আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন মানবজাতিকে পৃথিবীতে প্রেরণের সাথে সাথে বেঁচে থাকার জন্য নানা রকমের খাদ্যের ব্যবস্থা করেছেন। তবে শারীরিক সুস্থতার জন্য পরিমিত আহার যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা আমাদের সকলেরই জানা। রাসূল (ছাঃ) বলেন, দু’টি নে‘মত রয়েছে, যে দু’টিতে বহু মানুষ ধোঁকায় পতিত হয়েছে- স্বাস্থ্য এবং অবসর।[1] কখনও অবসরকে কাজে লাগানো বা সময়ের মূল্য দিলেও স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে আমরা তেমন গুরুত্বই দেই না। অথচ এটাও আমাদের ধর্মীয় কর্তব্যেরই অংশ। যেমন :

* রাসূল (ছাঃ) স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য পরিমিত আহার গ্রহণের উপদেশ দিয়ে বলেন, ‘পেট অপেক্ষা নিকৃষ্টতর কোন পাত্র মানুষ পূর্ণ করে না। আদম সন্তানের জন্য ততটুকু খাদ্যই যথেষ্ট যতটুকুতে তার পিঠ সোজা থাকে। আর যদি এর চেয়ে বেশী খেতেই হয়, তাহ’লে সে যেন তার পেটের এক-তৃতীয়াংশ আহারের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ পানের জন্য এবং এক-তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য ব্যবহার করে’।[2]

* তিনি অধিক রসনাবিলাসীদের নিন্দা করে বলেন, إِنَّ مِنْ شِرَارِ أُمَّتِيَ الَّذِيْنَ غُذُّوْا بِالنَّعِيْمِ، هِمَّتُهُمْ أَلْوَانَ الطَّعَامِ وَأَلْوَانَ الثِّيَابِ يَتَشَدَّقُوْنَ فِي الْكَلَامِ ‘আমার উম্মতের সবচেয়ে নিকৃষ্ট লোকদের মধ্যে রয়েছে ঐ সকল ব্যক্তি, যারা অবাধ বিলাসব্যসনের মধ্যে জীবনযাপন করে, যাদের আকাংখা কেবল নানাবিধ খাদ্য ভক্ষণ করা আর নানার রংয়ের পোষাক পরিধান করা। তারা মানুষের প্রতি উপহাসচ্ছলে বল্গাহীন কথাবার্তা বলে (সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৮৯১)।

একদিন জনৈক কাফের রাসূল (ছাঃ)-এর অতিথি হ’ল। রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশক্রমে এবং তার চাহিদামত তার জন্য একে একে ৭টি বকরীর দুধ দোহন করে পরিবেশন করা হ’লে উক্ত ব্যক্তি সবটুকুই খেয়ে নিল। পরদিন সকালে সে ইসলাম গ্রহণ করল। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) একইভাবে তাকে দুধ দিতে বললেন। কিন্তু লোকটি একটির বেশী বকরীর দুধ পান করতে সক্ষম হ’ল না। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘মুসলিম খায় একটি মাত্র পেটে, পক্ষান্তরে কাফের খায় সাত পেটে।[3]

আবূ জুহাইফা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, একদিন আমি গোশত ও রুটি মিশ্রিত ছারীদ খেলাম এবং রাসূল (ছাঃ)-এর সামনে ঢেকুর তুলতে তুলতে আসলাম। তিনি বললেন, كُفَّ عَنَّا جُشَاءَكَ فَإِنَّ أَكْثَرَهُمْ شِبَعًا فِي الدُّنْيَا أَطْوَلُهُمْ جُوعًا يَوْمَ القِيَامَةِ ‘আমাদের সামনে তোমার ঢেকুর তোলা বন্ধ কর। নিশ্চয় যে সকল ব্যক্তি দুনিয়াতে বেশি পরিতৃপ্ত হবে, তারাই কিয়ামতের দিন সবচেয়ে বেশি ক্ষুধার্ত থাকবে’।[4]

* রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম সর্বদা পরিমিত আহারকে প্রাধান্য দিতেন। যেমন আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, ঐ সত্তার কসম! যার হাতে আবূ হুরায়রার প্রাণ। দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করা পর্যন্ত একাধারে তিন দিন পর্যন্ত নবী করীম (ছাঃ) ও তাঁর পরিবার গমের রুটি দ্বারা পরিতৃপ্ত হননি (মুসলিম হা/২৯৭৬)

ওমর (রাঃ) বলেছেন, ‘মানুষ আজ কী পরিমাণ দুনিয়া কামাই করেছে! অথচ রাসূল (ছাঃ)-কে আমি দেখেছি যে, তিনি ক্ষুধার তাড়নায় সারাদিন অস্থির থাকতেন। পেট ভরার মত নিম্নমানের একটি খেজুরও তিনি (খেতে) পাননি’ (মুসলিম হা/২৯৭৮)।

আনাস (রাঃ) বলেন, ‘রাসূল (ছাঃ)-এর পরিবারের নিকট কোন সন্ধ্যাতেই এক ছা‘ গম বা কোন খাদ্যদানা (&আগামীকালের জন্য) অবশিষ্ট থাকত না। অথচ তাঁর স্ত্রী ছিলেন নয় জন’ (অর্থাৎ তিনি যা পেতেন সবই দান করে দিতেন। জমা রাখতেন না) (বুখারী হা/২০৬৯)।

একদিন আবু হুরায়রা (রাঃ) একদল মানুষের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। যাদের সামনে একটা ভুনা বকরী ছিল। তারা তাঁকে খাওয়ার জন্য দাওয়াত দিলেন। কিন্তু তিনি অস্বীকার করে বললেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে গেছেন। অথচ কখনো একটি যবের রুটি দিয়েও পরিতৃপ্ত হননি’ (বুখারী হা/৫৪১৪)

একদিন ক্ষুধার জ্বালায় রাসূল (ছাঃ) ঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন। পথে আবুবকর ও ওমর (রাঃ)-কে দেখতে পেয়ে জানতে পারলেন, তারাও ক্ষুধার কারণে খাবারের খোঁজে বাইরে এসেছেন। তারপর তাঁরা একজন আনছারী ছাহাবীর গৃহে দাওয়াত গ্রহণ করলে তিনি তাঁদের খেজুর, গোশত ও পানি দ্বারা আপ্যায়ন করলেন। তৃপ্তি সহকারে খাদ্যগ্রহণের পর রাসূল (ছাঃ) তাৎপর্যপূর্ণ যে কথাটি বললেন তা হ’ল, যে সত্তার হাতে আমার জীবন, তার কসম! কিয়ামতের দিন এ নে‘মত সম্পর্কেও তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে। ক্ষুধা তোমাদের বাড়ি হতে বের করে এনেছিল, অথচ তোমরা এ নে‘মত লাভ করে বাড়িতে ফিরে যাচ্ছো (মুসলিম হা/২০৩৮)।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন লোকদের সাথে নিয়ে জামা‘আতে ছালাত আদায় করতেন, তখন আহলে ছুফফার কিছু লোক ক্ষুধার যন্ত্রণায় ছালাতে দাঁড়ানো অবস্থা থেকে পড়ে যেতেন। তাদের এ অবস্থা দেখে বেদুঈনরা বলতো, এরাতো পাগল। রাসূল (ছাঃ) ছালাত শেষে তাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলতেন, ‘আল্লাহ তা‘আলার নিকট তোমাদের যে কত নে‘মতের ভান্ডার রয়েছে তা যদি তোমরা জানতে, তাহ’লে তোমরা বেশী বেশী ক্ষুধার্ত ও অভাব-অনটনে থাকতে পসন্দ করতে’।[5]

* অপরিমিত খাদ্যগ্রহণ তাক্বওয়াপূর্ণ জীবনযাপনের ক্ষেত্রেও অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তাইতো যারা ইবাদতে খুশূ-খুযূ হারিয়ে ফেলেছেন এবং আল্লাহভীতির অশ্রু খুঁজে ফিরছেন তাদের প্রতি হাসান বছরী (রহঃ)-এর উপদেশ, ‘যিনি হৃদয়জগতে আল্লাহভীরুতা কামনা করেন এবং চোখ থেকে অঝোর ধারায় অশ্রু প্রবাহিত করতে চান, তিনি যেন অর্ধেক পেট খাবার গ্রহণ করেন’ (আদাবুল হাসান বাছরী)

ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন, ‘১৬ বছর বয়স থেকে আমি আর কখনো (খাদ্যগ্রহণের ক্ষেত্রে) পূর্ণ পরিতৃপ্ত হইনি। বরং তা প্রত্যাখ্যান করেছি। কেননা পরিতৃপ্তি শরীরকে ভারী করে, হৃদয়কে কঠিন করে, বিচক্ষণতা দূরীভূত করে, ঘুম আনায়ন করে এবং ইবাদত থেকে দূর্বল করে দেয়’।[6] 

সুতরাং আসুন! আজকের এই বস্ত্তবাদী দুনিয়ায় আমরা অধিক বিলাস-ব্যাসন থেকে নিজেকে বিরত রাখি। যখন-তখন বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে বিলাসবহুল হোটেলে-রেস্তোরাঁয় অপ্রয়োজনীয় সময় কাটানো, সময় ও খাদ্যের অপচয় থেকে বিরত থাকি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন!


[1]. বুখারী হা/৬৪১২; মিশকাত হা/৫১৫৫।

[2]. তিরমিযী হা/২৩৮০; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৬৭৪।

[3]. মুসলিম হা/২০৬৩; তিরমিযী হা/১৮১৯।

[4]. হাকেম; ছহীহুত তারগীব হা/২১৩৬।

[5]. তিরমিযী হা/২৩৬৮; ছহীহাহ হা/২১৬৯।

[6]. ইবনু আবী হাতেম, আদাবুশ শাফেঈ পৃ.৭৮।






বিষয়সমূহ: বিবিধ
আরও
আরও
.