দরিদ্রদের জন্য জীবন উৎসর্গ করা পাকিস্তানের প্রখ্যাত সমাজসেবী আব্দুস সাত্তার ইদি (৮৮) মারা গেছেন। গত ৮ই জুলাই তিনি করাচীর এক মেডিকেল সেন্টারে কয়েক সপ্তাহ যাবৎ চিকিৎসাধীন থাকার পর মৃত্যুবরণ করেন।
ভারতের গুজরাটের এক বণিক পরিবারের সন্তান ইদি ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পাকিস্তানে চলে যান। নিজের অসুস্থ ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত মায়ের দেখাশোনা করতে রাষ্ট্র কিভাবে ব্যর্থ হ’ল, তা দেখে তিনি জীবনভর সমাজসেবায় রত থাকার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৫১ সালে একটি ক্লিনিক খোলার মাধ্যমে তাঁর ইদি ফাউন্ডেশন যাত্রা শুরু করে। সময়ের আবর্তনে যা পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় সমাজকল্যাণমূলক সংগঠনে পরিণত হয়। কেবল পাকিস্তানে নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় কাজ করছে ফাউন্ডেশনটি। অ্যাম্বুলেন্স সেবা, মর্গ, লাশ পরিবহন, বাড়িতে গিয়ে নার্সিং সেবা, বিনামূল্যে ঔষধ সরবরাহ, ইয়াতীমখানা, স্কুল, হাসপাতাল, নারী ও শিশু আশ্রয় কেন্দ্র, প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন কেন্দ্র, বৃদ্ধনিবাস, মাদকাসক্ত ও মানসিক রোগীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে এই ফাউন্ডেশন। যে কোন দুর্যোগে সবার আগে পৌঁছে যায় ইদি ফাউন্ডেশনের অ্যাম্বুলেন্স। কখনো কখনো রাষ্ট্র যেসব সেবা দিতে ব্যর্থ হয় সেগুলোও দিয়ে থাকে এই ফাউন্ডেশন।
অনৈতিক সম্পর্কে জন্মলাভ করা পরিত্যক্ত শিশুদের লালন-পালন করতেন তিনি। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, তিনি এরূপ প্রায় ৩৫ হাযার শিশুর লালন-পালন করেছেন। এছাড়া ১৫০০ অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে গঠিত তাঁর অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস পৃথিবীর সর্ববৃহৎ হিসাবে গিনেজ বুক রেকর্ডেও স্থান করে নিয়েছে।
১৯৮৭ সালে তিনি র্যামন ম্যাগসাস পুরস্কারে ভুষিত হন। এছাড়া লেনিন শান্তি পুরস্কার এবং বলসান পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। ১৯৮৯ সালে পাকিস্তান সরকার সে দেশের সবচেয়ে বড় বেসামরিক পুরস্কার ‘নিশান এ ইমতিয়ায’-এ ভূষিত করেন তাকে। কোনদিন স্কুলের গন্ডি না পেরুলেও ২০০৬ সালে করাচীর ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে তাকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এছাড়াও ২০১০ সালে ইংল্যান্ডের বেডফোর্ডশায়ার বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডি.লিট দেয়।
তাঁর মৃত্যুতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়ায শরীফ গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন, ‘মানবতার এক মহান সেবককে হারালাম আমরা। যিনি সামাজিকভাবে ভঙ্গুর, অভুক্ত, অসহায় ও দরিদ্রদের কাছে ভালবাসার মূর্ত প্রতীক ছিলেন’।
২০১৪ সালে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, সাধারণ জীবন যাপন, সততা, কঠোর পরিশ্রম ও সময়ানুবর্তিতা তার কাজের মূল বিষয়। তিনি বলেছিলেন, ‘অন্যদের সেবা করা প্রত্যেকের কর্তব্য, মানুষের জীবনের অর্থও তাই। মানুষ বেশী বেশী এমনভাবে চিন্তা করতে শুরু করলেই অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
ইদি ছিলেন স্পষ্টবাদী। কখনো কাউকে তোষামোদ করেননি। তিনি রাজনীতিবিরোধী মানুষ ছিলেন। বরং সবসময় মানুষকে সমাজ সেবায় উৎসাহ দিতেন। কিন্তু ধর্ম নিয়ে রাজনীতি এবং সামরিক স্বায়ত্ত্বশাসনের বিরুদ্ধে ছিল তাঁর কঠোর অবস্থান। চরমপন্থী হামলার জন্য তেহরিক-ই-তালিবানকে যেমন আক্রমণ করেছেন, আবার দুর্নীতির জন্য দুষেছেন সরকারকে। সমাজ পরিবর্তনের কথা বলতেন বলে সামরিক সরকারের রোষের মুখে পড়েছেন বহুবার।
২০০৩-০৪ সালে পাকিস্তানে ঢুকে পড়া ভারতের মূক ও বধির তরুণী গীতা ইদি ফাউন্ডেশনের আশ্রয়েই ছিল। ২০১৫ সালে গীতাকে ভারতে ফিরিয়ে দেওয়ার সময় কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ইদি ফাউন্ডেশনকে এক কোটি রুপী দেয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু সেবামূলক কাজের বিনিময়ে ঐ অর্থ গ্রহণ করতে রাযী হননি আবদুস সাত্তার ইদি।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের কথা উল্লেখ করেছিলেন। সেসময় করাচীতে ভারতের চালানো বোমা হামলায় নিহতদের ছিন্ন-ভিন্ন দেহের বিভিন্ন অংশ ইদি এবং তার স্ত্রী বিলকিস নিজ হাতে কুড়িয়ে একত্র করে গোসল দিয়েছিলেন। ইদি বলেন, ক্ষত-বিক্ষত, ছিন্ন-ভিন্ন দেহগুলো দেখে আমার হৃদয় কঠিন হয়ে যায় সেদিন। মানবতার কাছে এবং ধর্মের কাছে সেদিন থেকেই আমি আমার জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছিলাম।
বোমার ভয়াবহতা, ক্ষতিকারক গ্যাস সবকিছুর ভয় দূরে ঠেলে জীবনভর নিরপরাধ মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করে গেছেন তিনি। আজ তাই শত্রু-মিত্র, ভালো-মন্দ, ইতিবাচক-নেতিবাচক সবার কাছেই আবদুস সাত্তার ইদি অসম্ভব শ্রদ্ধার পাত্র এক চিরস্মরণীয় ব্যক্তিত্বের নাম। যার আলোয় আলোকিত বহু মানুষ।