[পাকিস্তানের
খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের যেলা মানসেহরা। এই
মানসেহরারই একটি তহসিল হ’ল ঐতিহাসিক বালাকোট শহর। উপমহাদেশের প্রথম
বৃটিশবিরোধী জিহাদ আন্দোলনের সর্বশেষ যুদ্ধক্ষেত্র হিসাবে বালাকোট উপত্যকা
এক অমর রক্তাক্ত স্মৃতি বহন করে চলেছে। বিশেষ করে বালাকোটের পর্বতময়
প্রান্তরে বৃটিশ-শিখবিরোধী জিহাদ আন্দোলনের দুই প্রাণপুরুষ বীর মুজাহিদ
সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রহঃ) এবং শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহঃ)-এর মর্মান্তিক
আত্মত্যাগের ইতিহাস উপমহাদেশের প্রতিটি ঈমানদারের হৃদয়কে প্রতিনিয়ত আলোড়িত
করে। কেবল তা-ই নয়, তাদের বিয়োগব্যথার অশ্রুবিন্দু অগ্নিশিখায় রূপান্তরিত
হয়ে আজও পর্যন্ত উপমহাদেশের প্রতিটি ইসলামী বিপ্লবকামী মুসলিমের বুকে
মরণজয়ী সংগ্রামের ক্ষীপ্র সলতে জ্বালিয়ে রেখেছে। গত ২৫.০৪.২০১৪ তারিখে
পাকিস্তানের ইসলামাবাদে অবস্থানরত ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’-এর সাবেক
গবেষণা সহকারী আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব ঐতিহাসিক এই শহরটি সফর করেন। এ সময়
তিনি বালাকোটে সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত আহলেহাদীছ মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম ও
খত্বীব এবং গত কয়েক দশকে বালাকোট অঞ্চলে আহলেহাদীছ আক্বীদার প্রচার ও
প্রসারে মূল ভূমিকা পালনকারী মাওলানা মুহাম্মাদ ছিদ্দীক মুযাফ্ফরাবাদীর
(৬২) সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। উর্দূ
ভাষায় গৃহীত মূল সাক্ষাৎকারটি ঈষৎ সংক্ষেপায়িত আকারে প্রকাশিত
হ’ল-সম্পাদক]
আত-তাহরীক : মুহতারাম আপনার প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে জানতে চাই।
মাওলানা মুহাম্মাদ ছিদ্দীক মুযাফ্ফরাবাদী : ধন্যবাদ, আমি মূলতঃ আযাদ কাশ্মীরের রাজধানী মুযাফ্ফরাবাদে জন্মগ্রহণ করি ১৯৫২ সালে। আমার পিতামহ হানাফী হ’লেও মাতামহ ছিলেন আহলেহাদীছ। ছোটবেলায় আমি বেড়ে উঠেছিলাম হানাফী হিসাবে। শৈশবে ও কৈশোরে স্কুলে পড়তাম। ফলে সে সময় দ্বীনী বিষয়ে তেমন ধারণা ছিল না। মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকে অধ্যয়নকালে সর্বপ্রথম দ্বীন সম্পর্কে এবং হানাফী-আহলেহাদীছ বিষয়ক দ্বন্দ্বগুলো জানার সুযোগ পাই। আত্মীয়-স্বজনদের কাছে যা কিছু শুনেছিলাম তাতে আহলেহাদীছ সম্পর্কে খুব খারাপ ধারণা জন্মেছিল। স্বভাবতঃই আহলেহাদীছদেরকে খুব ঘৃণার চোখে দেখতাম। মুযাফ্ফরাবাদে তখন অনেক আহলেহাদীছ পরিবার বসবাস করত। তাদের কিছু মসজিদও ছিল। কিন্তু তাদের সাথে কখনই মিশতাম না। একদিনের ঘটনা- এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়ে মিশকাত শরীফের অনুবাদ দেখে পড়ছিলাম। পড়তে পড়তে লক্ষ্য করলাম ছালাতের অধ্যায়ে বর্ণিত হাদীছগুলোর সাথে আহলেহাদীছদের আমলের মিল রয়েছে। বিষয়টি আমার মধ্যে প্রথম চিন্তার সূত্রপাত করল। আমার এক নিকটাত্মীয় দেওবন্দী আলেমের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলাম। কিন্তু তিনি অকস্মাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে আহলেহাদীছদেরকে এমন যাচ্ছেতাই ভাষায় গালি-গালাজ করতে লাগলেন যে, আমি তার আচরণে হতবাক হয়ে গেলাম। আমার মনে হ’ল এ বিষয়ে আমাকে আরো জানতে হবে। তখন থেকেই আমি আহলেহাদীছ আক্বীদা বিষয়ে একটু একটু করে জানতে শুরু করি। আল-হামদুলিল্লাহ যতই জানতে থাকি ততই সত্য আমার কাছে প্রকাশিত হ’তে থাকে। এক পর্যায়ে স্কুল ছেড়ে মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। চলে আসি রাওয়ালপিন্ডির ‘জামে‘আ সালাফিইয়াহ’ মাদরাসায় এবং এখানে টানা কয়েক বছর অধ্যয়নের পর ১৯৭৭ সালে দাওরায়ে হাদীছ সম্পন্ন করি।
আত-তাহরীক : আপনি বালাকোটে সর্বপ্রথম কখন এসেছিলেন? আপনার জন্ম মুযাফ্ফরাবাদে এবং পড়াশোনা রাওয়ালপিন্ডিতে, তাহ’লে বালাকোটে আসার যোগসূত্রটা কি ছিল?
মাওলানা মুযাফ্ফরাবাদী : রাওয়ালপিন্ডির ‘জামে‘আ সালাফিইয়াহ’ মাদরাসাটি মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছ কর্তৃক পরিচালিত হ’ত। আমি ফারেগ হওয়ার পর জমঈয়তের দায়িত্বশীল মিঞা নাঈমুর রহমান তাহের লাহোরীর পরামর্শে মারকাযী জমঈয়ত অফিস থেকে আমাকে বালাকোটে একটি আহলেহাদীছ মসজিদ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করতে বলা হয়। আমি তখন সদ্য লেখাপড়া শেষ করেছি ও নিজ এলাকায় প্রত্যাবর্তনের প্রস্ত্ততি নিচ্ছি। বালাকোটের মত এমন প্রত্যন্ত এলাকায় আসার জন্য মানসিকভাবে মোটেও প্রস্ত্তত ছিলাম না। কিন্তু দায়িত্বশীলদের নির্দেশে অনেকটা বাধ্য হয়ে এখানে আসলাম। এটা ছিল ১৯৭৭ সালের ঘটনা।
আত-তাহরীক : বালাকোটে এসে কিভাবে প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু করেছিলেন এবং মসজিদ নির্মাণের কাজটি কখন শুরু হয়?
মাওলানা মুযাফ্ফরাবাদী : বালাকোট বাজারের কেন্দ্রস্থলে মসজিদ নির্মাণের উদ্দেশ্যে এই জমিটি সর্বপ্রথম জমঈয়তের উদ্যোগে কেনা হয়েছিল ১৯৬২ সালে। গিলগিতের জনৈক আহলেহাদীছ ব্যক্তি গোলাম হায়দার নিজ অর্থে জমিটি ক্রয় করে দিয়েছিলেন। কিন্তু মসজিদ আবাদ করার মত কোন লোক এখানে ছিল না। খালি অবস্থায় জায়গাটি পড়ে ছিল প্রায় ১৫ বছর যাবৎ। ১৯৭৭ সালে বালাকোটে প্রথম আসার পর দেখলাম একেবারে শূন্য অবস্থা। অনেক খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারলাম মৌলভী ইদরীস (ক্বারী সাঈদের পিতা যিনি ২০০৫ সালের ভূমিকম্পে নিহত হন) নামের জনৈক বৃদ্ধ আছেন যিনি আহলেহাদীছ এবং জামায়াতে ইসলামীর রোকন। তিনি তখন কঠিন রোগে শয্যাশায়ী। আমি তাঁর বাড়িতে গেলাম এবং মসজিদ নির্মাণের জন্য পরামর্শ চাইলাম। একদিন তাঁকে অস্থায়ী বেড়া দিয়ে ঘেরা মসজিদে নিয়েও আসলাম। কিন্তু কোনও লাভ হ’ল না। উপরন্তু তিনি মসজিদ নির্মাণ পরিকল্পনার বিরোধিতা করে ওলট-পালট কিছু কথা শুনালেন। আহলেহাদীছের নামে মসজিদ বানালে এখানে ফেৎনা সৃষ্টি হবে-এটাই ছিল তাঁর মূল কথা। ফলে তাঁর দ্বারা বিশেষ কোন উপকার হ’ল না।
অনেকটা হতাশার মধ্যে সময় কাটতে লাগল। কোনরকমে মসজিদের ছোট্ট জায়গাটিতে একটা বেড়ার কাঠামো দাঁড় করিয়ে ওয়াক্তিয়া জামা‘আত শুরু করেছিলাম। প্রথম দিনগুলোর কথা আর কি বলব! নিজেই আযান দিতাম, তারপর অপেক্ষা করতাম কেউ আসে কি-না। কেউ যখন আসত না তখন নিজেই একামত দিয়ে ছালাত শুরু করতাম। তারপর ছালাত শেষ হওয়ার পরও দেখতাম আর কেউ আসেনি, আমি একাই মুছল্লী। এভাবেই গেছে প্রথম বেশ কিছুদিন। মাসখানিক যাওয়ার পর আস্তে আস্তে দু’একজন আসা শুরু হ’ল। তাদের সাথে আমি কে, কোথা থেকে এসেছি এমন প্রশেণর উত্তর দিতেই অনেক সময় চলে যেত। তারপর বাজারে কেনাকাটা করার সূত্রে কিছু মানুষের সাথে ঘনিষ্ঠতা হ’ল। তাদেরকে মসজিদে আসতে বলি। এভাবে মুছল্লীর সংখ্যাটা বেড়ে একসময় ৫/৬-এ উন্নীত হয়। আশ-পাশের দু’একটা বাচ্চাও ছালাতের জন্য আসত। তাদেরকে কুরআন শিখানোর জন্য মসজিদে মক্তব চালু করলাম। আমার পড়ানোর পদ্ধতির কারণে তারা বেশ আগ্রহের সাথে আসতে লাগল। একসময় তারা আমার প্রতি এত আকৃষ্ট হয়ে পড়ল যে, পিতামাতা তাদেরকে নিষেধ করলেও তারা ফাঁকি দিয়ে আমার এখানে আসত। এদের মধ্যেই আমি প্রথম আহলেহাদীছের দাওয়াত প্রচার শুরু করি। আল্লাহ সম্পর্কে, নবী সম্পর্কে তাদেরকে সঠিক আক্বীদা শিক্ষা দেই, ছালাতের সঠিক নিয়ম-কানূন শিখাই। তারা বাড়ী গিয়ে তাদের পিতা-মাতাকে সেসব বলত। এভাবে আস্তে আস্তে এলাকাবাসীর সাথে সুসম্পর্ক তৈরী হ’তে থাকল। আমার আচার-ব্যবহারেও তারা ছিল বেশ মুগ্ধ। কখনও কোন ব্যক্তি বা দলের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলতাম না। শুধুমাত্র মুসলমানদের সঠিক আক্বীদা ও আমল কি হওয়া উচিত এটুকুই বলতাম। সে কারণে এলাকার দেওবন্দী আলেমগণ নিজ নিজ মসজিদে আহলেহাদীছদের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী ভাষণ দেয়া শুরু করলেও আমার সামনাসামনি এসে বিরোধিতা করার সুযোগ পেতেন না। এমতবস্থায় একদিন সাহস করে জুম‘আর জামা‘আত চালু করলাম। মসজিদ একেবারে বাজারের মধ্যে হওয়ায় কিছু মুছল্লী ছালাতের সময় আসল। সব মিলিয়ে মুছল্লী হ’ল ২০ জনের মত। এভাবেই ১৯৭৭ সালের শেষের দিকে বালাকোটে প্রথম আহলেহাদীছ জুম‘আর জামা‘আত চালু করতে সক্ষম হ’লাম। ফালিল্লা-হিল হাম্দ।
আত-তাহরীক : মসজিদ নির্মাণে স্থানীয়রা কি বাধা দিয়েছিল? স্থানীয় আলেম-ওলামার ভূমিকা কি ছিল?
মাওলানা মুযাফ্ফরাবাদী : আসলে জায়গা আমাদের নিজস্ব কেনা ছিল বলে স্থানীয়দের পক্ষ থেকে সরাসরি বাধা তেমন আসেনি। তবে পার্শ্ববর্তী হানাফী মসজিদের ইমামরা খুৎবাতে লা-মাযহাবীদের বিরুদ্ধে স্বভাবসুলভ গালিগালাজ করতেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে কখনও তাদের আক্রমণের জবাব দেইনি। কারু বিরুদ্ধাচরণ না করে নিজের মতো যতটুকু সম্ভব মানুষকে হক্বের দাওয়াত দিয়ে যাব, এটাই ছিল আমার পরিকল্পনা। ফলে স্থানীয় আলেম-ওলামা বা সাধারণ মানুষের সাথে উচ্চ পর্যায়ের বিতর্ক বা বাহাছ-মুনাযারা এমন কিছু কোনদিন ঘটেনি। বরং মানুষজন আমাকে নম্র-ভদ্র ও সজ্জন হিসাবে বেশ শ্রদ্ধাই করত। বাচ্চাদের ক্রমাগত আসা-যাওয়া বৃদ্ধি পেতে থাকলে আমি মসজিদের সাথে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল খোলার পরিকল্পনা করি। তখনকার বিবেচনায় এমন পরিকল্পনা একেবারেই নতুন ছিল। এলাকার মানুষ তখন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল সম্পর্কে কোন ধারণাই রাখত না। এর মাধ্যমে আমার উদ্দেশ্য ছিল এলাকার মানুষের মাঝে আমার মসজিদের প্রতি আগ্রহ বাড়ানো। ১৯৮১ সালে মসজিদের পার্শ্বেই ছোট্ট স্কুলটি চালু করতে সক্ষম হই এবং বেশ কিছু ছাত্র ভর্তি হয়। এভাবে স্থানীয়দের সাথে আমার একটা ভাল সামাজিক যোগাযোগ তৈরী হয়। মসজিদের মুছল্লী ততদিনে বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত পরিবারও আহলেহাদীছের দাওয়াত কবুল করে বিশুদ্ধ আক্বীদা ও আমল করা শুরু করেছে। ফলে জুম‘আর দিন ছোট্ট মসজিদটায় আর সংকুলান হচ্ছিল না। সে কারণে রাস্তার সংলগ্ন বর্তমান স্থানটি কেনার জন্য প্রচেষ্টা শুরু করি। কিন্তু জমির মালিক কিছুতেই দিতে রাযী হ’ল না। এক পর্যায়ে জমির মালিক মৃত্যুবরণ করল। আমি তাঁর ছেলেদের কাছে গেলাম, তারাও রাযী হ’ল না। সে এক লম্বা কাহিনী। অবশেষে দীর্ঘ কয়েকবছর লাগাতার চেষ্টার পর ৮৩ বা ৮৪ সালের দিকে জমিটি কিনতে সক্ষম হই। সবমিলিয়ে এখানে প্রায় ৩ কানাল বা ৬০ মারলা (১ কানাল= ১ একরের ৮ ভাগের ১ ভাগ) জায়গা কেনা হয়। তারপর কেন্দ্রীয় জমঈয়তের কাছে আবেদন পাঠাই এখানে একটি বড় মসজিদের মঞ্জুরী দানের জন্য। শহরটির ঐতিহাসিক গুরুত্বের প্রতি নযর রেখে কেন্দ্রীয় জমঈয়ত থেকে দায়িত্বশীলবৃন্দ এখানে পরিদর্শনে আসেন এবং ইসলামাবাদের ফয়ছাল মসজিদের আদলে একটি সুদৃশ্য মসজিদ নিমার্ণের সিদ্ধান্ত নেন। অতঃপর ১৯৮৫ সালে মসজিদটির নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং বছরখানিকের মধ্যে শেষ হয়। চারপার্শ্বে চার মিনারওয়ালা তৃতলবিশিষ্ট মসজিদটি এতই দৃষ্টিনন্দন ছিল যে বালাকোটে আসা পর্যটকরা একে বিশেষ মসজিদ গণ্য করতে থাকে। অনেক দূর থেকে মসজিদটি দেখা যেত। বাজারের কেন্দ্রস্থলে হওয়ায় এই মসজিদটি স্থানীয়ভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। ছালাতে আহলেহাদীছ ছাড়াও বহু হানাফী আসত। জুম‘আর দিন মসজিদের ভিতর-বাহির মিলে প্রায় দুই-আড়াই হাযারের মত মুছল্লী হ’ত। এভাবে মসজিদের প্রসিদ্ধির সাথে সাথে আহলেহাদীছের দাওয়াতও প্রসার লাভ করতে থাকে। ফালিল্লা-হিল হামদ।
আত-তাহরীক : ২০০৫ সালে মসজিদটি যখন ধ্বংস হয়ে যায় সে সময়ের ঘটনাটি বলুন।
মাওলানা মুযাফ্ফরাবাদী : ২০০৫ সালের ৮ই অক্টোবরের সেই দিনটির ভয়াবহ স্মৃতি মনে পড়লে আজও শিউরে উঠি। সেদিন তো ভূমিকম্প হয়নি, যেন কিয়ামত হয়ে গিয়েছিল সমগ্র উপত্যকায়। সকাল সাড়ে ৮-টা বাজে। আমি তখন এই ঘরেই ছিলাম (আমরা যে ঘরের সামনে বারান্দায় বসেছিলাম সে স্থানটি নির্দেশ করে)। হঠাৎ তীব্র এক ঝাঁকুনী দিয়ে উপর থেকে ছাদ খসে পড়ল। আমি কিভাবে বেঁচে গেলাম বলতে পারি না। মাথায় এবং বুকে প্রচন্ড আঘাত পেয়েছিলাম। যদিও কোন ফ্রা্কচার হয়নি আল-হামদুলিল্লাহ। আমার ড্রাইভার, অফিস স্টাফ, মসজিদের ইমাম ও খাদেম প্রত্যেকেই প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল আল্লাহর খাছ রহমতে। বাইরে বের হয়ে দেখি উপত্যকার প্রতিটি প্রান্তে যেন প্রলয় ঘটে গেছে। যেদিকেই তাকাই কেবল ধ্বংসস্তূপ আর মানুষের চিৎকার-আর্তনাদ। আর আমার অন্তরাত্মায় জড়িয়ে থাকা তিনতলা বিশাল মসজিদটিও মাটির সাথে গুড়িয়ে গেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় কোন হুঁশ ছিল না। পাগলের মত একটানা ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া মানুষ উদ্ধারে সহায়তা করলাম। তারপর যখন যোহরের সময় হ’ল মসজিদে ফিরে আসলাম। কোন মুছল্লী নেই। একাই আযান দিয়ে একাই ছালাত আদায় করলাম। তখন কেবলই স্মরণ হচ্ছিল সেদিনটির কথা যেদিন একাকী এই মসজিদে প্রথম ছালাত শুরু করেছিলাম। ৩০ বছর পর মসজিদটি হঠাৎ চোখের পলকে সেই প্রথমদিনে ফিরে গেল। বেদনায় এমন মুষড়ে পড়েছিলাম যে, আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়ার অনুভূতিও ছিল না।
পরের টানা দু’দিন পর্যন্ত বাইরে কোথাও যোগাযোগের কোন সুযোগ ছিল না। রাস্তা-ঘাট সব ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। দু’দিন পর রাস্তা ঠিক হ’লে শত শত এ্যাম্বুলেন্স এবং উদ্ধারকারী ক্রেন শহরে প্রবেশ করে এবং মানুষ বাইরে যাওয়ার সুযোগ পায়। আমি সোজা মুযাফ্ফরাবাদে আমার বাড়ীতে যাই। তখনও জানতাম না বাড়িতে কেউ বেঁচে আছে কি-না। যাওয়ার পর দেখতে পাই আমার বাড়ীঘর ধ্বংস হয়ে গেলেও আল্লাহর অশেষ রহমত আমার পরিবারের সবাই রক্ষা পেয়েছে। কয়েকদিন পর আমি মুযাফ্ফরাবাদ থেকে ট্যাক্সিলার ওয়াহ কান্টনমেন্ট এরিয়ায় আমার বর্তমান আবাসস্থলে স্বপরিবারে হিজরত করে আসি।
ভূমিকম্পের সপ্তাহ দু্ই পর সরকারী অনুদানে টিনশেড দিয়ে মসজিদটি অস্থায়ীভাবে দাঁড় করাই। সেই থেকে মসজিদটি টিনশেডই রয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় জমঈয়তের কাছে একাধিকবার মসজিদটি পুনর্নির্মাণের আবেদন করে সাড়া পাইনি। অবশ্য আমি এতে বিচলিতও নই। কারণ আল্লাহর ঘর আল্লাহই নির্মাণ করিয়েছিলেন আমার হাত দিয়ে, আবার তিনিই ধ্বংস করেছেন। আল্লাহ চাইলে আবারও মসজিদটি কোন একদিন পুনর্নির্মিত হয়ে আগের অবস্থানে ফিরে আসবে ইনশাআল্লাহ। আমি না থাকলেও অন্য কারো হাতে নিশ্চয়ই হবে-এটাই কামনা করি সর্বদা।
আত-তাহরীক : আপনি স্থানীয়দের মধ্যে আহলেহাদীছের দাওয়াত প্রসারে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে আসছেন দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে। এই উপত্যকায় এর প্রভাবটা কতটুকু পড়েছে বলে মনে করেন?
মাওলানা মুযাফ্ফরাবাদী : কতটুকু প্রভাব পড়েছে সেটা ভিন্ন কথা। তবে একজন দাঈ হিসাবে সত্যি বলতে কি আমি সন্তুুষ্ট নই। আমি জানি অনেক পরিবার আমাদের দাওয়াতের ফলে বিশুদ্ধ আক্বীদা গ্রহণ করেছে ও কুরআন-হাদীছ ভিত্তিক আমল শুরু করেছে। ফালিল্লা-হিল হামদ। কিন্তু আমার বিশ্বাস, যদি সাংগঠনিকভাবে আমরা শক্তিশালী হ’তাম এবং দাওয়াতী কাজটা যথাযথভাবে করতে পারতাম, তবে এ এলাকার একটা মানুষও ভ্রান্ত আক্বীদার উপর থাকত না ইনশাআল্লাহ। কিন্তু সাংগঠনিক সমস্যার কারণে আমরা বেশ পিছিয়ে যাচ্ছি। আমি খুব কষ্ট পাই যখন দেখি আমাদের মধ্যে তুচ্ছ কারণে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশে গঠিত ‘মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছ’-এর কমিটিতে যথেষ্ট সমস্যা রয়েছে। এ কারণে আমি নিজেও কয়েকবছর ধরে সাংগঠনিক কাজে সক্রিয় নই। যদিও আমাকে জমঈয়তের কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য এবং আযাদ কাশ্মীর ও রাওয়ালপিন্ডির কমিটিতে নায়েবে আমীর হিসাবে দায়িত্ব দিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু কেপিকে’র কমিটি নিয়ে সমস্যাটি দূর না হওয়া পর্যন্ত সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় না থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আরেকটা সমস্যা হ’ল, নবাগত আহলেহাদীছরা তাক্বলীদের বিষয়টি নিয়ে প্রায়ই বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যায়। তাক্বলীদ বর্জনের মূলনীতি অনুধাবনে ব্যর্থ হওয়ায় তারা এতদূর পর্যন্ত চলে যায় যে হক্বপন্থী আলেম-ওলামাদের কাছে সঠিক বিষয়টি জানারও প্রয়োজন বোধ করে না। নিজেরাই পন্ডিত বনে যায় এবং মূর্খতাবশত কুরআন-হাদীছের অপব্যাখ্যা করে। ফলে তাদের মাধ্যমে বেশকিছু সমস্যা তৈরী হচ্ছে। তদুপরি সব মিলিয়ে বলব, প্রথম যেদিন এই অঞ্চলে এসেছিলাম, তখন আহলেহাদীছ কি জিনিস তা এ এলাকার মানুষ জানত না। কিন্তু বর্তমানে কেবল শহরের ভিতরেই প্রায় ৫০টি পরিবারের অনধিক ৩০০/৩৫০ সদস্য আহলেহাদীছ রয়েছে। রয়েছে ৩টি জামে মসজিদ, ফালিল্লা-হিল হামদ। তাই আহলেহাদীছরা কারা-সেটা নিয়ে মানুষের মাঝে এখন কোন সংশয় নেই। বর্তমানে এ অঞ্চলটি আহলেহাদীছের দাওয়াত প্রসারের জন্য খুবই উর্বর। এখানকার মানুষ ব্যক্তিগতভাবে খুবই সৎ, ধর্মপরায়ণ এবং শিক্ষা-দীক্ষায় যথেষ্ট অগ্রসর। দাওয়াতী কাজে আরেকটু সময় দিতে পারলে আমার বিশ্বাস খুব ভাল ফল পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ।
আত-তাহরীক : বৃটিশ বিরোধী জিহাদ আন্দোলনের অবিস্মরণীয় ইতিহাসের জ্বলন্ত সাক্ষী এই বালাকোট। স্থানীয় জনগণের মধ্যে সে ব্যাপারে কোন অনুভূতি কি কাজ করে? সেই আন্দোলনের কোন প্রভাব কি তাদের মাঝে পরিলক্ষিত হয়?
মাওলানা মুযাফ্ফরাবাদী : হ্যা, বালাকোট জিহাদ নিয়ে এই এলাকার মানুষের আবেগ খুবই সক্রিয়। এখানকার আবালবৃদ্ধবণিতা সাইয়েদ আহমাদ শহীদ এবং শাহ ইসমাঈল শহীদের প্রতি প্রবল ভক্তি পোষণ করে। বিশেষ করে তাঁদের শাহাদতের স্থান হিসাবে তারা এই বালাকোট উপত্যকাকে একটি পবিত্র ভূখন্ড বলে গণ্য করে। তবে সত্যিকার অর্থে এই আবেগ ও ভক্তির স্থানটা কেবল অন্তরেই, বাহ্যিক আমল-আক্বীদায় তার কোন প্রতিফলন নেই। বিশেষতঃ সাইয়েদ আহমাদ শহীদ এবং শাহ ইসমাঈল শহীদরা যে তাওহীদপন্থী এবং শিরক-বিদ‘আত প্রতিরোধী আন্দোলনেও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সে ব্যাপারে এলাকার সাধারণ মানুষ তো বটেই, আলেম-ওলামারাও বেখবর। আর সেজন্য ভূমিকম্পের আগ পর্যন্ত তাঁদের কবরগুলো পাকা করে তার উপর চাদর টানিয়ে একপ্রকার মাযারপূজাই চলে আসছিল। আমি নিজে বেশ কয়েকবার সে চাদর উঠিয়ে নিয়ে এসেছি এবং তাদের অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছি। কাজ হয়নি। তবে ভূমিকম্পের পর থেকে সে সব আয়োজন আর হয় না।
আত-তাহরীক : আরেকটি বিষয় স্রেফ কৌতূহলবশতঃ জানতে চাচ্ছি, আমরা ইতিহাসে দেখি সাইয়েদ আহমাদ শহীদ সাতবানে ঝরণার কাছে নিহত হবার পর তাঁর লাশের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি অথবা কোন বর্ণনায় পাওয়া যায়, তাঁর মস্তকবিহীন লাশের সন্ধান পেয়ে গ্রামবাসী কুনাহার নদীর পাশে দাফন করেছিল। আবার কোন বর্ণনায় তাঁর খন্ডিত মস্তকটি নদীতে পাওয়া গিয়েছিল এবং সেটিই কবরস্থ করা হয়েছিল বলে জানা যায়। তাহ’লে বর্তমানে কুনাহার ব্রীজের পার্শ্বে তাঁর যে কবরটি রয়েছে এ সম্পর্কে এলাকাবাসী বা আপনাদের ধারণা কি? তাঁর দাফন কি সত্যিই এখানে হয়েছিল?
মাওলানা মুযাফ্ফরাবাদী : এ বিষয়টি নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। তবে সাধারণভাবে ধারণা করা হয়, যুদ্ধের পর তাঁর দেহটি পাওয়া যায়নি, তবে তাঁর খন্ডিত মস্তকটি পাওয়া গিয়েছিল নদীতে এবং বর্তমান স্থানেই সেটি দাফন করা হয়েছিল। এ ধারণাটি আরো ভিত্তি পায়, যখন তাঁর সাথী মুজাহিদ ফযলে এলাহী ওয়াযীরাবাদী নিজের মৃত্যুর পর লাশটি এখানে সাইয়েদ আহমাদ শহীদের পার্শ্বে দাফন করার জন্য অছিয়ত করেছিলেন এবং তাঁকে এখানেই কবর দেয়া হয়েছিল।
তবে একবার আমার পরিচিত করাচীর এক প্রবীণ দেওবন্দী আলেম এখানে এসে সাইয়েদ আহমাদ শহীদ এবং শাহ ইসমাঈল শহীদের কবরের পার্শ্বে মুরাকাবায় বসেছিলেন। তিনি ফিরে যাওয়ার সময় আমাকে বলে গিয়েছিলেন, ‘আমি যখন শাহ ইসমাঈল শহীদের কবরের পার্শ্বে মুরাকাবায় বসেছিলাম, তখন কবর থেকে একটি আকাশমুখী নূর দেখেছিলাম। কিন্তু সাইয়েদ আহমাদ শহীদের কবরে অনুরূপ কিছু দেখিনি। আমার মনে হচ্ছে তাঁর দেহটি এই কবরে নেই’। যাহোক তাঁর বক্তব্য কোন উল্লেখযোগ্য সূত্রের মধ্যে পড়ে না। কেবল এটুকুই বলা যায়, তাঁর দেহ বা দেহাংশটি এখানেই দাফন করা হয়েছিল কি না সে বিষয়টি সুনিশ্চিত নয়। তবে শুরু থেকে এটিই তাঁর কবর হিসাবে প্রচলিত রয়েছে। মূল বিষয়টি আল্লাহই সর্বাধিক অবগত।
আত-তাহরীক : পরিশেষে জানতে চাইব, অত্র অঞ্চলে আহলেহাদীছ আন্দোলনের দাওয়াতের প্রসারে আপনাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
মাওলানা মুযাফ্ফরাবাদী : ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তো অনেক কিছুই। আপাততঃ এটুকু বলতে পারি এখানে সাংগঠনিক কার্যক্রমকে শক্তিশালী করাটা আমাদের প্রাথমিক দায়িত্ব। আর দ্বিতীয়তঃ এ এলাকায় আমাদের কোন প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। যা নতুন প্রজন্মের জন্য খুবই যরূরী হয়ে পড়েছে। ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েও আমরা শুরু করতে পারিনি। আর ভূমিকম্পের পর তো এখানকার স্বাভাবিক জীবনযাত্রাই থমকে গেছে। এখনও তার রেশ কেটে উঠেনি। এ অবস্থার মধ্যেও আশা আছে খুব শীঘ্রই আমরা এই উদ্যোগটি গ্রহণ করতে পারব ইনশাআল্লাহ।
আত-তাহরীক : আমাদেরকে দীর্ঘ সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, জাযাকুমুল্লাহু খায়রান।
মাওলানা মুযাফ্ফরাবাদী : আপনাকেও ধন্যবাদ। যখন রাওয়ালপিন্ডিতে পড়তাম তখন দু’একজন বাঙ্গালী সহপাঠী ছিল। তাদের নাম-ধাম এখন ভুলে গেছি। অনেকদিন পর আরেক বাঙ্গালী আহলেহাদীছ ভাইকে পেয়ে আমি খুব খুশী হ’লাম। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন এবং দ্বীনের পথে আমৃত্যু অটল রাখুন- আমীন!