প্রশ্ন-১৫. যে কোন পর্যায়ের নেতার আনুগত্য করা প্রয়োজন। কিন্তু এজন্য প্রত্যেক নেতার হাতে আনুগত্যের বায়‘আত করা কি আবশ্যক?
উত্তর : না, বরং কেবল খলীফার আনুগত্য প্রকাশের জন্য ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদে’র মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক বায়‘আত করা আবশ্যক (إجْبَارِى)। আর বাকীদের ক্ষেত্রে সেটা প্রয়োজন ও গুরুত্বমাফিক, কেননা সেটি ইখতিয়ারী বা ঐচ্ছিক (اخْتِيَارِى)। স্মর্তব্য যে, দেশে ইসলামী খেলাফত না থাকলেও সমাজ পরিচালনায় ইসলামী নেতৃত্ব থাকতে হবে। আর যে কোন প্রকার নেতৃত্ব, যেখানে আনুগত্যের প্রশ্ন আসে সেখানে শপথ বা স্বীকৃতি প্রদান যরূরী। নইলে নেতৃত্ব অকার্যকর হয়ে সমাজ বিপর্যস্ত হবে, যা ইসলামের কাম্য নয়। এ কারণেই নেতৃত্বের আনুগত্যের গুরুত্ব বুঝাতে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,وَمَنْ مَاتَ وَلَيْسَ فِى عُنُقِهِ بَيْعَةٌ مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً، ‘যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করল এমন অবস্থায় যে, তার গর্দানে আমীরের প্রতি আনুগত্যের বায়‘আত নেই, সে জাহেলিয়াতের মৃত্যুবরণ করল’।[1] এর অর্থ কুফরী নয়, বরং নেতৃত্বহীন অবস্থায় থাকাকে নাবিকহীন নৌকার মত বিশৃংখল অবস্থায় থাকার সাথে তুলনা করা হয়েছে। ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন,وَالْمُرَادُ بِالْمِيتَةِ الْجَاهِلِيَّةِ وَهِيَ بِكَسْرِ الْمِيمِ حَالَةُ الْمَوْتِ كَمَوْتِ أَهْلِ الْجَاهِلِيَّةِ عَلَى ضَلَالٍ وَلَيْسَ لَهُ إِمَامٌ مُطَاعٌ، ‘জাহেলী হালতে মৃত্যু’র অর্থ হ’ল জাহেলী যুগের লোকেদের মৃত্যুর ন্যায়। যারা ভ্রষ্টতার উপরে ছিল এবং যাদের কোন অনুসরণীয় নেতা ছিল না’।[2] অতএব নেতৃত্বের অধীনে থাকা ইসলামের একটি সামাজিক নির্দেশনা। তবে সকল প্রকার নেতৃত্বের বায়‘আত বা স্বীকৃতির জন্য আনুষ্ঠানিক ঘোষণার প্রয়োজন হয় না। যেমন পরিবারের পিতা-মাতার আনুগত্যের জন্য বায়‘আতের প্রয়োজন নেই। আবার চাকুরীর ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক আনুগত্য ঘোষণার প্রয়োজন নেই, বরং সাধারণ মৌখিক বা লিখিত স্বীকৃতিই যথেষ্ট। তবে সামাজিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক আনুগত্য প্রকাশের প্রয়োজন হয়। কেননা এর গুরুত্ব সাধারণ আনুগত্যের চেয়ে অধিক, যা সহজেই অনুমেয় এবং রাসূল (ছাঃ)-এর আমল দ্বারা প্রমাণিত।
প্রশ্ন-১৬. খেলাফত ব্যতীত অন্যান্য বায়‘আত সম্পর্কে পূর্বসূরী বিদ্বানদের মধ্যে আলোচনা স্বল্পতার কারণ কী?
উত্তর : এর পিছনে কয়েকটি কারণ হতে পারে। যেমন- (১) ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠিত থাকায় রাষ্ট্রীয় বায়‘আত ভিন্ন অন্য কোন বায়‘আতকে পূর্বসূরী বিদ্বানগণ আলোচনায় নিয়ে আসেননি। বিশেষতঃ হাদীছে খিলাফতের আনুগত্য বিষয়ক ফরয বায়‘আত সম্পর্কে জোর তাকীদ আসায় তাঁরা সাধারণ বায়‘আত সম্পর্কে আলোচনার প্রয়োজনবোধ করেননি। এমনকি জিহাদের বায়‘আতের আলোচনাও তেমন পাওয়া যায় না। তদুপুরি ইসলামী খেলাফত বা ইমারত বিষয়ে পূর্বসূরি বিদ্বানদের পর্যালোচনামূলক গ্রন্থই খুব অপ্রতুল। এটাও এর পিছনে একটি কারণ হ’তে পারে। সেই সাথে বর্তমান যুগে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একজন মুসলিম কিভাবে অমুসলিম দেশে জীবন যাপন করবে বা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট অথচ সেক্যুলার রাষ্ট্রে কিভাবে দ্বীনের পথে নিজেকে পরিচালনা করবে, সে সকল আলোচনাও হয়ত তাদের সামনে উপস্থিত হয়নি।
(২) মুসলিম উম্মাহর মধ্যে হাযারো দল-বিভক্তি সংখ্যাগরিষ্ট ওলামায়ে কেরামকে বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতি সম্পর্কে হতাশাবাদী অবস্থানে নিয়ে গেছে। ফলে নিদেনপক্ষে নিজেকে ‘দলাদলি’ থেকে মুক্ত রাখার সাধু চিন্তা গ্রাস করায় তারা বাস্তব পরিস্থিতির মূল্যায়ন করতে সমর্থ হননি। আর তাই খিলাফত ও বায়‘আতের আলোচনায় স্রেফ রাষ্ট্রকেন্দ্রিক চিন্তাধারায় তারা বন্দী থেকেছেন অথবা চুপ থেকেছেন। বাস্তবতার আলোকে কেবল ইমাম শাওকানী ব্যতীত হকপন্থী বিদ্বানদের মধ্যে অন্য কারো বক্তব্য তেমন আমরা পাইনি। ইমাম শাওকানী বলেন, فمعلوم أنه قد صار في كل قطر أو أقطار الولاية إلى إمام أو سلطان وفي القطر الآخر أو الأقطار كذلك ولا ينفذ لبعضهم أمر ولا نهي في قطر الآخر وأقطاره التي رجعت إلى ولايته فلا بأس بتعدد الأئمة والسلاطين ويجب الطاعة لكل واحد منهم بعد البيعة له على أهل القطر الذي ينفذ فيه أوامره ونواهيه ‘বর্তমান অবস্থা তো সবার জানা যে, প্রত্যেক অঞ্চলে কোন না কোন নেতা বা শাসক দেশ বা সমাজ শাসন করছেন। অন্য এলাকাতেও একই অবস্থা। এসব ক্ষেত্রে এক অঞ্চলের আদেশ-নিষেধ অন্য অঞ্চলে কার্যকর নয়। অতএব এমতাবস্থায় নেতা বা শাসক বহু সংখ্যক হওয়াটা দোষণীয় নয়। বরং এ অবস্থায় করণীয় হবে যে, প্রত্যেক এলাকার শাসকদের কাছে বায়‘আত করার পর তার আনুগত্য করা, যেখানে তার শাসনক্ষমতা কার্যকর’।
সমকালীন যুগে শায়খ উছায়মীন (রহঃ) ইসলামী সংগঠন এবং বায়‘আতের বিষয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করলেও যুগের বাস্তবতা উপলব্ধি করে ক্ষুদ্র পরিসরের নেতৃত্ব ও তার আনুগত্যের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করেননি। তিনি তাঁর এক বক্তব্যে বলেন, إنه لا إمام للمسلمين اليوم، فلا بيعة لأحد!! ـ نسأل الله العافية ـ ولا أدري أيريد هؤلاء أن تكون الأمور فوضى ليس للناس قائد يقودهم؟! أم يريدون أن يقال: كل إنسان أمير نفسه؟ ‘অনেকে মনে করেন যে, বর্তমান যুগে মুসলমানদের কোন নেতা নেই, অতএব কারো কাছে বায়‘আতও নেই। আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা চাই। জানি না তারা আসলে কী চায়। তারা কি চায় যে, কোন নেতৃত্ব না থেকে সমাজটা বিশৃংখলায় ভরে যাক! তারা কি চায় যে এটা বলা হোক, প্রত্যেক মানুষ হোক নিজেই নিজের নেতা!’ অতঃপর তিনি বলেন, لأن عمل المسلمين منذ أزمنة متطاولة على أن من استولى على ناحية من النواحي، وصار له الكلمة العليا فيها، فهو إمام فيها ‘দীর্ঘদিন ধরে মুসলমানদের অবস্থা এমন যে, কোন এক স্থানে যদি কেউ কোন এককভাবে কর্তৃত্বের অধিকারী হয় এবং তার কথা সমাজে কার্যকর হয়, তবে তিনিই সেখানে নেতৃত্ব দিয়ে সমাজ পরিচালনা করেন’।[3]
তিনি শায়খ বিন বাযের একটি উক্তি নকল করেছেন,إن هذا لا يمكن الآن تحقيقه، وهذا هو الواقع الآن، فالبلاد التي في ناحية واحدة تجدهم يجعلون انتخابات ويحصل صراع على السلطة ورشاوى وبيع للذمم إلى غير ذلك، فإذا كان أهل البلد الواحد لا يستطيعون أن يولوا عليهم واحداً إلا بمثل هذه الانتخابات المزيفة فكيف بالمسلمين عموماً؟!! هذا لا يمكن ‘আজকের যুগে একক রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্ভব নয়, এটাই বাস্তবতা। তুমি দেখবে বিভিন্ন দেশে নির্বাচন হচ্ছে, ক্ষমতার লড়াই চলছে, সেখানে ঘুষের লেনদেন, ভোট ক্রয়-বিক্রয় চলছে। যেখানে একটি দেশের জনগণই এই বানোয়াট নির্বাচন ছাড়া তাদের নেতা নির্বাচন করতে পারছে না, সেখানে সমগ্র মুসলিমদের নেতা কিভাবে নির্বাচন করবে? এটা সম্ভব না।[4] সুতরাং বর্তমান প্রেক্ষাপটকে মাথায় রেখে আমাদের নেতৃত্ব ও আনুগত্যের সীমারেখা নির্ধারণ করতে হবে। নতুবা নেতৃত্বহীনতায় মুসলিম উম্মাহ দিন দিন আরো দিশাহীন ও বিশৃংখল হ’তে থাকবে, যা মোটেও ইসলামের কাম্য হতে পারে না।
(৩) জামা‘আতবদ্ধ জীবনের গুরুত্ব অনুভব না করাও এর পিছনে বড় কারণ। তারা মনে করেন যে, জামা‘আত বলতে শুধু রাষ্ট্রই বুঝায়। প্রশ্ন হ’ল, এর উদ্দেশ্য যদি কেবল রাষ্ট্রই হ’ত তবে কি জামা‘আতবদ্ধ থাকার হুকুম কেবলমাত্র খুলাফায়ে রাশেদীনের আমল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল? কেননা খুলাফায়ে রাশেদীনের পর প্রকৃত ইসলামী খিলাফত বিদায় গ্রহণ করেছে এবং ১৯২৪ সাল থেকে নামমাত্র খিলাফতের যা বাকী ছিল, তাও পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে। আর সেই সাথে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর প্রায় সবগুলোই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। তাহলে এই পরিস্থিতিতে সমাজে দাওয়াত ও জিহাদের গুরুদায়িত্ব কিভাবে পালিত হবে? তেমনিভাবে অমুসলিম রাষ্ট্রের মুসলিম বাসিন্দারা কিভাবে ইসলামী জীবন যাপন করবে? এমতাবস্থায় একাকী দাওয়াত ও জিহাদের দায়িত্ব পালন করা কি কখনও সম্ভব? কখনও নয়। এজন্য যে কোন বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তি অনুধাবন করবেন যে, জামা‘আতবদ্ধ জীবন ছাড়া বিকল্প কোন পন্থায় প্রকৃত ইসলামী জীবন যাপন সম্ভব নয়।
আর জামা‘আতবদ্ধ জীবন অর্থই হ’ল সেখানে নেতৃত্ব ও আনুগত্য থাকা। কেননা আনুগত্য ব্যতীত কোন ইমারত বা জামা‘আত গঠিত হতে পারে না। যেকোন সংগঠনেই নেতাকে অনুসরণ ও তার নিয়মনীতি মেনে চলতে হয়। কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ করলেও তার নিয়ম-নীতির অনুসরণ করতে হয়। অথচ ইসলামী জীবনযাপনে কারু আনুগত্যের বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে না, এ কথা কি গ্রহণযোগ্য হতে পারে! উমর (রাঃ) এজন্য দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, ইসলাম হয় না জামা‘আত ছাড়া, জামা‘আত হয় না ইমারত ছাড়া এবং ইমারত হয় না আনুগত্য ছাড়া।[5]
সর্বোপরি ইসলাম সামাজিক শৃংখলার বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছে। এজন্য একক নেতৃত্ব ও একক রাষ্ট্রব্যবস্থা না থাকার এই যুগে আমাদের জন্য সংগঠনই জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপনের বিকল্প ব্যবস্থা। অথচ এ বিষয়ে বর্তমানে আমরা সর্বাধিক গাফেল ও উদাসীন। অনৈসলামিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শাসনাধীনে থাকতে থাকতে আমরা এতটাই আত্মভোলা হয়ে পড়েছি যে, নববী পদ্ধতিতে সমাজ সংশোধনের কোন তাকীদ আমরা আর অনুভব করি না। নির্দিষ্ট নেতৃত্বের অধীনে থেকে তাযকিয়া ও তারবিয়ার কঠিন দায়িত্ব পালন করতে চাই না। বরং ব্যক্তিস্বার্থ আর আত্মকেন্দ্রিকতার ঘেরাটোপে আমরা ভুলে গেছি উম্মাহর বৃহত্তর স্বার্থ, ভুলে গেছি মানবতার প্রতি মহান প্রভুর পক্ষ থেকে আমাদেরকে দেয়া দায়িত্ব। ফলে আমাদের মধ্যে একদিকে চরম নেতৃত্বহীনতা সৃষ্টি হয়েছে, অপরদিকে কারো নেতৃত্বের অধীনে আনুগত্যশালী থাকতে না চাওয়ার স্বেচ্ছাচারী মানসিকতা আমাদের গ্রাস করে ফেলেছে। আর এ কারণেই বিদ্বানদের মধ্যে বায়‘আতের আলোচনায় এই সীমাবদ্ধতা ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব পরিলক্ষিত হয় বলে আমাদের ধারণা।
প্রশ্ন-১৭. সাংগঠনিক বায়‘আত কি ছুফীদের বায়‘আতের সাথে তুলনীয় নয়?
উত্তর : বায়‘আতের অসংখ্য হাদীছ বিদ্বানদের মধ্যে অনালোচিতই থেকে যাওয়া সংশয় সৃষ্টির একটি বড় কারণ। ফলে একদল বিদ্বান অজ্ঞাতসারে সকল বায়‘আতকে এক লহমায় তাচ্ছিল্যের সাথে ‘ছুফীদের বায়‘আত’ আখ্যায়িত করে আত্মতৃপ্তি লাভ করছেন। অবলীলায় তারা সাংগঠনিক বায়‘আতকে পীরের বায়‘আতের সাথে তুলনা করেন। অথচ পীরের বায়‘আতের সাথে সাংগঠনিক বায়‘আতের কোন সম্পর্কই নেই। সাংগঠনিক বায়‘আত একটি সামাজিক আনুগত্যের শপথ বা বায়‘আত, যা সামাজিক শৃংখলা রক্ষার মাধ্যম হিসাবে গৃহীত হয়। অন্যদিকে ছূফীদের বায়‘আতের উদ্দেশ্য হ’ল গুরু-শিষ্যদের মধ্যে মরমীবাদী মেলবন্ধন তৈরী করে ফয়েয-কাশফ হাছিল করা। যার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, পদ্ধতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
যারা সাংগঠনিক বায়‘আতকে বিদ‘আতী বায়‘আত আখ্যা দেন, তাদের বক্তব্য কেবল রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতিষ্ঠিত একটি সুন্নাহ বিরোধীই নয়; বরং যা ইসলামেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশেষত্বকে নাকচ করার শামিল। কেননা বায়‘আত এমন একটি শারঈ ব্যবস্থার নাম, যা বিশৃংখল সমাজকে এক আল্লাহর নামে ওয়াদার মাধ্যমে একতাবদ্ধ করে পরস্পরকে সুসংগঠিত রাখে। পৃথিবীর অন্য কোন ধর্ম ও জাতির কাছে এমন ব্যবস্থা নেই।
তাই মানবজাতির কল্যাণে ইসলামের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ আদর্শ এবং রাসূল (ছাঃ)-এর আমলকে অবলীলাক্রমে বিদ‘আত আখ্যা দেয়ার পূর্বে শতবার ভাবা উচিৎ। সর্বোপরি যারা সাংগঠনিক বায়‘আতের বিরুদ্ধে কথা বলছেন, তারা ঢালাওভাবে কিছু অজুহাত পেশ করছেন মাত্র, যার কোন দলীল নেই। দুঃখজনকভাবে তারা ফাসেক সমাজনেতা ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রনেতাদের প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্য পোষণ করতে রাযী থাকলেও কোন ইমারতে শারঈর আনুগত্য মেনে চলতে রাযী নন। বরং একে ফিরকাবাজী বলে এড়িয়ে যান। আমরা মনে করি, এটা প্রকৃতপক্ষে সমাজের প্রতি নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ারই নামান্তর!
প্রশ্ন-১৮.রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর ছাহাবীদের যুগে খিলাফত ব্যতীত বায়‘আতের ভিন্ন দৃষ্টান্তগুলো তেমন পরিলক্ষিত না হওয়ার কারণ কী?
উত্তর : প্রথমতঃ ছাহাবীদের যুগে সাধারণ বায়‘আতের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না এটা সঠিক নয়। বরং এমন বেশকিছু দৃষ্টান্ত বিদ্যমান, যা খেলাফতের বায়‘আত ছিল না। যেমন ইমাম যাহাবী উল্লেখ করেন যে, হুসায়ন (রাঃ) তাঁর চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আক্বীলকে কুফায় পাঠালেন। তখন তার হাতে ১২ হাযার মানুষ আনুগত্যের বায়‘আত গ্রহণ করল (فدبَّ إِلَيْهِ أَهْلُ الكُوْفَةِ، فَبَايَعَهُ اثْنَا عَشَرَ أَلْفاً)।[6] এই বায়‘আত খেলাফতের বায়‘আত ছিল না, বরং মুসলিম বিন আক্বীলের মাধ্যমে হুসাইন (রা.)-এর প্রতি সাধারণ আনুগত্যসূচক বায়‘আত ছিল। অনুরূপভাবে মুআবিয়া (রাঃ) ওছমান (রাঃ)-এর হত্যার বদলা নেয়ার জন্য সিরিয়াবাসীর কাছে বায়‘আত গ্রহণ করেছিলেন। যেমন ইমাম যুহরী বলেন,لما بلغ معاوية قتل طلحة والزبير، وَظُهُوْرُ عَلِيٍّ، دَعَا أَهْلَ الشَّامِ لِلْقِتَالِ مَعَهُ عَلَى الشُّوْرَى وَالطَّلَبِ بِدَمِ عُثْمَانَ، فَبَايَعُوْهُ عَلَى ذلك أميرا غير خليفة. ‘যখন মু‘আবিয়া (রাঃ) তালহা ও যুবায়েরের মৃত্যু এবং আলী (রাঃ)-এর বিজয়ের কথা জানলেন, তখন তিনি আলী (রাঃ)-এর সাথে আলোচনা ও ওছমান (রাঃ)-এর রক্তপণ নেয়ার দাবীতে সিরিয়াবাসীকে যুদ্ধের জন্য আহবান করলেন। ফলে সিরিয়াবাসীরা তার কাছে বায়‘আত গ্রহণ করল আমীর হিসাবে, খলীফা হিসাবে নয়।[7] এই বায়‘আত ওছমান (রাঃ)-এর রক্তপণের দাবীতে যুদ্ধের জন্য গ্রহণ করা হয়েছিল, যা খিলাফতের বায়‘আত ছিল না। এসব দৃষ্টান্ত থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, সাধারণ বায়‘আত ছাহাবীদের যুগেও গৃহীত হয়েছে শাসন কর্তৃত্ব ছাড়াই। আর এ ব্যাপারে অন্য কোন ছাহাবী আপত্তিও করেননি। এমনকি আধুনিক যুগের পূর্বে কোন বিদ্বানই খিলাফত ভিন্ন সাধারণ বায়‘আতের বিষয়ে আপত্তি তোলেননি। অতএব শাসক ব্যতীত অন্যান্য সাধারণ বায়‘আতকে বাতিল মনে করা বা সুন্নাহ বিরোধী মনে করা রাসূল (ছা.)-এর প্রতিষ্ঠিত সুন্নাতের স্পষ্ট বিরুদ্ধাচরণ।
দ্বিতীয়তঃ যদি এ ব্যাপারে ছাহাবী কিংবা পরবর্তীদের কোন আমল নাও থাকত, তবুও তা আমলযোগ্য হ’ত। কেননা রাসূল (ছাঃ)-এর ছহীহ সূত্রে প্রমাণিত কোন কথা, কর্ম ও অনুমোদনসমূহ তথা সকল ছহীহ হাদীছ পরবর্তীদের জন্য পালনীয় এবং অনুসরণীয়, যতক্ষণ না তা মানসুখ হয় (منسوخ) কিংবা রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য খাছ হয় (مخصوص)। এর বাইরে পরবর্তীদের আমল না থাকা বা অন্য কোন কারণে রাসূল (ছাঃ)-এর আমল বাতিল করা যায় না। ইমাম শাফেঈ (২০৪হি.) স্পষ্টই বলেন, أن حديث رسول الله صلى الله عليه وسلم يثبت بنفسه لا بعمل غيره بعده ‘রাসূল (ছা.)-এর হাদীছ নিজেই নিজের দলীল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত, পরবর্তী কারোর আমলের দ্বারা নয়’।[8] তিনি আরও বলেন,ولو تركت السنن للعمل لتعطلت سنن رسول الله صـ ودرست رسومها وعفت آثارها ‘যদি আমল থাকা বা না থাকার ভিত্তিতে সুন্নাহকে পরিত্যাগ করতে হয় তবে রাসূল (ছাঃ)-এর বহু সুন্নাহ অকার্যকর হয়ে যাবে এবং তার নাম-নিশানা মুছে যাবে।[9]
ইবনুল কাইয়িম (৭৫১হি.) বলেন, والسنة هي العيار على العمل، وليس العمل عيارا على السنة ‘সুন্নাহই হ’ল আমলের মানদন্ড, আমল সুন্নাহর মানদন্ড নয়’।[10] ইমাম যুহরী বলেন, سَلِّمُوا لِلسُّنَّةَ وَلَا تُعَارِضُوهَا ‘তোমরা সুন্নাহর কাছে আত্মসমার্পণ কর, বিরুদ্ধাচরণ করো না’।[11] শায়খ আলবানী তামামুল মিন্নাহ গ্রন্থের ভূমিকায় সুন্নাত অনুসরণের ১৪তম মূলনীতি হিসাবে উল্লেখ করেছেন- وجوب العمل بالحديث الصحيح وإن لم يعمل به أحد ‘ছহীহ হাদীছের উপর আমল করা ওয়াজিব, যদিও তার উপর কেউ আমল না করুক’।[12]
এক্ষণে যদি কেউ বলেন যে, ছাহাবীদের যুগে শাসক ভিন্ন আর কোন বায়‘আতের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না, সেক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য-عدم علمنا ليس علماً بالعدم فربما عملوا به ولم ينقل إلينا অর্থাৎ হতে পারে যে তারা উক্ত আমল করেছিলেন, কিন্তু আমাদের পর্যন্ত তার বর্ণনা পৌঁছেনি। আমাদের না জানার কারণে কোন আমল হয়নি এটা প্রমাণিত হয় না।
উপসংহার :
প্রিয় পাঠক, বতর্মান যুগে ইসলামী খেলাফতের অবর্তমানে বিশেষ করে যেসব দেশে ইসলামী আইন ও বিধান চালু নেই অথবা অমুসলিম রাষ্ট্র যেখানে প্রচুর সংখ্যক মুসলিম বসবাস করে, তারা কীভাবে জীবন যাপন করবে? তারা কী যে যার মত চলবে বা স্ব স্ব এলাকার ইমাম, দাঈদের বক্তব্য শ্রবণ, দারস-তাদরীসে বসা ও সাধ্যমত অনুসরণ করাই তাদের জন্য যথেষ্ট হবে, নাকি ইসলামী সমাজ কায়েমের জন্য তাদের ঐক্যবদ্ধভাবে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিৎ হবে! আর বর্তমান যুগে ঐক্যবদ্ধ হ’তে চাইলে জামা‘আত বা সংগঠন ভিন্ন আর কোন বাস্তবসম্মত উপায় আছে কি?
মুসলিম উম্মাহ যখন সর্বদিক থেকে সমস্যার অতলে নিমজ্জিত, তখন কেবল দলাদলি ও পারস্পারিক হিংসা-বিদ্বেষকে বড় করে দেখে হতাশাগ্রস্ত হয়ে নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে ফেলাই কি আমাদের কর্তব্য হবে, না সাধ্যমত সমাজকে ঐক্যবদ্ধ ও লক্ষ্যপূর্ণ পথে এগিয়ে নেয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে? অপরের সমালোচনা আর কাল্পনিক ঐক্যের চিন্তা নিয়ে উদ্দেশ্যহীন বসে থাকাই সমাধানের পথ, নাকি ঐক্যের জন্য বাস্তবভিত্তিক ফলপ্রসূ কোন পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে? এ ব্যাপারগুলো মুসলিম উম্মাহর এই ক্রান্তিলগ্নে ওলামায়ে কেরামকে যেমন দায়িত্বশীলতা ও দূরদর্শিতার সাথে ভাবতে হবে, তেমনি সচেতন দ্বীনদার মানুষকেও ভাবতে হবে।
সর্বোপরি বলব, আমাদের অবস্থা হয়েছে এমন যে, আমরা বর্তমানে সামান্য কোন প্রতিষ্ঠান চালাতেও আবশ্যিকভাবে নেতৃত্ব খুঁজি, কিন্তু ইসলামী জীবন যাপনের জন্য, ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য, দাওয়াতী ময়দানকে অগ্রসর করার জন্য, ঐক্যবদ্ধভাবে বাতিলের মুকাবিলার জন্য কোন নেতৃত্বের প্রয়োজন অনুভব করি না। কেউ যদি জামা‘আতবদ্ধ হয়ে কাজ করে, তবে তাদের প্রচেষ্টাকে স্রেফ ‘দলাদলি’ আর ‘সংকীর্ণতা’ শব্দের মধ্যে বন্দী করে ফেলতে ভালবাসি। শুধু যার যার মত ব্যক্তিগতভাবে মসজিদে দাওয়াত দেয়া কিংবা মাদ্রাসায় দারস দেয়াই যদি ইসলামী সমাজ কায়েমের মাধ্যম হ’ত, তবে কোন নবীকেই সমাজ পরিবর্তনে এত বেগ পেতে হত না। কোন সমাজ সংস্কারককে এত বিপদ আর ঝুঁকির সম্মুখীন হ’তে হ’ত না।
এজন্য ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ মনে করে, বর্তমান ইসলামী খেলাফতের অবর্তমানে জামা‘আতবদ্ধ সাংগঠনিক জীবনের কোন বিকল্প নেই। আর জামা‘আতবদ্ধ জীবন মানে তা কোন ক্লাবের মত আনুগত্যহীন জমায়েতকেন্দ্র নয়, বরং তা মহান আল্লাহর নামে বায়‘আতের সাথে সম্পৃক্ত। যাতে থাকবে সমাজ সংস্কারের দৃঢ় অঙ্গীকার, থাকবে নেতৃত্বের নির্দেশনা মেনে চলার মত সুশৃংখল দাঈ ইলাল্লাহ। যাদের ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় সমাজে ইসলামের বিজয় আসবে ইনশা আল্লাহ। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমীন!
[1]. মুসলিম হা/১৮৫১; মিশকাত হা/৩৬৭৪।
[2]. ফাৎহুল বারী হা/৭০৫৩-এর ব্যাখ্যা ১৩/৭ পৃ.।
[3]. ইবনুল উছায়মীন, আশ-শারহুল মুমতি‘ (রিয়াদ : দারু ইবনুল জাওযী, ১৪২২ হি.), পৃ. ৮/১০।
[4]. তদেব।
[5]. দারেমী হা/২৫১, সনদে বিচ্ছিন্নতা রয়েছে, তবে বক্তব্য ছহীহ হাদীছসমূহের অনুকূলে।
[6]. যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৪/৩৬৪।
[7]. যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা, ২/৫২৩।
[8]. ইমাম শাফেঈ, আর-রিসালাহ, পৃ. ৪২০।
[9]. ইবনুল ক্বাইয়িম, ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন, ২/২৮৫।
[10]. ইবনুল ক্বাইয়িম, ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন, ২/২৭৪।
[11]. খত্বীব বাগদাদী, আল-ফাক্বীহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ, ১/৩৮৫।
[12]. নাছিরুদ্দীন আলবানী, তামামুল মিন্নাহ, ১/৪০-৪১।