কখনও
ভাবিনি নিজেকে কোর্ট-কাচারীতে যেতে হবে। ভাবিনি উকিল-মুখতার হ’তে হবে অথবা
জজ-ব্যারিস্টার ইত্যাদি! তবে একথা সত্য যে, পরিবার ও সমাজের
হিতাকাঙ্ক্ষীদের বড় স্বপ্ন ছিল যে, অমুকের ছেলে অমুক বড় একটা কিছু হবে।
কিন্তু না! কিছুদিন যেতে না যেতেই তাদের সে স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেল। চুরমার
হয়ে গেল তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভেস্তে গেল পারিবারিক সকল পরিকল্পনা। এখনও
সেকথাই অনেকে দুঃখ করে বলেন। কিন্তু কি আর করা! সর্বজ্ঞানী আল্লাহ যদি না
চান, বান্দার কি আর করার থাকে। তবে হ্যাঁ নিজে আইনের ছাত্র হয়েও এই অঙ্গনে
না যাওয়ার কারণ হ’ল সেখানে চলে সত্য-মিথ্যার খেলা, যালেম, দুর্নীতিবাজদের
আশ্রয় দেয়া, ঘুষ-বখশিস ইত্যাদির যথেচ্ছ ব্যবহার। সর্বোপরি বৃটিশ প্রণীত
প্রচলিত এই তাগূতী আইনের পদতলে থেকে জীবিকা নির্বাহ করাকে নিজের মন থেকে
কখনও মেনে নিতে পারিনি। বিশেষ করে ১৯৯০ সালে ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র
সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর যেন জীবনের মোড় ঘুরে যায়। যতদূর সম্ভব হালাল-হারাম
যাচাই-বাছাই শুরু হয়। তবে হ্যাঁ, বিচিত্র এই মায়াবী পৃথিবীতে মাঝে-মধ্যে
এমনও কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে, তখন আর নিজেকে ঐ নীতিতে অটল রাখা যায় না।
তখন তা ছিন্ন করে নির্যাতিত মানবতার পাশে দাঁড়াতে হয়। পরকালীন চেতনা নিয়ে
সাহায্যের হাত বাড়িয়ে লড়তে হয় মযলূমের পক্ষে। কারণ দুর্বলদের সহযোগিতার
জন্য আল্লাহ তা‘আলা স্বয়ং নির্দেশ দিয়েছেন (নিসা ৪/৭৫)।
আলোচ্য নিবন্ধে আমরা নিকট অতীতে বাংলাদেশের বুকে ঘটে যাওয়া এক মর্মান্তিক ইতিহাসের কথা তুলে ধরব। যে ইতিহাস ছিল বিগত জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থী চার দলীয় জোট সরকার কর্তৃক ২০০৫ সালে ঘটানো এক কলংকময় ও বর্বর মানবাধিকার লংঘনের ইতিহাস; যে ইতিহাস ছিল বাংলার যমীন থেকে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’কে মিটিয়ে দেওয়ার হীন চক্রান্তের ইতিহাস; যেটা ছিল আহলেহাদীছ আন্দোলনের নির্যাতিত-নিপীড়িত নেতা-কর্মীদের এক বড় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার ইতিহাস; যা ছিল বাংলাদেশে তথাকথিত জঙ্গীবাদের অপবাদকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার এক সংগ্রামী ইতিহাস। ফলে সে মুহূর্তে সঙ্গত কারণেই অনন্যোপায় হয়ে আমাদেরকে আশ্রয় নিতে হয়েছিল দেশের প্রচলিত আদালত সমূহে। এরই অংশ হিসাবে বিভিন্ন যেলার আদালত চত্বরের কিছু স্মৃতিকথা ও ঘটনা বিধৃত হ’ল আলোচ্য নিবন্ধে।
২৩শে ফেব্রুয়ারী’০৫ ভোর রাত। হঠাৎ দরজার বাইরে থেকে চাপা কণ্ঠ ভেসে এলো, আলম ভাই! আলম ভাই! উঠেন, তাড়াতাড়ি ওঠেন! ধড়ফড় করে ওঠে ভীত পদে অগ্রসর হয়ে দরজা খুলে দেখি সহকর্মী কাবীরুল ভাই। কি হয়েছে? দেখলাম, তার চোখে মুখে বিষণ্ণতার ছাপ। কি হয়েছে? বললেন, আমীরে জামা‘আতকে গভীর রাতে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে! কি বললেন! ধরে নিয়ে গেছে! হ্যাঁ ধরে নিয়ে গেছে। শুধু তাই না, সালাফী ছাহেব, নূরুল ইসলাম ছাহেব এবং আযীযুল্লাহ ভাইকেও নিয়ে গেছে। শুনে যেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল।
আমি ওযূ করে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করে বাসা থেকে বিদায় নিলাম। পার্শ্ববর্তী মসজিদে গেলাম। সেখানে ছিলেন আত-তাহরীক পত্রিকার সম্পাদক জনাব সাখাওয়াত হোসাইন ও মুযাফফর বিন মুহসিন প্রমুখ। আমরা ফজরের ছালাত শেষ করে নওদাপাড়া বাজার মসজিদে গেলাম। সেখানে উপস্থিত হ’লেন ‘আন্দোলন’-এর তৎকালীন কেন্দ্রীয় মুবাল্লিগ এস.এম আব্দুল লতীফ ভাই। এ পর্যায়ে তিনি বললেন, আমাদেরকে থানায় যেতে হবে। আমি বললাম, থানার পরপরই কোর্টে যেতে হবে। ফাইলপত্র সাথে নিতে হবে। কারণ এরপরে ওরা নেতৃবৃন্দকে কোর্টে চালান দিবে। এখন প্রশ্ন হ’ল- মাদরাসায় কে যাবে? সেখানেই তো স্যারের বাসা ও পরিবার। সকলে আমরা একে-অপরের দিকে তাকাতে লাগলাম। কারণ মাদরাসায় এ মুহূর্তে যে যাবে, সে নিশ্চিত গ্রেফতার হবে। শত শত পুলিশ-র্যাব, ডিবি, বিডিআর মাদরাসা ঘিরে রেখেছে। বললাম, আমি যাব, ভাগ্যে আল্লাহ যা লিখে রেখেছেন তাই-ই হবে।
আমি রিক্সা নিয়ে চললাম মাদরাসার দিকে। দেখি নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা, শত শত পুলিশ-র্যাব সদস্য রাস্তার দু’ধারে ও মাদরাসার চারিদিক বেষ্টন করে রেখেছে। ওদেরকে ডিঙ্গিয়ে রিক্সা নিয়ে সোজা মাদরাসার ভিতরে প্রবেশ করতে লাগলাম। জিজ্ঞেস করল, আপনি কে, কোথায় যাবেন? বললাম, আমি মাদরাসার শিক্ষক, কাজ আছে তাই যেতে হবে। ওরা মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আচ্ছা যান। মাদরাসার ভিতরে প্রবেশ করলাম। চারিদিকে আতংকের ছাপ!
আমাকে দেখে ছাত্ররা দৌঁড়ে এসে বলল, স্যার আমীরে জামা‘আতকে ধরে নিয়ে গেছে, এখন আমাদের কি হবে? সহকর্মী শিক্ষক হাফেয লুৎফর রহমান, মাওলানা ফযলুল করীম ও কর্মচারীরা এলেন। সবার মধ্যে চরম ভীতি আর আতঙ্ক কাজ করছে। প্রথমে আত-তাহরীক অফিস খুললাম। সকলকে সান্ত্বনা দিয়ে, ধৈর্য ধরতে এবং স্বাভাবিক কাজ চালিয়ে যাবার পরামর্শ দিলাম। বললাম, তাঁদেরকে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিবে। এতে তারা অনেকটা সাহস পেল। ‘আন্দোলন’ অফিসে গেলাম। কিন্তু কেউ নেই। আনোয়ার ভাইকে বাসা থেকে ডেকে আনা হ’ল। আমীরে জামা‘আতের বাসার খোঁজ-খবর নেওয়া হ’ল। আনোয়ার ভাইয়ের নিকট থেকে কাগজ-পত্র, ফাইল নিয়ে চললাম থানায়। অতঃপর কোর্টে। শুরু হ’ল আদালত অঙ্গন যাত্রা। জানি না এ যাত্রা কখন, কবে শেষ হবে? ভাবতে ভাবতে চললাম, আর আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানালাম, ‘হে আল্লাহ! আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতৃবৃন্দকে হেফাযত কর এবং অনতিবিলম্বে তাঁদেরকে মুক্ত করে দাও’।
রাজশাহী কোর্টে গেলাম। এ্যাডভোকেট শাহনেওয়ায, জার্জিস আহমাদ, মু‘তাছিম বিল্লাহ প্রমুখ যামিন আবেদন করলেন। কিন্তু নামঞ্জুর করা হ’ল। রাজশাহী শাহ মখদূম থানার ৫৪ ধারায় (সন্দেহমূলক) মামলাতে নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার দেখানো হয়। আমীরে জামা‘আতের এই অন্যায় গ্রেফতারে শাহ মখদূম থানার ওসি দারুণভাবে ব্যথিত হয়েছিলেন। কারণ নওদাপাড়া ছিল তাঁরই থানার অন্তর্ভুক্ত। ফলে তিনিই আমাদের সম্পর্কে সবচেয়ে বেশী জানতেন। জঙ্গী সংগঠন জে.এম.বি সন্দেহে গ্রেফতার তিনি মেনে নিতে পারেননি। বদলি হওয়ার সময় তিনি অনেক কথাই আমাদেরকে বলে গেছেন এবং দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
৫৪ ধারার এই সন্দেহমূলক মামলা দায়েরের পরপরই প্রায় ডজন খানেক মিথ্যা মামলায় শ্যোন এ্যারেস্ট (Shown Arrest) দেখানো হ’ল নেতৃবৃন্দকে। যার মধ্যে বগুড়ায় ৩টি, গাইবান্ধায় ২টি, নওগাঁয় ২টি, গোপালগঞ্জে ১টি ও সিরাজগঞ্জে ১টি। মামলার বিবরণে দেখা যায়, যে রাতে আমীরে জামা‘আত সহ চারজন নওগাঁ যেলার পোরশা থানায় ব্যাংক ডাকাতি করেছেন। সেই রাতে সিরাজগঞ্জ যেলার উল্লাপাড়া থানায় ব্যাংক ডাকাতি করেছেন এবং ফজরের আগেই রাজশাহী ফিরে এসেছেন। অতঃপর সকাল ৯-টায় রাজশাহী কলেজের সামনে স্বপ্নিল কমিউনিটি সেন্টারে সাংবাদিক সম্মেলনে স্যার ভাষণ দিয়েছেন। যা সে সময়ে প্রায় সকল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কি চমৎকার প্রশাসন!
উপরের ১০টি মামলা ছাড়াও নাটোরে ১টি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা হয়েছিল। যে মামলাটি সর্বপ্রথম বেশী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। অবশ্য পরবর্তীতে মামলাটি বাদ যায়। আমীরে জামা‘আতের বিরুদ্ধে প্রথম নিউজ করেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার ক্লাসমেট ও দৈনিক প্রথম আলোর নাটোর প্রতিনিধি। সে একজন উকিলও বটে। পরে তার কাছে আত-তাহরীক-এর তৎকালীন সার্কুলেশন ম্যানেজার আবুল কালাম ভাই সহ গিয়েছিলাম। কাগজপত্র নিয়ে তার সাথে দীর্ঘ আলোচনার পর সে একপর্যায়ে বলল, তাহ’লে হয়তবা ধৃত আসামীদেরকে পুলিশ জোর করে ড. গালিব স্যারের নামে স্বীকারোক্তি আদায় করেছে। যেটা আমরা পরে বুঝতে পেরেছিলাম।
তার একটি প্রমাণ আমরা পেলাম বগুড়া যেলা আদালতে একদিন উক্ত মামলা থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত এক আসামী হঠাৎ এসে আমার সাথে পরিচিত হয়। সে বর্ণনা করে যে, ‘২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারীর গোড়ার দিকে আমাকে এবং আরও ৭/৮ জনকে হঠাৎ পুলিশ ধরে থানায় নিয়ে বলে যে, ‘বল আমরা জেএমবি করি। আর ড. গালিব আমাদের নেতা’। সেদিন স্যারের নাম বলা ছাড়া আমাদের কোন উপায় ছিল না। কারণ পুলিশ আমাদের উপর বর্বর নির্যাতন চালিয়েছিল এবং মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিল’।
প্রথম আলোর বন্ধুকে বুঝানোর পর সে তার ভুল বুঝতে পেরে দুঃখ প্রকাশ করে বলল, যা হবার তো হয়ে গেছে দোস্ত এখন থেকে এ বিষয়ে আমি আর লিখব না। ঐ সাংবাদিক বন্ধু আর আমাদের বিরুদ্ধে কিছু লেখেননি। এজন্য ঢাকা থেকে ঐ পত্রিকার সম্পাদক তার উপর অনেক চাপ দিয়েছিল। কিন্তু তিনি বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যান। পরবর্তীতে তিনি স্যারের কাছে ক্ষমাও চেয়েছিলেন। তবে তিনি একান্তে এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছিলেন যে, ‘তোমাদেরকে ধরার পিছনে বেশী কাজ করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক সহকারী রেজিস্ট্রার (কুমিল্লা)। যে হাদীছ ফাউন্ডেশন বিল্ডিং থেকে বহিষ্কৃত। দ্বিতীয় জন হ’ল ‘আন্দোলন’ থেকে বহিষ্কৃত সাবেক এক নেতা (বগুড়া)। তিনি বলেন, ওরা আমার কাছে এসেছিল এবং নানা লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে স্যারের বিরুদ্ধে লিখতে প্ররোচনা দিয়েছিল। কিন্তু আমি তাদের কোন কথায় কান দেইনি।
কুচক্রীরা কয়েক সপ্তাহ ধরে ঢাকায় বিভিন্ন সাংবাদিক, গোয়েন্দা সংস্থা, এমপি-মন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ে কাগজপত্র সরবরাহ করেছে। একথা অবশ্য দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার তৎকালীন বার্তা সম্পাদক ছাহেবও বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আপনারা তো অনেক দেরী করে ফেলেছেন। আপনাদের বিরোধী পক্ষ খুব অগ্রসর। প্রশাসনের বিভিন্ন পদস্থ কর্মকর্তাও সংগঠন থেকে বহিষ্কৃত ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে কিছু বলতে আমাদের নিষেধ করেন। ঐ সময় বিশেষ কাজে আমি ও অধ্যক্ষ আব্দুছ ছামাদ (কুমিল্লা)-এর ছেলে আব্দুল কাইয়ূম ঢাকার উত্তরায় তাওহীদ ট্রাষ্ট অফিসে গেলে সেখানে নষ্টের মূল ঐ ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ হয়। তখন স্যারের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে সে বলে, এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। টিভিতে প্রচারিত হ’লে আমার মেয়ের মাধ্যমেই গালিব ছাহেবের গ্রেফতারের খবরটি প্রথম পাই। জঙ্গীবাদের সাথে তার সম্পর্কের কথা আমার জানা নেই’। অথচ এই ব্যক্তিই আমীরে জামা‘আতের গ্রেফতারের অব্যবহিত পরেই জার্মান বেতারের (ডয়েস-এ ভেল) বগুড়া সংবাদদাতা হাসীবুর রহমান বিলুর সাথে সাক্ষাৎকারে তাঁকে জঙ্গীবাদের সাথে সম্পৃক্ত প্রমাণে নানা মিথ্যা প্রলাপ বকেছেন। অবশেষে আমি ও বগুড়া যেলা ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি আব্দুর রহীম ভাই সাংবাদিকদের সাথে সাক্ষাৎ করে বিস্তারিত ডকুমেন্ট উপস্থাপনের পর তাদের হুঁশ ফিরে এবং তারা দুঃখ প্রকাশ করেন।
রাজশাহীতে বৃথা চেষ্টায় সপ্তাহ খানেক কেটে গেল। আমরা বুঝলাম, বিষয়টি খুব সহজ নয়। কথিত ইসলামী মূল্যবোধের (?) সরকারের শুধু আমাদের তাবলীগী ইজতেমা ভন্ডুল করাই উদ্দেশ্য নয়, বরং এদের পরিকল্পনা ও নীলনকশা বহু দূর বিস্তৃত। অতএব মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম, মুযাফফর বিন মুহসিন, মুফাক্ষার হোসাইন সহ কয়েকজন আমরা আত-তাহরীক সম্পাদক ড. সাখাওয়াত হোসাইনের বাসায় একদিন সকালে যরূরী বৈঠকে বসলাম। বললাম, এখানে থেকে আর লাভ নেই। আমাদেরকে ঢাকা যেতে হবে। ঢাকাতে বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ ও হাইকোর্টে আইনী লড়াইয়ের মাধ্যমে কিছু করা যায় কি-না দেখা উচিত। অতঃপর সম্পাদক ছাহেব ও আমি ২৭শে ফেব্রুয়ারী ঢাকায় গেলাম। ২৮শে ফেব্রুয়ারী ড. মুছলেহুদ্দীন ভাইয়ের সাথে পরামর্শ করলাম কি করা যায়? আমরা প্রথমে সেন্ট্রাল শরী‘আহ বোর্ডের তৎকালীন সেক্রেটারী জনাব মোখলেছুর রহমান এবং মাসিক মদীনা সম্পাদক মাওলানা মহিউদ্দীন খান ছাহেবের সাথে দেখা করলাম। তারা অনেক ভাল পরামর্শ ও সান্ত্বনা দিলেন এবং বললেন, আল্লাহ ড. গালিব ছাহেবকে জেলে রেখে ভাল করেছেন। এ মুহূর্তে বাইরে থাকলে হয়ত এর চেয়ে অনেক বেশী ক্ষতি হ’তে পারত। একথা অবশ্য তিনি ছাড়াও অনেক রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ এবং জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিবর্গ বলেছিলেন। সকলেরই বক্তব্য, একটু ধৈর্য ধরুন। এ জঘন্য কাজ কারা করেছে, তা আমরা বুঝতে পেরেছি। তাঁরা সেদিন ক্ষমতাসীন বৃহৎ ইসলামী দলটির দিকেই ইঙ্গিত করেছিলেন।
পরদিন গেলাম হাইকোর্টে। সেখানে মাওলানা হাফীযুর রহমান ভাইয়ের নেতৃত্বে সকলের আগাম যামিন নেওয়ার প্রচেষ্টা চলছিল। মুছলেহুদ্দীন ভাইদের সাথে দেখা ও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হ’ল। ঐদিন সম্পাদক ছাহেব এবং আমি মুছলেহুদ্দীন ভাইকে বললাম, ভাই এখানে দেখছি সকলে নিজেদের অগ্রীম যামিন করা নিয়েই ব্যস্ত। কিন্তু আমীরে জামা‘আতের জন্য কি করা হচ্ছে? এতে যেন কেউ কেউ নাখোশ হ’লেন। তার পূর্বে ভারপ্রাপ্ত আমীর মুছলেহুদ্দীন ভাইকে পরামর্শ দেওয়া হ’ল এ মুহূর্তে আপনি একটি যরূরী ‘আমেলা’ বৈঠক ডাকুন এবং পরবর্তী কর্মসূচী নির্ধারণ করুন। ‘যুবসংঘ’ ও ‘আন্দোলনে’র কর্মীগণ এখন দিশাহীন এবং অভিভাবকহীন অবস্থায় দিনাতিপাত করছে। এ আন্দোলনকে টিকিয়ে রাখতে হ’লে এভাবে পালিয়ে থাকলে চলবে না। পরিকল্পিতভাবে একটা কিছু করা এ মুহূর্তে অতীব যরূরী। তিনি তাই-ই করলেন। আমরা দু’জনে সেদিন মুছলেহুদ্দীন ভাইয়ের মুহাম্মাদপুরের বাসায় অনুষ্ঠিত সেই যরূরী বৈঠকে উপস্থিত ছিলাম। ডঃ মুছলেহুদ্দীন ভাইয়ের সভাপতিত্বে উক্ত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম, জনাব গোলাম মুক্তাদির, মাওলানা হাফীযুর রহমান, এস.এম. আব্দুল লতীফ, জনাব বাহারুল ইসলাম, মাওলানা গোলাম আযম প্রমুখ। এখানে বেশ কিছু ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত নেয়া হ’ল।
পরদিন আবার হাইকোর্টে গেলাম। সেখানকার পরিবেশ ছিল গোয়েন্দাদের কঠোর নযরদারীতে। তবুও আমরা ভয় না করে আমাদের বন্ধু-বান্ধব ছোট-বড় ১৫/২০ জন উকিলের পরামর্শ গ্রহণ করলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বড় মাপের কোন এ্যাডভোকেট এ মামলা নিতে চাচ্ছেন না। তারা বলছেন, এখন না, পরে। কেউবা স্যারের নাম শুনেই আঁৎকে উঠছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছোট ভাই এ্যাডভোকেট লিটনকে (কুমিল্লা) নিয়ে রাতে প্রথমে ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল-মামূনের কাছে গেলাম। তিনি বললেন, এখন না। কয়েক মাস পরে আসেন। অবশ্য শেষে যামিনের ব্যবস্থা তাঁর মাধ্যমেই হয়েছিল। পরে জানতে পারলাম মজলিসে আমেলার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোর্ট-কাচারীতে অভিজ্ঞ আমেলা সদস্য মাওলানা হাফীযুর রহমান ভাইকে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আর কেসগুলো ড. রফীকুল ইসলাম মেহদীর তত্ত্বাবধানে দেওয়া হয়েছে।
গাইবান্ধার পরিস্থিতি এমন জটিল যে, কেউ সেখানে যেতে সাহস করছেন না। এ্যাডভোকেটগণও বার বার নিষেধ করছেন যেতে। গেলেই গ্রেফতার হবে এটাই তাদের ধারণা। কিন্তু আমীরে জামা‘আতকে নিয়ে যাবে আর আমরা যাব না, তা হয় না। আর মামলাইবা দেখবে কে? অতঃপর আমি, স্যারের ২য় পুত্র নাজীব ও অফিস সহকারী আনোয়ার ভাই চললাম গাইবান্ধার পথে। এখানকার এ্যাডভোকেট ছিল আমারই বন্ধু এ্যাডভোকেট জামীল এবং গাইবান্ধা বারের খ্যাতনামা আইনজীবী সিরাজুল ইসলাম বাবু। আমাদের যাওয়ার কথা শুনে ওঁরা ভয় পেয়ে গেলেন। জামীল ফোনে বলল, দোস্ত তোমরা এখন এসো না? কারণ এখানকার পরিবেশ খুবই খারাব। এখন আমরাও তোমাদের এ কেস নিয়ে কঠিন চাপে আছি। একদিকে আইনজীবীদের চাপ, অন্যদিকে পুলিশ প্রশাসনের চাপ। ভয় হচ্ছে আমরাও গ্রেফতার হয়ে যাই কি-না। আর তুমি এলে তো নির্ঘাত গ্রেফতার হবে। বললাম, আমাদের নেতা গ্রেফতার হয়েছেন, এখন আমরা যদি গ্রেফতার হই, তাতে ক্ষতি কি? ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। আমাদের জন্যই যেন ওদের বেশী চিন্তা। এটাই স্বাভাবিক, সে হয়ত ভাবছে যে, আমাদের সামনে থেকে তাদের বন্ধুকে পুলিশে ধরে নিয়ে যাবে?
তিনজন বাস থেকে গাইবান্ধা কোর্টের সামনে নামলাম অনেকটা গ্রেফতার আতংক মাথায় নিয়ে। নামার সাথে সাথে দেখি, আমাদেরকে সাদা পোষাকের লোকজন ঘিরে ফেলেছে। ভাবলাম, কি করা যায়? আল্লাহর উপর ভরসা আর বুকভরা সাহস নিয়ে কোর্টে প্রবেশ করলাম। প্রথমে আমাদেরকে চেক করা হ’ল। নাম-ঠিকানা জানতে চাইলে সব বললাম। গোয়েন্দার সংখ্যা যেন বেড়েই চলেছে। আমরা সোজা আইনজীবী ভবনে ঢুকলাম। আমাদের দেখে বন্ধুবর এ্যাডভোকেট জামীলের চক্ষু ছনাবড়া। সে বলল, এসেছো? তোমরা কিভাবে এখানে এলে? বেশ তোমরা আমাদের এই চেম্বারে বসে থাক। এখান থেকে একটুও বের হবে না। কিন্তু আমরা নাছোড়বান্দা। স্যারের সাথে দেখা করবই। এখানে বসে থাকলে দেখা হবে কি করে? এক সময় তার অনুপস্থিতিতে বেরিয়ে পড়লাম কোর্টের দিকে, যেখানে স্যারকে হাযির করা হবে।
বের হওয়ার সাথে সাথে সাদা পোষাকের (গোয়েন্দা পুলিশের) লোক আমাদেরকে আবার ঘিরে ফেলল। আমরা কি করব, ভেবে পাই না। ভাবলাম, আমরা কি চোর-ডাকাত, না সন্ত্রাসী? এত ভয় কিসের? সরকারী এই লোকগুলোর মাথায় এতটুকু কি বুদ্ধি-বিবেক নেই যে, প্রকৃত জে.এম.বি সদস্যরা এখানে এইভাবে ঘুরে বেড়াতে পারে না। নিষিদ্ধ ঘোষিত ঐ দলের সদস্যরা এখন আত্মরক্ষার জন্য নদীর চর ও বনে-জঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে কুল পাচ্ছে না। অথচ আমাদের মত নির্দোষ, সহজ-সরল মানুষগুলোর পিছনে এরা আঠার মত লেগে আছে? কি নির্বুদ্ধিতা আমাদের গোয়েন্দা বিভাগের লোকজনের! ইতিমধ্যে সাংবাদিকরাও আমাদেরকে ঘিরে ধরেছে। তারা নানা প্রশ্ন করল। আমরা উত্তর দিলাম। এরপর স্যারের সাথে কোর্টে সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎ হ’ল। তাঁর অদম্য সাহস ও মিষ্টি হাসি আমাদেরকে অনুপ্রেরণা জোগাল। এ সময় আদালতের মধ্যে হাফীযুর রহমান ভাইও ছিলেন।
যদিও আমাদের মনের গভীরে ক্ষতের চিহ্ন এবং অশ্রুসিক্ত দু’নয়ন। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রবীণ প্রফেসরকে এভাবে সন্ত্রাসী বানিয়ে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে যেলায় যেলায় যেভাবে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং বিশ্ব মিডিয়াকে দেখানো হচ্ছে, তা এ যুগের কোন সভ্য সরকার করতে পারে না। আমরা যারপর নাই হতবাক ও বিস্মিত হ’লাম। এবার এ্যাডভোকেটদের সাথে পুনরায় সাক্ষাৎ শেষে ফেরার পালা। তারা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন, তোমাদের এত সাহস? তোমরাই পারবে এদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে। সেদিন যেন গ্রেফতারের হাত থেকে স্বয়ং আল্লাহই আমাদেরকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। সুস্থ হালেই ফিরে আসলাম রাজশাহীতে।
এ সময় হাফীযুর রহমান ভাই মূল ভূমিকা পালন করতেন। তাঁর এই আইনী তৎপরতা মূল কুচক্রীর নযরে পড়ে যায়। ফলে তাদেরই ষড়যন্ত্রে জয়পুরহাটের পুলিশ প্রশাসনকে দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেফতারের জন্য ‘হুলিয়া’ জারী করা হয়। ‘আন্দোলন’-এর ঢাকা অফিসে থাকা অবস্থায় পত্রিকায় ‘হুলিয়া’-র খবর পাঠ করে ২০০৫ সালের ১২ই নভেম্বর শনিবার বিকালে তিনি সেখানেই হার্টফেল করে মৃত্যুবরণ করেন (ইন্না লিল্লাহি...)। এরপর যতবার মামলার তারিখ হয়েছে, প্রায় সব বারই আমরা আদালতে গিয়েছি। সঙ্গে থাকতেন গাইবান্ধা যেলা ‘আন্দোলন’ ও অনেক সময় বগুড়া যেলা ‘আন্দোলন’-এর নেতৃবৃন্দ।
গাইবান্ধার কিছু স্মরণীয় ঘটনা :
(১) কোর্ট হাজত থেকে আদালতে নিয়ে যাওয়ার সময় স্যারের হাতে কখনো কখনো হাতকড়া পরা দেখলে আমরা খুবই কষ্ট পেতাম। আমাদের এ মনোভাব বুঝতে পেরে এ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম বাবু একদিন বললেন, আমি অনেক কমিউনিষ্ট, সেক্যুলার ও ইসলামী দল দেখেছি। কিন্তু আপনাদের সাহস দেখে আমি মুগ্ধ। রাজশাহী, ঢাকা সহ বিভিন্ন শহরে এমনকি এই গাইবান্ধাতেও স্যারের মুক্তির দাবীতে বড় বড় মিছিল-মিটিং হয়েছে। যেটা এই পরিবেশে অন্য দলের সাহসে কুলাতো না।
একটি গল্প শুনুন! হাতে-পায়ে হ্যান্ডকাপ-ডান্ডাবেড়ী পরা কোন ব্যাপার নয়। যারা দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করে, এসব দৃশ্য মানুষের মনে কঠিনভাবে আঘাত করবে। তাতে লাভই হয়। তিনি বলেন, একবার পুলিশ বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে কংগ্রেস নেতা জওহরলাল নেহেরুকে জেলে ঢুকায়। তাকে মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। কারাগার থেকে পুলিশ আদালতে নিয়ে আসবে। কিন্তু পুলিশ তাঁকে হাতে কোন হ্যান্ডকাপ বা পায়ে বেড়ী না পরিয়ে গাড়িতে উঠতে বলে। তখন তিনি যিদ ধরলেন, ‘আমাকে হ্যান্ডকাপ না পরালে গাড়িতে উঠব না। অবশেষে পুলিশ নেহেরুকে হ্যান্ডকাপ পরাতে বাধ্য হয়। তখন সাংবাদিকরা সে ছবি উঠায় এবং পরদিন হ্যান্ডকাপ পরিহিত সচিত্র প্রতিবেদন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ফল হ’ল এই যে, জনগণ এ দৃশ্য দেখার পর বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে সারা ভারত কাঁপিয়ে তুলে। কিছুদিন পরে তাঁকে বৃটিশ শাসক ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়’। এ্যাডভোকেট ছাহেব বললেন, এদেশে এখন ডঃ গালিব হ’লেন ‘হিরো’ (Hero)। পত্রিকায় দেখলাম, ঢাকায় তাঁর মুক্তির দাবীতে দুই কিলোমিটার দীর্ঘ মিছিল হয়েছে। ঢাকার ‘মুক্তাঙ্গনে’ বিশাল জনসভা হয়েছে। অতএব অন্যসব ছোটখাট বিষয়ের দিকে নযর দিবেন না।
(২) গোবিন্দগঞ্জ থানার মহিমাগঞ্জ ব্র্যাক অফিসে বোমা হামলা মামলায় হাযিরা দিতে স্যার কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন। স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের বিজ্ঞ বিচারপতি হঠাৎ পিপি-কে উদ্দেশ্য করে ঝাঁঝালো কণ্ঠে স্যারের দিকে ইঙ্গিত দিয়ে বললেন, দেখছেন না উনি দাঁড়িয়ে আছেন? সাথে সাথেই পিপি একটা চেয়ার নিয়ে সসম্মানে স্যারকে বসতে বললেন। বস্ত্ততঃ এরূপ ঘটনা একেবারেই বিরল। বিশেষ করে সে সময়কার চাঞ্চল্যকর অবস্থায়। আল্লাহ এভাবেই তাঁর নেককার বান্দাদের সম্মানিত করে থাকেন। উল্লেখ্য যে, ২৬/০৭/০৫ তারিখে উক্ত মামলা থেকে এফআরটি-র মাধ্যমে স্যার বেকসুর খালাস পান। অর্থাৎ প্রাথমিক পুলিশী তদন্তেই মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
এরূপ ঘটনা আমার দেখা মতে স্যারের মুক্তির পর ২০০২ সালের এক পুরানো মামলায় আরও দু’বার ঘটেছে ঢাকা যেলা জজ আদালতে। যেখানে বাদী ও বিবাদী উভয় পক্ষের সুপ্রিম কোর্টের এ্যাডভোকেটদ্বয়ের আবেদনক্রমে স্যারকে উকিলদের পাশে চেয়ারে বসতে দেওয়া হয়। উক্ত মামলায়ও স্যার বেকসুর খালাস পান। সেদিন বাদীর এ্যাডভোকেট আদালতকে উদ্দেশ্য করে স্যারের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, He is not only respected in our country, but throughout the world. উক্ত এ্যাডভোকেট বর্তমানে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পীকার।
(৩) পলাশবাড়ী থানার তোকিয়ার বাজার গানের প্যান্ডেলে বোমা হামলার বিচার চলছে। স্যারের আইনজীবী সিরাজুল ইসলাম বাবু জোরালো ভাষায় যুক্তি পেশ করছেন। এক পর্যায়ে তিনি আদালতকে উদ্দেশ্য করে বললেন, Dr. Ghalib is a renowned professor of the University of Rajshahi. He is a man of intellect and a femous social worker. The Government is envious to His good name and fame. So, we claim that this criminal case against him is totally baseless and bogus. তার এই জোরালো কথাগুলি সমস্ত আদালতকে কাঁপিয়ে দেয়। বিজ্ঞ বিচারপতির চেহারায় সন্তুষ্টি ভাব ফুটে উঠে। জবাবে সরকারী কৌঁসুলী তেমন কিছুই বলতে পারলেন না। সাক্ষীরাও কিছু বলেনি। মামলার রায় কি হবে তা আমরা সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম। অতঃপর উক্ত মামলা থেকে ২৬/০৬/০৮ তারিখে স্যার বেকসুর খালাস পান।
(৪) পুরাতন কারাগার থেকে স্যারকে আদালতে নিয়ে আসছেন বিশেষ পুলিশ এসকর্ট। ড্রাইভারের পাশেই স্যার বসেছেন। সঙ্গে উচ্চপদস্থ একজন পুলিশ অফিসার। চৌকস অফিসারটি স্যারকে বললেন, স্যার আমরা সবই জানি। কিন্তু কিছুই করার নেই। তবে আপনাকে সম্মান করার সাধ্যমত চেষ্টা আমরা করে যাব। তিনি আরও অনেক কথা বললেন। আদালতে সাক্ষাতের পর স্যার আমাদেরকে সে কথা শুনালেন।
(৫) ২০০৬ সালের গোড়ার দিকে বিশেষ ট্রাইবুনালে মামলার হাযিরা শেষে স্যারকে নিয়ে যাবে জেলখানায়। প্রতি তারিখের দিনের ন্যায় এদিনও অসংখ্য গুণগ্রাহী ও কর্মীবৃন্দের আগমন। বোনারপাড়ার প্রবীণ মাস্টার এমদাদুল হক, রংপুর যেলা সভাপতি মাস্টার খায়রুল আযাদ ও রংপুর পীরগাছার বিডিআর (অবঃ) আব্দুস সাত্তার ছাহেবের এবং আরও কয়েকজন মুরববীর হাউমাউ করে কান্না দেখে আমরা নিজেদেরকে ধরে রাখতে পারিনি। স্যার সকলকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন।
কিছু পরে স্যারকে পুলিশের গাড়িতে বিদায় দিয়ে আমরা দাঁড়িয়ে আছি বগুড়া যেলা ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি আব্দুর রহীম ভাইয়ের অপেক্ষায়। ততক্ষণে একটি পুলিশের ভ্যান ঠিক আমার সামনে এসে দাঁড়াল। এক পুলিশ অফিসার সামনে থেকে নেমে এসেই আমাকে বলল, আপনি গাড়িতে উঠেন। আমি বললাম, কেন? তিনি বললেন, এসপি স্যার আপনাকে ডেকেছেন। বললাম, কেন? তিনি বললেন, জানি না। তবে ওখানে আপনাদের আরও কিছু লোক আছেন। ভাবলাম, আজ আমার আর রক্ষা নেই। পৌঁছে দেখি সেখানে আব্দুর রহীম ভাই, ছহীমুদ্দীন গামা ভাই দু’জনে দাঁড়িয়ে। আমি বুঝতে পেরেও না বুঝার ভান করে সহজভাবে বললাম, কি ব্যাপার আব্দুর রহীম ভাই, আপনারা এখানে কেন? তারা চুপ। অতঃপর আমাদের উপরে নিয়ে যাওয়া হ’ল। ওনাদের বারান্দায় বসিয়ে রেখে আমাকে এসপির অফিসে নিয়ে যাওয়া হ’ল। সালাম দিলাম। ভদ্রলোক আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ।
অতঃপর বললেন, আপনার পরিচয় দিন এবং আপনি গাইবান্ধায় কেন এসেছেন? বললাম, ড. গালিব স্যারের মামলা পরিচালনার জন্য। তিনি আমার ব্যাগ খুলতে বললেন। তার মধ্যে মেয়র মিনুর প্রত্যয়ন পত্র এবং স্যারের লেখা অনেক বই-পুস্তক ছিল। তিনি বললেন, আপনাদের সাহস তো কম নয়? এ অবস্থায় এসব বই-পুস্তক নিয়ে এখানে এসেছেন? বললাম, এখান থেকে আমাকে ঢাকায় যেতে হবে। তাছাড়া এগুলো প্রয়োজনে নেয়া হয়েছে। এগুলো তো নিষিদ্ধ বই নয়। তিনি কিছুটা বিরক্তভাবে বললেন, এই কে আছ, উনাকে নিয়ে যাও। আমাকে গোয়েন্দাদের খাস কামরায় বসিয়ে রাখা হ’ল। ইতিমধ্যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল।
আমাকে ও আব্দুর রহীম ভাইকে এসপির কক্ষে আবার ডাকা হ’ল। নানান প্রশ্ন। তার মধ্যে একটি প্রশ্ন হ’ল রেযাউল করীম ছাহেবকে চিনেন কি? আমরা বললাম, চিনি। আব্দুর রহীম ভাই তার সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে এসপি ছাহেব বললেন, না তার সম্পর্কে আমি কিছু শুনতে চাচ্ছি না এবং বলারও দরকার নেই। এরপর আমাদের কথা ও তথ্য সমূহ উপস্থাপন করলাম। আমরা সেদিন ভেঙ্গে পড়িনি, সাহস হারাইনি, আল্লাহর উপর ভরসা ছিল যে, আমরা তো কোন অপরাধ করিনি। এসপি ছাহেব তখন রাজশাহী ডিআইজির কাছে ফোন করলেন এবং কি যেন বললেন। তারপর আমাদেরকে বন্ডে সই নিয়ে ছেড়ে দিলেন। আলহামদুলিল্লাহ। তখন সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে সাংবাদিকরা এসে নিউজ ও ছবি নিয়ে গেল। পরদিন পত্রিকাতে খবর বের হ’ল আমি, আব্দুর রহীম ভাই ও গামা ভাই গ্রেফতার হয়েছি। বাড়ি এবং বিভিন্ন স্থান থেকে ফোন আর ফোন। চারিদিকে যেন চাপা কান্না। কিন্তু তখন তো আমরা মুক্ত। আসলে সেদিন পুলিশের নিকটে তথ্য ছিল যে, কোর্টে ঐদিন জে.এম.বি-রা আত্মঘাতি হামলা করতে পারে। যার ফলে আমাদেরকে এইরূপ হয়রানী করা হ’ল।
মাঝে-মধ্যে ভাবতাম, ১৯৭৮ সালে ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর প্রতিষ্ঠাতা, ১৯৯৪ সালে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর প্রতিষ্ঠাতা, ১৯৮৯ সালে ‘তাওহীদ ট্রাষ্ট’ সমাজকল্যাণ সংস্থা, ১৯৯২ সালে ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’ ও ১৯৯৭ সালে মাসিক আত-তাহরীক-এর প্রতিষ্ঠাতা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র প্রফেসর বহু গ্রন্থের প্রণেতা দিন-রাত নিঃস্বার্থভাবে বিশুদ্ধ ইসলামের খেদমতে নিয়োজিত যিনি, তাঁরই নামে এত বড় মিথ্যা অপবাদ আল্লাহ কিভাবে সহ্য করবেন? অচিরেই কুচক্রীরা এর ফলাফল পাবে ইনশাআল্লাহ।
তৎকালীন সরকার স্যারের মাধ্যমে পরিচালিত সারা দেশে প্রায় পৌনে আটশ‘ ইয়াতীমের খাবার বন্ধ করেছে, শত শত মসজিদ-মাদরাসা-ইয়াতীমখানা-ওযূখানা ও দারুলহাদীছ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ বন্ধ করেছে। নিঃস্বার্থ সমাজসেবী কুয়েতী দাতা সংস্থা এহইয়াউত তুরাছকে বন্ধ করে তাদেরকে কালিমালিপ্ত করে এদেশ থেকে বের করে দিয়েছে। নওদাপাড়া মাদরাসার শিক্ষক ও কর্মচারীদের কোন বেতন নেই। সকলের সংসার চালানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। চারিদিকে সকল মানুষের কেবল চোখের পানি আর দো‘আর মাধ্যমে প্রত্যাশা ছিল আল্লাহ আমাদের ফরিয়াদ কবুল করবেন! সে দিনগুলোতে স্যারের সন্তানদের দিকে চেয়ে দেখতাম, তারা কত অসহায়! পরিবার কত কষ্টে রয়েছে! কিন্তু তারা ছিল অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী ও ধৈর্যশীল।
[ক্রমশঃ]