[শায়খ তালেবুর রহমান শাহ (১৯৫০ইং-) সমকালীন পাকিস্তানের একজন খ্যাতনামা আলেম এবং মুনাযির। পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের খানেওয়াল যেলায় জন্মগ্রহণকারী এই বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন পাকিস্তানে দেওবন্দী, ব্রেলভী, শী‘আ, কাদিয়ানী এবং খৃষ্টানদের সাথে বাহাছ-মুনাযারায় অংশগ্রহণ করে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাঁর হাতে বহু মানুষ তাওহীদ ও সুন্নাতের দীক্ষা নিয়েছেন। তাঁর রচিত ‘দেওবন্দিয়াহ’, ‘তাবলীগী জামা‘আত’, ‘কিয়া ফিক্বহে হানাফিয়াহ কিতাব ওয়া সুন্নাত কা নিচোড় হ্যায়?’ প্রভৃতি গ্রন্থ আলোড়িত করেছে পাঠক সমাজকে। বিগত ১৯.০৭.২০১৭ইং তারিখে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিস্থ স্যাটেলাইট টাউন শাহ ইসমাঈল শহীদ আহলেহাদীছ জামে মসজিদে ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’-এর গবেষণা বিভাগের পরিচালক আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব তাঁর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন এবং মাসিক আত-তাহরীকের পক্ষ থেকে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। উর্দূ থেকে ভাষান্তরিত এবং অনুলিখিত এই সাক্ষাৎকারটি সম্মানিত পাঠকদের জন্য পত্রস্থ করা হল।- সম্পাদক]
আত-তাহরীক : আপনার প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে জানতে চাই।
শায়খ তালেবুর রহমান শাহ : আমরা ইন্ডিয়ার আনবালা এলাকার বাসিন্দা ছিলাম। ১৯৪৭ সালে আমার পরিবার পাকিস্তানের মুলতানে সরাই সিধুঁ শহরে হিজরত করে চলে আসে। বর্তমানে এটিকে খানেওয়াল নামকরণ করা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা সেখানেই অর্জন করি। পরে মুলতান সাইন্স কলেজে ভর্তি হই। আমার বড় ভাই ডা. শফীকুর রহমান তখন ভাওয়ালপুর মেডিকেল কলেজে পড়তেন। তার পরামর্শে আমি ভাওয়ালপুর কলেজে মাইগ্রেশন করে চলে আসি। এখান থেকে এফএসসি পাশ করার পর পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিয়াতে অনার্স ও মাস্টার্স করি এবং পরে পিএইচডিও সম্পন্ন করি।
আত-তাহরীক : আমরা শুনেছি আপনি প্রথমে হানাফী ছিলেন। এমনকি শোনা যায় যে, আপনি এক সময় শী‘আ ছিলেন? পরে কীভাবে আহলেহাদীছ হ’লেন? একটু বিস্তারিত জানতে চাই।
শায়খ তালেবুর রহমান শাহ : হ্যাঁ, আমার পরিবার হানাফী ছিল। তাদের মধ্যে দেওবন্দী ও ব্রেলভী উভয় আক্বীদারই লোক ছিল। কিন্তু আমার পরিবারে কেউ শী‘আ ছিল না। আত্মীয়দের মধ্যে কেউ কেউ শী‘আ ছিলেন বলে হয়ত বিষয়টি এমনভাবে প্রচার হয়েছে যে, আমি শী‘আ ছিলাম। এটা সত্য নয়। আর আহলেহাদীছ হওয়ার কাহিনী হ’ল- পড়াশোনার জন্য যখন বড় ভাইয়ের কাছে ভাওয়ালপুরে আসি, তখন সেখানে এফএসসি কলেজের একজন প্রফেসর হাফেয আব্দুল্লাহ ছাহেবের সাথে পরিচয় হয়। তিনি তাঁর মসজিদের সাথে একটি হোস্টেল তৈরী করেছিলেন, যেখানে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা থাকত। আমিও সেখানে উঠেছিলাম। এই মসজিদে প্রতিদিন বাদ মাগরিব কুরআন তরজমা ও তাফসীর হ’ত। আমি বড় ভাই শফীকুর রহমানের সাথে এই দরসে নিয়মিত উপস্থিত হ’তাম। এই দরসে এমন নতুন নতুন কিছু কথা শুনতাম, যা আমি পূর্বে কখনও শুনিনি। হাফেয আব্দুল্লাহ ছাহেব ছিলেন আহলেহাদীছ। এতদিন আমি দেওবন্দী ও ব্রেলভী মাসলাকের মাসআলা-মাসায়েল শুনে আসলেও এই প্রথম সরাসরি কুরআন ও হাদীছ থেকে মাসআলা-মাসায়েল শুনতে পেলাম। এটা ছিল আমার জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা। নিয়মিত তার দরস শুনতে শুনতে বড় ভাই এক সময় আহলেহাদীছ হয়ে গেলেন। ফলে বাড়ী থেকে তার সাথে সম্পর্ক ছিন্নতা ঘোষণা করা হ’ল। তবে আমি তখনও আহলেহাদীছ হইনি।
এমতাবস্থায় একবার আমাদের হোস্টেলে জনৈক ড. শাববীর ছাহেবের সাথে একজন হানাফী আলেমের মুনাযারা হয়। মুনাযারার পর সেই হানাফী আলেম স্বীকার করে নিলেন যে, আমরা ছালাতে রাফঊল ইয়াদায়েন এ জন্যই করি না যে আমাদের ইমাম তা করেননি। অর্থাৎ রাফঊল ইয়াদায়েন রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত প্রমাণিত হওয়ার পরও কেবল এই জন্যই তা করেন না, যেহেতু তার ইমাম সেটি করেননি। তিনি এ কথা বলেননি যে, আমার কাছে কুরআন এবং সুন্নাতের দলীল আছে। বরং সোজাসুজি বললেন যে, তাক্বলীদের কারণে আমরা রাফঊল ইয়াদায়েন করতে নিষেধ করি। এই বিষয়টি আমার অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করে যে, রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতের বিপরীতে ইমামের কথার অনুসরণ করতে হবে, এর অর্থ কী? বিষয়টি আরও পরীক্ষা করার জন্য পার্শ্ববর্তী এক হানাফী মসজিদে গিয়ে ইমামকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, তোমরা ওয়াহ্হাবী। তোমরা আমাদেরকে শুধু বিরক্ত করার জন্য এসেছ। আমি বললাম, ইমাম ছাহেব! আমি শুধু সত্যটা জানার জন্য এসেছি। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করলেন না; বরং বললেন, আল্লাহর কসম খাও যে, যদি তুমি ওয়াহ্হাবী হও তাহ’লে তোমার বউ তালাক! আমি বললাম, আমার তো এখনও বিয়েই হয়নি। তিনি বললেন, তাহ’লে এই কসম খাও যে, তুমি ওয়াহ্হাবী হ’লে তোমার বিয়ের সাথে সাথে তোমার বউ তালাক হয়ে যাবে! আমরা তার এমন আচরণে হতভম্ব হয়ে গেলাম। কোনক্রমেই তিনি কুরআন ও হাদীছ থেকে দলীল দেখাতে চাইলেন না।
অবশেষে বাধ্য হয়ে সেখান থেকে চলে আসলাম। সেই দিন থেকেই আমার মনে বদ্ধমূল হয়ে গেল যে, প্রকৃত দ্বীন কুরআন এবং হাদীছেই রয়েছে, অন্য কিছুতে নয়। ফলে আমিও বড় ভাইয়ের মত আহলেহাদীছ হয়ে গেলাম। অতঃপর বাড়ী গেলাম। তারা আমার পরিবর্তন বুঝতে পেরে আমাকেও ঘর থেকে বের করে দিল। অবশেষে আমি ভাওয়ালপুরের ঐ হোস্টেলেই থাকতে লাগলাম। এফএসসি’র পর মেডিকেলে ভর্তির পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ততদিনে আমার অন্তর পরিবর্তন হয়ে গেছে। ফলে আল্লাহর ইচ্ছায় আমি ইসলামিয়াতে অনার্সে ভর্তি হই। পরবর্তীতে মাস্টার্স ও পিএইচডিও করি। আলহামদুলিল্লাহ মেডিকেল লাইন ছেড়ে দ্বীনী ইলম শিক্ষার পথ বেছে নেয়াটাই ছিল আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। আল্লাহর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা যে, তিনি ভাওয়ালপুর শহরে থাকা অবস্থায় হাফেয আব্দুল্লাহর মাধ্যমে আমাকে দ্বীনের সঠিক পথ দেখিয়েছিলেন এবং কুরআন ও সুন্নাতের উপর আমল করার তাওফীক দিয়েছিলেন। এখন আমার অপর তিন ভাই ডা. শফীকুর রহমান, তাইয়েবুর রহমান এবং তাওছীফুর রহমান প্রত্যেকেই ছহীহ দ্বীনের প্রচার ও প্রসারে খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন। ফালিল্লা-হিল হাম্দ।
আত-তাহরীক : মাশাআল্লাহ! অনেক শিক্ষনীয় বিষয় রয়েছে আপনার এই কাহিনীতে। আপনি পরবর্তী জীবনে বাহাছ-মুনাযারা জগতে মাশাআল্লাহ অনেক খ্যাতি অর্জন করেছেন। কিভাবে এই ময়দানে এলেন?
শায়খ তালেবুর রহমান শাহ : আমাদের এলাকায় একবার মাস্টার আমীন ওকাড়ভী এবং জনৈক আহলেহাদীছ আলেমের মধ্যে মুনাযারা হয়। তাদেরকে দেখেই প্রথম আমার মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি হয় মুনাযারার ব্যাপারে। তাছাড়া আহলেহাদীছ হওয়ার পর থেকে চরম বিরোধীয় পরিবেশ মোকাবিলা করতে হয়েছে। ফলে মানসিকভাবে তৈরীই ছিলাম। অতঃপর কুরআন ও ছহীহ হাদীছ থেকে দলীল একত্রিত করা শুরু করি এবং ধীরে ধীরে আলেমদের সাথী হিসাবে মুনাযারায় অংশগ্রহণ করা শুরু করি। এ পর্যন্ত মাযহাবীদের বিপরীতে যেমন বহু মুনাযারায় অংশগ্রহণ করেছি, তেমনি কাদিয়ানী, শী‘আ এবং খৃষ্টানদের সাথেও মুনাযারা করার সুযোগ হয়েছে। ফালিল্লা-হিল হাম্দ।
আত-তাহরীক : মুনাযারার ব্যাপারে বলা হয় যে, এসব বিতর্কে তেমন কোন উপকার হয় না, বরং পরস্পরের মধ্যে যিদ ও হঠকারিতা বৃদ্ধি পায়। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
শায়খ তালেবুর রহমান শাহ : আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি মুনাযারায় মূলতঃ বিতর্ককারী দুই পক্ষের তেমন উপকার হয় না। কিন্তু যারা শ্রোতা থাকে তারা অনেক উপকৃত হয়। কেননা একজন হক্বের অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তি যখন সামনা-সামনি বিতর্ক দেখে, তখন সে স্পষ্ট বুঝতে পারে যে, কার পক্ষে দলীল বেশী শক্তিশালী। ফলে মুনাযারা শুনে বহু সাধারণ মানুষ আহলেহাদীছ হয়। কিন্তু প্রতিপক্ষ মুনাযির আক্বীদা পরিবর্তন করেছেন এমন দৃষ্টান্ত খুব কম। একজন মুনাযিরের কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে, যার নাম আফযাল কাদেরী ছাহেব। ইসলামাবাদের ভারাকাওতে আমার সাথে এক মুনাযারার পর তিনি তৎক্ষণাৎ আহলেহাদীছ হয়েছিলেন।
আত-তাহরীক : মুনাযারায় দক্ষতা অর্জন করতে গেলে কী কী বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখা উচিৎ?
শায়খ তালেবুর রহমান শাহ : প্রথমে বিতর্কিত বিষয়গুলো সম্পর্কে ভাল জ্ঞান রাখতে হবে। তবে শুরুতেই রাফঊল ইয়াদায়েন, সরবে আমীন বলা, ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠ করা ইত্যাদি বিষয়ে বিতর্কে নামা ঠিক নয়। বরং প্রথমে আক্বীদা বিষয়ে মুনাযারা করা উচিৎ। যদি আক্বীদার সমস্যাটি মিটে যায়, তবে ছোট ছোট অন্যান্য বিষয়গুলো সহজেই সমাধান হয়ে যাবে। আক্বীদার মধ্যেই যদি শিরক ও কুফর থাকে, তবে বাকি বিষয়গুলো সমাধান করে কী লাভ? আর সাধারণ মানুষ যখন দেখবে যে প্রতিপক্ষের আক্বীদাতেই শিরক ও কুফর রয়ে গেছে, তখন তারা নিজেরাই হক্ব বুঝতে পারবে। তাছাড়া আক্বীদার বাহাছে মাযহাব ও তাক্বলীদ প্রসঙ্গও চলে আসবে। যখন মানুষ তাক্বলীদ ছেড়ে স্বচ্ছ মন-মগজে এবং বিবেক খোলা রেখে কিতাব ও সুন্নাতকে শরী‘আতের একচ্ছত্র দলীল হিসাবে মেনে নিবে, তখন তার জন্য বাকি বিষয়গুলো বোঝা সহজ হয়ে যাবে।
আত-তাহরীক : মুনাযারায় সফল হওয়ার জন্য আপনার পরামর্শ কী?
শায়খ তালেবুর রহমান শাহ : প্রথমে নিজেদের পক্ষের দলীলগুলো একত্রিত করতে হবে, তারপর অপরপক্ষের দলীলগুলোও। অতঃপর দেখতে হবে যে তাদের দলীলগুলো কেন গ্রহণযোগ্য নয় এবং তাদের পেশকৃত হাদীছগুলোতে কী ত্রুটি রয়েছে। এভাবে ইখলাছের সাথে নিয়মিত চর্চা চালিয়ে গেলে সফল মুনাযির হওয়া সম্ভব। সর্বোপরি এটি আল্লাহ প্রদত্ত প্রতিভা। পড়াশোনা করলেই যে ভাল মুনাযির হওয়া যাবে, তা নয়। অনেক বড় বড় আলেম রয়েছেন, যারা ভাল মুনাযির নন। যদিও তাঁদের জ্ঞানের পরিধি অনেক বড়। কেননা এতে জ্ঞানের সাথে সাথে উপস্থিত বুদ্ধিরও সমন্বয় ঘটাতে হয়। তবে অবশ্যই ইলম অর্জন চালিয়ে যেতে হবে। তারপর যদি কারও মুনাযারা করার যোগ্যতা থাকে, তাহ’লে সে সঠিকভাবে ইলমী গভীরতার সাথে জবাব দিতে পারবে। এছাড়া ছানাউল্লাহ অমৃতসরী, আব্দুল কাদের রৌপড়ী প্রমুখ ওলামায়ে কেরামের মুনাযারা সংকলন বাযারে পাওয়া যায়, সেগুলো পড়া যেতে পারে। সেখান থেকেও বাহাছের অনেক খুঁটিনাটি বিষয় আয়ত্ত্ব করা সম্ভব।
আত-তাহরীক : আজকাল দাওয়াতী ময়দানে মানুষের সামনে কথা বলা বেশ কঠিন হয়ে যায়। অনেকে সংশোধন প্রয়াসী হওয়ার পরিবর্তে এমন কথা বলেন যে, মুসলিমরা এমনিতেই অনেক ফিৎনার মধ্যে ডুবে আছে, সারা বিশ্বে তারা মার খাচ্ছে। আর এর মধ্যে আপনারা কেন খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে নতুন ফিৎনা শুরু করেছেন? মুনাযির হিসাবে এ ব্যাপারে আপনি কী বলবেন?
শায়খ তালেবুর রহমান শাহ : মক্কায় রাসূল (ছাঃ) তাওহীদের দাওয়াত নিয়ে ময়দানে নেমেছিলেন। যদি তাওহীদের দাওয়াত দেয়া ফিৎনা-ফাসাদ হয়, তাহ’লে রাসূল (ছাঃ) নিজেই ছিলেন ফিৎনাবাজ, নাঊযুবিল্লাহ। মক্কার সমাজে তখনও চুরি, ডাকাতি ছিল; মানুষ হত্যা, যেনা-ব্যভিচারের মত বড় বড় অপরাধ সংঘটিত হ’ত। কিন্তু রাসূল (ছাঃ) তাওহীদের দাওয়াতই প্রথমে শুরু করেছিলেন। সুতরাং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হ’ল তাওহীদের আক্বীদা। এই আক্বীদার প্রচারে ফিৎনা সৃষ্টি হয় না, বরং মানুষের মধ্যে সংস্কার ও সংশোধন আসে। রাসূল (ছাঃ) যখন তাওহীদের দাওয়াত শুরু করেন, তখন যে আরব সমাজ তাঁকে গালি দিয়েছিল, তাঁর চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে দিয়েছিল, তাঁকে কবি ও যাদুকর আখ্যা দিয়েছিল; সেই আরব সমাজেই একদিন এমন শান্তি নেমে এসেছিল, যে প্রসঙ্গে রাসূল (ছাঃ) বলেছিলেন, অমুক এলাকা থেকে অমুক এলাকা পর্যন্ত কোন রমণী একাকী পথ চলবে, অথচ কোন অচেনা পুরুষ তার ক্ষতি করা তো দূরে থাক, তার প্রতি দৃষ্টি পর্যন্ত দেবে না, তার মাল-সম্পদের কোন ক্ষতি করবে না। এটাই ছিল তাওহীদী আক্বীদার বরকত। আজও আমাদের দেশে একদিনে যে অপরাধ হয়, তা সঊদী আরবে তাওহীদের বরকতে সারাবছর মিলেও হয় না। সুতরাং তাওহীদের আক্বীদা প্রচারের জন্য ফিৎনা-ফাসাদ সৃষ্টি হবে, এটি ভুল ধারণা। আর এটা ঠিক যে, যখন কোন মানুষ বাপ-দাদার আমল থেকে কোন আক্বীদা-বিশ্বাস শিখে আসে; অতঃপর কোন নতুন কথা শোনে, তখন তার অন্তরে চোট লাগাই স্বাভাবিক। এ সব মানুষের প্রতি আমার নছীহত হ’ল, আপনি কমপক্ষে এটুকু অনুসন্ধান করে দেখুন যে, কিতাব ও সুন্নাত দ্বারা আপনার আক্বীদাটি সাব্যস্ত কি-না। তাওহীদ ও রিসালাতের কথা তো কিতাব ও সুন্নাতেরই কথা। সুতরাং আপনি এটা দেখবেন না যে, বাপ-দাদা কী করে গেছেন। বরং আপনার কর্তব্য হবে যে, তাদের ভুল হ’লে অবশ্যই সে ভুলকে ত্যাগ করে কুরআন ও সুন্নাত থেকে যে আক্বীদা সঠিক সাব্যস্ত হয়েছে, তা গ্রহণ করা।
আত-তাহরীক : এবারে কিছু সাংগঠনিক প্রশ্ন করি, জামা‘আত গঠন করা সম্পর্কে পাকিস্তানের কিছু আহলেহাদীছ আলেমের মধ্যে নেতিবাচক মন্তব্য দেখা যায়। আপনার মতামত কী?
শায়খ তালেবুর রহমান শাহ : জামা‘আত তো বানানো হয়নি, পরিস্থিতির আলোকে তৈরী হয়েছে। যখন শী‘আদের আবির্ভাব ঘটল, তখন অবস্থার প্রেক্ষাপটে ‘আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ পরিভাষা সুপরিচিত হয়ে উঠল। যারা ছাহাবীদের প্রতি মুহাববাত রাখতেন তারা আহলুস সুন্নাত নামে প্রসিদ্ধ হয়ে গেলেন, আর যারা ছাহাবীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিল তারা রাফেযী হিসাবে আখ্যায়িত হ’ল। একইভাবে যখন কুফায় রায়-কিয়াসের বাড়বাড়ন্ত শুরু হ’ল এবং আহলুর রায় পরিভাষাটি চালু হয়ে গেল, তখন এর বিপরীতে আহলেহাদীছ পরিভাষাটিও আপনা থেকেই প্রসিদ্ধি লাভ করল। মদীনায় ইমাম মালেক ছিলেন আহলেহাদীছ এবং কুফায় ইমাম আবু হানীফা, সুফিয়ান ছাওরী প্রমুখ ছিলেন আহলুর রায়ের অন্তর্ভুক্ত। ছাহাবায়ে কেরাম এবং পরবর্তী সকল প্রসিদ্ধ ইমামগণই হাদীছকে হুজ্জত হিসাবে গ্রহণ করতেন। সুতরাং তারা প্রত্যেকেই আহলেহাদীছ ছিলেন। কিন্তু তখন এ জামা‘আতের পৃথক কোন আমীর ছিল না, কমিটি-এজলাস ছিল না। পরবর্তীকালে পরিস্থিতির চাহিদায় এ সকল জামা‘আত তৈরী হয়েছে। এতে আপত্তির কিছু নেই। বরং এ সকল জামাআত যদি সংঘবদ্ধভাবে দাওয়াত ও তাওহীদের কাজ করে, তাতে অংশগ্রহণ করা এবং সমর্থন করা একান্ত কর্তব্য। হ্যাঁ এটা সত্য যে, এসব সংগঠনের মাঝে কিছু দ্বিধাবিভক্তি দেখা দিয়েছে। কিন্তু এই বিভক্তি মোটেও আক্বীদা বা মাসলাকের বিভক্তি নয়; বরং পদ ও ক্ষমতার বিভক্তি। এই জাতীয় বিভক্তি ছাহাবীদের মধ্যেও ঘটেছিল। হুসায়ন (রা.), আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের (রাঃ), মু‘আবিয়া (রাঃ) প্রমুখের মধ্যে ক্ষমতাকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব ছিল। কিন্তু তারা কখনও বলেননি যে, আমার আক্বীদা সঠিক, আর তোমার আক্বীদা ভুল। বরং আক্বীদার প্রশ্নে তারা সবাই ছিলেন এক। যার প্রমাণ আলী (রাঃ) ও মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর মধ্যে যুদ্ধকালে খৃষ্টানরা আলী (রাঃ) বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর সাথী হওয়ার জন্য প্রস্তাব দিল। তখন মু‘আবিয়া (রাঃ) বললেন, যদি তোমরা তাঁর বিরুদ্ধে লড়তে যাও তবে আমি তোমাদের বিরুদ্ধে প্রথম কাতারে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করব। কেননা আমাদের দ্বীন একই। আমাদের দাওয়াত একই। বিভক্তি কেবল রাজনৈতিক।
পাকিস্তানের আহলেহাদীছ জামা‘আতগুলোর মধ্যেও বিভক্তি কেবল ক্ষমতা ও প্রভাববিস্তার কেন্দ্রিক। তবে যেটা কাম্য সেটা হ’ল, এই বিভক্তির কারণে যেন পারস্পরিক দুশমনী সৃষ্টি না হয়, বরং সমঝোতার ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। যদি বলা হয় যে, এই বিভক্তির সমাধান কী? তবে এর উত্তর আমি দিতে পারব না। হযরত আলী (রাঃ) ও মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর দ্বন্দ্বের সময়ও এক পক্ষ অন্য পক্ষের দাবী মেনে নেওয়ার ব্যাপারে অনঢ় ছিলেন। তারা কেউ ছাড় দিতে তৈরী ছিলেন না। সুতরাং সহজে এসব সমস্যার সমাধান আশা করা ঠিক নয়। একবার সকল আহলেহাদীছকে একত্রিত প্লাটফর্মে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল ‘মুত্তাহিদা আহলেহাদীছ জামা‘আত’ গঠনের মাধ্যমে। কিন্তু অল্প কিছুদিন পরই দেখা গেল নানা অভিযোগ তুলে যে যার মত একে একে সবাই আলাদা হয়ে গেলেন। সুতরাং সমাধানের কথা বিশেষ ভেবে লাভ নেই। বরং আপসে লড়াই ত্যাগ করা এবং দ্বীনের কাজে ইখলাছের সাথে যত বেশী অগ্রসর থাকা যায়, সেই ফিকিরে সচেষ্ট থাকাই উত্তম।
আত-তাহরীক : কোন জামা‘আত বা সংগঠনের সাথে জড়িত হওয়া কতটা যরূরী।
শায়খ তালেবুর রহমান শাহ : খুবই যরূরী। কেননা জামা‘আত একটি বৃহৎ শক্তি। এর মাধ্যমে দুশমনের প্রতিরোধ করা এবং বহিঃশক্তির আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করা সহজ হয়। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, বিচ্ছিন্ন ভেড়া আক্রমণের শিকার হয়। সুতরাং জামা‘আতবদ্ধ জীবনের বিকল্প নেই।
আত-তাহরীক : পাকিস্তানের বেশ কিছু আহলেহাদীছ জামা‘আতকে দেখা যাচ্ছে যে, তারা পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। এ ব্যাপারে আপনার মত কী?
শায়খ তালেবুর রহমান শাহ : যদি কোন দলের নিয়ত এমন হয় যে আমরা পার্লামেন্টে গিয়ে কুরআন ও সুন্নাহর আওয়াজকে বুলন্দ করব, শিরক-বিদ‘আত প্রতিরোধ করব এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করব, তবে তাদের জন্য নির্বাচনে যাওয়া সিদ্ধ হ’তে পারে। এমন স্থানকে আমি কাফের বা ধর্মনিরপেক্ষদের জন্য বিলকুল খালি ছেড়ে দেওয়া ঠিক মনে করি না। নির্বাচিত হ’লে সেখানে কমপক্ষে কুরআন ও হাদীছের পক্ষে কিছু কথা বলার সুযোগ তো আসবে![1] তবে এর দ্বারা শুধু ক্ষমতায় যাওয়াই যদি উদ্দেশ্য হয়, চুপ করে বসে থাকা কাজ হয়, তবে সেখানে যাওয়া সিদ্ধ নয়। আর ইসলামী হুকুমত কায়েমের কথা বললে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মাধ্যমে ইসলামী হুকুমত আসার কোন সম্ভাবনা আমি দেখি না। তাছাড়া গণতন্ত্র যে আইন রচনায় কুফরী ও শিরকী পদ্ধতির অনুগামী, তাতে কোন সন্দেহ নেই। এতে অধিকাংশের রায় চূড়ান্ত- নীতিটি সুস্পষ্টভাবে ইসলামবিরোধী।
আত-তাহরীক : বাংলাদেশী আহলেহাদীছদের জন্য আপনার কোন বার্তা?
শায়খ তালেবুর রহমান শাহ : আমার আহবান থাকবে যে, আপনারা কিতাব ও সুন্নাতের দাওয়াতকে সর্বত্র বুলন্দ করার জন্য সাধ্যমত প্রচেষ্টা চালান। আর জামা‘আতী বিভক্তি যদি কোথাও থেকে থাকে সেটিকে বেশী গুরুত্ব দেওয়ার দরকার নেই। যদি একত্রে কাজ করা যায়, সেটি খুবই ভাল। যদি সম্ভব না হয়, তবে পরস্পর দুশমনী না রেখে বরং সহযোগিতার ভিত্তিতে হক-এর দাওয়াত কিভাবে ছড়িয়ে দেয়া যায় সেই প্রচেষ্টা চালাতে হবে। হানাফী, ব্রেলভী ইত্যাদি গ্রুপগুলোর কাছাকাছি যেতে হবে। তাদেরকে নিয়মিত দাওয়াত দিতে হবে। আর দাওয়াতী ময়দানে ছোট ছোট মাসআলা-মাসায়েল নয় বরং কিতাব ও সুন্নাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া এবং আক্বীদা পরিশুদ্ধ করার বিষয়ে অধিক গুরুত্বারোপ করতে হবে।
আত-তাহরীক : এতক্ষণ সময় দেওয়ার জন্য আপনার প্রতি অনেক শুকরিয়া। জাযাকুমুল্লাহ খাইরান।
শায়খ তালেবুর রহমান শাহ : আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।
[1]. আমরা তাঁর এই বক্তব্যের সাথে একমত নই। কেননা বিগত অভিজ্ঞতা বলে যে, বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আওয়াজকে বুলন্দ করা কোন অবস্থাতেই সম্ভব নয়; বরং এতে অংশগ্রহণ ইসলামের সপক্ষের শক্তিগুলোকে নৈতিকভাবে দুর্বল ও আপোষকামী করে দিয়েছে। মদের লাইসেন্স নিয়ে মদের দোকানে বসে যেমন মদের বিরুদ্ধে উপদেশবাণীর গুরুত্ব নেই, তেমনি গণতন্ত্রকে স্বীকৃতি দিয়ে ধর্মনিরপক্ষেপতাবাদের অধীনে থেকে ইসলামের বাণী প্রচার করা অর্থহীন এবং বাস্তবতাবিরুদ্ধ। বরং প্রচলিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার বিপরীতে ইসলামের রাজনৈতিক রূপরেখা বাস্তবায়নের চেষ্টাই হ’ল সঠিক ইসলামী রাজনীতি। বিস্তারিত দেখুন : মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব রচিত তিনটি মতবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, ইসলামী খেলাফত ও নেতৃত্ব নির্বাচন প্রভৃতি বইসমূহ।- সম্পাদক।