মোট ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, (উদাহরণ স্বরূপ) :
বিচার বিভাগ : সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অসদাচরণ তদন্ত ও অপসারণের সুফারিশ করার ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতেই ফিরছে। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের ৩ নম্বর দফায় বলা আছে, একটি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থাকবে। যা এই অনুচ্ছেদে ‘কাউন্সিল’ বলে উল্লিখিত হবে এবং প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকের মধ্যে পরবর্তী যে দু’জন কর্মে প্রবীণ তাদের নিয়ে গঠিত হবে। বিচারপতিদের জবাবদিহিতা ও ৩৯ দফা আচরণবিধি, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল, বিচারপতিদের নিয়োগ, ক্ষমতার পৃথকীকরণের বিষয়াদি রায়ের পর্যালোচনায় এসেছে। যদিও বর্তমানে একমাত্র বিচার বিভাগই অপেক্ষাকৃত স্বাধীন, তবুও তা ডোবার পথে।
তিনি বলেন, ‘এই সীমাহীন চ্যালেঞ্জের মুখে বিচার বিভাগই তুলনামূলকভাবে স্বাধীন অঙ্গ হিসেবে কাজ করছে, ডুবতে ডুবতে নাক উঁচিয়ে বেঁচে থাকার মতো। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে বিচার বিভাগও খুব বেশী দিন টিকে থাকবে না। এখনো পর্যন্ত উচ্চ আদালতের বিচারকদের নির্বাচন ও নিয়োগের কোন আইন হয়নি। নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের ক্ষমতা সংকুচিত করতে আগ্রহী। আর যদি তা হয় তাহ’লে এর চেয়ে ধ্বংসাত্মক আর কিছু হবে না’। রায়ে বলা হয়, বিচারক অপসারণের ক্ষমতা যদি সংসদ সদস্যদের হাতে যায়, তবে তার প্রভাব বিচার বিভাগে পড়বে এতে কোন সন্দেহ নেই। এছাড়া দীর্ঘদিন সুপ্রিম জুডিশিয়াল ব্যবস্থা অনুপস্থিত থাকায় প্রধান বিচারপতির প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যদি কোন একজন বিচারকের তার প্রতিষ্ঠান প্রধানের কাছে জবাবদিহিতা না থাকে, তবে ওই বিভাগ ধসে পড়তে বাধ্য’।
১১৬ অনুচ্ছেদ প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি রায়ে বলেছেন, সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ১১৬ অনুচ্ছেদে সংশোধনী আনা হয়, যাতে ‘সুপ্রিম কোর্টে’র স্থলে ‘প্রেসিডেন্ট’ শব্দ প্রতিস্থাপন করা হয়। এর মাধ্যমে জুডিশিয়াল সার্ভিসে কর্মরতদের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতির নিয়ন্ত্রণ প্রেসিডেন্টের কাছে ন্যস্ত করা হয়। এ ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে যদিও সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করার বিধান রাখা হয়েছে (১১৬ ক), তথাপি তা অর্থহীন, যদি নির্বাহী বিভাগ সুপ্রিম কোর্টকে সহযোগিতা না করে। তার ওপর এই অনুচ্ছেদ সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। যেখানে বলা হয়েছে, অধঃস্তন সকল আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হাইকোর্ট বিভাগের হাতে থাকবে’।... কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের স্থানে ‘প্রেসিডেন্ট’ শব্দ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে নিম্ন আদালতের স্বাধীনতা পুরোটাই সংকুচিত করা হয়েছে এবং বাদ দেওয়া হয়েছে।
সংবিধান : ১৯৭৫ সালের চতুর্থ সংশোধনী ছিল সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী। জিয়াউর রহমানের সামরিক ফরমান নয়, বরং চতুর্থ সংশোধনীর দ্বারাই সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে সংসদের ক্ষমতা খর্ব করে বিচারক অপসারণের কর্তৃত্ব রাষ্ট্রপতির কাছে ন্যস্ত করা হয়েছিল (দ্রঃ সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ ১০১ পৃ.)। এই সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে একদলীয় (বাকশাল) শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। ২০১৪ সালে সংসদে গৃহীত ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে পুনরায় সেটাই পুনর্জীবিত করা হয়েছে। অথচ ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যেতে গেলে প্রধান বিচারপতিই রাষ্ট্রপতিকে শপথ পড়াবেন, স্পীকার নন।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অসঙ্গতভাবে সংসদ সদস্যদের অধিকারকে শৃঙ্খলিত করেছে। সংসদের কোন ইস্যুতেই তারা দলীয় অবস্থানের বিরুদ্ধে কোন অবস্থান নিতে পারেন না। সন্দেহ নেই ৭০ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য হ’ল সরকারের স্থিতিশীলতা ও ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। দলের সদস্যদের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখা। কিন্তু সংসদ সদস্যদের যদি সন্দেহের চোখেই দেখা হয়, তাহ’লে তাদের কী করে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের মতো দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত নেয়ার কাজে ন্যস্ত করা যায়?
রাষ্ট্র ও সমাজ : প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এমন একটি পঙ্গু সমাজে আমরা আছি, যেখানে ভালো মানুষ আর ভালো স্বপ্ন দেখে না। কিন্তু খারাপ লোকেরা আরও লুটপাটের জন্য বেপরোয়া’। কোন একজন ব্যক্তি দ্বারা কোন একটি দেশ ও জাতি তৈরী হয়নি। জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা চাইলে আমিত্বের আসক্তি এবং আত্মঘাতী উচ্চাভিলাষ থেকে মুক্ত থাকতে হবে। ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দাম্ভিকতা দেখানোর ক্ষেত্রে বাধা দেওয়ার মতো কোন নযরদারী প্রতিষ্ঠান (ওয়াচডগ) নেই। ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষারও ব্যবস্থা নেই। নির্বাহী দাম্ভিক ও নিয়ন্ত্রণহীন হওয়ায় আমলাতন্ত্র কখনোই দক্ষতা অর্জনে সচেষ্ট হবে না’।
রাজনীতি : ‘রাজনীতি এখন মুক্ত নয়। এটি বাণিজ্যিক বিষয়। আর অর্থ রাজনীতি পরিচালনা করে। আর সেটিই তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে দেয়। এখন মেধা নয়, ক্ষমতাই সব জনপ্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণকারী’।
সামরিক শাসন : সামরিক শাসনামলের সমালোচনা করে রায়ে বলা হয়, ‘ক্ষমতালোভীরা দু’বার আমাদের রাষ্ট্রকে ‘ব্যানানা রিপাবলিকে’ (ব্যক্তিগত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে) পরিণত করেছিল। যেখানে ক্ষমতালোভীরা তাদের অবৈধ ক্ষমতাকে বৈধতা দেওয়ার জন্য জনগণকে পণ্যরূপে দেখেছে, ধোঁকা দিয়েছে। তারা জনগণের ক্ষমতায়ন করেনি, অপব্যবহার করেছে। তারা নানা রকম ধোঁকাবাজির আশ্রয় নিয়েছে। কখনো ভোটের নামে, কখনো জোরপূর্বক নির্বাচনের মাধ্যমে, কখনো নির্বাচন না করে। এর সবটাই করা হয়েছে তাদের ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে। আর এর মধ্য দিয়েই সুস্থ ধারার রাজনীতি পুরোপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। এসব অগণতান্ত্রিক শাসনামলের নোংরা রাজনীতির চর্চা আমাদের সার্বিক জনরাজনীতিকে মারাত্মক ক্ষতি করেছে’।
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও প্রতিরোধের স্পৃহার মাধ্যমে আমরা সামরিক শাসনের থাবা থেকে মুক্ত হয়েছি। কিন্তু পরাজিত হয়েছি স্বাধীন রাষ্ট্রে। এমনকি স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরেও আমরা আমাদের একটি জনপ্রতিষ্ঠানকেও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারিনি। আর এ কারণেই সুবিধাভোগীরা ক্ষমতার অপব্যবহারে উৎসাহিত হন এবং যত্রতত্র ক্ষমতার অপব্যবহারের ধৃষ্টতা দেখান। রাষ্ট্রক্ষমতার যা রাজনৈতিক ক্ষমতার আরেক রূপ, সাম্প্রতিক সময়ে তা গুটিকয়েক মানুষের একচ্ছত্র বিষয়ে পরিণত করেছে। ক্ষমতা কেন্দ্রীভূতকরণের আত্মঘাতী প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। ক্ষমতার লিপ্সা মহামারির মতো, যা একবার ধরলে তা দ্রুত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে চাই, এটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ও উদ্দেশ্য ছিল না। আমাদের পূর্বপুরুষেরা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছিলেন, কোন ক্ষমতাধর দৈত্যের জন্য নয়’।
নির্বাচন কমিশন ও সংসদ : প্রধান বিচারপতি তাঁর বক্তব্যে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সম্পর্কে বলেন, নির্বাচন কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়নি। জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষভাবে এবং কোনরূপ হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বাধীনভাবে না হ’তে পারলে গণতন্ত্র বিকশিত হ’তে পারে না। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া গ্রহণযোগ্য সংসদ প্রতিষ্ঠা হয় না।
তিনি বলেছেন, মানবাধিকার ঝুঁকিতে, দুর্নীতি অনিয়ন্ত্রিত, সংসদ অকার্যকর, কোটি মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা। আর প্রযুক্তির উন্নতির সহায়তা নিয়ে অপরাধের প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ভীষণ রকম ক্ষতিগ্রস্ত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম নয়। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাহী বিভাগ আরও অসহিষ্ণু ও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আর আমলাতন্ত্র দক্ষতা অর্জনে চেষ্টাহীন।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের এই বেঞ্চে ছিলেন ৭জন সদস্য। বেঞ্চের অপর ৬জন সদস্য হ’লেন বিচারপতি মো. আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি ঈমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। প্রধান বিচারপতি ছাড়া অন্য ৬ জনের মধ্যে ৫ জন বিচারপতি প্রধান বিচারপতির লিখিত পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত পোষণ করে নিজেরাও পৃথক পৃথক পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। শুধু বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার রায়ের সঙ্গে সহমত পোষণ করে নিজস্ব কোন পর্যবেক্ষণ দেননি (দৈনিক প্রথম আলো ৩রা আগষ্ট’১৭ পৃ. ১)।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া :
গত ৩১শে জুলাই’১৭ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায় বহাল রেখে ১লা আগষ্ট’১৭ মঙ্গলবার আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। উক্ত রায় প্রকাশের পর দেশের রাজনীতিতে তোলপাড় শুরু হয়। সরকারী দল বিব্রত। বিরোধী দল খুশী। তবে সরকারী দলের প্রবীণ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত (৮৩) তার স্বভাব সুলভ ভাষায় ৪ঠা আগষ্ট সিলেটে বলেন, ‘আদালত যতবার ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করবে, আমরা (সরকার) ততবার সংসদে বিল পাস করব। আমরা অনবরত সেটা করতে থাকব। জুডিশিয়াল কন্ডিশন আনটলারেবল। এদেরকে আমরা চাকরি দেই। তারা সংসদের উপর পোদ্দারী করবে?’ এর উত্তরে রিটকারী আইনজীবীদের অন্যতম এ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেছেন, ‘বয়স বিবেচনায়’ আদালত অবমাননা সূচক বক্তব্যের পরও তাঁর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আনা হবে না। সংবিধান সম্পর্কে ‘ধারণা না থাকায়’ অর্থমন্ত্রী এমন বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেন, সরকার চাইলেও এ বিষয়ে নতুন কোন আইন করতে পারবে না। কারণ যে আইন সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে, সে আইন পুনরায় পাস করার সুযোগ নেই’ (দৈনিক প্রথম আলো ৫ই আগষ্ট’১৭)।
সাবেক আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য আব্দুল মতিন খসরু বলেন, ‘আমরা আহত, ক্ষুব্ধ, ক্ষতিগ্রস্ত। আমাদের যারা বিরোধী দল, তারাও এ রকম নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেনি। তিনি অবশ্য একই সঙ্গে ৩৯ দফাবিশিষ্ট আচরণবিধি প্রণয়ন এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের সম্পদের বিবরণী প্রকাশ করার বিধানের বিষয়ে ইতিবাচক অভিমত দিয়েছেন’ (দৈনিক প্রথম আলো ৪ঠা আগষ্ট’১৭)।
৩১শে জুলাই রায় প্রকাশের পর ঘটনাপঞ্জি :
৭ই আগস্ট : মন্ত্রিসভায় ক্ষোভ। পর্যবেক্ষণের অনেক বিষয় অপ্রাসঙ্গিক ও আপত্তিকর’ (প্রথম আলো ১৩ই আগষ্ট)।
৯ই আগস্ট : আ.লীগের সংবাদ সম্মেলন : এ রায় বিএনপিকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছে’। সাবেক প্রধান বিচারপতি ও বর্তমানে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এ.বি.এম খায়রুল হকের সংবাদ সম্মেলন : আমরা এখন জনগণের নয়, বিচারকদের প্রজাতন্ত্রে বাস করছি। রায় পূর্বধারণাপ্রসূত। সাংসদদের যোগ্যতার প্রসঙ্গ অগ্রহণযোগ্য। সংসদ অকার্যকর- এটা সঠিক নয়। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের স্বচ্ছতা নেই’ (প্রথম আলো ১৩ই আগষ্ট)।
সরকারী মন্তব্য : রায় প্রকাশের ১০ দিনের মাথায় ১০ই আগস্ট সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, রায় নিয়ে দ্বিমত থাকলেও রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা রয়েছে। রায়ের রিভিউ করার বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, আমরা যেহেতু রায়ে সংক্ষুব্ধ, তাই নিশ্চয়ই চিন্তা-ভাবনা করছি যে এই রায়ের রিভিউ করা হবে কি না। তবে এখনো কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হইনি। কারণ, রায়ের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো এখনো নিবিড়ভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে’। উক্ত রায়ের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করে আইনমন্ত্রী বলেন, এই রায় আইনগতভাবেই মোকাবিলা করা হবে। তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতির কিছু পর্যবেক্ষণ আপত্তিকর ও অপ্রাসঙ্গিক। এমনকি অধঃস্তন আদালতের শৃংখলাবিষয়ক ১১৬ অনুচ্ছেদ নিয়ে প্রধান বিচারপতির রায় যুক্তিতাড়িত নয়, বরং আবেগ ও বিদ্বেষতাড়িত (প্রথম আলো ১১ই আগষ্ট শুক্রবার)।
প্রধান বিচারপতির মন্তব্য :
রায় নিয়ে রাজনীতি নয়। গঠনমূলক সমালোচনা করা যাবে। ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে আইন কমিশনের বক্তব্য সম্পর্কে ১০ই আগষ্ট বৃহস্পতিবার কয়েকজন আইনজীবী আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে প্রধান বিচারপতি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, সরকার বা বিরোধী দল কারও ট্র্যাপে (ফাঁদে) পড়ব না, আমরা সচেতন’ (প্রথম আলো ১১ই আগষ্ট’১৭ শুক্রবার)।
প্রতিবাদের পাশাপাশি আলোচনায় আ.লীগ :
উক্ত প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে ১২ই আগষ্ট শনিবার দিবাগত রাত ৮-টায় প্রধান বিচারপতি এস.কে. সিনহার বাসায় যান আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সেখানে তিনি প্রায় দু’ঘণ্টা অবস্থান করেন। অতঃপর তাঁরা দু’জন একসঙ্গে রাতের খাবার খান। দলীয় সূত্র জানায়, আলোচনার মাধ্যমে দু’টি পথের সন্ধান করছে আওয়ামী লীগ। প্রথমতঃ স্বপ্রণোদিত হয়ে পর্যবেক্ষণের কিছু অংশ বাদ দেওয়ার বিষয়ে প্রধান বিচারপতিকে রাযী করানো। নতুবা পুনর্বিবেচনার আবেদন করা হ’লে আওয়ামী লীগের চাওয়া পূরণ হবে- এমন নিশ্চয়তা আদায় করা। এই সমঝোতা প্রচেষ্টার বাইরে আওয়ামী লীগ দলগতভাবে ও সমমনাদের দিয়ে রায়ের সমালোচনা অব্যাহত রাখবে’ (প্রথম আলো ১৪ই আগষ্ট সোমবার ১ম পৃ.)।
অন্যান্যদের মন্তব্য : সরকার পক্ষীয়-
(১) বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ বলেছেন, ১৫ই আগস্ট’৭৫ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর একাধিক বিচারপতি সামরিক শাসকদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। বিএনপি সংসদ নিয়ে যে কথাগুলো বলে, তা আদালতের রায়ের মধ্য দিয়ে উচ্চারিত হয়েছে’ (প্রথম আলো ১০ই আগষ্ট)।
(২) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, সুপ্রিম কোর্টের রায়কে কেন্দ্র করে নতুনভাবে বিএনপি ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে’ (দৈনিক ইনকিলাব ১৩ই আগষ্ট’১৭ রবিবার)।
(৩) স্থানীয় সরকার ও সমবায় মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বঙ্গবন্ধুকে কটাক্ষ করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। গত ১১ই আগষ্ট মাদারীপুরের শিবচরে শেখ হাসিনার নামে সড়ক ও সেতু উদ্বোধন কালে এক সুধী সমাবেশে মন্ত্রী বলেন, বিচার ব্যবস্থায় আস্থার সংকট দেখা দিলে যেকোন দেশে প্রলংকারী ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়। মন্ত্রী শিবচরের বিভিন্ন স্থানে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কাজের উদ্বোধন করেন। তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতি যে রায় দিয়েছেন তা ব্যাপকভাবে অসাংবিধানিক এবং তিনি অনৈতিক কথাবার্তার অবতারণা করেছেন। এমন কি রায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে নিয়েও কটাক্ষ করতে দ্বিধা করেননি। যা এই সভার মাধ্যমে আমরা ধিক্কার জানাই’ (ইনকিলাব ১২ই আগষ্ট শনিবার)।
(৪) খাদ্যমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম ক্ষুব্ধ হয়ে প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ দাবী করেন। তিনি বলেন, নিজ থেকে পদত্যাগ না করলে সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে তার অপসারণে আইনজীবীরা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবে’ (ইনকিলাব ১৩ই আগষ্ট)।
(৫) অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, এই রায়ে বঙ্গবন্ধুকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ অথবা এক্সপানশনের মাধ্যমে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে’ (দৈনিক ইনকিলাব ১৩ই আগষ্ট’১৭ রবিবার)।
(৬) বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ : ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের দেয়া পর্যবেক্ষণ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরা। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সদস্য সচিব ব্যারিষ্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ১২ই আগষ্ট শনিবার ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তিনদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে আগামী ১৩, ১৬ ও ১৭ই অগস্ট দুপুরে সারাদেশে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনের কথা জানানো হয়’ (ইনকিলাব ১৩ই আগষ্ট রবিবার)।
(৭) ১৪ দলীয় জোট : সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের যে রায় দিয়েছেন তা অপ্রাসঙ্গিক, অগ্রহণযোগ্য ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মন্তব্য করে রায়কে আইনগতভাবে ও রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করা হবে বলে জানিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট (ইনকিলাব ১৪ই আগষ্ট সোমবার)।
(৮) ওলামা লীগ : মূর্তি স্থাপনকারী ইতিহাস বিকৃতকারী এস কে সিনহা পদত্যাগ না করলে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হবে :
ওলামা লীগ নেতৃবৃন্দ বলেন, অজ্ঞ, অপরিপক্ক এবং মুসলিম দেশ বাংলাদেশের আদালত প্রাঙ্গণে প্রকাশ্যে মূর্তি স্থাপনকারী প্রধান বিচারপতি এস.কে. সিনহা ইতিহাস বিকৃত করে চরম মিথ্যার বেসাতি নিয়ে জিয়াউর রহমানের সংবিধান বাস্তবায়ন করে জাতির জনক সম্বন্ধে মিথ্যা তোহমত দিয়ে স্বাধীনতা বিরোধীদের খুশী করে সাধু সাজার পাঁয়তারা চালাচ্ছেন। তারা বলেন, স্বঘোষিত রাজাকার এবং দেশদ্রোহী প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ না করলে ওলামা লীগ দেশপ্রেমিক আলেমদের নিয়ে এস.কে. সিনহার বিরুদ্ধে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তুলবে ইনশাআল্লাহ। ওলামা লীগের সভাপতি পীর আখতার হোসেন বুখারী, কার্যকরী সভাপতি হাফেজ মাওঃ আবদুস সাত্তার, সাধারণ সম্পাদক কাজী মাওলানা আবুল হাসান শেখ শরীয়তপুরী ও মাওলানা শোয়েব আহমদ গোপালগঞ্জী এক বিবৃতিতে এ কথা বলেন’ (ইনকিলাব ১২ই আগষ্ট শনিবার ৩য় পৃ.)।
(৯) যুব মহিলা লীগ : আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল বলেছেন, সুরেন্দ্র কুমার সিনহা হিন্দু নন। আমরা জানতে পেরেছি স্বাধীনতার সময় তিনি শান্তি কমিটিতে ছিলেন। এ শান্তি কমিটির প্রধান লক্ষ্য ছিল হিন্দু নিধন। তাই একজন হিন্দু কীভাবে শান্তি কমিটিতে যোগ দেন? তিনি আরও বলেন, প্রধান বিচারপতি ষড়যন্ত্র করছেন। তিনি বিএনপির সুরে কথা বলছেন। আমরা তার অপসারণ চাই’ (ইনকিলাব ১৩ই আগষ্ট রবিবার ১ম পৃ.)।
বিরোধী পক্ষীয় :
(১) বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এই সরকার বিচার বিভাগের প্রতিপক্ষ হিসেবে অবস্থান নিয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা খুব পরিষ্কার করে বলতে চাই, এই রায়ের যে অবজারভেশন, এটা বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের কথা। সুতরাং দেশের ১৬ কোটি মানুষ এই রায়ের অবজারভেশনের সঙ্গে আছে এবং তারা একমত।
তিনি বলেন, এই রায় দেওয়ার পর মন্ত্রীসভায় যে আলোচনা হয়েছে এবং সরকারের কিছু মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের কিছু নেতা যে ভাষায় কথা বলছেন, আমি জানি না আপনারা (আইনজীবীরা) ভালো বলতে পারবেন, তা আদালত অবমাননার দায়ে পড়ে কি না? তিনি অভিযোগ করে বলেন, তারা সুপরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রের যে প্রধান তিনটি স্তম্ভ, সেই স্তম্ভগুলিকে ধ্বংস করে দিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করছে। বিচার বিভাগের সঙ্গে পার্লামেন্টের বিরোধ তারাই তৈরী করে দিয়েছে। মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, এই সরকারের যদি ন্যূনতম গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ থাকত, তাহ’লে তারা পদত্যাগ করত। তাদের আর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকার কোন নৈতিক অধিকার নেই’ (প্রথম আলো ১০ই আগষ্ট’১৭ বৃহস্পতিবার)।
(২) বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি বিপজ্জনক : ৯ই আগষ্ট বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘নাগরিক ঐক্য’ আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা উক্ত মন্তব্য করেন। তারা বলেন, বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির চেষ্টা করা একটি বিপজ্জনক প্রবণতা। এর পরিণতি কী ভয়াবহ হ’তে পারে, তা কল্পনাও করা যায় না। আলোচনা সভায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, স্বাধীনতার ঘোষণা ‘আমি’ দিয়ে শুরু হয়নি। এটা ‘আমাদের’ দেশ। ‘আমি’র দেশ নয়।... শাহদীন মালিক বলেন, যতই দলীয় নিয়োগের কথা বলা হোক না কেন, ওখানের (আদালতের) পরিবেশটাই ন্যায়বিচারের জন্য উদ্বুদ্ধ করে। আপিল বিভাগের সাতজন বিচারপতির সবাই আওয়ামী লীগের আমলে নিয়োগ পাওয়া। এই সাতজনই কিন্তু রায়ে একমত হয়েছেন। বিচার বিভাগের যে এখনো স্বাধীনতা আছে, স্বাধীনভাবে রায় দেওয়ার দৃঢ় মনোভাব আছে, তা উচ্চভাবে প্রমাণিত হ’ল। এ সময় তিনি বলেন, ৭০ অনুচ্ছেদের ভবিষ্যৎ আমার কাছে উজ্জ্বল ঠেকছে না। হাইকোর্ট সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ মানতে বাধ্য’ (প্রথম আলো ১০ই আগষ্ট বৃহস্পতিবার)।
(৩) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল সরকারের উদ্দেশ্যে বলেন, আদালত এর আগে পাঁচটি সংশোধনী বাতিল করেছিলেন। তার মধ্যে তিনটি সংশোধনী আপনারা অত্যন্ত আনন্দ চিত্তে গ্রহণ করেছিলেন। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল হওয়ার পর কত খুশী হয়েছিলেন (যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিধি বাতিল করা হয়)। নিয়ম ভেঙে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হককে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বানিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘ভারতে আটটি সংশোধনী উচ্চ আদালত বাতিল করেছেন। পাকিস্তানে তিনজন প্রধানমন্ত্রীকে উচ্চ আদালত বাতিল করেছেন। উচ্চ আদালতের যে ক্ষমতা, সেটা ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণীত ক্ষমতা’ (প্রথম আলো ১০ই আগষ্ট)।
(৪) বিচারপতি খায়রুল হকের অপসারণ দাবি জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের :
সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির ভবন প্রাঙ্গণে ঘোষিত ১৩, ১৬, ১৭ রবিবার, বুধবার ও বৃহস্পতিবার তিন দিনের কর্মসূচির প্রথম দিনে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ থেকে তারা এই দাবি জানান। সমাবেশে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, রায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিচারপতি খায়রুল হক ডাবল স্ট্যান্ডার্ড গ্রহণ করেছেন। তিনি প্রধান বিচারপতি থাকাকালে একটি রায়ে বলেছিলেন, বিচারপতিদের অবসরের পর চাকরিতে যোগ দেওয়া উচিত নয়। আবার তিনিই এখন সরকারী চাকরি নিয়েছেন। প্রধান বিচারপতি ও ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে আপত্তিকর বক্তব্য দিয়ে চাকরিবিধি লংঘন করেছেন’।
ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে যে রায় দেওয়া হয়েছিল, ১৬ মাস পর পূর্ণাঙ্গ রায়ে তা পাল্টে দিয়েছিলেন বিচারপতি খায়রুল হক। ওই রায় দিয়ে জাতির সঙ্গে প্রতারণা করায় জনতার আদালতে তার একদিন বিচার হবে’ (ইনকিলাব ১২ই আগষ্ট শনিবার)। কারণ সেখানে প্রথমে বলা হয়েছিল যে, আগামী দু’টি টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে।
(৫) বিচারপতি খায়রুল হককে লিগ্যাল নোটিশ।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী রায় নিয়ে অপব্যাখ্যা করার অভিযোগে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের বক্তব্য ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রত্যাহার চেয়ে লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়েছে। গতকাল রোববার সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী বি এম সুলতান মাহমুদ রেজিস্ট্রি ডাকযোগে এ নোটিশ পাঠান। নোটিশে বলা হয়েছে, বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে, প্রধান বিচারপতি ও বিচার বিভাগ নিয়ে আপত্তিকর বক্তব্য দিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে খায়রুল হকের এ বক্তব্য আদালত অবমাননার শামিল। লিগ্যাল নোটিশের মাধ্যমে বিচারপতি খায়রুল হককে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে বলা হয়েছে বলেও জানান ওই আইনজীবী। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এ বি এম খায়রুল হক বক্তব্য প্রত্যাহার না করলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়’ (ইনকিলাব ১৪ই আগষ্ট সোমবার)।
(৬) যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজ ‘৭০ অনুচ্ছেদের অবাক ব্যাখ্যা’ শিরোনামে বলেন, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের প্রধান বিষয় অবশ্যই সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নয়; কিন্তু সংশোধনী বাতিলের রায়ে এই অনুচ্ছেদের ৩২ বার উল্লেখ এবং বাতিলের ভিত্তিভূমি হিসেবে ৭০ অনুচ্ছেদের পুনঃ পুনঃ আলোচনা আমাদের এই অনুচ্ছেদের গুরুত্ব এবং তার দীর্ঘ ছায়া স্মরণ করিয়ে দেয়। রায়ের পরে যে আলোচনা চলছে, তাতে যাঁরা বক্তব্য দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বক্তব্য আমাদের বিশেষ বিবেচনা দাবি করে।... কেননা তাঁরা যা বলেছেন, তা তিন দশক ধরে সংবিধান বিশেষজ্ঞ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা সপ্রমাণ যা হাযির করেছেন, তার বিপরীত। তাঁদের এই বিপরীত অবস্থানের অধিকার অস্বীকার করা আমার লক্ষ্য নয়। শুধু এটা মনে করিয়ে দেওয়া যে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করার পথে এই ধারার বিপদ নিয়ে বিচারপতি হক ২০০৬ সালে তাঁর দেওয়া রায়ে যে অবস্থান নিয়েছিলেন, ২০১৭ সালে আইন কমিশনের প্রধান হিসেবে তিনি সেই অবস্থানে নেই। বিচারপতি হক ২০০৬ সালে এক মামলার রায়ে মন্তব্য করেছিলেন যে, ৭০ অনুচ্ছেদের বিধিনিষেধ একজন এমপিকে দলীয় বন্দীতে পরিণত করেছে। কিন্তু ২০১৭ সালে এসে খায়রুল হক এই ৭০ অনুচ্ছেদের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন। তিনি বুধবার তড়িঘড়ি করে আইন কমিশনের নামে যে সংবাদ সম্মেলন করেন, তাতে উক্ত বিরোধী মত ব্যক্ত করেন... (প্রথম আলো, ১০ই আগস্ট ২০১৭)।
একইভাবে আইনমন্ত্রী বলেছেন, আপিল বিভাগের রায়ে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ প্রসঙ্গে দেওয়া বক্তব্য তথ্যনির্ভর নয়।... গত কয়েক দশকে, বিশেষত ১৯৯১ সালে দেশে সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর দেশে সংসদের কার্যক্রম এবং গণতন্ত্রের গতিধারা নিয়ে যাঁরাই গবেষণা করেছেন, তাঁরাই এই উপসংহারে পৌঁছেছেন যে, ৭০ অনুচ্ছেদ দেশের গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করেছে।... এ বিষয়ে অনেকেই আপত্তি তোলেন এবং এই বিধানের বিষয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় সাংসদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছিলেন, ৭০ অনুচ্ছেদের মধ্যে এমন একটা অগণতান্ত্রিক বিধান রাখা হয়েছে, যা পৃথিবীর আর কোন সংবিধানে নেই।
...যুক্তি দেখানো হচ্ছে যে ৭০ অনুচ্ছেদ সাংসদদের কিছু স্বাধীনতা দেয় এবং বিশেষ করে (২০১১ সালে গৃহীত) পঞ্চদশ সংশোধনীর পরে তা আরও শক্তিশালী হয়েছে। কিন্তু এখানে তিনটি বিষয় আমাদের বিবেচনা করা দরকার। প্রথমতঃ পঞ্চদশ সংশোধনীর পরে সংসদে কি এমন কোন উদাহরণ তৈরী হয়েছে, যেখানে সরকারী দল, এমনকি সরকারী জোটের সাংসদেরা ক্ষমতাসীন দলের উত্থাপিত বিলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ভোট দিয়েছেন?... দ্বিতীয়তঃ যে সংসদের সংসদ নেতা, দলের সংসদীয় দলের প্রধান, দলের নেতা ও প্রধানমন্ত্রী একই ব্যক্তি এবং যাঁর হাতে সাংবিধানিকভাবেই ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ ঘটেছে, তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের সম্ভাবনা কতটুকু? তৃতীয়তঃ যে দেশের প্রধান প্রধান দলের ভিতরে গণতন্ত্রের চর্চা, ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ অনুপস্থিত, সেখানে কেবল একটি সাংবিধানিক অনুচ্ছেদ কোন সংসদ সদস্যকে তাঁর দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার সাহস জোগাবে, এমন মনে করার পিছনে যুক্তি পাওয়া অসম্ভব।
ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে সরকার ও ক্ষমতাসীন দল ক্ষোভ প্রকাশ করতেই পারে। কিন্তু এই রায়ে দেশের রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থার বিষয়ে যেসব পর্যবেক্ষণ আছে, সেগুলোকে প্রত্যাখ্যান করার মধ্যে দেশের এবং সাংবিধানিক রাজনীতির জন্য ইতিবাচক কিছু অর্জনের সম্ভাবনা নেই। আইনমন্ত্রী বলেছেন যে সরকার বিচার বিভাগের সঙ্গে পাওয়ার কনটেস্টে অবতীর্ণ হয় নাই। এই বক্তব্য ইতিবাচক। এখন দেখার বিষয় তাঁর এই বক্তব্য তাঁর দলের ও সরকারের সদস্যদের আচরণে কতটা প্রকাশিত হয় (দৈনিক প্রথম আলো ১৩ই আগষ্ট’১৭ পৃ. ১১ মতামত কলাম)।
(৭) সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পর্যবেক্ষণে উপেক্ষিত’ শিরোনামে বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের মৌলিক কাঠামো।... অথচ রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সামগ্রিক বিষয়টি উঠে না আসাই রায়ের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।...
বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে বিচারকেরা সামগ্রিকভাবে দেখেননি। তাঁরা খন্ডিতভাবে শুধুই ৯৬ অনুচ্ছেদের আওতায় দেখেছেন। আর সে কারণে তাঁরা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকেই মৌলিক কাঠামো হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আবার যে কাউন্সিল প্রধানমন্ত্রীর পূর্বানুমোদন ছাড়া কারও বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্তই শুরু করতে পারবে না, তেমন একটি মারাত্মক দুর্বলতা সম্পর্কেও রায়ে কোন পর্যবেক্ষণ নেই।
এটা ঠিক যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রশ্নে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা তাঁর রায়ে ১১৬ অনুচ্ছেদ সংক্রান্ত (নিম্ন আদালতের শৃঙ্খলা সংক্রান্ত) আপিল বিভাগের পূর্ববর্তী তিনটি রায়ের পর্যবেক্ষণের ধারাবাহিকতায় ১১৬ অনুচ্ছেদকে সংবিধান পরিপন্থী বলেছেন। এর বাইরে আরও একটি রায়ের (দশ বিচারক খ্যাত রায়) কথাও তিনি উল্লেখ করতে পারতেন। কিন্তু বিস্ময়করভাবে অন্য বিচারকেরা তাঁর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ না করলেও সহমত প্রকাশ করেননি। তাঁরা অবশ্য নিশ্চিত করেছেন যে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে তাঁরাও অপরিবর্তনীয় মৌলিক কাঠামো হিসেবে স্বীকার করেন। কিন্তু অধঃস্তন আদালত যদি সরকার নিয়ন্ত্রণ করে, সংবিধানে যদি সে কারণে দ্বৈত শাসন টিকে থাকে, তাহ’লে মৌলিক কাঠামো কী করে মৌলিক কাঠামোর মর্যাদা পেতে পারে? এটা সত্যিই বিস্ময়ের ব্যাপার যে প্রধান বিচারপতির ১১৬ অনুচ্ছেদসংক্রান্ত পর্যবেক্ষণকে চারজন বিচারক প্রাসঙ্গিক নয় বললেন।
অথচ কী আশ্চর্য, তথাকথিত নিম্ন আদালতের বিচারকদের অপসারণ সরকারের হাতেই থাকল। উচ্চ আদালতের বিচারকদের চাইতে তাঁরা সংখ্যায় ১৫ গুণ বেশী, তাঁদের থেকে মামলা নিষ্পত্তি করেন অন্তত সাত গুণ বেশী, আর নিম্ন আদালতই মূল বিচারিক আদালত হিসেবে স্বীকৃত। এ নিয়ে চার বিচারকের কোন পর্যবেক্ষণ না দেওয়া রায়টির একটি বড় দুর্বলতা বলে মনে করি। এমনকি অ্যামিকাস কিউরিরাও এ নিয়ে কিছু বলেননি। আর সম্ভবত এ কারণেই আইনমন্ত্রী মূল রায়কে অগ্রহণযোগ্য বললেও ওই চারজনের ওই বিষয়ের নীরবতাকে দ্বিমত অভিহিত করে তাঁদের তিনি ধন্যবাদ দিয়েছেন। এমনকি বলেছেন, ১১৬ অনুচ্ছেদ সংক্রান্ত প্রধান বিচারপতির রায় যুক্তিতাড়িত নয়, বরং আবেগ ও বিদ্বেষ তাড়িত।
বিচারকেরা যদি অবসরে গিয়ে সরকারের দেওয়া পদ-পদবী গ্রহণে উদগ্রীব থাকেন, বিচারকদের নিয়োগে যদি নির্বাহী বিভাগের প্রাধান্য থাকে, দশ বিচারকের মামলার রায়ে যেভাবে বিচারক বাছাইয়ে আপিল বিভাগ নিজেই রীতিনীতি বেঁধে দিয়েছিলেন, তার বাস্তবায়নে সুপ্রিম কোর্টের যথাভূমিকা পালনে যদি ঘাটতি থাকে, তাহ’লে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জোর থাকে কী করে? সেটা আমরা কীভাবে মৌলিক কাঠামো হিসেবে মানব? এছাড়া বিচারকদের বেতন-ভাতা যে অপ্রতুল, বাজেটে সুপ্রিম কোর্টের জন্য বরাদ্দ যে ভীষণ রকম অকিঞ্চিৎকর এবং এসব ঘটনায় যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নামের মৌলিক কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত বা সর্বদা হুমকির মুখে থাকছে, তারও কোন প্রাসঙ্গিক পর্যবেক্ষণ রায়ে নেই। অথচ ৭০ অনুচ্ছেদের (সংসদ সদস্যদের ফ্লোর ক্রসিং সংক্রান্ত) আলোকে সংসদের গুণমান নিয়ে আলোচনাটা প্রায় সবাই বিস্তারিত করেছেন।...
বাহাত্তর সালের এই বিধানে বলা ছিল, বিচারকেরা অবসরে গিয়ে প্রজাতন্ত্রের কোন পদে যোগ দিতে পারবেন না। অথচ এই অনুচ্ছেদটিকে মৌলিক কাঠামো হিসেবে চিহ্নিত করা হ’ল না। পঞ্চম সংশোধনীর রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক এটিকে পরোক্ষভাবে অবৈধ চিহ্নিত করেন। তাঁর সেই রায় মতে তাঁর বর্তমান (আইন কমিশনের চেয়ারম্যান) পদ বৈধ নয়।...
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখার ধারণায় এটা স্বীকৃত যে, হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের বিচারকের সংখ্যা আইন দ্বারা নির্দিষ্ট থাকতে হবে। অথচ মৌলিক কাঠামো হিসেবে দেখতে গিয়ে বিচারকেরা তাঁদের রায়ে এ বিষয়টি সম্পর্কে কোন প্রাসঙ্গিক পর্যবেক্ষণ দেননি। আপিল বিভাগের বিচারক সংখ্যা গেজেটে নির্দিষ্ট থাকলেও সরকার তা মানে না।...
অতঃপর ‘শুভংকরের ফাঁকি’ শিরোনামে তিনি বলেন, ১৯৭২ সালের সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে লেখা হ’ল, বিচার বিভাগ পৃথক করতে হবে। ১১৬ অনুচ্ছেদে বিচারকদের শৃঙ্খলা সুপ্রিম কোর্টের কাছে ন্যস্ত থাকবে। কিন্তু ক্রান্তিকালীন বিধানাবলীর বৈধতা দান সংক্রান্ত ১৫০ অনুচ্ছেদে একটি শুভংকরের ফাঁক রাখা হয়। এতে বলা হয়েছে, সংবিধানের ১১৪ থেকে ১১৬ ক অনুচ্ছেদের আওতায় যাবতীয় কার্যক্রম (বিচারকদের নিয়োগ, বদলী, পদোন্নতি, শৃঙ্খলা বিধান, তদারকী) যথাশীঘ্র সম্ভব বাস্তবায়িত করা হবে। আর তার আগ পর্যন্ত সংবিধান প্রবর্তনের আগে যেভাবে চলেছে সেভাবে চলবে। আবার এই বিধানকে ৭খ অনুচ্ছেদের আওতায় অপরিবর্তনীয় মৌলিক কাঠামোও বলা হয়েছে। পরিহাস হ’ল, ২০১১ সালে এই ১৫০ অনুচ্ছেদের তফসিলে সংশোধনী আনা হ’লেও বাহাত্তরে যুক্ত করা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিনাশী ওই কালাকানুন (১৫০ (৬) বহাল রাখা হয়েছে। এর লক্ষ্য বিচার বিভাগকে কবজায় রাখা। এ ব্যাপারে সব সরকারের ঐক্যমত এবং এটা যে মৌলিক কাঠামোকে আঘাত করে, সে বিষয়ে আলোচনা প্রাসঙ্গিক ছিল।
শুধু বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন মাত্র একটি বাক্যে ১৫০ অনুচ্ছেদের চতুর্থ তফসিলের ৬ (৬) নম্বর প্যারাগ্রাফের উল্লেখ করেছেন। শুধু বলেছেন, বিচার বিভাগ পৃথকীকরণে আইনসভা ও সরকার কোন পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণে আপিল বিভাগ বিধি তৈরীতে সংসদকে নির্দেশনা দিয়েছিল। কিন্তু বলেননি যে, পঞ্চদশ সংশোধনীতেও এটি টিকিয়ে রাখার সাংবিধানিক তাৎপর্য কী ভয়ংকর।
সংবিধানের কোন একটি অনুচ্ছেদকে খন্ডিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয় না। ১১৬ অনুচ্ছেদকে সংবিধানের পরিপন্থী অভিহিত করে প্রধান বিচারপতি তাকে আইনগত কর্তৃত্বহীন হিসেবেও চিহ্নিত করলেন। কিন্তু তাকে তিনি ১৫০ অনুচ্ছেদের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে আরও ভালো হতো। ১১৬ অনুচ্ছেদ যদি মৌলিক কাঠামোকে আঘাত দেয়, তাহ’লে ১৫০ অনুচ্ছেদের ওই বিধান বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য আরও ক্ষতিকর।
বাক স্বাধীনতা ছাড়া বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অর্থহীন। রায়ে ২০১৩ সালের আদালত অবমাননা আইনটি বাতিল করার ফলে সংসদে প্রশ্ন উঠেছে এবং সদস্যরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন, এ কথা রায়ে আছে। কিন্তু রায়ে এ নিয়ে কোন অনুশোচনা নেই যে, স্বাধীন বাংলাদেশে করা আদালত অবমাননা সংক্রান্ত প্রথম আইনটি বাতিলে গণমাধ্যম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।... ওই আইনের একটি-দু’টি বিধান বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতি হুমকি ছিল। কিন্তু আদালত গোটা আইনটিকেই বাতিল করেছেন।... আদালত অবমাননার আইন না থাকায় মনে হচ্ছে যাঁরা দুর্দমনীয় ও ক্ষমতাবান, তাঁরা অনবরত তা করে যেতে পারেন এবং আদালত সে ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিতে কুণ্ঠাবোধ করছেন। অন্যদিকে, গণমাধ্যম অতি সতর্কতার কারণে গঠনমূলক সমালোচনা থেকেও বিরত থাকছে। অথচ এ বিষয়ে কোন প্রাসঙ্গিক পর্যবেক্ষণ নেই। সংসদে রায় এবং বিচারকদের নিয়ে কবে কী অযথাযথ আলোচনা হয়েছে, তা বিস্তারিত এসেছে। প্রধান বিচারপতি এসব প্রসঙ্গ তুলেই চলমান সংসদীয় গণতন্ত্রকে অপরিপক্ক বলেছেন। কিন্তু এই অপরিপক্কতা শুধু রাষ্ট্রের দু’টি স্তম্ভই দেখায়, তা সত্য নয়। কোন সংসদীয় গণতন্ত্র বিচার বিভাগকে বাদ দিয়ে কল্পনা করা যায় না।
বিচারক নিয়োগে প্রলয় ঘটেছিল, কিন্তু তা কী ছাপ রাখছে, তারও প্রাসঙ্গিক আলোচনা প্রত্যাশিত ছিল। বিচারকদের তরফে আচরণবিধি লঙ্ঘনের আলোচিত ঘটনাগুলোর উল্লেখ বা তার কোন পর্যালোচনা রায়ে একদম অনুপস্থিত। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কী কারণে এতকাল ঘুমন্ত ছিল, তা এখন কেন সক্রিয় হবে বলে জনগণ মনে করবে, তার কোন ব্যাখ্যা রায়ে নেই। পর্যবেক্ষণে বিচার বিভাগীয় ত্রুটিবিচ্যুতিকেই শুধু অন্য দু’টি স্তম্ভের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ভালো থাকার কথা বলা হয়েছে। পানিতে নাক উঁচু করে রাখা বা ডুবুডুবু অবস্থা কেন ও কীভাবে এটা হ’ল? এ জন্য তো শুধু সরকার ও সংসদকেই দায়ী করা অন্যায্য হবে। দু’টি স্তম্ভ সাবজেকটিভ, অর্থাৎ চোখে আঙুল দিয়ে, আর একটি স্তম্ভ অর্থাৎ বিচার বিভাগ নিরেট অবজেকটিভ বা সমালোচনার একদম বাইরে থেকেছে। আমাদের বড় আক্ষেপ, এই রায়ে বিচারকেরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার স্বরূপ উদঘাটনে খন্ডিত ধারণার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন’ (প্রথম আলো ১৩ই আগষ্ট’১৭ পৃ. ১০ মতামত কলাম)।
(৮) সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, কোন সরকারের সময়ে এমনকি বর্তমান সরকারের সময়েও নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারেনি। এর ফলে ইসির টেকসই প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন হয়নি। তাঁর মতে, ইসিকে সহায়তার পরিবর্তে এর ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করা হয়। এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারীর নির্বাচন। যেখানে বড় রাজনৈতিক দল অংশ নেয়নি, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩ জন নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী হ’লে এটা হ’তে পারত না’ (দৈনিক প্রথম আলো ৩রা আগষ্ট’১৭ বৃহস্পতিবার)।
(৯) এ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ : ‘নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভার ওপর বিচার বিভাগ নযরদারি করছে। কিন্তু বিচার বিভাগের ওপর কি নযরদারির প্রয়োজন নেই?’ এমন এক প্রশ্নের উত্তরে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল চেয়ে রিট আবেদনকারী ৯ জন আইনজীবীর অন্যতম এ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, অবশ্যই আছে। কেউ জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নন। মাননীয় আদালত রায়ে যে ৩৯ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন, তাতে বিচার বিভাগের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। বিচারকেরা কী করতে পারবেন, কী পারবেন না, তারও স্পষ্ট নির্দেশনা আছে। তবে আমি মনে করি, এটিও পরিপূর্ণ নয়’।
[মন্তব্য : যত দফাই প্রণয়ন করা হৌক না কেন, আল্লাহর নিকট জবাবদিহিতার ভয় না থাকলে কখনোই ন্যায় বিচার কায়েম হবে না। অতএব আল্লাহকে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক ঘোষণা করে সর্বক্ষেত্রে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার নিশ্চিত করার মধ্যেই জনগণের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত হ’তে পারে। সংবিধানের পাতায় নয়, বরং নাগরিকদের বাস্তব জীবনে ও তাদের হৃদয়পটে স্থান পেলেই কেবল সেটি গ্রহণযোগ্য ও টেকসই হবে। মনে রাখা আবশ্যক যে, ইংল্যান্ডে কোন লিখিত সংবিধান নেই। চলছে কেবল দেশীয় প্রথার উপরে ভিত্তি করে। আমরা কি পারি না কুরআন ও সুন্নাহর উপরে ভিত্তি করে দেশ পরিচালনা করতে? যা আমরা দিন-রাত পালন করি এবং যা সূর্য ও চন্দ্রের ন্যায় সকল মানুষের জন্য সর্বযুগে সমানভাবে কল্যাণকর (স.স.)।]