দেশের
বিভিন্ন প্রান্তে হকপিয়াসী অনেক দ্বীনী ভাই মাযহাবী গোঁড়ামি ও তাক্বলীদে
শাখছী তথা অন্ধ ব্যক্তি পূজার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে অভ্রান্ত সত্যের উৎস
পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের পতাকাতলে সমবেত হচ্ছেন। এতে মাযহাবী ভাইদের
অনেকের গাত্রদাহ শুরু হয়েছে। তাই তারা দিশেহারা হয়ে আহলেহাদীছদের বিরুদ্ধে
বিভিন্ন অপপ্রচার, বিষোদগার ও মিথ্যাচারে মরিয়া হয়ে উঠেছে। আসলে হক পথের
স্বরূপ এমনই যে, হকপন্থীদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাবে এবং বিরুদ্ধবাদীরা
ক্রুদ্ধ হবে। ফলে তারা হকপন্থীদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত হবে।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের নিকট ইসলামের দাওয়াত দিয়ে পত্র
প্রেরণ করেন। রোম সম্রাট পত্র হাতে পেয়ে ব্যবসা উপলক্ষে সেখানে অবস্থানরত
কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান (তখনও তিনি মুসলমান হননি)-কে তার দরবারে ডেকে
পাঠান এবং তাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও মুসলমানদের সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন করেন।
তন্মধ্যে ৪,৫ ও ৬ নং প্রশ্নগুলি ছিল,
প্রশ্ন-৪ : নবুঅতের দাবী করার পূর্বে তোমরা কি কখনো তাঁর উপরে মিথ্যার অপবাদ দিয়েছ? তিনি বললেন, না। হিরাক্লিয়াস বললেন, ঠিক। যে ব্যক্তি মানুষকে মিথ্যা বলে না, সে ব্যক্তি আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যা বলতে পারে না।
প্রশ্ন-৫ : তাঁর দ্বীন কবুল করার পর কেউ তা পরিত্যাগ করে চলে যায় কি? তিনি বললেন, না। হিরাক্লিয়াস বলেন, ঈমানের প্রভাব এটাই যে, তা একবার হৃদয়ে বসে গেলে আর বের হয় না।
প্রশ্ন-৬ : ঈমানদারগণের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, না কমছে?
তিনি বললেন, বাড়ছে। হিরাক্লিয়াস বললেন, ঈমানের এটাই বৈশিষ্ট্য যে, আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পায় ও তা ক্রমে পূর্ণতার স্তরে পৌঁছে যায়। [1]
ঠিক তেমনি হ’ল আহলেহাদীছদের অবস্থা। গত কয়েক বছর যাবত আহলেহাদীছ আন্দোলন যোরদার হওয়ায় আহলেহাদীছদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এমনকি দেশের এমন কিছু এলাকা আছে, যেখানে পূর্বে আহলেহাদীছ-এর কোন অস্তিত্ব ছিল না, অথচ বর্তমানে সেখানে আহলেহাদীছদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখা যাচ্ছে। ফালিল্লাহিল হাম্দ। মাযহাবীদের অন্ধ ব্যক্তিপূজা ও গোঁড়ামির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে হাযারো হকপিয়াসী মুসলিম প্রতিনিয়ত আহলেহাদীছ হচ্ছেন এমন প্রমাণ অসংখ্য। পক্ষান্তরে কোন আহলেহাদীছ মাযহাবী হয়েছে এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। আর এটাই আহলেহাদীছদের হকপন্থী ও মুক্তিপ্রাপ্ত দল হওয়ার অন্যতম প্রমাণ।
রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) বলেছেন, لاَ يَزَالُ مِنْ أُمَّتِى أُمَّةٌ قَائِمَةٌ بِأَمْرِ
اللهِ، لاَ يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ وَلاَ مَنْ خَالَفَهُمْ حَتَّى
يَأْتِيَهُمْ أَمْرُ اللهِ وَهُمْ عَلَى ذَلِكَ. ‘আমার উম্মতের একদল লোক
সর্বদা আল্লাহর বিধানের উপর কায়েম থাকবে। যারা তাদেরকে হেয় ও বিরোধিতা করতে
চাইবে, তারা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না, এমনকি ক্বিয়ামত পর্যন্ত তারা
এভাবেই থাকবে’।[2]
ইতিমধ্যে মাযহাবী কতিপয় আলেমের পক্ষ থেকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে আমাদের নিকট কিছু প্রশ্ন প্রেরিত হয়েছে। প্রশ্নকারীদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন পিরোজপুরের জনৈক মুফতী আব্দুল মালেক ছাহেব। ইতিপূর্বে জনৈক ভাই তার প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত হ’লেও সারগর্ভ ও প্রামাণ্য জবাব দিয়েছেন। প্রত্যুত্তরে জনাব আব্দুল মালেক ছাহেব উত্তরদাতাকে সহ আহলেহাদীছদেরকে এমনভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও হেয় প্রতিপন্ন করে আত্মম্ভরিতা প্রকাশ করেছেন যা সত্যিই অনভিপ্রেত। তার অহংকার ও অহমিকা তার প্রত্যুত্তর থেকেই প্রতীয়মান হয়। ভাবখানা এই যে, তিনি ও তার মাযহাবী আলেমগণই শুধু কুরআন-হাদীছ বুঝেন, আর কেউই বুঝেন না। প্রবাদ আছে, ‘খালি কলসি বাজে বেশী’। প্রকৃত জ্ঞানী যারা তারা কখনো নিজেকে বড় মনে করেন না এবং নিজের বড়ত্ব যাহির করেন না। বরং তারা হন ভদ্র, বিনয়ী, মিতভাষী, সহনশীল ও হিতৈষী।
আসলে সত্যকে গ্রহণ করার যোগ্যতা ও সৌভাগ্য আল্লাহ তা‘আলা সবাইকে দান করেননি। আবু জাহলের পূর্বনাম ছিল ‘আবুল হাকাম’ তথা জ্ঞানের পিতা। কিন্তু হককে গ্রহণ না করায় পরবর্তীতে তার নামকরণ হয়েছে ‘আবু জাহল’ তথা মূর্খের পিতা। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে- ‘ঘুমন্ত ব্যক্তিকে জাগানো যায়, কিন্তু যে ঘুমের ভান করে তাকে জাগানো যায় না’।
এক্ষণে আমরা মাযহাবী ভাইদের উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর উত্তর পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে প্রদান করতে প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ। যিদ ও হঠকারিতা ছেড়ে নিরপেক্ষ মনে উত্তরগুলো পড়লে সত্যের দিশা পাবেন ইনশাআল্লাহ।
প্রশ্ন- ১ : أُولِي الْأَمْرِ কথার অর্থ কি?
প্রশ্ন- ২ : فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِيْ شَيْءٍ فَرُدُّوْهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُوْلِ
‘অতঃপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে লিপ্ত হয়ে পড়, তাহ’লে তা আল্লাহ এবং রাসূলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর’ (নিসা ৪/৫৯)। এই অংশ তার পূর্বের অংশের সাথে কিভাবে সম্পর্কযুক্ত?
أُولِي الْأَمْرِ-এর অনুকরণে যদি বিবাদ সৃষ্টি হয় তাহ’লে কি আল্লাহ ও রাসূলের দিকে প্রত্যর্পণ করব, নাকি আগেই আল্লাহ এবং রাসূলের অনুসরণ করব? কথাগুলোর ব্যাখ্যা কি?
উত্তর : প্রশ্ন দু’টি একই আয়াতের দু’টি অংশ এবং প্রথমাংশটি দ্বিতীয়াংশের সাথে সম্পর্কযুক্ত হওয়ায় দু’টির উত্তর একই সাথে প্রদান করা হ’ল।-
কোন আয়াতের অংশ বিশেষ দ্বারা আয়াতের সঠিক মর্ম উপলব্ধি করা যায় না। বিশেষ করে যদি আয়াতের একাংশ অপরাংশের পরিপূরক ও নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত হয়। তাতে আয়াতের উদ্দেশ্য ব্যাহত হয় এবং মর্মার্থের বিপর্যয় ঘটে। তাই প্রথমে পুরো আয়াতটি উল্লেখ করা হ’ল। মহান আল্লাহ বলেন,
يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا أَطِيْعُوْا اللهَ وَأَطِيْعُوْا الرَّسُوْلَ وَأُولِيْ الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِيْ شَيْءٍ فَرُدُّوْهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُوْلِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيْلاً-
‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর ও তোমাদের নেতৃবৃন্দের আনুগত্য কর। অতঃপর যদি কোন বিষয়ে তোমরা বিতন্ডা কর, তাহ’লে বিষয়টি আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও। যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক। এটাই কল্যাণকর ও পরিণতির দিক দিয়ে সর্বোত্তম’ (নিসা ৪/৫৯)।
أُولُوا الْأَمْرِ শব্দদ্বয় ব্যাপক অর্থবোধক। মুফাসসিরগণ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এর অর্থ করেছেন, যা নিম্নরূপ।-
সর্বাধিক হাদীছ বর্ণনাকারী ছাহাবী আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, أُولُوا الْأَمْرِ হ’লেন রাজা-বাদশাহ, শাসনকর্তা প্রমুখ (ইবনু জারীর)। মায়মূন বিন মিহরান, মুক্বাতিল, কালবী প্রমুখ মুফাসসির বলেন, ‘যুদ্ধের সেনাপতি’ (কুরতুবী)।
জালালুদ্দীন সূয়ুতী (রহঃ) বলেন, أُولُوا الْأَمْرِ হ’লেন ‘যাদের হাতে শাসন করার দায়িত্ব থাকে’ (জালালাইন)।
আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ), মুজাহিদ, আত্বা প্রমুখ মুফাসসির বলেন, أُولُوا الْأَمْرِ হ’লেন ‘ওলামা ও ফুক্বাহা’ (ইবনু জারীর)। মুজাহিদ (রহঃ) আরো বলেন, أُولُوا الْأَمْرِ হ’লেন ‘মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণ’ (কুরতুবী)। ইকরিমা বলেন, أُولُوا الْأَمْرِ হ’লেন আবুবকর ও ওমর (রাঃ) (ইবনু জারীর)।
ইবনু কাছীর (রহঃ) أُولُوا الْأَمْرِ-এর তাফসীরে লিখেছেন, أن الآية في جميع أولي الأمر من الأمراء والعلماء، ‘শাসকগণ এবং ওলামা ও সকল শ্রেণীর আদেশদাতা উক্ত আয়াতের অন্তর্ভুক্ত’(ইবনু কাছীর)।
নাসাফী (রহঃ) বলেন, أُولُوا الْأَمْرِ হ’লেন রাষ্ট্রনায়ক বা আলেমগণ। কারণ তাদের নির্দেশ অধীনস্ত নেতাদের উপর বিজয়ী হয়। আয়াতটি প্রমাণ করে যে শাসকদের কথা তখন মানা আবশ্যক, যখন তারা সত্যের উপর থাকেন। কিন্তু যদি তারা সত্যের বিরোধিতা করেন, তাহ’লে তাদের কথা মানা যাবে না। কারণ রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, لاَ طَاعَةَ لِمَخْلُوْقٍ فِىْ مَعْصِيَةِ الْخَالِقِ ‘স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির প্রতি কোন আনুগত্য নেই’ (নাসাফী)।
আলূসী (রহঃ) বলেন, ‘উলুল আমর’-এর ব্যাখ্যায় মতভেদ আছে। কেউ বলেন, ‘উলুল আমর’ হ’লেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগে ও তাঁর পরে মুসলমানদের শাসকগণ। তাঁদের সাথে খলীফাগণ এবং বাদশাহ ও বিচারপতিগণও শামিল। কারো মতে যুদ্ধের নেতাগণ ও কারো মতে বিদ্বানগণ (রূহুল মা‘আনী)।
বাগাভী (রহঃ) বলেন, ‘উলুল আমর’-এর ব্যাখ্যায় মতভেদ আছে। বিখ্যাত ছাহাবী ইবনু আববাস ও জাবির (রাঃ) বলেন, তাঁরা হ’লেন সেসব ফক্বীহ ও আলিমগণ যাঁরা লোকদেরকে দ্বীন শিক্ষা দেন। আলী (রাঃ) বলেন, একজন নেতার জন্য অপরিহার্য হচ্ছে আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তদনুযায়ী ফায়ছালা দেওয়া এবং আমানত আদায় করা। যখন তাঁরা এরূপ করবেন, তখন তাঁদের প্রজাদের কর্তব্য হচ্ছে তাঁদের কথা শোনা ও মানা (তাফসীর বাগাভী)।
ছানাউল্লাহ পানিপথী বলেন, ‘উলুল আমর’ হ’লেন, ফক্বীহ ও আলেমগণ এবং শিক্ষাগুরুগণ। তাঁদের হুকুম তখনই মানা অপরিহার্য হবে, যখন তা শরী‘আতসম্মত হবে (তাফসীর মাযহারী)।
মুফতী মুহাম্মাদ শফী বলেন, ‘উলুল আমর’ আভিধানিক অর্থে সে সমস্ত লোককে বলা হয়, যাদের হাতে কোন বিষয়ের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পিত থাকে। সে কারণেই ইবনে আববাস, মুজাহিদ ও হাসান বছরী প্রমুখ মুফাসসিরগণ ওলামা ও ফুক্বাহা সম্প্রদায়কে ‘উলুল আমর’ সাব্যস্ত করেছেন। তাঁরাই হচ্ছেন মহানবী (ছাঃ)-এর নায়েব বা প্রতিনিধি। তাঁদের হাতেই দ্বীনী ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পিত।
এছাড়া
তাফসীরে ইবনে কাছীর এবং তাফসীরে মাযহারীতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ শব্দটির
দ্বারা (ওলামা ও শাসক) উভয় শ্রেণীকেই বুঝায়। কারণ নির্দেশ দানের বিষয়টি
তাঁদের উভয়ের সাথেই সম্পর্কিত।[3]
সাইয়েদ
আবুল আ‘লা মওদূদী, আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্যের স্বরূপ সম্পর্কে বিশদ
আলোচনার পর লিখেছেন, তৃতীয় আর একটি আনুগত্য ইসলামী জীবন ব্যবস্থার
আওতাধীনে মুসলমানদের ওপর ওয়াজিব। সেটি হচ্ছে মুসলমানদের মধ্য থেকে ‘উলিল
আমর’ তথা দায়িত্ব ও ক্ষমতার অধিকারীদের আনুগত্য। মুসলমানদের সামাজিক ও
সামষ্টিক কার্যকলাপের ক্ষেত্রে দায়িত্বসম্পন্ন ও নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তি
মাত্রই ‘উলিল আমর’-এর অন্তর্ভুক্ত। তারা মুসলমানদের মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও
চিন্তাগত ক্ষেত্রে নেতৃত্বদানকারী ওলামায়ে কেরাম বা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ
হ’তে পারেন। আবার দেশের শাসনকার্য পরিচালনাকারী প্রশাসকবৃন্দ হ’তে পারেন,
অথবা আদালতে বিচারের রায় প্রদানকারী বিচারপতি বা তামাদ্দুনিক ও সামাজিক
বিষয়ে গোত্র, মহল্লা ও জনবসতির নেতৃত্বদানকারী সরদার বা প্রধানও হ’তে
পারেন। মোটকথা যে ব্যক্তি যে কোন পর্যায়েই মুসলমানদের নেতৃত্বদানকারী হবেন,
তিনি অবশ্যই আনুগত্য লাভের অধিকারী হবেন।[4]
উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আয়াতে বর্ণিতأُولِى الأَمْرِ শব্দদ্বয় ব্যাপক অর্থবোধক। যা দ্বারা নির্দিষ্ট কোন ইমাম, মুজতাহিদ, ফক্বীহ বা শাসককে বুঝায় না। বরং এর দ্বারা ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সমাজনেতা সহ সকল পর্যায়ের কর্তৃত্বশীলদের বুঝায়।
কিন্তু দুঃখজনক হ’লেও সত্য যে, আলোচিত ‘উলিল আমর’ কথাটি মাযহাবীদের মূল পুঁজি। এই আয়াতাংশটির কল্পিত ব্যাখ্যা করেই মূলতঃ মাযহাব তথা নির্দিষ্ট ইমামের তাক্বলীদকে অপরিহার্য করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, চার মাযহাবকে ‘চার ফরয’ ঘোষণা করা হয়েছে। যা আল্লাহ তা‘আলার উপর মিথ্যা অপবাদ মাত্র । আল্লাহ বলেন, وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللهِ الْكَذِبَ ‘তার চেয়ে অধিক যালিম আর কে আছে, যে আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে’ (ছফ ৬১/৭)।
উক্ত আয়াতাংশ দ্বারা যে শুধু ইমাম চতুষ্টয় বা তাঁদের কোন একজনকে নির্দিষ্ট করে বুঝানো হয়নি, তা সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায় ‘উলিল আমর’-এর সাথে সংযুক্ত مِنْكُمْ শব্দ দ্বারা। আরবী ভাষায় যাদের ন্যূনতম জ্ঞান আছে তারা ভালোভাবেই জানেন যে, مِنْكُمْ শব্দের অর্থ হ’ল ‘তোমাদের মধ্যকার’। এর দ্বারা অতীত বুঝায় না। বরং বর্তমান উলুল আমরকে বুঝায়। যেমন আল্লাহ বলেন, فَلْيَصُمْه فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ ‘তোমাদের মধ্যেকার যে ব্যক্তি মাসটি (রামাযান মাস) পায়, সে যেন ছিয়াম রাখে’ (বাক্বারাহ ২/১৮৫)। فَمَنْ كَانَ مِنْكُمْ مَرِيْضًا ‘অতঃপর তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ হবে’ (বাক্বারাহ ২/১৮৪)। أَوْ جَاءَ أَحَدٌ مِنْكُمْ مِنَ الْغَائِطِ ‘অথবা তোমাদের মধ্য হ’তে যদি কেউ পায়খানা থেকে আসে’ (নিসা ৪/৪৩)। রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا ‘তোমাদের মধ্যকার যে ব্যক্তি কোন গর্হিত কাজ দেখবে’।[5] এভাবে কুরআনে ও হাদীছে যত জায়গায় مِنْكُمْ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, সব জায়গায় জীবিত ও বর্তমান ব্যক্তিদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে। অনুরূপভাবে أُولِى الأَمْرِ مِنْكُمْ দ্বারা স্ব স্ব যুগের ওলামা-ফুক্বাহা বা শাসকবর্গকে বুঝানো হয়েছে। সুতরাং أُولِى الأَمْرِ مِنْكُمْ দ্বারা অতীত কালের কোন একজন নির্দিষ্ট ইমামের তাক্বলীদ করার দলীল কোথায়?
সম্মানিত প্রশ্নকারী বিষয়টি বুঝতে পেরেই চতুরতার সাথে কেবল أُولِى الأَمْرِ অর্থ কি? এই প্রশ্ন করেছেন। কিন্তু أُولِى الأَمْرِ مِنْكُمْ অর্থ কি? সে প্রশ্ন করেননি। কেননা তার উদ্দেশ্য হ’ল প্রায় ১৩শ’ বছর পূর্বে মৃত্যুবরণকারী তাদের নির্দিষ্ট ইমামের তাক্বলীদের দলীল খোঁজা।
হানাফী বিদ্বান তাকী ওছমানী অনেক মেধা ও শ্রম ব্যয় করে কুশলী বিন্যাসে যুক্তির আশ্রয়ে ‘মাযহাব কি ও কেন’? শিরোনামে যে গ্রন্থ রচনা করেছেন, সেখানে মাযহাব তথা তাক্বলীদে শাখছী অর্থাৎ বিনা দলীলে নির্দিষ্ট কোন ইমামের অনুসরণের পক্ষে ‘আহকামুল কুরআন’ প্রণেতা আবুবকর জাসসাসের বরাতে যে তাফসীরাংশ পেশ করেছেন তাতেও নির্দিষ্ট এক ইমামের তাক্বলীদ করার কথা প্রমাণিত হয়নি। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে সেই তাফসীরাংশটি হুবহু পেশ করা হ’ল।
فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُولِ (سورة النساء آية 59 (يدل على أن أولي الأمر هم الفقهاء، لأنه أمر سائر الناس بطاعتهم ثم قال : فإن تنازعتم في شيء فردوه إلى الله والرسول فأمر أولي الأمر برد المتنازع فيه إلى كتاب الله وسنة نبيه صلى الله عليه وسلم إذ كانت العامة ومن ليس من أهل العلم ليست هذه منزلتهم، لأنهم لا يعرفون كيفية الرد إلى كتاب الله والسنة ووجوه دلائلهما على أحكام الحوادث فثبت أنه خطاب للعلماء-
(فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ) অংশটি প্রমাণ করে যে, উলুল আমর হ’লেন ফক্বীহগণ। কেননা সর্বসাধারণকে তাদের অনুসরণের আদেশ দেয়া হয়েছে। অতঃপর আল্লাহ বলেন, ‘আর যদি তোমরা কোন বিষয়ে মতভেদে লিপ্ত হও, তাহ’লে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে সোপর্দ কর’। সুতরাং উলিল আমরকে বিরোধপূর্ণ বিষয়গুলো কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে সমাধান করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কেননা সাধারণ লোকেরা এবং যারা আলেম নন, তারা সেই পর্যায়ের নন। কেননা তারা কুরআন-হাদীছের মাধ্যমে ফায়ছালা করার পদ্ধতি অবগত নয় এবং সংঘটিত বিধানের ক্ষেত্রে দলীল পেশ করতেও জানে না। সুতরাং প্রমাণিত হ’ল যে, আয়াতের শেষাংশে আলিম মুজতাহিদগণকেই সম্বোধন করা হয়েছে।[6] উক্ত তাফসীরাংশে ‘ফুক্বাহা’ ও ‘ওলামা’ শব্দ এসেছে, যা একবচন নয় বরং বহুবচন। সুতরাং এ তাফসীরের মধ্যে নির্দিষ্ট একজন ইমামের মাযহাব মান্য করা বা তার তাক্বলীদ করার দলীল কোথায়?
আমাদের এ আলোচনায় কোন সুযোগসন্ধানী প্রশ্ন করতে পারেন যে, আহলেহাদীছগণ কি তাহ’লে নির্দিষ্ট একজন ইমামের তাক্বলীদ না করে বহু ইমামের তাক্বলীদ করেন? এর উত্তর হ’ল আহলেহাদীছগণ নির্দিষ্ট কোন একজন ইমামের তো নয়ই; বহু ইমাম বা মুজতাহিদেরও তাক্বলীদ করেন না। কারণ তাক্বলীদ অর্থ কারো কোন কথা বিনা দলীলে মেনে নেওয়া। আহলেহাদীছগণ দল-মত নির্বিশেষে যেকোন ইমাম, মুজতাহিদ, মুহাদ্দিছ, মুফাসসির, আলেম, ফক্বীহ-এর কথা মান্য করেন, যখন তারা কুরআন ও ছহীহ হাদীছের প্রামাণ্য দলীলের ভিত্তিতে কোন ফায়ছালা পেশ করেন।
أُولِى الأَمْرِ আয়াতাংশ দ্বারা যতটুকু আলেমদেরকে বুঝানো হয়েছে, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশী শাসক, প্রশাসক, দায়িত্বশীল ও সেনাপতিদেরকে বুঝানো হয়েছে। যা অত্র আয়াতের শানে নুযূল ও তাফসীর থেকে প্রতীয়মান হয়।
শানে নুযূল :
ছহীহ বুখারীর কিতাবুত তাফসীর ও মাগাযী এবং তাফসীর ইবনে কাছীর, কুরতুবী, ত্বাবারী সহ অধিকাংশ তাফসীরে এসেছে যে, আয়াতটি আব্দুল্লাহ বিন হুযাফাহ বিন ক্বায়েস সাহমী সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। ঘটনাটি ছিল নিম্নরূপ।-
আলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) একটি সেনাদল প্রেরণ করেন এবং আনছারদের এক ব্যক্তিকে তার সেনাপতি নিযুক্ত করে তিনি তাদেরকে তাঁর আনুগত্য করার নির্দেশ দেন। (কোন কারণে) আমীর রাগান্বিত হয়ে যান। তিনি বললেন, রাসূল (ছাঃ) কি তোমাদেরকে আমার আনুগত্য করতে নির্দেশ দেননি? তাঁরা বললেন, অবশ্যই। তিনি বললেন, তাহ’লে তোমরা কিছু কাঠ সংগ্রহ করে আনো। তাঁরা কাঠ সংগ্রহ করলেন। তিনি বললেন, এগুলোতে আগুন লাগিয়ে দাও। তাঁরা ওতে আগুন লাগালেন। তখন তিনি বললেন, এবার তোমরা সকলে এ আগুনে প্রবেশ কর। তারা আগুনে প্রবেশ করতে সংকল্প করে ফেললেন। কিন্তু তাদের কয়েকজন অন্যদের বাধা দিয়ে বললেন, আগুন থেকেই তো আমরা পালিয়ে গিয়ে নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে আশ্রয় নিয়েছিলাম। এভাবে ইতস্তত করতে করতে আগুন নিভে গেল এবং তার রাগও প্রশমিত হ’ল। এরপর এ সংবাদ নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে পৌঁছলে তিনি বললেন, যদি তারা আগুনে ঝাঁপ দিত, তাহ’লে ক্বিয়ামতের দিন পর্যন্ত আর এ আগুন থেকে বের হ’তে পারত না। আনুগত্য (করতে হবে) কেবল সৎ কাজে (বুখারী হা/৭১৪৫)।[7] আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, ঐ সময় সেনাপতি বলেন, أَمْسِكُوا عَلَى أَنْفُسِكُمْ فَإِنَّمَا كُنْتُ أَمْزَحُ مَعَكُمْ ‘তোমরা থাম। আমি তোমাদের সাথে স্রেফ হাসি-ঠাট্টা করতে চেয়েছিলাম মাত্র’ (ইবনু মাজাহ হা/২৮৬৩)। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, নিসা ৫৯ আয়াতটি অত্র ঘটনার প্রেক্ষিতে নাযিল হয়’ (বুখারী হা/৪৫৮৪ ‘তাফসীর’ অধ্যায়, সূরা নিসা ৫৯ আয়াত)।
উল্লিখিত শানে নুযূল ও তাফসীর থেকে প্রমাণিত হ’ল যে, আয়াতেأُولِى الأَمْرِ দ্বারা মূলতঃ শাসন ক্ষমতার অধিকারী শাসক, প্রশাসক, যুদ্ধের সেনাপতি, কর্তৃত্বশীল নেতৃবৃন্দকে বুঝানো হয়েছে। কোন আলেম বা ফক্বীহকে নয়। কেননা সাধারণত কোন আলেম বা ফক্বীহ আদেশ দানের ক্ষমতা রাখেন না। যেমন মদীনায় রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভের পূর্বে মাক্কী জীবনে আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় রাসূলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, فَذَكِّرْ إِنَّمَا أَنْتَ مُذَكِّرٌ، لَسْتَ عَلَيْهِمْ بِمُصَيْطِرٍ ‘অতএব তুমি উপদেশ দাও, তুমি একজন উপদেশদাতা মাত্র। তুমি তাদের উপর শাসক নও’ (গাশিয়া ৮৮/২১-২২)।
উপরোক্ত আয়াত দু’টি দ্বারা বুঝা যায় যে, মদীনায় রাষ্ট্র ক্ষমতা পাওয়ার পূর্বে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এরও শাসন ক্ষমতা ছিল না এবং তিনি দন্ডবিধি তথা হুদূদ কায়েম করার অধিকারী ছিলেন না। অনুরূপভাবে আলেম, ফক্বীহ ও মুজতাহিদগণও উপদেশদাতা মাত্র, হুদূদ কায়েমকারী নন। তবে তাদের মধ্যে কেউ শাসন ক্ষমতার অধিকারী হ’লে তাদের কথা ভিন্ন। কিন্তু দুঃখজনক হ’লেও সত্য যে, أُولِى الأَمْرِ-এর অর্থ কোন কোন মুফাসসির ‘ওলামা, ফুক্বাহা’ করায় ওটাকে পুঁজি করে মাযহাবী ভাইয়েরা প্রথমে ইমাম চতুষ্টয়কে মান্য করা ওয়াজিব করেছেন। অতঃপর চার ইমামের একই বিষয়ে চার ধরনের ফৎওয়া থেকে যার যার সুবিধা অনুযায়ী ফৎওয়া গ্রহণ করেছেন। সেই সাথে চার ইমামের যেকোন একজনের ফৎওয়া মানা ওয়াজিব করা হয়েছে। এভাবে শূন্য থেকে বিন্দু বানিয়ে সেখান থেকে সিন্ধু বানানো হয়েছে।
মাযহাবীদের জন্য নির্মম বাস্তবতা :
মাযহাবীগণ
أُولِى الأَمْرِ مِنْكُمْ-এর কপোলকল্পিত ব্যাখ্যা করে নির্দিষ্ট ইমাম তথা
মাযহাব মানাকে অপরিহার্য করেছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হ’ল أُولِى الأَمْرِ
مِنْكُمْ-এর অনুবাদ করার সময় ‘তোমাদের ইমামদের/ আলেমদের/ফক্বীহদের/
মুজতাহিদদের অনুগত হও’ এমন অনুবাদ না করে সঠিক অনুবাদ করেছেন। এজন্য
মাযহাবীগণকে সাধুবাদ জানাই। যেমন, (১) সরকারী প্রতিষ্ঠান ‘ইসলামিক
ফাউন্ডেশন’ থেকে অনূদিত আল-কুরআনুল কারীমেأُولِى الأَمْرِ -এর অর্থ করা
হয়েছে, ‘যাহারা তোমাদের মধ্যে ক্ষমতার অধিকারী’।[8]
(২) বাংলাদেশের খ্যাতনামা হানাফী আলেম মাওলানা মুহিউদ্দীন খান অনূদিত সংক্ষিপ্ত তাফসীর মাআরেফুল কুরআনে এ আয়াতাংশের অনুবাদ করা হয়েছে, (নির্দেশ মান্য কর) ‘তোমাদের মধ্যে যারা বিচারক তাদের’।
(৩) প্রখ্যাত হানাফী গবেষক আব্দুল মান্নান তালিব অনূদিত ও আববাস আলী খান সম্পাদিত ‘তাফহীমুল কুরআন’-এ উক্ত আয়াতাংশের অনুবাদ করা হয়েছে, ‘আর (আনুগত্য কর) সেইসব লোকের, যারা তোমাদের মধ্যে দায়িত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী’।
(৪) অন্যান্য হানাফী প্রকাশনী থেকে অনূদিত কুরআনে أُولِى الأَمْرِ مِنْكُمْ-এর অনুবাদ নিম্নরূপ :
নিউ ইসলামিয়া লাইব্রেরী, আফতাবীয়া লাইব্রেরী, বাংলাদেশ তাজ কোম্পানী, নেছারিয়া লাইব্রেরী, আনোয়ারা লাইব্রেরী, সোলেমানিয়া বুক হাউজ, ঢাকা প্রকাশিত বঙ্গানুবাদ কুরআনে উলিল আমরের অর্থ করা হয়েছে- তোমাদের শাসকদের অনুগত হও’। এছাড়া মীনা বুক হাউজ, ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত বঙ্গানুবাদ কুরআনে অর্থ করা হয়েছে- ‘তোমাদের মধ্যকার (ন্যায়বান) নেতৃবৃন্দের’। তদ্রূপ খান কুতুব খানা, ঢাকা থেকে প্রকাশিত বঙ্গানুবাদ কুরআনে অর্থ করা হয়েছে- ‘তোমাদের (ন্যায়বান) শাসকদের মান্য কর’।
উল্লিখিত অনুবাদ সমূহ থেকে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয় যে, أُولِى الأَمْرِ কোন আলেম, ফক্বীহ বা মুজতাহিদ নন। বরং أُولِى الأَمْرِ হ’লেন, শাসক, বিচারক, দায়িত্বশীল এবং কর্তৃত্বের বা ক্ষমতার অধিকারী। উপরোক্ত অনুবাদগুলি কোন আহলেহাদীছ বিদ্বান করেননি। বরং এ সকল অনুবাদ হানাফী আলেমগণই করেছেন, যা হানাফী মাযহাবের বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
মাযহাবী ভাইদের প্রতি আমাদের সবিনয় জিজ্ঞাসা যে, أُولِى الأَمْرِ مِنْكُمْ আয়াতাংশের কপোলকল্পিত ব্যাখ্যা করে প্রথমে তাক্বলীদ করা, অতঃপর ইমাম চতুষ্টয়ের চার মাযহাব মানাকে ফরয বা ওয়াজিব সাব্যস্ত করলেন। অতঃপর বিভিন্ন বাহানা ও খোঁড়া যুক্তি দিয়ে নির্দিষ্ট এক ইমামকে মানা, অতঃপর নির্দিষ্ট এক মাযহাব মানাকে ফরয বা ওয়াজিব সাব্যস্ত করলেন।[9] কিন্তু সেই আয়াতাংশ অনুবাদের সময় সঠিক অনুবাদ ‘তোমাদের শাসকের অনুগত হও’ করলেন কেন? কুরআনের অনুবাদের সময় মনগড়া অনুবাদ করতে আল্লাহর ভয়ে বুক কাঁপে! তাই সঠিক অনুবাদ করেন। কিন্তু ঐ একই আয়াতের মনগড়া ব্যাখ্যা করে ‘মাযহাব’ মানা ফরয বলতে আল্লাহর ভয়ে বুক কাঁপে না কেন?
মাযহাবী ভাইদের জন্য পরামর্শ :
যেভাবে أُولِى الأَمْرِ مِنْكُمْ-এর সঠিক অনুবাদ করেছেন, অনুরূপভাবে সকল গোঁড়ামি ও অন্ধ ব্যক্তিপূজা ছেড়ে সঠিক ব্যাখ্যায় ফিরে আসুন। অর্থাৎ মাযহাব ও তাক্বলীদ ছেড়ে দিন। নতুবা আপনাদের অনূদিত কুরআন মাজীদেরأُولِى الأَمْرِ مِنْكُمْ-এর অনুবাদে মনগড়া অপব্যাখ্যার ন্যায় লিখুন ‘তোমরা তোমাদের নির্দিষ্ট ইমাম বা মাযহাবের অনুগত হও’ (নাঊযুবিল্লাহ)।
প্রশ্ন-৩ :أُولِى الأَمْرِ -এর অনুকরণের ভিতর যদি বিবাদ সৃষ্টি হয় তাহ’লে কি আল্লাহ এবং রাসূলের দিকে প্রত্যর্পণ করব, নাকি আগেই আল্লাহ এবং রাসূলের অনুকরণ করব?
উত্তর : যে সকল বিষয়ে কুরআন ও ছহীহ হাদীছে সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন বিধান রয়েছে, সে সকল বিষয়ে আগেই আল্লাহ এবং রাসূলের অনুকরণ তথা তাঁদের বিধান মানতে হবে। কেননা আল্লাহ এবং রাসূলের আনুগত্য হবে শর্তহীনভাবে আর أُولِى الأَمْرِ-এর আনুগত্য হবে শর্তাধীন। আর সে শর্তগুলো হ’ল- (১) أُولِى الأَمْرِ -এর আনুগত্য ঐ পর্যন্ত করতে হবে, যে পর্যন্ত তিনি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের বিধান অনুযায়ী নির্দেশ দিবেন। (২)أُولِى الأَمْرِ -এর সিদ্ধান্তে মতবিরোধ হ’লে তাদের কোন পক্ষের সিদ্ধান্ত না মেনে আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি বিষয়টাকে প্রত্যর্পণ করতে হবে। অর্থাৎ কিতাব ও সুন্নাহর দিকে। (৩) নেতা ন্যায়পরায়ণ ও আমানতদার হ’লে তার আনুগত্য করতে হবে, নতুবা নয়।
আলী (রাঃ) বলেন,
حق على الإمام أن يحكم بالعدل، ويؤدي الأمانة؛ فإذا فعل ذلك وجب على المسلمين أن يطيعوه؛ لأن الله تعالى أمرنا بأداء الأمانة والعدل، ثم أمر بطاعته.
‘নেতার
কর্তব্য হ’ল ন্যায়সঙ্গত ফায়ছালা করা এবং আমানত রক্ষা করা। যখন তিনি এ কাজ
করবেন, তখন মুসলমানদের প্রতি ওয়াজিব হ’ল তাঁর আনুগত্য করা। কেননা আল্লাহ
তা‘আলা আমাদেরকে আদেশ দিয়েছেন আমানত রক্ষা করতে এবং ন্যায়বিচার করতে। অতঃপর
নেতার আনুগত্য করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।[10]
অতএব সর্বপ্রথম আল্লাহ ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আনুগত্য করতে হবে। এর সুদৃঢ় প্রমাণ আয়াতের বাচনভঙ্গি থেকেই পাওয়া যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,قُلْ أَطِيْعُوْا اللهَ وَالرَّسُوْلَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ الْكَافِرِيْنَ ‘তুমি বল, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর। যদি তারা এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহ’লে (তারা জেনে রাখুক যে) আল্লাহ কাফিরদের ভালবাসেন না’ (আলে ইমরান ৩/৩২)।
উল্লেখ্য যে, আয়াতে আল্লাহ এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আনুগত্যের বিধান বর্ণনার ক্ষেত্রে উভয় স্থানে পৃথকভাবে أَطِيعُوا শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু أُولِى الأَمْرِ -এর পূর্বে أَطِيعُوْا ‘আনুগত্য কর’ শব্দটি উল্লেখ না করে শুধু আত্ফ হিসাবে واو উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বুঝা যায় যে, গুরুত্বের বিবেচনায় আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্য এবং أُولِى الأَمْرِ-এর আনুগত্য সমপর্যায়ের নয়। আর এটাও বুঝা যায় যে, উলুল আমরের আনুগত্য রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি আনুগত্যের শর্তাধীন।
তাছাড়া উপরোক্ত আয়াত ব্যতীত কুরআনুল কারীমে আরও যত স্থানে আনুগত্যের বিষয়টি এসেছে, সকল স্থানে কেবল আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্যের কথা এসেছে। যেমন সূরা নূর ৫৪, ৫৬; সূরা নিসা ৬৪, ৬৯, ৮০ ইত্যাদি।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য হবে নিঃশর্তভাবে এবং أُولِى الأَمْرِ বা শাসকের আনুগত্য হবে শর্তসাপেক্ষে। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, يَقُوْدُكُمْ بِكِتَابِ اللهِ فَاسْمَعُوْا لَهُ وَأَطِيْعُوْا ‘যদি তিনি তোমাদেরকে আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী পরিচালনা করেন, তাহ’লে তোমরা তার কথা শোন ও তার আনুগত্য কর’।[11] সুতরাং এ আনুগত্য অর্থ তাক্বলীদ করা নয়। আর এর দ্বারা নির্দিষ্ট একজন ইমামের অনুসরণ ও তাঁর মাযহাবের তাক্বলীদ করা বুঝায় না। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন- আমীন!
[1]. বুখারী হা/৭ ও অন্যান্য; সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) ২য় সংস্করণ পৃ: ৪৬৯।
[2]. বুখারী হা/৩৬৪১; মিশকাত হা/৬২৭৬।
[3]. মুফতী মুহাম্মাদ শফী প্রণীত, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান অনূদিত তাফসীর মাআরেফুল কোরআন (সংক্ষিপ্ত), পৃঃ ২৬০।
[4]. সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী, তাফহীমুল কুরআন আব্দুল মান্নান তালিব অনূদিত (ঢাকা : আধুনিক প্রকাশনী, ১৪২৬ হিঃ/২০০৫ ইং), ২/১৪৫ পৃঃ।
[5]. মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯০৯ ‘সৎকাজের আদেশ’ অধ্যায়।
[6]. মাওলানা তাকী উছমানী, মাযহাব কি কেন? অনুবাদ : আবু তাহের মেসবাহ (ঢাকা : মোহাম্মদী বুক হাউস, তাবি), পৃঃ ২১।
[7]. সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) ২য় সংস্করণ, সারিইয়াহ ক্রমিক ৮৭, পৃ. ৫৮২।
[8]. ইফাবা প্রকাশিত বঙ্গানুবাদ আল-কুরআনুল কারীম, পৃঃ ১৩০।
[9]. মাযহাব কি ও কেন? পৃঃ ১৯-২০, ৫৭-৬৩।
[10]. কুরতুবী, তাফসীর সূরা নিসা ৫৯ আয়াত।
[11]. মুসলিম হা/১২৯৮; মিশকাত হা/৩৬৬২।