নওদাপাড়া, রাজশাহী ২৮শে আগস্ট শুক্রবার : অদ্য সকাল ৯-টা হ’তে রাত ৯-টা পর্যন্ত রাজশাহী মহানগরীর নওদাপাড়ায় অনুষ্ঠিত ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর বার্ষিক কর্মী সম্মেলনে প্রদত্ত উদ্বোধনী ভাষণে সম্মেলনের সভাপতি মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব উপরোক্ত কথা বলেন।
তিনি বলেন, ইসলাম হয় দাওয়াতের মাধ্যমে এবং ইমারত হয় বায়‘আতের মাধ্যমে। যা সমাজ সংস্কারের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয়। তিনি বলেন, যে কোন জিনিস প্রতিষ্ঠা করতে গেলে যোগ্য নেতা, নির্দিষ্ট লক্ষ্য, নির্দিষ্ট কর্মপন্থা ও একদল নিবেদিতপ্রাণ কর্মী আবশ্যক। যেমন একটি সুন্দর বাড়ী তৈরী করতে একদল জোগাড়ে ও কিছু দক্ষ মিস্ত্রী দরকার। শুধু একদল জোগাড়ে যেমন একটি সুন্দর বাড়ী তৈরী করতে পারে না, তেমনি জোগাড়ে বাদ দিয়ে শুধু মিস্ত্রী তা তৈরী করতে পারে না।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে দুনিয়ায় এসেছিলেন। তা হ’ল জাহেলী সমাজকে আল্লাহভীরু সমাজে পরিণত করা। এজন্য তিনি দাওয়াত ও বায়‘আতের মাধ্যমে নিবেদিতপ্রাণ একদল কর্মীকে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠায় কাজে লাগান। কারণ তিনি দূরদর্শী নেতা হিসাবে ভাল করেই জানতেন যে, অঙ্গীকারহীন কোন মানুষকে সামনে রেখে সংস্কার ও দাওয়াতী কাজে সফল হওয়া যাবে না। তাই তিনি হজ্জের মৌসুমে ইয়াছরিব থেকে আগত প্রথমবার ৬ জন, দ্বিতীয়বার ১২ জন ও তৃতীয়বার ৭৫ জন কর্মীকে আল্লাহর নামে বায়‘আত নেন। তারা বললেন, এই বায়‘আত যদি আমরা পূর্ণ করি, তবে মাল-সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতি ও নেতাদের হতাহতের বিনিময়ে কি পাব? জবাবে রাসূল (ছাঃ) বলেছিলেন, জান্নাত। তখন বায়‘আতকারীগণ বলেছিলেন, আল্লাহর কসম আমরা কখনোই এই বায়‘আত পরিত্যাগ করব না এবং তা ভঙ্গ করব না’ (আহমাদ হা/১৪৪৯৬, সনদ ছহীহ)।
তিনি বলেন, বায়‘আত ও হিজরত অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই উক্ত অঙ্গীকারাবদ্ধ ব্যক্তিদের আহবানে রাসূলু্ল্লাহ (ছাঃ) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেন। হিজরতের পর বদরের যুদ্ধে এই ঈমানদার ব্যক্তিদের দৃঢ় ঈমানী চেতনার ফলে আল্লাহর রহমতে বিজয় অর্জিত হয়। হঠাৎ আবু জাহলের সুপরিকল্পিত আক্রমণের খবর শুনে অপ্রস্ত্তত অবস্থায় রাসূল (ছাঃ) পরামর্শ বৈঠক আহবান করেন। একদল যুদ্ধ না করে মদীনায় ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। কেননা তারা এসেছিলেন কুরায়েশদের বাণিজ্য কাফেলা আটকানোর জন্য, বড় ধরণের কোন যুদ্ধ করার জন্য নয়। অতঃপর মুহাজিরগণের মধ্য থেকে মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ (রাঃ) বললেন, ‘সেই সত্তার কসম, যিনি আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন, যদি আমাদেরকে নিয়ে আপনি বারকুল গিমাদ পর্যন্ত চলে যান, তবে আমরা অবশ্যই আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে সেই স্থান পর্যন্ত চলে যাব। কিন্তু আমরা মূসার কওমের মত আপনাকে বলব না যে, ‘আপনি ও আপনার রব গিয়ে যুদ্ধ করুন, আমরা এখানে বসে রইলাম’। বরং আমরা বলব, ‘আপনি ও আপনার রব গিয়ে যুদ্ধ করুন, আমরা আপনার সাথী হয়ে অবশ্যই যুদ্ধ করব’। তাঁর এই বক্তব্য শুনে রাসূল (ছাঃ) খুবই খুশী হ’লেন এবং তার জন্য কল্যাণের দো‘আ করলেন। অতঃপর আনছারগণের পক্ষে আওস নেতা সা‘দ বিন মু‘আয একইভাবে বললেন, যদি আপনি আমাদের নিয়ে এ সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তবে আমরাও আপনার সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ব। আমাদের একজন লোকও পিছিয়ে থাকবেনা। অতএব আপনি আমাদের নিয়ে আল্লাহর নামে এগিয়ে চলুন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার জন্য কল্যাণের দো‘আ করলেন। রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবীদের দৃঢ় ঈমানী চেতনায় আল্লাহ খুশী হয়ে ফেরেশতা পাঠালেন। ফলে বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের অভাবিত বিজয় অর্জিত হয়। যা ছিল ইসলামের ইতিহাসে মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা। এর মাধ্যমে আল্লাহ সত্যকে সত্য ও মিথ্যাকে মিথ্যা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন’ (আনফাল ৮)। এখনও যদি আমরা বলিষ্ঠ ঈমান নিয়ে দাওয়াতী ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ি, তাহ’লে আল্লাহ আমাদের সাহায্যেও ফেরেশতা পাঠাবেন ইনশাআল্লাহ। তাই ঈমানকে মযবূত করুন! শিরক ও বিদ‘আতের সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করুন!
করোনা মহামারীর মধ্যেও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে স্রেফ দ্বীনের মহববতে ও সংগঠনের টানে যেসব কর্মী এখানে উপস্থিত হয়েছেন, তাদের সবাইকে সাদর অভিনন্দন জানিয়ে মুহতারাম আমীরে জামা‘আত আল্লাহর নামে দিনব্যাপী কর্মী সম্মেলনের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন।
সকাল ৯-টায় পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে সম্মেলন শুরু হয়। অতঃপর ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ সম্পাদক মাওলানা আলতাফ হোসাইনের পরিচালনায় ১ম অধিবেশনে কেন্দ্রীয় সেক্রেটারী জেনারেল অধ্যাপক মাওলানা নূরুল ইসলাম স্বাগত ভাষণ দেন। অতঃপর সকাল সাড়ে ৯-টায় মুহতারাম আমীরে জামা‘আত উদ্বোধনী ভাষণ পেশ করেন।
আমীরে জামা‘আতের উদ্বোধনী ভাষণের পর বিষয়ভিত্তিক আলোচনা শুরু হয়। ‘কর্মী গঠনের ধারাবাহিকতা’ বিষয়ে কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রশীদ আখতার (কুষ্টিয়া), ‘আন্দোলন’-এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ’ বিষয়ে কেন্দ্রীয় যুববিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক আমীনুল ইসলাম (রাজশাহী), ‘দাওয়াতী জীবনে প্রশিক্ষণের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা’ বিষয়ে কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ সম্পাদক মাওলানা আলতাফ হোসাইন (সাতক্ষীরা), ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন কি চায়, কেন চায় ও কিভাবে চায়?’ বিষয়ে কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক ও আত-তাহরীক এর সহকারী সম্পাদক ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম (মারকায), ‘সাংগঠনিক জীবনে হিংসা ও অংহংকার থেকে বেঁচে থাকার আবশ্যকতা’ বিষয়ে কেন্দ্রীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক মাওলানা দুররুল হুদা (রাজশাহী), ‘উন্নত জীবন গঠনে রাসূল (ছাঃ)-এর সীরাত পাঠের গুরুত্ব’ বিষয়ে আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়ার ভাইস প্রিন্সিপাল ড. নূরুল ইসলাম (রাজশাহী), ‘ইখলাছ ও তাক্বওয়া সফলতার চাবিকাঠি’ বিষয়ে আল-ফুরক্বান ইসলামিক সেন্টার, বাহরাইন-এর দাঈ শরীফুল ইসলাম (রাজশাহী), ‘নেতৃত্বের অপরিহার্য গুণাবলী’ বিষয়ে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম (যশোর) আলোচনা পেশ করেন।
অতঃপর বাদ জুম‘আ বিকাল ৩-টায় কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য কাযী হারূণুর রশীদের পরিচালনায় ২য় অধিবেশন শুরু হয়। সেখানে সংগঠনের উন্নতি ও অগ্রগতি বিষয়ে যেলা সভাপতি ও প্রতিনিধিগণের মধ্য হ’তে পরামর্শমূলক বক্তব্য সমূহ আহবান করা হয়। তাতে একে একে বক্তব্য পেশ করেন ঢাকা-দক্ষিণ সাংগঠনিক যেলা ‘আন্দোলন’-এর উপদেষ্টা তাসলীম সরকার, সাতক্ষীরা যেলা সভাপতি মাওলানা আব্দুল মান্নান, মেহেরপুর যেলা সভাপতি মাওলানা মানছূরুর রহমান ও কিশোরগঞ্জ যেলা সভাপতি অধ্যাপক এস.এম. নূরুল ইসলাম সরকার।
অতঃপর বাদ আছর কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলামের পরিচালনায় ৩য় অধিবেশন শুরু হয়। সেখানে ‘আদর্শ সোনামণি গঠনে ‘সোনামণি’ সংগঠনের ভূমিকা’ বিষয়ে ‘সোনামণি’র কেন্দ্রীয় পরিচালক মুহাম্মাদ আব্দুল হালীম (রাজশাহী), ‘যুবচরিত্র সংশোধনে ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র ভূমিকা’ বিষয়ে ‘যুবসংঘ’-এর কেন্দ্রীয় সভাপতি ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব, ‘সমাজ সংস্কারে সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা’ বিষয়ে মাওলানা আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল (ঢাকা থেকে অনলাইনে), ‘ঐক্যের মানদন্ড’ বিষয়ে খুলনা যেলা সভাপতি মাওলানা জাহাঙ্গীর আলম (খুলনা থেকে অনলাইনে), ‘ইত্তেবা ও তাক্বলীদের মধ্যে পার্থক্য’ বিষয়ে মাওলানা মুখলেছুর রহমান (নওগাঁ) বক্তব্য পেশ করেন।
এরপর অনলাইনে ‘আন্দোলন’-এর প্রবাসী শাখার দায়িত্বশীলদের মধ্যে বক্তব্য পেশ করেন ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ সঊদী আরব শাখার সাধারণ সম্পাদক মাওলানা আব্দুল হাই, মালয়েশিয়া শাখার সাধারণ সম্পাদক আল-আমীন, সিঙ্গাপুর শাখার সভাপতি শফীকুল ইসলাম, কাতার শাখার যুগ্ম-আহবায়ক আব্দুল হক এবং সাইপ্রাস শাখার আহবায়ক কাছীদুল হক কুতুব।
অতঃপর বাদ মাগরিব কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ও আত-তাহরীক সম্পাদক ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইনের পরিচালনায় ৪র্থ অধিবেশন শুরু হয়। সেখানে ‘প্রবাস জীবনে দাওয়াতী কাজের পদ্ধতি’ বিষয়ে সঊদী আরব শাখার সহ-সভাপতি হাফেয মুহাম্মাদ আখতার (নওগাঁ), ‘সমাজ সংস্কারে দাওয়াতের গুরুত্ব ও আধুনিক মাধ্যম সমূহের ব্যবহার’ বিষয়ে ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন (মারকায), ‘সাংগঠনিক জীবনে সততা ও আমানতদারিতার গুরুত্ব’ বিষয়ে কেন্দ্রীয় সেক্রেটারী জেনারেল অধ্যাপক মাওলানা নূরুল ইসলাম (মেহেরপুর) বক্তব্য পেশ করেন।
সম্মেলনের বিভিন্ন পর্যায়ে কুরআন তেলাওয়াত করেন আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহীর হিফয বিভাগের প্রধান হাফেয লুৎফর রহমান (বগুড়া), আল-‘আওন-এর কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হাফেয আহমাদ আব্দুল্লাহ শাকির (মারকায), মারকাযের মক্তব বিভাগের শিক্ষক ক্বারী নিযামুদ্দীন (নওগাঁ) ও হিফয বিভাগের ছাত্র তাওফীকুল ইসলাম (সিরাজগঞ্জ)। ইসলামী জাগরণী পরিবেশন করেন আল-হেরা শিল্পীগোষ্ঠীর সদস্য মুহাম্মাদ মীযানুর রহমান (জয়পুরহাট), ইয়াকূব আলী (মেহেরপুর) রাকীবুল ইসলাম (মেহেরপুর), নওদাপাড়া মারকাযের ছাত্র ফরীদুল ইসলাম (নাটোর) ও মুহাম্মাদ বখতিয়ার (যশোর)।
কেন্দ্রীয় পরিষদ সদস্য সম্মেলন :
একই দিন বিকাল সাড়ে ৪-টায় আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফীর পূর্ব পার্শ্বস্থ ভবনের শিক্ষক মিলনায়তনে ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় পরিষদ সদস্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে উদ্বোধনী ভাষণ পেশ করেন ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় সেক্রেটারী জেনারেল অধ্যাপক মাওলানা নূরুল ইসলাম (মেহেরপুর)। অতঃপর ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরের আয়-ব্যয়ের অডিটকৃত হিসাব পেশ করেন কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক বাহারুল ইসলাম (কুষ্টিয়া) এবং ২০১৯-২১ সেশনের কেন্দ্রের পরিকল্পনা পেশ করেন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম (যশোর)।
এরপর সংগঠনের অগ্রগতি সম্পর্কে পরামর্শমূলক বক্তব্য আহবান করা হয়। সেখানে বক্তব্য পেশ করেন রাজশাহী সদর সাংগঠনিক যেলা ‘আন্দোলন’-এর উপদেষ্টা এ্যাডভোকেট জারজিস আহমাদ, রাজশাহী-পূর্ব সাংগঠনিক যেলা সভাপতি ডা. ইদ্রীস আলী ও রাজশাহী সদর সাংগঠনিক যেলার সাবেক সভাপতি মুহাম্মাদ নাযিমুদ্দীন প্রমুখ।
অতঃপর মুহতারাম আমীরে জামা‘আত কেন্দ্রীয় পরিষদ সদস্যদের প্রতি নছীহত ও সমাপনী ভাষণ পেশ করেন। সবশেষে বৈঠক ভঙ্গের দো‘আ পাঠের মাধ্যমে সম্মেলন সমাপ্ত হয়।