন সমালোচকগণ তাকে আধুনিক ‘রামায়ণের এলাহাবাদ সংস্করণ’ বলে মন্তব্য করেছেন। রায়টি যে ৮ হাযার ৫০০ পৃষ্ঠার এক মহাকাব্যিক কলেবর ধারণ করেছে তার জন্য নয়, একবিংশ শতাব্দীতে এসে এলাহাবাদ হাইকোর্টের দুই মহামান্য হিন্দু বিচারক নতুন করে যে রামায়ণ লিখলেন তা পাঠ করে মহর্ষী বাল্মীকিও হয়ত একটু মৃদু হাস্য করতেন। আমরা এলাহাবাদী রামায়ণ নয়, বরং বাল্মীকির রামায়ণের নায়ক রামচন্দ্রের জীবনী সংক্ষেপে উল্লেখ করে আলোচনার অবতারণা করতে চাই। কেননা আমাদের চিন্তাসূত্রের গ্রন্থি উন্মোচিত হ’তে শুরু করে যখন ভারতের বিশিষ্ট সাংবাদিক স্বপন দাশগুপ্ত বাবরি মসজিদের রায়ে তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় উল্লেখ করেন-
ভারতের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদদের দাবী, রামের জন্মভূমি আফগানিস্তানে বা অন্য কোথাও এবং বাবরি মসজিদের কাঠামো ফাঁকা পাথুরে জমিতে নির্মিত হয়েছে (প্রথম আলো, ২ অক্টোবর ২০১০)।
চিন্তার রাজ্যে আমাদের একটু হোঁচট খেতে হয়। কারণ ভারতীয় হিন্দুরা যে রামের জন্ম অযোধ্যায় বলে জিগির তুলছে সেখানে ঐতিহাসিকরা এমন কথা বললেন কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, রাম ছিলেন আর্য। পাঁচ হাযার বছর পূর্বে ভারতীয় উপমহাদেশে আর্যদের আগমন শুরু হয়। তারা ইরান ও আফগানিস্তান দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। এদেশে অনার্যদের (আদিবাসী) সঙ্গে আর্যদের সংঘর্ষ হয়। উন্নত ভাষা, সংস্কৃতি ও অস্ত্র দিয়ে তারা এদেশে রাজ্য বিস্তার করে অনার্যদের শাসন করে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রায় ২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে রামের পিতা রাজা দশরথ উত্তর ভারত দখল করেন। এজন্য রামকে আর্য পুত্র বলা হয়। আবার হিন্দুদের মতে, রামচন্দ্র হ’লেন, বিষ্ণুর সপ্তম অবতার। মহামুণি বাল্মীকি খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে আদর্শ চরিত্র রামচন্দ্রকে নিয়ে রামায়ণ রচনা করেন (বাংলাপিডিয়া, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত)।
গোদাবরী নদীর তীরে বসে বাল্মীকি রামায়ণের শোক রচনা করলেও রামচন্দ্রের জন্মস্থানের কোন উল্লেখ নেই সেখানে। পরিণত বয়সে রাম কিভাবে পিতৃ আদেশ শিরধার্য করে বনবাসে গেলেন সেই কাহিনী বর্ণিত হয়েছে রামায়ণে। এ সূত্রে বলা যায়, রামচন্দ্র একটি পৌরাণিক চরিত্র, ঐতিহাসিক নয়। অন্যদিকে সম্রাট বাবর ১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইবরাহীম লোদিকে পরাজিত করে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। বাবরের সে ঐতিহাসিক বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য সেনাপতি মীর বাকী ১৫২৮ খ্রিষ্টাব্দে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ নির্মাণ করেন। এ কারণে এ মসজিদটি ঐতিহাসিক স্থাপত্যের নিদর্শনও বটে। আদালত অযোধ্যাকে রামের জন্মস্থান হিসাবে নির্ধারণ করে যে রায় প্রদান করেছেন সে রায়কে সমালোচনা করে ভারতের স্বনামধন্য সাংবাদিক সিদ্ধার্থ ভারাদারাজন বলেন, ‘কবি তুলসীদাস তার ‘রামচরিতমানস’ (সংস্কৃত রামায়ণের হিন্দি অনুবাদ) লিখেছিলেন ষোল শতকে অযোধ্যায় বসে। কিন্তু রামের জন্মস্থান নিয়ে তিনি কিছু না বললেও ৫০০ বছর পরে আদালত সেই জন্মস্থানটি এত নিশ্চিত করেন কিভাবে?
এ একটি বিষয়ই আদালত আমলে নিলে বাবরি মসজিদের রায়টি অন্যরকম হ’তে পারত। আবার হিন্দুদের যে দাবী, ‘রামমন্দির ভেঙ্গে বাবরের সেনাপতি বাবরি মসজিদ নির্মাণ করেন’ সেটাও অসার প্রমাণিত হয়, যদিও আদালত এত কিছু বুঝতে চেষ্টা করেননি। সেনাপতি মীর বাকী যদি রামমন্দির ভেঙ্গে মসজিদ তৈরি করতেন, তাহ’লে সে বিষয়ে ইতিহাস নীরব কেন? তাছাড়া উক্ত স্থানে যদি রামের মন্দির থাকত তাহ’লে সে মন্দির কারা তৈরি করে বা কার আমলে তৈরি হয়েছিল তাও জানা যেত। মন্দির ধ্বংস করে মসজিদ তৈরি করলে সমসাময়িককালের হিন্দুদের মধ্যে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হওয়ার কথা এবং তৎকালের ঐতিহাসিকগণও মুঘলদের শাসন-ত্রাসনের বর্ণনায় এর উল্লেখ করতেন। সম্রাট বাবরের মত ধার্মিক ও বিজ্ঞ শাসকের পক্ষে কিভাবে মন্দির ভেঙ্গে মসজিদ তৈরির অনুমতি দেয়া সম্ভব হ’ল তা আমাদের বোধগম্য হয় না। বরং ভারতীয় হিন্দুরা-ই যে মুঘল শাসকদের বেশি পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছে সেটা ঐতিহাসিক সত্য। হাইকোর্টের কাছে ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগের রিপোর্ট ও রাডার সমীক্ষার যে সচিত্র প্রতিবেদন ছিল তাতে মন্দির থাকার কোন চিহ্নই পাওয়া যায়নি। যদিও ভারতের মত বৃহৎ রাষ্ট্রে প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে মানব সভ্যতার যে নিরন্তর ভাঙ্গাগড়া চলে এসেছে, একবিংশ শতাব্দীতে এসে তার হিসাব মেলানো সত্যি খুবই দুরূহ ব্যাপার। ইতিহাস যেখানে নীরব, সেখানে সাক্ষ্য প্রমাণ ও যুক্তিকে পাশ কাটিয়ে সম্প্রদায় বিশেষের প্রতি অযৌক্তিক পক্ষপাত প্রদর্শন করা আদালতের পক্ষে প্রাগৈতিহাসিক ঘটনা বৈ কিছু নয়।
বাবরি মসজিদের ট্রাজিক পরিণতি তখনই নিশ্চিত হয়ে যায় যখন এর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু হয়। গত শতকের ৮০ দশকে বিশ্বহিন্দু পরিষদ বিজেপি ও আরএসএস রামের জন্মস্থানকে মুক্ত করার জন্য রাজনৈতিকভাবে পদক্ষেপ নেয়। এটা তাদের পক্ষে সম্ভব, কারণ তারা নিজেদের কট্টর হিন্দুত্ববাদী বলে প্রমাণ করেছে। কিন্তু কংগ্রেসের ভূমিকা আমরা ঠিক মেলাতে পারি না। ১৯৯২ সালে মসজিদ ভাঙ্গার পূর্বে কংগ্রেসের মত ধর্মনিরপেক্ষ দলের প্রধান রাজীব গান্ধীর ভূমিকা এবং ভাঙ্গার সময় প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাওয়ের ভূমিকা কংগ্রেসের দর্শন সম্পর্কে আমাদের সন্দিহান করে তোলে। এবারের রায়েও যার ব্যতিক্রম হয়নি।
কংগ্রেস যে ধর্মনিরপেক্ষতার আবরণে হিন্দুত্ববাদকে প্রতিষ্ঠা করছে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কংগ্রেস শুধু চেয়েছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এড়িয়ে চলতে, তাই বিচারের নামে সালিশ করে একজনের সম্পত্তিতে অন্যদের শরীক বানিয়ে দিতে দ্বিধা করেননি। এ কারণে লেখিকা ও সমাজকর্মী অরুন্ধতি রায় এ রায়কে 'Political statement' বলে কঠোর সমালোচনা করেছেন।
এই রায়ের মধ্যে ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের প্রতিফলন ঘটেছে বলেও আমরা মনে করি। দ্বিজাতিতত্ত্বের নামে ভারত বিভাগ হ’লেও আসলে ভারত বিভক্ত হয়েছে সাম্প্রদায়িক সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে। মূলতঃ সেখানেই ২:১ থিউরির উৎপত্তি হয়, ভারত বিভাগের সকল দায় জিন্নাহর ঘাড়ে চাপানো হ’লেও তা প্রাপ্য অংশ থেকে তৎকালীন কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ অত্যন্ত সুকৌশলে বঞ্চিত করেন। বাংলা, পাঞ্জাব, কাশ্মীর, সিন্ধু প্রভৃতি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ হওয়া সত্ত্বেও আধাআধি ভাগ করে জন্ম দেয়া হয় এক দীর্ঘস্থায়ী রক্তক্ষয়ী বিবাদের। পুরো উপমহাদেশের ৩ ভাগের ২ ভাগের থেকেও বেশী কংগ্রেস এবং অবশিষ্ট ১ ভাগের থেকেও কম মুসলিম লীগের জন্য দেয়া হয়। বাবরি মসজিদের সেই বিভাগ কংগ্রেসের সে ২:১ থিউরিকে পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেয়।
এখন একই জমিতে দুই উপাসনালয় তৈরি করে কংগ্রেস যতই তাদের অসাম্প্রদায়িক মনোভাব প্রকাশ করুক না কেন তার মূলে যে ২:১ থিউরির মানসিকতা একেবারে নেই এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এটা আসলে দীর্ঘস্থায়ী সাম্প্রদায়িক বিবাদের একটা স্থায়ী ব্যবস্থা মাত্র। তাই জওহর লাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিবেদিত মেনন এ রায়ের সমালোচনায় বলেন,
"It is a 'second demolition' of The Babri Mosque. By accepting the claim that Ram was born at the Babri site, the judjes have don grane injustice to the original owners of the property. It has legitimised and justified the wanton destruction of a place of Muslim worship in secular India." (The Daily star, 8 October 2010).
সমালোচকগণের মতে, সংখ্যালঘু মুসলমানদের প্রতি সরকার ও হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর বৈরী মনোভাব ভারতের অগ্রগতির পথে প্রধান প্রতিবন্ধক। এ রায়ে প্রমাণিত হয়, ভারতের মুসলমানরা বহিরাগত এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। তাদের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা দেয়া ভারত সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। বস্ত্ততঃ মুসলমানদের পিছে ঠেলে দিয়ে ভারত নিজেই পিছিয়ে যাচ্ছে। ভারতের নৃতাত্ত্বিক ও ভাষাগত ইতিহাস পর্যালোচনাকালে প্রমাণিত হয়, আজ আর কেউ বহিরাগত নয় আজ সকলেই স্থানীয় ও ভারতীয়। পাঁচ হাযার বছর পূর্বে আর্যদের আগমনের মধ্য দিয়ে ভারতে বাহিরাগতদের আধিপত্য বিস্তারের যে লড়াই শুরু হয়েছিল, সে স্রোতে বৈদিক ব্রাহ্মণেরা যেমন এসেছেন, তেমনি মুসলমান ধর্ম প্রচারক, শাসকগণও এসেছেন। ক্রমান্বয়ে ইউরোপীয় বণিক বেশে এসেছে ইংরেজরা। ইংরেজরা না পারলেও হিন্দু-মুসলমানরা এদেশকে নিজেদের দেশ হিসাবে গ্রহণ করেছে। ফলে সরকারের মনে রাখা উচিত, মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির তৈরি করে ভারতের তেত্রিশ কোটি দেবতাকে (?) হয়ত সন্তুষ্ট করা যেতে পারে, কিন্তু তেত্রিশ জন জাগ্রত বিবেককেও সন্তুষ্ট করা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়।
তাই ভারত সরকারের উচিত সাম্প্রদায়িক অচলায়তন থেকে মুক্ত হয়ে হিন্দুত্ববাদী অপশক্তির হিংস্র থাবা থেকে বাবরি মসজিদের সম্পত্তিকে উদ্ধার করে বৈধ মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেয়া। সরকারের নিরপেক্ষরতা ও আন্তরিকতাই এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট হবে বলে আমরা মনে করি।
[সংকলিত]