পর্ব ১ । পর্ব ২ ।  পর্ব ৩ । পর্ব ৪  । পর্ব ৫  । পর্ব ৬ । শেষ পর্ব । 

‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ মুসলিম সমাজে একটি বহুল ব্যবহৃত পরিভাষা। ৩৭ হিজরীতে ওছমান (রাঃ)-এর হত্যাকান্ডের সূত্র ধরে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে যে রাজনৈতিক ফিৎনার জন্ম হয়, তা সময়ের পরিক্রমায় সুদূর প্রসারী ধর্মীয় ফিৎনার রূপ পরিগ্রহ করে। ফলে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে হক্বপন্থী ও বাতিলপন্থী দ্বৈরথ অনিবার্য হয়ে ওঠে। এই প্রেক্ষাপটে উদ্ভূত দল-উপদলগুলো কালক্রমে নানা বৈশিষ্ট্যগত অভিধায় পরিচিত হ’তে থাকে। ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ হ’ল অনুরূপই একটি বৈশিষ্ট্যগত নাম, যা প্রাচীন কাল থেকে বাতিলপন্থী যাবতীয় দল-উপদলের বিপরীতে ইসলামের সত্য ও সঠিক রূপকে ধারণকারী হক্বপন্থী দলের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে এই পরিভাষার নানা অপপ্রয়োগও দেখা যায়। কেননা ফেরকায়ে নাজিয়াহ বা মুক্তিপ্রাপ্ত দল হিসাবে প্রসিদ্ধ হওয়ায় এই জামা‘আতে নিজেদেরকে অন্তর্ভুক্ত করতে চায় এমন অনেক দল, যারা প্রকৃতপক্ষে এই জামা‘আতের গৃহীত নীতি ও আদর্শ বিবর্জিত। ফলে সাধারণ মানুষের নিকটে পরিভাষাটি সম্পর্কে প্রায়শই ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়। এই বিভ্রান্তি নিরসনে বক্ষমান প্রবন্ধে আমরা ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ দলটির পরিচিতি এবং এর বৈশিষ্ট্যসমূহ সবিস্তার আলোচনার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।

‘আহলে সুন্নাত ওয়া জামা‘আত’ পরিভাষাটির বিশ্লেষণ :

পরিভাষাটি বিশ্লেষণ করলে মূলতঃ দুটি শব্দ বা বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। (১) সুন্নাত (২) জামা‘আত। নিম্নে শব্দ দু’টির আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থ বিশ্লেষণপূর্বক আনুসঙ্গিক আলোচনা উপস্থাপন করা হ’ল-

(ক) সুন্নাত :

(১) سُنَّة (সুন্নাহ) শব্দটি سَنَّ মূল ধাতু থেকে فُعْلَةٌ-এর ওযনে مَفْعُوْلَةٌ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যার আভিধানিক অর্থ الطريقة والسيرة বা পথ-পদ্ধতি ও আচার-প্রথা।[1]

পারিভাষিক সংজ্ঞায় ‘সুন্নাত’-এর বেশ কয়েকটি অর্থ বর্ণনা করা হয়েছে। যা নিম্নরূপ :

ক. মুহাদ্দিছগণের পরিভাষায়,ما أثر عن النبي صلي الله عليه وسلم من قول أو فعل أو تقرير أو صفة خلقية أو خلقية أو سيرة سواء كان قبل البعثة أو بعدها রাসূল (ছাঃ)-এর যে সকল কথা, কর্ম, মৌন সম্মতি, সৃষ্টিগত গুণাবলী এবং চারিত্রিক গুণাবলী, আচার-আচরণের বিবরণ বিধৃত হয়েছে, সেটা নবুয়তপূর্ব জীবনে হোক বা পরবর্তী জীবনে হোক সবই সুন্নাহ’।[2] এই অর্থে সুন্নাহ এবং হাদীছ পরস্পর সমর্থক। তাঁরা সুন্নাতকে রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনের সমগ্র দিক ও বিভাগের সামষ্টিক নাম হিসাবে গ্রহণ করেছেন।

খ. উছূলবিদগণের পরিভাষায়,ما أضيف إلى النبي عليه الصلاة والسلام من قول أو فعل أو تقرير ‘যে সকল কথা, কর্ম ও অনুমোদনকে রাসূল (ছাঃ)-এর দিকে সম্বন্ধিত করা হয় তা-ই সুন্নাহ।’[3]

তারা সুন্নাতকে আল্লাহর কিতাবের পর শরী‘আতের ২য় দলীল হিসাবে গ্রহণ করেছেন এবং এ মর্মেই সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছেন। তাদের এই সংজ্ঞা অনুযায়ী পূর্ববর্তী রাসূলগণের আমল, রাসূল (ছাঃ)-এর নবুয়তপূর্ব কর্মকান্ড এবং ছাহাবায়ে কেরামের আমলসমূহ সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত হবে না।[4] যদিও পরবর্তী আহনাফদের কেউ কেউ ছাহাবায়ে কেরামের আমলকে এই সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত করেছেন[5] এবং আল্লামা শাত্বেবী একে জোরালো সমর্থন দিয়েছেন। তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর কথা, কর্ম ও অনুমোদনের মত খুলাফায়ে রাশেদীন বা ছাহাবায়ে কেরামের আমলও শরী‘আতের অকাট্য দলীল, সেটা কুরআন ও হাদীছে বর্ণিত হোক বা না হোক। যেমন মদ্যপানের হদ্দ, বন্ধক রাখা, কুরআন একত্রিতভাবে সংকলন করা, কুরআনের একটি কির’আতকে সর্বজনীনতা প্রদান করা প্রভৃতি বিষয়। এ মর্মেই রাসূল (ছাঃ) বলেন, فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ ‘তোমরা আমার ও আমার সৎপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে অাঁকড়ে ধর’।[6] অর্থাৎ ছাহাবায়ে কেরাম থেকে বর্ণিত বিষয়াদিও সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত।[7]

তবে জমহূর ওলামায়ে কেরামের মতে, ছাহাবায়ে কেরামের আমল যদিও শরী‘আতের একটি স্বতন্ত্র দলীল এবং সুন্নাত সংশ্লিষ্ট বিষয়, তবে সরাসরি সুন্নাতের অংশ নয়।[8]

গ. ফকীহ ওলামায়ে কেরামের পরিভাষায়, ما ثبت عن النبي صلي الله عليه وسلم من غير افتراض ولا وجوب ‘ফরয বা ওয়াজিব নয়, এমন যে সকল বিষয়াদি রাসূল (ছাঃ) থেকে সাব্যস্ত হয়েছে তাই সুন্নাত।[9] এটাই অধিকাংশ মাযহাবের গৃহীত মত।

ইবনুল হুমাম বলেন,ما واظب النبي صلي الله عليه وسلم علي فعله مع ترك ما بلا عذر ‘রাসূল (ছাঃ) যা নিয়মিত করতেন, তবে কোন ওযর ছাড়াই কখনো তা পরিত্যাগ করেছেন সে সকল আমলকে সুন্নাত বলে’।[10]

কবাযী বায়যাভী বলেন, ما يحمد فاعله ولا يذم تاركه ‘যা করাটা প্রশংসনীয়, তবে বর্জন করা নিন্দনীয় নয়’।[11]

অর্থাৎ ফকীহদের নিকট সুন্নাত বলতে শরী‘আতের মধ্যস্থ সাধারণ কোন ভাল অভ্যাস (الطريقة والعادة), পসন্দনীয় কাজ (المستحب والمندوب), ইচ্ছাধীন কাজ (التطوع) বা বৈধ কাজ (الزيادة والمباح) অর্থাৎ ফরয ইবাদতের বাইরে অতিরিক্ত সব আমলই বুঝায়। উল্লেখ্য যে, সুন্নাতের সাধারণ সংজ্ঞা তথা সুন্নাতকে শরী‘আতের উৎস হিসাবে গ্রহণের ক্ষেত্রে মুহাদ্দিছ এবং উছূলবিদদের সাথে ফকীহদের কোন পার্থক্য নেই। তবে তারা শরী‘আতের হুকুমের মধ্যে কোনটি আবশ্যক এবং কোনটি সাধারণ ইচ্ছাধীন তার মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করার জন্য এই বিশেষ সংজ্ঞাটি ব্যবহার করেছেন। এটি রাসূল (ছাঃ) থেকেই প্রমাণিত। যেমন তিনি বলেন,إِنَّ رَمَضَانَ شَهْرٌ افْتَرَضَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ صِيَامَهُ وَإِنِّي سَنَنْتُ لِلْمُسْلِمِينَ قِيَامَهُ  ‘নিশ্চয়ই এই রামাযান মাসে আল্লাহ তোমাদের উপর ছিয়ামকে ফরয করেছেন। আর আমি মুসলমানদের উপর কিয়ামকে (তারাবীহর ছালাত) সুন্নাত হিসাবে চালু করলাম’।[12] অনুরূপ তাবেঈ মাকহূলও মন্তব্য করেন, ‘সুন্নাত দুই প্রকার। (১) যা পালন করা অপরিহার্য এবং পরিত্যাগ করা কুফরী। (২) যা পালন করা ফযীলতপূর্ণ তবে পরিত্যাগ করলে সমস্যা নেই’।[13]

ঘ. আক্বীদাগত পরিভাষায়, সুন্নাত শব্দটি البدعة তথা নবাবিষ্কৃত আমলের বিপরীতে ব্যবহৃত হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই বলা হয়ে থাকে, فلان علي السنة ‘লোকটি সুন্নাতের উপর রয়েছে’, যখন সে বিশ্বাস, বুঝ, শরী‘আত গ্রহণ এবং আমলের ক্ষেত্রে রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশনার হুবহু অনুসরণের চেষ্টা করে। এর বিপরীতে বলা হয়-فلان علي البدعة ‘লোকটি বিদ‘আতের উপর রয়েছে’, যখন সে সুন্নাতের বিপরীত কাজ করে। ওছমান (রাঃ)-এর হত্যাকান্ডের পর ফিৎনা ছড়িয়ে পড়লে মুসলিম সমাজে বিদ‘আত এবং প্রবৃত্তিপরায়ণতার সূচনা হয়। ফলে ওলামায়ে কেরাম সুন্নাতের অনুসারী এবং বিদ‘আত ও প্রবৃত্তির অনুসারীদের মধ্যে পার্থক্য করতে শুরু করেন। যেমন বিশিষ্ট তাবেঈ মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (১১০হিঃ) বলেন,لم يكونوا يسألون عن الإسناد، فلما وقعت الفتنة، قالوا: سموا لنا رجالكم، فينظر إلى أهل السنة فيؤخذ حديثهم، وينظر إلى أهل البدع فلا يؤخذ حديثهم ‘মুসলমানরা (প্রাথমিক যুগে) সূত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করত না। কিন্তু ফিৎনা সংঘটিত হওয়ার পর তারা বলতে লাগলেন, তোমাদের লোকদের নাম বল (অর্থাৎ যাদের সূত্রে বর্ণনা করছ)। যদি দেখা যেত তারা সুন্নাতের অনুসারী, তবে তাদের হাদীছ গ্রহণ করা হ’ত; আর যদি তারা বিদ‘আতের অনুসারী হ’ত, তবে তাদের হাদীছ গ্রহণ করা হ’ত না’।[14]

এই অর্থটি আরও স্পষ্ট হয় রাসূল (ছাঃ)-এর বহুল প্রসিদ্ধ হাদীছ- مَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِي فَلَيْسَ مِنِّي ‘যে ব্যক্তি আমার সুন্নাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল, সে আমার দলভুক্ত নয়’।[15] অনুরূপভাবে রাসূল (ছাঃ) বলেন,وَشَرُّ الأُمُورِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ ‘সবচেয়ে নিকৃষ্ট হ’ল নতুন আমল, আর সকল বিদ‘আত বা নতুন আমলই ভ্রষ্টতা’।[16]

ইবনু শিহাব যুহরী বলেন,بلغنا عن رجال من أهل العلم، أنهم كانوا يقولون: الاعةصام بالسنن نجاة ‘বিদ্বানদের ব্যাপারে আমার কাছে পৌঁছেছে যে, তারা বলতেন, সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরাতেই মুক্তি রয়েছে’।[17] এই অর্থেই মদীনা নগরীকে তৎকালীন সময়ে دار السنة বলা হ’ত, যেহেতু সেখানে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতের সংরক্ষণ ও অনুশীলন সর্বাধিক ছিল। মদীনার এই আলোকজ্জ্বল ভূমিকার কারণে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত কেবল শারঈ মর্যাদাই পায়নি বরং সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবেও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিল। রাসূল (ছাঃ)-এর সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছিল,مَنْ أَحْدَثَ فِى أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيهِ فَهُوَ رَدٌّ ‘যে ব্যক্তি আমার এই দ্বীনে নতুন কিছু আবিষ্কার করল, যা তার অন্তর্ভুক্ত না, তা প্রত্যাখ্যাত’।[18] ফলে বিদ‘আত থেকে বেঁচে থাকার বিপরীতে সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরার এই আদর্শই হাদীছ সংরক্ষণ আন্দোলনে একটি বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। সেই সাথে রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর সালাফে ছালেহীনের পদাংক অনুসরণ, রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত অনুসরণেরই অপর নাম হয়ে গেল। এই অনুসরণকারীদের নাম হয়ে গেল ‘সালাফী’, যারা সুন্নাতের পুনর্জীবন এবং বিদ‘আতের অপনোদনে নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করলেন।[19]

এজন্য হিজরী তৃতীয় শতকের ওলামায়ে কেরাম ‘আস-সুন্নাহ’ শিরোনামে বহু গ্রন্থ রচনা করেন, যাতে আক্বীদা বিষয়ক আলোচনা এবং বিদ‘আতীদের ভ্রান্ত ধারণার খন্ডন সন্নিবেশিত হয়েছিল। যেমন- আহমাদ বিন হাম্বল সংকলিত ‘উছূলুস সুন্নাহ’, আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন হাম্বল, আবু বকর ইবনুল আছরাম, ইবনু আবী আছেম, মুহাম্মাদ বিন নাছর আল-মারওয়াযী, আহমাদ বিন মুহাম্মাদ আল-খাল্লাল রচিত ‘আস-সুন্নাহ’, ইবনু জারীর ত্বাবারী রচিত ‘ছরীহুস সুন্নাহ’, ইমাম বারবাহারীর ‘শারহুস সুন্নাহ’ প্রভৃতি।

ইবনু রজব বলেন, পরবর্তীকালের অধিকাংশ বিদ্বান সুনণাহ শব্দটি বিশেষভাবে আক্বীদার ক্ষেত্রে ব্যবহার করতেন। কেননা আক্বীদাই দ্বীনের মূল বিষয়। আর এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণকারীরা চরম বিপর্যয়ে নিমজ্জিত।[20]  

সুতরাং এই অর্থে সুন্নাত হ’ল বিদ‘আতীদের বাতিল আক্বীদার বিপরীতে কিতাব ও সুন্নাত দ্বারা প্রমাণিত ছহীহ আক্বীদা। ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বলেন, সুন্নাত হ’ল তা-ই যার অনুসরণ করা অপরিহার্য, যার অনুসারীরা প্রশংসিত এবং বিরোধীরা নিন্দিত। আর তা হ’ল আক্বীদা, ইবাদত এবং দ্বীনের অন্যান্য সকল বিষয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর আচরিত নীতি। বিশুদ্ধ হাদীছসমূহে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ)-এর কথা ও কর্ম সম্পাদন কিংবা নিষেধাজ্ঞার যে বিবরণ জানা যায় এবং ছাহাবী ও তাবেঈগণ যে নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, তা থেকে সুন্নাত সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায়।[21]

সারকথা : সুন্নাতের উপরোক্ত সংজ্ঞাগুলোর মধ্যে মুহাদ্দিছগণের গৃহীত সংজ্ঞাটিই সার্বজনীন। কেননা তা রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনের সমস্ত কর্মকান্ডকে শামিল করে। পূর্বসূরী ওলামায়ে কেরাম যারা সুন্নাতের সংকলন ও সংরক্ষণে নিয়োজিত ছিলেন, সকলেই সুন্নাতকে মূলতঃ এই অর্থে গ্রহণ করেছিলেন। তবে বিশেষ ব্যবহার হিসাবে অন্য অর্থগুলোও চালু রয়েছে।

(খ) জামা‘আত :

الجماعة শব্দটির উৎপত্তি হ’ল الجمع মূলধাতু থেকে। অর্থ বস্ত্তসমূহের একত্রিকরণ।[22] রাসূল (ছাঃ) বলেন,بُعِثْتُ بِجَوَامِعِ الْكَلِمِ ‘আমি ব্যাপকার্থবোধক বাক্যসমূহ সহকারে প্রেরিত হয়েছি’।[23] অর্থাৎ এমন বাক্যসমূহ যাতে শব্দসংখ্যা কম, অর্থ ব্যাপক।

الجماعة শব্দের অর্থ বহু সংখ্যক মানুষ অথবা এমন এক দল মানুষ যারা একক লক্ষ্যে সংগঠিত।[24] এর দ্বারা মূলতঃ একটি ঐক্যবদ্ধ বা সংঘবদ্ধ দল উদ্দেশ্য। ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বলেন, জামা‘আত হ’ল ঐক্যবদ্ধতা, যা বিচ্ছিন্নতার বিপরীত। তবে একটি ঐক্যবদ্ধ দলের জন্যই জামা‘আত শব্দটি ব্যবহৃত হয়।[25] এই অর্থেই আরবী الإجماع শব্দটি এসেছে, যার অর্থ ঐক্যমত পোষণ করা। কোন মাসআলায় আলেমদের ঐক্যমতকে الإجماع বলা হয়।

পারিভাষিক অর্থে জামা‘আত শব্দের ব্যাখ্যায় ইমাম ত্বাবারী পূর্বসূরীদের বেশ কিছু অভিমত একত্রিত করেছেন। আর তা হ’ল- (১) মুসলমানের মধ্যে বড় দল। (২) ফিরকায়ে নাজিয়ার মানহাজ তথা মুক্তিপ্রাপ্ত দলের গৃহীত নীতির অনুসারী ইমাম ও বিদ্বানগণ। (৩) ছাহাবীগণ। (৪) কোন শারঈ বিষয়ে ঐক্যমত পোষণকারী বিদ্বানগণ।[26] ইমাম শাত্বেবী অনুরূপ উল্লেখ করার পর পঞ্চম আরেকটি মত বৃদ্ধি করেছেন। তা হ’ল- মুসলমানদের জামা‘আত, যখন তারা কোন নেতার অধীনে ঐক্যবদ্ধ হয়।[27]

উপরোক্ত মতামতগুলি একত্রিত করলেযে অর্থ দাড়ায়, তা হ’ল-

(১) এখানে জামা‘আত অর্থ এমন দল, যেটি হক্বের অনুসারী এবং বিদ‘আত পরিত্যাগকারী। এটা হ’ল সত্য পথ যার উপর পরিচালিত হওয়া এবং যার অনুসরণ করা প্রত্যেকের জন্য অপরিহার্য। এটাই হ’ল ছাহাবীগণ এবং তাদের পথের অনুসারীদের গৃহীত নীতি ও মানহাজ, যা ‘মা আনা আলাইহে ওয়া আছহাবিহী’ (আমি (রাসূল ও আমার ছাহাবীগণ যার উপর প্রতিষ্ঠিত)-এর সঠিক রূপ। এই দলের অনুসারীর সংখ্যা কম হোক বা বেশী হোক, এদেরই অনুসরণ অপরিহার্য। এই সংজ্ঞা ইলমী বা বুদ্ধিবৃত্তিক অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন,إِنَّمَا الْجَمَاعَةُ مَا وَافَقَ طَاعَةَ اللهِ وَإِنْ كُنْتَ وَحْدَكَ ‘জামা‘আত হ’ল যা আল্লাহর আনুগত্যের অনুবর্তী হয়, যদিও তুমি একাকী হও না কেন’।[28]

(২) জামা‘আত হ’ল এমন দল যেটি কিতাব ও সুন্নাত মোতাবেক পরিচালিত একজন নেতার অধীনে ঐক্যবদ্ধ হয়। যাতে নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য থাকা অপরিহার্য এবং তা থেকে বেরিয়ে আসা নিষিদ্ধ। উল্লেখ্য যে, সুন্নাতের বিপরীতে কোন ঐক্যবদ্ধতা এখানে ধর্তব্য নয়। যেমন খারেজী, মু‘তাযিলা ও অন্যান্য দলসমূহ। এই সংজ্ঞাটি রাজনৈতিক অর্থেই বেশী ব্যবহৃত হয়, যা কুরআন ও সুন্নাহর বহু দলীল দ্বারা প্রমাণিত।[29]

মোদ্দাকথা উপরোক্ত সংজ্ঞাসমূহ থেকে বোঝা যায় যে, জামা‘আত শব্দের মধ্যে মৌলিক কিছু উপাদান থাকা আবশ্যক। যেমন তাতে একতাবদ্ধ বহু সংখ্যক মানুষ থাকবে, তা ভ্রষ্টতা ও ধ্বংস হওয়া থেকে মানুষকে রক্ষা করবে এবং তা একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে। ওলামায়ে কেরাম ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত’ বলতে যে দলটিকে বুঝিয়ে থাকেন, তাতে উপরোক্ত সকল উপাদান বিদ্যমান রয়েছে।                               [চলবে]


[1]. ইবনে মানযূর, লিসানুল আরাব, ১৩তম খন্ড, পৃ. ২২৫; আয-যুবায়দী, তাজুল আরূস, ৩৫ খন্ড, পৃ. ২২৯; মুহাম্মাদ আর-রাযী, মুখতারুছ ছিহাহ, পৃ. ৩২৬।

[2]. ড. মুছত্বফা আস-সিবাঈ, আস-সুন্নাহ ওয়া মাকানাতুহা ফিত তাশরীঈল ইসলামী , পৃ. ৪৭।

[3]. তাহের আল-জাযায়েরী, তাওজীহুন নাযর ইলা উছূলিল আছর, ১ম খন্ড, পৃ. ৪০; আবুল হাসান আল-আমেদী, আল-ইহকাম, ১ম খন্ড, পৃ. ১৬৯।

[4]. আব্দুল গণী আব্দুল খালেক, হুজ্জিয়াতুস সুন্নাহ, পৃ. ৬৯।

[5]. যেমন আল মানার, নূরুল আনওয়ার, ক্বমারুল আক্বমার প্রণেতাগণ এবং ফখরুল ইসলাম বাযদুভীর সকল অনুসারীবৃন্দ। দ্র. হুজ্জিয়াতুস সুন্নাহ, পৃ. ৬৯।  

[6]. আহমাদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/১৬৫।

[7]. আশ-শাত্বেবী, আল মুওয়াফাক্বাত, ৪র্থ খন্ড, পৃ. ২৯০-৯৩।

[8]. আব্দুল গণী আব্দুল খালেক, হুজ্জিয়াতুস সুন্নাহ, পৃ. ৭০।

[9]. ড. মুছত্বফা আস-সিবাঈ, আস-সুন্নাহ ওয়া মাকানাতুহা ফিত তাশরীঈল ইসলামী , পৃ. ৪৮।

[10]. শামসুদ্দীন ইবনু আমীরিল হাজ্জ, আত-তাক্বরীর ওয়াত তাহবীর, ২য় খন্ড, পৃ. ২২৩। 

[11]. তাজুদ্দীন আস-সুবকী, আল-ইবহাজ শারহুল মিনহাজ, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৬। 

[12]. মুসনাদ আহমাদ, হা/১৬৬০, ১৬৮৮; আব্দুর রহমান ইবনু আওফ থেকে বর্ণিত।

[13]. সুনান দারেমী, হা/৬০৯; সনদে দুর্বলতা থাকলেও মর্ম ছহীহ।

[14]. মুকাদ্দামাতু মুসলিম, ১ম খন্ড, পৃ. ১৫।

[15]. বুখারী, হা/৫০৬৩; মুসলিম হা/১৪০১।

[16]. মুসলিম হা/৮৬৭।

[17]. আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক, আয-যুহদু ওয়ার রাক্বায়েক্ব, হা/৮১৭, ১ম খন্ড, পৃ. ২৮১।

[18]. বুখারী হা/২৬৯৭; মুসলিম হা/১৭১৮।

[19]. ড. ছুবহী ছালেহ, উলূমুল হাদীছ ওয়া মুসতালাহুহু, পৃ. ৭-৯।

[20]. ইবনু রজব, জামি‘উল ‘উলূম ওয়াল হিকাম, ২য় খন্ড, পৃ. ৭৭৩।

[21]. ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমু‘উল ফাতাওয়া, ৩য় খন্ড, পৃ. ৩৭৮।

[22]. ইবনু ফারেস, মু‘জামু মাক্বায়ীসীল লুগাহ, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৭৯।

[23]. মুসলিম হা/৫২৩।

[24]. আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব, ১ম খন্ড, পৃ. ১৩৫।

[25]. ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমু‘উল ফাতাওয়া, ৩য় খন্ড, পৃ. ১৫৭।

[26]. ইবনু হাজার, ফাৎহুল বারী, ১৩শ খন্ড, পৃ. ৩৭।

[27]. আশ-শাত্বেবী, আল-ই‘তিছাম, ২য় খন্ড, পৃ. ২৬৩।

[28]. হিবাতুল্লাহ আল-লালকাঈ, শারহু উছূলিল ই‘তিক্বাদ, ১ম খন্ড, পৃ. ১২১।

[29]. ড. মুহাম্মাদ ইউসরী, ইলমুত তাওহীদ ইনদা আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ, পৃ. ২১-২২।





ইসলামে তাক্বলীদের বিধান (২য় কিস্তি) - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
মানুষের দো‘আয় শামিল হওয়ার উপায় - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
দাওয়াত ও সংগঠন (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
প্রাক-মাদ্রাসা যুগে ইসলামী শিক্ষা - আসাদুল্লাহ আল-গালিব (শিক্ষার্থী, ইংরেজী বিভাগ, ২য় বর্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)।
মুসলিম উম্মাহর পদস্খলনের কারণ - মীযানুর রহমান মাদানী
যাকাত ও ছাদাক্বা : আর্থিক পরিশুদ্ধির অনন্য মাধ্যম - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
শান্তির ধর্ম ইসলাম - মুহাম্মাদ রশীদ, উনাইযা ইসলামিক সেন্টার, সঊদী আরব।
পিতা-মাতার সাথে আদব সমূহ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
সীমালংঘন ও দুনিয়াপূজা : জাহান্নামীদের দুই প্রধান বৈশিষ্ট্য (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
মাদ্রাসার পাঠ্যবই সমূহের অন্তরালে (২য় কিস্তি) - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ঈদুল আযহা : গুরুত্ব ও তাৎপর্য - ড. মুহাম্মাদ আজিবার রহমান
আহলেহাদীছ আন্দোলন-এর পাঁচ দফা মূলনীতি : একটি বিশ্লেষণ (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
আরও
আরও
.