[পাকিস্তানের
সমকালীন ইতিহাস গবেষকদের মধ্যে অন্যতম হলেন প্রবীণ ইতিহাসবিদ মাওলানা
ইসহাক ভাট্টি (৯০)। উপমহাদেশে ইসলামী জ্ঞানের প্রচার ও প্রসারের
বস্ত্তনিষ্ঠ ইতিহাস তুলে ধরার লক্ষ্যে তিনি প্রায় অর্ধশত বছর ধরে
নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে তাঁর লিখিত প্রায় ৪০টি গ্রন্থ
প্রকাশিত হয়েছে, যার অধিকাংশই ইতিহাস বিষয়ক। বিশেষতঃ উপমহাদেশের
আহলেহাদীছদের স্বর্ণালী ইতিহাস নিয়ে বিস্তর লেখালেখির মাধ্যমে তিনি এক
নবদিগন্তের উন্মোচন করেছেন। যার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি খ্যাতি লাভ করেছেন
‘মুআররেখে আহলেহাদীছ’ (مؤرخ اہلحديث) হিসাবে। গত ০৫.১২.২০১৪ইং পাকিস্থানে অবস্থানরত ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর সাবেক সাধারণ সম্পাদক আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
লাহোর সফরে গিয়ে মাওলানা ইসহাক ভাট্টির সাথে তাঁর বাসভবনে সৌজন্য সাক্ষাৎ
করেন এবং একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। সাক্ষাৎকারটি পাঠকদের খেদমতে উর্দূ
থেকে অনূদিত হল। মাওলানার পরামর্শে ফয়ছালাবাদ থেকে প্রকাশিত ‘ইলম ওয়া
আগাহী’ পত্রিকায় (জুলাই-সেপ্টেম্বর’১০ সংখ্যা) প্রকাশিত মাওলানার অপর একটি
সাক্ষাৎকারের সাথে এটি সমন্বয় করা হয়েছে।-সম্পাদক]
আত-তাহরীক : মুহতারাম আপনার জন্ম, শৈশব ও শিক্ষাজীবন সম্পর্কেঁ জানতে চাই।
মাওলানা ইসহাক ভাট্টি : ১৯২৫ সালের ১৫ই মার্চ পূর্ব পাঞ্জাবের পাতিয়ালা যেলায় নানার বাড়ীতে আমার জন্ম। বড় হই দাদার বাড়ী ফরিদকোট যেলার কোটকাপুরায়। আমাদের বংশে জ্ঞানচর্চার সাথে কেউ যুক্ত ছিল না। কৃষি এবং ব্যবসাই ছিল পূর্বপুরুষদের প্রধান কাজ। ফলে আমার ছেলেবেলা কেটেছে গ্রামের আর দশজনের মত খুব সাধারণভাবে। তবে সেই যামানায় ছোট বাচ্চাদেরকে মৌলভী রহীম বখশের লেখা ১৪ খন্ডে রচিত ‘ইসলাম কি কিতাব’ নামক একটি বই পড়ানো হ’ত। আমার দাদা এই বইটির প্রথম পাঁচ খন্ড আমাকে পড়িয়েছিলেন, যাতে দ্বীনী মাসায়েল সহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনা ছিল।
আত-তাহরীক : দ্বীনী জ্ঞানার্জন শুরু করেছিলেন কখন?
মাওলানা ভাট্টি : শৈশবে যখন গ্রামের পাঠশালায় টুকটাক যাতায়াত শুরু করেছি, তখন কোটকাপুরায় মাওলানা আতাউল্লাহ হানীফ ভুজিয়ানী (১৯০৮-১৯৮৭ইং) আগমন করেন। তিনি স্থানীয় মসজিদে খুৎবা দেয়ার সাথে সাথে দারস ও তাদরীসের কাজ আঞ্জাম দিতেন। আমি তাঁর এই ইলমী হালকায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করতাম। তিনি আমাদেরকে কুরআনের তরজমাও পড়াতেন। ১৯৩৬ সালের শেষাবধি এই ধারাবাহিকতা জারি ছিল। ১৯৩৭ সালে মাওলানা মুহাম্মাদ আলী লাক্ষাভী (মাওলানা মহিউদ্দীন লাক্ষাভী এবং মাওলানা মঈনুদ্দীন লাক্ষাভী-এর পিতা) ফিরোযপুর যেলার লাক্ষোকী’তে ‘মারকাযুল ইসলাম’ নামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন এবং মাওলানা ভূজিয়ানীকে সেখানে শিক্ষকতার জন্য আমন্ত্রণ জানান। মাওলানা ভূজিয়ানী সেখানে ১ বছর শিক্ষকতা করার পর ফিরোযপুর চলে যান। আমিও তাঁর সাথে ফিরোযপুরে গমন করি এবং টানা তিন বছর তাঁর সাহচর্যে থেকে বিভিন্ন কিতাব অধ্যয়ন করি। ১৯৪০ সালে আমি গুজরানওয়ালায় হাফেয মুহাম্মাদ গোন্দলভী এবং মাওলানা ইসমাঈল সালাফী’র খেদমতে উপস্থিত হই এবং তাঁদের কাছে প্রচলিত নিছাবের শেষ কিতাবগুলো পড়ি। আমার আনুষ্ঠানিক পড়াশোনা ছিল এ পর্যন্তই।
আত-তাহরীক : কর্মজীবন শুরু করেছিলেন কোথায়?
মাওলানা ইসহাক ভাট্টি : কর্মজীবনের শুরুতে ওকাড়া যেলার হেড সুলায়মানকি পানি উন্নয়ন বিভাগে একজন সাধারণ ক্লার্ক হিসাবে চাকুরী শুরু করি ২৫ রুপি বেতনে। এটাই ছিল আমার প্রথম চাকুরী। ৮/১০ মাস সেখানে কাজ করার পর চাকুরী ছেড়ে হিন্দুস্তানের বিভিন্ন শহরে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাঘুরি করি। দিল্লী এবং আগ্রাতেও কিছুকাল ছিলাম। একটি বেকার সময় অতিবাহিত করছিলাম তখন। অতঃপর ১৯৪৩ সালের এপ্রিলে মাওলানা মুঈনুদ্দীন লাক্ষাভী আমাকে ‘মারকাযুল ইসলাম’-এ আসার জন্য আহবান জানান। আমি সেখানে শিক্ষকতা শুরু করি এবং ১৯৪৭-এর জুলাই পর্যন্ত এই দায়িত্বে নিয়োজিত থাকি।
আত-তাহরীক : রাজনৈতিক কর্মকান্ডে কিভাবে জড়িত হয়েছিলেন?
মাওলানা ভাট্টি : ছোট থেকেই ইতিহাস এবং রাজনীতি বিষয়ক গ্রন্থ পাঠ করতাম খুব আগ্রহসহকারে। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ আন্দোলন, হিন্দুস্তানের ওয়াহহাবী আন্দোলনের ইতিহাস পড়তে পড়তে মুসলমানদের উপর ইংরেজদের অত্যাচার-অবিচার সম্পর্কে বিস্তর ধারণা আসে। স্বভাবতঃই মনে মনে ইংরেজদের প্রতি তীব্র ক্ষোভ তৈরী হয়। সেই থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়া। বেশ কিছুদিন জেলও খাটতে হয়েছিল এই কারণে।
১৯৪৫ সালের জুনে পাঞ্জাবের ৮টি প্রসিদ্ধ শহরে ‘প্রজামন্ডল’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন হয়। আমার যেলা ফরিদকোটে ‘প্রজামন্ডলে’র সভাপতি ছিলেন জ্ঞানী জৈল সিং, যিনি পরবর্তীকালে ভারতের ৭ম প্রেসিডেন্ট (১৯৮২-১৯৮৭ইং) হয়েছিলেন। আর আমি ছিলাম জেনারেল সেক্রেটারী। রাজনৈতিক দাবী-দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে আমরা আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু করলে ইংরেজ সরকার একসাথে আমাদের ১৩ জনকে আটক করে। যাদের মধ্যে ৪ জন মুসলমান, ৭ জন শিখ এবং ২ জন হিন্দু ছিলেন। জেলে খুব সংকীর্ণ কক্ষে আমাদের আটকে রাখা হয়। কারো সঙ্গে কারোর দেখা করার সুযোগ ছিল না। এমতাবস্থায় বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হয়। অতঃপর পাঞ্জাব প্রদেশের কংগ্রেস সভাপতি ড. সাইফুদ্দীন কিচলু আমাদের সাথে দেখা করতে আসেন এবং সার্বিক খবরাখবর নেন। এর কয়েকদিনের মধ্যে আমাদেরকে মুক্তি দেয়া হয়। মুক্তির পর বাথিনডা রেলওয়ে স্টেশনে উপস্থিত হ’লে পন্ডিত জওহর লাল নেহেরুর সাথে আমাদের সাক্ষাৎ হয়। এটা ছিল ১৯৪৬ সালের জুন মাসের ঘটনা।
আত-তাহরীক : মাওলানা আবুল কালাম আযাদের সাথে আপনার সাক্ষাতের ঘটনাটি বলুন।
মাওলানা ভাট্টি : মাওলানা আবুল কালাম আযাদ ‘কাওলে ফায়ছাল আওর তাযকিরা’ বইটি আমি ছোট থাকতেই পড়েছিলাম। পরে তাঁর সম্পাদিত ‘আল হেলাল’ ও ‘আল-বালাগ’ পত্রিকার কয়েকটি সংখ্যা পড়ার পর তাঁর প্রতি বিশেষভাবে দুর্বল হয়ে পড়ি। ১৯৩৯ সালে লাহোরে এক সম্মেলনে প্রথম তাঁকে সরাসরি দেখার সুযোগ হয়। মাওলানা দাউদ গযনভীর সভাপতিত্বে আয়োজিত সেই বিশাল জনসমাবেশে ৩৫ মিনিট বক্তব্য রেখেছিলেন মাওলানা আবুল কালাম আযাদ। তাঁর বক্তব্য এমন হৃদয়স্পর্শী ছিল যে, মানুষ পিনপতন নীরবতায় বক্তব্য শুনছিল। সরাসরি তাঁর বক্তব্য শোনার অভিজ্ঞতা আমার ওটাই ছিল প্রথম এবং শেষ। তাঁর বক্তব্যে সেদিন এত প্রভাবিত হয়েছিলাম যে, তাঁর কথাগুলো আমার মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। কত মানুষকে যে পরে তা শুনিয়েছি এবং পত্রিকাতেও লিখেছি। আজও যেন তা কানে লেগে আছে।
৮ বছর পর ১৯৪৭ সালের ২২ জুন তাঁর সাথে আবার সাক্ষাৎ হয়। তখন তিনি হিন্দুস্তানের অন্তবর্তীকালীন সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। দিল্লীতে তাঁর সরকারী বাসায় আমরা চারজন সাক্ষাৎ করি। মাওলানা মঈনুদ্দীন লাক্ষাভী, কাযী ওবায়দুল্লাহ, মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুহু আল-ফাল্লাহ এবং আমি। ভোর সোয়া পাঁচটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত তাঁর সাথে আমাদের কথাবার্তা হয়। তিনি ভারতের স্বাধীনতা, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা এবং ভারতবিভাগের ফলে মুসলমানদের উপর আসন্ন বিপর্যয় সম্পর্কে তাঁর মতামত ব্যক্ত করলেন। তিনি খুব স্পষ্টভাষী ছিলেন এবং উন্নত শব্দচয়নে চমৎকারভাবে কথা বলতেন। সামনাসামনি তাঁর মুখ থেকে নির্গত প্রতিটি কথা শোনার পর মনে হচ্ছিল যেন সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে ইলহাম হচ্ছে। সত্যিই তাঁর মত একাধারে বড় আলেম এবং প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিন্দুস্তানে আর জন্ম নেয়নি। তিনি সেদিন বলছিলেন যে, ‘আমি লিয়াকত আলী খানকে বলেছিলাম, পাঞ্জাব এবং বাংলা ভাগের দাবী যেন মেনে নিয়ো না। বরং গোটা বাংলা এবং আসামের দাবীতে অটল থাক। কেননা সামগ্রিকভাবে দু’টি অঞ্চলই ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। লিয়াকত আলী খান সেটা নিজে মেনে নিলেও অন্যদেরকে মানাতে পারেনি’।
১৯৪৭ সালের ১২ই আগস্ট আমি এবং কাযী উবায়দুল্লাহ ছাহেব আবার যাই দিল্লীতে। দেশভাগ তখন অত্যাসন্ন। মাওলানা ছিলেন খুব হতাশ। ভারতের মুসলমানদের পরিণতি নিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করলেন। মিনিট বিশেকের মত কথা হল তাঁর সাথে সেদিন। ঐ দিনই সর্দার প্যাটেলের সাথেও আমরা দেখা করি। তিনি বললেন, দেশভাগের ব্যাপারে কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত তিনি ঐ দিন রাত ৮টায় দিল্লীর রামলীলা ময়দানের জনসভায় ঘোষণা করবেন। আমাদেরকে সেখানে আসতে বললেন। পরে আমরা আর যাইনি।
আব্দুর রব নিশতার ছাহেব তখন মুসলীম লীগের পক্ষ থেকে অন্তর্বতীকালীন সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। তাঁর সাথেও সেদিন দেখা করি এবং আমার যেলা ফরিদকোটে অবস্থানরত মুসলমানদের বিষয়ে করণীয় আলোচনা করি। তিনি বললেন, ‘দেশভাগের পরিকল্পনা চূড়ান্ত। আমি কাল করাচী যাচ্ছি পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণের জন্য। সারা দেশের অবস্থা সংকটাপন্ন হতে যাচ্ছে। দো‘আ করুন যেন পরিস্থিতি শিগগিরই স্বাভাবিক হয়ে আসে।’ আমরা তাঁর পরামর্শে পরদিন সন্ধ্যায় নিজ শহর কোটকাপুরার উদ্দেশ্যে রওনা হই। দিল্লী থেকে লাহোরগামী ‘বোম্বাই এক্সপ্রেস’ ট্রেনে চড়ে যাত্রা করেছিলাম। এটাই ছিল দিল্লী থেকে লাহোরগামী সর্বশেষ ট্রেন। তারপর দাঙ্গা-হাঙ্গামা ব্যাপকভাবে শুরু হয়ে গেল এবং আনুষ্ঠানিকভাবে দেশবিভাগের ঘোষণা আসল। কিছুদিন পর আমরা সপরিবারে পূর্ব পাঞ্জাব থেকে হিজরত করে পশ্চিম পাঞ্জাব তথা নবগঠিত পাকিস্তানের ফয়ছালাবাদে চলে আসি। এরপর ১৯৪৮ সালের ২৪ জুলাই আমাকে ‘মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছ পশ্চিম পাকিস্তান’-এর অফিস সেক্রেটারী হিসাবে মনোনীত করা হয় এবং আমি লাহোরে চলে আসি। জমঈয়তের সভাপতি এবং নাযেমে আ‘লা মনোনীত হন যথাক্রমে মাওলানা সাইয়েদ মুহাম্মাদ দাউদ গযনভী (রহ.) এবং প্রফেসর আব্দুল কাইয়ুম (রহ.)।
আত-তাহরীক : লেখালেখির জগতে কখন পদার্পণ করলেন?
মাওলানা ভাট্টি : ১৯৪৯ সালের আগস্ট মাসে গুজরানওয়ালা থেকে ‘মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছ’-এর মুখপত্র ‘আল-ই‘তিছাম’-এর যাত্রা শুরু হয়। সম্পাদক ছিলেন মাওলানা হানীফ নদভী (রহঃ)। আর আমাকে করা হয় সহকারী সম্পাদক। ১৯৫১ সালের মে মাসে মাওলানা হানীফ নদভী (রহঃ) লাহোরে সরকারী সংস্থা ‘ইদারায়ে ছাক্বাফাতে ইসলামিয়া’তে যোগদান করলেন। ফলে ‘আল-ই‘তিছাম’ সম্পাদনার দায়িত্ব আমার কাঁধে অর্পিত হয়। দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর আমি এই দায়িত্বে নিয়োজিত থাকি। ১৯৬৫-এর মে মাসে আভ্যন্তরীণ কিছু কারণে আমি এই দায়িত্ব থেকে ইস্তোফা দেই। অতঃপর ঐ সালেরই অক্টোবরে ‘ইদারায়ে ছাক্বাফাতে ইসলামিয়া’-এর রিসার্চ ফেলো হিসাবে যোগদান করি। সেই থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ টানা ৩২ বছর এই ইদারাতেই আমার যিন্দেগী অতিবাহিত হয় এবং গোটা সময়টা নিরবচ্ছিন্নভাবে লেখালেখির মধ্যে ডুবে থাকি। শেষের দিকে কিছুদিন এই ইদারা থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘আল-মা‘আরিফ’ পত্রিকার সম্পাদক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছি। ইদারা’য় থাকাকালীন চাকুরীর অংশ হিসাবে বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্পে অংশ নিয়েছিলাম। তবে চাকুরী থেকে অবসর নেয়ার পর আমি স্বাধীনভাবে লেখালেখি শুরু করি এবং খালেছভাবে আহলেহাদীছদের ইতিহাস লেখা শুরু করি। অদ্যাবধি এই ধারা চলমান রয়েছে। এ পর্যন্ত আমার রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ৪০-এর উপরে। এছাড়া পত্র-পত্রিকায় বহু প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত উর্দূ এনসাইক্লোপেডিয়াতে আমার লিখিত প্রায় ৪০টি নিবন্ধ সন্নিবেশিত হয়েছে। বিশেষ করে কুরআন সম্পর্কিত যাবতীয় ভুক্তি আমারই লেখা।
আত-তাহরীক : রেডিও-টেলিভিশনেও আপনি অনেকদিন কাজ করেছেন। সেই অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কিছু বলুন।
মাওলানা ভাট্টি : হ্যঁা, ১৯৬৫ সাল থেকেই আমি রেডিও পাকিস্তানে ধারাবাহিক ধর্মীয় আলোচনা শুরু করি। তারপর দীর্ঘ ৩৪ বছর যাবৎ রেডিওতে নানা প্রোগ্রাম করেছি। মাওলানা সুলায়মান মানছূরপুরীর ‘রহমাতুল্লিল আলামীন’-এর সারাংশ, ‘হাদীছ আওর আসমায়ে রিজাল’ ইত্যাদি প্রোগ্রামগুলো বেশ প্রসিদ্ধি লাভ করে। এছাড়া ‘যিন্দা ও তাবিন্দাহ’ শিরোনামে একটি প্রোগ্রাম করতাম যেখানে অনেক আহলেহাদীছ ওলামায়ে কেরাম যেমন মাওলানা আব্দুল্লাহ গযনভী, মাওলানা দাউদ গযনভী, মাওলানা আব্দুল্লাহ রৌপড়ী, মাওলানা ইসমাঈল সালাফী প্রমুখের জীবনী আলোচনা করেছিলাম। মাওলানা আতাউল্লাহ হানীফ ভূজিয়ানী (রহ.) এই প্রোগ্রামটি নিয়মিত শুনতেন যদিও তিনি ‘রেডিও’ ঘরে রাখার ঘোর বিরোধী ছিলেন। ১৯৭২ সাল থেকে টেলিভিশনেও বিভিন্ন আলোচনা প্রোগ্রামে অংশ নেয়া শুরু করি। তারপর একটা সময় আসে যখন রেডিও, টেলিভিশন উভয় থেকেই আমি নিজেকে গুটিয়ে নেই।
আত-তাহরীক : সাধারণতঃ দেখা যায় ফারেগ হওয়ার পর আলেম-ওলামাগণ মাদরাসায় পাঠদান কিংবা বক্তব্যের ময়দানে যুক্ত হন। কিন্তু আপনি যুক্ত হলেন লেখালেখিতে। এর পিছনে কি কারণ ছিল?
মাওলানা ভাট্টি : লেখালেখির ইচ্ছাটা ছোট থেকে কিছুটা ছিল, যেহেতু আমি পড়তে ভালবাসতাম। তবে এ নিয়ে কোন পূর্বপরিকল্পনা ছিল না। দেশবিভাগের পূর্বে আমি শিক্ষকতাই করতাম, বক্তব্যও দিতাম কখনও। লেখালেখির কোন সুযোগ হয় নি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর যখন ‘আল-ইতিছাম’ পত্রিকার দায়িত্বে আসলাম, তখন পেশাগতভাবে লেখালেখির সুযোগ আসল। মাওলানা হানীফ নদভী (রহ.) এ সময় আমার পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। তাঁর কাছে আমি অনেক কিছু শিখেছি। তবে ‘আল-ই‘তিছাম’-এ আমার লেখাগুলো ছিল সাংবাদিকতার মত। কেননা তাতে মূলতঃ রাজনৈতিক কলাম, দ্বীনী বিতর্ক, সমালোচনা-পর্যালোচনা ইত্যাদি নানা ধাঁচের কলাম লিখতে হত। পরে ‘ইদারায়ে ছাক্বাফাতে ইসলামিয়া’তে আসার পর মৌলিক ও তাহকীকী রচনায় হাত দেই। লেখালেখির জগতে পরিপূর্ণভাবে যুক্ত হয়ে পড়ি মূলতঃ তখন থেকেই। যতটুকু অর্জন করেছি তাতে আমার নিজস্ব কোন কৃতিত্ব নেই। এটা আল্লাহর একান্ত ফযল ও করম এবং আমার আসাতিযায়ে কেরামের উত্তম তারবিয়াতের ফসল।
আত-তাহরীক : ৪৭-এর দেশ বিভাগ আপনার চোখের সামনেই হয়েছে। কংগ্রেসের রাজনীতিতে যুক্ত থাকায় আপনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পক্ষে ছিলেন না। সে সময়কার পরিস্থিতিটা একটু ব্যাখ্যা করবেন?
মাওলানা ভাট্টি : হ্যঁা, তৎকালীন পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশভাগের বিরুদ্ধেই ছিল আমার অবস্থান। কেননা আমরা ভেবেছিলাম এতে মুসলমানদের লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশী হবে। মুসলমানরা বিভক্ত হয়ে পড়বে। অপরদিকে ভারতে বসবাসরত মুসলমানরা হিন্দুদের অধীনস্ত হয়ে পড়বে। কিন্তু শেষদিকে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ এত চরমে ওঠে যে একত্রিত থাকার আর কোন অবস্থা ছিল না। স্বয়ং কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটি ১৯৪৭ সালের ৩রা জুন দেশভাগের প্রস্তাব অনুমোদন করে। কিন্তু যেভাবে দেশবিভাগ কার্যকর হয়েছিল এবং একে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলমান অধিবাসীদের মধ্যে যে পরিমাণ রক্তপাত ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা সংঘটিত হয়েছিল, তা ছিল খুব বিপর্যকর। এতে ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হয়েছিল বেশীরভাগই মুসলমানরা। দুঃখের বিষয় হল, সেই খুন-খারাবী ও বিশৃংখলার ধারাবাহিকতা আজও পর্যন্ত পাকিস্তানের পিছু ছাড়ে নি। অথচ এটা হওয়ার কথা ছিল না।
আত-তাহরীক : আপনার ঐতিহাসিক রচনাবলীর বড় অংশই হল মনীষীদের জীবনীমূলক। এই ধারাটি কেন বেছে নিলেন?
মাওলানা ভাট্টি : মনীষীদের জীবনী রচনার ধারাটি মূলতঃ শুরু করেছিলাম ১৯৮২ সাল থেকে। ইদারায়ে ছাক্বাফাতে ইসলামিয়ার বিশিষ্ট গবেষক মাওলানা শাহ মুহাম্মাদ জা‘ফর ফালওয়ারাভী মৃত্যুবরণ করার পর আমি তাঁর জীবনী রচনা করি। ‘আল-মা‘আরিফ’ পত্রিকায় সেটি ছাপা হলে তা ইদারার পরিচালক প্রফেসর মুহাম্মাদ সাঈদ শেখের নযরে আসে। তিনি লেখাটির উচ্চ প্রশংসা করেন। এতে আমি উৎসাহিত হই। এরপর মাওলানা আব্দুল্লাহ লায়ালপুরী মৃত্যুবরণ করলে তাঁর জীবনীর উপরও একটি প্রবন্ধ লিখি ‘আল-মা‘আরিফ’ পত্রিকায়। সেটি পড়ার পর প্রসিদ্ধ সাংবাদিক জনাব আব্দুল্লাহ মালেক আমার কাছে দীর্ঘ পত্র লেখেন এবং তাতে উল্লেখ করেন যে, আপনি প্রবন্ধটি যেভাবে লিখেছেন তাতে আমি এত প্রভাবিত হয়েছি যে, আমার চোখে পানি চলে এসেছিল। জনাব আব্দুল্লাহ মালেক ছাহেব সম্পর্কে আরেকটু না বললেই নয় যে, তিনি ছিলেন লাহোরের চিনাওয়ালী আহলেহাদীছ জামে মসজিদের একজন ট্রাস্টি। পরে তিনি হঠাৎ কম্যুনিজমে দীক্ষিত হন। তিনি মাওলানা আহমাদ আলী লাহোরীর উপর একটি বই লিখেছেন। বেশকিছু রাজনৈতিক গ্রন্থও লিখেছেন। ‘পাকিস্তান টাইমস’ এবং ‘এমরোয’ পত্রিকার সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন তিনি। সস্ত্রীক একবার তিনি হজ্জও করেন এবং ফিরে এসে রচনা করেন ‘একজন কম্যুনিস্টের হজ্জ্বের দিনলিপি’।
১৯৮৪ সালের জুলাই মাসে ইদারায়ে ছাক্বাফাতে ইসলামিয়া’র উদ্যোগে মাওলানা হানীফ নদভী (রহ.)-এর জীবন ও কর্ম নিয়ে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং ওলামায়ে কেরাম প্রবন্ধ পাঠ করেন। আমি নিজেও একটি ছোটখাটো প্রবন্ধ লিখি এবং সেমিনারে পাঠ করি। শিরোনাম ছিল ‘মাওলানা মুহাম্মাদ হানীফ নদভী (রহ.) ওয়াকে‘আত ওয়া লাতায়েফ কি আয়েনে মে’। অনুষ্ঠানে তৎকালীন ফেডারেল শিক্ষামন্ত্রী ড. মুহাম্মাদ আফযাল উপস্থিত ছিলেন। আমি প্রবন্ধটি পাঠ করার পর উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্যে খুব সাড়া পড়ে যায়। পরবর্তীতে অনেকে চিঠি লিখে প্রবন্ধটির প্রশংসা করেন। উক্ত অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের মাশহূর সাংবাদিক মুজীবুর রহমান শামীও উপস্থিত ছিলেন। তিনি তাঁর সম্পাদিত ‘কওমী ডাইজেস্ট’ পত্রিকায় লেখার জন্য আমাকে দাওয়াত দিলেন। আমি সেই পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে কয়েকজন মনীষীর জীবনী লিখেছিলাম। এভাবেই আমার জীবনী রচনার ধারাটি গড়ে ওঠে। আজও পর্যন্ত তা অব্যাহত রেখেছি।
আত-তাহরীক : বর্তমানে কি বিষয়ে লিখছেন?
মাওলানা ইসহাক ভাট্টি : বর্তমানে ‘চামানিস্তানে হাদীছ’ এবং ‘বুস্তানে হাদীছ’ নামে দু’টি গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পথে রয়েছে। আর লাক্ষাভী ওলামায়ে হাদীছের উপর একটি বই লিখছি এখন। আল্লাহ চাহেন তো খুব শিগগীরই তা সমাপ্ত হবে।
আত-তাহরীক : লেখালেখির জীবনে ঘটে যাওয়া কোন স্মরণীয় ঘটনার কথা বলবেন কি?
মাওলানা ভাট্টি : বিগত ৬০ বছরের লেখালেখির জীবনে স্মরণীয় অনেক ঘটনাই তো রয়েছে। দু’একটি বলি। ২০০৩ সালের ঘটনা। আমি ‘তাযকিরায়ে ছূফী মুহাম্মাদ’ নামে একটি বই লিখেছিলাম। ছূফী মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ ছিলেন জামা‘আতে মুজাহিদীনের আমীর। ১৯২২ সালের দিকে তিনি বর্তমান ফয়ছালাবাদ যেলার উডাওয়ালাতে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এর প্রায় ৪০ বছর পর তিনি ১৯৬৩ সালে মামূকাঞ্জনে ‘দারুল উলূম’ নামে ভিন্ন একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি অত্যন্ত মুত্তাকী পরহেযগার মানুষ ছিলেন এবং তাঁকে মুস্তাজাবুদ দা‘ওয়াহ বলা হ’ত। মাওলানা ছূফী আয়েশ মুহাম্মাদ সহ অন্যান্য বন্ধুদের অনুরোধে আমি তাঁর উপর সাড়ে তিন’শ পৃষ্ঠার একটি বই রচনা করি। লেখা শেষ করার পর চিন্তা করলাম বইটি ছাপানোর পূর্বে মাওলানা আব্দুল কাদের নদভীকে (তিনি ছূফী ছাহেবের খুব নিকটের মানুষ ছিলেন এবং বর্তমানে তিনিই তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদরাসার পরিচালক) বইটি একবার দেখিয়ে নিতে হবে। কিছু কম-বেশী করার দরকার হ’লে তাঁর পরামর্শ মোতাবেক করে নেব। সেই মোতাবেক উনার সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করি এবং ৭ই মে ২০০৩ আমি নিজে ফয়ছালাবাদে তাঁর মাদরাসায় গিয়ে তাঁর হাতে কম্পোজকৃত খসড়া কপিটি দিয়ে আসি। তিনি বললেন, ‘আপনি লাহোরে ফিরে যান। আমি দু’দিন পর ৯ তারিখে এটি আপনার কাছে ফেরৎ পাঠাব। আমি লাহোরে চলে আসলাম। নির্ধারিত দু’দিন পার হয়ে গেল। তিনি পাঠালেন না। আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম। অতঃপর মে মাস পার হয়ে জুনও অতিক্রম করল। এ ব্যাপারে তাঁকে কিছু জিজ্ঞাসা করতেও আমার লজ্জাবোধ হচ্ছিল। আমার এক বন্ধু মরহূম আলী আরশাদকে দায়িত্ব দিলাম বিষয়টি জানার জন্য। তিনি বললেন, ‘তুমি উনার কাছে খোঁজ নাও, কে জানে তিনি আবার সেটি হারিয়েই ফেলেছেন নাকি’। তাঁর কথা শুনে আমি আর দেরী না করে ২৭শে জুলাই ফয়ছালাবাদ রওয়ানা হলাম। সেখান থেকে আলী আরশাদ ছাহেব, জামে‘আ সালাফিইয়ার শায়খুল হাদীছ মাওলানা আব্দুল আযীয আলাভী, ড. খালেদ যাফরুল্লাহকে নিয়ে আমি মাওলানা আব্দুল কাদেরের নিকট উপস্থিত হলাম। তাঁর সাথে নানা প্রসঙ্গে কথা চলতে থাকল। কিন্তু তিনি আমার বইটি সম্পর্কে কিছুই বলছেন না। অবশেষে বললাম, ‘মাওলানা, আমি যে বইটি কি আপনাকে দিয়েছিলাম দেখার জন্য, ওটা কি দেখেছিলেন’? তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘কোন বই’? আমি বললাম, ‘ছূফী ছাহেবের উপর আমার লেখা যে বইটি আপনাকে দিয়েছিলাম সেটি’। তিনি বললেন, এমন কোন বই তো তুমি আমাকে দাওনি? আমি তাঁকে মনে করিয়ে দিলাম। তখন উনি বললেন, ‘আমি তাহলে ফেরৎ দিয়েছি’। ‘কবে ফেরত দিয়েছেন?’ তিনি আর কোন জওয়াব দিতে পারলেন না।
যাইহোক, তিনি বইটি কোথায় রেখেছিলেন তা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন, আর খুঁজে পেলেন না। হাফেয আহমাদ শাকের ‘ই‘তিছাম’ অফিসের কম্পিউটারে খসড়াটি কম্পোজ করিয়েছিলেন। সেখানে খোঁজ নিয়ে জানা গেল গত জুন মাসে কম্পিউটারটি ক্রাশ করায় সব ডাটা হারিয়ে গেছে। ফলে কম্পোজ কপিও আর পাওয়া যাবে না। আমি শোকে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এত কষ্ট করে লেখা বইটি খসড়া সহ হারিয়ে গেল? আমি কাউকে আর এ ব্যাপারে কিছু বললাম না।
এরই মধ্যে দৈনিক ‘জং’ পত্রিকায় আমার এক বন্ধু হারূনুর রশীদ ছূফী ছাহেবের উপর একটি কলাম লিখলেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করলেন যে, ‘ইসহাক ভাট্টি ছাহেব উনার উপর একটি কিতাব লিখছেন’। অথচ আমার কাছে তখন সেই কিতাবের একটি অক্ষরও অবশিষ্ট নেই। অবশেষে এই কলামটি দেখার পর আমি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলাম যে, আমি ছূফী ছাহেবের উপর পূর্বে কিছু লিখেছিলাম। সবকিছু ভুলে আবার নতুন করে লেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। কেননা পত্রিকায় বিষয়টি আসার পর দেশ-বিদেশের লোকজন ফোন করে লাগাতার জানতে চাইবে বইটির খবর। আমি তাদের কী জওয়াব দেব? সুতরাং হিম্মত নিয়ে কলম ধরলাম এবং দ্বিতীয়বার লেখা শুরু করলাম। প্রথম বারে রচিত বইটি তো সাড়ে তিন’শ পৃষ্ঠার ছিল, আর দ্বিতীয় বারের রচনাটি আল্লাহ অশেষ রহমতে মাত্র দু’মাসের প্রচেষ্টায় সাড়ে চার’শ পৃষ্ঠায় উপনীত হল। আগেই বলেছি খসড়া কপিটি হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আমি কাউকেই কিছু বলিনি। পরবর্তীতে একটি অনুষ্ঠানে স্বয়ং মাওলানা আব্দুল কাদের নদভী ঘটনাটি উল্লেখ করলেন এবং বললেন, ‘ভাট্টি ছাহেব খুব বড় হৃদয়ের মানুষ। এমন একটি ইলমী সম্পদ হারিয়ে যাওয়ার পরও তিনি টু শব্দটি করেননি। যদি আমি হতাম তাঁর জায়গায়, তাহলে তাঁর মাথা ফাটিয়ে দিতাম’।
আরেকটি ঘটনা বলি ১৯৫৫ সালের। ফয়ছালাবাদে মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছের ৩য় বার্ষিক সম্মেলন। মাওলানা ইসমাঈল সালাফীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। একই সাথে সেদিন জামে‘আ সালাফিইয়ারও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হওয়ার কথা। মাওলানা ইসমাঈল সালাফী মাওলানা আব্দুল ওয়াহেদ গযনভী (রহ.)-এর সন্তান এবং মাওলানা দাউদ গযনভী (রহ.)-এর চাচাতো ভাই। অনেক বড় আলেম। সম্মেলনের আগে হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এমতাবস্থায় মাওলানা দাউদ গযনভী আমাকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, ‘আপনি সভাপতির বক্তব্যটি লিখে দেবেন, যেটি সম্মেলনের শুরুতে পড়া হবে’। আমি সবিনয়ে মাওলানাকে বললাম, ‘মাওলানা ইসমাঈল অনেক বড় মাপের মানুষ। তিনি সম্মেলনে যা বলতে চান তা আমার পক্ষে কিভাবে লেখা সম্ভব? আমার তো সেই ভাষাও নেই, চিন্তাশক্তিও নেই’! মাওলানা আমাকে উৎসাহ দিয়ে বললেন, ‘আপনি লিখুন, আমার বিশ্বাস আপনি সেভাবেই লিখতে পারবেন, যেভাবে মাওলানা ইসমাঈল চিন্তা করেছিলেন’।
মাওলানার ফরমান মোতাবেক আমি রাত ন’টায় লিখতে বসলাম এবং রাত দু’টায় শেষ করলাম। পরদিন সকালে ৮টার সময় অফিসে হাযির হয়ে মাওলানাকে সেটি দেখালাম। মাওলানা খুবই খুশী হলেন এবং আমার জন্য অনেক দো‘আ করলেন। পরদিন লেখাটি প্রিন্ট করে মাওলানা গযনভী আমাকে মাওলানা ইসমাঈলের নিকট নিয়ে গেলেন। মাওলানা ইসমাঈল পুরো বক্তব্যটি পড়ার পর আমাকে খুব ধন্যবাদ দিলেন এবং বললেন আপনি আমার চিন্তাধারা ঠিক ঠিক ভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি পুরস্কারস্বরূপ আমাকে ২০০ রূপি হাদিয়া দিলেন। যেটা তখন আমার মাসিক বেতনের সমপরিমাণ ছিল। এই ধরনের বেশ কিছু স্মরণীয় ঘটনা রয়েছে আমার লেখালেখির জীবনে।
আত-তাহরীক : আপনি অনেক সমকালীন আলেমদের জীবনী লিখেছেন। নির্মোহভাবে কারো জীবনী লেখার কাজটি সহজ নয়। বিশেষ করে কম-বেশী পক্ষপাতের একটা সুক্ষ্ম টানাপোড়েন থেকে যায়। এগুলো কিভাবে সামাল দিয়েছেন?
মাওলানা ভাট্টি : আমি যে সকল ওলামায়ে কেরামের উপর লিখেছি, আপন মর্যীর উপর ভিত্তি করে লিখেছি। আমার অন্তর যা বলেছে এবং যা আমি জানি তা-ই লিখেছি। চেষ্টা করেছি যথাসাধ্য নির্মোহভাবে লিখতে। আমার লেখার সাথে অনেকের মত মিলতেও পারে, নাও মিলতে পারে। আমি প্রতিটি মানুষকে মানুষই মনে করি, ফেরেশতা নয়। প্রতিটি মানুষের যেমন ভাল দিক থাকে, তেমন কিছু কমতিও থাকে। আমি নিজের ধ্যান-ধারণা থেকেই তা প্রকাশ করেছি। যে ব্যক্তি সম্পর্কে লিখতে আমার অন্তর চায় না, তাঁর সম্পর্কে আমি চেষ্টা করেও লিখতে পারি না। আমি বহু মানুষের জীবনী লিখেছি এবং তা অন্তরের গভীর থেকেই লিখেছি। এসব জীবনীর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মনে করি মাওলানা আবুল কালাম আযাদ (রহঃ), মাওলানা দাঊদ গযনভী (রহঃ), সাইয়েদ আতাউল্লাহ শাহ বুখারী (রহঃ) এবং মাওলানা মুহাম্মাদ হানীফ নদভী (রহঃ)-এর জীবনী। (ক্রমশঃ)