সম্প্রতি উত্তর আফ্রিকা ও
মধ্যপ্রাচ্যে গণ অভ্যুত্থান হয়েছে। তাতে ইতিমধ্যে তিউনিসিয়া ও মিসরের দুই
লৌহমানবের পতন ঘটেছে। লিবিয়া ও ইয়ামনের দুই লৌহমানব এখন পতনের মুখে।
বাহরায়েন ও জর্ডানে লু হাওয়া বইছে। সিরিয়া ও সঊদী আরবে আতংক দেখা দিয়েছে।
সুদান ইতিমধ্যে বিভক্ত হয়ে গেছে। শোনা যাচ্ছে যে, মধ্যপ্রাচ্যকে ৪০টি
রাষ্ট্রে বিভক্ত করা হবে।
ছহীহ হাদীছ সমূহে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ইহুদী-নাছারাদেরকে মুসলমানদের প্রধান শত্রুশক্তি হিসাবে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। এজন্য প্রতিদিন ছালাতে সূরা ফাতিহার শেষ দিকে ‘গায়রিল মাগযূবে ‘আলাইহিম অলাযযা-ল্লীন’ বলে অভিশপ্ত ইহুদী ও পথভ্রষ্ট নাছারাদের পথে না যাওয়ার জন্য আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করা হয়। কিন্তু বলা চলে যে, আজকের মুসলিম বিশ্বের প্রায় সকল রাষ্ট্রনেতা ঐসব অভিশপ্ত ও পথভ্রষ্টদের গোলামী করছে। কেউ কেউ তাদের বিরুদ্ধে বললেও তাদের পাতানো সিস্টেমের গোলামী করছে। ফলে পরোক্ষভাবে তাদেরই কপট উদ্দেশ্য পূর্ণ হচ্ছে। গত শতাব্দীতে ওছমানীয় খেলাফতের শেষ খলীফা ২য় আব্দুল হামীদের নিকটে যখন ফিলিস্তীনে ইহুদী বসতি স্থাপনের অনুমতি চেয়েছিল বৃটিশ প্রতিনিধি, তখন দুর্বল খলীফার ঈমানী চেতনা তার প্রতিবাদ করে উঠেছিল। তিনি অনুমতি দেননি। সুচতুর বৃটিশরা তখন অন্যপথ ধরেছিল। তারা আরবদের সাথে তুকীদের বিভেদ ঘটানোর জন্য জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করতে থাকে। সেই সাথে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয় তরুণদের মাঝে। ‘যেকোন নতুন বস্ত্তই সুস্বাদু’-এই প্রবাদ বাক্যটি তরুণ বংশধরদের মাঝে উত্তেজনার সৃষ্টি করে। ফলে ১০/১২ বছরের মধ্যেই উত্তাল হয়ে ওঠে জনমত। পাশ্চাত্যের দাবার ঘুঁটি কামাল পাশার নেতৃত্বে ঘটে যায় বিপ্লব। ওছমানীয় খেলাফত ভেঙ্গে যায়। বিদেশীরা ভাগ বাটোয়ারা করে নেয় পুরা খেলাফতকে। শক্তিশালী তুরষ্ক রাতারাতি ‘ইউরোপের রুগ্ন ব্যক্তি’ বলে পরিচিত হয়। ১৯২৪ সালে ঘটে যাওয়া এই মহা বিপর্যয়ের পিছনে মূল কারণ ছিল খৃষ্টান সাম্রাজ্যবাদীদের সুদূরপ্রসারী নীলনকশা। তারা সেদিন অস্ত্র নিয়ে আসেনি। এসেছিল মতবাদ নিয়ে। মগয ধোলাই করেছিল তরুণদের। তাদেরকে ইসলাম থেকে দূরে নিয়ে নিজেদের তৈরী করা মতবাদ সমূহের ফাঁদে আটকে ফেলেছিল। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের মাধ্যমে ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে যাচ্ছে-তাই করার উন্মত্ত নেশা, গণতন্ত্রের মাধ্যমে যোগ্য-অযোগ্য নির্বিশেষে যেকেউ নেতা হবার মদমত্ত আবেগ, পুঁজিবাদের মাধ্যমে প্রত্যেকে লুটেপুটে ধনী হবার উন্মাতাল প্রেরণা, জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে উদার মানবতাবাদের কবর রচনা করে ভাষা ও অঞ্চলভিত্তিক ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ গন্ডীভুক্ত চিন্তায় আচ্ছন্নকারী প্রগলভতা তুর্কী ও আরবদের মাঝে বাধার বিন্ধ্যাচল দাঁড় করিয়ে দেয়। যা পরবর্তীতে আরব বংশোদ্ভূত নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) ও তাঁর প্রচারিত ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়। তাই দেখা যায়, বিপ্লবের পরে তুরষ্ক থেকে আরবী আযান তুলে দেওয়া হয়। মেয়েদের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে বোরকা ছিঁড়ে উলঙ্গ করে ছেড়ে দেওয়া হয়। ঐক্যবদ্ধ ইসলামী খেলাফত ভেঙ্গে পৃথিবীতে এখন মুসলিম রাষ্ট্রের সংখ্যা ৫৬টি। তন্মধ্যে কেবল মধ্যপ্রাচ্যেই ২২টি। এবার সেগুলি ভেঙ্গে করা হবে নাকি ৪০টি। খৃষ্টীয় সাম্রাজ্যবাদের এই আঘাত থেকে মুসলমানদের মধ্যে অনেক বিপ্লবী নেতার জন্ম হয়। যারা সাম্রাজ্যবাদীদের লুণ্ঠন থেকে স্ব স্ব দেশকে রক্ষায় সমর্থ হন। সঊদী আরবের আব্দুল আযীয, মিসরের মোহাম্মদ আলী, লিবিয়ার মু‘আম্মার আল-গাদ্দাফী, ইরানের আয়াতুল্লাহ খোমেনী নিঃসন্দেহে তাঁদের অন্যতম। এঁদের মধ্যে কেবল গাদ্দাফী বেঁচে আছেন। কিন্তু শেষ দিকে এসে তিনি তাঁর বিপ্লবী চরিত্র হারিয়ে ফেলেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও ইরাকে সাদ্দাম হোসায়েনের পরাজয়ের পর গাদ্দাফী রাতারাতি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের মিত্র বনে যান এবং এইসব লুটেরাদের জন্য লিবিয়ার তৈল ভান্ডার উন্মুক্ত করে দেন। এর ফলে সেখানে কিছু ধনকুবের সৃষ্টি হলেও দেশে কর্মসংস্থানমুখী কোন শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা হয়নি। কৃষিতেও ঘটানো হয়নি কোন উন্নয়ন। ফলে সেদেশের মাথা পিছু জাতীয় আয় ১২ হাযার ডলারের বেশী হলেও দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের গড় আয় প্রতিদিন মাত্র দুই ডলারেরও কম। সেদেশে বর্তমানে কর্মক্ষম মানুষের ২১ শতাংশই বেকার। ফলে জনগণ গাদ্দাফীর প্রতি আগের মত এখন আর অন্ধভক্তি পোষণ করে না। অন্যান্য দেশেও কমবেশী একই অবস্থা বিরাজ করছে। আর এই সুযোগটাই নিয়েছে পাশ্চাত্য শকুনীরা। তারা এখন পুরা মধ্যপ্রাচ্যকে টুকরা টুকরা করে তৈল সম্পদের উপর দখল নিতে চায়। বর্তমান গণ-অভ্যুত্থানের ফলাফল সেদিকেই এগিয়ে চলেছে।
এক্ষণে উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রচ্যের দেশগুলির রাষ্ট্রনেতাগণ যদি নিজেদের ভুলগুলো শুধরে নেন এবং স্ব স্ব দেশে ইসলামী নীতিমালা বাস্তবায়নে আন্তরিক হন ও জনগণের মৌলিক মানবাধিকার সমূহ সুরক্ষায় আত্মনিয়োগ করেন, তাহ’লে নিজ দেশের জনগণ হবেন তাদের দেহরক্ষী। তবে এটাও বাস্তব যে, সর্বদা বিদেশের চর ও স্বার্থপর রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী সব মুসলিম দেশেই আছে ও থাকবে। ওদেরকে চিহ্নিত করে দিলে জনগণ তাদের বয়কট করবে। বিদেশীরা নিরাশ হবে। মিডিয়ার মিথ্যা প্রচারণা কোন কাজে আসবে না ইনশাআল্লাহ।
বর্তমান অমুসলিম বিশ্ব ইসলামকে তাদের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে চিহ্নিত করেছে। তবে মুসলমানদের মধ্যে তারা তিনটি দলকে তাদের আপন মনে করে ও একটি দলকে তাদের শত্রু মনে করে (সূত্র: Rand’07)। ১. সেক্যুলার ২. পপুলার এবং ৩. ছূফীবাদীগণ। কারণ সেক্যুলাররা পাশ্চাত্যের কাছে দাসখত দিয়েই রাজনীতি করে। তারা ক্ষমতায় গেলে পাশ্চাত্যের সবকিছুর অনুসরণ করবে এবং ইসলামের কোন বিধানই কার্যকর করবে না, এরূপ অলিখিত চুক্তি তাদের থাকে। পপুলাররা ‘এটাও ঠিক ওটাও ঠিক’ বলে মডারেট ইসলামিস্ট হবার কোশেশ করে। আর ছূফীরা তো ‘যত কল্লা তত আল্লা’ শ্লোগান দিয়ে সর্বদা স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে পার্থক্য ঘুঁচিয়ে দেবার মেহনত করেন। আগ্রাসী যালেম শক্তি হয়তবা তাদের দৃষ্টিতে খোদ আল্লাহরই অংশ। অতএব তাদেরকে সাদরে বরণ করে নেওয়াই কর্তব্য। কেননা ‘কিছু হইতে কিছু হয় না, যা কিছু হয় আল্লাহ হইতে হয়।’ অতএব যুলুম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বা জিহাদ নয়, বরং যালিমের যুলুম হাসিমুখে বরণ করে নেওয়া এবং ত্বাগূতী শক্তির গোলামীর তকমা গলায় বাঁধাকে তারা হয়তবা ‘আল্লাহ হইতে হয়েছে’ বলে সন্তুষ্ট হবেন। উপমহাদেশে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের আমলে তাদের এই চরিত্রই দেখা গেছে। ফলে এসব মতবাদের ওরস ও ইজতেমায় লাখ মানুষের ভিড় হয়। মানুষ সেখানে ছুটে যায় পরকালীন মুক্তির মিথ্যা আশায় অথবা দুনিয়াবী চাওয়া-পাওয়ার উদগ্র নেশায়। অথচ সবকিছুই মায়া-মরীচিকা মাত্র।
পক্ষান্তরে শত্রুদের চোখের বালি হ’ল সালাফী তথা আহলেহাদীছ আন্দোলন। যারা ইসলামকেই মানবজাতির ইহকালীন মঙ্গল ও পরকালীন মুক্তির একমাত্র চাবিকাঠি বলে বিশ্বাস করেন এবং পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছকে অভ্রান্ত সত্যের চূড়ান্ত উৎস বলে মনে করেন। উক্ত বিশ্বাসের আলোকে তারা তাদের সার্বিক জীবন গড়ে তোলার সর্বাত্মক চেষ্টা করে থাকেন। অদ্বৈতবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও মডারেট উদারতাবাদের শিরকী ও বিদ‘আতী ধারা সমূহের বাইরে তারা তাদের রাজনীতি, অর্থনীতি ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে নিরংকুশভাবে স্রেফ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর অনুসরণ করেন। উক্ত অভ্রান্ত বিধানের আলোকে আক্বীদা ও আমলের সংস্কার সাধনের মাধ্যমে তারা সমাজের সার্বিক সংস্কার কামনা করেন এবং এজন্য দিন-রাত দাওয়াত ও সংগঠনে জীবন ব্যয় করেন। তারা বিশ্বাস করেন যে, ঈমান ও আমলে ছালেহ হ’ল ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার একমাত্র উপায়। দেশের জনগণ যখন উপরোক্ত চেতনায় উদ্বুদ্ধ হবে এবং এর অনুকূলে গণজাগরণ সৃষ্টি হবে, তখনি আসবে কাংখিত ইসলামী খেলাফত। যাকে সবচেয়ে বেশী ভয় পায় পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদীরা ও তাদের দোসররা। আহলেহাদীছ আন্দোলন-এর পক্ষে বাংলাদেশে যখন গণজোয়ার সৃষ্টি হতে যাচ্ছিল, তখনই পাশ্চাত্যের এদেশীয় দোসররা মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তাদের উপর জেল-যুলুম চাপিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু জানা উচিৎ যে, ইসলাম যেন্দা হোতা হায় হর কারবালা কে বা‘দ। তাই বিজাতীয় মতবাদের পক্ষে নয় বা ইসলামের নামে কোন শিরক ও বিদ‘আতের পক্ষে নয়, বরং নির্ভেজাল তাওহীদ ও ছহীহ সুন্নাহর পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হৌক এবং জনগণকে পরিচালনার জন্য যোগ্য ইসলামী নেতৃবৃন্দ সৃষ্টি হৌক আল্লাহর নিকটে আমরা কেবল সে প্রার্থনাই করব। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন-আমীন!! (স.স.)।