আল্লাহ তা‘আলার আদেশ-নিষেধ পরিপন্থী কোন কাজ করাই মূলত গোনাহ। গোনাহের মধ্যে ছোট ও বড় দু’রকমের গোনাহ রয়েছে। ছোট গোনাহসমূহ বিভিন্ন সৎআমলের মাধ্যমে ক্ষমা পাওয়া যায়। কিন্তু বড় গোনাহসমূহ তওবা ব্যতীত ক্ষমা পাওয়ার কোন সুযোগ নেই। অথচ আমরা প্রতিনিয়ত ছোট-বড় নানা ধরনের গোনাহে লিপ্ত হয়ে পড়ছি। ছোট ছোট গোনাহগুলো বারবার করার ফলে তা বড় গোনাহে পরিণত হচ্ছে। আবার অনেক বড় বড় গোনাহকে আমরা তুচ্ছজ্ঞান করে সামান্য মনে করে অবলীলায় তাতে লিপ্ত হচ্ছি। অথচ এর জন্য আমাদের মনে কোন অনুশোচনারও উদ্রেক হচ্ছে না। ফলে আমরা ইস্তেগফার করারও প্রয়োজনবোধ করছি না।
একবার ভেবে দেখুন তো! পরিণতি সম্পর্কে জানা-বুঝার পরও গীবত, হিংসা-বিদ্বেষ, আমানতের খেয়ানত, পিতা-মাতার অবাধ্যতা, মিথ্যা বলা, পরনারীর প্রতি দৃষ্টিপাত ও অন্যের মর্যাদাহানির মত গোনাহগুলো থেকে আমরা কয়জন বেঁচে থাকতে পারছি! কয়জন এগুলোকে পাপকর্ম হিসাবে মূল্যায়ন করছি? এসব পাপে লিপ্ত হওয়ার পর আমাদের মধ্যে কোন অনুশোচনার উদ্রেক হচ্ছে কি? হয়ত হচ্ছে। কিন্তু তা খুব সামান্যই।
অকারণে জামা‘আত পরিত্যাগ করে ঘরে ছালাত আদায় করছি। আর ভাবছি.. অনেকে তো ছালাতই আদায় করে না। আমি তো অন্তত আদায় করছি। অবলীলায় গীবত করছি আর ভাবছি.. এতে তেমন কোন গোনাহ হবে না! পাপপূর্ণ দৃশ্য দেখছি আর ভাবছি.. জীবনে তো কত গোনাহই করলাম। এটা আর এমন কি! নিশ্চয়ই আল্লাহ মাফ করে দিবেন।
এভাবেই ঈমানী দুর্বলতা, আল্লাহভীতির অভাব এবং পরকালীন জবাবদিহিতার ব্যাপারে অসচেতনতা ও অবহেলার কারণে আমরা আমাদের পাপগুলোকে প্রতিনিয়তই তুচ্ছজ্ঞান করে চলেছি।
অথচ ছোট ছোট গোনাহের ব্যাপারেই রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে বারবার সতর্ক করেছেন। যেমন এক হাদীছে তিনি বলেন,إِيَّاكُمْ وَمُحَقَّرَاتِ الذُّنُوبِ ... وَإِنَّ مُحَقَّرَاتِ الذُّنُوبِ مَتَى يُؤْخَذْ بِهَا صَاحِبُهَا تُهْلِكْهُ، ‘তোমরা ছোট ছোট তুচ্ছ পাপ থেকেও দূরে থেকো। ছোট ছোট গোনাহগুলোর উদাহরণ ঐ লোকদের মতো, যারা কোন খোলা প্রান্তরে উপনীত হ’ল এবং তাদের প্রত্যেকেই কিছু কিছু করে লাকড়ি সংগ্রহ করে নিয়ে এলো। শেষ পর্যন্ত তারা ঐ পরিমাণ লাকড়ি সংগ্রহ করল যা দিয়ে তাদের খাবার পাকানো সম্পন্ন হ’ল। ছোট ছোট তুচ্ছ পাপের পাপীকে যখন ধরা হবে তখন তা তাকে ধ্বংস করে ছাড়বে’।[1]
তিনি বলেন, ‘তোমরা নগণ্য ছোট ছোট গোনাহ থেকে সাবধান হও; কেননা সেগুলো মানুষের কাঁধে জমা হ’তে থাকে অতঃপর তাকে ধ্বংস করে দেয়’।[2]
গোনাহকে অবজ্ঞা করার মূল কারণ ঈমানী দুর্বলতা। ঈমানী দুর্বলতার কারণে বড় বড় পাপকেও নগণ্য মনে হয়। অন্যদিকে ঈমান যখন শক্তিশালী হয়, তখন সে তখন সামান্য পরিমাণ গোনাহ নিয়েও চিন্তিত হয়ে পড়ে, নিজেকে ধ্বংসে নিপতিত জ্ঞান করে, প্রতিনিয়ত তওবা করে এবং আগামীতে এরূপ গোনাহ থেকে দূরে থাকার দৃঢ় সংকল্প করে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ الْمُؤْمِنَ يَرَى ذُنُوبَهُ كَأَنَّهُ قَاعِدٌ تَحْتَ جَبَلٍ يَخَافُ أَنْ يَقَعَ عَلَيْهِ، وَإِنَّ الْفَاجِرَ يَرَى ذُنُوبَهُ كَذُبَابٍ مَرَّ عَلَى أَنْفِهِ ‘একজন ঈমানদার ব্যক্তি তার গোনাহগুলোকে এত বড় মনে করে, যেন সে একটা পর্বতের নীচে উপবিষ্ট আছে, আর সে আশঙ্কা করছে যে, সম্ভবত পর্বতটা তার উপর ধ্বসে পড়বে। আর পাপিষ্ঠ ব্যক্তি স্বীয় গোনাহগুলোকে মাছির মত মনে করে, যা তার নাকের উপর দিয়ে চলে যায়’।[3]
ছাহাবায়ে কেরাম যেকোন গোনাহকেই ধ্বংসাত্মক মনে করতেন। আনাস (রাঃ) বলেন, ‘তোমরা এমন সব (গোনাহের) কাজ করে থাক, যা তোমাদের দৃষ্টিতে চুল থেকেও সূক্ষ্ম মনে হয়। কিন্তু নবী করীম (ছাঃ)-এর যামানায় আমরা এগুলোকেই ধ্বংসাত্মক মনে করতাম’।[4]
সামান্য কোন পাপ করে ফেললেও তা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তারা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতেন। যেমন আবুবকর (রাঃ) একবার রাবী‘আহ (রাঃ)-এর সাথে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন এবং একপর্যায়ে তাকে একটা অপসন্দনীয় কথা বলে ফেলেন। অতঃপর তিনি অনুতপ্ত হয়ে বললেন, হে রাবী‘আহ! তুমি অনুরূপ কথা বলে প্রতিশোধ নিয়ে নাও, যাতে তা আমার কথার ক্বিছাছ হয়ে যায়। কিন্তু রবী‘আহ আবুবকর (রাঃ)-এর উচ্চ মর্যাদার কথা ভেবে অনুরূপ কথা বলতে অস্বীকৃতি জানালেন। আবুবকর (রাঃ) বললেন, তোমাকে অবশ্যই বলতে হবে নতুবা তোমার বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করব।
অতঃপর তিনি পুরো ঘটনা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জানালে তিনি রবী‘আহকে বললেন, তুমি অনুরূপ বলবে না। বরং বলবে, হে আবুবকর! আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করে দিন। রাসূল (ছাঃ)-এর এ নির্দেশনা শুনে আবুবকর (রাঃ) ক্রন্দনরত অবস্থায় ফিরে গেলেন।[5]
অতএব হে পাঠক! আমরা সতর্ক হই ক্বিয়ামতের সেই ভয়াবহ দিনটির ব্যাপারে, যেদিন বান্দা অণু পরিমাণ নেকীর কাজ করলেও তা দেখতে পাবে, অণু পরিমাণ গোনাহের কাজ করলেও তা দেখতে পাবে (যিলযাল ৯৯/৭-৮)। তাই জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে আমাদেরকে ছোট-বড় সকল গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। আত্মসমালোচনা অব্যাহত রাখতে হবে। শয়তানী ওয়াসওয়াসায় কখনো গোনাহে লিপ্ত হয়ে পড়লে দেরী না করে সাথে সাথে তওবা করতে হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘নিশ্চয়ই বামের ফেরেশতা পাপী মুসলিমের উপর থেকে ছয় ঘণ্টা কলম তুলে রাখেন। অতঃপর সে যদি পাপে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হয়, তাহ’লে তা উপেক্ষা করেন। নচেৎ একটি পাপ লেখা হয়।[6] অতএব সর্বদা গোনাহ থেকে বাঁচার জন্য আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করি এবং প্রতিনিয়ত তওবা ও ইস্তিগফারের মাধ্যমে নিজেকে পবিত্র রাখি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন!
[1]. আহমাদ, ছহীহাহ হা/৩৮৯।
[2]. আহমাদ, ছহীহুত তারগীব হা/২৪৭০।
[3]. বুখারী হা/৬৩০৮; মিশকাত হা/২৩৫৮।
[4]. বুখারী হা/৬৪৯২; মিশকাত হা/৫৩৫৫।
[5]. আহমাদ, ছহীহাহ হা/৩২৫৮।
[6]. ত্বাবারাণী, ছহীহাহ হা/১২০৯।