প্রতিষেধক মূলক ঝাড়ফুঁক ও দো‘আ :

আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,

جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ يَا رَسُولَ اللهِ مَا لَقِيتُ مِنْ عَقْرَبٍ لَدَغَتْنِى الْبَارِحَةَ قَالَ أَمَا لَوْ قُلْتَ حِيْنَ أَمْسَيْتَ أَعُوْذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ لَمْ تَضُرُّكَ إِنْ شَاءَ اللهُ-

‘এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! গত রাতে বিচ্ছুর দংশনে আমি খুবই কষ্ট পেয়েছি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, যদি তুমি সন্ধ্যায় উপনীত হয়ে বলতে ‘আঊযু বিকালিমা-তিল্লাহিত তা-ম্মাতি মিন শাররি মা-খালাক্ব’। অর্থাৎ ‘আমি আল্লাহর পূর্ণ বাক্যের মাধ্যমে আশ্রয় প্রার্থনা করছি, তিনি যা সৃষ্টি করেছেন তার অনিষ্ট হ’তে’, তাহ’লে আল্লাহর ইচ্ছায় কোন কিছুই তোমার ক্ষতি করতে পারত না’।[1]

আবান ইবনু ওছমান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আমার পিতাকে একথা বলতে শুনেছি যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি প্রত্যেক সকাল-সন্ধ্যায় তিনবার করে পড়বে,بِسْمِ اللهِ الَّذِىْ لاَ يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَىْءٌ فِى الأَرْضِ وَلاَ فِى السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ. ‘বিসমিল্লা-হিল্লাযী লা- ইয়াযূররু মা‘আসমিহী শায়উন ফিল আরযি ওয়ালা- ফিসসামা-য়ি, ওয়া হুওয়াস সামী‘উল ‘আলীম’ (অর্থাৎ আল্লাহর নামে শুরু করছি, যে নামের সাথে আসমান ও যমীনে কোন কিছুই কোন ক্ষতি করতে পারে না। তিনি সব শুনেন ও জানেন) তাহ’লে কোন কিছু তাকে ক্ষতি করতে পারবে না। বর্ণনাকারী বলেন, আবান (রাঃ) পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত ছিলেন। এজন্য যারা হাদীছ শুনছিলেন তারা তাঁর দিকে তাকাচ্ছিলেন। আবান (রাঃ) তখন বললেন, আমার দিকে কি দেখছ? নিশ্চয়ই হাদীছ যা আমি বর্ণনা করেছি তাই, তবে যেদিন আমি এ রোগে আক্রান্ত হয়েছি সেদিন এ দো‘আ পড়িনি। এ কারণে আল্লাহ আমার ভাগ্যে যা লিখে রেখেছিলেন তা কার্যকরী হয়েছে’।[2] অন্য বর্ণনায় রয়েছে,لَمْ تُصِبْهُ فَجْأَةُ بَلاَءٍ حَتَّى يُصْبِحَ وَمَنْ قَالَهَا حِيْنَ يُصْبِحُ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ لَمْ تُصِبْهُ فَجْأَةُ بَلاَءٍ حَتَّى يُمْسِىَ، ‘সে রাতে তাঁর ওপর কোন আকস্মিক বিপদাপদ ঘটবে না যে পর্যন্ত না ভোর হয়, আর যে তা ভোরে তিনবার পড়বে তার ওপর কোন আকস্মিক বিপদাপদ সংঘটিত হবে না যে পর্যন্ত না সন্ধ্যা উপনীত হয়’।[3]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর নাতী হাসান ও হোসাইনকে নিম্নোক্ত দো‘আর মাধ্যমে ঝাড়-ফুঁক করেছেন,أُعِيْذُكُمَا بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّةِ مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ وَهَامَّةٍ وَمِنْ كُلِّ عَيْنٍ لاَمَّةٍ، ‘দু’জনকে আললাহর পূর্ণ বাক্য সমূহের আশ্রয় নিচ্ছি প্রত্যেক শয়তান হ’তে, বিষাক্ত কীট হ’তে ও প্রত্যেক অনিষ্টকারী চক্ষু হ’তে’।[4]

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَقُوْلُ اللَّهُمَّ إِنِّىْ أَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْبَرَصِ وَالْجُنُونِ وَالْجُذَامِ وَمِنْ سَيِّئِ الأَسْقَامِ. ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দো‘আয় বলতেন, ‘আল্লা-হুম্মা ইন্নী আ‘ঊযুবিকা মিনাল বারাছি, ওয়াল জুনূনি, ওয়াল জুযা-মি, ওয়া মিন সাইয়্যিয়িল আসক্বা-ম’। অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! আমি শ্বেতরোগ, কুষ্ঠরোগ, উম্মাদনা ও কঠিন রোগসমূহ হ’তে তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি’।[5]

করোনার এই সংকটময় সময়ে এ দো‘আটি বেশী বেশী পাঠ করা উচিত। আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,

كَانَ إِذَا أَوَى إِلَى فِرَاشِهِ كُلَّ لَيْلَةٍ جَمَعَ كَفَّيْهِ ثُمَّ نَفَثَ فِيهِمَا فَقَرَأَ فِيهِمَا (قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ) وَ (قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ) وَ (قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ) ثُمَّ يَمْسَحُ بِهِمَا مَا اسْتَطَاعَ مِنْ جَسَدِهِ يَبْدَأُ بِهِمَا عَلَى رَأْسِهِ وَوَجْهِهِ وَمَا أَقْبَلَ مِنْ جَسَدِهِ يَفْعَلُ ذَلِكَ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ.

‘নবী করীম (ছাঃ) প্রতি রাতে (ঘুমাবার জন্য) বিছানায় যাবার সময় দু’হাতের তালু একত্র করতেন। তারপর এতে ‘কুল হুওয়াল্লা-হু আহাদ, কুল আ‘ঊযু বিরাবিবল ফালাক্ব ও কুল আ‘ঊযু বিরাবিবন্না-স’ পড়ে ফুঁ দিতেন। এরপর এ দু’হাত দিয়ে তিনি তাঁর শরীরের যতটুকু সম্ভব মুছে নিতেন। শুরু করতেন মাথা, চেহারা এবং শরীরের সম্মুখ ভাগ হ’তে। এভাবে তিনি তিনবার করতেন’।[6]

ঝাড়ফুঁক করে বিনিময় গ্রহণ :

ঝাড়ফুঁক করে বিনিময় গ্রহণ করা জায়েয। নিম্নোক্ত হাদীছসমূহ তার বাস্তব প্রমাণ। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, أَنَّ نَاسًا مِنْ أَصْحَابِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم أَتَوْا عَلَى حَىٍّ مِنْ أَحْيَاءِ الْعَرَبِ فَلَمْ يَقْرُوْهُمْ، فَبَيْنَمَا هُمْ كَذَلِكَ إِذْ لُدِغَ سَيِّدُ أُولَئِكَ فَقَالُوا هَلْ مَعَكُمْ مِنْ دَوَاءٍ أَوْ رَاقٍ فَقَالُوا إِنَّكُمْ لَمْ تَقْرُوْنَا، وَلاَ نَفْعَلُ حَتَّى تَجْعَلُوْا لَنَا جُعْلاً. فَجَعَلُوْا لَهُمْ قَطِيعًا مِنَ الشَّاءِ، فَجَعَلَ يَقْرَأُ بِأُمِّ الْقُرْآنِ، وَيَجْمَعُ بُزَاقَهُ، وَيَتْفِلُ، فَبَرَأَ، فَأَتَوْا بِالشَّاءِ، فَقَالُوْا لاَ نَأْخُذُهُ حَتَّى نَسْأَلَ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم فَسَأَلُوهُ فَضَحِكَ وَقَالَ وَمَا أَدْرَاكَ أَنَّهَا رُقْيَةٌ، خُذُوْهَا، وَاضْرِبُوْا لِىْ بِسَهْمٍ- ‘নবী করীম (ছাঃ)-এর কতক ছাহাবী আরবের এক গোত্রের নিকটে আসলেন। গোত্রের লোকেরা তাদের কোন আতিথেয়তা করল না। তারা সেখানে থাকতেই হঠাৎ সেই গোত্রের নেতাকে সাপে দংশন করল। তখন তারা এসে বলল, আপনাদের কাছে কি কোন ঔষধ আছে কিংবা আপনাদের মধ্যে ঝাড়ফুঁককারী কেউ আছেন কি? তারা উত্তর দিলেন, হ্যাঁ। তবে তোমরা আমাদের কোন আতিথেয়তা করনি। কাজেই আমাদের জন্য কোন পারিশ্রমিক নির্দিষ্ট না করা পর্যন্ত আমরা তা করব না। ফলে তারা তাদের জন্য এক পাল বকরী পারিশ্রমিক দিতে রাযী হ’ল। তখন একজন ছাহাবী উম্মুল কুরআন (সূরা ফাতিহা) পড়তে লাগলেন এবং মুখে থুথু জমা করে সে ব্যক্তির গায়ে ছিটিয়ে দিলেন। ফলে সে রোগমুক্ত হ’ল। এরপর তারা বকরীগুলো নিয়ে এসে বলল, আমরা নবী করীম (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করার পূর্বে এটি স্পর্শ করব না। এরপর তারা এ বিষয়ে নবী করীম (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করল। নবী করীম (ছাঃ) শুনে হেসে দিলেন এবং বললেন, তোমরা কিভাবে জানলে যে, এটি রোগ সারায়? বকরীগুলো নিয়ে যাও এবং তাতে আমার জন্যও এক ভাগ রেখে দিও’।[7]

অন্য বর্ণনায় এসেছে,حَتَّى قَدِمُوا الْمَدِيْنَةَ فَقَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ أَخَذَ عَلَى كِتَابِ اللهِ أَجْرًا فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ أَحَقَّ مَا أَخَذْتُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا كِتَابُ اللهِ. ‘তারা মদীনায় পৌঁছে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তিনি আল্লাহর কিতাবের উপর পারিশ্রমিক গ্রহণ করেছেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, যে সকল জিনিসের উপর তোমরা বিনিময় গ্রহণ করে থাক, তন্মধ্যে সবচেয়ে বেশী হক রয়েছে আল্লাহর কিতাবের’।[8]

অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,كُلْ فَلَعَمْرِى مَنْ أَكَلَ بِرُقْيَةِ بَاطِلٍ لَقَدْ أَكَلْتَ بِرُقْيَةِ حَقٍّ- ‘তুমি এটা খাও। আমার জীবনের কসম! লোকেরা বাতিল মন্ত্র পড়ে রোজগার করে, আর তুমি তো সত্য ঝাড়ফুঁক দ্বারা রোজগার করছ’।[9]

জনৈক ছাহাবী মানসিক রোগীর চিকিৎসা করে ১০০টি বকরী বিনিময় পেয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট সেটার বৈধতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রায় একইভাবে বলেন,هَلْ قُلْتَ غَيْرَ هَذَا قُلْتُ لاَ قَالَ خُذْهَا فَلَعَمْرِى لَمَنْ أَكَلَ بِرُقْيَةِ بَاطِلٍ لَقَدْ أَكَلْتَ بِرُقْيَةِ حَقٍّ. ‘তুমি এ সূরা ছাড়া অন্য কিছু বলেছ কি? আমি (রাবী) বললাম, না। রাসূল (ছাঃ) বলেন, তুমি এটা গ্রহণ কর। আমার জীবনের কসম! লোকেরা বাতিল মন্ত্র পড়ে রোজগার করে আর তুমি তো সত্য ঝাড়ফুঁক দ্বারা রোজগার করেছ’।[10] উক্ত হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, শুধু কুরআন দ্বারা ঝাড়ফুঁক করে বিনিময় গ্রহণ করা যাবে, নচেৎ নয়।

রুগ্ন অবস্থায় সংযত পানাহার :

রোগ থেকে আরোগ্য লাভের অন্যতম উপায় হ’ল সংযত পানাহার। ডাক্তারগণ রোগীকে ঔষধ দেয়ার সাথে সাথে কিছু পথ্য ও বিধি-নিষেধ দিয়ে থাকেন। যা পূর্ণাঙ্গ সুস্থতার পূর্বশর্ত। উম্মুল মুনযির (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,

دَخَلَ عَلَىَّ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَمَعَهُ عَلِىٌّ وَلَنَا دَوَالٍ مُعَلَّقَةٌ قَالَتْ فَجَعَلَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَأْكُلُ وَعَلِىٌّ مَعَهُ يَأْكُلُ فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم لِعَلِىٍّ مَهْ مَهْ يَا عَلِىُّ فَإِنَّكَ نَاقِهٌ قَالَ فَجَلَسَ عَلِىٌّ وَالنَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم يَأْكُلُ قَالَتْ فَجَعَلْتُ لَهُمْ سِلْقًا وَشَعِيرًا فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم يَا عَلِىُّ مِنْ هَذَا فَأَصِبْ فَإِنَّهُ أَوْفَقُ لَكَ-

‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের বাড়ীতে আসলেন। আলী (রাঃ) তাঁর সাথে ছিলেন। আমাদের খেজুরের ছড়া ঝুলিয়ে রাখা ছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তা থেকে খেতে আরম্ভ করলেন। তাঁর সাথে আলী (রাঃ)ও খেতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আলী (রাঃ)-কে বললেন, হে আলী থাম! থাম! তুমি অসুস্থতাজনিত দুর্বল। রাবী বলেন, আলী (রাঃ) বসে গেলেন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) খেতে থাকলেন। আমি তাঁদের জন্য বীট ও বার্লি বানিয়ে আনলাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হে আলী! তুমি এটা খাও, এটা তোমার জন্য উপযোগী’।[11]

রোগীর জন্য উপযুক্ত পথ্য ‘তালবীনা’ :

আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,أَنَّهَا كَانَتْ تَأْمُرُ بِالتَّلْبِينِ لِلْمَرِيْضِ وَلِلْمَحْزُوْنِ عَلَى الْهَالِكِ، وَكَانَتْ تَقُولُ إِنِّى سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُوْلُ إِنَّ التَّلْبِينَةَ تُجِمُّ فُؤَادَ الْمَرِيْضِ، وَتَذْهَبُ بِبَعْضِ الْحُزْنِ- ‘তিনি রোগীকে এবং কারো মৃত্যুজনিত শোকাহত ব্যক্তিকে তালবীনা খাওয়ানোর আদেশ করতেন। তিনি বলতেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, ‘তালবীনা’ রোগীর কলিজা মযবূত করে এবং নানাবিধ দুশ্চিন্তা দূর করে’।[12]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত যে,أَنَّهَا كَانَتْ تَأْمُرُ بِالتَّلْبِينَةِ وَتَقُوْلُ هُوَ الْبَغِيْضُ النَّافِعُ- ‘তিনি তালবীনা খেতে আদেশ দিতেন এবং বলতেন, এটি হ’ল অপসন্দনীয়, তবে উপকারী’।[13]

‘তালবীনা’-এর উপকারিতা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেছেন,التَّلْبِينَةُ مَجَمَّةٌ لِفُؤَادِ الْمَرِيْضِ، تَذْهَبُ بِبَعْضِ الْحُزْنِ ‘তালবীনা’ রুগ্নব্যক্তির হৃদয়ে প্রশান্তি আনে এবং শোক-দুঃখ দূর করে’।[14] ‘তালবীনা’ হ’ল তরল জাতীয় খাদ্য। যা দুধ, যব/ময়দা, বার্লি দ্বারা প্রস্ত্তত করা হয়’।[15]

আধুনিক গবেষণা এবং নবী করীম (ছাঃ)-এর হাদীছ অনুযায়ী যবের উপকারিতা অপরিসীম। পাকস্থলী এবং অন্ত্রতে আলসারের রোগীদেরকে সকালের নাশতায় নবী করীম (ছাঃ)-এর যামানায় উন্নতমানের ব্যবস্থাপত্র স্বরূপ ‘তালবীনা’ প্রদান করা হ’ত। এতে আলসারের প্রতিটি রোগী ২/৩ মাসের মধ্যে আরোগ্য লাভ করত। প্রস্রাবের সাথে রক্ত ও পুঁজ পড়া রোগীদের জন্য, তা যে কারণেই হোক না কেন, উপযুক্ত চিকিৎসার সাথে সাথে যবের পানি যদি মধুর সাথে মিশ্রণ করে পান করান যায়, তাহ’লে এ রোগ পনের দিনের মধ্যে নিঃশেষ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। আবার কখনো এ পদ্ধতি পেটের পাথর বের করার জন্যও খুব কার্যকরী প্রমাণিত হয়েছে। পুরাতন কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য যবের দলিয়া থেকে উত্তম কোন ঔষধ পাওয়া মুশকিল’।[16]

রোগীকে পানাহারে বাধ্য করা সমীচীন নয় :

উক্ববা ইবনু আমির (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,لاَ تُكْرِهُوا مَرْضَاكُمْ عَلَى الطَّعَامِ فَإِنَّ اللهَ يُطْعِمُهُمْ وَيَسْقِيهِمْ، ‘তোমরা তোমাদের রোগীদের পানাহারের জন্য জবরদস্তি করো না। কেননা আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে খাওয়ান এবং পান করান’।[17]

فَإِنَّ اللهَ يُطْعِمُهُمْ وَيَسْقِيهِمْ،-এর ব্যাখ্যায় আল্লামা আব্দুর রহমান মুবারকপুরী (রহঃ) ‘তুহফাতুল আহওয়াযী’ গ্রন্থে লিখেছেন,يَمُدُّهُمْ بِمَا يَقَعُ مَوْقِعَ الطَّعَامِ وَالشَّرَابِ وَيَرْزُقُهُمْ صَبْرًا عَلَى أَلَمِ الْجُوعِ وَالْعَطَشِ فَإِنَّ الْحَيَاةَ وَالْقُوَّةَ مِنَ اللهِ حَقِيقَةً لَا مِنَ الطَّعَامِ وَلَا الشَّرَابِ وَلَا مِنْ جِهَةِ الصِّحَّةِ-‘কেননা মহান আল্লাহ তাদেরকে খাওয়ান এবং পান করান’। অর্থাৎ খাবার খাওয়া ও পানি পান করার স্থলাভিষিক্ত যা হয় তিনি তা সরবরাহ করেন এবং ক্ষুধার যন্ত্রণা ও পিপাসার উপর ধৈর্যধারণ করার ক্ষমতা দান করেন, খাদ্য ও পানীয় যা পারে না। অনুরূপভাবে শরীরকে সুস্থ রাখা মহান আল্লাহর কাজ, এটা খানা-পিনার কাজ নয়’।[18]

হাফিয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) ‘আত-তিববুন নববী’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মোবারক যবান দিয়ে বের হওয়া হাদীছের বিষয়বস্ত্তর উপর চিকিৎসাশাস্ত্রের পন্ডিতগণ গবেষণা করেছেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল হাদীছে বর্ণিত সূক্ষ্মতত্ত্ব অনুসন্ধান। বিশেষত সে সকল চিকিৎসক, যারা রোগীদের চিকিৎসা করে থাকেন, তাদের জন্য এই হাদীছে অগণিত হেকমত রয়েছে। রোগীর পানাহারে ইচ্ছা না থাকার পেছনে হ’তে পারে রোগীর শরীর তখন রোগ নির্মূল করার কাজে ব্যস্ত থাকে, অথবা তার চাহিদা শেষ হওয়া, অথবা শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা কমে যাওয়া, কিংবা নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার কারণে পানাহারের চাহিদা কমে থাকতে পারে। মোটকথা কারণ যাই হোক, এমতাবস্থায় রোগীকে খাবার খেতে বাধ্য করা কোনভাবেই সমীচীন নয়’।

যে কারণে খাবার গ্রহণের চাহিদা থাকে না :

জ্ঞাতব্য বিষয় হ’ল, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খাবারের প্রত্যাশী হওয়ার নামই ক্ষুধার্ত হওয়া। তবিয়ত এই খাবারের মাধ্যমে শরীরের ভেতরের নিষ্কাশনের কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। কেননা পাকস্থলী থেকে দূরতম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাকস্থলীর নিকটতম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে খাবার গ্রহণ করে থাকে। এভাবে খাবার গ্রহণের ধারাবাহিকতা পাকস্থলী পর্যন্ত পৌঁছায়। যার ফলে মানুষের মধ্যে ক্ষুধার অনুভূতি হয় এবং খাবার তালাশ করে। যখন মানুষ রোগাক্রান্ত হয়, তখন তবিয়ত রোগের মূল উৎস চিহ্নিত করে তা প্রতিহত করার প্রতি মনোনিবেশ করে। তাই এ সময় রোগীর মাঝে খাবার-পানীয় গ্রহণের মতো কোন চাহিদাই থাকে না’।[19]

কাযী আয়ায (রহঃ) বলেন,وَالشَّرَابِ فِيْ حِفْظِ الرُّوحِ وَتَقْوِيْمِ الْبَدَنِ، وَنَظِيرُهُ قَوْلُهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَبَيْتُ عِنْدَ رَبِّي يُطْعِمُنِي وَيَسْقِينِي، وَإِنْ كَانَ مَا بَيْنَ الْإِطْعَامَيْنِ وَالطَّعَامَيْنِ بَوْنًا بَعِيدًا অর্থাৎ আত্মাকে (রূহকে) হিফাযত রাখতে ও শরীরকে শক্তিশালী রাখতে খাবার ও পানির যে উপকার মহান আল্লাহ সেটা সরবরাহ করার মাধ্যমে তাদের (রোগীদের) শক্তিকে সংরক্ষণ করেন। যেমনটি হাদীছে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আমি আমার রবের নিকট রাত্রি যাপন করেছি তিনি আমাকে খাদ্য খাওয়াইছেন ও পান করিয়েছেন। আর এ খাবার খাওয়ানো ও আমার খাবার মাঝে অনেক দূরত্ব ছিল’।[20]

রোগীকে সান্ত্বনা প্রদানের মাধ্যমে আত্মবিশ্বাসী করে তোলা :

রোগ থেকে সুস্থতা লাভের অন্যতম একটি উপায় হ’ল রোগীর মাঝে এমন আত্মবিশ্বাস তৈরী হওয়া যে, এটা এমন কোন বড় রোগ নয়, এ থেকে তাড়াতাড়িই আমি সুস্থ হয়ে যাব ইনশাআল্লাহ। রোগীর মধ্যে এ আত্মবিশ্বাস তৈরীতে সহযোগিতা করা তথা তাকে অভয় দেয়া ও সান্ত্বনা দেয়া উচিত। তাই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কোন রোগীকে দেখতে গেলে বলতেন, لاَ بَأْسَ طَهُوْرٌ إِنْ شَاءَ اللهُ ‘কোন ভয় নেই, আল্লাহ চান তো তুমি খুব শীঘ্রই ভালো হয়ে যাবে’।[21]

বস্ত্তগত ঔষধ ছাড়াও মানসিক ঔষধ মানবদেহে অধিকতর দ্রুত কাজ করে। এমনকি সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, যে কোন রোগের আরোগ্য ৮০ শতাংশ নির্ভর করে

রোগীর মানসিক শক্তির উপর। এমনকি ক্যান্সারের মত দুরারোগ্য ব্যাধিতেও বেদনার উপশম হয় রোগীর জোরালো মানসিক শক্তির উপরে। ইউরোপ-আমেরিকায় এখন রোগীকে মানসিক ঔষধ দেওয়া হচ্ছে এভাবে যে, তুমি বার বার বলা ‘আমার কোন অসুখ নেই, আমি সুস্থ’। এভাবে পরীক্ষায় প্রমাণিত

হয়েছে যে, মানসিকভাবে শক্তিশালীগণ দ্রুত আরোগ্য লাভ করে হাসপাতাল ত্যাগ করেছেন’।[22]

সমাপনী : অন্যান্য দিক ও বিভাগের ন্যায় চিকিৎসা বিজ্ঞানেও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অবদান অপরিসীম। কিন্তু আজ অনেক ক্ষেত্রেই নববী চিকিৎসা পদ্ধতি অজ্ঞাত ও অবহেলিত। মুসলিম জাতিও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর চিকিৎসা পদ্ধতিকে যথার্থ মূল্যায়নে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে তারা বস্ত্তবাদী চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করে নিজেদের পকেট সাফ করে চলছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর চিকিৎসা পদ্ধতি সহজসাধ্য, ব্যয়বহুল নয়। বিধায় এটা ধনী-গরীব নির্বিশেষে সকলের জন্য উপযোগী। অতএব মুসলিম গবেষকদের উচিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে ব্যাপকতর গবেষণা করা এবং এ চিকিৎসা মানুষের দোর গোড়ায় পৌঁছে দেয়া। নববী চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করা অন্যান্য সুন্নাতের ন্যায় এটাও একটি সুন্নাত। অতএব এ মৃতপ্রায় সুন্নাতকে পুনর্জীবিত করতে সকলের এগিয়ে আসা উচিত। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক দান করুন- আমীন!

মুহাদ্দিছ, বেলটিয়া কামিল মাদ্রাসা, জামালপুর।


[1]. মুসলিম হা/২৭০৯; আবূদাঊদ হা/৩৮৯৮; ছহীহুল জামি‘ হা/১৩১৮।

[2]. তিরমিযী হা/৩৩৮৮; আবূ দাঊদ হা/৫০৮৮; ইবনু মাজাহ হা/৩৮৬৯; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৭৪৫; ছহীহ আত-তারগীব হা/৬৫৫।

[3]. আবূদাঊদ, মিশকাত হা/২৩৯১, সনদ ছহীহ।

[4]. বুখারী হা/৩৩৭১; আবূদাঊদ হা/৪৭৩৭; তিরমিযী হা/২০৬০।

[5]. আবূদাঊদ হা/১৫৫৪; নাসাঈ হা/৫৪৯৩; ছহীহুল জামে‘ হা/১২৮১।

[6]. বুখারী হা/৫০১৭; মুসলিম হা/২৭১৫; আবূদাঊদ হা/৫০৫৬।

[7]. বুখারী হা/৫৭৩৬, ৫৭৪৯; মুসলিম হা/২২০১।

[8]. বুখারী হা/৫৭৩৭।

[9]. আবূদাঊদ হা/৩৯০১।

[10]. আবূদাঊদ হা/৩৮৯৬ ‘চিকিৎসা’ অধ্যায়, সনদ ছহীহ।

[11]. তিরমিযী হা/২০৩৭; আবূদাঊদ হা/৩৮৫৬, সনদ ছহীহ।

[12]. বুখারী হা/৫৬৮৯, ৫৪১৭।

[13]. বুখারী হা/৬৩৯০।

[14]. বুখারী হা/৫৪৯৭; মুসলিম হা/২২১৬; আহমাদ হা/২৫২৭৪।

[15]. তিরমিযী হা/২০৩৯; ইবনু মাজাহ হা/৩৪৪৫, ৩৪৪৬।

[16]. ছহীহুল বুখারী (বঙ্গানুবাদ), তাওহীদ পাবলিকেশন্স, ঢাকা ৫/১৯৬ টীকা দ্রষ্টব্য।

[17]. তিরমিযী হা/২০৪০; ইবনু মাজাহ হা/৩৪৪৪; ছহীহাহ হা/৭২৭; ছহীহুল জামে‘ হা/৭৪৩৯।

[18]. তুহফাতুল আহওয়াযী ৫/৪৫৩ পৃঃ ২০৪০নং হাদীছের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।

[19]. আত-তিববুন নববী (ছাঃ), ১৫২ পৃঃ।

[20]. মিরক্বাতুল মাফাতীহ, উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।

[21]. বুখারী হা/৩৬১৬, ৫৬৫৬, ৫৬৬২; মিশকাত হা/১৫২৯।

[22]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, তাফসীরুল কুরআন, ৩০তম পারা (রাজশাহী : হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ৩য় মুদ্রণ ২০১৩), পৃঃ ৫৬৭।






বিষয়সমূহ: বিধি-বিধান
মাহে রামাযানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য - ড. মুহাম্মাদ আলী
মানবাধিকার ও ইসলাম (১০ম কিস্তি) - শামসুল আলম
ইসলামের কতিপয় সামাজিক বিধান - মুহাম্মাদ ইমদাদুল্লাহ
কুরবানীর মাসায়েল
সীমালংঘন - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
মানবাধিকার ও ইসলাম (৬ষ্ঠ কিস্তি) - শামসুল আলম
আহলেহাদীছ জামা‘আতের বিরুদ্ধে কতিপয় মিথ্যা অপবাদ পর্যালোচনা (৬ষ্ঠ কিস্তি) - তানযীলুর রহমান - শিক্ষক, বাউটিয়া দাখিল মাদ্রাসা, রাজশাহী
শায়খ আলবানীর তাৎপর্যপূর্ণ কিছু মন্তব্য (২য় কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
ইসলামী বিচার ব্যবস্থার কল্যাণকামিতা - শেখ মুহাম্মাদ রফীকুল ইসলাম, সহকারী অধ্যাপক, পাইকগাছা সরকারী কলেজ, খুলনা
দো‘আয় ভুল-ভ্রান্তি ও তা কবুলে দেরী হ’লে করণীয় - আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আল্লাহর নিদর্শন - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
শারঈ জ্ঞানার্জনের বাধ্যবাধকতা ও বর্তমান সমাজ বাস্তবতা - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আরও
আরও
.