‘যে দেউটি নিভে গেছে, তারই জ্বালা শত দীপশিখা

জ্বলেছে যে ঘরে ঘরে।....

জ্ঞানের সাধক তার মহৎ জীবনে

গভীর সাধনালব্ধ সুচিন্তিত ধ্যানে

যা কিছু পেয়েছে তারে ভরিয়া অঞ্জলী

ছড়ায়ে দিয়েছে। সত্য প্রকাশে কেবলি

প্রয়াস পেয়েছে বার বার,

স্রষ্টার অমৃতবাণী করেছে প্রচার

যুগে যুগে যে বাণীর স্রোতধারা বয়ে

কাল হ’তে কালান্তরে চলিবে তাহার স্মৃতি ল’য়ে’।

মাওলানা স্মরণে লিখিত প্রখ্যাত মহিলা কবি বেগম সুফিয়া কামালের (১৯১১-১৯৯৯) উপরোক্ত কবিতাংশ দিয়ে শুরু করছি ঊনিশ শতকের শেষার্ধে ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মুসলিম বাংলা তথা মুসলিম ভারতের রেনেসাঁ আন্দোলনের অগ্রদূত, শতাব্দীর সূর্য, যুগস্রষ্টা মরহূম মাওলানা আকরম খাঁনের অমূল্য জীবনী আলোচনা।

জন্ম ও শিক্ষা : ১২৭৫ সালের ২৪শে জ্যৈষ্ঠ মোতাবেক ১৮৬৮ সালের ৮ই জুন তিনি পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগণা যেলার হাকিমপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত আলেম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মাওলানা আব্দুল বারী, মাতার নাম রাবেয়া খাতুন। তাঁর পিতা মিয়াঁ নাযীর হুসাইন মুহাদ্দিছ দেহলভীর ছাত্র ছিলেন। একই দিনে পিতা-মাতা দু’জনেই মারা যান। ফলে তিনি নানার কাছে মানুষ হন। পারিবারিক ঐতিহ্য অনুসারে বাড়ীতেই তিনি আরবী-ফার্সী শিক্ষা করেন। অতঃপর কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। কিন্তু লেখাপড়ার ভাগ্য তাঁর বেশীদিন হয়নি। ইংরেজের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার কারণে ফাযেল পরীক্ষা না দিয়েই মাদ্রাসা শিক্ষা ত্যাগ করেন। এর অন্যতম কারণ ছিল ইংরেজ প্রবর্তিত মাদ্রাসা শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে তাঁর তীব্র ক্ষোভ। ১৯৩২ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর কলিকাতা আলবার্ট হলে (Albert Hall) আয়োজিত বঙ্গ-আসাম প্রথম আরবী ছাত্র সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে তিনি প্রচলিত আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় বক্তব্য রাখেন। দুঃখের বিষয় পাকিস্তানের ২৪ বছর এবং বাংলাদেশের ১২ বছরেও সেই শিক্ষানীতির যৎকিঞ্চিৎ পরিবর্তন ছাড়া মূল কাঠামো পুরাপুরি বজায় রাখা হয়েছে। যার ফলে দ্বিমুখী শিক্ষানীতির দুষ্ট প্রভাবে বাংলার মুসলিম শিক্ষিত সম্প্রদায় দ্বিমুখী চিন্তাধারার সংঘাতে আপোষে জর্জরিত হয়ে চলেছে। এই সংঘাতের অবসান যত তাড়াতাড়ি হবে ততই মঙ্গল।

সম সাময়িক মুসলিম সমাজ :

সম সাময়িক মুসলিম বাংলার অবস্থা বিবেচনার জন্য আমাদেরকে একটু পিছন দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।

দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর (রাঃ)-এর সময়কাল (৬৩৪-৪৪ খৃঃ) হ’তেই ভারতে মুসলিম অভিযান শুরু হয় এবং আফগানিস্তান, মালাবার, সিন্ধু প্রদেশের সাথে সাথে বাংলাদেশেও ইসলাম প্রচারের ঢেউ এসে লাগে। অতঃপর ১২০১ খৃষ্টাব্দে ইখতিয়ারুদ্দীন মুহাম্মাদ বিন বখ্তিয়ার খিলজী কর্তৃক বঙ্গ বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ সর্বপ্রথম রাজনৈতিকভাবে ইসলামের সংস্পর্শে আসে। এই সময় হ’তে বাংলার স্বাধীন রাজনৈতিক অস্তিত্ব মুছে যাওয়ার কাল অর্থাৎ ১২০১-১৭৬৭ খৃ. পর্যন্ত ৫৬৬ বৎসরের দীর্ঘ সময়টিকে আমরা তিনটি পর্যায়ে ভাগ করতে পারি। প্রথম- ১২০১ সাল হ’তে ১৩৪০ সাল পর্যন্ত ১৪০ বৎসর। এই সময় দিল্লীর সম্রাটগণ কর্তৃক নিযুক্ত সুবাদার দ্বারা বাংলাদেশ অঞ্চল শাসিত হ’ত। দ্বিতীয়- ১৩৪০ হ’তে ১৫৭৬ সাল পর্যন্ত ২৩৬ বৎসর। এই সময় স্বাধীন মুসলিম সুলতানগণ বঙ্গদেশ শাসন করতেন। তৃতীয়- ১৫৭৬ হ’তে ১৭৬৭ পর্যন্ত ১৯১ বৎসর। অর্থাৎ সম্রাট আকবর কর্তৃক বঙ্গ বিজয়ের পর থেকে তাঁর দুর্বল উত্তরাধিকারীগণ কর্তৃক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে বাংলার দেওয়ানী ন্যস্ত করার সময় পর্যন্ত।

উপরোক্ত তিনটি পর্যায়ের মধ্যে প্রথমটিকে আমরা তুলনামূলকভাবে শান্তি ও নিরাপত্তার যুগ রূপে আখ্যায়িত করতে পারি। মুসলিম বাংলার প্রকৃত বিপদ শুরু হয় দ্বিতীয় যুগে এবং মোগলদের অধীনে তৃতীয় যুগে এটি চরম আকার ধারণ করে। এ প্রসঙ্গে মাওলানা আকরম খাঁর নিজস্ব বক্তব্য শ্রবণ করুন-

‘উপরোল্লেখিত দ্বিতীয় ও তৃতীয় যুগে মুসলিম সমাজের আভ্যন্তরীণ বিপদ ছিল খুবই গুরুতর। প্রথমতঃ এই সময়ে অন্য কোন ভাষায় কুরআনের তরজমা অধর্মের কাজ রূপে বিবেচিত হইত। তদুপরি একদিকে তুর্ক, তাতার, আফগান, ইরানী প্রভৃতি বিভিন্ন বহিরাগত মুসলমান এবং অপরদিকে হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায় হইতে ধর্মান্তরিত স্থানীয় মুসলমানের মিশ্রণের ফলে উদ্ভূত ভাষা সমস্যাও ছিল বিপদের অন্যতম কারণ। গুলিস্তাঁ ও বুস্তাঁসহ মাত্র কয়েকটি ফারসী পুস্তক ব্যতিত সার্বিকভাবে ফারসী সাহিত্য মুসলমানদের উপকার অপেক্ষা ক্ষতিই করিয়াছে বেশী। সর্বশেষে মুসলিম বাংলার দীর্ঘ ইতিহাসে (সত্যিকারের) ইসলামী ভাবধারা ও আদর্শে অনুপ্রাণিত এরূপ একজন চরিত্রবান শাসনকর্তা, সরকারী কর্মচারী ও রাজনৈতিক নেতার সাক্ষাত আমরা পাই না, যিনি বাংলার মুসলমানদিগকে তাহাদের ব্যক্তিগত অথবা সমাজ জীবনে প্রেরণা যোগাইতে সক্ষম ছিলেন। ইহাই ছিল মুসলিম সমাজের মানসিক খাদ্যের দুর্ভিক্ষ, যাহা উহাকে ভিতর হইতে ধ্বংস ও অধঃপাতিত করিয়া চলিয়াছিল’।

দূরদর্শী চিন্তানায়ক মাওলানা আকরম খাঁ এরপর বলেন, ‘এইভাবে মুসলিম মানস যখন সম্পূর্ণভাবে ইসলামী ভাবধারা ও আদর্শ বিবর্জিত এবং উহার নিজস্ব তাহজীব-তমদ্দুনের সহিত পরিচয় শূন্য হইয়া শয়তানের কারখানায় পরিণত হইতে চলিয়াছে, ঠিক সেই সময় বাংলার হিন্দুদের মধ্যে বুদ্ধি ও ধর্মের এক অভূতপূর্ব জাগরণ দেখা দেয়। বলা বাহুল্য হিন্দু বাংলার এই বুদ্ধির জয়যাত্রা ধর্ম ও পৌরাণিক সাহিত্যকে ভিত্তি করিয়াই শুরু হয়। এই সময় বাংলার তথাকথিত উদার, মহানুভব ও বিদ্যোৎসাহী মুসলমান নবাব ও সুলতানগণ তাঁহাদের নিজস্ব ধর্ম ও সাহিত্য চর্চার প্রতি নজর দেওয়া অথবা একাজে কোন মুসলমানকে উৎসাহ দান ও পৃষ্ঠপোষকতা করার কোন প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন নাই। সমসাময়িক সাহিত্য খুঁজিয়া বাংলার এই সমস্ত নবাব ও সুলতানগণের দরবারে কোনদিন কুরআন অধ্যয়ন অথবা হযরত মোহাম্মাদ (ছাঃ)-এর জীবন চরিত ও শিক্ষা সম্পর্কে আলোচনার অনুষ্ঠান হইয়াছে এই ধরনের কোন আভাস আমরা পাই না। ... অথচ তাঁহাদের দরবারে রামায়ণ ও মহাভারতের নিয়মিত সাহিত্যিক আসরের অনুষ্ঠান হইয়াছে। ... ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন বলেন যে, হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থানের জন্য বিভিন্ন প্রকারের যে প্রচেষ্টা চলে, তাহাই হইতেছে বাংলা ভাষার উন্নতির প্রথম এবং প্রধান কারণ। বলা বাহুল্য বাংলা ভাষার এই উন্নতি যাহা হিন্দু ধর্মের পুনরুজ্জীবন ব্যতীত কিছুই ছিল না- গৌড়ের মুসলিম সুলতানগণের পৃষ্ঠপোষকতার ফলেই তাহা সম্ভব হইয়াছিল। ইহা একটি সর্বজন স্বীকৃত ঐতিহাসিক সত্য’।

মুসলিম বাংলার দ্বিতীয় যুগের উপরোক্ত বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে মড়ার উপর খাড়ার ঘায়ের মত আপতিত হয় সম্রাট আকবরের বঙ্গ বিজয় ও তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ শাসননীতি। ইতিপূর্বে যে সমস্ত বিরুদ্ধ শক্তি প্রকাশ্যে অথবা গোপনে ইসলাম ও মুসলমানের ধ্বংস সাধনে লিপ্ত ছিল, আকবরের সক্রিয় সাহায্য ও সমর্থনে তারা তাদের শক্তি সুসংহত করে এবং মরণোন্মুখ মুসলিম সমাজ বিরুদ্ধবাদীদের সর্বশেষ সম্মিলিত আঘাতে নিস্তনাবুদ হয়ে যায়। ফলে বাংলার উপর থেকে শুধু মোগল শাসন নয় বরং মুসলিম শাসনেরও অবসান ঘটে।

এই সময় মুসলমানদের ধর্মীয় অবস্থা চরম শোচনীয় অবস্থায় ছিল। মোগল হেরেমে নিয়মিত মূর্তিপূজা ও অগ্নিপূজা চলতো, সালামের বদলে সিজদা চালু ছিল, গরু কুরবানী আকবরের আইনে নিষিদ্ধ ছিল, হিন্দু-মুসলিম বিবাহ মহা ধুমধামে অনুষ্ঠিত হ’ত। বাংলার মধ্যবিত্ত মুসলিম সমাজ এমন কলুষিত ইসলাম বিরোধী আবহাওয়ার মধ্যে অবস্থান করছিল যে, হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায় হ’তে ধর্মান্তরিত নও-মুসলিমদের পক্ষে ইসলামের সত্যিকারের শিক্ষা ও আদর্শের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার কোন সুযোগই ছিল না। ফলে বিভিন্ন আরবী ও ফারসী নামের আড়ালে মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশ ঘটে অসংখ্য শিরক ও বিদ‘আতী অনুষ্ঠান সমূহ। আকবর কর্তৃক উত্তর-পশ্চিম ভারত হ’তে স্থানান্তরিত একদল ধর্মদ্রোহী পীর ও ফকীরের আগমনের ফলে এই সময় বাংলার মুসলমানের ধর্মীয় অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে পড়ে। মুসলমানগণ কিভাবে সরাসরি হিন্দুদের দেব-দেবীগণকে আপন করে নিজেদের পীর হিসাবে বরণ করে নিয়েছিল তা দেখাবার জন্য ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন ‘কালুগাজী চম্পাবতী’ নামক পুঁথি, ‘জেবুল মুলক শামা রুখ’ কাব্য প্রভৃতি পুঁথিকাব্য সমূহের নাম উল্লেখ করেছেন। সপ্তদশ শতকের মুসলিম কবি জনৈক মোহাম্মদ আকবরের (জন্ম ১৬৫৭ খৃ.) এক খানি পুঁথিকাব্যের প্রারম্ভে মা হাওয়াকে মা কালী ও হযরত মোহাম্মদ (ছাঃ)-কে শ্রী চৈতন্য রূপে দেখানো হয়। যেমন তিনি বলেন,

মা হাওয়া বন্দম জগত জননী

হিন্দুকুলে কালী নাম প্রচারে মোহিনী।

হযরত রছুল বন্দি প্রভু নিজ সখা

হিন্দুকুলে অবতারি চৈতন্য রূপে দেখা\

দুর্ভাগ্য বর্তমান সময়ের দুইজন প্রখ্যাত মুসলিম পন্ডিত (ডঃ এনামুল হক ও আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ) উক্ত বন্দনা গীতিটিকে খুবই প্রশংসা করেছেন। অমনিভাবে ‘নূরন্নেহার ও কবির কথা’ নামক গীতি কাব্যের রচয়িতা লিখেছেন ‘বিছমিল্লাহ ও শ্রী বিষ্ণু একই কথা। আল্লাহ দুই অংশে বিভক্ত হইয়া রাম ও রহিম হইয়াছেন।’ শুধু বাংলা সাহিত্য নয় ফারসী ও উর্দূ সাহিত্যের মাধ্যমেও মুসলিম সমাজের সর্বনাশ ঘটানো হয়েছে। যেমন মোহাম্মাদ (ছাঃ)-কে আল্লাহর আসনে বসাতে গিয়ে মীলাদের কবিতায় বলা হয়েছে-

وه جو مستوى عرش تہا خدا ہوكر

اتر پڑا ہے مدينہ ميں مصطفى ہو كر

ওহ্ জো মুস্তাবী আরশ থা খোদা হো কর্

উতার পড়া হ্যায় মদীনা মেঁ মুছতফা হো কর্

অর্থ : যিনি আরশের উপর খোদারূপে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তিনিই মদীনায় অবতরণ করলেন ‘মোছতফা’ হয়ে। এরই সুরে সুর মিলিয়ে বাংলার কবি লালন শাহ (১৭৭২-১৮৯০ খৃ.) গেয়ে ওঠেন, ‘আকার কি নিরাকার সাঁই রববানা, আহমদ আহাদ হ’লে তবে যায় জানা’। প্রখ্যাত ইরানী কবি হাফেয শীরাযী (মৃ. ৭৯১ হি./১৩৮৯ খৃ.) বলেন,

حافظا! گر وصل خواہى + صلح كن با خاص و عام
با مسلمان الله الله + با برهمان رام رام

‘হাফেয! যদি মিলন চাও, তাহ’লে সকলের সাথে সন্ধি করে চলো। মুসলমানের সাথে আল্লাহ। আর ব্রাহ্মণের সাথে রাম রাম’ (দীওয়ানে হাফেয)

মোদ্দাকথা হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতিকে এইভাবে আদর্শরূপে গ্রহণ করার এবং হিন্দু ধর্মের অদ্বৈতবাদী কুফরী দর্শনের ছাঁচে নিজেদেরকে গড়ে তোলার প্রবণতা শুধুমাত্র কবি-সাহিত্যিকদের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনের সর্বস্তরে এটি সঞ্চারিত ও উত্তরোত্তর প্রসার লাভ করে চলেছিল। এরই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি স্বরূপ হিন্দুদের জলদেবতা বরুণ মুসলমানদের কাছে পীর বদরে, গৌরচন্দ্র চৈতন্য গোরাচাঁদ পীরে, ওলাইচন্ডী ওলা বিবিতে, সত্যনারায়ণ সত্যপীরে, লক্ষ্মীদেবী মা বরকতে রূপান্তরিত হন। তদুপরি এই সমস্ত রূপান্তরিত দেব-দেবীগণ ছাড়াও বহু পীরের কল্পিত কবর এমনকি ভুয়া কবরগুলিও মুসলমানদের নিকট থেকে নযর-নেয়ায-তাবাররুক, মোমবাতি, আগরবাতি লাভ করতে থাকে। বায়েজীদ বোস্তামীর কল্পিত কবরের নাম আমরা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে পারি। অনেক থান, খানকাহ, দরগাহ এদেশের মুসলমানদের সুখ-সমৃদ্ধি এবং বিপদ-আপদ হ’তে উদ্ধার লাভের উপলক্ষ বা অসীলা হিসাবে দীর্ঘকাল যাবত এখানে আল্লাহর স্থান দখল করে আছে।

এবারে আসুন ১৭৬৭-এর পরবর্তী বৃটিশ অধিকৃত বাংলাদেশের অবস্থাটা একবার অবলোকন করি। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্ণওয়ালিশ প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে মুসলমানদের জমিদারী ও ভূমি মালিকানা গেল, বাযেয়াফ্তির নামে লা-খেরাজ আয়মাদারী গেল, রাজভাষা ফারসীর বদলে ইংরেজী করার ফলে চাকুরী গেল, পোষাক পরিবর্তনে শরাফতীর নিশানাটুকুরও অবসান হ’ল। সাড়ে ছয়শো বছরের অভিজাত ও ইন্টেলিজেন্টশিয়া বাংলার মুসলিম নেতারা রাতারাতি পথের ফকির হয়ে গেল। এক কালের সম্মানিত শিক্ষিত মুসলিম সম্প্রদায় একরাতে মূঢ়ের জাত হয়ে গেল। মুসলিম খানদানী বংশের লোকেরা হঠাৎ করে ‘ছোটলোক চাষা’ ‘যবন-ম্লেচ্ছ’ বনে গেল।

মুসলমানদের এই অবস্থা সারা বৃটিশ ভারতে ছিল। তথাপি বিশেষ করে মুসলিম বাংলার কথা বলছি দু’টি কারণে। এক. এই সময় ইংরেজের অত্যাচার বেশী হয়েছিল বাংলার উপরে। কারণ কথিত ওয়াহ্হাবী তথা জিহাদ আন্দোলন, সিপাহী আন্দোলন, তিতুমীরের মুহাম্মদী আন্দোলন, শরীয়তুল্লাহর ফারায়েযী আন্দোলন, মজনু শাহের ফকির আন্দোলন প্রভৃতি গণবিপ্লব ও খন্ড যুদ্ধসমূহ দাবাগ্নির মত জ্বলে উঠেছিল প্রধানতঃ এই বাংলাতেই। ফলে আম্বালা ও পাটনার বিচার ছাড়া বিচারের নামে বাকী সবগুলি অত্যাচার সংঘটিত হয় এই বাংলার কলিকাতা, বর্ধমান, বারাসাত, রাজশাহী, দিনাজপুর ও অন্যান্য অঞ্চলে। হাযার হাযার কৃষক ও আলেমকে ‘নিকটতম বৃক্ষে ঝুলাইয়া’ প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয় এই বাংলাতেই। এই দানবীয় যুলুম চলে ঊনিশ শতকের শেষার্ধের মধ্যভাগ পর্যন্ত।

এই সময়কার অবস্থা সম্পর্কে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের সদস্য স্কটিশ ইতিহাসবিদ ও পরিসংখ্যানবিদ উইলিয়াম উইলসন হান্টার (১৮৪০-১৯০০ খৃ.)-এর মন্তব্য আরও পরিষ্কার। তিনি তার The Indian Musalmans বইয়ে (আগস্ট ১৮৭১ খৃ.) লেখেন, ‘যারা এককালে দেশের শাসক ছিল, তারা আজ নিঃস্ব। পঞ্চাশ বছর আগেও যাদের পক্ষে গরীব হওয়া অসম্ভব ছিল, এখন তাদের পক্ষে ধনী হওয়া অসম্ভব হয়েছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে হিন্দু তহশিলদার দ্বারা খাজনা আদায়ের ফলে আজ তারাই জমিদার হয়েছে। মুসলিম জমিদাররা সম্পত্তিহীন হয়ে পড়েছে। ফারসী উঠিয়ে দেওয়ায় আইন ও চিকিৎসা ব্যবসায়ের পথও তাদের বন্ধ হয়েছে’ (???)।

দ্বিতীয় কারণটি হ’ল- আমরা আজ যে মনীষীর উপর সেমিনারে আলোচনা করছি, তাঁর জন্ম হয়েছিল ঊনিশ শতকের এই তান্ডবলীলার মধ্যেই।

মুক্তি পথের সন্ধান :

১৮৩১ সালে বালাকোট ও বারাসাত বিপর্যয় শেষে চল্লিশ বছর ধরে বিচ্ছিন্ন সংগ্রামের পর আলেমদের মধ্যে দু’টি দল সৃষ্টি হয়। একদল- মাওলানা কেরামত আলী জৌনপুরীর (১৮০০-১৮৭৩) নেতৃত্বে ভারতকে দারুল হরবের স্থলে ‘দারুল ইসলাম’ ঘোষণা করে ইংরেজের সঙ্গে সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করেন। স্যার সৈয়দ আহমদ খান, নবাব আব্দুল লতিফ প্রমুখ নেতা ছিলেন এই দলে। দ্বিতীয় দল- শাহ ইমদাদুল্লাহ ও মাওলানা কাসেম নানুতুভীর নেতৃত্বে আমৃত্যু জেহাদ চালাবার সংকল্প করেন। এঁরাই পরে দেওবন্দ দারুল উলূম প্রতিষ্ঠা করে ধর্মশিক্ষার অন্তরালে জেহাদী মনোভাব যিন্দা রাখতে সচেষ্ট হন।

প্রথম দলের ইংরেজ ঘেঁষা নীতি গণমানসের অনুকূলে ছিল না। বরং লজ্জা ও পরিতাপের বিষয় হ’লেও সত্য যে, স্যার সৈয়দ ও নবাব আব্দুল লতিফের বাস্তববাদী নীতি পরবর্তীকালে স্বার্থপর ও সুবিধাবাদী রাজনীতিতে পরিণত হয়। নবাব মুহসিনুল মুলক ও নবাব ভিকারুল মুলক প্রমুখের নেতৃত্বে প্রথম দলের নীতির অপভ্রংশের ধারা অবশেষে রূপ পায় নাইট-নবাবদের সুবিধাবাদী আঞ্জুমানী রাজনীতিতে। যা ছিল সাধারণ জনগণের নাগালের অনেক বাইরে।

দ্বিতীয় দলের জিহাদী নীতি গণমানসের অধিক নিকটবর্তী হ’লেও তা ছিল অতিশয় চরম পন্থা। যা ছিল তখন নিশ্চিত পরাজয়ের সম্মুখীন।

উপরোক্ত দুই চরমপন্থী নীতির মধ্যবর্তী একদল নেতা ও আলেম ছিলেন। আজকের আলোচ্য নেতা জাতির দিশারী মাওলানা আকরম খাঁ ছিলেন সেই মধ্যপন্থী দলের অগ্রনায়ক ও প্রাণপুরুষ।

এই দলের নীতি ছিল ইংরেজ সরকারের সাথে রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ধরা না দিয়ে আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ করা এবং সেকাজে সরকারের সহযোগিতা নেওয়া ও দেওয়া। তাঁরা সরকারের ভাল কাজের প্রশংসা যেমন করেন, তেমনি মন্দ কাজের বিরোধিতাও করতে থাকেন। যেমন তুরস্কের খেলাফত ধ্বংসের ব্যাপারে প্রথমোক্ত দল ইংরেজের নীতিকে সমর্থন করে। কিন্তু মধ্যপন্থী দল এর তীব্র বিরোধিতা করে।

এই দলের দৃষ্টি শুধু শিক্ষা ও চাকুরীর ক্ষেত্রে হিন্দু সমাজের সাথে প্রতিযোগিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং এঁদের মহান উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম ভারতের সার্বিক পুনর্জাগরণ। বিগত একশত বৎসর যাবত ওলামা সম্প্রদায় মুসলিম জাতিকে ইংরেজী শিক্ষা ও চাকুরী-বাকুরী হ’তে দূরে রাখার ফলে নব্য শিক্ষিত তরুণ সম্প্রদায় শুধু ওলামা বিরোধীই হয়নি বরং তাদেরকে ইসলাম বিরোধীও করে তুলেছিল। এই সঙ্গে খৃষ্টান পাদ্রীরা সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের প্রচারণা বা প্ররোচনা যোরদার করার ফলে বহু তরুণ বিপথগামী হয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে তারা প্রতিবেশী হিন্দুদের বহু সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অন্ধ অনুসারী হয়ে পড়েছিল। তাই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের সাথে সাথে জাতির সাংস্কৃতিক মুক্তি অর্জনের প্রচেষ্টা চালানোও নেতাদের পবিত্র দায়িত্ব ছিল।

বাংলাদেশে এই দায়িত্ব পালনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যে মুষ্টিমেয় কয়জন দুঃসাহসী আত্মত্যাগী আলেম, মাওলানা আকরম খাঁ ছিলেন তাদের অগ্রনায়ক। তাঁর মধ্যে ঘটেছিল একাধারে রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় নেতৃত্বের মধুমিশ্রণ।

মাওলানা আকরম খাঁর অবদান :

সমসাময়িক মুসলিম সমাজের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, তমদ্দুনিক বা সাংস্কৃতিক অবস্থার সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ শেষে এবার আমরা এই মহান যুগ সংস্কারকের সংস্কার আন্দোলনের যৎকিঞ্চিত তুলে ধরার চেষ্টা পাব।

আলেমের পুত্র আলেম মাওলানা আকরম খাঁ শৈশবেই পিতার নিকট আহলেহাদীছ আন্দোলনের সবক নেন। সৈয়দ আহমাদ ব্রেলভী, শাহ ইসমাঈল শহীদ, বেলায়েত আলী, এনায়েত আলী, পরিচালিত আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী হিসাবে তাঁর পিতা তখন খুলনা ও ২৪ পরগণা এলাকায় দাওয়াত ও জিহাদ সংগঠনের কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। পাশ্চাত্য ভাবধারায় রচিত ইতিহাস সমূহ বৃটিশ প্রভুদের সুরে সুর মিলিয়ে পাক-ভারত উপমহাদেশের একমাত্র নির্ভেজাল ইসলামী আন্দোলন তথা আহলেহাদীছ আন্দোলনকে ওহাবী আন্দোলন হিসাবে চিহ্নিত করেছে। বাংলাদেশে তীতুমীরের মুহাম্মাদী আন্দোলন, শরীয়তুল্লাহর ফারায়েযী আন্দোলন সবই ছিল সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী ও শাহ ইসমাঈল শহীদের ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত আহলেহাদীছ আন্দোলনেরই প্রতিধ্বনি মাত্র। বাংলার অন্যতম বিদগ্ধ পন্ডিত দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ (১৯০৬-১৯৯৯) এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আহলেহাদীছ আন্দোলনের ফলে যেসব গবেষণা এ অঞ্চলে হয়েছে, তার সিদ্ধান্তের সঙ্গে কারও কারও দ্বিমত থাকলেও সকলেই একবাক্যে স্বীকার করতে বাধ্য যে, এ আন্দোলনের ফলেই বাংলা অঞ্চলে মুসলিম মানসের আত্মবিকাশের সূচনা দেখা দেয় এবং ধর্মচিন্তা থেকে বহুদিন বঞ্চিত মানুষ আপনার বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার আলোকে কুরআন ও হাদীছের সূত্রগুলি বুঝবার চেষ্টা করে’।[1] 

ছোটবেলায় পিতার নিকট এই আন্দোলনের শিক্ষা গ্রহণের ফলে আকরম খাঁ যাবতীয় অন্ধ তাকলীদ ও রেওয়াজ পূজার ধূম্রজাল হ’তে মুক্ত থাকতে পেরেছিলেন এবং সারা জীবন মুক্ত বুদ্ধির অনুশীলনে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন। সবকিছুকে কুরআন ও হাদীছের কষ্টি পাথরে যাচাই করার অনুপ্রেরণা তিনি স্বীয় পিতার উত্তরাধিকার হিসাবেই পেয়েছিলেন।

আগেই বলেছি ফাযেল পরীক্ষা না দিয়েই তিনি অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ফলে আনুষ্ঠানিক পড়াশুনা শেষ হয়। এরপর তিনি নিজের চেষ্টায় লিখতে শুরু করলেন। তখনকার দিনে বাংলা চর্চাকে অত্যন্ত খারাপ নযরে দেখা হ’ত। তবুও তিনি দমলেন না। এক সময় তিনি নিজের বাংলা শেখার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, আমি রাতের পর রাত জেগেছি এর জন্যে। বালিশ মাথায় না দিয়ে বরং বাংলা ডিকশোনারী মাথায় দিয়ে শুতাম নিতান্ত ঘুম পেলে। যাতে সত্বর ঘুম ভেঙ্গে যায়। অবশেষে একদিন তাঁর প্রথম লেখা বের হ’ল কলিকাতার একটি হিন্দু পত্রিকায়। মাওলানা আকরম খাঁ আকুল আগ্রহ নিয়ে তা পড়লেন এবং একটি চা স্টলে বসলেন হিন্দুদের মন্তব্য শুনবার জন্য। তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয় হিন্দু লেখকদের মধ্যে। তারা সহ্য করতে পারলো না এই তরুণ যবন লেখকের লেখা দেখে। বিভিন্ন জায়গায় ‘আক্রমণ খাঁ’ বলে তাঁকে তাচ্ছিল্য করা হ’তে লাগলো। তিনি বলেন, এতে আমার যিদ চেপে গেল এবং উৎসাহ বেড়ে গেল।

(১) সাংবাদিকতায় হাতে খড়ি : আহলেহাদীছ আন্দোলনের অন্যতম নেতা কলিকাতার তাঁতীবাগানের লক্ষপতি হাজী আব্দুল্লাহ আকরম খাঁর লেখা পড়ে চমৎকৃত হ’লেন। তিনি তাঁকে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘বাবা! আমি তোমাকে প্রেসসহ আনুসঙ্গিক সব ব্যবস্থা করে দেব। তুমি পত্রিকা বের করতে পারবে?’ আকরম খাঁর সুপ্ত বাসনা ভয়ে ভয়ে স্বীকারোক্তির আকারে বেরিয়ে এলো। হাজী ছাহেব উৎসাহিত হয়ে তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘বাবা! জাহেলিয়াতের নিগড়ে আবদ্ধ এদেশের মুসলিম সমাজকে জাগিয়ে তোলার দায়িত্ব তোমাকে নিতে হবে। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর রেখে যাওয়া সত্যিকারের নির্ভেজাল ইসলামী আদর্শের পতাকা উড্ডীন করার ব্রত নিয়ে তোমাকে পত্রিকার নাম রাখতে হবে ‘মোহাম্মদী’। আকরম খাঁ রাযী হ’লেন। শুরু হ’ল সাংবাদিকতা।

এমনি করে প্রখ্যাত সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৭৯)-এর ভাষায় তিনি মুসলিম বাংলা তথা সারা মুসলিম ভারতের রাজনৈতিক অধিকারের জন্য আন্দোলন করার সাধু উদ্দেশ্য নিয়ে একে একে বের করেন বাংলা মাসিক মোহাম্মদী (১৯০৩), মাসিক আল-এছলাম (প্রকাশক ও যুগ্ম সম্পাদক)। সম্পাদক মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী (১৮৭৫-১৯৫০)। দৈনিক সেবক (১৯২১-২২), উর্দূ দৈনিক যামানা (১৯২০-২৪), ইংরেজী THE COMRADE (১৯৪৬) ও দৈনিক আজাদ (১৯৩৬)।

(২) ধর্মীয় সংস্কার : কর্মজীবনে প্রবেশ করেই মাওলানা আকরম খাঁ মুসলমানদের অধঃপতনের মূল কারণ অনুসন্ধান করেন। তিনি বুঝতে পারেন যে, মুসলমানদের এই ক্রমাবনতির মূল কারণ হ’ল তার নিজের সত্তা সম্পর্কে অজ্ঞতা। সে জানে না তার ঐতিহ্যের উৎস কোথায়। কাজেই প্রকৃত দরদীর সর্বপ্রধান কর্তব্য হচ্ছে এ মানব গোষ্ঠীকে আত্মসচেতন করে তোলা। সে গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি দেখতে পেলেন যে, মুসলমানের মূল তওহীদ বিশ্বাসেই ঘুণ ধরেছে। নানাবিধ শিরক ও বিদ‘আতের আগাছা-পরগাছা ইসলামের পবিত্র দেহকে কালিমা লিপ্ত করেছে। ব্যক্তিপূজা, কবরপূজা, অসীলা পূজা প্রভৃতি সাধারণ মুসলমানের মধ্যে এমনভাবে দানা বেঁধেছে যে, তাকে সরিয়ে নিতে চাইলে তারা মরিয়া হয়ে হামলা করার চেষ্টা করে। এমনকি আলেম সম্প্রদায়ও ধর্মের অনুশাসনের ক্ষেত্রে চার ইমামের মযহাবকে শেষ ব্যাখ্যা মনে করে ইজতিহাদ বা শরী‘আত গবেষণার দুয়ার চিরতরে বন্ধ ভেবে এক্ষেত্রে টুঁ শব্দটি করার সাহস খুঁজে পাচ্ছেন না। তিনি সর্বপ্রথমে এর বিরুদ্ধে কলম ধরেন এবং প্রমাণ করেন যে, ইসলামে রেওয়াজ পূজা ও অন্ধ তাক্বলীদের কোন স্থান নেই। বরং পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ক্বিয়ামত ঊষার উদয় কাল পর্যন্ত অনাগত ভবিষ্যতের অসংখ্য সমস্যাবলীর সমাধান অবশ্যই সম্ভব এবং প্রতি যুগের যোগ্য আলেমগণ কুরআন ও হাদীছ ব্যাখ্যা করার অধিকার রাখেন। বলা বাহুল্য আহলেহাদীছ আন্দোলনের এই উদার মতবাদ অনেকের নিকট অসহ্য ঠেকলেও যুক্তিবাদী শিক্ষিত মহলে তা বিশেষভাবে সমাদৃত হয়।

(৩) শিক্ষা সংস্কার : তিনি ইংরেজ প্রবর্তিত দ্বিমুখী শিক্ষানীতির তীব্র বিরোধিতা করেন। এতদ্ব্যতীত তৎকালীন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যখন মুসলমানদের প্রতি বিমাতাসূলভ আচরণ করতে থাকে এবং সেখানে মুসলিম সংস্কৃতির ছিঁটেফোটাও যাতে ঢুকতে না পারে, সেজন্য মুসলিম লেখকদের রচনা পাঠ্য-পুস্তক সমূহ থেকে তারা বাদ দিতে থাকেন ও মুসলিম সমাজে প্রচলিত আরবী-ফার্সী শব্দগুলি বর্জন করতে থাকেন, তখন তার বিরুদ্ধে কলম ধরেন একাই মাওলানা আকরম খাঁ।

এই সময় মুসলিম ছাত্রদের হীনমন্যতা এত নিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, তারা রীতিমত টেরি কেটে ধূতি পরে ক্লাসে যেত এবং তা দেখে যখন হিন্দু বন্ধুরা বলতো ‘কিরে লতিফ! চমৎকার ধূতিখানা পরেছিস তো, তোকে দেখে কারুর বাবার সাধ্য নেই যে, তোকে মুসলমান বলে’। তখন মুসলিম ছাত্ররা আহলাদে আটখানা হয়ে বলতো ‘সকলে তাই-ই তো বলে’।

ওদিকে হিন্দুদের অপপ্রচারণার ফলে এবং Risley-এর সেন্সাস রিপোর্টের ফলে মুসলমান শিক্ষিত সমাজে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে, বাঙালী মুসলমানেরা হাড়ি, ডোম, বাগদী নমশূদ্র প্রভৃতি অন্ত্যজ ও অস্পৃশ্য হিন্দুদের বংশধর। Risley তাঁর রিপোর্টে বললেন, বর্ণ হিন্দুদের চেয়ে এদের নাকের উচ্চতা অনেক কম। চোয়ালের হাড়ের উচ্চতা, কোকড়ানো চুল প্রভৃতিতে এদের অনার্য্য রক্তের পরিচয় সুস্পষ্ট।

মাওলানা আকরম খাঁ ইতিহাস ঘেঁটে প্রমাণ করে দেখিয়ে দিলেন যে, বাংলাদেশী মুসলমানেরা নমঃশূদ্রের বংশধর নয়, বরং তারা ইসলাম কবুলকারী এ দেশেরই উচ্চ বংশের সন্তান এবং অনেকে সরাসরি আরব রক্তের সন্তান।

(৪) ভাষা সমস্যা : তখনকার দিনে মুসলিম অভিজাত মহলের এমনকি শেরে বাংলা ফজলুল হকেরও অভিমত ছিল উর্দূই প্রকৃত প্রস্তাবে বাঙলাদেশী মুসলমানদের মাতৃভাষা। একমাত্র নওয়াব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ছাড়া অন্য কোন অভিজাত ব্যক্তি আমাদের মাতৃভাষা বাংলা বলে স্বীকার করতেন না। আলেমদের মধ্যে মাওলানা আকরম খাঁই সর্বপ্রথম এর বিরুদ্ধে কলম ধরেন এবং ইতিহাস দিয়ে প্রমাণ করেন যে, আমাদের মাতৃভাষা বাংলা এবং বাংলাই হবে আমাদের জাতীয় ভাষা।

(৫) রাজনীতিতে : এই সময় মুসলিম ভারতে দু’ধরণের রাজনীতি চালু ছিল। একটি নাইট-নবাব-খানবাহাদুরী রাজনীতি। অপরটি প্রগতিবাদী স্বাধীন রাজনীতি। শেষোক্তটির নেতৃত্বে ছিলেন আলী ভ্রাতৃদ্বয়, মাওলানা আজাদ, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রমুখ। মাওলানা আকরম খাঁ এঁদেরই মুখপাত্র হিসাবে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। মাওলানা আকরম খাঁ এ উদ্দেশ্যে সরকারী ‘আঞ্জুমানে ইসলামিয়া’র মোকাবেলায় ‘আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙ্গালা’ প্রতিষ্ঠা করেন ও নিজে তার সম্পাদক হন। তিনি কংগ্রেস, খেলাফত ও প্রজা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একদল যোগ্য কর্মী গড়ে তোলেন। যারা পরবর্তীতে কায়েদে আযমের নেতৃত্বে পাকিস্তান আন্দোলনের সেনাবাহিনীতে পরিণত হয়। ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব গ্রহণের পর থেকে তিনি পাকিস্তান অর্জনের প্রতি তাঁর পুরা দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। পাকিস্তান অর্জনের এক বছর পর তিনি ঢাকায় চলে আসেন স্থায়ীভাবে এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি হন। ইতিপূর্বে তিনি যুক্ত বাংলা মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। ১৯৫৪ সালের পর তিনি পাকিস্তান মুসলিম লীগের সহ-সভাপতি হন। ১৯৬২ সালের ২৯শে অক্টোবর তাঁর সভাপতিত্বে ঢাকায় আহূত পাকিস্তান মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে জীবনের শেষ সভাপতিত্ব করেন এবং খাজা নাজিমুদ্দীনকে সভাপতি নির্বাচন করে তাঁকে দায়িত্ব দিয়ে তিনি ৯৪ বছর বয়সে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নেন।

তাঁর রাজনীতির সাফল্য এখানেই যে, ঐ সময়ে আজাদে তাঁর প্রতিটি লেখাই এদেশের রাজনীতির গতি নির্ধারণ করতো। এতদসত্ত্বেও তিনি কখনো কোন সরকারী পদ গ্রহণ করেননি। এখানেই সত্যিকারের ত্যাগী রাজনৈতিক নেতার পরিচয় সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।

(৬) অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনে : বাংলার গরীব মেহনতী মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য তিনিই সর্বপ্রথম ১৯২৯ সালে প্রজা আন্দোলনের জন্ম দেন এবং ১৭৯৩ সালে বৃটিশ প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উচ্ছেদ দাবী করেন। বস্ত্ততঃপক্ষে মুসলিম বাংলার অর্থনৈতিক মুক্তির এটিই ছিল প্রথম সুসংগঠিত দাবী।

(৭) গ্রন্থ রচনা : রাজনীতি ও সাংবাদিকতার এত ডামাডোলের মধ্যে এবং সর্বদা জেল-যুলুমের মধ্যে থেকেও মাওলানা ১. তাফসীরুল কোরআন ২. মোস্তফা চরিত ৩. মোস্তফা চরিতের বৈশিষ্ট্য ৪. উম্মুল কোরআন ৫. আমপারার তাফসীর (কাব্যে) ৬. সমস্যা ও সমাধান ৭. মোছলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস প্রভৃতি অতি মূল্যবান গবেষণা ও পান্ডিত্যপূর্ণ বড় বড় গ্রন্থ রচনা করেন। যা সত্যিই বিস্ময়ের ব্যাপার। দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মাদ আজরফের ভাষায় ‘একজন নবী মুরসলের জীবনীকে এমন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে লেখার প্রচেষ্টা বিশ্ব সাহিত্যে এইটেই (মোস্তফা চরিত) বোধ হয় সর্বপ্রথম’। প্রখ্যাত বাগ্মী জিতেন্দ্রলাল একে বলতেন ‘এক বিরাট অবদান’। ডঃ সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন (১৯২০-১৯৯৫) বলেন, ‘আমার বিশ্বাস মোস্তফা চরিতের ইংরেজী অনুবাদ হ’লে এটি যুগান্তকারী গ্রন্থ হিসাবে সর্বত্র স্বীকৃতি পাবে’। মাওলানা সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, সাংবাদিকতা ও পান্ডিত্য এক জিনিস নয়। কিন্তু মাওলানার মধ্যে এ দু’য়ের এক আশ্চর্য্য সমন্বয় আমরা দেখেছি... যুক্তিবাদী মনীষা তাঁর ভাষাকে একটা অদ্ভূত শক্তি ও দীপ্তি দিয়েছে’।

মৃত্যু : ১৩৭৫ সালের ২রা ভাদ্র মোতাবেক ১৯৬৮ সালের ১৮ই আগস্ট এই শতায়ু মহীরুহের জীবনাবসান ঘটে। ইন্না লিল্লা-হি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজি‘ঊন। 

অবদান মূল্যায়ন : সাহিত্যিক সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৭৯) মরহুম মাওলানাকে ‘মুসলিম বাংলার রেনেসাঁর অগ্রনায়ক’ বলে অভিহিত করেন। তাঁর মৃত্যুর পরে দৈনিক পাকিস্তান মন্তব্য করে ‘তাঁর মত মনীষী একটা জাতির জীবনে দুই এক শতাব্দীর মধ্যেও জন্মগ্রহণ করে না। ফরাসী বিপ্লবে রুশো ও ভল্টেয়ারের যে অবদান ছিলো, আমাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবে এই জ্ঞানবৃদ্ধ মনীষীর অবদান তার চাইতে কোন অংশে কম নয়’। পশ্চিম পাকিস্তানের দৈনিক জং মন্তব্য করে ‘মাওলানা শুধু একটি ইতিহাস সৃষ্টি করেন নাই, তিনি নিজেও একটি ইতিহাস’।

নিজস্ব স্মৃতিচারণ :

(১) ১৯৬৭ সালের দিকে আমার আববা মাওলানা আহমাদ আলী আমাকে সাথে নিয়ে ঢাকায় দৈনিক আজাদ অফিসে মাওলানা আকরম খাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে যান। তখন আববার হাতে ছিল স্বলিখিত পুস্তক ‘আক্বীদায়ে মোহাম্মাদী বা মযহাবে আহলেহাদীছ’। মাওলানা আকরম খাঁ পুত্রসহ প্রিয় শিষ্যকে সামনে দেখে আনন্দের সাথে স্বাগত জানালেন ও বললেন, তোমার হাতে ওটা কি? মাওলানা আহমাদ আলী বইটি তাঁর হাতে তুলে দিলেন। মাওলানা এক নিঃশ্বাসে বইটি পড়ে ফেললেন। অতঃপর বললেন, ‘আহমাদ আলী তুমি যে লিখতে শিখেছ’। জওয়াবে তিনি বলেন, ‘হুযুর! সমাজ ও জামা‘আত নিয়ে দিনরাত ব্যস্ত থাকি। ঠান্ডা মাথায় লেখার সময় পাই না’। মাওলানা বললেন, ‘আহমাদ আলী। মনে রেখ এ পৃথিবীতে যা কিছু হয়েছে, তা ব্যস্ত লোকেরাই করেছে। অলসরা কিছুই করেনি’।

(২) আমার আববা মাওলানা আহমাদ আলী তাঁর প্রিয় ছাত্র যশোর যেলার ঝিকরগাছা উপযেলাধীন দিকদানা গ্রামের মাওলানা শামসুদ্দীনকে সঙ্গে নিয়ে বর্তমান সাতক্ষীরা যেলাধীন কলারোয়া উপযেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম কাকডাঙ্গায় জীবনের শেষ স্মৃতি ‘কাকডাঙ্গা আহমাদিয়া সিনিয়র মাদরাসা’র ভিত্তি স্থাপন করেন। স্বীয় উস্তাদ সমতুল্য মাওলানা আকরম খাঁকে মাদরাসা কমিটির প্রেসিডেন্ট করে তিনি এর পূর্ণ পরিচালনার দায়িত্ব হাতে নেন।

(৩) বাংলা ১৩১৯ সালে মাওলানা আকরম খাঁ এক বাহাছে বর্তমান সাতক্ষীরা যেলার ঝাউডাঙ্গায় আসেন ও প্রতিপক্ষের হানাফী আলেম মাওলানা রূহুল আমীনকে পরাজিত করেন। বাহাছের পর গরুর গাড়ী জোড়ার সময় না পেয়ে মুরীদরা নিজেরাই গরুর গাড়ী ঠেলে মাওলানা ছাহেবকে নিয়ে দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করেন।

উপসংহার : 

তাঁদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরা বলি শতাব্দীর এই মহীরুহের ছায়াতলে আমরা যারা তাঁর উত্তরসূরী, যাঁর দীর্ঘ সংগ্রামের পটভূমিকায় আজকে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়, সেই মহান যুগস্রষ্টা মাওলানা আকরম খাঁর উদ্দেশ্যে শুধু একটি আলোচনা বৈঠক বা সেমিনার নয় বরং তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শের পূর্ণ বাস্তবায়নের প্রত্যয়দৃঢ় শপথ গ্রহণ করতে পারলেই কেবল তাঁর প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করা সম্ভব হবে। জাতির আগামী দিনের নাগরিকদেরকে তিনি মৃত্যুর পূর্বে হুঁশিয়ার করে গিয়েছেন ‘সাবধান! পশ্চাতে ভূতের মায়া কাঁদন, সম্মুখে আলেয়ার জ্বলন্ত মোহ। সাবধান!’ আমরা কি পারবো তাঁর সেই অন্তিম উপদেশ মেনে চলতে?

পরিশেষে আজকের দিনে ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের দাবী থাকবে, তারা যেন মাওলানার একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনী প্রকাশের ব্যবস্থা নেন ও তাঁর রেখে যাওয়া গ্রন্থগুলি পুনঃ প্রকাশের দায়িত্ব নেন। আরো দাবী থাকবে দেশের সরকারের নিকট যেন মাওলানার নামে রাজধানীতে বড় একটি রাস্তার নামকরণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের নিকট দাবী থাকবে তারা যেন মাওলানার নামে কোন একটি হলের নামকরণ করেন এবং মাওলানা আকরম খাঁ বৃত্তি চালু করেন।

সেমিনারে উপস্থিত সুধীবৃন্দের মন্তব্য :

১. মোসলেম আলী (প্রধান সমন্বয়কারী; সম্পাদক, দৈনিক বার্তা) : (ক) সংখ্যাগরিষ্ঠরাই সাম্প্রদায়িক হয়। তারা সংখ্যালঘিষ্ঠদের আত্মীকরণ করতে চায়। না পারলে তখন তারা সাম্প্রদায়িক হামলা শুরু করে।

(খ) মাওলানা আকরম খাঁর মাসিক মোহাম্মদীর প্রথম গ্রাহক ছিলেন মুনশী মোঃ চ্যাং। (সাংস্কৃতিক দৈন্যের পরিচয় এটা)

(গ) আজাদ পত্রিকা প্রকাশের দু’তিনদিন পর মাওলানা নিজ গ্রাম হাকিমপুরে গেলে তাঁর চাচী তাঁকে বলেছিলেন ‘তুমি মুসলমানের ছেলে হয়ে খবরের কাগজ বের করেছ? ওতে তো শুধু মিথ্যা কথা লেখা থাকে’। মাওলানা রয়টারের খবরের সত্যতার কথা বললে তিনি বললেন, ‘রাণী ভিক্টোরিয়া কি তোমার শ্বাশুড়ী, যে তোমাকে সত্য খবর পাঠাবে’?

উল্লেখ্য যে, দৈনিক ‘আজাদ’ পত্রিকা ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা প্রকাশ পায় ১৯৩৬ সালের ৩১শে অক্টোবর শনিবার। ১৯২৯ সালে মাওলানা হজ্জ করেন।

(ঘ) মাওলানা খুবই নিরহংকার ছিলেন। প্রেসের যেকোন লোকের সামনে যেকোন চেয়ারে বসতে তাঁর লজ্জা ছিল না।

(ঙ) বাড়ীর বয়স্ক চাকরকে তিনি তুমি বলে সম্বোধন করায় বাড়ীর একজন মুরববী তাঁকে আড়ালে ডেকে বলেন, ‘তুমি ওকে আপনি বললে সে আরও খুশী হতো’। এই ঘটনার পর থেকে মাওলানা সকলের সাথে ‘আপনি’ সম্বোধনে কথা বলতেন।

(চ) আমি তাঁর কাগজে (আজাদে) ১২ বছর চাকুরী করেছি।

(ছ) মাওলানাকে ভুলে গেলে জাতি হিসাবে আমরা টিকে থাকতে পারব না।

২. অধ্যাপক আবু তালেব (সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়) : লালনের অদ্বৈতবাদী গানগুলো তার নয়, বরং সংগ্রাহকদের ভুল বা বিকৃতি’। মাওলানা ছাহেবকে আমি একথা বললে উনি এর উপরে আমাকে বই লিখতে বলেন।

পীর গোরাচাঁদ ও গৌরাঙ্গদেব এক ব্যক্তি নন। উনি আসলে সৈয়দ আববাস আলী মক্কী। ডঃ শহীদুল্লাহ পীর গোরাচাঁদের বংশধর। ডঃ সুকুমার সেন পীর গোরাচাঁদ ও গৌরাঙ্গদেবকে এক করে দেখিয়েছেন। শহীদুল্লাহ ছাহেবও একই ভুল করেছেন। আমি তাঁকে সংশোধন করে দিই। ‘মোছলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস’ বইয়ের সমালোচনা করে আমি তাঁকে কিছু বললে তিনি বলেন, আমি যা পেয়েছি তার উপর ভিত্তি করে লিখেছি। আপনারা সত্য উদঘাটন করুন।

‘সমস্যা ও সমাধান’ বইয়ে সঙ্গীত জায়েয কথা লিখলে আলেম সমাজ ক্ষেপে যান। তিনি জওয়াবে লেখেন, ‘খাসি খাওয়া জায়েয তাই বলে অন্যের চুরি করা খাসি খাওয়া জায়েয নয়। সঙ্গীত জায়েয তাই বলে সব সঙ্গীত জায়েয নয়’। মাওলানা আকরম খাঁ পরমতসহিষ্ণু ছিলেন।

৩. নূরুল আলম রঈসী (পরিচালক, ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র রাজশাহী, ইসাকেরা) : ‘মোস্তফা চরিতের’ ইংরেজী অনুবাদ হচ্ছে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে। ‘সমস্যা ও সমাধান’ বই পাওয়া গেলে তা পুনঃ মুদ্রণের জন্য ফাউন্ডেশনের কাছে পেশ করা হবে।

৪. শাহ আনীসুর রহমান (সহকারী সম্পাদক, দৈনিক বার্তা, রাজশাহী) : ফকির আন্দোলনের মূল কেন্দ্র ছিল রাজশাহীর বড় কুঠি। নেতা ছিলেন ফকির মজনু শাহ। তবে তার আন্দোলন সারা বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যাতেও ছিল (তার সমর্থনে অধ্যাপক আবু তালেব একই কথা বলেন)।

১৯১৫-১৯২১ পর্যন্ত ‘আল-এছলাম’ আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙ্গালার মুখপাত্র রূপে প্রকাশ পায়। এর মধ্যে তিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্য চেয়েছিলেন। কিন্তু সফল হননি।

মাওলানার চিন্তাভাবনায় কোন গোঁড়ামি ছিল না।

‘বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মেলনে’র সভাপতি হিসাবে মাওলানা বলেন, ‘দুনিয়ায় অনেক অদ্ভূত প্রশ্ন আছে। তেমনি এক প্রশ্ন হ’ল বাঙ্গালীদের মাতৃভাষা বাংলা না উর্দূ? নারিকেল গাছে নারিকেল ফলিবে না অন্য কিছু, ইহা কাউকে বলিয়া দেওয়ার কথা নয়’।

৫. সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাজশাহী কলেজে আগত অধ্যাপক আযহারুদ্দীন বলেন, সেখানে কোন পাঠ্য-পুস্তকে কোন মুসলিম লোকের এমনকি নজরুলেরও লেখা নেই।

[লেখক ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র রাজশাহী (ইসাকেরা)-র পক্ষ হ’তে ১৮ই আগষ্ট ১৯৮৩ বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত উক্ত সেমিনারে প্রবন্ধ পাঠক হিসাবে আমন্ত্রিত হন। আমন্ত্রণকালে লেখকের বারবার প্রশ্ন সত্ত্বেও আয়োজকরা এটি মৃত্যু বার্ষিকী নয়, বরং বিশেষ সেমিনার বলে আশ্বস্ত করেন। কিন্তু স্টেজের ব্যানারে ‘মৃত্যু বার্ষিকী’ লেখা দেখে তিনি ক্ষুব্ধ হন এবং প্রবন্ধ পাঠের পূর্বেই ‘জন্ম বার্ষিকী’ বা ‘মৃত্যু বার্ষিকী’ পালন ইসলামী সংস্কৃতির অংশ নয় বলে আয়োজকদের প্রতি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। অতঃপর সেমিনারের প্রধান অতিথি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী গ্রন্থাগারিক মাওলানা আকরম খাঁ-কে হানাফী ও পীরের মুরীদ বলে অভিহিত করলে লেখক সরাসরি তার প্রতিবাদ করেন।]

[1]. দৈনিক আজাদ, ১৮.০৮.১৯৬৯ মোতাবেক ১লা ভাদ্র ১৩৭৬ বঙ্গাব্দ, বিশেষ সংখ্যা হ’তে।






ঈছালে ছওয়াব : একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
ওয়াহ্হাবী আন্দোলন : উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ এবং মুসলিম বিশ্বে এর প্রভাব (৩য় কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
আক্বীদা ও আহকামে হাদীছের প্রামাণ্যতা (৪র্থ কিস্তি) - মীযানুর রহমান মাদানী
স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসাশিক্ষার বৈষম্য - ড. মুহাম্মাদ কামরুয্যামান
গোপন ইবাদতে অভ্যস্ত হওয়ার উপায় - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
ইসলাম ও পর্দা - মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান
নেতার প্রতি আনুগত্যের স্বরূপ - মাওলানা মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম
আল্লামা আলবানী সম্পর্কে শায়খ শু‘আইব আরনাঊত্বের সমালোচনার জবাব - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
ইসলামী বাড়ীর বৈশিষ্ট্য - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
পবিত্রতা অর্জন সম্পর্কিত বিবিধ মাসায়েল (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
চিন্তার ইবাদত (৫ম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
ধবংসলীলা - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
আরও
আরও
.