عَنِ ابْنِ كَعْبِ بْنِ مَالِكٍ الأَنْصَارِىِّ عَنْ أَبِيهِ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مَا ذِئْبَانِ جَائِعَانِ أُرْسِلاَ فِى غَنَمٍ بِأَفْسَدَ لَهَا مِنْ حِرْصِ الْمَرْءِ عَلَى الْمَالِ وَالشَّرَفِ لِدِينِهِ-
হযরত কা‘ব বিন মালেক আনছারী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন যে, দু’টি ক্ষুধার্ত নেকড়ে বাঘকে ছাগপালের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া অত বেশী ধ্বংসকর নয়, যত না বেশী মাল ও মর্যাদার লোভ মানুষের দ্বীনের জন্য ধ্বংসকর।[1] জাবের (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে غَابَ عَنْهَا رِعَاؤُهَا ‘যখন ছাগপালের রাখাল অনুপস্থিত থাকে।[2] রাবী হ’লেন, তাবূক যুদ্ধ থেকে পিছিয়ে থাকা সেই বিখ্যাত তিনজন ধনাঢ্য ও নেতৃস্থানীয় ছাহাবীর অন্যতম যারা যথার্থ কোন অজুহাত ছাড়াই জিহাদে গমন থেকে বিরত ছিলেন। পরে তারা ভুল স্বীকার করে তওবা করেন, যা পঞ্চাশ দিন পরে কবুল হয় এবং তাদের ক্ষমা করে আয়াত নাযিল হয় (তওবা ৯/১১৮)।
আলোচ্য হাদীছটি দুনিয়ার লোভে দ্বীন নষ্ট হওয়ার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দেওয়া অত্যন্ত মূল্যবান একটি দৃষ্টান্ত। রাতের বেলা রাখালবিহীন ছাগলের খোয়াড়ে ঢুকে দু’টি ক্ষুধার্ত নেকড়ে বাঘ যেভাবে ইচ্ছামত ছাগল মেরে চিরে নাস্তানাবূদ করে। যার হামলা থেকে কোন ছাগলই রেহাই পায় না। অনুরূপভাবে অর্থ-সম্পদ এবং নাম-যশ ও পদের লোভ মুমিনের ঈমানকে নির্বাপিত করে দেয় ও দ্বীনকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়।
হাদীছে মাল ও মর্যাদার লোভের কথা বলা হয়েছে। প্রত্যেকটিই দুই প্রকার : বৈধ ও অবৈধ।
১. সম্পদের লোভ :
এটা
প্রথমতঃ দুই প্রকার। (ক) বৈধ পথে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ অর্জনের লোভ
করা ও তার জন্য জীবনপাত করা। যেমন উপরোক্ত হাদীছটির প্রেক্ষাপট যা আছেম বিন
‘আদী (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে যে, আমি ও আমার ভাই খায়বরের গণীমত সমূহের
১০০টি অংশ খরীদ করি। কথাটি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কানে গেলে তিনি অত্র
মন্তব্য করেন যা আলোচ্য হাদীছে বলা হয়েছে (ত্বাবারাণী কাবীর হা/৪৫৯)।
অতএব বৈধভাবে হ’লেও অধিক মাল অর্জনের লোভ করা যাবে না। কেননা তাতে কেবল
সময় ও শ্রমের অপচয় হবে এবং আল্লাহর দেওয়া আয়ুষ্কালকে আল্লাহর পথে ব্যয় করা
হ’তে বিরত থাকতে সে বাধ্য হবে। তাকে এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, প্রত্যেক
বান্দার জন্য আল্লাহ রিযিক বণ্টন করে দিয়েছেন। যা থেকে কমবেশী করা হবে না।
অতএব পরিমিত ও প্রয়োজন পূর্ণ হওয়ার পর আরও বেশী পাওয়ার আকাংখাকে দমন করতে
হবে। যেমন আল্লাহ বলেন, أَلْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ- حَتَّى زُرْتُمُ
الْمَقَابِرَ- ‘অধিক পাওয়ার আকাংখা তোমাদের (পরকাল থেকে) গাফেল রাখে,
যতক্ষণ না তোমরা কবরস্থানে উপনীত হও’ (তাকাছুর ১০২/১-২)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দো‘আ করতেন,اللَّهُمَّ ارْزُقْ آلَ مُحَمَّدٍ قُوتًا হে
আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদের পরিবারকে পরিমিত রিযিক দান কর’।[3]
অতএব হে লোভী! যখন তুমি মালের পেছনে জীবন শেষ করলে, তখন আখেরাতের জন্য তুমি কখন সময় দিবে? অথচ আল্লাহ বলেন,يَا ابْنَ آدَمَ تَفَرَّغْ لِعِبَادَتِى أَمْلأْ صَدْرَكَ غِنًى وَأَسُدَّ فَقْرَكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ مَلأْتُ صَدْرَكَ شُغْلاً وَلَمْ أَسُدَّ فَقْرَكَ ‘হে আদম সন্তান! আমার ইবাদতের জন্য অবসর হও। তাহ’লে আমি তোমার অন্তর প্রাচুর্য দিয়ে ভরে দিব এবং তোমার অভাব দূর করে দিব। আর যদি তা না কর তাহ’লে তোমার দু’হাত ব্যস্ততা দিয়ে ভরে দিব এবং তোমার অভাব দূর করব না’ ।[4] কবি বলেন,
وَلاَ تَحْسَبَنَّ الْفَقْرَ مِنْ فَقْرِ الْغِنَى + وَلَكِنْ فَقْرُ الدِّيْنِ مِنْ أَعْظَمِ الْفَقْرِ
‘সচ্ছলতা হারানোকে দরিদ্রতা ভেবো না। বরং দ্বীন হারানোই হ’ল সবচেয়ে বড় দরিদ্রতা’।[5] নিঃসন্দেহে মালের লোভ সকল শত্রুর চেয়ে বড় শত্রু। যা মানুষকে সর্বদা ব্যস্ত রাখে। অথচ তা তার নিজের কোন কাজে লাগে না। যা তাকে আখেরাতের কাজ থেকে বিরত রাখে। অথচ যেটা ছিল তার নিজের জন্য। কেননা অতিরিক্ত যে মাল জমা করার জন্য সে দিন-রাত দৌড়ঝাঁপ করছে, তা সবই সে ফেলে যাবে। কিছুই সাথে নিতে পারবে না, তার নিজস্ব নেক আমলটুকু ব্যতীত। অথচ সে আমল করার মত ফুরছত তার নেই।
কবি হুসাইন বিন আব্দুর রহমান বলেন,
الْمَالُ عِنْدَكَ مَخْزُونً لِوَارِثِهِ + مَا الْمَالُ مَالُكَ اِلاَّ يَوْمَ تُنْفِقُهُ
‘মাল তোমার কাছে জমা থাকে তার ওয়ারিছদের জন্য। আর ঐ মাল তোমার নয়, যতক্ষণ না তুমি তা (আল্লাহর পথে) ব্যয় করবে’।[6] অতএব লোভ হ’ল দু’প্রকারের। ক্ষতিকর লোভ (حرص فاجع)। যা তাকে আখেরাত থেকে ফিরিয়ে দুনিয়ার কাজে লিপ্ত রাখে। আর কল্যাণকর লোভ(حرص نافع), যা তাকে আল্লাহর আনুগত্যের কাজে আকৃষ্ট করে ও সেদিকেই ব্যস্ত রাখে।
(খ) দ্বিতীয় প্রকার মালের লোভ হ’ল, যা অবৈধ ও হারাম পথে উপার্জনে প্ররোচিত করে। এটাকে الشُّحُّ
বা কৃপণতা বলে। যা নিন্দিত। আল্লাহ বলেন,وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ
فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ ‘যে ব্যক্তি হৃদয়ের কৃপণতা থেকে বাঁচল, সে
সফলকাম হ’ল’ (হাশর ৫৯/৯)। হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) হ’তে
বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,إِيَّاكُمْ وَالشُّحَّ فَإِنَّمَا
هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ بِالشُّحِّ أَمَرَهُمْ بِالْبُخْلِ
فَبَخَلُوا وَأَمَرَهُمْ بِالْقَطِيعَةِ فَقَطَعُوا وَأَمَرَهُمْ
بِالْفُجُورِ فَفَجَرُوا- ‘তোমরা কৃপণতা হ’তে বেঁচে থাক। কেননা কৃপণতা
তোমাদের পূর্বেকার লোকদের ধ্বংস করেছে। এ বস্ত্ত তাদের বলেছে আত্মীয়তার
সম্পর্ক ছিন্ন করতে, তখন সে তা করেছে। তাদের বখীলী করার নির্দেশ দিয়েছে,
তখন সে তা করেছে। তাদের পাপ করার নির্দেশ দিয়েছে, তখন সে তা করেছে’।[7]
জাবের (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে,وَاتَّقُوا الشُّحَّ فَإِنَّ الشُّحَّ
أَهْلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ حَمَلَهُمْ عَلَى أَنْ سَفَكُوا
دِمَاءَهُمْ وَاسْتَحَلُّوا مَحَارِمَهُمْ ‘...এ বস্ত্ত তাদেরকে রক্ত
প্রবাহিত করতে প্ররোচিত করে (তখন তারা সেটা করে) এবং তারা হারামকে হালাল
করে’।[8]
একদল বিদ্বান বলেন, الشُّحُّ বা কৃপণতা হ’ল الحرص الشديد ‘কঠিন লোভ’। যা তাকে বৈধ অধিকার ছাড়াই তা নিতে প্ররোচিত করে। যেমন অন্যের মাল অবৈধ ভাবে নেওয়া, অন্যের অধিকারে অবৈধ হস্তক্ষেপ করা। অন্যের ইযযতের উপর হামলা করা ইত্যাদি। মূলতঃ এর অর্থ হ’ল شَرَةُ النَّفْسِ বা প্রচন্ড লোভ, যা আল্লাহকৃত হারামের প্রতি তাকে প্রলুব্ধ করে। সে তখন তার হালাল মাল, হালাল স্ত্রী বা অন্যান্য বৈধ বস্ত্ততে তুষ্ট থাকতে পারে না। সে অন্যের অধিকার হরণে হামলে পড়ে। ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত বিশ্বের সর্বত্র আজকের শক্তিমানরা এ কাজ অহরহ করে চলেছে।
এক্ষণে الْبُخْلُ বা বখীলী হ’ল, নিজের হাতে যেটা আছে, সেটা না দেওয়া। পক্ষান্তরে الشُّحُّ বা কৃপণতা হ’ল, যুলুম ও শত্রুতার মাধ্যমে অন্যের মাল বা অন্য কিছু গ্রাস করা। এজন্য একে বলা হয়, সকল পাপের শীর্ষ (رأس المعاصى كلها)। এভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) ও অন্যান্য সালাফগণ (ইবনু রাজাব ৭০ পৃ.)। এখান থেকেই হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত হাদীছের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, যেখানে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, لاَ يَجْتَمِعُ الشُّحُّ وَالإِيمَانُ فِى جَوْفِ رَجُلٍ مُسْلِمٍ ‘মুমিনের হৃদয়ে কৃপণতা ও ঈমান একত্রিত হ’তে পারে না’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, فِى قَلْبِ عَبْدٍ أَبَدًا ‘কোন বান্দার অন্তরে’।[9] কখনো কখনো কৃপণতা ও বখীলী একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু উভয় শব্দের উৎপত্তিগত মৌলিক পার্থক্য সেটাই, যা উপরে বর্ণিত হয়েছে।
অতএব যখন সম্পদের লোভ মানুষকে কৃপণতার স্তরে নামিয়ে দেয়, তখন তার দ্বীন ও ঈমান তলানিতে চলে যায়। সে ঈমানের কোন স্তরেই আর থাকে না। পশুর সঙ্গে তার কোন পার্থক্য থাকে না।
২. মর্যাদার লোভ :
এটি সম্পদের লোভের চাইতে ভয়ংকর। কেননা এটির জন্য মানুষ তার মাল-সম্পদ পানির মত ব্যয় করে। এর জন্য হেন কাজ নেই, যা সে করতে পারে না। এটি দু’ভাগে বিভক্ত।
(ক) নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব ও সম্পদ লাভের মাধ্যমে মর্যাদা অর্জন করা : এটি অত্যন্ত ক্ষতিকর বস্ত্ত। যা মানুষকে আখেরাতের মর্যাদা ও কল্যাণ হ’তে বঞ্চিত করে। এর মাধ্যমে সে দুনিয়াতে সর্বোচ্চ ফাসাদ ও অশান্তি সৃষ্টি করে। আল্লাহ বলেন, تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لَا يُرِيدُونَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلاَ فَسَادًا وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ- ‘আখেরাতের এই গৃহ (অর্থাৎ জান্নাত) আমরা প্রস্ত্তত করে রেখেছি ঐসব মুমিনের জন্য, যারা দুনিয়াতে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেনা এবং বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায় না। আর শুভ পরিণাম হ’ল কেবল আল্লাহভীরুদের জন্য’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৩)।
বস্ত্ততঃ
এমন লোক কমই আছে যারা নেতৃত্ব লাভের মাধ্যমে দুনিয়াবী মর্যাদা কামনা করে
না। সেকারণেই আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আব্দুর রহমান বিন সামুরাকে বলেন,لاَ
تَسْأَلِ الإِمَارَةَ، فَإِنَّكَ إِنْ أُوتِيتَهَا عَنْ مَسْأَلَةٍ
وُكِلْتَ إِلَيْهَا، وَإِنْ أُوتِيتَهَا مِنْ غَيْرِ مَسْأَلَةٍ أُعِنْتَ
عَلَيْهَا- ‘তুমি নেতৃত্ব চেয়ে নিয়ো না। কেননা যদি তুমি সেটা চাওয়ার
মাধ্যমে প্রাপ্ত হও, তাহ’লে তোমাকে তার দিকে সোপর্দ করা হবে। আর যদি না
চেয়ে পাও, তাহ’লে তুমি সাহায্যপ্রাপ্ত হবে’।[10] হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ)
হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, إِنَّكُمْ سَتَحْرِصُونَ عَلَى
الإِمَارَةِ، وَسَتَكُونُ نَدَامَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ، فَنِعْمَ
الْمُرْضِعَةُ وَبِئْسَتِ الْفَاطِمَةُ ‘তোমরা সত্বর নেতৃত্বের লোভী হয়ে
পড়বে। অথচ সেটি ক্বিয়ামতের দিন লজ্জার কারণ হবে। অতএব কতইনা সুন্দর দুগ্ধ
দায়িনী ও কতই না মন্দ দুগ্ধ বিচ্ছিন্নকারিনী’।[11]
এখানে পদমর্যাদাকে দুগ্ধদায়িনী এবং পদ হারানোকে দুগ্ধ বিচ্ছিন্নকারিনী মায়ের সাথে তুলনা করা হয়েছে। দুই অবস্থাতেই মা যেমন আনন্দ পায়, তেমনি কষ্ট পায়। অনুরূপভাবে পদমর্যাদা লাভ যেমন দুনিয়াতে আনন্দের বিষয়, তেমনি আখেরাতে অনুতাপের বিষয়। কেননা পদমর্যাদার যথাযথ হক বুঝিয়ে দেওয়া সেদিন খুবই কষ্টকর হবে। যা নিঃসন্দেহে লজ্জাকর। অতএব জ্ঞানী ব্যক্তির এমন কাজে প্রার্থী হওয়া সঙ্গত নয়, যার পরিণাম লজ্জা ও অনুতাপ ছাড়া কিছুই নয়।
হযরত আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ)-এর সাথী দু’জন যখন রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে প্রশাসনিক পদ প্রার্থনা করল, তখন তিনি তাদের বললেন,إِنَّا لاَ نُوَلِّى هَذَا مَنْ سَأَلَهُ، وَلاَ مَنْ حَرَصَ عَلَيْه، وفى رواية :ِ مَنْ أَرَادَهُ ‘আমরা আমাদের কাজে এমন কাউকে নিযুক্ত করি না, যে পদ চেয়ে নেয়। যে তার লোভ করে বা তার আকাংখা করে’।[12]
বস্ত্ততঃ নেতৃত্ব ও পদমর্যাদার লোভ মানুষকে তা প্রাপ্তির পূর্বে যেমন ফিৎনায় নিক্ষেপ করে, প্রাপ্তির পরে সে তার চাইতে বেশী ফিৎনায় নিপতিত হয়। কেননা পদপ্রার্থী হওয়ায় সে তা অর্জনের জন্য আগ্রাসী হয়ে ওঠে এবং জান-মাল-ইয্যত সবকিছু বিলিয়ে দেয়। আর পদ প্রাপ্তির পর সে একদিকে অহংকারী হয়। অন্যদিকে যথাযথ হক আদায়ে ব্যর্থ হওয়ার গ্লানিতে সে অন্তর্জ্বালায় জ্বলতে থাকে। সেই সাথে আখেরাতে জওয়াবদিহিতার ভয়ে ভীত হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, আল্লাহ বলেছেন,الْكِبْرِيَاءُ رِدَائِى وَالْعَظَمَةُ إِزَارِى فَمَنْ نَازَعَنِى وَاحِدًا مِنْهُمَا قَذَفْتُهُ فِى النَّارِ ‘অহংকার আমার চাদর, বড়ত্ব আমার পাজামা। যে ব্যক্তি আমার উক্ত দুই বস্ত্ত টানাটানি করবে, আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব’।[13] এ কারণে পূর্ববর্তী কাযীগণ নিজেদের ‘ক্বাযীউল কুযাত’ (قاضي القضاة) ‘কাযীদের সেরা’ বলতেন না। এযুগেও সঊদী বাদশাহগণ ‘জালালাতুল মালিক’ লকব ছেড়ে নিজেদের জন্য ‘খাদেমুল হারামাইন শরীফাইন’ (দুই পবিত্র হারামের খাদেম) উপাধি গ্রহণ করেছেন।
বিগত যুগের জনৈক কাযী স্বপ্নে দেখেন যে, জনৈক ব্যক্তি তাকে বলছেন, তুমি বিচারপতি। আর আল্লাহ বিচারপতি। এতে ভয়ে তিনি জেগে ওঠেন ও পরদিনই ঐ পদ ত্যাগ করেন (ইবনু রাজাব ৭৫ পৃ.)।
আল্লাহ বলেন,لاَ تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَفْرَحُونَ بِمَا أَتَوْا وَيُحِبُّونَ أَنْ يُحْمَدُوا بِمَا لَمْ يَفْعَلُوا فَلَا تَحْسَبَنَّهُمْ بِمَفَازَةٍ مِنَ الْعَذَابِ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ ‘যেসব লোকেরা তাদের মিথ্যাচারে খুশী হয় এবং তারা যা করেনি, এমন কাজে প্রশংসা পেতে চায়, তুমি ভেব না যে, তারা শাস্তি থেকে বেঁচে যাবে। বস্ত্ততঃ তাদের জন্য রয়েছে মর্মান্তিক আযাব’ (আলে ইমরান ৩/১৮৮)। এ আয়াত নাযিল হয়েছিল ঐসব লোকদের উদ্দেশ্যে, যারা লোকদের নিকট থেকে নিজের জন্য প্রশংসা কামনা করে এবং প্রশংসা না করলে নাখোশ হয় ও তাকে শাস্তি দেয়। অথচ সকল প্রশংসার হকদার হ’লেন কেবলমাত্র আল্লাহ। তিনিই বান্দাকে যোগ্যতা ও গুণ-ক্ষমতা দান করে থাকেন।
সেকারণ একবার খলীফা ওমর বিন আব্দুল আযীয
(৯৯-১০১ হি.) ফরমান জারি করেন,لا تحمدُوا عَلَى ذلك كُلِّهِ إلاَّ للهِ،
فَإِنّهُ لوْ وَكَلَني إِلَى نفسِي كنتُ كغيري ‘তোমরা আমার কোন কাজের জন্য
প্রশংসা করো না। কেননা সকল প্রশংসা কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য। তিনি যদি
(নাখোশ হয়ে) আমাকে আমার প্রতি সমর্পণ করে দেন, তাহ’লে আমি অন্যের মত হয়ে
যাব’।[14]
একজন বিধবা মহিলার ব্যাপারে তাঁর একটি ঘটনা প্রসিদ্ধ রয়েছে যে, উক্ত মহিলা তাঁর নিকটে তার ইয়াতীম কন্যাদের জন্য সরকারী ভাতার আবেদন করে। ফলে তিনি দু’জনের জন্য ভাতা নির্ধারণ করেন। তাতে মহিলা আলহামদুলিল্লাহ বলে। তখন তিনি তৃতীয় মেয়েটির জন্য ভাতা বরাদ্দ করেন। তাতে মহিলা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায়। তখন তিনি বলেন, আমরা তোমার কন্যাদের জন্য ভাতা বরাদ্দ করলাম এজন্য যে, তুমি যথার্থ সত্তার প্রতি প্রশংসা জ্ঞাপন করেছ। এক্ষণে ঐ তিনজন কন্যাকে আদেশ দাও, তারা যেন ৪র্থ কন্যাটির প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করে। এর দ্বারা তিনি বুঝাতে চেয়েছেন যে, আনুগত্য সম্পূর্ণরূপে কেবল আল্লাহর জন্য। আর তিনি আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়নকারী মাত্র। অতএব সকল সম্মান ও প্রশংসা কেবল তাঁরই প্রাপ্য’ (ইবনু রাজাব ৭৬ পৃ.)।
কিন্তু একাজ খুবই কঠিন। কেননা ন্যায় বিচার কায়েম করতে গেলে সমাজ তার উপরে ক্ষেপে যাবে। আর সেজনেই নবী-রাসূলগণ ও তাদের সাথীরা দুনিয়াতে এত নির্যাতিত হয়েছেন। আল্লাহর পথে দাওয়াত দিতে গিয়ে তারা যেমন নির্যাতিত হয়েছেন, আল্লাহর আদেশ-নিষেধসমূহ বাস্তবায়ন করতে গিয়েও তেমনি তারা নির্যাতিত হয়েছেন। এতে তারা ধৈর্য ধারণ করেছেন এবং খুশী থেকেছেন। কেননা প্রিয়ভাজনরা সর্বদা তার প্রিয় সত্তার সন্তুষ্টির উপর খুশী থাকে। বিপদাপদ দিয়ে তিনি তার প্রিয় বান্দাকে পরীক্ষা করেন। যেমন খলীফা ওমর বিন আব্দুল আযীয যখন হক জারি করতে ও ন্যয়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হন, তখন তার পুত্র আব্দুল মালেক বলেন, হে আববা! আমি বরং চাই আমার ও আপনার জন্য আল্লাহর পথে কড়াই গরম করি’।
এর দ্বারা তিনি বুঝাতে চেয়েছেন যে, নিজেরা নির্যাতন ভোগ করি। কিন্তু মানুষ আল্লাহর বিধান মেনে সুখে থাক।
নবীগণ ও তাদের দ্বীনদার সাথীদের উপর নির্যাতন করে সর্বদা দুনিয়াদার ও অজ্ঞ মানুষেরা। যাদের সংখ্যা সর্বদাই অধিক। যারা তাদের ভবিষ্যৎ মঙ্গলামঙ্গলের খবর রাখে না। স্বার্থান্ধ নেতাদের চাকচিক্যপূর্ণ কথা শুনে ও নগদ দুনিয়া পাওয়ার লোভে তারা নবীগণকে মিথ্যা ধারণা করে ও তাদের হক দাওয়াতকে স্তব্ধ করার জন্য সকল শক্তি নিয়োগ করে। যাতে সাধারণ মানুষ ভীত হয় ও প্রতারিত হয়। একারণেই আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে সাবধান করে বলেন,وَتَمَّتْ كَلِمَتُ رَبِّكَ صِدْقًا وَعَدْلًا لَا مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِهِ وَهُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ، وَإِنْ تُطِعْ أَكْثَرَ مَنْ فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَنْ سَبِيْلِ اللهِ إِنْ يَتَّبِعُوْنَ إِلَّا الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلَّا يَخْرُصُوْنَ- ‘তোমার প্রতিপালকের বাণী সত্য ও ন্যায় দ্বারা পূর্ণ। তাঁর বাণীর পরিবর্তনকারী কেউ নেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’। ‘অতএব যদি তুমি জনপদের অধিকাংশ লোকের কথা মেনে চল, তাহ’লে ওরা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। তারা তো কেবল ধারণার অনুসরণ করে এবং তারা তো কেবল অনুমান ভিত্তিক কথা বলে’ (আন‘আম ৬/১১৫-১১৬)।
(খ) দ্বীনী কাজের মাধ্যমে মানুষের উপরে মর্যাদা ও বড়ত্ব কামনা করা : এটা দু’ভাবে হয়ে থাকে।
এক-
দ্বীনের বিনিময়ে মাল উপার্জন করা। এটি সম্পদের লোভের চাইতে অনেক বেশী মন্দ
ও অনেক বেশী ক্ষতিকর। কেননা ইলম, আমল ও যুহ্দের মাধ্যমে আখেরাত সন্ধান করা
হয় ও আল্লাহর নৈকট্য তালাশ করা হয়। অথচ তা না করে যদি এর উদ্দেশ্য সম্পদ
হাছিল করা হয়, তাহ’লে সেটি তার জন্য জাহান্নামের কারণ হবে। কেননা তার নিকটে
আখেরাতের পাথেয় থাকা সত্ত্বেও সে সেটিকে দুনিয়া হাছিলের পিছনে ব্যয় করেছে।
আর এটি হারাম পন্থায় মাল উপার্জনের মধ্যে পড়ে। এভাবে মালের লোভ ও দুনিয়াবী
স্বার্থ মানুষের দ্বীনকে ধ্বংস করে। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,بَادِرُوا بِالأَعْمَالِ فِتَنًا كَقِطَعِ
اللَّيْلِ الْمُظْلِمِ يُصْبِحُ الرَّجُلُ مُؤْمِنًا وَيُمْسِى كَافِرًا
أَوْ يُمْسِى مُؤْمِنًا وَيُصْبِحُ كَافِرًا يَبِيعُ دِينَهُ بِعَرَضٍ مِنَ
الدُّنْيَا ‘তোমরা গাঢ় অন্ধকার রাত্রির অংশ সদৃশ ফিৎনাসমূহে পতিত হওয়ার
পূর্বেই দ্রুত সৎকর্মসমূহের দিকে ধাবিত হও। যখন ব্যক্তি সকালে ঘুম থেকে
উঠবে মুমিন অবস্থায় ও সন্ধ্যা করবে কাফির অবস্থায়। আর সন্ধ্যা করবে মুমিন
অবস্থায় ও সকালে উঠবে কাফির অবস্থায়। সে দুনিয়ার বিনিময়ে তার দ্বীনকে
বিক্রি করবে’।[15] এখানে দুনিয়ার বিনিময়ে দ্বীন বিক্রয় করাকে কুফরী বলা
হয়েছে। যা মারাত্মক কবীরা গোনাহ। অত্র হাদীছে ‘কাফির’ অর্থ আল্লাহকে
অস্বীকারকারী ‘কাফির’ নয়। যা মুমিনকে ঈমানের গন্ডী থেকে বের করে দেয়।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ تَعَلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يُبْتَغَى بِهِ
وَجْهُ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ لاَ يَتَعَلَّمُهُ إِلاَّ لِيُصِيبَ بِهِ
عَرَضًا مِنَ الدُّنْيَا لَمْ يَجِدْ عَرْفَ الْجَنَّةِ يَوْمَ
الْقِيَامَةِ ‘যে ব্যক্তি ইলম শিক্ষা করল যার মাধ্যমে আল্লাহর চেহারা
অন্বেষণ করা হয়, অথচ সে তা শিক্ষা করে দুনিয়াবী সম্পদ অর্জন করার জন্য, সে
ক্বিয়ামতের দিন জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না’।[16]
এর
অর্থ এটা নয় যে, দ্বীনী ইলম শিখলে সম্পদ অর্জন করা যাবে না। বরং এর অর্থ
হ’ল দ্বীনকে অক্ষুণ্ণ রেখে বৈধ সম্পদ অর্জন করা। সম্পদ যেন লক্ষ্য না হয়
যে, দ্বীন বিক্রি করে হলেও তা অর্জন করতে হবে। আর ‘ক্বিয়ামতের দিন
জান্নাতের সুগন্ধি লাভ করা’ অর্থ দুনিয়াতেই তার নিদর্শন প্রকাশ পাওয়া। আর
তা হ’ল আল্লাহকে চেনা, তাকে ভালোবাসা ও তার সাক্ষাতের আকাংখী হওয়া। প্রতিটি
কাজে তার ভয় ও আনুগত্য প্রকাশ পাওয়া। সর্বদা তাকে স্মরণ করা ও সর্বাবস্থায়
তার উপর ভরসা করা। শ্রুতি ও প্রদর্শনী থেকে দূরে থাকা। নিরহংকার ও বিনয়ী
হওয়া। আল্লাহর জন্য ভালোবাসা ও আল্লাহর জন্য বিচ্ছেদ-এর নীতি অবলম্বন করা।
যার ইলম তাকে এসব জান্নাতী গুণাবলী অর্জনে সক্ষম করে, সে বেঁচে থাকতেই
দুনিয়ার জান্নাতে প্রবেশ করে। অতঃপর মৃত্যুর পর সে আখেরাতের জান্নাতের
সুগন্ধি লাভে ধন্য হয়। পক্ষান্তরে দুনিয়াতে যে আলেম দ্বীনের এই সুগন্ধি লাভ
করেনি, আখেরাতেও সে জান্নাতের সুগন্ধি পাবে না। এজন্য রাসূল (ছাঃ) দো‘আ
করতেন,اللَّهُمَّ إِنِّى أَعُوذُ بِكَ مِنْ عِلْمٍ لاَ يَنْفَعُ وَمِنْ
قَلْبٍ لاَ يَخْشَعُ وَمِنْ نَفْسٍ لاَ تَشْبَعُ وَمِنْ دَعْوَةٍ لاَ
يُسْتَجَابُ لَهَا ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি ঐ ইলম থেকে
যা কোন ফায়েদা দেয় না। ঐ অন্তর থেকে যা তোমার ভয়ে ভীত হয় না। ঐ আত্মা থেকে
যা তৃপ্ত হয় না এবং ঐ দো‘আ থেকে যা কবুল হয় না’।[17]
দুই-
ইলম, আমল ও দুনিয়া ত্যাগের মাধ্যমে মানুষের উপর নেতৃত্ব করা ও শ্রেষ্ঠত্ব
কামনা করা। যাতে মানুষ তাকে বড় আলেম মনে করে এবং সবাই তার দিকে তাকায়।
এগুলির পরিণাম জাহান্নাম ছাড়া কিছুই নয়। আখেরাতের হাতিয়ার দিয়ে যা অর্জন
করা হয় এবং যা অত্যন্ত নিকৃষ্ট ও গর্হিত কর্ম, মাল ও ক্ষমতার মাধ্যমে
আখেরাত ধ্বংস করার চাইতে। হযরত কা‘ব বিন মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ طَلَبَ الْعِلْمَ لِيُجَارِىَ بِهِ
الْعُلَمَاءَ أَوْ لِيُمَارِىَ بِهِ السُّفَهَاءَ أَوْ يَصْرِفَ بِهِ
وُجُوهَ النَّاسِ إِلَيْهِ أَدْخَلَهُ اللهُ النَّارَ ‘যে ব্যক্তি ইলম শিখে
এজন্য যে, তার দ্বারা সে আলেমদের সঙ্গে মুকাবিলা করবে অথবা বোকাদের সঙ্গে
ঝগড়া করবে অথবা লোকদের চেহারা তার দিকে ফিরিয়ে নিবে, আল্লাহ তাকে
জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন’।[18]
এইসব আলেমরা তাদের অমূল্য ইলমকে দুনিয়ার ন্যায় নিকৃষ্ট গোবরের বিনিময়ে বিক্রি করে, যা আখেরাতে কোন কাজে লাগে না। আলেমদের চাইতে আরও নিকৃষ্ট হ’ল ঐসব লোকেরা, যারা নিজেদেরকে পরহেযগার ও দুনিয়াত্যাগী হিসাবে দেখায়। অথচ সে আসলেই একজন দুনিয়াদার। এটি হ’ল সবচেয়ে বড় প্রতারণা। যা দিয়ে সে মানুষকে ধোঁকা দেয়। এখানে আবু সুলায়মান দারেনীর (১৪০-২১৫ হিঃ)-এর মত অনেক সালাফ ঐ ব্যক্তিকে দোষারোপ করতেন, যে ব্যক্তি মাথায় ‘আবা’ পরিধান করে। অথচ তার অন্তরে রয়েছে দুনিয়াবী প্রবৃত্তি।
দূর অতীতে এইসব দুষ্টমতি আলেমদের একজনের ঘটনা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন একদিন বাগদাদের রুছাফাহ (الرصافة) জামে মসজিদে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (১৬৪-২৪১ হি.) ও ইমাম ইয়াহইয়া বিন মাঈন (১৫৮-২৩৩ হি.) ছালাত আদায় করছিলেন। এমন সময় জামা‘আত শেষে একজন উঠে দাঁড়ালেন এবং সবাইকে হাদীছ শুনাতে লাগলেন। এভাবে তিনি প্রায় ২০ পৃষ্ঠা পাঠ করেন। যার মধ্যে এক স্থানে তিনি বলেন, আহমাদ বিন হাম্বল ও ইয়াহইয়া বিন মাঈন আমাদের বলেছেন, তারা আব্দুর রাযযাকের নিকট থেকে, তিনি ক্বাতাদাহর নিকট থেকে ও তিনি আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ يُخْلَقُ مِنْ كُلِّ كَلِمَةٍ مِنْهَا طَائِرٌ مِنْقَارُهُ مِنْ ذَهَبٍ وَرِيشُهُ مَرْجَانٌ ‘যে ব্যক্তি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে, আল্লাহ তার প্রতিটি শব্দ থেকে একটি করে পাখি সৃষ্টি করবেন। যাদের ঠোঁট হবে স্বর্ণের এবং পালক হবে ‘মারজান’ (প্রবাল) পাথরের’।[19]
এ
হাদীছ শুনে আহমাদ ও ইয়াহইয়া একে অপরকে জিজ্ঞেস করেন এবং তারা প্রত্যেকে
বলেন, আমরা ইতিপূর্বে কখনো এটি শুনিনি। তখন ইমাম ইয়াহইয়া তাকে ইঙ্গিতে
ডাকলেন। লোকটি পুরস্কার পাবে মনে করে দ্রুত তাঁর কাছে এল। অতঃপর ইয়াহইয়া
তাকে বললেন, কে আপনাকে এ হাদীছ শুনিয়েছেন? লোকটি বলল, ইমাম আহমাদ ও ইমাম
ইয়াহইয়া বিন মাঈন। জবাবে তিনি বললেন, আমি ইয়াহইয়া এবং ইনি আহমাদ। আমি কখনো
এমন কথা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কোন হাদীছের মধ্যে শুনেনি। যদি এরূপ থেকে
থাকে, তবে অবশ্যই সেটা অন্য কারু কাছ থেকে হবে। তখন ঐ বক্তা আলেম বলল, আমি
সর্বদা শুনে আসছি যে, ইয়াহইয়া বিন মাঈন একজন আহমক। আমি কখনো সেটা যাচাই
করিনি এই মুহূর্তে ছাড়া। ইয়াহইয়া বললেন, কিভাবে? সে বলল, দুনিয়াতে আপনারা
দু’জন ব্যতীত আর কি কোন ইয়াহইয়া ও আহমাদ বিন হাম্বল নেই? আমি ১৭ জন ইয়াহইয়া
ও আহমাদ থেকে হাদীছ লিখেছি’।[20]
এভাবে
অধিকাংশ বক্তা আল্লাহকে ভয় করে না। তাদের বক্তৃতার মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে
শ্রোতাদের মন জয় করা ও তাদেরকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করা। আল্লাহ ও রাসূল ও
ছাহাবীগণের নামে তারা বিনা দ্বিধায় যা ইচ্ছা বলে যায়। যেমন বাগদাদের এক
তাফসীর মাহফিলে জনৈক বক্তা সূরা বনু ইস্রাঈলের ৭৯ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন,
আল্লাহ মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে নিজ আরশে বসাবেন। তা শুনে মানুষ খুশীতে কেঁদে
বুক ভাসায়। কথাটি ইমাম ইবনু জারীর ত্বাবারীর (২২৪-৩১০ হি.) কানে গেলে তিনি
ভীষণভাবে ক্রুদ্ধ হন এবং স্বীয় বাসগৃহের দরজায় লিখে দেন, سُبْحَانَ مَنْ لَيْسَ لَهُ أَنِيْسٌ + وَلاَ لَهُ عَلَى عَرْشِهِ جَلِيْسٌ
‘মহা পবিত্র সেই সত্তা যার কোন একান্ত সাথী নেই এবং তাঁর আরশে তাঁর সাথে
বসবার কেউ নেই’। এটা পড়ে বাগদাদের আম জনতা তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তার
দরজায় পাথর নিক্ষেপ করতে থাকে। অবশেষে দরজা বন্ধ হয়ে যায় এবং কপাট ছাড়িয়ে
পাথরের ঢিবি উপরে উঠে যায়।[21]
এমনি করে দুনিয়াত্যাগী নামে পরিচিত পীর-মাশায়েখ ও অলি-আউলিয়াদের মাধ্যমে মানুষ প্রতারিত হয়। তাদের দ্বীনদারী দেখে মানুষ তাদেরকেই বড় মনে করে ও তাদের দরবারে গিয়ে ভিড় করে। এরূপ একজন ব্যক্তি ছিলেন বাগদাদের গোলাম খলীল (মৃ. ২৭৫ হি.) নামের একজন ব্যক্তি। যিনি ছিলেন দুনিয়াত্যাগী নীরব সাধক। যিনি সর্বদা ছালাত ও ইবাদতে রত থাকতেন। মানুষ তার প্রতি ছিল অত্যন্ত আসক্ত। শয়তান এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছিল এবং তাকে দিয়ে হাদীছ জাল করানোর কাজ নিয়েছিল। তিনি বলতেন, আমি এগুলো করি মানুষের হৃদয় গলানোর জন্য। হাদীছ জালকারী এই দরবেশ যেদিন মারা গেলেন, সেদিন তার শোকে বাগদাদের সকল দোকান-পাট বন্ধ হয়ে যায় (আস-সুন্নাহ ৮৭ পৃঃ)।
এইভাবে আরেক দল আলেম রাজা-বাদশা ও ধনিক শ্রেণীকে খুশী করার জন্য তাদের ইলম ব্যয় করে ও মিথ্যা হাদীছ বর্ণনা করে। যেমন গিয়াছ বিন ইবরাহীম নামে বাগদাদের এক বিখ্যাত আলেম একদা খলীফা মাহদী (১৫৮-১৬৯ হি.)-এর কাছে যান। যখন তিনি কবুতর নিয়ে খেলছিলেন। এটা দেখে ঐ আলেম হাদীছ বর্ণনা করলেনلاَ سَبَقَ إِلاَّ فِى نَصْلٍ أَوْ خُفٍّ أَوْ حَافِرٍ ‘তীর অথবা উট বা ঘোড়া ব্যতীত অন্য কিছুর মধ্যে প্রতিযোগিতা নেই।[22] কিন্তু এই সাথে তিনি বাড়িয়ে বললেন, أَوْ جَنَاحٍ ‘অথবা কবুতরবাযী’ (যঈফাহ হা/২২১)। যাতে খলীফা সেটা শুনে খুশী হন। খলীফা তাকে ১০ হাযার দিরহাম উপঢৌকন দিলেন। অতঃপর তিনি চলে গেলে খলীফা বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয়ই তুমি রাসূল (ছাঃ)-এর উপর একজন মিথ্যারোপকারী (كَذَّابٌ) মাত্র। অতঃপর তিনি তার কবুতরটি যবহ করার নির্দেশ দিলেন (আস-সুন্নাহ ৮৮ পৃঃ)। এযুগে যেসব নেতারা শান্তির নামে পায়রা উড়িয়ে দেন, তারা বিষয়টি খেয়াল করুন।
এমনিভাবে প্রবৃত্তি পূজারী ও স্বেচ্ছাচারী আলেমরা যুগে যুগে ইসলামের ক্ষতিসাধন করেছে এবং নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য মুমিনদের দ্বীন ও ঈমান নিয়ে খেলা করেছে। যদি ঐদিন খলীফা মাহদী ঐ ব্যক্তিকে কোন উপঢৌকন না দিতেন এবং নিরীহ কবুতরটিকে যবহ না করে ঐ মিথ্যুকটিকে শাস্তি দিতেন, তাহ’লে হাদীছ জাল করার দুঃসাহস কেউ দেখাত না। যেমন পরবর্তী খলীফা তার পুত্র হারূনুর রশীদ (১৭০-১৯১ হি.)-এর সময় তাঁরই জনৈক বিচারপতি কাযী আবুল বাখতারী এসে তাঁকে হাদীছ শুনিয়ে বলেন যে, كَانَ يُطَيِّرُ الْحَمَامَ ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিয়মিত কবুতর উড়াতেন’। বিদ্বান খলীফা বিষয়টি বুঝে ফেলেন এবং তাকে ধমক দিয়ে বলেন, ‘বেরিয়ে যাও এখান থেকে! যদি তুমি কুরায়েশ বংশীয় না হ’তে, তাহ’লে তোমাকে পদচ্যুত করতাম’ (আস-সুন্নাহ ৮৯ পৃঃ)।
তবে হারূনের পরে তার ছেলে মামূন (১৯৮-২১৮ হি.) মু‘তাযেলী হয়ে যান। ফলে তার ও তার পরবর্তী খলীফাদের সময় হকপন্থী আহলেহাদীছ বিদ্বানগণের উপর চরম নির্যাতন নেমে আসে। বস্ত্ততঃ কপট আলেম ও দরবেশরাই বিগত যুগে ইসলামের ক্ষতি করেছে সবচেয়ে বেশী। এইসব লোকেরা আমীর-ওমারা ও ধনিক শ্রেণীর বাড়ীতে বাড়ীতে এবং মসজিদ ও বাজার-ঘাটে জনগণের মধ্যে সর্বদা বিচরণ করত এবং মিথ্যা হাদীছ বলে ও কুরআন-হাদীছের অপব্যাখ্যা করে মানুষকে পথভ্রষ্ট করত। যদি সে সময় আহলেহাদীছ বিদ্বানগণ জান বাজি রেখে ময়দানে এগিয়ে না আসতেন, তাহ’লে ছহীহ হাদীছের অস্তিত্ব দুনিয়াতে থাকত না। ফলে ইসলামের রূহ শেষ হয়ে যেত। কেবল নামটুকু বাকী থাকত। একারণে ইমাম আবু দাঊদ (২০২-২৭৫ হি.) বলেছেন, لَوْلاَ هَذِهِ الْعِصَابَةُ لَانْدَرَسَ الْإِسْلاَمُ ‘যদি এই দলটি না থাকত, তাহ’লে ইসলাম মিটে যেত।[23] এই দল বলতে খাঁটি আহলেহাদীছ বিদ্বানদের বুঝানো হয়েছে। নামধারী ও কপট কোন ব্যক্তিকে নয়।
এভাবে দুষ্টু আলেমদের সংখ্যা সর্ব যুগে বেশী ছিল, আজও আছে। যদিও প্রত্যেকে নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবেন ও খাঁটি আলেম বলে দাবী করেন। সেকারণ তারা সর্বদা ফৎওয়া দিতে ভালবাসেন। বড় বড় ইসলামী জালসায় প্রশ্ন সমূহ আহবান করেন ও সেসবের উত্তর দিতে উৎসাহ বোধ করেন। যাতে বড় আলেম হিসাবে সর্বত্র তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। লোকেরা তাকে দামী দামী উপঢৌকন দেয়। অথচ ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফী বিদ্বানগণ ফৎওয়া প্রদান থেকে দূরে থাকতেন।
আব্দুর রহমান ইবনু আবী লায়লা (মৃ. ৮৩ হি.) বলেন, আমি ১২০ জন আনছার ছাহাবীকে দেখেছি যাদেরকে কোন বিষয় জিজ্ঞেস করা হলে তারা প্রত্যেকে চাইতেন যে তার অমুক ভাই এর জন্য যথেষ্ট হৌক। এইভাবে প্রত্যেকে ফিরিয়ে দিতেন। অবশেষে প্রথম ব্যক্তির কাছে প্রশ্নটি ফিরে আসত’।[24] ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলতেন, إِنَّ الَّذِى يُفْتِى النَّاسَ فِى كُلِّ مَا يُسْتَفْتَى فِيهِ لَمَجْنُونٌ- ‘যে ব্যক্তি যেকোন বিষয়ে চাইলেই ফৎওয়া দেয়, সে একটা পাগল’।[25] খলীফা ওমর বিন আব্দুল আযীয (৯৯-১০১ হি.)-এর নিকট কোন বিষয়ে ফৎওয়া চাইলে তিনি বলতেন, ما أَنا عَلى الفُتيا بِجَريءٍ ‘ফৎওয়া দেওয়ার মত দুঃসাহস আমার নেই’। তিনি তার জনৈক রাজকর্মচারীকে লেখেন, আল্লাহর কসম! আমি ফৎওয়া দানের ব্যাপারে আগ্রহী নই। যতক্ষণ না আমি বাধ্য হই’। ইমাম মালেক (৯৩-১৭৯ হি.)-কে কোন প্রশ্ন করা হলে মনে হ’ত যেন তিনি দাঁড়িয়ে আছেন জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝখানে’ (ইবনু রাজাব ৮৪ পৃঃ)।
সুফিয়ান ছাওরী (৯৭-১৬১ হি.) বলেন, আমরা বিদ্বানদের পেয়েছি এমতাবস্থায় যে, তারা ফৎওয়া প্রদান থেকে দূরে থাকতেন, যতক্ষণ না তারা বাধ্য হ’তেন’। ইমাম আহমাদ (১৬৪-২৪১ হি.)-কে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলতেন, الإمساك أحبُّ الىّ ‘বিরত থাকাই আমার নিকট উত্তম’। ক্বাতাদাহ (৬১-১১৮হি.) যখন ফৎওয়া দিতে বসেন, তখন আমর ইবনু দীনার (৪৬-১২৪ হি.) তাকে বলেন, আপনি জানেন কোন কাজে আপনি বসেছেন? আপনি নিক্ষিপ্ত হয়েছেন আল্লাহ ও বান্দার মাঝখানে। আপনি বলছেন এটা ঠিক এবং ওটা বেঠিক’। মুহাম্মাদ ইবনুল মুনকাদির (মৃ. ১৩০ হি.) বলতেন, আলেম আল্লাহ ও তার সৃষ্টি জগতের মাঝখানে প্রবেশ করে। অতএব সে দেখুক কিভাবে প্রবেশ করবে। ইবনু সীরীন (৩৩-১১০হি.)-কে হালাল ও হারাম বিষয়ে কোন প্রশ্ন করা হ’লে ভয়ে তাঁর চেহারা বিবর্ণ হয়ে যেত। তাকে আগের চেহারায় চেনা যেত না’।
কোন কোন সালাফী বিদ্বান মুফতীদের বলতেন, যখন তোমাকে কোন বিষয় প্রশ্ন করা হবে, তখন তোমার বড় চিন্তা যেন না হয় প্রশ্নকারীকে মুক্ত করা। বরং তোমার বড় চিন্তা যেন হয় নিজেকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করা’ (ইবনু রাজাব ৮৩-৮৪ পৃঃ)।
আবু
হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদীছে এসেছে রাসূল (ছাঃ) বলেন, ক্বিয়ামতের দিন
প্রথম যে তিন শ্রেণীর লোকের বিচার করা হবে, তাদের মধ্যে এক শ্রেণী হ’ল
আলেমগণ। অতঃপর দানশীল অতঃপর শহীদ। যাদের কোন আমলই কবুল করা হবে না তাদের
স্ব স্ব অহংকারের কারণে। অবশেষে তাদের উপুড় করে ফেলে মাটিতে চেহারা ঘেঁষে
টানতে টানতে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।[26]
উপরের আলোচনায় আমরা বলেছি যে, সম্পদ ও নেতৃত্ব এবং এ দু’টির লোভ মানুষের দ্বীনকে ধ্বংস করে দেয়। শেষে তার কিছুই অবশিষ্ট থাকে না যতটুকু আল্লাহ ইচ্ছা করেন ততটুকু ব্যতীত। আর এটি মূলতঃ দুনিয়ার লোভ থেকে আসে। আর দুনিয়ার লোভ আসে প্রবৃত্তি পূজা থেকে। আর প্রবৃত্তিপূজার ফলে মানুষ হারামকে হালাল করে। আল্লাহ বলেন, فَأَمَّا مَنْ طَغَى- وَآثَرَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا- فَإِنَّ الْجَحِيمَ هِيَ الْمَأْوَى- وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى- فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى- ‘যে ব্যক্তি সীমালংঘন করেছে’ ‘এবং পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে’ ‘জাহান্নাম তার ঠিকানা হবে’। ‘পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তার প্রভুর সম্মুখে দন্ডায়মান হওয়ার ভয় করেছে এবং নিজেকে প্রবৃত্তির গোলামী হ’তে বিরত রেখেছে’ ‘জান্নাত তার ঠিকানা হবে’ (নাযে‘আত ৭৯/৩৭-৪১)।
সম্পদ ও নেতৃত্ব লোভীদের পরকালীন পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, وَأَمَّا مَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ بِشِمَالِهِ فَيَقُولُ يَالَيْتَنِي لَمْ أُوتَ كِتَابِيَهْ- وَلَمْ أَدْرِ مَا حِسَابِيَهْ- يَالَيْتَهَا كَانَتِ الْقَاضِيَةَ- مَا أَغْنَى عَنِّي مَالِيَهْ- هَلَكَ عَنِّي سُلْطَانِيَهْ- ‘অতঃপর (ক্বিয়ামতের দিন) যার বাম হাতে আমলনামা দেওয়া হবে, সে বলবে, হায়! যদি আমি আমার আমলনামা না পেতাম’ ‘এবং আমি আমার হিসাব না জানতাম’। ‘হায়! যদি মৃত্যুই আমার জন্য চূড়ান্ত হ’ত’। ‘আজ আমার সম্পদ কোন কাজে আসল না’। ‘আমার ক্ষমতা আজ ধ্বংস হয়ে গেল’ (আল হা-ক্কাহ ৬৯/২৫-২৯)।
জানা আবশ্যক যে, উচ্চ সম্মান ও উচ্চ মর্যাদার লোভ মানুষের স্বভাবজাত। আর এ থেকেই অহংকার সৃষ্টি হয়। শয়তান তাকে উসকে দিয়ে মানুষকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করে। এই শয়তানী ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে পারাটাই আল্লাহর পরীক্ষা। হতভাগ্যরা এই ফাঁদে পা দিয়ে দুনিয়া অর্জন করে ও আখেরাতে বঞ্চিত হয়।
কিন্তু জ্ঞানীরা
স্থায়ী মর্যাদা চায়। যাতে আল্লাহর নৈকট্য লাভ হয় এবং যা আখেরাতে পাওয়া যায়।
কেননা দুনিয়ার বড়ত্ব সাময়িক ও নিন্দনীয়। কিন্তু আখেরাতের মর্যাদা
চিরস্থায়ী ও প্রশংসনীয়। আল্লাহ বলেন,وَفِي ذَلِكَ فَلْيَتَنَافَسِ
الْمُتَنَافِسُونَ- ‘আর এরূপ বিষয়েই প্রতিযোগীদের প্রতিযোগিতা করা উচিত’ (মুত্বাফফেফীন ৮৩/২৬)।
হাসান বাছরী (২১-১১০ হি.) বলেন, إذَا رَأَيْت الرَّجُلَ يُنَافِسُ فِي
الدُّنْيَا فَنَافِسْهُ فِي الآخِرَةِ ‘যখন তুমি দেখবে কেউ তোমার সঙ্গে
দুনিয়ার ব্যাপারে প্রতিযোগিতা করছে, তখন তুমি তার সঙ্গে আখেরাতের বিষয়ে
প্রতিযোগিতা কর’।[27]
ওমর ফারূক (রাঃ)-এর
নিকটে জনৈক ব্যক্তি লোকদের প্রতি ওয়ায করার অনুমতি চাইলে তিনি তাকে বলেন,
أَخْشَى عَلَيْكَ أَنْ تَقُصَّ فَتَرْتَفِعَ عَلَيْهِمْ فِى نَفْسِك ثُمَّ
تَقُصَّ فَتَرْتَفِعَ حَتَّى يُخَيَّلَ إِلَيْكَ أَنَّكَ فَوْقَهُمْ
بِمَنْزِلَةِ الثُّرَيَّا فَيَضَعَكَ اللَّهُ تَحْتَ أَقْدَامِهِمْ يَوْمَ
الْقِيَامَةِ بِقَدْرِ ذَلِكَ. ‘আমার ভয় হয় ওয়ায করার ফলে তোমার মধ্যে
ধ্রুবতারার ন্যায় উচ্চ মর্যাদা পাওয়ার অহংকার সৃষ্টি হবে। আর তাতে আল্লাহ
তোমাকে ক্বিয়ামতের দিন ঐসব লোকদের পায়ের তলায় রাখবেন’।[28]
রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) বলেছেন,يُحْشَرُ الْمُتَكَبِّرُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَمْثَالَ
الذَّرِّ فِى صُوَرِ الرِّجَالِ يَغْشَاهُمُ الذُّلُّ مِنْ كُلِّ مَكَانٍ
فَيُسَاقُونَ إِلَى سِجْنٍ فِى جَهَنَّمَ يُسَمَّى بُولَسَ تَعْلُوهُمْ
نَارُ الأَنْيَارِ يُسْقَوْنَ مِنْ عُصَارَةِ أَهْلِ النَّارِ طِينَةِ
الْخَبَالِ- ক্বিয়ামতের দিন অহংকারীরা হাশরের ময়দানে মানুষের অবয়বে ক্ষুদ্র
পিপীলিকার ন্যায় জমা হবে, তাদেরকে ‘বূলুস’ (بولُس) নামক
জাহান্নামে হাঁকিয়ে নেওয়া হবে। সেখানে আগুনের উপর আগুন বৃদ্ধি করা হবে এবং
তাদেরকে জাহান্নামীদের গলিত পুঁজ-রক্ত ‘ত্বীনাতুল খাবাল’ পান করানো হবে।[29]
ওয়াহাব বিন মুনাবিবহ (মৃ. ১১০ হি.) একদা মাকহূল (মৃ. ১১২ হি.)-কে লেখেন فإنكَ أصبتَ بظاهرِ علمكَ عندَ الناسِ شَرفًا ومنزلةً، فاطلُبْ بباطنِ علمكَ عندَ اللَّه منزلةً وزُلْفَى، واعلمْ أنَّ إِحدَى المنزلَتيِن تمنعُ من الأخْرى- ‘আপনি প্রকাশ্য ইলমের মাধ্যমে মানুষের নিকট সম্মান ও মর্যাদা লাভ করেছেন। এক্ষণে গোপন ইলমের মাধ্যমে আল্লাহর নিকট সম্মান ও নৈকট্য হাছিল করুন। মনে রাখবেন একটির মর্যাদা অন্যটিকে বাধা প্রদান করে’।
এখানে ‘প্রকাশ্য ইলম’ বলতে শরী‘আতের ইলম, ফৎওয়া প্রদান, ওয়ায-নছীহত ইত্যাদিকে বুঝানো হয়েছে। আর ‘গোপন ইলম’ বলতে আল্লাহকে চেনা, তাকে ভয় করা, তাকে ভালোবাসা, তার উপর ভরসা করা, তাকদীরের ফায়ছালার উপর সন্তুষ্ট থাকা, ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার সম্পদের আকাংখা থেকে বিরত হওয়া এবং চিরস্থায়ী আখেরাতের সম্পদ লাভে আকাংখী হওয়া ইত্যাদিকে বুঝানো হয়েছে। যার একটি অপরটির বিপরীত। কেননা দুনিয়া লাভের আকাংখা আখেরাত লাভের আকাংখাকে বারিত করে। ফলে সে আখেরাতকে বেছে নেয় এবং তাকে দুনিয়ার উপরে অগ্রাধিকার দেয়। আল্লাহ বলেন, مَنْ كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الْآخِرَةِ نَزِدْ لَهُ فِي حَرْثِهِ وَمَنْ كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الدُّنْيَا نُؤْتِهِ مِنْهَا وَمَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ نَصِيبٍ ‘যে কেউ পরকালের ফসল কামনা করে, আমরা তার ফসল বাড়িয়ে দেই। আর যে ব্যক্তি ইহকালের ফসল কামনা করে, আমরা তাকে সেখান থেকে কিছু দিয়ে থাকি। কিন্তু পরকালে তার কোনই অংশ থাকবে না’ (শূরা ৪২/২০)।
এর
অর্থ এটা নয় যে, সে একেবারেই দুনিয়াত্যাগী হবে। বরং এর অর্থ আখেরাতকে
অগ্রাধিকার দিয়ে দুনিয়া করা, যতটুকু না করলে নয়। আর দুনিয়ার ফিৎনা যেন তাকে
গ্রেফতার না করে সেজন্য দুনিয়ায় ও আখেরাতে কল্যাণ চেয়ে আল্লাহর কাছে
প্রার্থনা করতে হবে। যেমন রাসূল (ছাঃ) অধিকাংশ ছালাতে এই দো‘আ করতেন
رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَّفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً
وَّقِنَا عَذَابَ النَّارِ ‘হে আল্লাহ! হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি আমাদেরকে
দুনিয়াতে মঙ্গল দাও ও আখেরাতে মঙ্গল দাও এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব
থেকে বাঁচাও’।[30]
আখেরাতের আকাংখী ব্যক্তিরা আল্লাহ ও বান্দার ভালোবাসা পায়। যেমন আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَيَجْعَلُ لَهُمُ الرَّحْمَنُ وُدًّا- ‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম সমূহ সম্পাদন করে, সত্বর তাদের জন্য দয়াময় (স্বীয় বান্দাদের অন্তরে) মহববত সৃষ্টি করে দিবেন’ (মারিয়াম ১৯/৯৬)।
রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) বলেন, إِنَّ اللهَ إِذَا أَحَبَّ عَبْدًا دَعَا جِبْرِيلَ فَقَالَ
إِنِّى أُحِبُّ فُلاَنًا فَأَحِبَّهُ- قَالَ : فَيُحِبُّهُ جِبْرِيلُ ثُمَّ
يُنَادِى فِى السَّمَاءِ فَيَقُولُ إِنَّ اللهَ يُحِبُّ فُلاَنًا
فَأَحِبُّوهُ. فَيُحِبُّهُ أَهْلُ السَّمَاءِ- قَالَ : ثُمَّ يُوضَعُ لَهُ
الْقَبُولُ فِى الأَرْضِ. وَإِذَا أَبْغَضَ عَبْدًا دَعَا جِبْرِيلَ
فَيَقُولُ إِنِّى أُبْغِضُ فُلاَنًا فَأَبْغِضْهُ- قَالَ : فَيُبْغِضُهُ
جِبْرِيلُ ثُمَّ يُنَادِى فِى أَهْلِ السَّمَاءِ إِنَّ اللهَ يُبْغِضُ
فُلاَنًا فَأَبْغِضُوهُ- قَالَ : فَيُبْغِضُونَهُ ثُمَّ تُوضَعُ لَهُ
الْبَغْضَاءُ فِى الأَرْضِ- ‘যখন আল্লাহ কোন বান্দাকে ভালবাসেন, তখন ডেকে
বলেন, হে জিব্রীল! আমি অমুককে ভালবেসেছি। তুমিও তাকে ভালবাস। তখন জিব্রীল
তাকে ভালবাসেন এবং তিনি সেটি আসমানবাসীদের বলে দেন। তখন তারা তাকে
ভালবাসেন। অতঃপর উক্ত ভালোবাসা যমীনে নামিয়ে দেওয়া হয়। পক্ষান্তরে আল্লাহ
যখন কোন বান্দার উপরে ক্রুদ্ধ হন, তখন ডেকে বলেন, হে জিব্রীল! আমি অমুকের
প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছি। তুমিও তার প্রতি ক্রুদ্ধ হও। তখন জিব্রীল তার প্রতি
ক্রুদ্ধ হন এবং তিনি সেটি আসমানবাসীদের বলে দেন। তখন তারা তার প্রতি
ক্রুদ্ধ হন। অতঃপর উক্ত ক্রোধ যমীনে নামিয়ে দেওয়া হয়’।[31]
মোটকথা
আখেরাতের মর্যাদা সন্ধান করলে দুনিয়ার মর্যাদা সেই সাথে অর্জিত হয়। যদিও
সে ব্যক্তি তার কামনা করে না বা তার জন্য চেষ্টাও করে না। আর যে ব্যক্তি
দুনিয়ার মর্যাদা সন্ধান করে, সে কেবল সেটাই পায়। কিন্তু আখেরাত হারায়।
কেননা দু’টি বস্ত্ত কখনো এক সাথে অর্জন করা যায় না। অতএব সৌভাগ্যবান সেই,
যে ব্যক্তি চিরস্থায়ী মর্যাদাকে ক্ষণস্থায়ীর উপর প্রাধান্য দেয়। যেমন আবু
মূসা আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,مَنْ أَحَبَّ
دُنْيَاهُ أَضَرَّ بِآخِرَتِهِ وَمَنْ أَحَبَّ آخِرَتَهُ أَضَرَّ
بِدُنْيَاهُ فَآثِرُوا مَا يَبْقَى عَلَى مَا يَفْنَى ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াকে
ভালবাসবে, সে তার আখেরাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আর যে ব্যক্তি আখেরাতকে
ভালবাসবে, সে তার দুনিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। অতএব তোমরা ধ্বংসশীল বস্ত্তর
উপরে চিরস্থায়ী বস্ত্তকে অগ্রাধিকার দাও’।[32]
লোভ দমনে করণীয় :
দুনিয়ার লোভ দমন করার জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলির প্রতি সর্বদা দৃষ্টি রাখতে হবে। (১) ঐসব কর্তৃত্বশীল লোকদের মন্দ পরিণতির দিকে দৃষ্টি দেওয়া, যারা আখেরাতের হক আদায় করেনি। ফলে তারা আল্লাহর রহমত ও মানুষের দো‘আ থেকে চিরবঞ্চিত হয়েছে। বিগত যুগের ও বর্তমান যুগের দুষ্টু নেতারা এর বাস্তব উদাহরণ। (২) মিথ্যাবাদী, অহংকারী ও যালেমদের উপর আল্লাহর প্রতিশোধ থেকে শিক্ষা নেওয়া (৩) বিনয়ী ব্যক্তিদের প্রতি দুনিয়াতে আল্লাহর পুরস্কার এবং আখেরাতে তাদের উচ্চ মর্যাদার প্রতি দৃষ্টিপাত করা। (৪) আল্লাহ ওয়ালা ব্যক্তিদের পবিত্র জীবন ও দুনিয়াবী মর্যাদা থেকে উদ্বুদ্ধ হওয়া। যেমন আল্লাহ বলেন, مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُمْ بِأَحْسَنِ مَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ- ‘পুরুষ হৌক নারী হৌক মুমিন অবস্থায় যে সৎকর্ম সম্পাদন করে, আমরা তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং অবশ্যই তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম অপেক্ষা উত্তম পুরস্কারে ভূষিত করব’ (নাহল ১৬/৯৭)। বস্ত্ততঃ পবিত্র জীবন লাভ করাই হ’ল দুনিয়াতে আল্লাহর দেওয়া সবচেয়ে বড় পুরস্কার। এছাড়া আখেরাতের অতুলনীয় পুরস্কার তো আছেই। যা চোখ কখনো দেখেনি, কান কখনো শোনেনি এবং হৃদয় কখনো কল্পনা করেনি।[33] নিঃসন্দেহে আলেম যখন তার ইলমের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করবে তখন সবাই তাকে ভয় করবে। আর যখন তার দ্বারা সে মাল বৃদ্ধি কামনা করবে, তখন সে অন্যকে ভয় করবে। অতএব সকল কল্যাণ নিহিত রয়েছে আল্লাহর আনুগত্যের মধ্যে। আর আল্লাহর অনুগত বান্দা দুনিয়া ও আখেরাতের মালিক। আল্লাহ বলেন, وَلِلَّهِ الْعِزَّةُ وَلِرَسُولِهِ وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَلَكِنَّ الْمُنَافِقِينَ لاَ يَعْلَمُونَ ‘সকল সম্মান আল্লাহর জন্য, তার রাসূলের জন্য এবং মুমিনদের জন্য। কিন্তু কপট বিশ্বাসীরা তা জানে না’ (মুনাফিকূন ৬৩/৮)।
সম্পদ লাভের ক্ষতিকর দিক সমূহ :
(১) এটি মানুষের প্রবৃত্তি পরায়ণতাকে উসকে দেয়। (২) বিলাসিতার প্রতি তার অন্তর ধাবিত হয়। (৩) কখনো কখনো হালাল আয়ের সীমা অতিক্রম করে সে সন্দেহযুক্ত আয়ের মধ্যে প্রবেশ করে। এমনকি যুক্তি দিয়ে হারামকে হালাল করে। (৪) সে আল্লাহ থেকে উদাসীন হয়ে পড়ে।
সম্মান লাভের ক্ষতিকর দিক সমূহ :
(১) এজন্য সে তার সমস্ত মাল-সম্পদ লুটিয়ে দেয়। (২) তার মধ্যে রিয়া ও নিফাক্ব প্রবেশ করে। যা তাকে চরিত্রহীন করে ফেলে। আর এটাই হ’ল তার সকল ক্ষতির বড় ক্ষতি।
চার ধরনের মানুষ :
ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ
(রহঃ) বলেন, মাল ও সম্পদ কামনার বিষয়ে চার ধরনের মানুষ রয়েছে। (১) যারা
আল্লাহর অবাধ্যতার মাধ্যমে মানুষের উপর কর্তৃত্ব চায় ও বিশৃংখলা সৃষ্টি
করে। যেমন দুষ্টমতি রাজা-বাদশা ও সমাজনেতারা। (২) যারা কর্তৃত্ব কামনা
ছাড়াই সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টি করে। যেমন চোর-বাটপার প্রভৃতি নিম্নশ্রেণীর
লোকেরা (৩) যারা বিশৃংখলা ছাড়াই কেবল কর্তৃত্ব চায়। যেমন ঐসব দ্বীনদার লোক
যারা দ্বীনের মাধ্যমে সমাজের উপর তাদের শ্রেষ্ঠত্ব কামনা করে। (৪)
জান্নাতীগণ। যারা সমাজে শ্রেষ্ঠত্ব চায় না ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করে না।[34]
এক্ষণে
সম্পদ ও কর্তৃত্ব যদি আল্লাহর নৈকট্য হাছিলে ব্যয়িত হয়, তবে সেটাতে দ্বীন ও
দুনিয়ার কল্যাণ রয়েছে। আর যদি তা না থাকে, তাহ’লে তা হয় সমাজের জন্য
সবচেয়ে ক্ষতিকর। যেটাকে হাদীছে ক্ষুধার্ত নেকড়ে বাঘের সঙ্গে তুলনা করা
হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ اللهَ لاَ يَنْظُرُ إِلَى صُوَرِكُمْ
وَأَمْوَالِكُمْ وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের চেহারা ও মাল দেখেন না। তিনি দেখেন তোমাদের হৃদয় ও
কর্ম’।[35]
এক্ষণে যে ব্যক্তি জিহাদ ও ক্ষমতার মাধ্যমে দ্বীন কায়েমে ব্যর্থ হবে, সে ব্যক্তি উপদেশের মাধ্যমে ও আল্লাহর নিকট দো‘আর মাধ্যমে সেটা করবে। সর্বোপরি সে তার সর্বোচ্চ সাধ্য মতে আল্লাহর আনুগত্য করে যাবে।
আলোচ্য হাদীছে কঠোর সাবধানবাণী রয়েছে সম্পদ ও মর্যাদা লোভী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। যা থাকলে কারু দ্বীন নিরাপদ থাকবে না আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহপ্রাপ্ত স্বল্প সংখ্যক লোকেরা ব্যতীত। এজন্য এ দু’টি লোভকে দু’টি ক্ষুধার্ত নেকড়ে বাঘের সাথে তুলনা করা হয়েছে। যা মুমিনের ঈমানকে খেয়ে ফেলে। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাযত করুন- আমীন!
[1]. তিরমিযী হা/২৩৭৬; মিশকাত হা/৫১৮১।
[2]. বায়হাক্বী, শু‘আব হা/১০২৬৮।
[3]. বুখারী হা/৬৪৬০; মুসলিম হা/১০৫৫; মিশকাত হা/৫১৬৪।
[4]. ইবনু মাজাহ হা/৪১০৭; আহমাদ হা/৮৬৮১; ছহীহ আত-তারগীব হা/৩১৬৬; মিশকাত হা/৫১৭২।
[5]. ইবনু রজব হাম্বলী (৭৩৬-৭৯৫ হিঃ), মাজমূ‘ রাসায়েল ৬৫ পৃ.।
[6]. খতীব বাগদাদী, কিতাবুল বুখালা ২২২ পৃ.।
[7]. আবুদাঊদ হা/১৬৯৮।
[8]. মুসলিম হা/২৫৭৮; মিশকাত হা/১৮৬৫।
[9]. আহমাদ হা/৯৬৯১; নাসাঈ হা/৩১১১; মিশকাত হা/৩৮২৮।
[10]. বুখারী হা/৬৬২২; মুসলিম হা/১৬৫২; মিশকাত হা/৩৬৮০।
[11]. বুখারী হা/৭১৪৮; মিশকাত হা/৩৬৮১।
[12]. বুখারী হা/৭১৪৯, ২২৬১; মুসলিম হা/১৭৩৩; মিশকাত হা/৩৬৮৩।
[13]. আবুদাঊদ হা/৪০৯০; মিশকাত হা/৫১১০; মিশকাতে ‘মুসলিম’ লেখা হয়েছে। কিন্তু মুসলিমের রেওয়ায়াতে (হা/২৬২০) কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে।
[14]. আবু নু‘আইম ইছফাহানী, হিলইয়াতুল আউলিয়া ৫/২৯২।
[15]. মুসলিম হা/১১৮; মিশকাত হা/৫৩৮৩ ‘ফিৎনাসমূহ’ অধ্যায়।
[16]. আবুদাঊদ হা/৩৬৬৪; ইবনু মাজাহ হা/২৫২; মিশকাত হা/২২৭।
[17]. মুসলিম হা/২৭২২; মিশকাত হা/২৪৬০।
[18]. তিরমিযী হা/২৬৫৪, সনদ হাসান; মিশকাত হা/২২৫।
[19]. ইবনুল জাওযী, কিতাবুল মাওযূ‘আত ১/৪৬ পৃঃ।
[20]. যাহাবী, মীযানুল ই‘তিদাল ১/৪৭; আবু যাহু, আল-হাদীছ ওয়াল মুহাদ্দিছূন ৩৪২ পৃঃ।
[21]. মুছত্বফা আস-সুবাঈ (১৯১৫-১৯৬৪ খ্রি.), আস-সুন্নাহ ওয়া মাকানাতুহা ৮৬-৮৭ পৃঃ।
[22]. তিরমিযী হা/১৭০০; নাসাঈ হা/৩৫৮৬; মিশকাত হা/৩৮৭৪, সনদ ছহীহ।
[23]. আবুবকর আল-খত্বীব বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ পৃঃ ২৯।
[24]. ইবনু রজব ৮৪ পৃঃ; ইবনু হাজার, তালখীছুল হাবীর ৪/৪৫৪।
[25]. দারেমী হা/১৭১, সনদ ছহীহ।
[26]. মুসলিম হা/১৯০৫; মিশকাত হা/২০৫ ‘ইলম’ অধ্যায়।
[27]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/৩৬৩৫১।
[28]. আহমাদ হা/১১১, সনদ হাসান।
[29]. তিরমিযী হা/২৪৯২; ছহীহ আত-তারগীব হা/৩৫৮৩, সনদ হাসান; মিশকাত হা/৫১১২।
[30]. বুখারী হা/৪৫২২, ৬৩৮৯; বাক্বারাহ ২/২০১; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৪৮৭।
[31]. মুসলিম হা/২৬৩৭; বুখারী হা/৩২০৯; মিশকাত হা/৫০০৫।
[32]. আহমাদ হা/১৯৭১২; ছহীহ আত-তারগীব হা/৩২৪৭; মিশকাত হা/৫১৭৯।
[33]. বুখারী হা/৩২৪৪; মুসলিম হা/২৮২৪; মিশকাত হা/৫৬১২।
[34]. ইবনু তায়মিয়াহ, আস-সিয়াসাতুশ শারঈয়াহ ২১৭-১৯ পৃঃ।
[35]. মুসলিম হা/২৫৬৪; মিশকাত হা/৫৩১৪।