গত মাস থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বয়ে যাচ্ছে তাপপ্রবাহ। এই তীব্র গরমে অস্বস্তি সহ স্বাস্থ্যের ওপরে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। মাথাব্যথা, দুর্বলতা, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া, এমনকি দীর্ঘমেয়াদী পানিশূন্যতায় কিডনিরও ক্ষতি হ’তে পারে। দেখা দিতে পারে গরম সংক্রান্ত বিভিন্ন অসুস্থতা। অসচেতনতায় সবচেয়ে মারাত্মক সমস্যা হিটস্ট্রোকও হয়ে যেতে পারে। অতএব তাপপ্রবাহের সময়ে আমাদেরকে নিম্নোক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
অধিক গরম লাগা রোধে করণীয় :
(ক) সরাসরি রোদে যাওয়া থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকা। বিশেষত সকাল ১০/১১-টা থেকে বিকেল ৪-টা পর্যন্ত। (খ) বদ্ধ ও জনাকীর্ণ পরিবেশ থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকা। (গ) গরম খাবার, ভাজাপোড়া, চা, কফি, বর্জন করা এবং খাবার পরিমিত খাওয়া। এতে শরীরের তাপমাত্রা কম থাকতে সহায়ক হবে। (ঘ) খাদ্যগ্রহণের পর অন্তত ৩০ মিনিট ফ্যানের নীচে থেকে তারপর বাইরে যাওয়া। (ঙ) ঢিলেঢালা, সাদা হালকা রঙের সুতি পোষাক পরিধান করা। (চ) মানসিক অবসাদ, টেনশন পরিহার করা। যেকোন কাজে তাড়াহুড়া বর্জন করা। (ছ) সুযোগ থাকলে একাধিকবার ঠান্ডা পানিতে গোসল করা।
বাইরে গেলে করণীয় :
(ক) অবশ্যই ছাতা ব্যবহার করতে হবে। (খ) মাথায় টুপি/ক্যাপ, সানগ্লাস/রোদচশমা ব্যবহার করা যেতে পারে। (গ) তৃষ্ণা না পেলেও পর্যায়ক্রমে পানি পান করতে থাকতে হবে।
বাইরে থেকে বাসায় ফিরে করণীয় :
(ক) সাথে সাথে অতিরিক্ত পোষাক পরিবর্তন করতে হবে। (খ) পানি পান করতে হবে। (গ) সরাসরি এসির বাতাসে যাওয়া যাবে না। যাতে আবার ঠান্ডা লেগে সর্দি-কাশি না হয়। (ঘ) যাদের ত্বক তৈলাক্ত বিশেষত ব্রনের সমস্যায় ভুগে থাকেন- তাদের মুখ ফেসওয়াশ ব্যবহার করে ধুয়ে ফেলা উচিত। অন্য সবারও মুখে শীতল পানির ঝাপটা নেওয়া উচিত।
ঘরে গরম কমাতে করণীয় :
(ক) বাইরে বাতাস গরম হয়ে গেলেই রুমের জানালা দরজা পর্দা দিয়ে ঢেকে রাখা উচিত, থাই গ্লাস গরম হয়ে গেলে ভেজা তোয়ালে/কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা যেতে পারে। তবে বাতাস স্বাভাবিক থাকলে বিশেষত সকালে, সন্ধ্যার পর থেকে জানালা খোলা রেখে ঘরে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে। (খ) ছাদের নীচে কাপড় টাঙানো যেতে পারে। ছাদে পানি ঢেলে ঠান্ডা করার চেষ্টা করা যেতে পারে। (গ) এসি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এসি ব্যবহার করলে তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রিতে রাখা উচিত। সরাসরি এসির ঠান্ডা বাতাস শরীরে লাগানো যাবে না।
পানিশূন্যতা রোধে করণীয় :
(ক) পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে- ওযন ৬০ কেজির কম হ’লে ৯-১০ গ্লাস, ৬০ কেজির বেশী হ’লে ১০-১২ গ্লাস। (খ) এছাড়া স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে তরমুজ, ডাবের পানি, লেবু পানি/তরল খাবার খাওয়া যেতে পারে। (গ) তেল-চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করতে হবে।
পানি পানে বিশেষ সতর্কতা : বাইরে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে বেশী পানি পান করা যাবে না। একসঙ্গে সর্বোচ্চ ২ গ্লাসের বেশী পানি পান করা উচিত নয়। অতিরিক্ত ঠান্ডা/ফ্রিজের পানি সরাসরি পান না করে স্বাভাবিক পানির সাথে মিশিয়ে হালকা শীতল পানি পান করা যেতে পারে।
কিডনি রোগ/হার্ট ফেইলিউর/শরীরে পানি জমে থাকা রোগীদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পানি পান করতে হবে।
খাবার বিষয়ে পরামর্শ ও সতর্কতা :
(ক) গরমে প্রচুর সবজি খাওয়া উচিত। শসা, টমেটো, ক্যাপসিকাম, লাউ, শাক-পাতা খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে। এতে কোষ্টকাঠিন্য হওয়ার সম্ভাবনা কমবে। (খ) ফ্রিজের বাইরে রাখা খাবারের স্বাদ/গন্ধ পরিবর্তন হয়ে গেলে তা খাওয়া যাবে না। (গ) নরমাল ফ্রিজে রাখলেও ২-৩ দিনের বেশী রেখে খাওয়া যাবে না। (ঘ) ডায়রিয়া বা অন্য কারণে খাওয়ার জন্য ওরস্যালাইন প্রস্ত্তত করা হ’লে ৪ ঘন্টার বেশী সময় পরে তা খাওয়া উচিত না। (ঙ) উচ্চ প্রোটিন বা তেলচর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করা। (চ) বাইরের বিশেষত রাস্তার পাশের খোলা খাবার/শরবত বর্জন করা উচিত।
ঘামাচি রোধে করণীয় : শীতল পানিতে গোসল করে শরীরের গরম কমানো। অধিক গরম লাগার কাজ যথাসম্ভব পরিহার করা। গামছা/রুমাল ভিজিয়ে শরীর মুছা যেতে পারে। ট্যালকম পাউডার ব্যবহার করা যেতে পারে।
গরম সংক্রান্ত অসুস্থতা ও প্রাথমিক করণীয় :
(ক) গরমে মাংশপেশীর ব্যথা ও সংকোচন : পায়ের মাংশপেশীতে সাধারণত ব্যথা হ’তে পারে। এসময় ওরস্যালাইন ও প্যারাসিটামল খেতে হবে। ম্যাসাজ করতে হবে। কয়েক ঘন্টার মধ্যে পরিশ্রমের কাজ করা যাবে না। প্রয়োজনে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হ’তে হবে।
(খ) অজ্ঞান হয়ে যাওয়া : অবস্থা বেশী খারাপ না হ’লে শীঘ্রই জ্ঞান ফিরে আসে। এমতাবস্থায় প্রেসার মেপে দেখতে হবে। ফ্যানের নীচে নিতে হবে। শরীরের তাপমাত্রা কমানোর চেষ্টা করতে হবে। স্যালাইন খাওয়াতে হবে। তাতেও অবস্থার উন্নতি না হ’লে চিকিৎসক এর শরণাপন্ন হ’তে হবে।
(গ) হিট স্ট্রোক : প্রচন্ড দাবদাহে হঠাৎ করে কোন ব্যক্তি অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন এবং এক্ষেত্রে জ্ঞান স্বাভাবিক হবে না, একে বলা হয় ‘হিটস্ট্রোক’।
লক্ষণ : শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে ১০৪ ডিগ্রি বা তার অধিক হওয়া, প্রচন্ড ক্লান্তি ভাব, ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, মাংসপেশীতে অস্বস্তি/কাঁপুনি, চরম দুর্বলতা, অস্থিরতা/আগ্রাসী হওয়া। তারপর রোগী অচেতন হয়ে পড়তে পারে।
হিটস্ট্রোকে প্রাথমিক করণীয় :
(১) প্রথমেই অসুস্থ ব্যক্তিকে ছায়ায় বা অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা জায়গায় নিয়ে চিৎ করে রাখতে হবে। জ্ঞান একদম না থাকলে কাত করে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যবস্থা থাকলে ব্লাড সুগার মেপে দেখা উচিত। ব্লাড সুগার কমে যেতে পারে। (২) অতিরিক্ত জামা কাপড় খুলে বা ঢিলে করে দিতে হবে। (৩) ফ্যানের নীচে নিয়ে ফুল স্পিডে ফ্যান চালাতে হবে। (৪) ঠান্ডা পানিতে ভেজা তোয়ালে দিয়ে শরীর মুছে দেওয়া। (৫) সম্ভব হ’লে অবশ্যই কাপড়ে বরফ পেচিয়ে বগলে/দুইপাশের কুচকিতে দিতে হবে। (৬) তৎক্ষণাৎ এ্যাম্বুলেন্সে করে (সম্ভব হ’লে অক্সিজেন দিয়ে) হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
ডা. মেহেদী হাসান মনিম
আহলেহাদীছ পেশাজীবী ফোরাম হেলথ কেয়ার।