পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার ক্ষতিকর প্রভাব

ভূমিকা :

পাপ তথা আল্লাহর নাফরমানী মানব জীবনের নানা দিক ও বিভাগে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। পাপের ফলে বান্দা দুনিয়াবী জীবনে নানা অকল্যাণ ও অনিষ্টের সম্মুখীন হয়। তদ্রূপ আখিরাতেও পাপী ব্যক্তিকে বিভিন্ন স্তরে শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। সুতরাং পাপের অশুভ পরিণতি দুনিয়া ও আখিরাতে উভয় জীবনেই ভোগ করতে হবে। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা উপস্থাপন করা হ’ল।-

ক. ব্যক্তির অন্তরে পাপের প্রভাব

১. অন্তর অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়া :

পাপের কারণে অন্তরে কালো দাগ পড়ে। এভাবে পাপ যত বেশী হয়, অন্তরে কালো দাগ তত বৃদ্ধি পায়। এতে অন্তর অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়। আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন,إن للحسنة ضياءً في الوجه، ونورًا في القلب، وسَعة في الرزق، وقوة في البدن، ومحبة في قلوب الخلق، وإن للسيئة سوادًا في الوجه، وظلمة في القلب، وضيقًا في الرزق، وبُغضًا في قلوب الخلق ‘পুণ্য হচেছ মুখমন্ডলের লাবণ্য, অন্তরের জ্যোতি, জীবিকার প্রশস্ততা, দেহের শক্তি এবং স্রষ্টার হৃদয়ে মহববতের কারণ। আর পাপ হচ্ছে মুখমন্ডলে কালিমা, অন্তরের অন্ধকার, জীবিকার সংকোচন এবং স্রষ্টার হৃদয়ে অসন্তোষের কারণ’।[1]

২. আত্মমর্যাদাবোধ ক্ষুণ্ণ হয় :

ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, পুরুষ-মহিলা প্রত্যেক মানুষের মধ্যে আত্মসম্মানবোধ রয়েছে। হাদীছে এসেছে,

‘মুগীরাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, সা‘দ ইবনু উবাদাহ (রাঃ) বলেছেন, যদি আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে কোন পরপুরুষকে দেখি তবে আমি তাকে তরবারীর ধারালো দিক দিয়ে আঘাত করব। তার এ কথা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে পৌঁছলে তিনি বললেন, أَتَعْجَبُوْنَ مِنْ غَيْرَةِ سَعْدٍ، لأَنَا أَغْيَرُ مِنْهُ، وَاللهُ أَغْيَرُ مِنِّى. তোমরা কি সা‘দ-এর আত্মমর্যাদা- বোধে আশ্চর্য হচ্ছ? আমি ওর থেকে অধিক আত্মসম্মানী। আর আল্লাহ আমার থেকেও অধিক আত্মসম্মানের অধিকারী’।[2] আরেকটি হাদীছে এসেছে,

‘আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, কোন এক সময় রাসূল (ছাঃ) তার একজন স্ত্রীর কাছে ছিলেন। ঐ সময় উম্মুহাতুল মুমিনীনের আর একজন একটি পাত্রে কিছু খাদ্য পাঠালেন। যে স্ত্রীর ঘরে নবী করীম (ছাঃ) অবস্থান করছিলেন সে স্ত্রী খাদিমের হাতে আঘাত করলেন। ফলে খাদ্যের পাত্রটি পড়ে ভেঙ্গে গেল। নবী করীম (ছাঃ) পাত্রের ভাঙ্গা টুকরোগুলো কুড়িয়ে একত্রিত করলেন, তারপর খাদ্যগুলো কুড়িয়ে তাতে রাখলেন এবং বললেন, তোমাদের মায়ের আত্মর্যাদাবোধে আঘাত লেগেছে। তারপর তিনি খাদিমকে অপেক্ষা করতে বললেন এবং যে স্ত্রীর কাছে ছিলেন তাঁর নিকট হতে একটি পাত্র নিয়ে যার পাত্র ভেঙ্গেছিল, তার কাছে পাঠালেন এবং ভাঙ্গা পাত্রটি যে ভেঙ্গেছিল তার ঘরেই রেখে দিলেন।[3] পাপাচার তথা আল্লাহর অবাধ্যতা এই আত্মসম্মান- বোধ ক্ষুণ্ণ করে। ফলে মানুষ সমাজে মান-মর্যাদা হারায়।

৩. অপমান-অপদস্ত হওয়া :

মহান আল্লাহ সমস্ত ইয্যতের মালিক। সুতরাং তাঁর আনুগত্য করলে আল্লাহর ভালবাসা বৃদ্ধি পায়। ফলে বান্দাকে তিনি সম্মানিত করেন। পক্ষান্তরে আল্লাহর অবাধ্যতা করলে তাঁর অসন্তোষ বান্দার প্রতি আপতিত হয়। ফলে সে মানব সমাজে অপমানিত হয়। আল্লাহ বলেন,وَكَثِيرٌ حَقَّ عَلَيْهِ الْعَذَابُ وَمَنْ يُهِنِ اللهُ فَمَا لَهُ مِنْ مُكْرِمٍ، ‘আর বহু মানুষ আছে তাদের উপর শাস্তি অবধারিত হয়ে গেছে। বস্ত্ততঃ আল্লাহ যাকে লাঞ্ছিত করেন তাকে সম্মান দেওয়ার কেউ নেই’ (হজ্জ ২২/১৮)

রাসূল (ছাঃ) বলেন,جُعِلَ رِزْقِى تَحْتَ ظِلِّ رُمْحِى، وَجُعِلَ الذِّلَّةُ وَالصَّغَارُ عَلَى مَنْ خَالَفَ أَمْرِى، ‘আমার জীবিকা রাখা হয়েছে আমার বর্শার ছায়াতলে। অপমান ও লাঞ্ছনা রাখা হয়েছে আমার আদেশের বিরোধীদের জন্য’।[4]

৪.লজ্জাহীন হওয়া :

পাপাচার বান্দার লজ্জাশীলতা দুর্বল করে দেয়। ফলে তার নিকৃষ্টাবস্থা মানুষের গোচরে আসলে এবং তার পাপাচার জনগণ দেখে ফেললেও তার মধ্যে কোন ভাবান্তর তৈরী হয় না। এমনকি তাকে তার নিন্দনীয় অবস্থা ও অপকর্ম সম্পর্কে সতর্ক করা হ’লেও সে বিরত হয় না। এক সময় তার অবস্থা এমন পর্যায় পৌঁছে যে, অপকর্ম করতে সে আল্লাহকেও ভয় পায় না এবং মানুষকেও লজ্জা করে না। সে প্রকাশ্যে পাপাচার করে, কখনও গোপনে করলেও মানুষের কাছে প্রকাশ করে দেয়। তার মনে যা চায় সে তাই করে। আবূ মাসঊদ উকবাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ مِمَّا أَدْرَكَ النَّاسُ مِنْ كَلاَمِ النُّبُوَّةِ، إِذَا لَمْ تَسْتَحِى فَافْعَلْ مَا شِئْتَ. ‘আম্বিয়ায়ে কিরামের উক্তিসমূহ যা মানব জাতি লাভ করেছে, তার মধ্যে একটি হ’ল, ‘যদি তোমার লজ্জা না থাকে তাহ’লে তুমি যা ইচ্ছে তাই কর’।[5]

৫. পাপের কারণে হৃদয় অধঃপতিত হয় :

গোনাহের কারণে মানবহৃদয় অধঃপতিত হয়। ফলে সে বাতিলকে হক ও হককে বাতিল ভাবে এবং নিকৃষ্টকে উৎকৃষ্ট ও উৎকৃষ্টকে নিকৃষ্ট কাজ হিসাবে দেখে।

‘হুযায়ফা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, تُعْرَضُ الْفِتَنُ عَلَى الْقُلُوبِ كَالْحَصِيرِ عُودًا عُودًا، فَأَيُّ قَلْبٍ أُشْرِبَهَا، نُكِتَ فِيهِ نُكْتَةٌ سَوْدَاءُ، وَأَيُّ قَلْبٍ أَنْكَرَهَا، نُكِتَ فِيهِ نُكْتَةٌ بَيْضَاءُ، حَتَّى تَصِيرَ عَلَى قَلْبَيْنِ، عَلَى أَبْيَضَ مِثْلِ الصَّفَا فَلَا تَضُرُّهُ فِتْنَةٌ مَا دَامَتِ السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ، وَالْآخَرُ أَسْوَدُ مُرْبَادًّا كَالْكُوزِ، مُجَخِّيًا لَا يَعْرِفُ مَعْرُوفًا، وَلَا يُنْكِرُ مُنْكَرًا، إِلَّا مَا أُشْرِبَ مِنْ هَوَاهُ মানুষের হৃদয়ে চাটাইয়ের পাতা (ছিলকার) মত একটির পর একটি করে ক্রমান্বয়ে ফিতনার প্রাদুর্ভাব হবে। সুতরাং যে হৃদয়ে সে ফিতনা সঞ্চারিত হবে সে হৃদয়ে একটি কালো দাগ পড়ে যাবে এবং যে হৃদয় তার নিন্দা ও প্রতিবাদ করবে সে হৃদয়ে একটি সাদা দাগ অঙ্কিত হবে। পরিশেষে (সকল মানুষের) হৃদয়গুলি দুই শ্রেণীর হৃদয়ে পরিণত হবে। প্রথম শ্রেণীর হৃদয় হবে মসৃণ পাথরের ন্যায় সাদা; এমন হৃদয় আকাশ-পৃথিবী অবশিষ্ট থাকা অবধি কোন ফিতনা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। আর দ্বিতীয় শ্রেণীর হৃদয় হবে উপুড় করা কলসীর মত ছাই রঙের; এমন হৃদয় তার সঞ্চারিত ধারণা ছাড়া কোন ভালোকে ভালো বলে জানবে না এবং মন্দকে মন্দ মনে করবে না (তার প্রতিবাদও করবে না)।[6]

অন্তর নষ্ট হ’লে ইহকাল ও পরকালে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আল্লাহ বলেন, ‘সফল হয় সেই ব্যক্তি, যে তার নফসকে পরিশুদ্ধ করে। আর ব্যর্থ হয় সেই ব্যক্তি, যে তার নফসকে কলুষিত করে’ (শামস ৯১/৯-১০)

৬. বক্ষ সংকুচিত হয় :

যখন কোন ব্যক্তি পাপে লিপ্ত হয় এবং আল্লাহর আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তখন তার বক্ষ বা হৃদয় সংকুচিত হয়। আল্লাহ বলেন,فَمَنْ يُرِدِ اللهُ أَنْ يَهْدِيَهُ يَشْرَحْ صَدْرَهُ لِلْإِسْلَامِ وَمَنْ يُرِدْ أَنْ يُضِلَّهُ يَجْعَلْ صَدْرَهُ ضَيِّقًا حَرَجًا كَأَنَّمَا يَصَّعَّدُ فِي السَّمَاءِ كَذَلِكَ يَجْعَلُ اللهُ الرِّجْسَ عَلَى الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ، ‘অতএব আল্লাহ যাকে সুপথ প্রদর্শন করতে চান, তিনি তার বক্ষকে ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। আর যাকে তিনি পথভ্রষ্ট করতে চান, তার বক্ষকে তিনি সংকীর্ণ ও সংকুচিত করে দেন, যেন সে অতি কষ্টে আকাশে আরোহণ করছে। এভাবেই আল্লাহ অবিশ্বাসীদের উপর অপবিত্রতাকে চাপিয়ে দেন’ (আন‘আম ৬/১২৫)

৭. অন্তরে মরিচা পড়ে :

পাপের কারণে অন্তরে আবরণ পড়ে যায়। আর এটা তাকে তার রব থেকে ফিরিয়ে রাখে। হাদীছে এসেছে, আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ العَبْدَ إِذَا أَخْطَأَ خَطِيئَةً نُكِتَتْ فِي قَلْبِهِ نُكْتَةٌ سَوْدَاءُ، فَإِذَا هُوَ نَزَعَ وَاسْتَغْفَرَ وَتَابَ سُقِلَ قَلْبُهُ، وَإِنْ عَادَ زِيدَ فِيهَا حَتَّى تَعْلُوَ قَلْبَهُ، وَهُوَ الرَّانُ الَّذِي ذَكَرَ اللهُ {كَلَّا بَلْ رَانَ عَلَى قُلُوبِهِمْ مَا كَانُوا يَكْسِبُونَ} ‘বান্দা যখন একটি গুনাহ করে তখন তার অন্তরের মধ্যে একটি কালো চিহ্ন পড়ে। অতঃপর যখন সে গুনাহের কাজ পরিহার করে, ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং তওবা করে তখন তার অন্তর পরিষ্কার ও দাগমুক্ত হয়ে যায়। সে আবার পাপ করলে তার অন্তরে দাগ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তার পুরো অন্তর এভাবে কালো দাগে ঢেকে যায়। এটাই সেই মরিচা আল্লাহ তা‘আলা যার বর্ণনা করেছেন, ‘কখনো নয়, বরং তাদের কৃতকর্মই তাদের অন্তরে মরিচা ধরিয়েছে’ (মুত্বাফফিফীন ১৪)[7]

হাসান বছরী (রহঃ) বলেন, ‘এটা (পাপের প্রভাব) হচ্ছে, পাপের উপরে পাপ করা, এমনকি এতে অন্তর অন্ধ হয়ে যায়। ফলে তা মরিচাযুক্ত, বদ্ধ, তালাবদ্ধ ও মোহর মারা হয়ে যায়। যাতে অন্তরে আবরণ ও পর্দা পড়ে যায়। তখন শয়তান তার উপরে ক্ষমতাশীল হয়ে যায় এবং তাকে যেভাবে ইচ্ছা পরিচালনা করে’।

৮. মানব হৃদয়ে আল্লাহর মাহাত্ম্য দুর্বল করে :

পাপাচার মানব অন্তরে আল্লাহর বড়ত্ব-মাহাত্ম্য দুর্বল করে এবং তাঁর মার্যাদাকে খাটো করে দেয়। এর ফলে তাকে সৃষ্টির নিকটে আল্লাহ ভীতিকর ও হীন করে দেন। এছাড়া পাপাচার বান্দার প্রতি আল্লাহর বিস্মৃতি আবশ্যিক করে। আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَلْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَا قَدَّمَتْ لِغَدٍ وَاتَّقُوا اللهَ إِنَّ اللهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ، وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ نَسُوا اللهَ فَأَنْسَاهُمْ أَنْفُسَهُمْ أُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ، ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আর প্রত্যেক ব্যক্তির উচিৎ এ বিষয়ে ভেবে দেখা যে, সে আগামী দিনের জন্য কি অগ্রিম প্রেরণ করছে? আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে সম্যক অবহিত। আর তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে। অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে আত্মভোলা করে দিয়েছেন। ওরাই হ’ল অবাধ্য’(হাশর ৫৯/১৮-১৯)

খ. দুনিয়াবী জীবনে বান্দার উপরে পাপের প্রভাব

১. পাপের পুনরাবৃত্তি :

পাপী একটা পাপ করে থেমে যায় না বরং একাধারে পাপ করতেই থাকে। কারণ পাপকে সে কিছুই মনে করে না। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন,إِنَّ الْمُؤْمِنَ يَرَى ذُنُوبَهُ كَأَنَّهُ قَاعِدٌ تَحْتَ جَبَلٍ يَخَافُ أَنْ يَقَعَ عَلَيْهِ، وَإِنَّ الْفَاجِرَ يَرَى ذُنُوبَهُ كَذُبَابٍ مَرَّ عَلَى أَنْفِهِ. ‘ঈমানদার ব্যক্তি তার গুনাহগুলোকে এত বিরাট মনে করে, যেন সে একটা পর্বতের নীচে উপবিষ্ট আছে, আর সে আশঙ্কা করছে যে, সম্ভবত পর্বতটা তার উপর ধ্বসে পড়বে। আর পাপিষ্ঠ ব্যক্তি তার গুনাহগুলোকে মাছির মত মনে করে, যা তার নাকের উপর দিয়ে চলে যায়’।[8] ফলে পাপী একের পর এক পাপ করেই যায়। যেমন ধূমপায়ী একবার পান করে, সূদখোর একবার সূদ খেয়ে এবং ব্যভিচারী একবার করে বিরত হয় না। বরং তাদের পাপ বাড়তে থাকে।

হাসান বাছরী (রহ.) বলেন, ‘নেক আমলের প্রতিদান হ’ল সেই আমলের পরে আরেকটি নেক আমল করতে পারা। আর পাপের পরিণাম হ’ল সেই পাপের পরে আরেকটি পাপ করে ফেলা। কারণ আল্লাহ যখন কোন বান্দাকে কবুল করে নেন, তখন তাকে তাঁর আনুগত্য করার তাওফীক্ব দেন এবং তাকে পাপ থেকে দূরে রাখেন’।[9]

প্রখ্যাত তাবেঈ ‘উরওয়া ইবনু যুবাইর (রহঃ) বলেন,إِذَا رَأَيْتَ الرَّجُلَ يَعْمَلُ الْحَسَنَةَ فَاعْلَمْ أَنَّ لَهَا عِنْدَهُ أَخَوَاتٍ فَإِذَا رَأَيْتَهُ يَعْمَلُ السَّيِّئَةَ فَاعْلَمْ أَنَّ لَهَا عِنْدَهُ أَخَوَاتٍ فَإِنَّ الْحَسَنَةَ تَدُلُّ عَلَى أَخَوَاتِهَا وَإِنَّ السَّيِّئَةَ تَدُلُّ عَلَى أَخَوَاتِهَا، ‘তুমি যদি কোন ব্যক্তিকে নেক আমল করতে দেখ, তবে জেনে রেখ- তার আরো নেক আমল রয়েছে। আর যদি কোন ব্যক্তিকে পাপ করতে দেখ, তবে বুঝে নিও, তার আরো অনেক পাপ রয়েছে। কেননা একটি নেক আমল তার সমপর্যায়ের অন্য নেক আমলের প্রতি নির্দেশ করে এবং একটি পাপ অন্যান্য পাপের দিকে নির্দেশ করে’।[10]

২. আল্লাহ কর্তৃক বান্দাকে ভুলে যাওয়া :

বান্দা আল্লাহর অবাধ্যতা করলে তিনি বান্দাকে ভুলে যান। কারণ পাপ করার অর্থ হ’ল আল্লাহকে ও তাঁর মাহাত্ম্যকে ভুলে যাওয়া। আল্লাহ বলেন,وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ نَسُوا اللهَ فَأَنْسَاهُمْ أَنْفُسَهُمْ أُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ، ‘আর তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে। অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে আত্মভোলা করে দিয়েছেন। ওরাই হ’ল অবাধ্য’ (হাশর ৫৯/১৮-১৯)। তিনি আরো বলেন, نَسُوا اللهَ فَنَسِيَهُمْ ‘তারা আল্লাহকে ভুলে গেছে। ফলে আল্লাহ তাদের ভুলে গেছেন’ (তওবা ৯/৬৭)

৩. আল্লাহর রহমত ও নে‘মত থেকে বঞ্চিত করে :

পাপাচার তথা আল্লাহর অবাধ্যতা তাঁর রহমত ও নে‘মত থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণ। আল্লাহ বলেন,وَمَا أَصَابَكُمْ مِنْ مُصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُو عَنْ كَثِيرٍ، ‘তোমাদের যেসব বিপদাপদ হয়, তা তোমাদেরই কৃতকর্মের ফল। আর তিনি তোমাদের অনেক পাপই মার্জনা করে দেন’ (আশ-শূরা ৪২/৩০)। তিনি আরো বলেন,ذَلِكَ بِأَنَّ اللهَ لَمْ يَكُ مُغَيِّرًا نِعْمَةً أَنْعَمَهَا عَلَى قَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِمْ وَأَنَّ اللهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ، ‘এটা এজন্য যে, আল্লাহ কোন সম্প্রদায়ের উপর কোন নে‘মত দান করলে তার পরিবর্তন ঘটান না, যতক্ষণ না তারা নিজেরা সেটা পরিবর্তন করে। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (আনফাল ৮/৫৩)

৪. আযাব অবধারিত করে :

মহান আল্লাহ আমাদের স্রষ্টা, রিযিক দাতা, পালনকর্তা। সুতরাং আনুগত্য করলে ও তাঁর বিধান মোতাবেক চললে, তাঁর সন্তোষ লাভ হয় ও জান্নাতে প্রবেশ করা যায়। পক্ষান্তরে তাঁর অবাধ্যতা করলে তাঁর আযাবের সম্মুখীন হ’তে হয়, জাহান্নামে যেতে হয়। সুলায়মান বলেন, জনৈক ছাহাবী সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,لَنْ يَهْلَكَ النَّاسُ حَتَّى يَعْذِرُوا، أَوْ يُعْذِرُوا مِنْ أَنْفُسِهِمْ، ‘মানুষের ব্যক্তিগত পাপাচার ব্যাপক না করা পর্যন্ত এবং তাদের কোন ওযর পেশ করার সুযোগ থাকা পর্যন্ত তারা ধ্বংস হবে না’।[11]

৫. পাপ রিযিক থেকে মাহরূম করে :

আল্লাহকে ভয় করলে ও তাঁর বিধান মানলে তিনি অগণিত রিযিক দান করেন। আল্লাহ বলেন,وَمَنْ يَتَّقِ اللهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا، وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ، ‘বস্ত্ততঃ যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য উপায় বের করে দেন। আর তিনি তাকে তার ধারণাতীত উৎস থেকে রিযিক প্রদান করে থাকেন’ (তালাক ৬৫/২-৩)। অতএব যে ব্যক্তি আল্লাকে ভয় করে না, তার জন্য আল্লাহ কোন পথ বের করে দেন এবং তাকে অকল্পনীয় উৎস থেকে রিযক দেন না।

৬. সম্পদের বরকত দূরীভূত হয় :

সততা ও ন্যায়পরায়ণতা সম্পদে বরকত বৃদ্ধি পায়। অপরদিকে পাপাচার ও অবাধ্যতা সম্পদের বরকত দূরীভূত হয়। হাদীছে এসেছে,

‘হাকীম ইবনু হিযাম (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, الْبَيِّعَانِ بِالْخِيَارِ مَا لَمْ يَتَفَرَّقَا أَوْ قَالَ حَتَّى يَتَفَرَّقَا فَإِنْ صَدَقَا وَبَيَّنَا بُورِكَ لَهُمَا فِى بَيْعِهِمَا، وَإِنْ كَتَمَا وَكَذَبَا مُحِقَتْ بَرَكَةُ بَيْعِهِمَا যতক্ষণ উভয়ে বিচ্ছিন্ন না হবে ততক্ষণ ক্রেতা-বিক্রেতার ইখতিয়ার থাকবে। যদি তারা সত্য বলে ও যথাযথ অবস্থা বর্ণনা করে তবে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত হবে, আর যদি পণ্যের প্রকৃত অবস্থা গোপন করে ও মিথ্যা বলে তবে ক্রয়-বিক্রয়ের বরকত চলে যাবে।[12]

৭. দুনিয়াতে জীবন যাপন সংকীর্ণ হয় :

আল্লাহর বিধান অমান্য করলে দুনিয়াবী জীবন সংকীর্ণ হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন,وَمَنْ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنْكًا، ‘আর যে ব্যক্তি আমার কুরআন হ’তে মুখ ফিরিয়ে নিবে, তার জীবিকা হবে সংকুচিত’ (তোয়াহা ২০/১২৪)

৮. রোগ-ব্যাধি ও কষ্টভোগ :

পাপের কারণে সমাজে নানা দুরারোগ্য ব্যাধির বিস্তার ঘটে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَا مِنْ قَوْمٍ يُعْمَلُ فِيهِمْ بِالْمَعَاصِي، هُمْ أَعَزُّ مِنْهُمْ وَأَمْنَعُ، لَا يُغَيِّرُونَ، إِلَّا عَمَّهُمُ اللهُ بِعِقَابٍ، ‘কোন জাতির মধ্যে যখন প্রকাশ্যে পাপাচার হ’তে থাকে এবং তাদের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাদের পাপাচারীদের বাধা দেয় না, তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর ব্যাপকভাবে শাস্তি পাঠান’।[13]

অন্যত্র তিনি বলেন,لَمْ تَظْهَرِ الْفَاحِشَةُ فِي قَوْمٍ قَطُّ، حَتَّى

يُعْلِنُوا بِهَا، إِلَّا فَشَا فِيهِمُ الطَّاعُونُ، وَالْأَوْجَاعُ الَّتِي لَمْ تَكُنْ مَضَتْ فِي أَسْلَافِهِمُ الَّذِينَ مَضَوْا، ‘যখন কোন জাতির মধ্যেপ্রকাশ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে তখন সেখানে মহামারী আকারে প্লেগরোগের প্রাদুর্ভাব হয়। তাছাড়া এমন সব ব্যাধির উদ্ভব হয়, যা পূর্বেকার লোকেদের মধ্যে কখনো দেখা যায়নি’।[14] তিনি আরো বলেন,ما اخْتَلَجَ عِرْقٌ ولا عينٌ إلا بذنبٍ، وما يَدْفَعُ الله عنه أكثر. ‘দেহের শিরায় খিচুনী (ধনুষ্টঙ্কার) ও চোখের (পাতায়) কম্পন কেবল পাপের কারণেই হয়ে থাকে। আর তার থেকে আল্লাহ অনেক কিছু সারিয়ে দেন’।[15]

[ক্রমশঃ]


[1]. ইবনু তায়মিয়াহ, আমরাযুল কুলূব ওয়া শিফাউহা, পৃঃ ৭।

[2]. বুখারী হা/৬৮৪৬, ৭৪১৬; মুসলিম হা/১৪৯৯; মিশকাত হা/৩৩০৯।

[3]. বুখারী হা/৫২২৫, ২৪৮১; আবুদাউদ হা/৩৫৬৭; মিশকাত হা/২৯৪০।

[4]. বুখারী তা‘লীক, অনুচ্ছেদ-৮৮; আহমাদ হা/৫১১৪-১৫, ৫৬৬৭; ছহীহুল জামে‘ হা/২৮৩১।

[5]. বুখারী হা/৩৪৮৩-৮৪, ৬১২০; মিশকাত হা/৫০৭২।

[6]. মুসলিম হা/১৪৪; আহমাদ হা/২৩৩২৮; মিশকাত হা/৫৩৮০।

[7]. তিরমিযী হা/৩৩৩৪; ছহীহুত তারগীব হা/১৬২০, সনদ হাসান।

[8]. বুখারী হা/৬৩০৮; তিরমিযী হা/২৪৯৭; মিশকাত হা/২৩৫৮।

[9]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মিফতাহু দারিস সা‘আদাহ, ১/২৯৯।

[10]. হিলয়াতুল আওলিয়া ২/১৭৭; ইবনুল জাওযী ছিফাতুছ ছাফওয়া ১/৩৪৯।

[11]. আবুদাউদ হা/৪৩৪৭; মিশকাত হা/৫১৪৬; ছহীহুল জামে‘ হা/৫২৩১।

[12]. বুখারী হা/২০৭৯; ২০৮২; মুসলিম হা/১৫৩২; মিশকাত হা/২৮০২।

[13]. ইবনু মাজাহ হা/৪০০৯; আহমাদ হা/১৮৭৩১, ১৮৭৬৮, সনদ হাসান।

[14]. ইবনু মাজাহ হা/৪০১৯; ছহীহাহ হা/১০৬।

[15]. ত্বাবারানী, ছগীর, ছহীহাহ হা/২২১৫; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৫২১।






কুরবানীর মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
যুবসমাজের অধঃপতন : কারণ ও প্রতিকার - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
বিদায়ের আগে রেখে যাও কিছু পদচিহ্ন (৭ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
মুহাররম ও আশূরা : করণীয় ও বর্জনীয় - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
মানবাধিকার ও ইসলাম (১৪তম কিস্তি) - শামসুল আলম
এক নযরে হজ্জ - আত-তাহরীক ডেস্ক
ইয়াতীম প্রতিপালন (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
আহলেহাদীছ আন্দোলন-এর পাঁচ দফা মূলনীতি : একটি বিশ্লেষণ (৩য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
আক্বীদা ও আহকামে হাদীছের প্রামাণ্যতা (৭ম কিস্তি) - মীযানুর রহমান মাদানী
জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপনের আবশ্যকতা (৫ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
আরব প্রিন্সদের উঁচু ভবন বানানোর প্রতিযোগিতা - রবার্ট ফিস্ক
কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে তাক্বলীদ (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
আরও
আরও
.