ঢাকা থেকে
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলকে বিভক্ত করা পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে একটি সেতু
তৈরীর পরিকল্পনা কখন শুরু হয়, এ প্রসঙ্গে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে ‘বিশেষজ্ঞ
কমিটি’র সদস্য বুয়েটের এমেরিটাস প্রফেসর আইনুন নিশাত বলেন, পদ্মা সেতুর
প্রাক্-সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয়েছিল আশির দশকে যমুনা সেতুর সঙ্গেই’ (প্রথম আলো ২৫শে জুন ২০২২)।
পরে শেখ হাসিনার আমলে ১৯৯৯ সালের মে মাসে সেতু প্রকল্পের জন্য
প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয়। এর মাধ্যমে সেতু নির্মাণ কেন দরকার, কী
সুবিধা হবে, নির্মাণ ব্যয় কেমন হ’তে পারে ইত্যাদি বিষয় যাচাই করে দেখা হয়।
অতঃপর ২০০১ সালের ৪ঠা জুলাই সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা। অতঃপর একই বছর ১০ই অক্টোবর বিএনপি ক্ষমতায় এলে কাজ থেমে যায়।
এরপর ২০০৭ সালে ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসে ২৮শে
আগস্ট ১০ হাযার ১৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে মূল পদ্মা সেতু প্রকল্প পাস করা হয়।
২০০৯ সালের ৬ই জানুয়ারী ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা পূর্বের নকশা পরিবর্তন করে
সেতুর সাথে রেল, গ্যাস, পানি, নদী শাসন ও অ্যাপ্রোচ সড়ক সহ ‘পদ্মা বহুমুখী
সেতু প্রকল্প’ গ্রহণ করেন এবং একে অগ্রাধিকার তালিকায় নিয়ে আসেন। অতঃপর
১৯শে জুন সেতুর নকশা প্রণয়নের প্রস্তাব মন্ত্রীসভায় অনুমোদিত হয়। যেখানে
২০১৩ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার সময় নির্ধারণ করা হয়।
সেতু বাস্তবায়নে প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে ১১ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি সেতুর নকশা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন পর্যায়ে প্রকল্প কর্মকর্তা, নকশা পরামর্শক ও উন্নয়ন সহযোগীদের বিশেষজ্ঞ পরামর্শ প্রদান করে। ২০২০ সালের ২৮শে এপ্রিল রেজা চৌধুরীর মৃত্যুর পর এই কমিটির প্রধান হন বিশিষ্ট অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ প্রফেসর শামীম জেড বসুনিয়া। এই কমিটিতে আরও আছেন নদী বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের এমিরেটাস প্রফেসর আইনুন নিশাত, পরিবেশ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ফিরোজ আহমেদ ও পাইলিং বিশেষজ্ঞ প্রফেসর হোসাইন মুহাম্মাদ শাহীন প্রমুখ।
বাধা-বিপত্তি : শুরুতে ২০১১ সালের ২৮শে এপ্রিল বিশ্ব ব্যাংকের সাথে ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। একই বছরে এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকা, আইডিবি ও এডিবি এই সেতুর অর্থায়নে যুক্ত হয়। কিন্তু ২০০৮-০৯ সালে প্রকল্প প্রস্ত্ততির সাথে যুক্ত কিছু লোকের দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় বিশ্বব্যাংক অর্থ ছাড় বন্ধ করে দেয়। অতঃপর ২০১২ সালের ২৯শে জুলাই আনুষ্ঠানিক ভাবে তারা ঋণচুক্তি বাতিল করে। তখন অন্যান্য দাতারাও সেটির অনুসরণ করে। এ সময় প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী সরকারকে আশ্বস্ত করে বলেন, আমরা যমুনা সেতু করেছি। ইঞ্জিনিয়ারিং দিকটা বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞ প্যানেল সুষ্ঠুভাবে সামলাতে পারবে। আপনারা অর্থের দিকটা দেখুন’ (প্রথম আলো ২৪শে জুন ৮ম পৃ.)।
উপরোক্ত ঘটনায় তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে মন্ত্রীসভা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় ও সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে জেলে পাঠানো হয়। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় কানাডীয় আদালত মামলাটি খারিজ করে দেয়। তখন বিশ্বব্যাংক পুনরায় অর্থায়নে ফিরে আসতে চাইলেও সরকার সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এবং নিজস্ব অর্থায়নে করার সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অনৈতিকভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে থাকতে না পেরে নোবেল জয়ী অধ্যাপক ড. ইউনুস পদ্মা সেতু নিয়ে সরকারকে চাপে ফেলতে চক্রান্তের আশ্রয় নেন। এমনকি তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে দিয়ে শেখ হাসিনাকে ফোনও করান। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল সহ অনেকে নানা নেতিবাচক মন্তব্য করেন। ২০১৯ সালে পদ্মা সেতুর জন্য শিশুদের ‘কাটা মাথা’ লাগবে বলে গুজব ছড়ানো হয়। এ নিয়ে নেত্রকোনার একটি ঘটনা পত্রিকায় আসে। ফলে বরগুনা সহ পুরা দক্ষিণাঞ্চলে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
সেতুর শুরু ও শেষ :
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ২০১৭ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটিতে প্রথম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয় পদ্মা সেতু। এরপর একে একে ৪২টি পিলারে ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৪১টি স্প্যান বসিয়ে ৬.১৫ কি.মি. দীর্ঘ সেতুটি পুরোপুরি দৃশ্যমান হয় ২০২০ সালের ১০ই ডিসেম্বর।
সেতুর তত্ত্বাবধানে ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বুয়েট এবং কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশন (কেইসি)। মূল সেতু নির্মাণের জন্য কাজ করেছে চীনের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানী (এমবিইসি)। আর নদীশাসনের কাজ করেছে দেশটির আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন। দু’টি সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ করেছে বাংলাদেশের আবদুল মোনেম লিমিটেড। এ প্রকল্পে কাজ করেছেন ৩ হাযার নির্মাণ শ্রমিক সহ প্রায় ৪ হাযার শ্রমিক।
নির্মাণ ব্যয় :
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুসারে সেতু নির্মাণে মোট ব্যয় হয়েছে ৩০ হাযার কোটি টাকারও বেশী। তবে মূল সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১২ হাযার ১০০ কোটি টাকা। নদী শাসনে ব্যয় হয়েছে ৯ হাযার ৪০০ কোটি টাকা। ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনে ব্যয় হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ হাযার কোটি টাকা। এখানে ৮০ হাযারের বেশী লোককে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। এ বিষয়ে কারও কাছ থেকে কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি।
সেতুর পাশ দিয়ে ৪০০ কেভি বিদ্যুৎ লাইন বসাতে খরচ ১ হাযার কোটি টাকা। মূল সেতুর রেললাইনের পাশ দিয়ে গ্যাস লাইন নির্মাণে খরচ হয়েছে ৩০০ কোটি টাকা। কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালটেন্সির জন্য ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। এছাড়া পদ্মা সেতুকে দুই অংশের মূল সড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করতে নির্মিত হয়েছে মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে প্রায় ২৭ কি.মি. সংযোগ সড়ক। যা নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় দেড় হাযার কোটি টাকা।
রেল পথ চালু হবে কবে?
পদ্মা সেতুতে রেল পথ নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। এ পর্যন্ত অর্ধেকের বেশী কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ট্রেন চলাচল শুরু হবে ২০২৩ সালের ২৫শে জুন তারিখে। রেলওয়ে সূত্র জানায়, ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে রেলপথ যাবে যশোরে। এই রেলপথের মোট দৈর্ঘ্য হবে ১৬৯ কি.মি.। এর মধ্যে ২৩ কি.মি. হবে পুরোপুরি এলিভেটেড (উড়াল)। যশোর পর্যন্ত রেলপথের কোথাও থাকবে না কোন লেভেল ক্রসিং। এতে সময় বাঁচবে, ঘটবে না দুর্ঘটনা। দেশে উড়াল ও ক্রসিংবিহীন প্রথম রেলপথ হ’তে চলেছে এটি।
ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপযেলা পর্যন্ত ৮২ কিলোমিটার রেলপথ ২০২৩ সালের জুন মাসে খুলে দিতে কাজ চলছে। ২০২৪ সালে পুরো কাজ শেষ হবে। প্রকল্পের মোট ব্যয় হবে ৪০ হাযার ৪২৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে চীন ঋণ দিবে ২১ হাযার কোটি টাকা এবং বাকী অর্থ দেবে সরকার।
স্থাপত্যশৈলীর যেসব অনন্য রেকর্ডের অধিকারী পদ্মা সেতু
খরস্রোতা পদ্মার বুক চিরে দাঁড়ানো পদ্মা সেতু কেবল নদীর দুই পাড়কেই এক করেনি, স্থাপত্যশৈলীতেও অনন্য নযীর স্থাপন করেছে। ভার বহন ক্ষমতা, দুর্যোগ সহনশীলতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন দিক দিয়ে পদ্মা সেতু একের পর এক রেকর্ডে পেছনে ফেলেছে বিশ্বের বড় বড় সেতুকে। এর তলদেশে রয়েছে ৪২ তলা ভবন সমান কাঠামো, যা বিশ্বে প্রথম।
সেতু সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, খরস্রোতা পদ্মায় প্রতি সেকেন্ডে ১ লাখ ৪০ হাযার ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়। এমন দ্রুত গতির পানিপ্রবাহ কেবল বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদীতেই আছে। এ কারণে পদ্মায় সেতু নির্মাণ ছিল অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ ও বিস্ময়কর। পদ্মার তলদেশ এত দ্রুত পরিবর্তনশীল, যে কোন মুহূর্তে গভীর স্রোতে এবং ভূমিকম্প হ’লে ২১০ ফুট তথা ২১ তলা ভবন সমান গভীর খাদ তৈরী হ’তে পারে। ফলে ধসে পড়তে পারে সেতু। এ চ্যালেঞ্জ জয় করেই পদ্মার ওপর দাঁড়িয়েছে রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল সেতু। পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চেয়ারম্যান, বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ও বিশিষ্ট অবকাঠামো প্রকৌশলী অধ্যাপক শামীম জেড বসুনিয়া বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে সর্বোচ্চ মান নিশ্চিতের চেষ্টা আর কারিগরি চ্যালেঞ্জ সামলাতে গিয়ে বিশ্বের সামনে বেশকিছু নযীর স্থাপন করেছে বাংলাদেশ।
পাইলিং : সেতুকে টেকসই করতে নদীর অংশের খুঁটির নিচে চীন থেকে আনা তিন মিটার ব্যাসার্ধের ১২২ মিটার গভীর পর্যন্ত ইস্পাতের পাইল বসানো হয়েছে, যা ৪০ তলা ভবনের সমান। বিশ্বে এত গভীরে ও মোটা পাইল কোন সেতুতে বসানো হয়নি। প্রতিটি পিলারে বসেছে ৬টি পাইল। পাইলের মাথায় মাটি নরম থাকায় ২২টি পিয়ারে পাইল দেওয়া হয়েছে ৭টি করে। কিছু জায়গায় সবচেয়ে বেশী দৈর্ঘ্যের পাইল দিয়েও মাটির নিচে শক্ত স্তর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে স্কিন গ্রাউটিং প্রযুক্তির মাধ্যমে বসানো হয় এসব পাইল, যে প্রযুক্তি বিশ্বের কোথাও প্রয়োগ হয়নি, এমনকি কোন পাঠ্যবইয়েও নেই।
কংক্রিট ও স্টিল : পৃথিবীতে এই প্রথম কোন সেতু নির্মাণে কংক্রিট এবং স্টিল উভয়টিই ব্যবহৃত হয়েছে, যা সেতুকে করে তুলেছে কয়েক গুণ শক্তিশালী। বিশ্বের অন্যান্য সেতুগুলো হয় কংক্রিটে নির্মিত, না হয় স্টিলে।
সবচেয়ে বড় বিয়ারিং : ভূমিকম্প প্রতিরোধে পদ্মা সেতুতে ব্যবহার করা হয়েছে সবচেয়ে বড় ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং। একেকটি বিয়ারিংয়ের ওযন ধারণক্ষমতা ১০ হাযার ৫০০ মেট্রিক টন। এর আগে পৃথিবীতে কোন সেতুতে এমন উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়নি। রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে টিকে থাকার মতো সক্ষমতা রয়েছে এ সেতুর। বিয়ারিংগুলো চীনের চৌহানে ভূমিকম্প পরীক্ষার পর ফের পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া হয় যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
সেতু রক্ষায় নদীশাসন : পদ্মার জন্য এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এজন্য যে, ১০০ বছরে নদীর পাড় ভাঙতে ভাঙতে যদি নদীটাই সেতুর বাইরে চলে যায়, তাহ’লে তো সেতুই ব্যর্থ হয়ে যাবে। সেকারণ সেতুর দুই পাশে নদীর তীর এমন মযবূত করা হয়েছে, যেন সহজে তীর না ভাঙে। একেই বলা হয় নদীশাসন। এজন্য সেতুর দুই পাশে নদীর ঢালে ১৪ কিলোমিটার এলাকাব্যাপী একেকটি ৮০০ কেজি ওযনের প্রায় ২ কোটি ১৭ লাখ জিও ব্যাগ ব্যবহার করা হয়েছে। পাথর ফেলা হয়েছে প্রায় সোয়া ১০ লাখ ঘনমিটার। নদীর তলদেশে ঢাল তৈরির জন্য ভারতের ঝাড়খন্ড থেকে আনা একেকটি ১ টন ওযনের পাথর। সবমিলিয়ে নদী শাসনে ব্যয় হয়েছে ৯ হাযার ৪০০ কোটি টাকা, যা এ কাজে পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল। এছাড়া সেতুর জন্য ১৪ কিলোমিটার নদীশাসন আর কোথাও নেই। এত গভীরে নদীশাসনও কোথাও হয়নি।
সর্ববৃহৎ ক্রেন : পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রেন ব্যবহার করা হয়েছে, যার ওযন ৪ হাযার টন। বিশ্বে প্রথম কোন সেতু তৈরিতে এত দীর্ঘ সময়ের জন্য ক্রেনটি চীন দেশ থেকে ভাড়ায় আনা হয়েছে। ক্রেনটির দাম আড়াই হাযার কোটি টাকা।
সবচেয়ে বড় হ্যামার : এই সেতুতে সাড়ে ৩ হাযার টন ওযনের পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হ্যামার ব্যবহার হয়েছে।
অধ্যাপক শামীম জেড বসুনিয়া বলেন, এক বছরে ২৫-৩০ ফুট পলি জমে পদ্মায়। সে কারণে নৌযান চলতে পানি থেকে ৭০ ফুট উঁচুতে সেতু করা হয়েছে। সেতুতে ব্যবহার করা কংক্রিটের অধিকাংশই আনা হয়েছে ভারত, ভুটান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। বিশেষ কিছু রড আনা হয়েছে চীন থেকে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাজ্য থেকে অ্যালুমিনিয়াম আনা হয়েছে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের নির্বাহী পরিচালক দেওয়ান মোহাম্মদ আব্দুল কাদের বলেন, পদ্মার নীচের মাটি খুবই নরম। তাছাড়া খরস্রোতা নদী হওয়ায় নীচের মাটি সরে যায় প্রতিনিয়ত। এ অবস্থায় কীভাবে এত বড় একটা অবকাঠামো দাঁড়িয়ে থাকবে, তা ঠিক করা ছিল প্রকৌশলীদের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ। আমাদের দেশের সাধারণ সিমেন্ট দিয়ে এসব পিলারের গ্রাইন্টিং তৈরি করা সম্ভব ছিল না। তাই অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানিকৃত মাইক্রো ফাইন সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে, যা অত্যন্ত মিহি এবং শক্তিশালী। এতে বস্তা প্রতি খরচ হয়েছে ১৫ হাযার টাকা।
সবমিলিয়ে এই প্রকল্পে ১০টি দেশের বিপুল উপকরণ এবং প্রায় ৫০টি দেশের কিছু না কিছু উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া এর বিভিন্ন কাজে বাংলাদেশ, চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও মালয়েশিয়া সহ ২০টি দেশের মানুষ সরাসরি যুক্ত ছিলেন।
মৎস্যশূন্যের পথে বঙ্গোপসাগর
ভয়াবহ মাত্রায় বিষিয়ে উঠছে বঙ্গোপসাগর। মাছসহ সামুদ্রিক প্রাণী ও উদ্ভিদের টিকে থাকার অনুপযোগী হয়ে উঠছে সমুদ্রের পরিবেশ-প্রকৃতি। কর্ণফুলী নদী ও বঙ্গোপসাগরের মিলিত মোহনায় চট্টগ্রাম বন্দরের নৌ-চলাচল চ্যানেলে ড্রেজিং করতে গিয়ে তলদেশে স্থানভেদে ২ থেকে ৭ ফুট পর্যন্ত পুরু প্লাস্টিক-পলিথিন ও কঠিন বর্জ্যের স্তর পাওয়া গেছে। প্লাস্টিক ও পলিথিনের মোটা আস্তর জমেছে বঙ্গোপসাগর-এর উপকূলজুড়ে। তাছাড়া বৃহত্তর চট্টগ্রাম, ঢাকা, খুলনা অঞ্চলসহ সারাদেশের হাযারো কল-কারখানার বিপুল পরিমাণ শিল্পবর্জ্য নদী-নালা-খাল হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ছে।
তেল বা পোড়া তেলের বর্জ্য, সমগ্র দেশে জমিতে ব্যবহৃত বিষাক্ত কীটনাশক, সারসহ বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য, প্লাস্টিক-পলিথিন মিলিয়ে যাবতীয় ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে বঙ্গোপসাগর। প্রতিদিনই শত শত জাহায-ট্রলার, নৌযান থেকে বর্জ্য-আবর্জনা সমুদ্রে ফেলা হচ্ছে অবাধে। যা মানুষের তৈরি সমস্যা-সঙ্কট। অথচ এর বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা কার্যত নেই। অভাব রয়েছে বিশেষায়িত সার্ভেল্যান্স জাহায ও প্রশিক্ষিত জনবলের।
সমুদ্রে ওইসব বিষাক্ত বর্জ্য মাছেরা খাদ্যের সাথে খেয়ে ফেলছে। ফলে এসব বর্জ্য উপাদান শেষ গন্তব্য হিসেবে ঢুকছে মানুষের পেটে। এতে করে নানাবিধ জটিল রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার উচ্চঝুঁকি রয়েছে মানুষের। বিজ্ঞানীগণ বলছেন, ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যাদি মিশ্রণের অব্যাহত প্রক্রিয়ার ফলে সমুদ্রের পানিতে অক্সিজেনের অভাব প্রকট হচ্ছে। গভীর সমুদ্রে তৈরি হচ্ছে ‘ডেড জোন’। এর ফলে মাছসহ জীববৈচিত্র হুমকির মুখে পড়েছে। মাছশূন্য হতে চলেছে বঙ্গোপসাগর।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেসহর প্রফেসর সমুদ্রবিজ্ঞানী সাইদুর রহমান চৌধুরী জানান, প্লাস্টিক-পলিথিন সমুদ্রের তলদেশে ঢেকে ও জেঁকে বসছে। এতে করে সাগরের তলদেশীয় মাছের বিচরণ এলাকা মাছশূন্য হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, কৃষিকাজে মাত্রাতিরিক্ত হারে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার বিশেষত ইউরিয়া সার, বিষাক্ত কীটনাশকের অর্ধেকই পানিতে ধুয়েমুছে সারাদেশের নদী-নালা-খাল-বিল হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ছে। রাসায়নিক সার, কীটনাশক দ্রব্য নিঃসরণের ফলে বঙ্গোপসাগরের পানিতে অক্সিজেন-শূন্য জোন সৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে মাছসহ পরিবেশ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র হুমকির মুখে পড়েছে। প্লাস্টিক-পলিথিন, বিষাক্ত রাসায়নিক জনস্বাস্থ্যের
প্রতি হুমকি সৃষ্টি করছে।
প্রফেসর সাইদুর জানান, এই রাসায়নিক দূষণের কারণে বঙ্গোপসাগরের বিরাট এলাকা বর্তমানে অক্সিজেন-শূন্য হয়ে পড়েছে। সেখানে মাছ টিতে থাকতে পারবে না। বঙ্গোপসাগরের কমপক্ষে ১০ ভাগ এলাকা অক্সিজেন-শূন্য। তবে এটা ২০১৬ সালের গবেষণার তথ্য। এখন যত এলাকায় ইউরিয়াসহ রাসায়নিকের দূষণ ছড়িয়ে পড়বে, অক্সিজেন-শূন্য এলাকার বিস্তার ও আয়তন ততই বেড়ে যাবে।
বিগত ২০১৮ সালে জাতিসংঘের সহায়তায় নরওয়ের সর্বাধুনিক জরিপ-গবেষণা জাহায ‘ড. ফ্রিডজফ নেনসেন-৩’-এর সাহায্যে বঙ্গোপসাগরের পরিবেশ-প্রকৃতির উপর পরিচালিত সর্বশেষ গবেষণা কার্যক্রমে দেশী-বিদেশী ৩০ জন বিজ্ঞানীর অন্যতম ছিলেন প্রফেসর সাইদুর রহমান চৌধুরী। এই গবেষণায়ও সমুদ্রে রাসায়নিক দূষণে অক্সিজেন-শূন্য জোন সৃষ্টির বিষয়টিও উঠে আসে।
বঙ্গোপসাগরের এক লাখ ১৮ হাযার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার বিস্তীর্ণ এলাকা বাংলাদেশের সমুদ্র সীমা। ক্রমাগত ভয়াবহ দূষণ, বেপরোয়া মাছ বিশেষ করে মা-মাছ নিধন, বিদেশী ট্রলার নৌযানে ব্যাপকহারে মাছ চুরি বা লোপাটের কারণে বঙ্গোপসাগরে অসংখ্য প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির মুখে কিংবা অস্তিত্ব সঙ্কটে। সমুদ্রে কয়েকদিনের ট্রিপে মাছ শিকারের জন্য গিয়ে অনেক সময়ই জেলেরা ফিরছে প্রায় খালি হাতে। সমুদ্রপাড়ের অনেক জেলে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে।
[প্রত্যেক সরকারই এসবের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা ও কর্ণফুলী আজও দূষণমুক্ত ও অবৈধ দখলদার মুক্ত হয়নি। এর উত্তর সবাই জানেন। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? যারা শপথ নিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেন, তারা শপথ ভঙ্গের প্রতিযোগিতায় সময় পার করেন। আল্লাহ আমাদের হেদায়াত দান করুন! (স.স.)]।