নফসের উপর যুলুম

উপস্থাপনা : পাপ ও সীমালংঘনের মাধ্যমে নফসের উপর যুলুম হয়ে থাকে। আল্লাহর বিধানের অবজ্ঞা ও রাসূল (ছাঃ)-এর আদেশ-নিষেধ অমান্য করার মাধ্যমে তথা আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখাকে অতিক্রম করার মাধ্যমে যুলুম হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন,وَمَنْ يَّتَعَدَّ حُدُوْدَ اللهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ- ‘বস্ত্ততঃ যারা আল্লাহর সীমারেখা সমূহ অতিক্রম করে, তারা হ’ল যালেম তথা সীমালংঘনকারী’ (বাক্বারাহ ২/২২৯)

‘নফসের উপর যুলুম’ অর্থ শরী‘আতের সীমালংঘন করে মানুষের এমন কোন পাপের কথা বলা বা এমন কোন পাপকর্ম করা, যার পাপভার তার নিজের উপর বর্তায়। যেমন- তালাক বিষয়ে আলোচনার পর মহান আল্লাহ বলেন, وَتِلْكَ حُدُودُ اللهِ وَمَنْ يَّتَعَدَّ حُدُودَ اللهِ فَقَدْ ظَلَمَ نَفْسَهُ، ‘এগুলি হ’ল আল্লাহর সীমারেখা। যে ব্যক্তি আল্লাহর সীমারেখা লংঘন করে, সে তার নিজের উপর যুলুম করে’ (তালাক ৬৫/১)। অন্যত্র তিনি বাগান মালিকের দম্ভের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন,وَدَخَلَ جَنَّتَهُ وَهُوَ ظَالِمٌ لِّنَفْسِهِ قَالَ مَآ أَظُنُّ أَنْ تَبِيدَ هَذِهِ أَبَدًا- ‘অতঃপর সে তার বাগানে প্রবেশ করল নিজের উপর যুলুম করা অবস্থায়। সে (বড়াই করে) বলল, আমি মনে করি না যে, এটা কখনো ধ্বংস হবে’ (কাহ্ফ ১৮/৩৫)। আলোচ্য প্রবন্ধে নফসের উপর যুলুম ও এ থেকে প্রতিকারের উপায় আলোচনা করা হ’ল-

সবচাইতে কঠিন যুলুম হ’ল নফসের উপর যুলুম : আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করার ফলে নফসের উপর যুলুম হয়। যেমন বনু ইস্রাঈলের উপরে আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ অনুগ্রহ সমূহের বর্ণনা এবং তাদের নিজেদের নফসের উপর যুলুমের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন,وَظَلَّلْنَا عَلَيْكُمُ الْغَمَامَ وَأَنْزَلْنَا عَلَيْكُمُ الْمَنَّ وَالسَّلْوَى كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ وَمَا ظَلَمُونَا وَلَكِنْ كَانُوْآ أَنْفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ- ‘আর আমরা তোমাদের উপর মেঘমালা দিয়ে ছায়া করেছিলাম এবং তোমাদের জন্য ‘মানণা’ ও ‘সালওয়া’ নাযিল করেছিলাম। অতএব আমরা তোমাদেরকে যে রূযী দান করেছি, তা থেকে পবিত্র বস্ত্তসমূহ ভক্ষণ কর। বস্ত্ততঃ তারা আমাদের উপর যুলুম করেনি, বরং তারাই নিজেদের উপরই যুলুম করেছিল’ (বাক্বারাহ ২/৫৭)। নিম্নে কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হ’ল-

রাণী বিলক্বীসের নফসের উপর যুলুম ও ক্ষমা প্রার্থনা : রাণী বিলক্বীস পূর্বে কাফের সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সে আল্লাহর পরিবর্তে যার পূজা করত, সেই-ই তাকে ঈমান থেকে বিরত রেখেছিল। অতঃপর নবী সুলায়মান (আঃ)-এর

* প্রিন্সিপাল, মারকাযুস সুন্নাহ আস-সালাফী, পূর্বাচল, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।

দাওয়াতে তার ভুল ভাঙ্গে। আল্লাহ বলেন,قِيلَ لَهَا ادْخُلِي الصَّرْحَ فَلَمَّا رَأَتْهُ حَسِبَتْهُ لُجَّةً وَّكَشَفَتْ عَنْ سَاقَيْهَا قَالَ إِنَّهُ صَرْحٌ مُّمَرَّدٌ مِّنْ قَوَارِيرَ قَالَتْ رَبِّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي وَأَسْلَمْتُ مَعَ سُلَيْمَانَ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ- ‘তাকে বলা হ’ল প্রাসাদে প্রবেশ করুন! অতঃপর যখন সে তার প্রতি দৃষ্টিপাত করল, তখন সে (আঙিনাকে) ধারণা করল পানি এবং সে তার দু’পায়ের গোছা উন্মুক্ত করল। তখন সুলায়মান বলল, এটা তো স্বচ্ছ কাঁচ নির্মিত প্রাসাদ। রাণী বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমি তো নিজের প্রতি যুলুম করেছি। আমি সুলায়মানের সাথে জগত সমূহের প্রতিপালক আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ করলাম’ (নামল ২৭/৪৪)

মূসা (আঃ)-এর নফসের উপর যুলুম ও ক্ষমা প্রার্থনা : মূসা (আঃ) দুইজন লোককে লড়াইরত দেখলেন। তাদের একজন ছিল তার নিজ গোত্রের। অপরজন ছিল তার শত্রু পক্ষের। অতঃপর নিজ গোত্রের লোকটি তার নিকটে তার শত্রুর বিরুদ্ধে সাহায্য চাইল। তখন মূসা (আঃ) তাকে ঘুষি মারলেন। তাতেই সে মারা গেল। মূসা (আঃ) বললেন, এটি শয়তানের কাজ। কেননা সে মানুষের প্রকাশ্য শত্রু ও পথভ্রষ্টকারী। এই হত্যাকান্ডের খবর কেবল ঐ ইস্রাঈলী জানত। ফলে এ সময় তার মুখে ঐ কথা শুনে ক্বিবতী দ্রুত গিয়ে ফেরাঊনের নিকট ঐ তথ্য ফাঁস করে দিল। তখন ফেরাঊনের লোকেরা মূসা (আঃ)-কে হত্যার সিদ্ধান্ত নিল। তখন মূসা (আঃ) প্রার্থনা করলেন। যেমন আল্লাহ বলেন,قَالَ رَبِّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي فَاغْفِرْ لِي فَغَفَرَ لَهُ إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ- ‘সে বলল, হে আমার পালনকর্তা! আমি আমার নিজের উপর যুলুম করেছি। অতএব তুমি আমাকে ক্ষমা কর! তখন আল্লাহ তাকে ক্ষমা করলেন। নিশ্চয়ই তিনি তো ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (ক্বাছাছ ২৮/১৬)

ইউনুস (আঃ)-এর নফসের উপর যুলুম ও ক্ষমা প্রার্থনা : আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশনা আসার পূর্বেই ইউনুস (আঃ) নির্দিষ্ট এলাকা ত্যাগ করেন। ফলে তাকে পরীক্ষায় পড়তে হয়েছিল। আল্লাহ বলেন,وَذَا النُّونِ إِذْ ذَّهَبَ مُغَاضِبًا فَظَنَّ أَنْ لَنْ نَّقْدِرَ عَلَيْهِ فَنَادَى فِي الظُّلُمَاتِ أَنْ لَّآ إِلَهَ إِلَّآ أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ- فَاسْتَجَبْنَا لَهُ وَنَجَّيْنَاهُ مِنَ الْغَمِّ وَكَذَالِكَ نُنْجِي الْمُؤْمِنِيْنَ- ‘আর (স্মরণ কর) মাছওয়ালা (ইউনুস)-এর কথা। যখন সে ক্রুদ্ধ অবস্থায় চলে গিয়েছিল এবং বিশ্বাসী ছিল যে, আমরা তাকে কোন কষ্টে ফেলব না। অতঃপর সে (মাছের পেটে) ঘন অন্ধকারের মধ্যে আহবান করল (হে আল্লাহ!) তুমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তুমি পবিত্র। আর নিশ্চয়ই আমি সীমালংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত। অতঃপর আমরা তার দো‘আ কবুল করলাম এবং তাকে দুশ্চিন্তা হ’তে মুক্ত করলাম। আর এভাবেই আমরা বিশ্বাসীদের মুক্তি দিয়ে থাকি’ (আম্বিয়া ২১/৮৭-৮৮)

নফসের উপরে যুলুমের মাধ্যমসমূহ :

শিরকের মাধ্যমে নফসের উপর যুলুম : লোকমান হাকীম স্বীয় পুত্রকে উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন,يَابُنَيَّ لاَ تُشْرِكْ بِاللهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ- ‘হে বৎস! আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না। নিশ্চয়ই শিরক হ’ল বড় যুলুম’ (লোক্বমান ৩১/১৩)। আল্লাহ বলেন,اَلَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوآ إِيمَانَهُمْ بِظُلْمٍ أُولَئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُمْ مُّهْتَدُونَ- ‘যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানের সাথে শিরককে মিশ্রিত করেনি, তাদের জন্যই রয়েছে নিরাপত্তা এবং তারাই সুপথপ্রাপ্ত’ (আন‘আম ৬/৮২)। অতএব শিরকের মাধ্যমে নফসের উপর যুলুম করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

রিয়া-শ্রুতির মাধ্যমে নফসের উপর যুলুম : লোক দেখানো ও শুনানোর উদ্দেশ্যে কাজ করা শিরক। এটা শিরকে আছগার বা ছোট শিরক। আর এই রিয়া-শ্রুতির মাধ্যমে নফসের উপর যুলুম হয়ে থাকে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,أَيُّهَا النَّاسُ! إِيَّاكُمْ وَشِرْكَ السَّرَائِرِ، قَالُوا : يَا رَسُولَ اللهِ وَمَا شِرْكُ السَّرَائِرِ؟ قَالَ : يَقُومُ الرَّجُلُ فَيُصَلِّي فَيُزَيِّنُ صَلاَتَهُ جَاهِدًا لِمَا يَرَى مِنْ نَظَرِ النَّاسِ إِلَيْهِ، فَذَالِكَ شِرْكُ السَّرَائِرِ- ‘হে জনগণ! তোমরা গোপন শিরক থেকে সাবধান হও! ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! গোপন শিরক কি? তিনি বললেন, মানুষ ছালাতে দাঁড়িয়ে তার ছালাতকে সুশোভিত করতে সচেষ্ট হয় এই কারণে যে, লোকেরা তার প্রতি দৃষ্টিপাত করবে। অতএব এটাই হ’ল গোপন শিরক’।[1] তিনি আরো বলেন,أَيُّهَا النَّاسُ! اِتَّقُوا هَذَا الشِّرْكَ؛ فَإِنَّهُ أَخْفَى مِنْ دَبِيبِ النَّمْلِ. فَقَالَ لَهُ : مَنْ شَاءَ اللهُ أَنْ يَّقُولَ وَكَيْفَ نَتَّقِيهِ وَهُوَ أَخْفَى مِنْ دَبِيبِ النَّمْلِ يَا رَسُولَ اللهِ؟ قَالَ : قُولُوا : اَللَّهُمَّ إِنَّا نَعُوذُبِكَ مِنْ أَنْ نُشْرِكَ بِكَ شَيْئًا نَعْلَمُهُ، وَنَسْتَغْفِرُكَ لِمَا لاَ نَعْلَمُ- ‘হে জনগণ! তোমরা এই শিরককে ভয় কর। কেননা তা পিপীলিকার চলার শব্দ থেকেও গোপন ও সূক্ষ্ম। একজন বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! কিভাবে আমরা তা থেকে বেঁচে থাকব, অথচ সেটা পিপীলিকা চলার শব্দের চেয়েও অধিক সূক্ষ্ম? তিনি বললেন, তোমরা এই দো‘আ বল,اللَّهُمَّ إِنَّا نَعُوذُ بِكَ مِنْ أَنْ نُشْرِكَ بِكَ شَيْئًا نَعْلَمُهُ، وَنَسْتَغْفِرُكَ لِمَا لاَ نَعْلَمُ- ‘হে আল্লাহ জেনে-শুনে কোন কিছুকে তোমার সাথে শরীক করা থেকে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি এবং না জেনে শিরক হয়ে গেলে তা থেকেও তোমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি’।[2]

অহি-র বিধান থেকে বিমুখ হওয়া যুলুম : পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অনুসরণ করা প্রতিটি মুসলিমের জন্য আবশ্যক। কেননা অহি-র বিধান থেকে বিমুখ হওয়া যুলুম। আল্লাহ বলেন, وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ ذُكِّرَ بِآيَاتِ رَبِّهِ فَأَعْرَضَ عَنْهَا، ‘তার চাইতে অধিক যালেম আর কে আছে, যাকে তার প্রতিপালকের আয়াতসমূহ দ্বারা উপদেশ দেওয়া হয়, অতঃপর সে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়’ (কাহফ ১৮/৫৭)। তিনি বলেন,فَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ كَذَّبَ بِآيَاتِ اللهِ وَصَدَفَ عَنْهَا سَنَجْزِي الَّذِينَ يَصْدِفُونَ عَنْ آيَاتِنَا سُوءَ الْعَذَابِ بِمَا كَانُوا يَصْدِفُونَ- ‘অতঃপর তার চাইতে বড় যালেম আর কে আছে, যে আল্লাহর আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করে ও তা এড়িয়ে চলে? যারা আমাদের আয়াতসমূহকে এড়িয়ে চলে, সত্বর আমরা তাদেরকে এড়িয়ে চলার মর্মন্তুদ শাস্তি প্রদান করব’ (আন‘আম ৬/১৫৭)

কৃপণতার মাধ্যমে নফসের উপর যুলুম : কৃপণ ব্যক্তি মানবতার দুশমন। কৃপণকে কেউই ভালোবাসে না। সার্বিক জীবনে সে ব্যর্থ। আল্লাহ বলেন,وَمَنْ يُّوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ- ‘যারা হৃদয়ের কার্পণ্য হ’তে মুক্ত, তারাই সফলকাম’ (হাশর ৫৯/৯)। রাসূল (ছাঃ) বলেন,اِتَّقُوا الظُّلْمَ فَإِنَّ الظُّلْمَ ظُلُمَاتٌ يَّوْمَ الْقِيَامَةِ، وَاتَّقُوا الشُّحَّ فَإِنَّ الشُّحَّ أَهْلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ، حَمَلَهُمْ عَلَى أَنْ سَفَكُوا دِمَاءَهُمْ وَاسْتَحَلُّوا مَحَارِمَهُمْ- ‘তোমরা যুলুম থেকে বেঁচে থাক। কেননা যুলুম ক্বিয়ামতের দিন ঘন অন্ধকার হয়ে দেখা দিবে। আর কৃপণতা থেকে বেঁচে থাক। কেননা কৃপণতা তোমাদের পূর্ববর্তীদের ধ্বংস করেছে। এই কৃপণতাই তাদেরকে রক্ত প্রবাহিত করতে প্ররোচিত করেছিল (তখন তারা সেটা করেছে)। তাদের উপর হারামকৃত বস্ত্তসমূহ হালাল করতে প্রলুব্ধ করেছিল’।[3]

অপচয়ের মাধ্যমে নফসের উপর যুলুম : অপচয় ও অপব্যয় কোনটিই কাম্য নয়। কারণ অপচয়ের মাধ্যমে নফসের উপর যুলুম করা হয়। অপচয়কারী শয়তানের ভাই। আল্লাহ বলেন,وَالَّذِينَ إِذَآ أَنْفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذَالِكَ قَوَامًا- ‘আর যখন তারা ব্যয় করে, তখন অপব্যয় করে না এবং কৃপণতাও করে না। বরং এ দু’য়ের মধ্যবর্তী পথ অবলম্বন করে’ (ফুরক্বান ২৫/৬৭)। মহান আল্লাহর প্রকৃত বান্দাদের গুণাবলী বলতে গিয়ে অনেক গুণের সাথে এ দু’টিও উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ রহমানের প্রকৃত বান্দা হ’তে হ’লে অপচয় বা কৃপণতা কোনটিই করা যাবে না। করলে এটি তার নফসের উপর যুলুম হিসাবে গণ্য হবে।

কুচিন্তার মাধ্যমে নফসের উপর যুলুম : মনের গহীনে উত্থিত কুচিন্তার কারণে নফসের উপর যুলুম হয়ে থাকে। ফলে ক্বলবে কালো দাগ পড়ে যায়। রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِنَّ اللهَ تَجَاوَزَ عَنْ أُمَّتِي مَا حَدَّثَتْ بِهِ أَنْفُسَهَا مَا لَمْ تَعْمَلْ أَوْ تَتَكَلَّمْ- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা আমার উম্মতের মনের ওয়াসওয়াসাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন, এটি আমলে পরিণত করা বা মুখে উচ্চারণ না করা পর্যন্ত’।[4]

পাপ ও সীমালংঘনের মাধ্যমে নফসের উপর যুলুম : পাপ ও সীমালংঘনের মাধ্যমে নফসের উপর যুলুম হয়ে থাকে। যার ফলে রিযিক সঙ্কুচিত হয়ে যায়। রাসূল (ছাঃ) বলেন,لاَ يَرُدُّ الْقَدَرَ إِلاَّ الدُّعَاءُ وَلاَ يَزِيدُ فِي الْعُمْرِ إِلاَّ الْبِرُّ وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيُحْرَمُ الرِّزْقَ بِالذَّنْبِ يُصِيبُهُ- ‘কেবল দো‘আর মাধ্যমেই তাক্বদীর পরিবর্তন হয়, সৎ আমলের মাধ্যমে বয়স বৃদ্ধি পায় এবং মানুষ পাপকর্মের কারণে রূযী থেকে বঞ্চিত হয়’।[5] পাপ ও সীমালংঘনের কারণে রূযী সংঙ্কুচিত হওয়ার তাৎপর্য হচ্ছে সে নিজের কর্মদোষে নিজ নফসের উপর যুলুম করে চলেছে।

পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়ার মাধ্যমে নফসের উপর যুলুম : পিতা-মাতা সন্তানের জন্য রহমত স্বরূপ। পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া কবীরা গুনাহ। পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়ার মাধ্যমে নফসের উপর যুলুম হয়ে থাকে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, رَغِمَ أَنْفُهُ رَغِمَ أَنْفُهُ رَغِمَ أَنْفُهُ، قِيلَ : مَنْ يَا رَسُولَ اللهِ؟ قَالَ : مَنْ أَدْرَكَ وَالِدَيْهِ عِنْدَ الْكِبَرِ أَحَدَهُمَا أَوْ كِلاَهُمَا ثمَّ لَمْ يَدْخُلِ الْجَنَّةَ- ‘তার নাক ধূলি ধূসরিত হৌক! তার নাক ধূলি ধূসরিত হেŠক! তার নাক ধূলি ধূসরিত হৌক! বলা হ’ল, কে সেই ব্যক্তি হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)? তিনি বললেন, যে ব্যক্তি তার পিতা-মাতা উভয়কে কিংবা একজনকে বৃদ্ধাবস্থায় পেল, অথচ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না’।[6]

জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন,صَعِدَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمِنْبَرَ فَلَمَّا رَقِيَ عَتَبَةً قَالَ آمِينَ!... ثُمَّ قَالَ : أَتَانِي جِبْرِيلُ فقَالَ... وَمَنْ أَدْرَكَ وَالِدَيْهِ أَوْ أَحَدَهُمَا فَدَخَلَ النَّارَ فَأَبْعَدَهُ اللهُ قُلْتُ آمِينَ! ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মিম্বরে আরোহণ করলেন। অতঃপর সিঁড়িতে পা দিয়ে বললেন, আমীন!... (ছাহাবীদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন) জিব্রীল আমাকে এসে বললেন, হে মুহাম্মাদ! যে ব্যক্তি তার পিতা-মাতাকে বা তাদের একজনকে পেল। কিন্তু তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করল না। ফলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করল। আল্লাহ তাকে স্বীয় রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দিলেন। তুমি বল, আমীন! তখন আমি বললাম, আমীন![7] পিতা-মাতার অবাধ্যতার মাধ্যমে সে নিজের প্রতি এতটাই যুলুম করে যে, যার পরিণাম হচ্ছে জাহান্নাম।

মানুষের গোপনীয়তা ফাঁস করে নফসের উপর যুলুম : এক মুমিন অপর মুমিনের জন্য আয়না স্বরূপ। দোষ-গুণে মিলেই মানুষ। মানুষ মাত্রই ভুলকারী। তবে মুমিনের এই ভুলের প্রচারণা করা মহা অন্যায়। মানুষের গোপনীয়তা ফাঁস করে নফসের উপর যুলুম করা হয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন,يَا مَعْشَرَ مَنْ أَسْلَمَ بِلِسَانِهِ وَلَمْ يُفْضِ الْإِيمَانُ إِلَى قَلْبِهِ لاَ تُؤْذُوا الْمُسْلِمِينَ وَلاَ تُعَيِّرُوهُمْ وَلاَ تَتَّبِعُوا عَوْرَاتِهِمْ فَإِنَّهُ مَنْ يَّتَّبِعْ عَوْرَةَ أَخِيهِ الْمُسْلِمِ يَتَّبِعِ اللهُ عَوْرَتَهُ وَمَنْ يَّتَّبِعِ اللهُ عَوْرَتَهُ يَفْضَحْهُ وَلَوْ فِي جَوْفِ رَحْلِهِ- ‘হে ঐ সমস্ত লোকেরা! যারা মুখে ইসলাম কবুল করেছ, কিন্তু অন্তরে এখনো ঈমান মযবূত হয়নি। তোমরা মুসলমানদের কষ্ট দিবে না, তাদের লজ্জা দিবে না এবং তাদের গোপন দোষ অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হবে না। কেননা যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের গোপন দোষ অনুসন্ধানে নিয়োজিত হবে, আল্লাহ তার গোপন দোষ প্রকাশ করে দিবেন। আর যে ব্যক্তির দোষ আল্লাহ প্রকাশ করে দিবেন তাকে অপমান করে ছাড়বেন, সে তার বাহনের ভিতরে অবস্থান করলেও’।[8]

বান্দার হক নষ্ট করে নফসের উপর যুলুম : হাক্কুল ইবাদ তথা বান্দার হক আদায় করা গুরুত্বপূর্ণ আমানত। এই আমানতের খেয়ানত মহান আল্লাহও ক্ষমা করেন না, যতক্ষণ না হকদার থেকে মাফ নেওয়া না হয়। সুতরাং বান্দার হক নষ্ট করা নফসের উপর যুলুমের শামিল। রাসূল (ছাঃ) একদিন ছাহাবীদের বললেন, ‘তোমরা কি জান নিঃস্ব কে? তারা বললেন, আমাদের মধ্যে নিঃস্ব সেই ব্যক্তি যার কোন টাকা-পয়সা ও ধন-সম্পদ নেই। তখন তিনি বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে নিঃস্ব সেই ব্যক্তি, যে দুনিয়া থেকে ছালাত-ছিয়াম, যাকাত ইত্যাদি আদায় করে আসবে। সাথে ঐসব লোকেরাও আসবে, যাদের কাউকে সে গালি দিয়েছে, কারো উপর অপবাদ দিয়েছে, কারো মাল গ্রাস করেছে, কাউকে হত্যা করেছে বা কাউকে প্রহার করেছে। তখন ঐসকল পাওনাদারকে ঐ ব্যক্তির নেকী থেকে পরিশোধ করা হবে। এভাবে পরিশোধ করতে করতে যদি তার নেকী শেষ হয়ে যায়, তখন ঐসকল লোকদের পাপসমূহ এই ব্যক্তির উপর চাপানো হবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’।[9] আলোচ্য হাদীছ থেকে বুঝা যায় যে, হাক্কুল ইবাদ বা বান্দার হক নষ্ট করার মাধ্যমে প্রকারান্তরে নিজের নফসের উপর যুলুম করা হয়। ফলে জান্নাতের পথযাত্রী জাহান্নামের খোরাকে পরিণত হয়।

নবী করীম (ছাঃ)-এর প্রতি দরূদ পাঠ না করে নফসের উপর যুলুম : নবী করীম (ছাঃ)-এর প্রতি দরূদ পাঠ করা গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। যার জন্য অশেষ নেকী ও ফযীলত রয়েছে। রাসূল (ছাঃ)-এর নাম শুনে তাঁর উপর দরূদ পাঠ না করা জঘন্য অপরাধ। যা নফসের উপর যুলুমের শামিল। রাসূল (ছাঃ) বলেন,رَغِمَ أَنْفُ رَجُلٍ ذُكِرْتُ عِنْدَهُ فَلَمْ يُصَلِّ عَلَيَّ، ‘ঐ ব্যক্তির নাক ধূলি ধূসরিত হৌক, যার নিকট আমার নাম উচ্চারিত হয়েছে, অথচ সে আমার প্রতি দরূদ পাঠ করেনি’।[10]

কবীরা গোনাহগার সবচাইতে বড় যালেম : বিভিন্ন গুনাহের বিভিন্ন স্তরভেদ রয়েছে। পাপের মাত্রানুযায়ী গুনাহ ছোট ও বড় হয়। বিভিন্ন ইবাদতের মাধ্যমে ছোট ছোট পাপরাশি মোচন হয়ে যায়। তবে বড় বড় পাপের জন্য তওবা করতে হয়। তওবা ব্যতীত কবীরা গোনাহ বা বড় পাপ মাফ হয় না। সেকারণ কবীরা গোনাহগার সবচাইতে বড় যালেম। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন,يَا رَسُولَ اللهِ! أَيُّ الذَّنْبِ أَكْبَرُ عِنْدَ اللهِ؟ قَالَ : أَنْ تَدْعُوَ لِلَّهِ نِدًّا وَهُوَ خَلَقَكَ، قَالَ : ثُمَّ أَيٌّ؟ قَالَ : ثُمَّ أَنْ تَقْتُلَ وَلَدَكَ مَخَافَةَ أَنْ يَطْعَمَ مَعَكَ، قَالَ : ثُمَّ أَيٌّ؟ قَالَ : أَنْ تُزَانِيَ حَلِيلَةَ جَارِكَ، فَأَنْزَلَ اللهُ تَصْدِيقَهَا : وَالَّذِينَ لاَ يَدْعُونَ مَعَ اللهِ إِلَهًا آخَرَ وَلاَ يَقْتُلُونَ النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللهُ إِلاَّ بِالْحَقِّ وَلاَ يَزْنُونَ وَمَنْ يََّفْعَلْ ذَالِكَ يَلْقَ أَثَامًا- يُضَاعَفْ لَهُ الْعَذَابُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَيَخْلُدْ فِيهِ مُهَانًا- ‘হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর নিকটে কোন্ গোনাহটি সবচেয়ে বড়? তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে কোন সমকক্ষ সাব্যস্ত করা। অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। লোকটি বলল, তারপর কোন্টি? তিনি বললেন, দারিদ্রে্যর কারণে তোমার সন্তানকে হত্যা করা এই ভয়ে যে, সে তোমার সাথে খাবে। জিজ্ঞেস করল, তারপর কোন্টি? তিনি বললেন, প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া। রাসূল (ছাঃ)-এর এ কথারই সত্যায়ন করে আল্লাহ নেক্কার লোকদের প্রশংসায় আয়াত নাযিল করেন, ‘আর যারা আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্যকে আহবান করে না। আর যারা আল্লাহ যাকে নিষিদ্ধ করেছেন তাকে সঙ্গত কারণ ব্যতীত হত্যা করে না’ (ফুরক্বান ২৫/৬৮-৬৯)[11]

নফসের উপর যুলুমকারী নিজেই দায়ী হবে : আমলে ছালেহ বাস্তবায়ন করতে পারা বান্দার উপর আল্লাহর বিশেষ এক রহমত। সেজন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা যরূরী। তবে শয়তানের বিস্তৃত জালের ফাঁদে আটকে গিয়ে কেউ নফসের উপর যুলুম করলে যুলুমকারী নিজেই এজন্য দায়ী হবে। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, আল্লাহ বলেন,يَا عِبَادِي لَوْ أَنَّ أَوَّلَكُمْ وَآخِرَكُمْ وَإِنْسَكُمْ وَجِنَّكُمْ كَانُوا عَلَى أَفْجَرِ قَلْبِ رَجُلٍ وَاحِدٍ، مَا نَقَصَ ذَالِكَ مِنْ مُلْكِي شَيْئًا، ...يَا عِبَادِي إِنَّمَا هِيَ أَعْمَالُكُمْ أُحْصِيهَا لَكُمْ، ثُمَّ أُوَفِّيكُمْ إِيَّاهَا، فَمَنْ وَجَدَ خَيْرًا، فَلْيَحْمَدِ اللهَ وَمَنْ وَجَدَ غَيْرَ ذَالِكَ، فَلاَ يَلُومَنَّ إِلاَّ نَفْسَهُ- ‘হে আমার বান্দাগণ! যদি তোমাদের প্রথম ও শেষ, মানুষ ও জিন তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা পাপাচারী ব্যক্তির অন্তরের ন্যায় অন্তর নিয়ে অনাচার করে এটা আমার রাজ্যের কিছুমাত্র ক্ষতি করতে পারবে না।... হে আমার বান্দাগণ! বাকী রইল তোমাদের ভাল-মন্দ আমল। এটা আমি তোমাদের জন্য যথাযথভাবে রক্ষা করি। অতঃপর তার প্রতিফল তোমাদের দিব পূর্ণভাবে। সুতরাং যে ব্যক্তি কোন ভাল কাজের তাওফীক লাভ করে, সে যেন আল্লাহর শোকর আদায় করে, আর যে ব্যক্তি মন্দ কর্ম করে, সে যেন নিজের নফসকে ব্যতীত কাউকেও তিরস্কার না করে’।[12]

প্রতিকার :

তওবা করা : ভুলবশত বা ইচ্ছাকৃত কোন পাপকর্ম হয়ে গেলে দ্রুততার সাথে তওবা করা আবশ্যক। যেমন আদি পিতা-মাতা আদম ও হাওয়া (আঃ) নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করার পর দ্রুততার সাথে তওবা করে প্রার্থনায় বলেন,رَبَّنَا ظَلَمْنَآ أَنْفُسَنَا وَإِنْ لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ- ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নিজেদের উপর যুলুম করেছি। এক্ষণে আপনি যদি আমাদের ক্ষমা না করেন ও দয়া না করেন, তাহ’লে আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব’ (আ‘রাফ ৭/২৩)

ছালাতের শেষ বৈঠকে ক্ষমা প্রার্থনা : বিশিষ্ট ছাহাবী আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বললাম,يَا رَسُولَ اللهِ عَلِّمْنِي دُعَاءً أَدْعُو بِهِ فِي صَلاَتِي، ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে এমন একটি দো‘আ শিক্ষা দিন, যা আমি ছালাতে পাঠ করব। তখন তিনি বললেন, তুমি বল,اَللَّهُمَّ إِنِّيْ ظَلَمْتُ نَفْسِيْ ظُلْمًا كَثِيْرًا وَّلاَ يَغْفِرُ الذُّنُوْبَ إِلاَّ أَنْتَ، فَاغْفِرْ لِيْ مَغْفِرَةً مِّنْ عِنْدِكَ وَارْحَمْنِيْ إِنَّكَ أَنْتَ الْغَفُوْرُ الرَّحِيْمُ- ‘হে আল্লাহ! আমি আমার নফসের উপরে অসংখ্য-অগণিত যুলুম করেছি। ঐসব গুনাহ মাফ করার কেউ নেই আপনি ব্যতীত। অতএব আপনি আমাকে আপনার পক্ষ হ’তে বিশেষভাবে ক্ষমা করুন এবং আমার উপরে অনুগ্রহ করুন। নিশ্চয়ই আপনি ক্ষমাশীল ও দয়াবান’।[13]

নফসের উপর যুলুমের পর ক্ষমা প্রার্থনা : মানুষ পাপ করার মাধ্যমে নিজ নফসের উপর যুলুম করে থাকে। আর মানুষ মাত্রই ভুলকারী। তাই এই ভুলের সাগরে হাবুডুবু না খেয়ে আল্লাহর পথে ত্বরিৎ ফিরে আসা উচিৎ। আল্লাহ বলেন,وَالَّذِيْنَ إِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوآ أَنْفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوبِهِمْ وَمَنْ يَّغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلاَّ اللهُ؟ وَلَمْ يُصِرُّوا عَلَى مَا فَعَلُوا وَهُمْ يَعْلَمُونَ- ‘যারা কখনো কোন অশ্লীল কাজ করলে কিংবা নিজের উপর কোন যুলুম করলে আল্লাহকে স্মরণ করে। অতঃপর স্বীয় পাপসমূহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। বস্ত্ততঃ আল্লাহ ব্যতীত পাপসমূহ ক্ষমা করার কে আছে? আর যারা জেনে-শুনে স্বীয় কৃতকর্মের উপর হঠকারিতা করে না’ (আলে ইমরান ৩/১৩৫)। অন্যত্র তিনি বলেন,وَمَنْ يَّعْمَلْ سُوْءًا أَوْ يَظْلِمْ نَفْسَهُ ثُمَّ يَسْتَغْفِرِ اللهَ يَجِدِ اللهَ غَفُوْرًا رَّحِيْمًا- ‘যে কেউ দুষ্কর্ম করে অথবা স্বীয় নফসের প্রতি যুলুম করে, অতঃপর আল্লাহর নিকট ক্ষমাপ্রার্থী হয়, সে আল্লাহকে ক্ষমাশীল ও দয়ালু পাবে’ (নিসা ৪/১১০)

তিনি আরো বলেন,وَلَوْ أَنَّهُمْ إِذْ ظَّلَمُوآ أَنْفُسَهُمْ جَآءُوكَ فَاسْتَغْفَرُوا اللهَ وَاسْتَغْفَرَ لَهُمُ الرَّسُولُ لَوَجَدُوا اللهَ تَوَّابًا رَّحِيمًا- ‘আর যদি তারা নিজেদের নফসের উপর যুলুম করার পর তোমার নিকটে আসত, অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করত এবং রাসূলও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেন, তাহ’লে তারা অবশ্যই আল্লাহ্কে তওবা কবুলকারী ও দয়াশীলরূপে পেত’ (নিসা ৪/৬৪)। আল্লাহ বলেন,وَأَقِمِ الصَّلاَةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِّنَ اللَّيْلِ إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ ذَالِكَ ذِكْرَى لِلذَّاكِرِينَ- ‘আর তুমি ছালাত কায়েম কর দিনের দুই প্রান্তে ও রাত্রির কিছু অংশে। নিশ্চয়ই সৎকর্মসমূহ মন্দ কর্মসমূহকে বিদূরিত করে। আর এটি (কুরআন) হ’ল উপদেশ গ্রহণকারীদের জন্য সর্বোত্তম উপদেশ’ (হূদ ১১/১১৪)। পাপকর্মের কারণে অন্তরে পাপের কালিমা লেপন হয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِنَّ الْمُؤْمِنَ إِذَا أَذْنَبَ كَانَتْ نُكْتَةٌ سَوْدَاءُ فِي قَلْبِهِ فَإِنْ تَابَ وَاسْتَغْفَرَ صُقِلَ قَلْبُهُ وَإِنْ زَادَ زَادَتْ حَتَّى تَعْلُوَ قَلْبَهُ فَذَلِكُمُ الرَّانُ الَّذِي ذَكَرَ اللهُ تَعَالَى (كَلاَّ بَلْ رَانَ عَلَى قُلُوبِهِمْ مَّا كَانُوْا يَكْسِبُوْنَ)- ‘মুমিন ব্যক্তি যখন গুনাহ করে তখন তার অন্তরে একটি কালো দাগ পড়ে। অতঃপর সে পাপকাজ পরিত্যাগ করে ক্ষমা প্রার্থনা করলে তার অন্তর পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়। পুনরায় সে গুনাহ করলে সেই কালো দাগ বেড়ে যায় এবং পাপের মরিচা ধরে। এই সেই মরিচা যা আল্লাহ স্বীয় কিতাবে উল্লেখ করেছেন’।

আল্লাহ বলেন, كَلاَّ بَلْ رَانَ عَلَى قُلُوبِهِمْ مَّا كَانُوْا يَكْسِبُوْنَ- ‘কখনই না। বরং তাদের অপকর্মসমূহ তাদের অন্তরে মরিচা ধরিয়েছে’ (মুত্বাফফেফীন ৮৩/১৪)[14] তবে বান্দা যদি বেশী বেশী তওবা-ইস্তিগফার করে, তাহ’লে তার অন্তর পরিচ্ছন্ন ও কোমল হয় এবং আল্লাহর ইবাদতের জন্য পরিপূর্ণভাবে প্রস্ত্তত হয়ে যায়। জনৈক ব্যক্তি কোন এক মহিলাকে চুম্বন করেছিল। অতঃপর সে নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট আসল এবং তাঁকে উক্ত ঘটনা বর্ণনা করল। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা এই আয়াত নাযিল করলেন, ...إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ، ‘নিশ্চয়ই সৎকর্মসমূহ মন্দ কর্মসমূহকে বিদূরিত করে দেয়। আর এটি (কুরআন) হ’ল উপদেশ গ্রহণকারীদের জন্য সর্বোত্তম উপদেশ (হূদ ১১/১১৪)। তখন সে ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! এটা কি শুধুমাত্র আমার জন্য। তিনি বললেন, আমার উম্মতের সকলের জন্যই। অপর বর্ণনায় আছে, আমার উম্মতের যে কেউ এরূপ মন্দ কাজের পর ভাল আমল করবে।[15]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, যদি তোমাদের কেউ দৈনিক পাঁচবার নদীতে গোসল করে, তাহ’লে তার দেহে কোন ময়লা থাকে কি? ছাহাবীগণ বললেন, না, তার শরীরে কোন ময়লা থাকতে পারে না। তখন তিনি বললেন,فَذَالِكَ مَثَلُ الصَّلَوَاتِ الْخَمْسِ يَمْحُو اللهُ بِهِنَّ الْخَطَايَا- ‘পাঁচ ওয়াক্ত ফরয ছালাতও অনুরূপ। যার মাধ্যমে আল্লাহ পাপ সমূহ দূর করে দেন’।[16] অতএব নফসের উপর যুলুম হয়ে গেলে যত দ্রুত সম্ভব আল্লাহর পথে ফিরে আসা এবং সাধ্যমত নেক আমল করা উচিত।

ক্ষমা প্রার্থনার দো‘আ : রাসূল (ছাঃ) স্বীয় প্রার্থনায় বলতেন,اَللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا عَمِلْتُ وَمِنْ شَرِّ مَا لَمْ أعمَلْ- ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট আশ্রয় চাই সেসকল মন্দ কর্মের অনিষ্ট হ’তে, যা আমি করেছি এবং যা আমি করিনি তা থেকেও’।[17] এছাড়াও সাইয়েদুল ইস্তেগফার এবং ক্ষমা প্রার্থনার অন্যান্য দো‘আ পড়তে হবে।

উপসংহার : মানুষ মাত্রই ভুলকারী ও নফসের উপর যুলুমকারী। তবে নিয়মিত ভুলের উপর প্রতিষ্ঠিত না থেকে যত দ্রুত সম্ভব তওবা করে আল্লাহর পথে ফিরে আসতে হবে। নফসের উপর যুলম করা থেকে যথাসম্ভব বিরত থাকতে হবে। ‘নফসে আম্মারাহ’ তথা কুপ্রবৃত্তি হ’তে সাবধান থাকতে হবে। আমরা যেন আমাদের সার্বিক জীবনে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর যথাযথ অনুসারী হই এবং নফসের উপর যুলুম করা থেকে বিরত থাকতে পারি, মহান আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক দান করুন- আমীন!


[1]. ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/৯৩৭; বায়হাক্বী শো‘আব হা/২৮৭২

[2]. আহমাদ হা/১৯৬০৬ হাসান লি-গায়রিহ; ত্বাবারাণী আওসাত্ব হা/৩৪৭৯

[3]. মুসলিম হা/২৫৭৮; মিশকাত হা/১৮৬৫।

[4]. বুখারী হা/৫২৬৯; মুসলিম হা/১২৭।

[5]. ইবনু মাজাহ হা/৪০২২, সনদ হাসান; মিশকাত হা/৪৯২৫।

[6]. মুসলিম হা/২৫৫১; মিশকাত হা/৪৯১২

[7]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪০৯, ছহীহ লেগায়রিহী; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৬৪৬, হাসান ছহীহ; ত্বাবারাণী কাবীর হা/৬৪৯

[8]. তিরমিযী হা/২০৩২; আবুদাঊদ হা/৪৮৮০, হাসান ছহীহ; মিশকাত হা/৫০৪৪; ছহীহুত তারগীব হা/২৩৩৯।

[9]. মুসলিম হা/২৫৮১; মিশকাত হা/৫১২৭।

[10]. তিরমিযী হা/৩৫৪৫; মিশকাত হা/৯২৭।

[11].বুখারী হা/৭৫৩২; মিশকাত হা/৪৯

[12]. মুসলিম হা/২৫৭৭; মিশকাত হা/২৩২৬।

[13]. বুখারী হা/৮৩৪; মুসলিম হা/২৭০৫; মিশকাত হা/৯৪২।

[14]. ইবনু মাজাহ হা/৪২৪৪ সনদ হাসান; মুস্তাদরাক হাকেম হা/৩৯০৮; মিশকাত হা/২৩৪২।

[15]. বুখারী হা/৫২৬; মুসলিম হা/২৭৬৩; মিশকাত হা/৫৬৬

[16]. বুখারী হা/৫২৮; মুসলিম হা/৬৬৭; মিশকাত হা/৫৬৫।

[17]. মুসলিম হা/২৭১৬; মিশকাত হা/২৪৬২






আল্লাহর জন্য কাউকে ভালবাসা (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
আদর্শ পরিবার গঠনে করণীয় (৬ষ্ঠ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
পরকালে পাল্লা ভারী ও হালকাকারী আমল সমূহ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
মানব জাতির সাফল্য লাভের উপায় (৭ম কিস্তি) - হাফেয আব্দুল মতীন - পিএইচ.ডি গবেষক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া
মানবাধিকার ও ইসলাম (৩য় কিস্তি) - শামসুল আলম
জিহাদের ন্যায় ফযীলতপূর্ণ আমল সমূহ - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
ঈমান বিধ্বংসী দশটি কারণ - মুহাম্মাদ খায়রুল ইসলাম
মাদ্রাসার পাঠ্যবই সমূহের অন্তরালে - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বালা-মুছীবত থেকে পরিত্রাণের উপায় - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
মাসায়েলে কুরবানী - আত-তাহরীক ডেস্ক
১৬ মাসের মর্মান্তিক কারা স্মৃতি (৫ম কিস্তি) - মাওলানা মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম
সত্য ও মিথ্যার মিশ্রণ - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
আরও
আরও
.