মুসলিম বিশ্বের অন্যতম দু’টি দেশ ইরান ও আফগানিস্তান। সুন্নী মতাবলম্বী তালেবান কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তান। অপর দিকে শী‘আদের দ্বারা শাসিত ইরান। দেশ দু’টির মধ্যে ভয়াবহ উত্তেজনা বিরাজ করছে। যেকোন সময় ভয়ঙ্কর সংঘাত লেগে যেতে পারে। সম্প্রতি আফগানিস্তানের মাযার-ই শরীফে তালেবান কর্তৃক ইরানের ৯ জন কূটনীতিক হত্যাকে কেন্দ্র করেই মূলতঃ দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের এই চরম অবনতি। ইরান ২ লাখ ৭০ হাযার সৈন্য, অসংখ্য ট্যাঙ্ক, কামান ও জঙ্গী বিমান মোতায়েন করে স্মরণকালের বৃহত্তম সামরিক মহড়া শুরু করেছে আফগান সীমান্তে। অপরপক্ষে তালেবান সরকারও ১০ হাযার সৈন্য মোতায়েন করেছে। প্রতিবেশী দু’টি মুসলিম দেশের এই অবস্থা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। যেখানে ইসলামী আদর্শে উজ্জীবিত পাশাপাশি ভ্রাতৃপ্রতিম দু’টি দেশ একত্রে অবিচ্ছিন্নভাবে পারস্পরিক আদর্শ বিশ্ববাসীকে উপহার দেয়ার কথা, সেখানে নিজেদের শত্রুসুলভ মহড়া মুসলিম বিশ্বকে তো হতাশ করেছেই, পাশাপাশি ইসলাম বিদ্বেষী বিশ্ব মোড়লদের হাত তালির সুযোগ করে দিয়েছে। পৃথিবী জুড়ে যখন ব্যাপক হারে মুসলিম নিধন চলছে, আন্তর্জাতিক চক্রান্তের শিকার হয়ে মুসলমানরা যখন প্রায় কোণঠাসা, বসনিয়া-চেচনিয়ার পরে এখন কসোভোয় যখন মুসলমানদের পাইকারীভাবে হত্যা করা হচ্ছে, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে, পার্শ্ববর্তী ভারতীয় কাশ্মীরে মুসলমানরা চরমভাবে নির্যাতিত হচ্ছে, তখন প্রতিবেশী দু’টি মুসলিম দেশের মধ্যে উত্তেজনা সত্যিই হতাশাব্যঞ্জক।
শী‘আ-সুন্নী মতবাদই ইরান-আফগান বৈরিতার অন্যতম কারণ। চরমপন্থী শী‘আ শাসিত ইরান কখনো চায় না যে, পৃথিবীর কোথাও সুন্নী রাষ্ট্র গড়ে উঠুক। ফলে ইসলামী ও আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করে ৭ হাযার অসহায় তালেবান যুদ্ধবন্দীকে নির্দয়ভাবে হত্যা করতেও তারা বিন্দুমাত্র সংকোচ বোধ করেনি। প্রথমবার মাযার-ই শরীফ দখল করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার সময় এই হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে। অথচ পরবর্তীতে মাযার-ই শরীফ পুনর্দখলের সময় পূর্বের ঘটনার নাটের গুরু নয় জন ইরানী কূটনীতিক যুদ্ধাবস্থায় নিহত হ’লে ইরান উপরোক্ত ব্যবস্থা নেয়। ইরান মূলতঃ পূর্ব থেকেই সুন্নী নিধনে সচেষ্ট ছিল। শী‘আ শাসক ইসমাঈল ছাফাভী (১৪৯৯-১৫২৪ খৃঃ) কর্তৃক ইরানে শী‘আদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সুন্নীদের একচেটিয়া হত্যাকান্ড এর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। ইসমাঈল ছাফাভী কর্তৃক সুন্নী হত্যার পর সম্ভবতঃ ইতিহাসের বৃহত্তম সুন্নী নিধন ছিল সম্প্রতি সাত হাযার তালেবান সুন্নী যুদ্ধবন্দীকে হত্যা করা। মূলতঃ তালেবান কর্তৃক শী‘আ অধ্যুষিত মাযার-ই শরীফ দখলের পর থেকেই ইরানের গাত্রদাহ শুরু হয়। ইতিপূর্বে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল তালেবানদের দখলে আসলে ইরান কাবুল থেকে স্বীয় দূতাবাস গুটিয়ে নেয়। মোটকথা তালেবানদের উত্থান ইরান কখনো মেনে নিতে পারেনি। পাশাপাশি দু’টি মুসলিম দেশের বৈরিতা আমাদের কাম্য নয়। বরং ইরানের উচিৎ নতুন মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে আফগানিস্তানকে স্বীকৃতি ও সমর্থন দিয়ে পারস্পরিক নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করা এবং ইসলাম বিদ্বেষী চক্রের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা।
ইসলাম শান্তির ধর্ম হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম উম্মাহ শতধা বিচ্ছিন্ন। ঐক্য, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের পরিবর্তে আজ পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতা বিরাজমান। ফলে একদিকে যেমন আভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি, তেমনি ইসলামের শত্রুদের উপহাসের পাত্র হচ্ছি। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের যুগে ইসলামের একটি মাত্র দল ছিল। তাঁদের সংবিধান ছিল পবিত্র কুরআন ও রাসূল (ছাঃ)-এর বাণী, সম্মতি ও কর্ম তথা হাদীছ। উদ্ভূত সমস্যাবলীর সমাধান তাঁরা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ থেকেই নিতেন।
দুর্ভাগ্যজনক হ’লেও সত্য যে, পরবর্তীতে প্রথমে শী‘আ-সুন্নী ও ৪র্থ শতাব্দীতে এসে তাক্বলীদী দর্শন সুন্নীদেরকে প্রথমতঃ চারটি প্রধান মাযহাবে বিভক্ত করে। ফলে মাযহাবী বিদ্বেষের কারণে বাগদাদ ধ্বংস হয়। অথচ আল্লাহ পাকের নির্দেশ ছিল ‘তোমরা পরস্পরে সম্মিলিত ভাবে আল্লাহর রজ্জুকে ধারণ কর, সাবধান দলে দলে বিভক্ত হয়ো না’ (আলে ইমরান ৩/১০৩)। এই সুমহান বাণীর দিকে সামান্যতম ভ্রুক্ষেপ না করে আমরা অসংখ্য দলে-উপদলে বিভক্ত হয়েছি। ফলে যে মুসলমানরা এক সময় অর্ধ জাহান শাসন করেছিল, সে মুসলমান আজ নিজ গৃহেও নিরাপদ নয়। কেউ কেউ ঐক্যের আহবান জানান বটে, কিন্তু নিজ মাযহাবী সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। এ যেন এমন যে, ‘বিচার মানি কিন্তু তাল গাছটি আমার’। আমরা মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যের আহবান জানাই সকল বিষয়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছকে নিঃশর্তভাবে মেনে নেয়ার একটি মাত্র শর্তে। যখন আমরা এই শর্তের কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারব তখন ঐক্য সম্ভব হবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদেরকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে জীবন গড়ার তাওফীক দান করুন- আমীন!