[মাওলানা ওযায়ের শামস (জন্ম : ১৯৫৭) মুসলিম বিশ্বের একজন প্রসিদ্ধ ও সুপরিচিত মুহাক্কিক। তিনি জামে‘আ সালাফিইয়াহ, বেনারস থেকে ফারেগ হওয়ার পর মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়, মক্কায় শিক্ষা সমাপ্ত করেন। বর্তমানে তিনি ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ ও ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ)-এর গ্রন্থাবলী ও পান্ডুলিপিসমূহ তাহকীকে নিয়োজিত আছেন। তাঁর রচিত ও তাহকীককৃত গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ’ল, হায়াতুল মুহাদ্দিছ শামসুল হক ওয়া আ‘মালুহু (আরবী ও উর্দূ), শামসুল হক আযীমাবাদী, বুহূছ ওয়া তাহকীকাত লিল মায়মানী, আল-জামে‘ লি-সীরাতি শায়খিল ইসলাম ইবনে তায়মিয়াহ খিলালা সাব‘আতি কুরূন (যৌথভাবে), জামেউল মাসায়েল লি ইবনে তায়মিয়াহ (৫ খন্ড), রাওয়াই‘উত তুরাছ (বিভিন্ন বিষয়ে ১০টি দুর্লভ রিসালাহ), আর-রিসালাহ আত-তাবূকিইয়াহ লি ইবনিল ক্বাইয়িম। এমনকি তিনি ইবনু তায়মিয়াহ বিশেষজ্ঞ হিসাবে বিদ্বান মহলে সুপরিচিত। তিনি আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব রচিত থিসিসের উর্দূ অনুবাদ সম্পাদনার দায়িত্বও গ্রহণ করেছেন, যা বর্তমানে চলমান রয়েছে। বিগত কয়েক বছর পূর্বে তিনি জামে‘আ সালাফিইয়া বানারাসে আগমন করলে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল। সাক্ষাৎকারটি উর্দূ মাসিক পত্রিকা ‘মুহাদ্দিছ’-এর মে ২০১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। বিশেষ গুরুত্ব বিবেচনায় উক্ত সাক্ষাৎকারটি ‘আত-তাহরীক’-এর পাঠকদের জন্য অনুদিত হ’ল।]

প্রশ্ন : আপনার শিক্ষাজীবন সম্পর্কে জানতে চাই।

ওযায়ের শামস : ১৯৬৬ সালে ফায়যে ‘আম মাদ্রাসা, মেŠ-য়ে আমার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর এক বছর যাবৎ ফার্সীর প্রাথমিক বইপত্র পড়াশোনা করি। এরপর দারভাঙ্গায় অবস্থিত ‘দারুল উলূম আহমাদিয়া সালাফিইয়া’য় জামা‘আতে উলায় ভর্তি হই এবং সেখানে আরবী শিক্ষা শুরু করি। পরের বছর আমার পিতা ইস্তফা দিয়ে এখান থেকে মুর্শিদাবাদ চলে যাওয়ার কারণে সেখানকার দারুল হাদীছ মাদ্রাসায় দোসরী জামা‘আত শেষ করি। জামে‘আ সালাফিইয়াহ, বেনারসের শায়খুল হাদীছ যখন মাওলানা আযাদ রহমানী মারফত আমার পিতাকে বেনারসে ডেকে পাঠান তখন ১৯৬৯ সালে জামে‘আ রহমানিয়া, বেনারসে তেসরী জামা‘আত থেকে শিক্ষা অর্জন করি। চৌথী জামা‘আতের পর ‘আলামিয়াতের চার বছর ও ফাযীলাতের দুই বছর জামে‘আ সালাফিইয়াহ, বেনারসে সম্পন্ন করে ১৯৭৬ সালে ফারেগ হই। অতঃপর ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারীতে মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবী ভাষা অনুষদে ভর্তি হই। ১৯৮১ সালে অনার্স (লিসান্স) শেষ করে উম্মুল কুরা ও মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় উভয়টিতেই মাস্টার্সে চান্স পাই। আমি উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়কে নির্বাচন করি এবং ১৯৮৫ সালে মাস্টার্স ডিগ্রী লাভ করি। মাস্টার্সে থিসিসের বিষয় ছিল التأثير العربي في شعرحالى ونقده ‘হালীর কবিতায় আরবীয় প্রভাব ও তার সমালোচনা’। আমি এ থিসিসে হালীর ‘মুসাদ্দাস’ (ছয় পংক্তির কবিতা)-এর আরবীতে অনুবাদ করি। পিএইচ.ডি-তে আমার গবেষণার বিষয় ছিল       الشعر العربي في الهند: دراسة نقدية ‘ভারতে আরবী কবিতা : একটি সমালোচনামূলক পর্যালোচনা’। ১৯৯০ সালে আমি যখন অভিসন্দর্ভ জমা দিতে চাইলাম, তখন সুপারভাইজারের সাথে আমার মতভেদ সৃষ্টি হয়। সেকারণ আমার মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়নি। ফলে আমি ডক্টরেট ডিগ্রী থেকে বঞ্চিত হই। আমার শিক্ষা জীবন এ পর্যন্তই।

প্রশ্ন : আপনি কোন কোন শিক্ষক দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছেন?

ওযায়ের শামস : যখন আরবীর পহেলী জামা‘আতে আহমাদিয়া সালাফিইয়া মাদ্রাসায় ছিলাম, তখন মাওলানা নূর আযীম নাদভীর কাছে প্রাথমিক কিতাবাদি পড়েছিলাম। তিনি আমাদের আরবী বলা ও লেখার অনুশীলন করাতেন এবং ‘ইমলা’ বা শ্রুতলিখন সংশোধন করে দিতেন। আমি তাঁর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি যে, তিনি প্রাথমিক শিক্ষার জন্য যথেষ্ট মেহনত করেছিলেন। মরহুম চাচা মাওলানা আইনুল হক সালাফীর কাছে নাহু-ছরফের প্রাথমিক গ্রন্থগুলি পড়ি। সে সময় নাহু-ছরফের সমস্ত কায়েদা-কানূন মুখস্থ হয়ে যায়। যার ফল আজও পাচ্ছি। এছাড়া অন্যান্য শিক্ষকমন্ডলী দ্বারাও প্রভাবিত হই। মাওলানা মুহাম্মাদ রাঈস আহমাদ নাদভী ছাহেবের রিজাল শাস্ত্রের দক্ষতা ও মাওলানা আব্দুল মতীন ছাহেবের মা‘কূলাতের পান্ডিত্য দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হই।

প্রশ্ন : আপনি যখন জামে‘আ সালাফিইয়াহ, বেনারসে ছাত্র ছিলেন তখন জামে‘আ বিভিন্ন দিক থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ছিল। সে সময়ের কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা বলুন!

ওযায়ের শামস : ঐ সময় জামে‘আর শিক্ষা পরিবেশ কয়েকটি দিক থেকে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ছিল। প্রথমতঃ সেখানে শীর্ষস্থানীয় শিক্ষকগণ মওজুদ ছিলেন। দ্বিতীয়তঃ তখনকার পাঠ্যক্রম অত্যন্ত মানসম্পন্ন ছিল। মা‘কূলাত, দ্বীনিয়াত এবং ভাষা ও সাহিত্য এই তিনটি বিষয়ের উপর পূর্ণ গুরুত্ব দেওয়া হ’ত। এর ফলে ছাত্ররা আরবী বলতে ও লিখতে অনুপ্রাণিত হ’ত। তৃতীয়তঃ তখন ছাত্র সংখ্যা কম ছিল। ছয়টি ক্লাসে সর্বসাকুল্যে প্রায় ১০০ জন ছাত্র ছিল। নতুন শিক্ষানীতিতেও আপনি দেখবেন যে, একটি শ্রেণীতে ২৫-এর অধিক ছাত্র রাখা হয় না। আমাদের ক্লাসেও ছাত্রের সংখ্যা ১৫-১৬ জন ছিল। ছাত্র কম হওয়ার কারণে শিক্ষকদের পূর্ণ মনোযোগ তাদের প্রতি নিবিষ্ট থাকত। চতুর্থ বৈশিষ্ট্য এই ছিল যে, ছাত্রদের মাঝে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার আগ্রহের পারদ সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল। আমরা পাঁচজন সহপাঠী বিশেষ করে মাওলানা ছালাহুদ্দীন, বদরুয্যামান নেপালী, রফী আহমাদ ও শিহাবুল্লাহ যা কিছু পড়তাম সে বিষয়ে পরস্পরে মতবিনিময় করতাম। ةاريخ الدعوة الاسلامية ‘ইসলামী দাওয়াতের ইতিহাস’ বইটির জন্য পালা নির্ধারিত ছিল। একজন ছাত্র পড়া শেষ করলে দ্বিতীয়জনের পালা আসত। একজন কোন পত্রিকা পড়লে অন্যজন আরেকটি পত্রিকা পড়ত। একজন আহমাদ আমীনের বই পড়লে আরেকজন ত্বহা হুসাইন-এর বইপত্র পড়ত। আবার অন্যজন আক্কাদ-এর সাহিত্য পড়ত। মোটকথা প্রতিযোগিতার এক অদম্য আগ্রহ ছিল। যা তাদেরকে সামনে অগ্রসর হ’তে প্রেরণা যোগাতো। সে সময় ছাত্রদের যথেষ্ট স্বাধীনতা ছিল। আমরা এখান থেকে বের হয়ে কখনো হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে, কখনো রামনগরে, কখনো সারনাথে চলে যেতাম। আবার কখনো গোদোউলিয়া চার্চে যেতাম। কখনো গুরুদুয়ারায় চলে যেতাম। সেখানে শিখদের পবিত্র গ্রন্থাবলী অধ্যয়ন করেছি। অর্থাৎ স্রেফ পুঁথিগত বিদ্যা নয়, বরং ভ্রমণ ও আনন্দ-বিনোদনের মাধ্যমেও জ্ঞানের ভান্ডার সমৃদ্ধ করি।

মোদ্দাকথা হ’ল, সে সময় জামে‘আয় বড় বড় আলেম-ওলামা ও জ্ঞানী-গুণীদের আগমন বেশী ঘটত। তাদের কাছ থেকে অনেক ইলমী ফায়েদা হাছিলের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। ক্বারী তৈয়ব ছাহেব দেওবন্দ থেকে এখানে আসেন। মাওলানা আবুল হাসান মিঞা আলী নদভী, প্রফেসর মুখতারুদ্দীন আরযু ছাড়াও আরব শায়খগণের আসা-যাওয়া চলতে থাকত। তাঁদের সাথে সাক্ষাতের মাধ্যমে ব্যক্তিত্ব গঠন ও বিকাশের স্পৃহা সৃষ্টি হ’ত।

প্রশ্ন : বলা হয়ে থাকে যে, মাদ্রাসা শিক্ষা সমাপ্তকারী ছাত্ররা সমকালীন চাহিদা সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞান লাভ করতে পারে না। যদি এটা সঠিক হয়, তাহ’লে আপনার দৃষ্টিতে এর সংস্কার কিভাবে সম্ভব?

ওযায়ের শামস : আমার মতে, আমরা যখন মাদ্রাসায় থাকি তখন সে সময় পৃথিবীতে কি ঘটছে এবং মুসলিম উম্মাহর সামনে কোন সমস্যা রয়েছে প্রভৃতি সম্পর্কে আমরা বেশীর বেশী পত্র-পত্রিকা পড়ে জ্ঞান লাভ করি। কিন্তু বাস্তবে আমরা সরাসরি সেসব সমস্যার মুখোমুখি হই না। আমার প্রস্তাব হ’ল, মাদ্রাসার শিক্ষা সমাপ্তকারী প্রত্যেক ছাত্রকে আধুনিক কোন ইউনিভার্সিটির অধীনে এক বা দুই বছরের কোন কোর্স হতে পারে ডিপ্লোমা কোর্স অবশ্যই করা উচিত। সেখানে ছাত্ররা বিভিন্ন চিন্তাধারার মানুষের মুখোমুখি হবে, যার মাধ্যমে তাদের সাথে আলোচনা, বিতর্ক, সংলাপ প্রভৃতির নিয়ম-নীতি ও পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পারবে। মাদ্রাসা শিক্ষায় ততক্ষণ পর্যন্ত উদার মনোভাব সৃষ্টি হয় না যতক্ষণ না সেখানকার পরিবেশ থেকে বের হয়ে নানামুখী চিন্তাধারা মানুষের মতামত বা দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে জানা হয়। যুগের চাহিদার সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য মাদ্রাসা শিক্ষা সমাপ্তকারীদেরকে সরাসরি জ্ঞানার্জনের মানসে নিজের সময়কে উক্ত পরিবেশে অতিবাহিত করতে হবে এবং বিভিন্ন ধ্যান-ধারণার লোকদের মুখোমুখি হ’তে হবে।

প্রশ্ন : এক শ্রেণীর মানুষ মাদ্রাসার ছাত্রদের সমকালীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা অর্জন করার বিরোধী। তাদের ধারণা আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হওয়ার পরে মাদ্রাসা ছাত্রদের চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তন সূচিত হয় এবং তারা তাদের দ্বীনী ও ইলমী পুঁজিকে পশ্চাতে নিক্ষেপ করে। এর কারণ কি হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

ওযায়ের শামস : সমকালীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হওয়ার পর ছাত্রদের চিন্তা-ভাবনায় দৃশ্যমান পরিবর্তন এজন্য হয় যে, এখানে ছাত্ররা মৌলিকভাবে দৃঢ় থাকতে পারে না। আমার দৃষ্টিতে এটা শিক্ষার ত্রুটি, ছাত্রের নয়। মাদ্রাসায় যেসব বিষয় তাদের মাথায় ঢুকানো হয় তাতে তাদের ভিতরে মযবূতী সৃষ্টি হয় না। যদি আপনি মাদ্রাসার অভ্যন্তরে এমন যোগ্যতা তৈরী করতে পারেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থার মোকাবিলা করতে পারবেন, তাহ’লে আপনি বিজয়ী থাকবেন। অন্যথা পরাজিত হবেন। চিন্তাগতভাবে এর জন্য প্রয়োজন হ’ল, মন-মানসিকতায় উদার হওয়া। বিশেষ করে ফিক্বহী মাসআলা-মাসায়েলে বেশী কঠোরতা পরিহার করা উচিত। উদাহরণস্বরূপ আমি এ আহবান জানাই যে, মাযহাবী মতভেদ সমূহে খুব বেশী গভীরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এসব ইজতিহাদী মাসায়েলের ক্ষেত্রে অধিক থেকে অধিকতর বিশ্লেষণ ও সূক্ষ্ম তদন্তের পর এর ফল এটা আসবে যে, এটা প্রাধান্যযোগ্য মত। কোন জিনিসকে আপনি বিদ‘আত বলতে পারবেন না (ফিক্বহী মাসায়েলের ক্ষেত্রে, আক্বীদার ক্ষেত্রে নয়)। এজন্য অনেক মানুষ এসব মাসআলা-মাসায়েল নিয়ে ব্যস্ত থেকে জীবনপাত করে এবং বিরোধী মাযহাবকে নিজের সবচেয়ে বড় দুশমন মনে করে। এমন মানসিকতা পরিবর্তন করা দরকার। এ ধরনের মানসিকতা পোষণ করা উচিত নয়। আমাদের চিন্তা-ভাবনা হবে ইসলামী। যা অনৈসলামিক চিন্তা-চেতনার মুকাবিলায় প্রস্ত্তত থাকবে। আসলে আমরা যেসব মাসআলা নিয়ে আলোচনা করি তার ৯০ শতাংশ সেসব সমস্যা নয়, যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয় সমাজ, দেশ বা জাতি।

প্রশ্ন : বর্তমানে ইসলামী মাদ্রাসাগুলোর অবস্থা ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। দিন দিন মাদ্রাসার সাথে মানুষের সম্পর্ক দুর্বল হচ্ছে এবং অভিভাবকগণ তাদের সন্তানদেরকে মাদ্রাসায় পাঠানোর ব্যাপারে আগ্রহ হারাচ্ছেন। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের কার্যকরী পদক্ষেপ কি হ’তে পারে বলে আপনি মনে করেন?

ওযায়ের শামস : জী হ্যাঁ। বর্তমান চিত্র অবর্ণনীয়। বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতের অবস্থা তো আরো খারাপ। হায়দরাবাদের মাদ্রাসাগুলোতে স্থানীয় ছাত্রদের কোন নাম-গন্ধ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। আরবী শ্রেণীগুলোতে তো মোটেও নেই। সুখের কথা হ’ল এ অবস্থা উত্তর প্রদেশের মাদ্রাসাগুলোতে নেই। তবে ধীরে ধীরে এ রোগ তীব্র আকার ধারণ করছে। যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি মাদ্রাসার কারিকুলাম এমন যুগোপযোগী না করবেন যে, অভিভাবকরা বুঝতে পারবেন যার ফলে এই ছাত্ররা ফারেগ হওয়ার পর কতটা উপকারী সাব্যস্ত হবে? ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষের মনোযোগ সেদিকে আকৃষ্ট হবে না। মাদ্রাসার ভিতরে যদি কোন ধরনের আকর্ষণী শক্তি না থাকে তাহ’লে মানুষ মনে করবে যে, এখানে পঠন-পাঠন সময় নষ্ট বৈ কিছুই নয়। মাদ্রাসাগুলোর আত্মসমালোচনা করা দরকার যে, তাদের ভিতরে কোন কোন জিনিসের ঘাটতি রয়েছে? কি কারণে ছাত্ররা মাদ্রাসামুখী হয় না? মাদ্রাসাগুলোর মধ্যে এমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে হবে এবং সেগুলির মধ্যে এমন নতুনত্ব সৃষ্টি করতে হবে, যাতে ছাত্ররা এখানে মনের টানে আসে এবং ফারেগ হওয়ার পর কোন না কোন জায়গায় নিযুক্ত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। মূলতঃ মাদ্রাসার যে সিলেবাস রয়েছে আদতে তা সিলেবাসই নয়। এখানে শুধু মোটা মোটা কিতাব আছে। এসব মোটা মোটা কিতাব পাঠ্যসূচীভুক্ত হতে পারে না। মাদ্রাসাগুলোতে সিলেবাস সংস্কার বলতে বুঝায় একটি কিতাবের নাম বাদ দিয়ে তদস্থলে অন্য কিতাবের নাম অন্তর্ভুক্ত করা। এটাকে সিলেবাস বা সিলেবাস সংস্কার বলা যায় না।

প্রশ্ন : তাহ’লে আপনি সিলেবাসে নতুনত্ব নিয়ে আসার পক্ষপাতী?

ওযায়ের শামস : জী হ্যাঁ! আপনারা মাদ্রাসায় ঐসব বিষয়ই পড়াবেন যা এখন পড়াচ্ছেন। কিন্তু সমকালীন চাহিদা অনুযায়ী পড়াবেন। কুরআন, হাদীছ, ফিক্বহ, তাফসীর সবকিছুই পড়াবেন। কিন্তু নতুন পদ্ধতিতে। বর্তমানে আহলেহাদীছ মাদ্রাসাগুলোতে এ প্রবণতা আছে যে, তারা হানাফী ফিক্বহ পড়ান না। যে পরিবেশে একজন ছাত্র থাকে এবং যেখানে যে ফিক্বহের প্রচলন আছে, তা অধ্যয়ন করা যরূরী। এর পাশাপাশি অন্যান্য যেসব মাযহাব ও মাসলাক আছে তার পাঠদান করাও যরূরী। একজন শিক্ষার্থী যখন এ সমস্ত বিষয় না দেখবে তখন সে ফারেগ হওয়ার পর কি করবে? মানুষকে কিভাবে বুঝাবে? আপনারা মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার বা সিলেবাসের ত্রুটি এ বিষয়টা থেকে অনুমান করতে পারেন যে, যারা মাদ্রাসার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন তারা তাদের সন্তানদেরকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও আধুনিক কলেজে পড়ান। এটা কেন? এর অর্থ হ’ল আপনাদের সিলেবাস ত্রুটিপূর্ণ। আপনারা যখন নিজেদের সন্তানদের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারটি অনুধাবন করছেন, তাহ’লে জাতির সন্তানদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করার জন্য কেন উঠেপড়ে লেগেছেন?

প্রশ্ন : তাহকীক আপনার পসন্দের বিষয়। বিশেষত পান্ডুলিপির ময়দানে আপনি বিশাল খিদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। তাহকীক সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতার কথা কিছু বলুন!

ওযায়ের শামস : পান্ডুলিপির প্রতি আমার মনের টান শুরু থেকেই ছিল। (পাটনার) খোদাবখ্শ লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত পান্ডুলিপির সূচীপত্র তৈরী করার কাজে কিছুদিন নিয়োজিত ছিলাম। অতঃপর মদীনা ইউনিভার্সিটিতেও সূচীপত্র তৈরির কাজ করেছি। পান্ডুলিপির ময়দানে এমন বহু কিতাব আমার চোখে পড়েছে যা শত শত বছর যাবৎ ধরে অমুদ্রিত ছিল। সম্পাদনা করে সেগুলো প্রকাশ করা, সেগুলো সম্পর্কে পর্যালোচনা ও গবেষণা করা এবং প্রবন্ধ লেখার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। একটা সময় ছিল যখন অনেক কষ্টে পান্ডুলিপি পর্যন্ত পৌঁছা সম্ভব হ’ত। কিন্তু এখন তো একাজ অনেক সহজ হয়ে গেছে।

পান্ডুলিপির ক্ষেত্রে যথেষ্ট বিস্তৃত। এতে তাখাছ্ছুছ বা বিশেষ যোগ্যতা হাছিলের প্রয়োজন রয়েছে। আরবীর যোগ্যতা, আরবী লিপিকলা সম্পর্কে জ্ঞান, পান্ডুলিপি সম্পর্কিত জ্ঞান ও বিজ্ঞান সম্পর্কে জানাশোনা থাকা যরূরী। আসলে খুব কম লোকই এদিকে মনোনিবেশ করে। তবে যার মনে আকর্ষণ সৃষ্টি হয়ে যায় সে এটা ছেড়ে অন্য কোন দিকে যেতে চায় না। আমি ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) রচিত কিতাবগুলোর একটি তালিকা তৈরী করি যে, তাঁর কোন কোন কিতাব প্রকাশ হয়েছে এবং সেগুলি কোথা থেকে প্রকাশিত হয়েছে? আমি পৃথিবীর বিভিন্ন লাইব্রেরীর তালিকা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখে বুঝতে পেরেছি যে, বহু বই অপ্রকাশিত রয়েছে। সঊদী আরবের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে বহু পান্ডুলিপির ফটোকপি মওজুদ ছিল। তন্মধ্যে যেগুলো অপ্রকাশিত ছিল সেগুলি জমা করতে শুরু করি এবং এক এক খন্ড করে ছাপতে থাকি।

আমি ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ)-এর ঐ সকল ফৎওয়া, রাসায়েল-মাসায়েল প্রভৃতি যা কোথাও ছাপা হয়নি সেগুলি একত্রিত করলাম, যা দশ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। এজন্য আমি পৃথিবীর ৮০ থেকে ৮২টি লাইব্রেরীর প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ খন্ডের তালিকা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখি। চাই তা আরবী, উর্দূ, ইংরেজী, ফার্সী, জার্মানী, ফরাসী যে ভাষাতেই হোক। অনুরূপভাবে ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ)-এর কিতাবের উপরেও গবেষণা করেছি যে, পৃথিবীতে কোথায় কোথায় তাঁর কিতাবের হস্তলিখিত কপি পাওয়া যায়? আপনি ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ)-এর কোন কিতাব সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞেস করুন! আমি বলে দিব যে, সেটার কোন কোন হস্তলিখিত পান্ডুলিপি কোথায় মওজুদ আছে? এভাবে ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) সম্পর্কে কোন ব্যক্তি কি লিখেছে? তাঁর উপরে লিখিত প্রবন্ধ সমূহ, পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় কোন কিতাবে তাঁর উপর এক একটি অধ্যায়, অনুচ্ছেদ বা বিশ্বকোষে তাঁর উপর যা কিছু লেখা হয়েছে তাও বলতে পারব। মোটকথা এসব বিষয় গবেষণা করার চেষ্টা করেছি। দু’টি Bibliography তৈরী করেছি। একটি তাঁর জীবনী সম্পর্কে এবং অন্যটি তার পান্ডুলিপি সম্পর্কে। ইনশাআল্লাহ দ্রুত তা প্রকাশ পাবে।

প্রশ্ন : মাদ্রাসার ছাত্রদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন!

ওযায়ের শামস : মেহনত করুন! এখন থেকে একটা লক্ষ্য নির্ধারণ করুন যে, আমি কি হ’তে চাই? কোন ব্যক্তিকে নিজের আদর্শ হিসাবে নির্ধারণ করুন যে, তার মতো কাজ করব বা তার চেয়ে ভাল কাজ করব। অথবা যে ক্ষেত্রে শূন্যতা রয়েছে তা পূরণ করব। একথা জেনে নিন যে, প্রত্যেক মানুষ সব ক্ষেত্রে কাজ করতে পারে না। অথবা সকল বিষয়ে সমান যোগ্যতা হাছিল করতে পারে না। যে ব্যক্তি এরূপ দাবী করবে, সে নির্বোধ। যে বিষয়ে আকর্ষণ রয়েছে সেটা বেছে নেয়া উচিত। পঠন-পাঠন, দাওয়াত ও তাবলীগ, রচনা ও গবেষণা, অনুবাদ, সাংবাদিকতা, রাজনীতি যেটাই আপনার পসন্দ হবে তার জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ করুন! এজন্য আদর্শ ব্যক্তি নির্ধারণ করুন এবং নিজে মেহনত করুন। ইনশাআল্লাহ অবশ্যই সফলতা আসবে।

 







তাবলীগী ইজতেমা উপলক্ষে সাক্ষাৎকার : প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবে
মতলববাজদের দুরভিসন্ধিতে সাম্প্রদায়িক হামলা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মাওলানা ইসহাক ভাট্টি (২য় ভাগ) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
প্রফেসর শাহ মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান - আত-তাহরীক ডেস্ক
মাওলানা ওযায়ের শামস - তানযীলুর রহমান - শিক্ষক, বাউটিয়া দাখিল মাদ্রাসা, রাজশাহী
মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের হজ্জব্রত পালনঃ একটি সাক্ষাৎকার
প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া - আত-তাহরীক ডেস্ক
শায়খ তালেবুর রহমান শাহ - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
মাওলানা ইসহাক ভাট্টি (১ম ভাগ) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
সাক্ষাৎকার (শায়খ হাদিয়ুর রহমান মাদানী) - আত-তাহরীক ডেস্ক
সাক্ষাৎকার - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
১৯৯১ সালে ‘যুবসংঘ’ কর্তৃক আয়োজিত ‘২য় জাতীয় সম্মেলন ও তাবলীগী ইজতেমা’ সম্পর্কে প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবে’র এই স্মৃতিচারণ
আরও
আরও
.