গীবত দুরারোগ্য ব্যাধির ন্যায়। গীবতের রোগ মরণ ব্যাধি ক্যান্সার অপেক্ষাও ভয়াবহ। ক্যান্সার মানুষের শরীর নিঃশে^ষ করে দেয়, আর গীবত কর্মফল ধ্বংস করে দেয়। দুনিয়াতে তাকে অপদস্থ করে এবং পরকালে সর্বস্বান্ত করে ছাড়ে। অথচ আমরা নিত্যদিন গীবত করার মাধ্যমে আমাদের অতি আদরের দেহটাকে আগুনের খোরাক বানাচ্ছি। সুতরাং জীবদ্দশাতেই গীবত ও পরনিন্দা থেকে বাঁচার পথ খুঁজে নিতে হবে। এ নিবন্ধে আমরা গীবত থেকে পরিত্রাণ লাভের কতিপয় উপায় সম্পর্কে আলোকপাত করব ইনশাআল্লাহ।
১. গীবতের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবগত হওয়া :
গীবত থেকে বাঁচার জন্য সর্বপ্রথম এর ভয়াহতা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা যরূরী। কারণ কোন কিছুর ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারণা না থাকলে সেই ক্ষতিকারক বিষয় থেকে সতর্ক থাকা যায় না। সুতরাং গীবত যে ভয়াবহ পাপ সেটা যদি কেউ না জানে এবং গীবতের স্বরূপ তার কাছে অস্পষ্ট থাকে, তবে তার মাধ্যমে গীবতের পাপ হওয়াই স্বাভাবিক।
কিন্তু সে যদি জানে গীবত সাধারণ কোন কাবীরা গুনাহ নয়, এটা যেনা-ব্যভিচার, সূদ-ঘুষ, চুরি-ডাকাতির চেয়েও মারাত্মক। এই পরনিন্দা ঋণের মতো, যা অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। যার দোষ-চর্চা করা হয়, ক্বিয়ামতের দিন তাকে নিজের কষ্টার্জিত আমলের নেকী ও ছওয়াব বাধ্য হয়ে দিতে হবে। আর যদি নিজের নেকী না থাকে, তবে সেই ব্যক্তির পাপের বোঝা গীবতকারীর উপরে চাঁপিয়ে দেওয়া হবে এবং তাকে উল্টোমুখী করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এসব বিষয় কেউ অবহিত হ’লে তার জন্য গীবত পরিহার করা অনেকটা সহজ হবে।
ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেন,عَلَيْكُمْ بِذِكْرِ اللهِ فَإِنَّهُ شِفَاءٌ، وَإِيَّاكُمْ وَذِكْرَ النَّاسِ فَإِنَّهُ دَاءٌ، ‘তোমরা আল্লাহর যিক্রে নিমগ্ন থাক, কেননা এটা (অন্তরের) প্রতিষেধক। আর অবশ্যই মানুষের দোষ চর্চা করা থেকে সাবধান থাকবে, কেননা এটা একটা রোগ’।[1] গীবত থেকে সবাইকে বাঁচতে হবে। কেননা তা কর্মফল নষ্টকারী। যেমন আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (রহঃ) বলেছেন, فر من المغتاب فرارك من الأسد، ‘তুমি বাঘ থেকে যেভাবে পলায়ণ কর, গীবতকারী থেকে সেভাবে পালিয়ে যাও’।[2]
২. জিহবার হেফাযত করা :
জিহবা ঘটিত পাপগুলো খুব সহজে করা হয়, ফলে এর ভয়াবহতাও বেশী। গীবত মূলত জিহবার মাধ্যমেই করা হয়ে থাকে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ الرَّجُلَ لَيَتَكَلَّمُ بِالكَلِمَةِ لَا يَرَى بِهَا بَأْسًا يَهْوِي بِهَا سَبْعِينَ خَرِيفًا فِي النَّارِ، ‘মানুষ কখনো এমন কথাও বলে, যে কথার ব্যাপারে সে অসুবিধার কিছু মনে করে না, অথচ এই কথার কারণে তাকে সত্তর বছর জাহান্নামে অবস্থান করতে হবে’।[3] তাই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিভিন্ন হাদীছে জিহবা সংযত করার ব্যাপারে জোরালো নির্দেশ দিয়েছেন। উক্ববাহ ইবনে আমের (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! নাজাতের উপায় কি? তিনি বললেন,يَا عُقْبَةُ، أَمْسِكْ عَلَيْكَ لِسَانَكَ، وَلْيَسَعْكَ بَيْتُكَ، وَابْكِ عَلَى خَطِيئَتِكَ، ‘হে উক্ববাহ! তুমি নিজ জিহবাকে নিয়ন্ত্রণে রাখ। তোমার ঘর প্রশস্ত রাখ (অর্থাৎ অবসরে নিজ গৃহে অবস্থান কর)। আর নিজের পাপের জন্য ক্রন্দন কর’।[4] একবার তিনি মু‘আয ইবনে জাবাল (রাঃ)-কে উপদেশ দিতে গিয়ে নিজ জিভটিকে টেনে ধরে বলেন, كُفَّ عَلَيْكَ هَذَا ‘তোমার এটিকে সংযত রাখ’। মু‘আয বললেন, يَا نَبِيَّ اللهِ، وَإِنَّا لَمُؤَاخَذُونَ بِمَا نَتَكَلَّمُ بِهِ؟ ‘হে আল্লাহর নবী! আমরা যে কথা বলি তার জন্যও কি আমাদের পাকড়াও করা হবে? তিনি বললেন, ثَكِلَتْكَ أُمُّكَ يَا مُعَاذُ! وَهَلْ يَكُبُّ النَّاسَ فِي النَّارِ عَلَى وُجُوهِهِمْ أَوْ عَلَى مَنَاخِرِهِمْ إِلَّا حَصَائِدُ أَلْسِنَتِهِمْ، ‘তোমার মা তোমাকে হারিয়ে ফেলুক হে মু‘আয! মানুষের জিহবা ঘটিত পাপগুলোই তাদেরকে মুখ বা নাকের উপর উল্টোমুখী করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে’।[5]
সুতরাং কথা বলার আগে ভাবতে হবে, যে কথাটি বলা হবে তা আদৌ উচিত হবে কি-না। আগে চিন্তা করতে হবে উচ্চারিত কথাগুলো গীবত হচ্ছে কি-না। কেননা অন্তরের ভাবনাগুলোই মুখ দিয়ে বের হয়ে আসে। ইয়াহইয়া ইবনে মু‘আয (রহঃ) বলেন, القلوب كالقدور في الصدور تغلي بما فيها، ومغارفها ألسنتها، فانتظر الرجل حتى يتكلم فإن لسانه يغترف لك ما في قلبه من بين حلو وحامض، وعذب وأجاج، يخبرك عن طعم قلبه اغتراف لسانه، ‘অন্তরের উপমা হ’ল বক্ষস্থিত বড় পাতিলের মত, তাতে যা থাকে তা সিদ্ধ হয়। আর জিহবা হ’ল সেই পাতিলেন চামচ। সুতরাং ব্যক্তির আলাপচারিতা তুমি একটু খেয়াল করে দেখ। কেননা তার হৃদয়ে টক-মিষ্টি, মিঠা-লোনা যাই থাক না কেন, জিহবার চামচ দিয়ে তোমাকে তাই সে পরিবেশন করবে এবং তার কথার মাধ্যমে তোমাকে তার হৃদয়ের স্বাদ সম্পর্কেও অবহিত করবে’।[6] সুতরাং অন্তরকে পরিচ্ছন্ন করতে পারলে, জিহবা সংযত করার রাস্তাটাও সহজ হয়ে যাবে।
৩. কল্যাণকর কথা বলা নতুবা চুপ থাকা :
অধিকাংশ গীবত কথা-বার্তার মাধ্যমে হয়ে থাকে। সেজন্য প্রয়োজনীয় কথা বলা ছাড়া মুখটাকে বন্ধ রাখতে পারলে নানা পাপ থেকে রেহাই পাওয়া যায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ، ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাত দিবসের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন ভাল কথা বলে অথবা চুপ থাকে’।[7] অর্থাৎ ক্ষেত্র বিশেষে চুপ থাকাও ইবাদতে পরিণতি হ’তে পারে। এক ব্যক্তি সালমান ফারেসী (রাঃ)-কে বললেন, ‘আমাকে নছীহত করুন। তিনি বললেন, ‘কোন কথা বলবে না’। লোকটি বলল, সমাজে বসবাস করে কেউ কি কথা না বলে থাকতে পারে? উত্তরে তিনি বললেন,فَإِنْ تَكَلَّمْتَ، فَتَكَلَّمْ بِحَقٍّ أَوِ اسْكُتْ، ‘যদি কথা বলতেই হয়, তবে সঠিক কথা বল অথবা চুপ থাক’।[8]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّكَ لَنْ تَزَالَ سَالِمًا مَا سَكَتَّ، فَإِذَا تَكَلَّمْتَ كُتِبَ لَكَ أَوْ عَلَيْكَ، ‘তুমি যতক্ষণ চুপ থাকবে, ততক্ষণ নিরাপদ থাকবে। আর যখন কথা বলবে, তখন তোমার পক্ষে অথবা বিপক্ষে (হিসাব) লেখা শুরু হবে’।[9] আল্লাহ বলেন, مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ ‘সে যে কথাই উচ্চারণ করে, তা গ্রহণ করার জন্য তার কাছে সদা প্রস্ত্তত প্রহরী রয়েছে’ (ক্বা-ফ ৫০/১৮)। অর্থাৎ আমাদের মুখ দিয়ে উচ্চারিত প্রত্যেক শব্দ, বর্ণ ও বাক্য পুঙ্খানুপুঙ্খ লিখে রাখা হয়। সেজন্য প্রতিদিন সকালে আদম সন্তানের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার জিহবাকে সর্তক করে বলে,اتَّقِ اللهَ فِينَا فَإِنَّمَا نَحْنُ بِكَ، فَإِنْ اسْتَقَمْتَ اسْتَقَمْنَا وَإِنْ اعْوَجَجْتَ اعْوَجَجْنَا، ‘আমাদের ব্যাপারে আল্লাহ্কে ভয় কর। আমরা তোমারই অনুগত। তুমি ঠিক থাকলে আমরাও ঠিক থাকবো। আর তুমি বক্র পথে চলে গেলে আমরাও পথচ্যুত হয়ে যাব’।[10] হাসান বাছরী (রহঃ) বলেন,اللِّسَانُ أَمِيرُ الْبَدَنِ، فَإِذَا جَنَى عَلَى الْأَعْضَاءِ بِشَيْءٍ جَنَتْ، وَإِنْ عَفَّ عَفَّتْ، ‘জিহবা হ’ল দেহের আমীর। যখন জিহবা কোন অপরাধ করে, তখন অন্যান্য অঙ্গও অপরাধ করে। আর জিহবা যখন নিষ্কলুষ থাকে, তখন অন্যান্য অঙ্গও পরিচ্ছন্ন থাকে’।[11]
আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন,وَاللهِ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ، مَا عَلَى الْأَرْضِ أَحَقُّ بِطُولِ سِجْنٍ مِنَ اللِّسَانِ، ‘আল্লাহর কসম! যিনি ছাড়া সত্য কোন ইলাহ নেই। যমীনের বুকে দীর্ঘ সময় কারাগারে রাখার মতো জিহবার চেয়ে উপযুক্ত কোন বস্ত্ত নেই’।[12] ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘জিহবা বান্দার যাবতীয় গুনাহের অন্যতম প্রবেশদ্বার। কথার গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার উপায় হ’ল- চুপ থাকা বা মুখ দিয়ে অনর্থক কোন কথা উচ্চারণ না করা। কেউ যদি জিহবার পাপ থেকে নিরাপদ থাকতে চায়, তবে সে যেন কথা বলার আগে একটু চিন্তা-ভাবনা করে নেয় যে, এই কথায় আমার কোন ফায়দা আছে কি-না? যদি কথাটি অনর্থক হয়ে থাকে, তবে তা বলা থেকে বিরত থাকবে, আর যদি অনর্থক না হয়, তবুও ভেবে দেখবে, আমার এই কথার করণে এর চেয়ে উত্তম কিছু আমার হাতছাড়া হচ্ছে কি-না? যদি মুখের এই কথার কারণে উত্তম কোন কিছু হাতছাড়া হয়ে যায়, তবে এই কথা বলা থেকেও চুপ হয়ে যাবে’।[13] ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িমের উক্ত নীতির অনুসরণ করতে পারলে, গীবতের পাপ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হবে।
৪.আল্লাহর যিকরে জিহবাকে সিক্ত রাখা :
যিকর বান্দাকে গীবতের পাপ থেকে পরিচ্ছন্ন রাখে। আল্লাহর স্মরণে সিক্ত জিহবা সর্বদা কল্যাণকর কাজেই ব্যস্ত থাকে। ফলে নানাবিধ পাপের পঙ্কিলতা থেকে ব্যক্তি সুরক্ষিত থাকে। ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘আল্লাহর যিকরের মাধ্যমে গীবত, চোগলখুরী, মিথ্যা ও অশ্লীলতার মতো গর্হিত কথাবার্তা থেকে জিহবাকে মুক্ত রাখা যায়। মানুষের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য হ’ল সে চুপ থাকতে পারে না। কোন না কোন কথা তাকে বলতেই হয়। সেজন্য আল্লাহর যিকরে রসনাকে ব্যস্ত রাখা না হ’লে এবং শরী‘আতের বিধি-বিধানের ব্যাপারে আলোচনা করা না হ’লে জিহবা হারাম ও রবের অসন্তুষ্টিমূলক কথাবার্তায় লিপ্ত হবেই। আল্লাহর যিকর ছাড়া এত্থেকে উত্তরণের বিকল্প কোন পথ নেই। বাস্তব অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এ কথা দিবালোকের ন্যায় প্রমাণিত যে, কেউ যদি স্বীয় রসনাকে আল্লাহর যিকরে ব্যস্ত রাখতে পারে, তবে সে অন্যায় কথাবার্তা থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখতে পারবে। আর তার জিহবা যিকর থেকে নীরস-শুষ্ক থাকলে তার জিহবা বাতিল, অনর্থক ও অশ্লীল কথা দ্বারা সিক্ত হবে’।[14] সুতরাং পরনিন্দা থেকে পরিত্রাণ লাভে করণীয় হ’ল স্বীয় রসনাকে যিকরে ব্যস্ত রাখা। ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ (রহঃ) বলেছেন,الْمَحْبُوسُ مَنْ حُبِسَ قَلْبُهُ عَنْ رَبِّهِ تعالى، وَالْمَأْسُورُ مَنْ أَسَرَهُ هَوَاهُ، ‘প্রকৃত কয়েদী তো সেই ব্যক্তি, যার অন্তর মহান রবের স্মরণ থেকে বন্দী হয়ে গেছে। প্রকৃত বন্দী তো সেই ব্যক্তি, যাকে তার প্রবৃত্তি বন্দী করে ফেলেছে’।[15]
৫. গীবত করার সময় নেকী বিনষ্ট হওয়ার কথা মনে করা :
কারো দোষ বর্ণনা করার আগে মানুষ যদি একটু চিন্তা করে দেখে যে, আমি যে লোকের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করছি, তার কাছে আমি চিরদিনের জন্য ঋণী হয়ে যাচ্ছি। এই ঋণ নিজের কষ্টার্জিত ছওয়াব প্রদান অথবা তার পাপগুলো নিজের কাঁধে চাপিয়ে নিয়ে পরিশোধ করতে হবে। ক্বিয়ামতের দিন প্রত্যেক মানুষ যখন পাগলপরা হয়ে একটা নেকীর জন্য ছোটাছুটি করবে, সেই কঠিন মুহূর্তে নেকী দিয়ে গীবতের ঋণ পরিশোধ করতে হবে। সেই কঠিন মুহূর্তে নিজের ছওয়াবের ঝুলি থেকে একটা নেকী অপরকে দিয়ে দেওয়া আদৌ সহজ ব্যাপার নয়। ভয়বাহ সেই দৃশ্যপট হৃদয়ের আয়নায় মেলে ধরতে পারলে, গীবত করার আগে মানুষ বারবার ভাবতে বাধ্য হবে।
এজন্য আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (রহ.) বলেন,لو كنتُ مُغتاباً أحداً لاغتبتُ والديَ لأنهما أحقُّ بحسناتي، ‘আমি যদি কারো গীবত করতাম, তাহ’লে আমার পিতামাতার গীবত করতাম। কারণ তারাই আমার নেকী লাভ করার অধিক হকদার’।[16] হাসান বছরী (রহঃ)-কে বলা হ’ল অমুক ব্যক্তি আপনার গীবত করেছে। তখন তিনি গীবতকারীর উদ্দেশ্যে এক থালা মিষ্টান্ন উপহার পাঠালেন। আর বলে দিলেন, আমি শুনেছি আপনি আমাকে আপনার কিছু নেকী হাদিয়া দিয়েছেন। বিনিময়ে আমার উপহারটুকু গ্রহণ করবেন’।[17]
ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহ্হাব (রহঃ) বলেন,العلاج من مرض الغيبة، هو أن يتذكر المغتاب تعرضه لسخط الله تعالى بغيبته، وأن يعلم أنها محبطة لحسناته يوم القيامة، فإنها تنقل حسناته يوم القيامة إلى من اغتابه، بدلا عما استباحه من عرضه فإن لم يكن له حسنات نقل إليه من سيئات خصمه، ‘গীবতের রোগ থেকে আরোগ্যের উপায় হ’ল গীবতকারী তার নিন্দাবাদের কারণে নিজেকে আল্লাহর অসন্তুষ্টির সামনে উপস্থাপন করবে। আর একথাটি ভালোভাবে জানবে যে, ক্বিয়ামতের দিন গীবত তার নেকীগুলোকে গীবতকৃত ব্যক্তির দিকে স্থানান্তর করে দিবে। সে গীবতের মাধ্যমে যার সম্মান নষ্ট করেছে। যদি তার নেকী না থাকে, তবে গীবতকৃত ব্যক্তির পাপগুলো তার উপর চাঁপিয়ে দেয়া হবে’।[18]
৬. গীবতকারীদের মজলিস পরিত্যাগ করা :
গীবতে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে অন্যতম অনুঘটক হিসাবে কাজ করে পরিবেশ ও সঙ্গ। অনেক সময় বাধ্য হয়ে গীবত শুনতে হয়, অথচ গীবত শোনাও সমান গুনাহ। মজলিসে অনিচ্ছা সত্ত্বেও গল্পচ্ছলে গীবত হয়ে যায়। সেজন্য নিন্দুক ও গীবতকারীর সঙ্গ ও বৈঠক পরিত্যাগ করা উচিত। গীবতকারীকে যদি বাহ্যিক দ্বীনদারও মনে হয়, তবুও তার ব্যাপারে সতর্ক-সাবধান থাকা অপরিহার্য।
আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (রহঃ) মসজিদে ছালাত আদায় করার পরে কারো সাথে কোন গল্প করতেন না। সোজা বাড়িতে চলে যেতেন। একদিন শাক্বীফ ইবনে ইবরাহীম বলখী (রহঃ) তাকে বললেন, ‘আচ্ছা! আপনি তো আমাদের সাথেই ছালাত আদায় করেন, কিন্তু আমাদের সাথে বসেন না কেন? উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমি ফিরে গিয়ে ছাহাবী ও তাবেঈদের সাথে বসে কথা বলি’। আমরা বললাম, ‘ছাহাবী-তাবেঈদের আপনি কোথায় পেলেন’? তিনি বললেন, ‘আমি ফিরে গিয়ে ইলম চর্চায় মনোনিবেশ করি। তখন তাদের কথা ও কর্মের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়। তোমাদের সাথে বসে আমি কি করব? তোমরা তো একত্রে বসলেই মানুষের গীবত করা শুরু করে দাও’।[19]
খালীদ রাবা‘ঈ (রহঃ) বলেন, একদিন আমি মসজিদে বসেছিলাম। এসময় লোকজন এক ব্যক্তির দোষ-ত্রুটি নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিল। আমি তাদের নিষেধ করলে তারা অন্য আলোচনা শুরু করল। তারপর তারা আবার পরনিন্দা শুরু করে দিল। এবার আমিও তাদের সাথে কিছুটা শরীক হ’লাম। ঐ রাতে আমি স্বপ্নে দেখলাম, বিরাট লম্বা এক কৃষ্ণকায় লোক আমার কাছে আসল। তার হাতে শূকরের গোশত ভরা একটি বাটি। সে আমাকে বলল, খাও! আমি বললাম, শূকরের গোশত? আল্লাহর কসম! আমি কিছুতেই এগুলো খাব না। তখন সে আমাকে ভয়ানক ধমক দিয়ে বলল, তুমি তো এর চেয়েও খারাপ গোশত খেয়েছ। তারপর সে গোশতগুলো আমার মুখে চেপে ধরল। এমন সময় আমি ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠলাম। খালীদ রাবা‘ঈ বলেন,فوالله لقد مَكَثْتُ ثلاثين يوما أو أربعين يوما ما أكلتُ طعاما إلّا وَجَدْتُ طَعْمَ ذلك اللحم ونَتَنَهُ فِي فَمِي، ‘আল্লাহর কসম! এরপর থেকে ত্রিশ বা চল্লিশ দিন পর্যন্ত আমি কিছু খেলেই মুখে সেই শূকরের গোশতের দুর্গন্ধ অনুভূত হ’ত’।[20]
৭. মানুষের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করা :
মানুষের দোষ-ত্রুটি যথাসম্ভব না জানার চেষ্টা করা উচিত। কারণ কারো ত্রুটি-বিচ্যুতি জানলেই তো সেটা অপরকে বলে ফেলার ক্ষেত্র তৈরী হয়। সালাফগণ কিভাবে অন্যের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করতেন, তা বোঝার জন্য একটা উদাহরণ যথেষ্ট হবে। আবূ আলী দাক্কাক্ব (রহঃ) বলেন, ‘একবার হাতিম (রহঃ)-কে এক মহিলা একটি মাসআলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। কিন্তু সে সময় অসতর্কতাবশত সেই মহিলার মুখ থেকে একটি শব্দ বেরিয়ে যায়। ফলে মহিলাটি বেশ লজ্জায় পড়ে যান। তখন হাতিম (রহঃ) বলেন, ‘একটু জোরে বলুন’। আসলে তিনি বুঝাতে চাচ্ছিলেন যে, তিনি কানে কম শোনেন। এই ভেবে মহিলাটি খুব খুশি হন যে, তিনি কিছু শুনতে পাননি। এই ঘটনার কারণে হাতিম (রহঃ)-কে اَلْأَصَمُّ (বধির বা শ্রবণশক্তিহীন) উপাধি দেওয়া। ফলে তিনি ইতিহাসে ‘হাতিম আল-আছম’ নামেই পরিচিত।[21] সুতরাং মানুষের দোষ-ত্রুটির ব্যাপারে হাতিম আল-‘আছম (রহঃ)-এর ন্যায় হ’তে পারলে গীবতের অভ্যাস ত্যাগ করা যাবে।
৮. নিজের ভুল-ত্রুটির দিকে অধিক মনোনিবেশ করা :
মানুষ মাত্রেরই দোষ-ত্রুটি বিদ্যমান। কারোটা প্রকাশ পায়, কারোটা পায় না। সেজন্য নিজের দোষ-ত্রুটি নিয়ে অধিক চিন্তা করা উচিৎ, তাহ’লে ভুল সংশোধন সহজ হবে। আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন,إذَا أَرَدْت أَنْ تَذْكُرَ عُيُوبَ صَاحِبِك فَاذْكُرْ عُيُوبَك، ‘যদি তোমার বন্ধুর ত্রুটি-বিচ্যুতির কথা মনে করতে চাও, তবে নিজের দোষ-ত্রুটির কথা স্মরণ কর’।[22] বকর ইবনে আব্দুল্লাহ আল-মুযানী (রহঃ) বলেন,إِذَا رَأَيْتُمُ الرَّجُلَ مُوَلعًا بِعُيُوبِ النَّاسِ نَاسِيًا لِعَيْبِهِ فَاعْلَمُوا أَنَّهُ قَدْ مُكِرَ بِهِ، ‘যদি তোমরা কোন ব্যক্তিকে এমন দেখ যে, সে নিজের ত্রুটি-বিচ্যুতি ভুলে গিয়ে শুধু অপর মানুষের দোষ-ত্রুটির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে, তবে জেনে রেখ! নিশ্চিতভাবে সে ধোঁকার মধ্যে নিমজ্জিত হয়েছে’।[23]
মূলতঃ অপরের ভুল-ত্রুটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিজের ত্রুটি-বিচ্যুতির দিকে মনোনিবেশ করতে পারা আল্লাহর বিশেষ নে‘মত। আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (রহঃ) বলেন, إِذَا أراد الله أَن ينقل العبد من ذل المعصية إِلَى عز الطاعة آنسه بالوحدة وأغناه بالقناعة وبصره بعيوب نَفْسه فمن أعطي ذَلِكَ فَقَدْ أعطي خير الدنيا والآخرة ‘আল্লাহ যখন বান্দাকে পাপের লাঞ্ছনা থেকে আনুগত্যের সম্মানের দিকে বের করে আনতে চান, তখন নির্জনতায় তাকে ঘনিষ্ঠ করে নেন, অল্পেতুষ্ট রাখার মাধ্যমে তাকে সম্মানিত করেন এবং নিজের দোষ-ত্রুটির দিকেই তার দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখেন। যাকে এই গুণ দেওয়া হয়েছে, তাকে যেন দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় কল্যাণ দান করা হয়েছে’।[24]
ইবনুস সাম্মাক (রহঃ) বলেন, ‘জিহবার সাহায্যে তুমি সচরাচর হিংস্রতা প্রদর্শন করে থাক এবং গীবতের মাধ্যমে চারপাশের মানুষকে নির্মমভাবে ভক্ষণ কর। তুমি যুগ যুগ ধরে মানুষকে কষ্ট দিয়েছ। এমনকি তোমার এই হিংস্রতা থেকে কবরবাসীও রেহাই পায়নি। তুমি তাদেরও গীবত ও সমালোচনা করেছ। এই হিংস্রতা থেকে বাঁচার জন্য তোমাকে নিম্নোক্ত তিনটি উপায়ের কোন একটি অবশ্যই অবলম্বন করতে হবে।-
(১) তুমি যখন তোমার ভাইয়ের এমন কোন দোষ নিয়ে সমালোচনা করবে, যা তোমার মাঝেও বিদ্যমান, তখন চিন্তা করবে, একই বিষয়ে নিজের ও অন্যের সাথে দ্বৈত আচরণের কারণে তোমার রব তোমার সাথে কেমন আচরণ করবেন?
(২) তুমি যখন কোন বিষয়ে কারো সমালোচনা করবে, তখন ভাববে এই বিষয়টি তোমার মধ্যে তার চেয়েও বেশী মাত্রায় বিদ্যমান। এটা করতে পারলে অন্যের গীবত ও সমালোচনা থেকে বেঁচে থাকা অধিকতর সহজ হবে।
(৩) যখন তুমি কোন বিষয়ে অন্যের সমালোচনা করবে তখন চিন্তা-ভাবনা করবে যে, মহান আল্লাহ স্বীয় অনুগ্রহে তোমাকে এই দোষ থেকে মুক্ত রেখেছেন। ফলে এর কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তুমি তার সমালোচনা থেকে মুক্ত রাখবে। তুমি কি এই নীতিবাক্যটি শোননি,ارحم أخاك واحمد الذي عافاك ‘(কারো ত্রুটি দেখলে) তুমি তার প্রতি দয়াপরবশ হয়ো। সেই সঙ্গে ঐ সত্তার প্রশংসা কর, যিনি তোমাকে মুক্ত রেখেছেন’।[25]
নিজের ত্রুটির প্রতি লক্ষ্য না রেখে, অপরের দোষ চর্চায় মানুষ লিপ্ত হয়। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমাদের কেউ অন্যের চোখের সামান্য ময়লা দেখতে পায় কিন্তু নিজের চোখের উটও (বড় ময়লা) দেখতে পায় না।[26]
৯. আল্লাহর কাছে দো‘আ করা :
বান্দা নিজের অজান্তেই গীবতে লিপ্ত হয়। অনেক সময় দ্বীনদার ব্যক্তিদের মাধ্যমেও সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম গীবত হয়ে যায়। তাই জিহবার হেফাযত অপরিহার্য। হাসান ইবনে ছালেহ (রহঃ) বলেন, فَتَّشتُ الوَرَعَ، فَلَمْ أَجِدْهُ فِي شَيْءٍ أَقَلَّ مِنَ اللِّسَانِ ‘আমি পরহেযগারিতা অনুসন্ধান করলাম। কিন্তু জিহবার চেয়ে কম পরহেযগারিতা অন্য কোন অঙ্গে পেলাম না’।[27] এজন্য জিহবার নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পাপ থেকে জিহবাকে হেফাযত করা অবশ্য কর্তব্য। আর এটা সহজসাধ্য নয়; বরং জিহবার হেফাযত ত্যাগ ও সাধনার ব্যাপার। মুহাম্মাদ বিন ওয়াসে‘ (রহঃ) বলেন,حفظ اللسان أشد على الناس من حفظ الدينار والدرهم، ‘দীনার-দিরহাম সংরক্ষণের চেয়ে জিহবার হেফাযত করা অত্যন্ত কঠিন’।[28]
গীবত থেকে স্বীয় রসনাকে হেফাযত করা খুব কঠিন, তাই এই কঠিন ব্যাপারটি আল্লাহর সহযোগিতা ছাড়া অর্জন করা সম্ভব নয়। তাই গীবত সহ জিহবার যাবতীয় পাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আল্লাহর তাওফীক্ব কামনা করতে হবে এবং তাঁর দরবারে দো‘আ করতে হবে।
১০. গীবতের ব্যাপারে সালাফদের সতর্কতা অবগত হওয়া :
নবী-রাসূল, ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের জীবন অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়। তারা গীবত থেকে কিভাবে সতর্ক থাকতেন এবং কি পদক্ষেপ নিতেন, সেগুলো অবহিত হ’লে গীবত থেকে বাঁচা যাবে। এখানে সালাফদের জীবনী থেকে কয়েকটি কাহিনী তুলে ধরা হ’ল।-
(১) আবুবকর (রাঃ) জিহবাকে খুবই ভয় পেতেন। একদিন ওমর (রাঃ) তাঁর কাছে আসলেন। এসে দেখেন আবুবকর (রাঃ) নিজের জিহবা ধরে টানাটানি করছেন। ওমর (রাঃ) বললেন, কি করছেন, থামুন! আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন! তখন আবুবকর (রাঃ) বলেলেন, এই জিহবাই আমাকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করেছে।[29]
(২) আব্দুল্লাহ ইবনে ওয়াহ্হাব (রহঃ) বলেন, একবার আমি মানত করলাম যে, যদি কারো গীবত করি তাহ’লে একদিন করে ছিয়াম রাখব। এভাবে আমি গীবত থেকে বাঁচার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমি গীবত করি আবার ছিয়ামও রাখি। ফলে আমি নিয়ত করলাম, একবার গীবত করলে এক দিরহাম করে ছাদাক্বাহ করব। এবার আমি দিরহামের ভালোবাসায় গীবত পরিত্যাগ করতে সক্ষম হ’লাম’।[30]
(৩) ত্বাউক্ব ইবনে ওয়াহ্হাব বলেন, একবার আমি অসুস্থ অবস্থায় মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন (রহঃ)-এর কাছে গেলাম। তিনি আমাকে দেখে বললেন, তুমি কি অসুস্থ? বললাম, হ্যাঁ! আমি তার কাছে নিজের রোগের ব্যাপারে আরয করলাম। তিনি আমাকে বললেন, অমুক ডাক্তারের কাছে যাও এবং তার কাছে পরামর্শ নেও। একটু পরে আরেকজন ডাক্তারের কথা উল্লেখ করে বললেন, তুমি বরং অমুকের কাছে যাও। সে আগের জনের চেয়ে অভিজ্ঞ ডাক্তার। কথাটা শেষ হ’তেই বললেন, ‘আস্তাগফিরুল্লাহ! আমি হয়ত প্রথম ডাক্তারের গীবত করে ফেললাম’।[31]
উল্লেখ্য যে, কাউকে সতর্ক করার জন্য কারো দোষ বর্ণনা করা জায়েয এবং ক্ষেত্র বিশেষে ওয়াজিব। সেকারণ কেউ যদি কোন অনভিজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়, তবে তাকে অভিজ্ঞ ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু ইবনু সীরীন (রহঃ)-এর ঘটনার ক্ষেত্র হয়ত ভিন্ন রকম ছিল। হয়ত উভয়ই ভালো ও সমমানের ডাক্তার ছিলেন। কিন্তু প্রথম জনকে অনুত্তম বলে ফেলার কারণে এটাতেও তিনি গীবত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করেছেন। মূলত ইবনু সীরীন এত শক্তভাবে গীবত পরিহার করার চেষ্টা করতেন যে, অনেক ক্ষেত্রে বৈধ গীবতকেও পরিহার করতেন। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘গীবতের একটি প্রকার আছে, অথচ অধিকাংশ মানুষ সেটাকে গীবতই মনে করে না। সেই গীবতটা হ’ল, অমুকের চেয়ে অমুক বেশী জ্ঞানী বলা। কেননা এই কথার দ্বারা যাকে কম জ্ঞানী মনে করা হয় তাকে হেয় করা হয়। আর এটা তো সবার জানা কথা যে, গীবত হ’ল কারো পিছনে এমন কথা বলা যা সে অপসন্দ করে’।[32]
(৪) মাইমূন ইবনে সিয়াহ (রহঃ) গীবতের ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক থাকতেন। তিনি নিজে কারো গীবত করতেন না এবং তার সামনে কাউকে গীবত করতেও দিতেন না। কাউকে গীবত করতে দেখলে তাকে ধমক দিতেন এবং নিষেধ করতেন। অন্যথা সেখান থেকে উঠে চলে যেতেন।[33]
(৫) ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন, ‘যেদিন আমি জেনেছি, গীবতের মাধ্যমে গীবতকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তারপর থেকে কোন দিন আমি কারো গীবত করিনি’।[34] বকর ইবনে মুনীর (রহঃ) বলেন, আমি আবূ আব্দুল্লাহ বুখারীকে বলতে শুনেছি, ‘আমি আশা করি, আমি আল্লাহর সামনে এমন অবস্থায় হাযির হব যে, কারো গীবত করার ব্যাপারে আমি হিসাবের সম্মুখীন হব না’।[35] ইমাম বুখারীর এই কথা প্রসঙ্গে হাফেয যাহাবী বলেন, ‘তিনি সত্যই বলেছেন। কারণ জারাহ ও তা‘দীলের ক্ষেত্রে কেউ যদি তাঁর শব্দ চয়ন ও বাক্য বিন্যাসের দিকে গভীর দৃষ্টি দেয়, তাহ’লে তিনি খুব সহজেই ইমাম বুখারীর তাক্বওয়াপূর্ণ সামালোচনা-রীতি অনুধাবন করতে পারবেন। সেই সঙ্গে এটাও বুঝতে পারবেন যে, তিনি যাদের যঈফ বা দুর্বল সাব্যস্ত করেছেন, তাদের ক্ষেত্রে তিনি অসামান্য ন্যায়-নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন। একারণে অধিকাংশ সময় সমালোচনার ক্ষেত্রে বলেছেন, ‘মুনকিরুল হাদীছ, সাকাতু আনহু, ফীহি নাযরুন’ ইত্যাদি। খুব কম ক্ষেত্রেই তিনি কাউকে কায্যাব (মহা মিথ্যুক) অথবা হাদীছ রচনাকারী বলে আখ্যা দিয়েছেন। অধিকন্তু তিনি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, আমি যখন কারও ক্ষেত্রে বলি, তার হাদীছ বর্ণনায় ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে, তখনই মূলত সে সবার কাছে অভিযুক্ত হয়ে যায়। উল্লেখ্য যে, তার পূর্বোক্ত বক্তব্য, আমি আল্লাহর সামনে এমন অবস্থায় হাযির হব যে, কারো গীবত করার ব্যাপারে আমি হিসাবের সম্মুখীন হব না, কথাটার সারমর্ম এটাই’।[36]
(৬) প্রখ্যাত তাবেঈ রাবী‘ ইবনু খুছাইম (রহঃ) গীবতের ব্যাপারে খুবই সতর্ক থাকতেন। জনৈক সালাফ বলেছেন, আমি বিশ বছর যাবৎ রাবী‘ ইবনে খুছাইমের সাথে চলেছি। কিন্তু কাউকে নিন্দা করে একটা শব্দও তাকে বলতে শুনিনি।[37]
(৭) ওয়াহিব ইবনুল ওয়ার্দ (রহঃ) বলেন,والله لَترك الغِيبة عندي أحب إليَّ من التَّصدُّق بجبل من ذهبٍ، ‘আল্লাহর কসম! গীবত পরিত্যাগ করা আমার কাছে এক পাহাড় স্বর্ণ আল্লাহর পথে ছাদাক্বাহ করার চেয়েও প্রিয়তর’।[38]
(৮) আব্দুল কারীম ইবনে মালেক (রহঃ) বলেন, ‘আমরা সালাফে ছালেহীনকে এমন পেয়েছি যে, তারা শুধু ছালাত ও ছিয়ামকে ইবাদত মনে করতেন না; বরং মানুষের সম্মান রক্ষার জন্য গীবত পরিহার করাকেও ইবাদত গণ্য করতেন’।[39]
(৯) এক ব্যক্তি হাসান বছরী (রহঃ)-এর কাছে এসে বললেন, ‘আপনি আমার গীবত করেছেন’। তখন হাসান বছরী বললেন, ‘তোমার মর্যাদা আমার কাছে এত বেশী না যে, আমি গীবত করে নিজের নেকীগুলো তোমাকে দিয়ে দেব’।[40]
(১০) সুফিয়ান ইবনুল হুছাইন বলেন, একদিন আমি ইয়াস ইবনে মু‘আবিয়া (রহঃ)-এর কাছে বসেছিলাম। এক লোক আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেল। আমি সেই লোকের ব্যাপারে কিছু কথা বললাম। তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘চুপ থাকো! তুমি কি রোমকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছ? বললাম, না। তিনি বললেন, তবে কি তুমি বাইজেন্টাইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছ? বললাম, না। তখন তিনি বললেন, তোমার থেকে রোমান ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য নিরাপত্তা লাভ করেছে, কিন্তু তোমার মুসলিম ভাই তোমার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ হ’তে পারেনি’। এরপর থেকে আমি কখনো কারো ভুল-ত্রুটির ব্যাপারে সমালোচনা করিনি।[41]
(১১) ইমাম মালেক (রহঃ) মদীনাবাসীর প্রশংসা করে বলেন, আমি এই শহরে এমন কিছু মানুষের সাক্ষাত পেয়েছি, যাদের কোন ভুল-ত্রুটি ছিল না। কিছু মানুষ তাদের ভুল খুঁজে বের করার চেষ্ট করে নিজেরাই দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। আর আমি মদীনাতে এমন কিছু মানুষেরও সন্ধান পেয়েছি, যাদের সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল। কিন্তু তারা অপর মানুষের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করে নীরবতা অবলম্বন করত। ফলে তাদের দোষ-ত্রুটি আল্লাহ গোপন রেখেছেন এবং মানুষের স্মৃতি
থেকে বিস্মৃত করে দিয়েছেন’।[42]
(১২) মদীনা ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর ক্লাসে হাযিরা নিচ্ছেন। ছায়েম নামে একজন ছাত্রকে অনুপস্থিত পেলেন। তিনি ছাত্রদের কাছে ছায়েমের অনুপস্থিতির কারণ জানতে চাইলেন। তারপর একটু কৌতুক করে বললেন,هو صام ونام ‘ছায়েম তো ছিয়াম রেখে ঘুমাচ্ছে। মন্তব্যটা করেই প্রফেসর ছাহেব, ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ বলে উঠলেন। কারণ ছায়েমের ব্যাপারে তার মন্তব্যটিকে গীবত মনে হওয়ায় তিনি লজ্জিত হয়েছেন। পরের দিন ছায়েম যখন ক্লাসে আসল, তিনি সব ছাত্রের সামনে গীবতের জন্য অনুতপ্ত হয়ে ছায়েমের কাছে ক্ষমা চাইলেন এবং ছায়েমকে অনেকগুলো বই উপহার দিলেন।
পরিশেষে বলা যায়, তলায় ছিদ্র বিশিষ্ট বালতিতে যতই পানি ঢালা হোক না কেন, সেই বালতি কখনো পূর্ণ হবে না। বালতি পূর্ণ করতে হ’লে তার ছিদ্রটা বন্ধ করতে হবে। অনুরূপভাবে গীবতের মাধ্যমে আমলনামার পাত্রটা ছিদ্র করে ফেললে আমলের নেকী তাতে সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়; ফলে গীবতকারী ক্বিয়ামতের দিন নিঃস্ব, সর্বস্বান্ত হয়ে যায়।
সুতরাং আমরা জিহবার হেফাযত করি। গীবত থেকে বাঁচার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করি। কথাবার্তা, আলাপচারিতা এবং গল্পের আড্ডায় কারো গীবত হয়ে যায় কি-না সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। কারো নামে লেখালেখি ও বক্তব্য দেওয়ার আগেও চিন্তা করে দেখতে হবে যে, এই লেখা, শেয়ার, পোস্ট, কমেন্টের মাধ্যমে কোন ভাইয়ের মর্যাদাহানি হচ্ছে কি-না বা কারো গোপন বিষয় প্রকাশ পাচ্ছে কি-না? মহান আল্লাহ আমাদের সার্বিক জীবনকে গীবত থেকে নিরাপদ রাখুন। সকল প্রকার গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক্ব দান করুন। পার্থিব জীবনের সফরে কেবল তাঁর ইবাদতে ব্যস্ত থাকার সৌভাগ্য দান করুন। আমৃত্যু ছিরাতে মুস্তাক্বীমে অটল থেকে পরিশুদ্ধ ঈমান নিয়ে কবরে যাওয়ার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!
আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
এম.এ, আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[1]. আহমাদ ইবনে হাম্বল, কিতাবুয যুহদ, পৃ. ১০১।
[2]. ড. আব্দুল মুহসিন ক্বাসেম, খুতুওয়াতুন ইলাস সা‘আদাহ, পৃ. ১১৬।
[3]. তিরমিযী হা/২৩১৪; ইবনু মাজাহ হা/৩৯৭০, সনদ ছহীহ।
[4]. তাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর হা/৭৪১; ছহীহুত তারগীব হা/২৭৪১, সনদ ছহীহ লিগাইরিহী।
[5]. তিরমিযী হা/২৬১৬; ইবনু মাজাহ হা/৩৯৭৩, মিশকাত হা/২৯, সনদ ছহীহ।
[6]. আবূ নু‘আইম, হিলয়াতুল আওলিয়া ১০/৬৩।
[7]. বুখারী হা/৬১৩৬; মুসলিম হা/৪৭; মিশকাত হা/৪২৪৩।
[8]. ইবনু রজব হাম্বলী, জামে‘উল উলূম ওয়াল হিকাম ১/৩৪০।
[9]. মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৮১৫৬; ছহীহুত তারগীব হা/২৮৬৬, সনদ হাসান।
[10]. তিরমিযী হা/২৪০৭; মিশকাত হা/৪৮৩৮, সনদ হাসান।
[11]. ইবনু আবীদ্দুন্য়া, আছ-ছাম্তু, পৃ. ৬৯।
[12]. আল-বাহরুল মুহীত্ব ২/১৭৪।
[13]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-জাওয়াবুল কাফী, পৃ. ১৫৮।
[14]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ওয়াবিলুছ ছায়্যিব, ১/৯৮।
[15]. ইবনে তাইমিয়াহ, আল-মুস্তাদরাক ‘আলা মাজমূ‘ইল ফাতাওয়া, ১/১৫৪।
[16]. নববী, আল-আযকার পৃ. ৩৪০; ইবনুল মুফলিহ, আর-রিসালাতুল কুশাইরিয়্যাহ, ১/২৯২।
[17]. আর-রিসালাতুল কুশাইরিয়্যাহ, ১/২৯২
[18]. মুহাম্মাদ ইবনু আব্দিল ওয়াহ্হাব, আল-কাবায়ের, পৃ. ১৪৫।
[19]. খত্বীব বাগদাদী, তাকয়ীদুল ইলম, পৃ. ১২৬; ছিফাতুছ ছাফওয়াহ ৩/৩২৪।
[20]. ইবনুল আহনাফ ইয়ামানী, বুস্তানুল কুরআন ফী ই‘রাবি মুশকিলাতিল কুরআন ৩/১২৮।
[21]. খত্বীব বাগদাদী, তারীখু বাগদাদ, ৯/১৪৯; মাদারিজুস সালিকীন, ৩/৯৩।
[22]. ইবনু হাজার হায়তামী, আয-যাওয়াজির ২/১৮।
[23]. ইবনু আবিদ্দুন্য়া, যাম্মুল গীবতি ওয়ান নামীমাহ, পৃ. ২৩।
[24]. ইবনুল মুফলিহ, আল-আদাবুশ শার‘ইয়াহ, ১/২২৬।
[25]. ইবনুল জাওযী, ছিফাতুছ ছাফওয়া, ২/১০১-১০২।
[26]. আদাবুল মুফরাদ হা/২৪০, ৩৫১; ছহীহুত তারগীব হা/২৩৩১।
[27]. যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৭/৩৬৮।
[28]. গাযালী, ইহয়াউ উলূমিদ্দীন, ৩/১১১।
[29]. মুয়াত্তা মালেক হা/৩৬২১; ছহীহুত তারগীব হা/২৮৭৩, সনদ ছহীহ।
[30]. যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৯/২২৮; ইয়াসীর হামাদানী, হায়াতুত তাবেঈন, পৃ. ৯৬৪।
[31]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, ৫/৩১৪; ছিফাতুছ ছাফওয়া ২/১৪৩।
[32]. আব্দুল ওয়াহ্হাব আশ-শা‘রানী, তাম্বীহুল মুগতার্রিন, পৃ. ২০৩।
[33]. আবূ নু‘আইম আস্ফাহানী, হিলয়াতুল আওলিয়া, ৩/১০৭; ইবনুল জাওযী, ছিফাতুছ ছাফওয়া ২/১৩৭।
[34]. বুখারী, তারীখুল কুবরা ৫/৫৮৮; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ১২/৪৩৯-৪১।
[35]. তাহযীবুল কামাল ২৪/৪৪৬; শাযারাতুয যাহাব ৩/২৫৪।
[36]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ১২/৪৩৯-৪৪১।
[37]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবাল ৪/২৫৯।
[38]. মুহাম্মাদ ইসমাঈল মুক্বাদ্দাম, আল-ই‘লাম, পৃ. ৭০; আত-তাওবীখ ওয়াত-তানবীহ, ক্রমিক: ১৬৯।
[39]. হিলয়াতুল আওলিয়া, পৃ. ৩/১৫২।
[40]. নববী, আল-আযকার, পৃ. ৩৪০।
[41]. সামারকান্দি, তাম্বীহুল গাফিলীন, পৃ. ১৬৫।
[42]. আব্দুর রহমান সাখাবী, আল-জাওয়াহিরু ওয়াদ্দুরার, ৩/১০৬৭; ওমর মুক্ববিল, মাওয়াইযুছ ছাহাবাহ, পৃ. ১০৩।