একটা নির্দিষ্ট রক্তচাপ বজায় রাখা প্রত্যেক সুস্থ, সবল মানুষের জন্য অত্যন্ত যরূরী। সুস্থ মানুষের স্বাভাবিক রক্তচাপ এভারেজ ১২০/৮০ মি.মি. মার্কারী ধরা হ’লেও সিস্টোলিক ব্লাডপ্রেসার (ঊর্ধ্বসীমার রক্তচাপ) ৯০ থেকে ১৩০ মি.মি. আর ডায়াস্টলিক ব্লাডপ্রেসার (নিম্নসীমার রক্তচাপ) ৬০ থেকে ৮৫ মি.মি. পর্যন্ত স্বাভাবিক ধরা যায়।
দুই হাতের মাঝে ব্লাডপ্রেসারে কিছুটা পার্থক্য হ’তে পারে, সাধারণত ডান হাতে একটু বেশী থাকে। তবে বাংলাদেশের অনেকের এভারেজ ব্লাডপ্রেসার ৯০/৬০ মি.মি. এটাকে তাদের জন্য নরমাল বলা যায়।
৯০/৬০ মি.মি. অপেক্ষা কমে গেলে এবং বেশী মাথা ঘুরলে বা হাঁটাচলা, স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হ’লে এটাকে লো- প্রেসার বলা হয়। তবে এই রক্তচাপ নিয়ে নানান ভুল বুঝাবুঝি, ভ্রান্ত চর্চা, অসতর্কতা প্রচলিত রয়েছে। সেসব বিষয়ে ভালো করে জানাশোনা থাকা যরূরী। রক্তচাপ পরিমাপে কিছু লক্ষণীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রক্তচাপ নির্ণয়ের সঠিক নিয়ম শিক্ষিত, সচেতন সকলকে জেনে বুঝে রাখা একান্ত কর্তব্য।
১. রক্তচাপ পরিমাপের পূর্বে কমপক্ষে ৩-৫ মিনিট এক জায়গায় বসে থাকতে হবে। তারপর ওখানে বসেই প্রেসার মাপা উচিত। তবে ক্ষেত্রবিশেষে শুয়ে থেকেও রক্তচাপ মাপা যাবে।
২. রক্তচাপ পরিমাপের আধা ঘন্টা পূর্বে শারীরিক পরিশ্রম, চা/কফি খাওয়া, ধূমপান থেকে দূরে থাকতে হবে।
৩. রক্তচাপ পরিমাপের সময় কথাবার্তা, অস্থিরতা, উত্তেজনা পরিহার করে রিলাক্সে থাকতে হবে।
৪. ব্লাডপ্রেসার চেক করার সময় বসার সঠিক পদ্ধতি- এ সময় সোজা হয়ে চেয়ারে পিঠ হেলান দিয়ে বসে, হাতটাকে কাছাকাছি টেবিল বা চেয়ারের হাতলের উপর হার্টের বরাবর রাখতে হবে, দুই পা আড়াআড়ি রেখে বসা যাবে না।
৫. টাইট ফিটিং, মোটা কাপড় পরিহিত থাকলে সরিয়ে নেওয়া উচিত, তবে কাপড় শক্তভাবে ভাঁজ করে/গুটিয়ে রেখে মাপলেও কিছুটা ভুল আসতে পারে।
মূলত হাতে কাপড় থাকুক বা অনাবৃত থাকুক হাতের কনুইয়ের ভাজে ব্রাকিয়াল ধমনীর গতিশীলতা অনুভব করে এই নির্দিষ্ট অবস্থানে স্টেথোস্কোপ বসাতে হবে এবং বিপি মেশিনের কাফের তীর-চিহ্নিত অংশ রাখা যরূরী।
৬. বিপি মেশিনের কাফটিকে কনুইয়ের ভাজের ২ সে.মি. উপরে এবং টিউব ২ টিকে বাহুর সামনের দিকে রাখা যরূরী।
৭. এনালগ বিপি মেশিন ব্যবহার করা ভালো। ডিজিটাল মেশিন সঠিক নিয়মে সেট না করলে পরিমাপে বেশ কিছুটা কমবেশী/ভুল আসতে পারে।
৮. এনালগ মেশিনে চেক করার শুরুতে প্রতি সেকেন্ডে ৫ মি. মি. করে বিপি কাফ ফুলাতে হবে, অতঃপর কাফের প্রেসার কমানোর সময় আনুমানিক প্রতি সেকেন্ডে ২ মি. মি. করে কমিয়ে শব্দ শুনতে হবে। শব্দ শুরুর পয়েন্ট সিস্টোলিক, আর শব্দ শেষ হওয়ার পয়েন্ট ডায়াস্টলিক প্রেসার নির্দেশ করে।
৯. শুধু কাটা নড়াচড়া দেখে সঠিক মাপ ধারণা করা যাবে না, শব্দ শুনেই রক্ত চাপের হিসাব খেয়াল রাখতে হবে।
১০. বাথরুমের বেগ নিয়ে, তাড়াহুড়ো করে এসে, যেনতেনভাবে মেপে অনুমানে করে রক্তচাপ কনফার্ম করা যাবে না। রক্তচাপ অস্বাভাবিক আসলে পুনরায় চেক করতে হবে। অপর হাতেও ব্লাডপ্রেসার মেপে দেখা উচিত।
উচ্চ রক্তচাপ : রক্তচাপ ১৪০/৯০ মি. মি. মার্কারী বা এর বেশী হ’লে সেটাকে উচ্চ রক্তচাপ বলা হয়।
উচ্চ রক্তচাপ-এর কিছু কারণ :
প্রায় ৯৫% ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপ জেনেটিক, বংশগত প্রভাবে হয়ে থাকে। তবে এর সাথে কিছু পারিপার্শ্বিক প্রভাব কাজ করে থাকে। যেমন অতিরিক্ত ওযন, ঘুমের মাঝে নাকডাকা, শ্বাস নিতে সমস্যা ও ঘুমের ব্যাঘাত হওয়া, বেশী লবণ খাওয়া, ধূমপান করা, মাদকদ্রব্য সেবনসহ বিভিন্ন কারণে রিস্ক বেড়ে যায়। আর ৫% ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপ বিভিন্ন সমস্যার জন্য হ’তে পারে।
যেমন থাইরয়েডসহ বিভিন্ন হরমোনের সমস্যা, কিডনির কিছু রোগে, কিছু রক্তনালীর সমস্যা, কতিপয় ওষুধ অনেকদিন যাবত সেবন, যেমন- স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ, ব্যথার ওষুধ, মহিলাদের হরমোণাল পিল সেবন। আর গর্ভবতী অবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ হয়ে যেতে পারে।
উচ্চ রক্তচাপ-এর জটিলতা/ক্ষতিকর প্রভাব : রক্তচাপ অনিয়ন্ত্রিত থাকলে হার্ট এটাকসহ হার্টের বিভিন্ন সমস্যা, ব্রেইন স্ট্রোক, কিডনি, চোখের এবং দেহের বিভিন্ন অংশে রক্তনালীর বিভিন্ন জটিলতার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যেতে পারে।
হাইপ্রেসার নিয়ন্ত্রণ করতে কিছু পরামর্শ : ব্লাড প্রেসার ১৩০/৮০ বা এর নীচে রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। নয়তো কিডনি, হার্ট, ব্রেইন, চক্ষু, রক্তনালী ব্লক হয়ে পায়ে ঘা, পচন প্রভৃতি ক্ষতি হবার মারাত্মক ঝুঁকি বেড়ে যায়।
(১) অবশ্যই লবণ খাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে, যথাসম্ভব কম লবণে খেতে অভ্যস্ত হ’তে হবে। সারাদিনে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ সব মিলিয়ে ৫ গ্রাম/১ টেবিল চামচ লবণ খেতে পারেন, এর বেশী নয়। লবণ খাওয়া নিয়ন্ত্রণ করে ৭-৮ মি.মি. পর্যন্ত রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
(২) উচ্চ সোডিয়াম সমৃদ্ধ খাবারগুলো অবশ্যই যথাসম্ভব কম খেতে হবে, এতেও হাইপ্রেসার নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে। যেমন- গরুর গোশত, কলিজা, বিভিন্ন চিপস, সস, বিস্কুট, বেকিং পাউডার, আচার, চাটনি, পনির, চকলেট, কেক, পাউরুটি, জলপাই ইত্যাদি।
(৩) যাবতীয় ফাস্টফুড, তেল, চর্বি, ভাজাপোড়া জাতীয় খাবার (গ্রিল, চিকেন ফ্রাই, পিজ্জা ইত্যাদি) পরিহার করতে হবে। যথেষ্ট পরিমাণে শাক, আঁশযুক্ত সবজি, ফলমূল খেতে হবে। এমন করতে পারলে বাড়তি প্রেসার ৮-১৪ মি.মি. পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে।
(৪) ধূমপান-বিড়ি/সিগারেট, জর্দা, গুল, মাদকসহ যাবতীয় নেশাদার দ্রব্য সম্পূর্ণ বর্জনীয়। এগুলো সবই ইসলামের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ। এগুলো পরিহারেও হাই ব্লাডপ্রেসার নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়।
(৫) যাবতীয় দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ, অস্থিরতা সাধ্যমত পরিহার করে প্রশান্তচিত্তে থাকতে চেষ্টা করতে হবে। ৫ ওয়াক্ত ছালাত, কুরআন তেলওয়াত ও যিকর করা এক্ষেত্রে অত্যন্ত সহায়ক। এভাবে ৫ মি.মি. পর্যন্ত উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
(৬) শরীরের অতিরিক্ত ওযন কমাতে হবে। বিএমআই ২২.৫ এর নীচে রাখতে- উচ্চতা অনুসারে ওযন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অতিরিক্ত ১ কেজি ওযন কমালে ০.৫-২ মি.মি. মার্কারী পর্যন্ত রক্তচাপ কমে আসতে পারে।
(৭) উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পটাসিয়াম যুক্ত খাবার যেমন- দুধ, দই, কলা, কালোজিরা, ডাবের পানি, শিম, টমেটো, কমলা ইত্যাদি খেলে কিছুটা কাজ করবে।
(৮) প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট মাঝারি গতিতে খোলামেলা পরিবেশে হাঁটাহাঁটি করা প্রয়োজন। এতেও ৫-১০ মিমি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আসতে সহায়ক হবে।
(৯) রাতজাগা অবশ্যই বর্জন করতে হবে। রাতে নিয়মিত ১০/১১টা থেকে ফজর পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন ৭ ঘণ্টা খুব ভালো ঘুমানোর চেষ্টা করতে হবে।
(১০) নিয়মিতভাবে চেক আপে থাকতে হবে। সপ্তাহে অন্তত ১ দিন। আর শরীর খারাপ লাগলেও সঠিক নিয়মে রক্তচাপ মনিটরিং করে লিখে রাখতে হবে।
(১১) উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধের সঠিক ডোজ ঠিক করে নিয়মিত সেবন চালিয়ে যাওয়া একান্ত কর্তব্য।
ব্লাড প্রেসার সংক্রান্ত কিছু ভুল ধারণা/অসতর্কতা :
(১) হঠাৎ করে একবার প্রেসার বেশী পেলেই ওষুধ শুরু করা যাবে না, বরং কয়েকবার সঠিকভাবে মেপে প্রতিবারই বেশী থাকলে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক উপযুক্ত মেডিসিন এবং এর ডোজ ঠিক করতে হবে।
(২) কিছু দিন মেডিসিন খেয়ে একবার ব্লাডপ্রেসার কন্ট্রোলে এসে গেলে আর মেডিসিন খাওয়ার দরকার নেই- এমন ভুল ধারণার জন্যই হঠাৎ করে আবার ব্লাডপ্রেসার বেড়ে স্ট্রোক, হৃদরোগের সমস্যা বেশী হ’তে দেখা যায়। বরং মেডিসিন খেয়ে রক্তচাপ স্বাভাবিক হয়ে আসলেও নিয়মিত মেডিসিন সেবন ও মনিটরিং করতে হবে।
(৩) হঠাৎ স্ট্রোকের লক্ষণ দেখা দিলেই ব্লাডপ্রেসার বেশী পেলেই কমানোর জন্য অনেকে নিজে থেকে/ফার্মেসী থেকে ওষুধ খেয়ে নিচ্ছেন। এভাবে ব্লাডপ্রেসার কমালে হিতে বিপরীত হচ্ছে, স্ট্রোকের মাত্রা, পঙগুত্ব/প্যারালাইসিস এর ঝুঁকি আরও বেড়ে যাচ্ছে। অভিজ্ঞ MBBS ডাক্তার দেখিয়ে সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রেসারের ওষুধ নিতে হবে।
(৪) ডেঙগু জ্বর, ডায়রিয়া বা বমি, রক্তক্ষরণ হয়ে বা অন্য কোন সময় হঠাৎ ব্লাডপ্রেসার কমে ৯০/৬০ বা এর নীচে চলে গেলে নিয়মিত নেওয়া উচ্চ রক্তচাপের মেডিসিন সেবন বন্ধ রেখে অতিসত্বর মেডিসিনের ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
(৫) ফার্মেসী থেকে নিয়ে বা ইচ্ছে মতো যে কোন মেডিসিন খাওয়া বা বন্ধ করা একদম উচিত হবে না। মেডিসিনের ডোজ ও ধরন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক নির্ধারণ করতে হবে।
(৬) গর্ভবতী অবস্থায় ব্লাডপ্রেসার হঠাৎ বেড়ে যেতে পারে ৫ সপ্তাহের পর থেকে। সে সময় মাঝে মাঝে ব্লাডপ্রেসার চেক করতে হবে, আর বেশী হয়ে গেলে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক মেডিসিন সেবন করতে হবে।
(৭) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়- উচ্চ রক্তচাপ এর সুনির্দিষ্ট কোন লক্ষণ নাও দেখা দিতে পারে। সেজন্য প্রতি মাসে/কয়েক মাস পরপর ব্লাডপ্রেসার চেক করা উচিত। তাহ’লে উচ্চ রক্তচাপ এর ক্ষতি থেকে নিরাপদ থাকা সহজ হবে।
* মেডিকেল অফিসার (অনারারী), রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।