ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প চালু হয়ে গেল। ভারতের পনি সম্পদমন্ত্রী উমা ভারতী গত ১৬ই মে’১৬ সোমবার উক্ত ঘোষণা দিয়েছেন। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আশ্বস্ত করেছিলেন, বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো প্রকল্প তারা নেবেন না। বিশেষ করে বরাক নদীর উজানে ‘টিপাইমুখ ড্যাম প্রকল্প’ এবং ‘আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প’ করার আগে তারা বাংলাদেশের অনুমতি নেবে। কিন্তু তারা সে কথা রাখেননি। ১৯৯৮ সালে বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ জোট সরকার গঠনের পর প্রথম আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প হাতে নেয় ভারত। পরে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোটের আমলে পরিবেশবাদীদের বিরোধিতার কারণে তা এগোয়নি। এরপর ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নর্মদা ও শিপ্রা নদীকে খালের মাধ্যমে যুক্ত করার কাজের মধ্য দিয়ে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। ভারতের এমন সর্বনাশা প্রকল্পের বিরোধিতা করেছেন দেশটির পরিবেশবাদীরা। তারা বলেছেন, এভাবে নদীর পানি প্রত্যাহার করা হলে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশই শুধু নয়, ভারতের জন্যও তা বিপর্যয় ডেকে আনবে। ভারতের পরিবেশবাদীদের এমন বিরোধিতা সত্ত্বেও সে দেশের পানি-সম্পদমন্ত্রী বিবিসিকে বলেন, নদী সংযোগ প্রকল্প আমাদের প্রাইম এজেন্ডা এবং এ বিষয়ে জনগণ আমাদের পক্ষে। দ্রুত এই প্রকল্প এগিয়ে নিতে আমরা বদ্ধপরিকর’। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে ২০১৫ সালের ১৩ই জুলাই ভারতের মিডিয়ায় ফলাও করে সংবাদ প্রচার হলে ওই সময় বাংলাদেশ এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। হুজুগে ভোটারদের মনরক্ষা করতে গিয়ে ভারত যেভাবে আন্তর্জাতিক নদীগুলিকে খাল বানানোর কাজে হাত দিয়েছে, তাতে আগামী এক দশকের মধ্যেই তাকে পস্তাতে হবে। সারা ভারত পানির অভাবে খরতাপে পুড়ে মরবে। তখন বর্তমান সরকার থাকবে না। কিন্তু থাকবে তাদের পাপের ফসল। তখন আজকের ভোটাররাই তাদের অভিশাপ দিবে।
প্রতিবেশীর বৈরী পানিনীতি এবং ফারাক্কার কারণে এককালের প্রমত্তা পদ্মায় যখন শুধুই হাহাকার, তখন ভারত সরকার গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রসহ বড় বড় নদীর পানি প্রবাহ ভিন্ন খাতে সরিয়ে নিতে যাচ্ছে। এতে বিভিন্ন নদীর মধ্যে ৩০টি সংযোগ খাল স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। যাতে এক অববাহিকার উদ্বৃত্ত পানি অন্য অববাহিকায় যেখানে ঘাটতি রয়েছে, সেখানে স্থানান্তর করা যায়। এই সংযোগ খাল সমূহের মধ্যে ১৩টি হিমালয় বাহিত এবং ১৬টি পেনিনসুলার বা বিভিন্ন নদী ও উপদ্বীপ থেকে উৎসারিত। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারত সারাদেশে ৭৪টি জলাধার ও বেশ কিছু বাঁধ নির্মাণ করবে। ফলে বর্ষার সময় সঞ্চিত পানি শুকনো মৌসুমে বিভিন্ন স্থানে কৃষি ও অন্যান্য কাজে সরবরাহ করবে। এছাড়া শুষ্ক মৌসুমেও এসব সংযোগ খালের মাধ্যমে এক জায়গার পানি আরেক জায়গায় নেয়া যাবে। এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ হাযার কোটি মার্কিন ডলার। ২০১৬ সালের মধ্যে সংযোগ খালসমূহ খনন করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় ১৪টি লিংক তৈরি করা হবে। এই লিংকগুলোর মাধ্যমে ভারতের অভ্যন্তরে নদীগুলোর মধ্যে সংযোগ প্রতিষ্ঠা করা হবে। দেশের পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তঃনদী সংযোগের ফলে ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রবাহ ভারতের অন্য অঞ্চলে চলে গেলে তার ভয়াবহ প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে। ইতিমধ্যেই ফারাক্কা ও গজলডোবার বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশের একটি বিশাল অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। আর যদি ভারত ‘আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করে, তাহলে গোটা বাংলাদেশই পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। এক কথায় মরুভূমিতে পরিণত হবে। ইতিমধ্যে ভূগর্ভের পানি স্তর বহু নীচে নেমে গেছে। টিউবওয়েলে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। সুপেয় পানি এখন আর্সেনিক বিষে দুষ্ট হয়ে গেছে। খাল-বিল-পুকুর শুকিয়ে গেছে। মৎস্যসম্পদ শেষ হয়ে গেছে। বায়ু মন্ডল ক্রমেই উত্তপ্ত হচ্ছে। বজ্রপাতে মৃত্যুর হার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবহাওয়া পরিবর্তনের আভাষ পাওয়া যাচ্ছে। সবকিছুর মূলে মনুষ্যসৃষ্ট পানি দুর্যোগ। নেতৃত্বের ভিখারী অদূরদর্শী নেতাদের অপকর্মের কারণে বলতে গেলে পুরা উপমহাদেশ এখন চরম হুমকির মধ্যে পড়েছে।
পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ভাটির দেশ। ভারতের সাথে আমাদের ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে। দু’দেশের স্বার্থেই ভারতকে এসব নদী বাঁচিয়ে রাখতে হবে। নদীর প্রবাহ ঠিক রাখতেই ভারতকে তার আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প থেকে সরে আসতে হবে। তিনি বলেন, দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমাধান না হলে বাংলাদেশ প্রয়োজনে বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলবে’।
প্রতিমন্ত্রীর এই বক্তব্যে আমরা কিছুটা আশ্বস্ত বোধ করছি। কারণ ভারত একটি আধিপত্যবাদী শক্তি। চূড়ান্ত স্বার্থপর হওয়ার কারণে প্রতিবেশী কোন দেশের সাথেই তাদের সদ্ভাব নেই। এদের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা সময়ের অপচয় মাত্র। ১৯৭৫ সালে বন্ধুত্বের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তারা ২১শে এপ্রিল থেকে ৩১শে মে’৭৫ পর্যন্ত মাত্র ৪১ দিনের জন্য ফারাক্কা বাঁধ পরীক্ষা মূলকভাবে চালু করার বিষয়ে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি করে। অথচ বিগত ৪১ বছর ধরে তারা একতরফাভাবে পানি শোষণ করে চলেছে নির্লজ্জভাবে। ইতিমধ্যেই পদ্মা-তিস্তা শুকিয়ে উত্তরবঙ্গে মরুকরণ শুরু হয়ে গেছে। ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য আজ মারাত্মক হুমকির মুখে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য অতি প্রয়োজনীয় বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ঘূর্ণিঘড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে বাংলাদেশের সেফগার্ড পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি সুন্দরবন ক্রমশঃ ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলেছে। জোয়ারের সময় সমুদ্রের লোনা পানি দেশের অভ্যন্তর ভাগে প্রবেশ করলে নদীর পানি সেই লোনা পানিকে ঠেলে সমুদ্রে ফেরত পাঠায়। কিন্তু ফারাক্কার কারণে নদীর পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়ছে পুরো পদ্মা অববাহিকায়। এই লবণাক্ততার ফলে দেশের বিরাট অংশের ক্ষেতখামার, শিল্পকারখানা আজ মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ বিলুপ্ত হওয়ার পথে। পদ্মার ওপর নির্ভরশীল বিভিন্ন পেশার লাখ লাখ মানুষ আজ জীবিকাহারা। ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ই শুধু নয়, বাংলাদেশের ওপর আর্থ-সামাজিক একটি বড় বিপর্যয় ধেয়ে আসছে। সেই সাথে যোগ হয়েছে ১৯৯৮ সালে তিস্তা নদীর উপরে ভারতের দেওয়া গজলডোবা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের তিস্তা অববাহিকায় মরুকরণ প্রক্রিয়া। দেশের ছোট-বড় মোট ৪০৫টি নদীর মধ্যে কয়েকটি বাদে প্রায় সবগুলিই এখন মৃত বা আধা মৃত। এমনকি বৃহত্তম নদী পদ্মা-যমুনা-তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের বুকে এখন কোন কোন স্থানে গরুর গাড়ী চলছে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও নদী গবেষক ড. এস.আই খান বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম জরিপে নদীপথ ছিল ৩৭ হাযার কি.মি. যা ২০০২ সালে কমে ৬ হাযার কিলোমিটারে নেমে আসে এবং শুষ্ক মওসুমে নেমে আসে ২ হাযার কিলোমিটারে। ২০১০ সালের নভেম্বরে দেওয়া রিপোর্টে তিনি বলেন, এখন থেকে প্রায় এক দশক আগেও বছরে প্রায় ২০০ কোটি টন পলি মাটি আসতো, এখন তার চেয়ে অনেক বেশী আসে। শতকরা ৬০ ভাগ পলি আসে গঙ্গা দিয়ে, ৪০ ভাগ আসে অন্যান্য নদী দিয়ে। নদী প্রবাহ স্বাভাবিক থাকলে শতকরা ৮০ ভাগ পলি চলে যেতো সমুদ্রে। কিন্তু ভারতের পানি আগ্রাসী নীতির কারণে শতকরা ৮০ ভাগ পলি জমাট হয়ে নদী-নালা, খাল-বিল ভরাট হয়ে যাচ্ছে। মাত্র ২০ ভাগ পলি সমুদ্রে যায়। তিনি আরও বলেন, ভারত থেকে আসা পলির ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। আমাদের জমি, নদী-নালা, খাল-বিল নিরাপদ করতে হলে পলি অপসারণ স্বাভাবিক রাখতে হবে। পলি নিয়ে যেতে হবে সমুদ্রে। ভারতে পলি অপসারণের রাস্তা আছে। তারা পলি জমলেই তা বাংলাদেশের ভিতরে ছেড়ে দেয়।
বাংলাদেশ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) ২০১৪ সালে দেওয়া তথ্য মতে দেশে ৫,৯৯৫ কি.মি. নৌপথের মধ্যে ১২-১৩ ফুট গভীরতার প্রথম শ্রেণীর নৌপথ আছে মাত্র ৬৮৩ কি.মি.। ৭-৮ ফুট গভীরতার দ্বিতীয় শ্রেণীর নৌপথ আছে প্রায় ১ হাযার কি.মি. এবং ৫-৬ ফুট গভীরতার তৃতীয় শ্রেণীর নৌপথ আছে মাত্র ১,৮৮৫ কি.মি.। যেটুকু নৌপথ আছে নাব্য সংকট থাকায় সেটুকুতেও নির্বিঘ্নে চলাচলের উপায় নেই। শুষ্ক মৌসুমে নাব্য সংকটের কারণে নৌযান বিশেষ করে ফেরি চলাচলে বিঘ্ন ঘটে।
১৯৭৬ সালে ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে ঢাকা থেকে চাপাই নবাবগঞ্জের কানসাট পর্যন্ত যে লংমার্চ হয়েছিল। সেখানে আগ্রাসী ভারতের উদ্দেশ্যে মাওলানা ভাসানীর ব্যাঘ্র হুংকার শোনা গিয়েছিল, ‘খামোশ’ (চুপ থাক)। আজ সেই হুংকার দেওয়ার মত নির্ভীক নেতা নেই। তবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর আমলে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করার মাধ্যমে ২০১২ সালের ১৪ই মার্চ ও ৭ই জুলাই প্রদত্ত রায়ে মিয়ানমার ও ভারতের নিকট থেকে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের ১ লাখ ১৮ হাযার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকায় সার্বভৌম অধিকার লাভ করে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ২০০ নৌ-মাইল (নটিক্যাল) একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং ৩৫৪ নৌ-মাইল মহীসোপানের মালিকানা পায়। এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় অর্জন। এখন বাংলাদেশ সেখানে স্বাধীনভাবে তৈল-গ্যাস অনুসন্ধান চালাতে পারবে এবং অন্যান্য সমুদ্রসম্পদ আহরণ করতে পারবে। এছাড়া ভারতের সাথে ২০১৫ সালের ৩১শে জুলাই এক চুক্তির মাধ্যমে বিগত ৬৮ বছর যাবৎ নাগরিকত্ব হারা ছিটমহলবাসীদেরকে স্বাধীনতার স্বাদ পাইয়ে দেওয়াটাও ছিল আরেকটি স্থায়ী অর্জন। যদিও দেশকে এজন্য দিতে হয়েছে অনেক কিছু। এক্ষণে যদি আন্তর্জাতিক আদালতে ভারতের বিরুদ্ধে পানি আগ্রাসনের অভিযোগ যথার্থভাবে তুলে ধরা যায়, তাহ’লে আমরা আশা করি সুবিচার পাব। সত্যের জয় হবেই। ভারতের অদূরদর্শী নেতারা ফারাক্কা ও গজলডোবা বাঁধ দিয়ে সাময়িকভাবে ভোটে জিতলেও এখন সেই ভোটাররাই তাদের বিরোধী হয়ে গেছে। কারণ বাংলাদেশকে শুকিয়ে মারতে গিয়ে নিজেরাই এখন শুকিয়ে এবং ডুবে মরছে। আগামীতে তারা কেবল নিজ দেশেই নয়, বিশ্ব সভায় লজ্জায় ডুববে। যে অপরের জন্য গর্ত খোড়ে, সে নিজে ঐ গর্তে ডুবে মরে, এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ যুলুমের শিকার। ইনশাআল্লাহ মযলূম বিজয়ী হবে। প্রয়োজন কেবল সরকারের সাহসী পদক্ষেপ। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন! (স.স.)।