উপস্থাপনা :
উত্তরের হিমেল হাওয়ায় শীতের কোমল স্পর্শ অনুভূত হয়। তীব্রতা বাড়িয়ে দেয় ঠান্ডার। প্রত্যুষে ঘুম থেকে সজাগ হয়ে চারদিকে তাকালে যেন মনে হয় শীতল আমেজে চাদরাবৃত হয়ে রয়েছে সবকিছু। বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র্যে অপরূপ সৌন্দর্য আছে। যেগুলি আল্লাহর অনন্য সৃষ্টি। আর এই শীতকাল মুমিনের আমলী জীবনকে আরও বেশী সৌন্দর্যমন্ডিত করে থাকে। তাকে প্রস্ত্তত করে পরকালীন জীবনের জন্য পাথেয় সঞ্চয়ের সুবর্ণ সুযোগ গ্রহণ করতে।
শীতকালের পরিচয় :
বাংলাদেশের ষড়ঋতুর মধ্যে শীতকাল অন্যতম। পৌষ-মাঘ এ দু’মাস শীতকাল। এ ঋতু সম্পর্কে হাদীছে এসেছে এভাবে যে, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘জাহান্নাম তার রবের নিকট অভিযোগ করে বলেছে, হে রব! আমার এক অংশ অপর অংশকে খেয়ে ফেলছে। তখন তিনি তাকে দু’টি নিঃশ্বাস ফেলার অনুমতি প্রদান করেন। একটি নিঃশ্বাস শীতকালে, অপরটি গ্রীষ্মকালে। কাজেই তোমরা গরমের তীব্রতা এবং শীতের তীব্রতা পেয়ে থাক’।[1]
শীত মওসুম আমলের বসন্তকাল :
শীতকাল মুমিনের জন্য আমলের বসন্ত ঋতু। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন,مرحبا بالشتاء، فيه تنزل الرحمة، أما ليله فطول للقائم، وأما نهاره فقصير للصائم، ‘শীতকালকে স্বাগতম। এতে রহমত নাযিল হয়। এর রাত্রি ক্বিয়ামকারীর (রাতে নফল ছালাত আদায়কারীর) জন্য দীর্ঘ এবং এর দিন ছিয়াম পালনকারীর জন্য ছোট’।[2] মুমিন ইবাদতে মশগূল থেকে পরকালের পাথেয় সঞ্চয়ে এ মৌসুম কাজে লাগায়। যেভাবে বসন্ত মৌসুমে পশু-পাখিরা মাঠে-ময়দানে ঘুরে-ফিরে খাবার সংগ্রহ করে খেয়ে শরীরটা মোটা-তাযা করে থাকে।
ইবাদত, ওয়ায-নছীহত, ইলম অন্বেষণ ও গবেষণার সুযোগ :
ইবাদতের বসন্তকাল হ’ল শীতকাল। শীতে সারা দেশে ওয়ায-নছীহত, তা‘লীমী বৈঠক, মাসিক তাবলীগী ইজতেমা, ইসলামী সম্মেলন, বার্ষিক তাবলীগী ইজতেমা প্রভৃতি দাওয়াতী কাজের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। অন্যান্য মৌসুম অপেক্ষা শীতে গভীর ইলম অন্বেষণ ও দীর্ঘ গবেষণার সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে। প্রসঙ্গত ইমাম শাফেঈ (রহঃ)-এর কবিতাটি উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেন,
بقدر الكد تكتسب المعالى + ومن طلب العلا سهر الليالى
‘তীব্র কষ্ট স্বীকারে উচ্চ মর্যাদা লাভ করা যায়। আর যে ব্যক্তি শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করতে চায়, সে যেন রাত্রি জাগরণ করে’।
শীতের দীর্ঘ রাতে তাহাজ্জুদের সুযোগ :
আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ বছর জুড়ে এই বরকতপূর্ণ সময়ের প্রতি যত্নবান থাকেন। তাদের কাছে রাত ছোট ও বড় হওয়ার মধ্যে তেমন কোন তারতম্য নেই। তারা গ্রীষ্মকালের ছোট রাতেও অল্প সময় ঘুমিয়ে বিছানা ত্যাগ করেন এবং রাতের নিস্তব্ধ নীরবতায় আল্লাহর ইবাদতে মশগূল হয়ে যান। শেষ রাতে ছালাত পড়েন, ক্ষমা প্রার্থনা করেন, তওবা করেন। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও মুসলিম উম্মাহর জন্য প্রাণভরে কাকুতিভরা কণ্ঠে আল্লাহর সমীপে উভয় জগতের সফলতার জন্য দো‘আ করেন। রাত ছোট হওয়ায় বরং তাদের ইবাদতের তৃষ্ণা থেকে যায়। ফলে শীতের দীর্ঘ রাতে তারা এই তৃষ্ণা নিবারণ করতে সক্ষম হন এবং আত্মিক প্রশান্তি লাভ করেন। শীতকালে রাত বেশ দীর্ঘ হয়। এশার পর তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লে সহজে শেষ রাতে ওঠা সম্ভব হয়। সকল মুমিনের চেষ্টা করা উচিত শীতকালে এই সুবর্ণ সুযোগ যেন হাতছাড়া না হয়ে যায়। হাসান বছরী (রহঃ) বলেন,نعم زمان المؤمن الشتاء ليله طويل يقومه، ونهاره قصير يصومه ‘কতইনা উত্তম সময় মুমিনের জন্য শীতকাল! এর রাত দীর্ঘ, যাতে সে (ছালাতে) দন্ডায়মান হয়। এর দিন ছোট, যাতে সে ছিয়াম পালন করে’।[3] আর যারা রাতে ক্বিয়াম ও দিনে ছিয়াম পালন করেন ঐসকল মুমিনের প্রশংসায় আল্লাহ বলেন,كَانُوْا قَلِيلاً مِّنَ اللَّيْلِ مَا يَهْجَعُونَ- وَبِالْأَسْحَارِ هُمْ يَسْتَغْفِرُونَ- ‘তারা রাত্রির সামান্য অংশেই নিদ্রা যেত’। ‘এবং রাত্রির শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করত’ (যারিয়াত ৫১/১৭-১৮)। রাসূল (ছাঃ) বলেন,عَلَيْكُمْ بِقِيَامِ اللَّيْلِ فَإِنَّهُ دَأَبُ الصَّالِحِيْنَ قَبْلَكُمْ وَهُوَ قُرْبَةٌ إِلَى رَبِّكُمْ وَمُكَفِّرَةٌ لِّلسَّيِّئَاتِ وَمَنْهَاةٌ عَنِ الْإِثْمِ- ‘তোমাদের ক্বিয়ামুল লায়ল (রাতের ছালাত) আদায় করা উচিত। কেননা রাতে ইবাদত করা তোমাদের পূর্ববর্তী সৎকর্মশীল ব্যক্তিগণের রীতি, তোমাদের জন্য তোমাদের প্রতিপালকের নৈকট্য লাভের সুযোগ এবং পাপরাশি মোচনকারী ও পাপ হ’তে বিরত থাকার অন্যতম মাধ্যম’।[4]
ছিয়াম পালনে শীতল গণীমত লাভ :
শীতকাল এমন গণীমত যা কোন চেষ্টা ও কষ্ট ছাড়াই অর্জিত হয়। সকলেই কোন ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই এ গণীমত লাভ করতে এবং কোন প্রচেষ্টা বা পরিশ্রম ব্যতিরেকে তা ভোগ করতে পারেন। শীতকাল নফল ছিয়াম রাখার জন্য সুবর্ণ সুযোগ। শীতের সময় দিন সংক্ষিপ্ত হয় এবং রাত প্রলম্বিত হয়। শীতকালের দিনের বেলা ছিয়াম রাখলেও ছায়েম ক্ষুৎ-পিপাসায় কাতর হয় না; তেমন তৃষ্ণা অনুভব করে না। যারা নফল ছিয়াম রাখতে চান, কিন্তু গরমকালে অধিক তৃষ্ণার্ত হওয়া এবং দিন বড় হওয়ায় রাখতে পারেন না, শীতকাল তাদের জন্য এক অমূল্য সুযোগ। তাই আমরা এসময় অধিক পরিমাণে ছিয়াম রাখতে পারি। বিশেষতঃ সোমবার, বৃহস্পতিবার ও আইয়ামে বীযের ছিয়াম সমূহ এবং ছাওমে দাঊদ (একদিন পরপর ছিয়াম)। মা-বোনদের অবশিষ্ট ক্বাযা ছিয়াম সমূহ শীতকালে আদায় করাটা সহজতর। শীতকালে যেন এই সুযোগ হাতছাড়া না হয়, সেদিকে আমাদেরকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে। অল্প কষ্টে ছিয়ামের পূর্ণ নেকী অর্জনকে রাসূল (ছাঃ) গণীমত হিসাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, الْغَنِيمَةُ الْبَارِدَةُ الصَّوْمُ فِى الشِّتَآءِ- ‘শীতল গণীমত হচ্ছে শীতকালের ছিয়াম’।[5] সেকারণ আমরা যেন শীতের ছোট দিনে অধিক পরিমাণে ছিয়াম রাখতে পারি। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক দান করুন-আমীন!
ফজর ছালাত আদায়ের সুযোগ :
পার্থিব জীবনের ব্যস্ততম সময় অতিবাহিত করে অনেকে গভীর রাতে ঘুমাতে যান। ফলে তাদের পক্ষে ফজরের ছালাত জামা‘আতে আদায় করা কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। বিশেষ করে গ্রীষ্মকালের স্বল্পদৈর্ঘ্য রাতে ফজর ছালাত অনেকেই জামা‘আতে আদায় করতে পারে না। কিন্তু শীতের দীর্ঘ রাতে বিলম্বে শয্যা গ্রহণ করলেও ফজরে উঠতে ও জামা‘আতে শরীক হ’তে কষ্ট হয় না। ফলে অধিক ছওয়াব হাছিলের এই অবারিত সুযোগ লাভ করে সকলে ধন্য হ’তে পারেন। ফজর ছালাতের অনন্য ফযীলত সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ صَلَّى الصُّبْحَ فَهُوَ فِي ذِمَّةِ اللهِ، فَلَا يَطْلُبَنَّكُمُ اللهُ مِنْ ذِمَّتِهِ بِشَيْءٍ فَيُدْرِكَهُ فَيَكُبَّهُ فِي نَارِ جَهَنَّمَ، ‘যে ব্যক্তি ফজরের ছালাত আদায় করল সে মহান আল্লাহর যিম্মায় থাকবে। আর আল্লাহ তোমাদের কারো কাছে তার রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তাদানের বিনিময়ে কোন অধিকার দাবী করেন না। যদি করেন তাহ’লে তাকে এমনভাবে পাকড়াও করবেন যে, উল্টিয়ে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবেন’।[6] অন্যত্র তিনি বলেন,مَنْ صَلَّى الصُّبْحَ فَهُوَ فِي ذِمَّةِ اللهِ فَلَا يُتْبِعَنَّكُمُ اللهُ بِشَيْءٍ مِنْ ذِمَّتِهِ، ‘যে ব্যক্তি ফজরের ছালাত আদায় করে, সে আল্লাহর হেফাযতে থাকে। সুতরাং আল্লাহ তোমাদেরকে যেন তাঁর দায়িত্ব প্রসঙ্গে অভিযুক্ত না করেন’।[7]
ফজর ছালাত জামা‘আতে আদায়ের ফযীলত অত্যধিক। রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ صَلَّى الصُّبْحَ فِي جَمَاعَةٍ فَكَأَنَّمَا صَلَّى اللَّيْلَ كُلَّهُ، ‘যে ব্যক্তি ফজরের ছালাত জমা‘আতে আদায় করেছে, সে যেন পুরো রাত ছালাত আদায় করেছে’।[8] ফজরের ছালাত সময়মত আদায়ের সবচেয়ে বড় ফযীলত হ’ল আদায়কারী জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ পায় এবং জান্নাতে প্রবেশের সুযোগ লাভ করে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,لَنْ يَلِجَ النَّارَ أَحَدٌ صَلَّى قَبْلَ طُلُوعِ الشَّمْسِ، وَقَبْلَ غُرُوبِهَا، ‘সূর্যোদয়ের পূর্বে ও সূর্যাস্তের পূর্বে (ফজর ও আছরের) ছালাত আদায়কারী ব্যক্তি কখনও জাহান্নামে প্রবেশ করবে না’।[9] তিনি আরো বলেন,مَنْ صَلَّى الْبَرْدَيْنِ دَخَلَ الْجَنَّةَ ‘যে ব্যক্তি দু’ঠান্ডা সময় (ফজর ও আছরের) ছালাত আদায় করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[10]
কষ্টকর ওযূতে অধিকতর ছওয়াব :
গ্রীষ্মকালে ওযূ করতে কষ্ট হয় না। কিন্তু শীতকালের ঠান্ডা পানিতে ওযূ করতে কষ্ট হয়। কষ্টকর হওয়া সত্ত্বেও যারা পূর্ণরূপে ওযূ করেন, তাদের মর্যাদা সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন,أَلَا أَدُلُّكُمْ عَلَى مَا يَمْحُو اللهُ بِهِ الْخَطَايَا وَيَرْفَعُ بِهِ الدَّرَجَاتِ؟ قَالُوا : بَلَى يَا رَسُولَ اللهِ! قَالَ : إِسْبَاغُ الْوُضُوءِ عَلَى الْمَكَارِهِ، وَكَثْرَةُ الْخُطَى إِلَى الْمَسَاجِدِ، وَانْتِظَارُ الصَّلَاةِ بَعْدَ الصَّلاَةِ فَذَلِكُمُ الرِّبَاطُ- ‘আমি কি তোমাদের বলে দিব না যে, কিসের দ্বারা আল্লাহ মানুষের গোনাহ সমূহ মোচন করে দেন এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন? ছাহাবীগণ বললেন, হ্যাঁ বলুন হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তিনি বললেন, কষ্ট সত্ত্বেও পূর্ণরূপে ওযূ করা, পায়ে হেঁটে মসজিদে যাওয়া এবং এক ছালাত শেষ হওয়ার পর আরেক ছালাতের প্রতীক্ষায় থাকা। আর এটাই হচ্ছে ‘রিবাত’ বা প্রস্ত্ততি’।[11] অর্থাৎ কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও পূর্ণভাবে ওযূ করা, পায়ে হেঁটে মসজিদে যাওয়া এবং এক ছালাত শেষ হওয়ার পর আরেক ছালাতের প্রতীক্ষায় থাকার কারণে আল্লাহর পথে যুদ্ধরত সৈনিকদের জিহাদের সমপরিমাণ ছওয়াব তারা অর্জন করবে’।[12]
অধিক কুরআন তিলাওয়াত ও মুখস্থ করার অপার সুযোগ :
শীতকালের রাত অনেক লম্বা হয়। আর রাত যেকোন কিছু মুখস্থ করার জন্য উপযুক্ত সময়। সেকারণ শীত এলে বেশী বেশী ইলম অন্বেষণে সময় ব্যয় করা উচিৎ। পাশাপাশি কুরআন মাজীদ তারতীল সহকারে তিলাওয়াতের চেষ্টা করা অতীব যরূরী। শীতকাল আসলে ওবায়দ ইবনু উমায়র বলতেন,يا أهل القرآن! طال ليلكم طويل لقراءتكم فاقرؤوا، وقصر النهار لصيامكم فصوموا ‘হে কুরআনের অনুসারীগণ! তোমাদের জন্য রাতকে দীর্ঘ করা হয়েছে তেলাওয়াত করার জন্য, সুতরাং তোমরা তেলাওয়াত কর। দিনকে ছোট করা হয়েছে। ছিয়াম পালনের জন্য, সুতরাং তোমরা ছিয়াম রাখ’।[13]
অতএব হে কুরআনের পাখিরা! রাতে বেশী বেশী তিলাওয়াত করুন। আর দিনে ছিয়াম পালনে ব্রতী হৌন!
শীতার্ত অসহায় মানুষের সহযোগিতা করা :
অসহায় শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর একটা মহা সুযোগ চলে আসে এই শীতকালে। প্রচন্ড শীতে অসংখ্য আশ্রয়হীন মানুষ কষ্ট পায় শীতবস্ত্রের অভাবে। বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানো ইসলামের সুমহান আদর্শ সমূহের অন্যতম। তাই মানবিক ও ইসলামিক উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে এসব অসহায় মানুষের পাশে সাধ্যমত দাঁড়ানো উচিত। কারণ আল্লাহর দয়া-ভালোবাসা পেতে হ’লে মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করতে হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,اَلرَّاحِمُونَ يَرْحَمُهُمُ الرَّحْمَنُ، ارْحَمُوا مَنْ فِي الْأَرْضِ يَرْحَمْكُمْ مَنْ فِي السَّمَآءِ- ‘দয়াশীলদের উপর দয়াময় আল্লাহ অনুগ্রহ করেন। তোমরা যমীনবাসীর উপর দয়া করো, তাহ’লে আসমানবাসী আল্লাহ তোমাদের উপর অনুগ্রহ করবেন’।[14] অন্যত্র তিনি বলেন,لاَ يَرْحَمُ اللهُ مَنْ لاَّ يَرْحَمُ النَّاسَ- ‘আল্লাহ অনুগ্রহ করেন না ঐ ব্যক্তির উপর, যে মানুষের উপর দয়া করে না’।[15] সুতরাং শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ালে আল্লাহ বান্দাকে পরকালে সাহায্য করবেন।
শীতের তীব্রতায় তায়াম্মুম করার বিধান :
তীব্র শীতে কষ্ট হ’লে কুসুম গরম পানি দিয়ে ওযূ করতে শারঈ কোন বাধা নেই। ওযূর পর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গামছা-তোয়ালে দিয়ে মুছে ফেললেও কোন সমস্যা নেই। শীতের তীব্রতা যদি কারও সহ্যের বাইরে চলে যায়, পানি গরম করে ব্যবহার করার সুযোগ না থাকে এবং ঠান্ডা পানি ব্যবহারে শারীরিকভাবে অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাহ’লে তিনি ওযূর পরিবর্তে তায়াম্মুম করতে পারেন। মহান আল্লাহ বলেন,وَإِنْ كُنْتُمْ مَرْضَى أَوْ عَلَى سَفَرٍ أَوْ جَاءَ أَحَدٌ مِنْكُمْ مِنَ الْغَائِطِ أَوْ لَامَسْتُمُ النِّسَاءَ فَلَمْ تَجِدُوا مَاءً فَتَيَمَّمُوا صَعِيدًا طَيِّبًا، فَامْسَحُوا بِوُجُوهِكُمْ وَأَيْدِيكُمْ مِنْهُ، ‘যদি তোমরা পীড়িত হও অথবা সফরে থাক অথবা টয়লেট থেকে আস কিংবা স্ত্রী স্পর্শ করে থাক, অতঃপর পানি না পাও; তাহ’লে তোমরা পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম কর এবং এজন্য তোমাদের মুখমন্ডল ও দু’হাত উক্ত মাটি দ্বারা মাসাহ কর’ (মায়েদাহ ৫/৬)। এ আয়াতে দলীল রয়েছে যে, অসুস্থ ব্যক্তি ঠান্ডা পানি ব্যবহার করার ফলে যদি তার রোগ বৃদ্ধি বা জীবননাশের আশঙ্কা থাকে, সেক্ষেত্রে তিনি তায়াম্মুম করবেন। কারণ আল্লাহ তার বান্দার উপর কোনরূপ কাঠিন্য করতে চান না; বরং তিনি পবিত্র করতে চান।
আমর ইবনুল আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘যাতুস সালাসিল-এর অভিযানে তীব্র শীতের রাতে আমার স্বপ্নদোষ হয়ে গেল। আমি আশঙ্কা করলাম যে, আমি যদি গোসল করি তাহ’লে ধ্বংস হয়ে যাব। তাই আমি তায়াম্মুম করে আমার সাথীদেরকে নিয়ে ফজরের ছালাত আদায় করলাম। আমার সফর সাথীরা বিষয়টি নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে উল্লেখ করলে তিনি বললেন, হে ‘আমর! তুমি কোন অবস্থায় তোমার সাথীদের নিয়ে ছালাত পড়েছ? তখন আমি তাঁকে জানালাম কি কারণে গোসল করিনি এবং আরও বললাম যে, আমি শুনেছি যেখানে আল্লাহ বলেন,وَلاَ تَقْتُلُوا أَنْفُسَكُمْ إِنَّ اللهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا- ‘তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি অতিশয় দয়ালু’ (নিসা ৪/২৯)। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হেসে দিলেন এবং আমাকে কোন কিছু বললেন না’।[16] তবে যদি কারো পক্ষে গরম পানি সংগ্রহ করা সম্ভব হয় কিংবা গরম করার ব্যবস্থা থাকে, তাহ’লে সেটা করা তার জন্য আবশ্যক।
শীতকালে ওযূর সময় মোযার উপর মাসাহ করার বিধান :
শীতের মৌসুমে অধিকাংশ সময় মোযা পরিহিত অবস্থায় থাকার প্রয়োজন হয়। ওযূর সময় পা ধৌত করার পরিবর্তে মাসাহ করা বান্দার জন্য আল্লাহর এক বিশেষ অনুগ্রহ। তাই চামড়ার বা কাপড়ের মোযার ওপরে মাসাহ করা যাবে (বুখারী হা/২০৬)। ছাহাবীগণ অনেকেই কাপড়ের তৈরী মোযা পরিধান করতেন আর তার উপর তাঁরা মাসাহ করতেন। মুক্বীম অবস্থায় একদিন একরাত ও মুসাফির অবস্থায় তিনদিন তিনরাত একটানা মোযার উপরে মাসাহ করা চলবে, যতক্ষণ না গোসল ফরয হয় অথবা মোযা খুলে ফেলা হয়।[17] তবে অবশ্যই ওযূ অবস্থায় মোযা পরতে হবে।
পরিশেষে শীত মওসুম মুমিনের জন্য আমলের বসন্তকাল। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে বলব, বছর বিশেষত শীতকালে অধিকহারে ইবাদত-বন্দেগী করার তাওফীক দান করুন-আমীন!
ড. ইহসান ইলাহী যহীর
প্রিন্সিপাল, মারকাযুস সুন্নাহ আস-সালাফী, পূর্বাচল, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।
[1]. বুখারী হা/৩২৬০; মুসলিম হা/৬১৭; মিশকাত হা/৫৬৭২।
[2]. শামসুদ্দীন আস-সাখাবী, আল-মাক্বাছিদুল হাসানাহ, (বৈরূত : দারুল কুতুবিল আরাবী, ১ম প্রকাশ ১৪০৫হিঃ/১৯৮৫খ্রীঃ), পৃঃ ৪০৩; জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী, জামেঊল আহাদীছ, ১৯/৪১৩।
[3]. ইবনু আবীদ দুনিয়া, আত-তাহাজ্জুদ ওয়া ক্বিয়ামুল লায়ল, পৃঃ ৪৩২।
[4]. তিরমিযী হা/৩৫৪৯; মিশকাত হা/১২২৭।
[5]. তিরমিযী হা/৭৯৭; ছহীহাহ হা/১৯২২।
[6]. মুসলিম হা/৬৫৭।
[7]. তিরমিযী হা/২১৬৪; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৩৩৮।
[8]. মুসলিম হা/৬৫৬; তিরমিযী হা/২২১; ছহীহ ইবনু হিববান হা/২০৬০; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৩৪১; মিশকাত হা/৬৩০।
[9]. মুসলিম হা/৬৩৪; আবূদাঊদ হা/৪২৭; ছহীহুল জামে‘ হা/৫২২৮।
[10]. বুখারী হা/৫৭৪; মুসলিম হা/৬৩৫; মিশকাত হা/৬২৫।
[11]. মুসলিম হা/২৫১; মিশকাত হা/২৮২।
[12]. শরহ নববী ৩/১৪১ পৃ.।
[13]. ইবনু রজব হাম্বলী, লাত্বাইফুল মা‘আরিফ, (দারু ইবনু হাযম, ১ম প্রকাশ, ১৪২৪হিঃ/২০০৪ খ্রীঃ), পৃঃ ৩২৭।
[14]. আবুদাঊদ হা/৪৯৪১; তিরমিযী হা/১৯২৪; মিশকাত হা/৪৯৬৯।
[15]. বুখারী হা/৭৩৭৬; মুসলিম হা/২৩১৯; মিশকাত হা/৪৯৪৭।
[16]. আবুদাঊদ হা/৩৩৪।
[17]. মুসলিম হা/২৭৬; নাসাঈ হা/১২৭; তিরমিযী হা/৯৬; মিশকাত হা/৫১৭, ৫২০।