১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা
লাভের পর বিগত ৭৪ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে জটিল অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে হাবুডুবু
খাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে অগ্রসর অর্থনীতির দেশ শ্রীলংকা। যেখানে
মাথাপিছু জিডিপি ছিল ৪ হাযার ডলারের বেশী। যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ।
তাদের ৯৫ শতাংশ মানুষ শিক্ষিত। তাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও দক্ষিণ এশিয়ায়
সেরা। দক্ষিণ এশিয়ার পর্যটন আকর্ষণের বড় ঠিকানাও ছিল শ্রীলংকা। ২০১৯ সালে
দেশটি উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়। অথচ বছরখানেক ধরে দেশটির অর্থনীতি
কঠিন সংকটে ক্রমে তলিয়ে যাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একেবারে তলানিতে
পৌঁছে যাওয়ায় বিদেশ থেকে খাদ্যদ্রব্য আমদানী করে সংকট মোকাবেলার সামর্থ্য
এখন তাদের নেই বললেই চলে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ক্রমবর্ধমান ঘাটতি
জনজীবনে অভূতপূর্ব বিপর্যয় ডেকে এনেছে।
দীর্ঘ ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধ শেষে ২০০৯ সাল থেকে দেশটি দ্রুত ক্রমোন্নতির পথে ছিল। এমনকি উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ হিসাবে পরিচিতি পেয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে দেশটি ঋণ খেলাপী ও দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। এর কারণ সেদেশের সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উচ্চাভিলাষী মেগা প্রকল্প ও অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত সমূহ। যেমন (১) প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে জনতুষ্টিবাদী পদক্ষেপ নিতে গিয়ে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশ ধার্য করেন। একইসঙ্গে ২ শতাংশ হারের জাতীয় উন্নয়ন কর ব্যবস্থা বিলুপ্ত করেন। ফলে এক বছরেই দেশটির ভ্যাট আদায় কমে যায় প্রায় ৫০ শতাংশ। (২) ২০১৯ সালে কলম্বোর ৩টি হোটেল ও ৩টি গীর্জায় আকস্মিক বোমা বিস্ফোরণে ২৫৩ জন নিহত হয় ও বহু মানুষ আহত ও পঙ্গু হয়। ফলে দেশটির পর্যটন খাতে ধস নামে। যার অবদান তাদের জিডিপিতে ১০ শতাংশ। (৩) প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স অভূতপূর্বভাবে হ্রাস পায়। (৪) এরপরেই ২০২০ সালে শুরু হয় কোভিড সংক্রমণ। পরপর দু’বছর প্রবাসী আয়, পর্যটন ও রফতানী আয় সবকিছু হ্রাস পায়। অথচ অর্থনীতিতে প্রণোদনা খরচ বেড়ে যায়। ফলে বাজেট ঘাটতি বেড়ে ১০ শতাংশে দাঁড়ায়। (৫) ২০২১ সালের মে মাসে অর্গানিক সারের লবিস্ট গ্রুপের পরামর্শে সরকার রাসায়নিক সার আমদানী নিষিদ্ধ করে। ফলে ফসল উৎপাদন চরমভাবে হ্রাস পায়। দেশের দু’টি প্রধান রফতানী পণ্য এলাচি ও দারুচিনি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। (৬) হাম্বানটোটা গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের জন্য চীনের কাছ থেকে উচ্চ সূদহারে ১৫ বছরের জন্য বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ঋণ নেয় ৩০ কোটি ৭০ লাখ ডলার। এই মেগা প্রকল্প থেকে আয় হয় অতি সামান্য। যা ঋণ পরিশোধের জন্য যথেষ্ঠ ছিলনা। অবশেষে চীনের কাছেই বন্দরটি স্থায়ীভাবে লীজ দিতে হয় ৯৯ বছরের জন্য। অর্থাৎ এটি এখন চীনের মালিকানাধীন। (৭) কলম্বো সমুদ্র বন্দরের সন্নিকটে মেগা প্রকল্প চায়নিজ সিটি নির্মাণ। (৮) জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে রাজাপাকসে বিমানবন্দর নির্মাণ। যেগুলি ছিল মূলতঃ অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী প্রকল্প। এসবের জন্য ‘আন্তর্জাতিক সভরেন বন্ডে’র মাধ্যমে শ্রীলংকা প্রচুর বৈদেশিক ঋণ সংগ্রহ করেছিল। যেগুলির ম্যাচিউরিটি শুরু হচ্ছে ২০২২ সাল থেকে। কিন্তু এখন সূদাসলে ঐ বন্ডের অর্থ ফেরৎ দেওয়ার সামর্থ্য শ্রীলংকার নেই। ফলে নিজেদেরকে ঋণ পরিশোধে অপারগ ঘোষণা করে আইএমএফ ও বিশ্ব ব্যাংকের কাছে ‘রেসকিউ প্যাকেজ বা বেইলআউট প্যাকেজে’র জন্য হাত পাতা ছাড়া এখন তার অন্য কোন পথ খোলা নেই।
২০০৯ সালে শ্রীলংকার তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ও সদ্য পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে শ্রীলংকার গৃহযুদ্ধে ভারতের ভূমিকার কারণে ভারত থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়তে শুরু করেন। চীনও শ্রীলংকার ভূরাজনৈতিক অবস্থানের গুরুত্বের বিবেচনায় দেশটিকে নিজেদের প্রভাব বলয়ে নেওয়ার জন্য বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) আওতায় শ্রীলংকাকে পূর্বে বর্ণিত মেগা প্রকল্প সমূহে ঋণ দেয়। এভাবে একদিকে চীনের ঋণের ফাঁদ, অন্যদিকে ভারতীয় চক্রান্ত এবং বর্তমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দেশটিকে দেউলিয়া অবস্থায় নিয়ে এসেছে।
কথায় বলে ‘ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়’। বার্লিন ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত টানা পাঁচ বছর দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ছিল। এর মধ্যে ২০০১ সাল ছিল আওয়ামী লীগ জোট সরকারের শেষ বছর এবং ২০০২ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামল। ২০২১ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তানের পরে বাংলাদেশ এখন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। এখানে কোন রাজনৈতিক সংকট নেই। তবে রয়েছে অনেকগুলি জনতুষ্টিবাদী মেগা প্রকল্প। যেমন (১) ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার বুলেট ট্রেন প্রকল্প। ৬ বছর পূর্বে ঘোষিত হ’লেও বর্তমানে এটি স্থগিত (২) কক্সবাজার থেকে রামু ১২ হাযার কোটি টাকা ব্যয়ে রেল লাইন প্রকল্প। যেটা অপ্রয়োজনীয় ও অলাভজনক (৩) প্রস্তাবিত দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। অথচ ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশের জন্য কোনরূপ পারমাণবিক প্রকল্প গ্রহণ করা সমীচীন নয়। (৪) পূর্বাচলে ১১০ তলাবিশিষ্ট বঙ্গবন্ধু বহুতল ভবন কমপ্লেক্স। (৫) শরীয়তপুরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। (৬) পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া দ্বিতীয় পদ্মা সেতু। বরং এখানে নদীর তল দিয়ে টানেল নির্মাণ করা যুক্তিযুক্ত ও লাভজনক (৭) নোয়াখালী বিমানবন্দর। (৮) দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রকল্প। অথচ প্রথমটির এক-তৃতীয়াংশ ক্যাপাসিটিও আমরা ব্যবহার করতে সক্ষম হইনি (৯) ঢাকার বাইরে রাজধানী স্থানান্তর প্রকল্প। বরং মূল রাজধানী ঠিক রেখে চারপাশে চারটি ‘নিউ ঢাকা’ স্থাপন করা যেতে পারে (১০) সৈয়দপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রকল্প। (১১) পদ্মা সেতুর উপরে রেল লাইন প্রকল্প। যার ব্যয় উক্ত সেতু নির্মাণের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। অথচ লাভ অতি সামান্য (১২) পটুয়াখালীতে নির্মিত কয়লা ভিত্তিক পায়রা তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্প। যা কয়েক হাযার কোটি টাকা ব্যয়ের পর এখন বাতিল করা হয়েছে। অথচ শুরুতেই বিশেষজ্ঞগণ এথেকে নিষেধ করেছিলেন (১৩) মাতারবাড়ী কয়লা ও এলএনজি ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। যা ৬ হাযার ৭০০ মানুষের অকাল মৃত্যু ডেকে আনবে (১৪) রাশিয়া কর্তৃক নির্মিতব্য রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। যা বাংলাদেশের সবচাইতে বড় প্রকল্প। অথচ রাশিয়া তার চেরনোবিল এবং জাপান তার ফুকুশিমা পারমাণবিক চুল্লী বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। (১৫) দেশব্যাপী মহাসড়ক গুলি ফোর লেনে পরিণত করার প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণ কর্মসূচী। যা দুর্নীতির একটি বিশাল ক্ষেত্র। (১৬) বাগেরহাটের রামপাল তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্প। যা শুরুতেই পরিত্যক্ত হওয়া উচিৎ ছিল। অথচ পরিবেশবান্ধব সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করার প্রয়োজন ছিল সর্বাধিক। যা বঙ্গোপসাগরের উপকূল জুড়ে এবং নদীগুলির দুই পাড় বরাবর ও দেশের বাড়ী-ঘর সমূহের ছাদে স্থাপন করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এরপরেও কর্ণফুলী নদীর উভয় পার্শ্বে চট্টগ্রাম বন্দর সম্প্রসারণ করা আবশ্যক।
মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশের অর্থনীতি পোষাক রফতানী ও প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্সের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। এ দু’টি খাতে এবং কৃষি খাতে ধস নামলে আমাদের অর্থনীতি মহাসংকটে পড়বে। সবশেষে আমাদের প্রস্তাব : সর্বাগ্রে প্রশাসনকে ঘুষ ও দুর্নীতিমুক্ত করুন। অতঃপর দেশী-বিদেশী সকল প্রকার সূদী ঋণের ফাঁদ থেকে মুক্ত হয়ে নিজস্ব অর্থায়নে যতটুকু সম্ভব ততটুকু উন্নয়ন করুন! আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন! (স.স.)।