দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় আলেম ও মাসিক মদীনা সম্পাদক সুসাহিত্যিক ও সাংবাদিক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান (৮১) গত ২৫শে জুন শনিবার বিকেল সাড়ে ৬-টায় ইফতারের কিছু পূর্বে তিনি রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেঊন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, তিন পুত্র ও দুই কন্যাসহ অসংখ্য আত্মীয়স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ অসুস্থ ছিলেন।

২৬শে জুন বাদ যোহর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে তাঁর প্রথম জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। পরদিন নিজ যেলা ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপযেলার আনছারনগর গ্রামে জানাযা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। আল্লাহ রববুল আলামীন তাঁর সকল গুনাহখাতা মাফ করুন এবং তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন- আমীন!

জন্ম ও কর্মজীবন : মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ১৯৩৫ সালের ১৯শে এপ্রিল কিশোরগঞ্জ যেলাধীন পাকুন্দিয়া উপযেলার ছয়চির গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপযেলার পাঁচবাগ ইউনিয়নের আনছারনগরে। তার পিতা শিক্ষাবিদ মৌলভী হাকীম আনছারুদ্দীন খান। তিনি উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে দু’বার কারাবরণ করেন। পাঁচবাগ মাদরাসা থেকে ১৯৫১ সালে আলিম, ১৯৫৩ সালে ফাযিল এবং ঢাকা আলিয়া থেকে ১৯৫৫ সালে কামিল (হাদীছ) এবং ১৯৫৬ সালে কামিল (ফিক্বহ) ডিগ্রী লাভ করেন।

ছাত্রজীবন থেকেই তিনি সাপ্তাহিক কাফেলা, নেজামে ইসলাম, দৈনিক ইনসাফ, আজাদ, মিল্লাত প্রভৃতি পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখির মাধ্যমে সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। পরবর্তীতে ঢাকা থেকে প্রকাশিত উর্দু দৈনিক পাসবান, বাংলা মাসিক দিশারী ও সাপ্তাহিক নয়া জামানায় সম্পাদনা করেন  এবং ১৯৬১ সাল থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ৫৫ বছর যাবৎ মাসিক মদীনা সম্পাদনা করেছেন।

তাঁর ভাষ্য মতে তিনি ঢাকায় থাকাকালে সাপ্তাহিক আরাফাতে দু’বছর কাজ করেছেন এবং মাওলানা আব্দুল্লাহেল কাফী-এর সান্নিধ্যে কাটিয়েছেন (স.স.)

সাংগঠনিক জীবন : ১৯৮৮ সালে তিনি সঊদীআরব ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘রাবেতা আলমে ইসলামী’র কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য নিযুক্ত হন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৬ সালে তিনি ‘জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশে’র সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে তিনি এই সংগঠনের নির্বাহী সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া ইসলামী ঐক্যজোটের সিনিয়র সহ-সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

ইসলামী একাডেমী প্রতিষ্ঠা : বিংশ শতাব্দীর ষষ্ঠ দশকের মাঝামাঝিতে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সাবেক সদস্য ও ডেপুটি স্পীকার এটিএম আব্দুল মতীনের সহযোগিতায় বায়তুল মোকাররম কমপ্লেক্সের ভেতরেই একটা দালানের দ্বিতীয় তলা ভাড়া নিয়ে ‘দারুল উলূম ইসলামী একাডেমী’ নামে একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এ প্রতিষ্ঠান মাত্র এক বছরের মধ্যে অন্যূন দশটি কিতাব অনুবাদ করে প্রকাশ করে। এখান থেকে ১৯৬০ সালে মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের সম্পাদনায় ‘মাসিক দিশারী’ নামে একটা গবেষণা পত্রিকাও প্রকাশিত হয়। কয়েক বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে প্রতিষ্ঠানটি একটা ভাল অবস্থানে পৌঁছলে দেশের প্রথম সামরিক আইন প্রশাসক আইয়ুব খানের আমলে একে সরকারীকরণ করা হয়। মাওলানা মুহিউদ্দীন খানকে প্রস্তাব দেয়া হয় যে, তিনি ইচ্ছা করলে এখানে ভাল বেতনে সম্মানজনক চাকুরী করতে পারেন। কিন্তু এ প্রস্তাবে তিনি সম্মত হননি এ কারণে যে, (তার ধারণা মতে) ইসলামের ছহীহ ব্যাখ্যা দেয়ার উদ্দেশ্যে যে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন তা সরকারী ইসলামের নানা অপকর্মে ব্যবহৃত হবে। কিছুদিনের মধ্যেই মুসলিম লীগ নেতা আবুল হাশিম (বাম নেতা বদরুদ্দীন ওমরের পিতা) কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়োগপত্র নিয়ে এ প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক পদে যোগদান করেন। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এ প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন’ রাখা হয়।

সামাজিক কর্মকান্ডে তাঁর অবদান : সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত থেকে ১০০ কি.মি. দূরে সুরমা-কুশিয়ারা নদীর সম্মিলিত উজানে ভারত সরকারের টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ পরিকল্পনার প্রতিবাদে ২০০৫ সালের ৯ ও ১০ই মার্চ মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ‘ভারতীয় নদী আগ্রাসন প্রতিরোধ জাতীয় কমিটি’র ব্যানারে টিপাইমুখ অভিমুখে ঐতিহাসিক লংমার্চের ডাক দেন। এতে দেশের প্রায় ৩০টি সংগঠন যোগদান করে। অতঃপর লংমার্চ শেষে জকিগঞ্জে অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশে তিনি এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেন। যা রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করে।

অসহায়, দরিদ্র ও ইয়াতীম ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ, সম্বলহীন লোকদের বসতবাড়ি নির্মাণসহ সার্বিক কল্যাণে তিনি কাজ করে গেছেন। বান্দরবান যেলার কয়েক শ’ উপজাতি পরিবার তার সহযোগিতায় ইসলাম গ্রহণ করে। সেখানে প্রায় তিন শতাধিক নারী-পুরুষকে তিনি ‘তাওহীদ মিশন’ নামক সংস্থার মাধ্যমে পুনর্বাসন করেন।

দেশের রাজনীতি ও সমাজ সচেতন আলেমদের মধ্যে তাঁর অবস্থান ছিল শীর্ষে। মুসলিম উম্মাহর প্রতি অকৃত্রিম দরদ এবং কর্তব্যনিষ্ঠা থেকে তিনি পরিণত হয়েছিলেন এদেশের ইসলামী আন্দোলনের একজন যোগ্য অভিভাবকে। সে কর্তব্য পালনে তিনি মাযহাবী বিতর্ক, আভ্যন্তরীণ মতাদর্শভিত্তিক টানাপোড়েনকে তেমন গুরুত্ব দিতেন না। যার বড় প্রমাণ ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর আমীর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবের প্রতি তৎকালীন সরকারের যুলুমের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে তাঁর রুখে দাঁড়ানো।







আরও
আরও
.