স্ট্রোকের ক্ষেত্রে এটা সত্য যে কিছু বিষয়কে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না। এছাড়া স্ট্রোকের অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলোকে সচেতন জীবনযাপনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তেমন একটা বিষয় হ’ল ডায়েট। অর্থাৎ আমরা যেসব খাবার খাচ্ছি তা স্ট্রোককে প্রভাবিত করতে পারে বা ঝুঁকি বাড়াতে কিংবা কমাতে পারে। স্যাচুরেটেড ফ্যাট, ট্রান্স ফ্যাট ও কোলেস্টেরল সমৃদ্ধ খাবার খেলে কোলেস্টেরল বাড়ে। ফ্যাট ও ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবার শরীরকে স্থূল করে তোলে। অত্যধিক লবণ খেলে রক্তচাপ বাড়ে। এসবকিছু স্ট্রোকের ঝুঁকিকে উচ্চ করতে পারে। আবার এমনকিছু খাবার রয়েছে যা স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে পারে। নিম্নে স্ট্রোকের ঝুকি কমাতে ও বাড়াতে সাহায্য করে এমন কিছু খাবারের তালিকা দেয়া হ’ল।-

যে সকল খাবার স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে :

১. সামুদ্রিক মাছ : একটি গবেষণাভিত্তিক রিভিউ অনুসারে, প্রতি সপ্তাহে একবার অথবা দু’বার সামুদ্রিক মাছ (নন-ফ্রাইড) খেলে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে। গবেষকরা জানান, সমুদ্রের তৈলাক্ত মাছের ওমেগা-৩ ফ্যাট ধমনীর প্রদাহ কমিয়ে রক্তপ্রবাহ বাড়ায়। এটা রক্ত জমাটের ঝুঁকি কমায়। বেশী করে মাছ খেলে ডায়েটে অস্বাস্থ্যকর খাবারের পরিমাণও কমে যায়। যেমন- লাল গোশত ও প্রক্রিয়াজাত গোশত। এরূপ গোশতে ধমনীতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে এমন চর্বি (স্যাচুরেটেড ফ্যাট) রয়েছে। স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে ৮ আউন্স সামুদ্রিক মাছ খাওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা উচিত।

২. ওটস বা ওটমিল : শরীর থেকে খারাপ কোলেস্টেরল এলডিএল কমিয়ে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমানো যায়। ২০১৯ সালে সায়েন্টিফিক রিপোর্টস-এ প্রকাশিত গবেষণায় যারা ওটমিল খেয়েছেন তাদের স্ট্রোকের মত কার্ডিওভাস্কুলার রোগের ঝুঁকি কম ছিল। গবেষণায় যারা ওটমিল খেয়েছেন তাদের শরীরে এলডিএল কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লাইসেরাইডস, টোটাল কোলেস্টেরল এবং ইনফ্লামেটরি মার্কার কম ছিল। আপনার কার্ডিওভাস্কুলার রোগের বহুবিধ ঝুঁকি থাকলে এলডিএল কোলেস্টেরলকে ১০০ এমজি/ডিএল এর নীচে রাখুন। কোলেস্টেরলকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রতিদিন ২০ গ্রাম সলিউবল ফাইবার খাওয়ার চেষ্টা করুন। ওটমিলে প্রচুর পরিমাণে সলিউবল ফাইবার পাওয়া যায়।

৩. মিষ্টি আলু : হার্ট ও ব্রেইনের কথা ভেবে আপনার ডায়েটে নিঃসঙ্কোচে মিষ্টি আলুকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। এক বাটি খোসাসহ মিষ্টি আলুতে ভিটামিন ‘এ’ এর দৈনিক সুপারিশকৃত মাত্রার ৭৬৯ শতাংশ পাওয়া যায়। যা হার্ট, ফুসফুস ও কিডনির কার্যক্রমে স্বাভাবিকতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। একই পরিমাণে খোসাসহ মিষ্টি আলুতে দৈনিক প্রয়োজনীয় ফাইবারের ২৬ শতাংশ পাবেন। এছাড়া মিষ্টি আলুতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে, যা রক্তনালীতে প্লেকের গঠন বা প্রতিবন্ধকতা প্রতিরোধে অবদান রাখে।

৪. দুধ ও পনির : দুগ্ধজাত খাবারের সুখ্যাতির পাশাপাশি দুর্নামও রয়েছে। এর দুর্নাম থাকলেও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক হ’তে পারে। জার্নাল অব দ্য আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনে প্রকাশিত গবেষণা রিভিউতে দেখা গেছে, যারা উচ্চ পরিমাণে দুগ্ধজাত খাবার (বিশেষত দুধ ও পনির) খেয়েছেন তাদের স্ট্রোকের ঝুঁকি কম ছিল। দুগ্ধজাত খাবার ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও পটাশিয়ামে ভরা থাকে। এসব পুষ্টি রক্তচাপ কমিয়ে স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস করে। কিন্তু স্যাচুরেটেড ফ্যাট কমাতে কম চর্বি বা চর্বিমুক্ত দুগ্ধজাত খাবার খেতে হবে। স্যাচুরেটেড ফ্যাটের সঙ্গে কার্ডিওভাস্কুলার রোগের সম্পর্ক পাওয়া গেছে।

৬. কলা : বেশী করে পটাশিয়াম খেলে রক্তচাপ কমে। যারা হাইপারটেনশনে ভুগছেন তারা এই পুষ্টি গ্রহণে বিশেষ উপকার পেতে পারেন। স্ট্রোক নামক জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় পাওয়া গেছে, পটাশিয়াম স্ট্রোক প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রতিদিন ৪,৭০০ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম খাওয়ার চেষ্টা করুন। একটি কলাতে ৪২২ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম পাবেন। নিউইয়র্ক সিটির প্রিভেন্টিভ কার্ডিওলজি ডায়েটিশিয়ান মিশেল রুথেনস্টেইন বলেন, ‘রক্তচাপ কমাতে পাকা কলার চেয়ে কাঁচাকলা বেশী কার্যকর’।

৭. কুমড়ার বীজ : স্ট্রোক জার্নালে প্রকাশিত অন্য একটি গবেষণায় ৩৬,০০০ লোকের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খেলে স্ট্রোকের ঝুঁকি ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের মতে, মাত্র / বাটি মিষ্টি কুমড়ার বীজে দৈনিক প্রয়োজনীয় ৪২০ মিলিগ্রাম ম্যাগনেসিয়ামের ৪২ শতাংশ পাওয়া যায়। বীজটির অন্যান্য উপকারিতাও রয়েছে। ম্যাগনেশিয়ামের আরো কয়েকটি সমৃদ্ধ উৎস হ’ল- পালংশাক, গম, বার্লি ও ব্ল্যাক বিনস।

৮. পালংশাক : পালংশাকে কেবল ম্যাগনেসিয়াম নয়, প্রচুর পরিমাণে ‘বি’ ভিটামিন ফোলেটও রয়েছে। জেএএমএ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় জানা গেছে, ফোলেট বা ফলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ ডায়েট উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের মধ্যে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে পারে। তাই স্ট্রোক এড়াতে প্রতিদিন ৪০০ মাইক্রোগ্রাম ফোলেট খাওয়ার চেষ্টা করুন। আধা বাটি রান্না করা পালংশাকে দৈনিক প্রয়োজনীয় ফোলেটের প্রায় এক-চতুর্থাংশ পেতে পারেন।

৯. কাঠবাদাম : কাঠবাদামে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিন, ফাইবার ও আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট পাওয়া যায়। এক আউন্স কাঠবাদামে (২২-২৪টি) ৯ গ্রাম ফ্যাট পাওয়া যায়, যা খারাপ কোলেস্টেরল এলডিএল কমায় এবং ভাল কোলেস্টেরল এইচডিএল বাড়ায়। এছাড়া কাঠবাদামে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘ই’ পাবেন, যা ধমনীতে প্রতিবন্ধকতা গঠনে বাধা দিতে পারে।

যেসব খাবার স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে সাহায্য করে :

মস্তিষ্কের কোন অংশে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে সাধারণত স্ট্রোক হয়। দৃশ্যতঃ এটি মস্তিষ্কের টিস্যুর ক্ষতি করে। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, স্থূলতা এবং ব্যায়ামের অভাব এমন কিছু জীবনধারার কারণ যা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। তেমনই কয়েকটি খাবার স্ট্রোকের জন্য সমানভাবে দায়ী। তাই স্ট্রোক এড়াতে কিছু খাবার থেকে দূরে থাকতে হবে।

১. লবণ :

লবণ স্ট্রোকের জন্য একটি বড় ঝুঁকি। এখানে লবণ বলতে প্যাকেটজাত খাবার এবং প্রক্রিয়াজাত লবণকে বলা হচ্ছে। জেনে রাখুন, প্যাকেটজাত খাবারে প্রয়োজনের চেয়ে বেশী লবণ থাকে। আপনি যদি নিয়মিত এই জাতীয় খাবার খান তবে এটি আপনার রক্তচাপ এক চিমটে বাড়িয়ে দেবে, যা ধমনী, মস্তিষ্ক এবং হৃদপিন্ডকে খারাপভাবে প্রভাবিত করবে। তাই যতটা সম্ভব প্রক্রিয়াজাত ও প্যাকেটজাত খাবার থেকে দূরে থাকুন। দিনে ৫ গ্রাম লবণ খাওয়া কমিয়ে দিলে উচ্চরক্তচাপের সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে এবং স্ট্রোকের ঝুঁকিও কমে যাবে ইনশাআল্লাহ।

২. ধূমপান ও প্রসেসড মিট :

গোটা বিশ্বে ধূমপায়ীদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আর ধূমপানের এই নেশা ছাড়তে চেয়েও বারবার ব্যর্থতার মুখ দেখতে হয়েছে অসংখ্য মানুষকে। এমনকি হট ডগ, বেকন, সালামির মত খাবারগুলো খেতে ভাল লাগলেও যত তাড়াতাড়ি আপনি এটি খাওয়া বন্ধ করবেন ততই ভাল। আসলে সোডিয়াম নাইট্রেটের মত কিছু প্রিজারভেটিভ যোগ করা হয়, যা রক্তনালীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এমতাবস্থায় কেউ যদি এসব খাবার গ্রহণ করেন তাহ’লে স্ট্রোকের ঝুঁকি এড়ানো যায় না।

এই প্রিজারভেটিভগুলো প্রায়ই অক্সিডেটিভ স্ট্রেস সৃষ্টি করে, যা জাহাজের প্রাচীরের ক্ষতির দিকে নিয়ে যায়। অতএব প্রথম মুহূর্তে, আপনার ডায়েটে প্রক্রিয়াজাত এবং ধূমপানযুক্ত গোশতের গ্রহণ সীমাবদ্ধ করা উচিত।

৩. প্রক্রিয়াজাত খাবার খাওয়া বন্ধ করুন :

আপনি যদি জাঙ্ক এবং ট্রান্সফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার দিয়ে আপনার দিন শুরু করেন, তবে আপনার সতর্ক হওয়া উচিত। এই খারাপ খাদ্যাভ্যাস স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। চিকিৎসকদের মতে, জাঙ্ক ফুডে সাধারণত প্রচুর ট্রান্সফ্যাট থাকে, যা এলডিএল নামক খারাপ কোলেস্টেরলের জন্ম দেয়। এটি ধমনীতে জমা হয় এবং শরীরে প্রদাহ সৃষ্টি করে। কোলেস্টেরল শরীরের প্রদাহ বৃদ্ধি এবং হার্ট অ্যাটাকের প্রধান কারণ।

\ সংকলিত \






আরও
আরও
.