প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে কৃষি। যে লাঙল-জোয়াল আর ‘হালের বলদ’ ছিল কৃষকের চাষাবাদের প্রধান উপকরণ সে জায়গা এখন দখল করে নিয়েছে ‘কলের লাঙল’ ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার। সেদিন খুব দূরে নয়, যেদিন লাঙল দেখতে যেতে হবে জাদুঘরে।
কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে চাষাবাদের কারণে একদিকে যেমন সময়, শ্রম ও অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে, তেমনি ফসলের উৎপাদনও বেড়েছে। ফলে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকের। কেবল জমি চাষই নয়, জমিতে নিড়ানি, সার দেওয়া, কীটনাশক ছিটানো, ধান কাটা, মাড়াই, শুকানো ও ধান থেকে চাল সবই হচ্ছে আধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)-এর হিসাব মতে, বর্তমানে দেশের মোট আবাদি জমির ৯০ ভাগ চাষ হচ্ছে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে। তবে অন্যান্য কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারে এখনো অনেক পিছিয়ে দেশের কৃষকরা। যদি চাষাবাদের সব পর্যায়ে অর্থাৎ জমি তৈরি থেকে শুরু করে চাল উৎপাদন পর্যন্ত পুরোপুরি আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয় তাহ’লে রীতিমতো বিপ্লব ঘটবে কৃষিতে।
এদিকে কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার হওয়ায় কাঠের লাঙল তৈরির কারিগরদের এখন দুরবস্থা। কারিগররা তাদের পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন।
অনেক গবেষকের মতে, চীনে হানদের শাসনামলে [খ্রিস্টপূর্ব ২০২ থেকে ২২০ খ্রিস্টাব্দ] মানুষ প্রথম লাঙল ব্যবহার করে জমি চাষ শুরু করে। কাঠ দিয়ে লাঙল তারাই প্রথম তৈরি করে। লাঙলের ফলা তৈরিতে ব্যবহার করে লৌহদন্ড। জোয়াল তৈরিতে ব্যবহার করত কাঠ। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যে পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা ক্রমে বেড়ে গেলে হাল-চাষের এ প্রথাটি সারাবিশ্বে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে আশির দশকের শুরুতে কৃষিতে ধীরে-ধীরে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু হয়। সে সময় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও কৃষি বিজ্ঞানীরা কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবনের কাজ হাতে নেন। বর্তমানে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ ধরনের আধুনিক যন্ত্রপাতি কৃষিকাজে ব্যবহার হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
কৃষি বিজ্ঞানীরা বলেছেন, লাগসই প্রযুক্তির সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে কৃষিতে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন সম্ভব। বর্তমানে দেশে যেসব কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার হচ্ছে, তন্মধ্যে অন্যতম কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার। এ যন্ত্রের মাধ্যমে ফসল কাটা, খোসা হ’তে ফসলের দানা আলাদা করার কাজ করা হচ্ছে। এছাড়া ছোট জমি চাষের জন্য পাওয়ার টিলার, বড় জমি চাষে ট্রাক্টর বা হুইল ট্রাক্টর, বীজ বপন, সার প্রয়োগ ও কীটনাশক ছিটানোর জন্য ব্রডকাস্ট সিডার, নির্দিষ্ট অবস্থানে বীজ বপনের জন্য সিড ড্রিল, গভীরভাবে কঠিন স্তরের মাটি কর্ষণের জন্য সাব ব্রয়লার, ধান/বীজ শুকানোর যন্ত্র ‘ড্রায়ার’, ধান, গম, ভুট্টা শুকানোর যন্ত্র ব্যাচ ড্রায়ার, পাওয়ার রিপার মেশিন (শস্য কাটার যন্ত্র), ঝাড়ার যন্ত্র ইউনারসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি চাষাবাদে ব্যবহার হচ্ছে। ইতিমধ্যে দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাওয়ার টিলার, পাওয়ার রিপার, ঝাড়ার যন্ত্র ইউনার, নিড়ানির যন্ত্র ইউডার, ধান ও গম মাড়াই কল, ভুট্টা মাড়াই কল ইত্যাদি যন্ত্রপাতি তৈরি হচ্ছে। সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নাটোর, বগুড়া, রংপুর, যশোর, শেরপুরসহ দেশের বিভিন্নস্থানে সেচপাম্প, ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলারের খুচরা যন্ত্রপাতি তৈরির বেশকিছু কারখানা গড়ে উঠেছে।
কৃষি কাজের মধ্যে সবচেয়ে শ্রমনির্ভর কাজ হচ্ছে বীজ বা চারা রোপণ, আগাছা দমন ও ফসল কাটা। মৌসুমের নির্দিষ্ট সময়ে বীজ বপন, চারা রোপণ এবং ফসল কেটে ঘরে তুলতে কৃষককে বেশ সংকটে পড়তে হয়। ঐ সময়ে কৃষি শ্রমিকের মজুরিও অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। কখনো কখনো দ্বিগুণ মজুরি দিয়েও কৃষি শ্রমিক পাওয়া যায় না। ফলে বিলম্বে বীজ রোপণের জন্য ফলন কম হয়, পোকা-মাকড় ও রোগ-বালাইয়ের আক্রমণ বৃদ্ধি পায়। কখনো কখনো বিলম্বে ফসল কাটা ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে উৎপাদিত শস্যের একটি বড় অংশ নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া আগাম ফসল বিক্রি করতে না পারার কারণে প্রত্যাশিত মূল্য থেকেও কৃষক বঞ্চিত হয়। এসব থেকে রক্ষা পেতেই কৃষি কাজে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে যেমন সময় কম লাগছে, তেমনি বেশি ফসলও উৎপাদন হচ্ছে।
উল্লেখ্য, কৃষাণ দিয়ে এক বিঘা জমির ধান কাটাতে খরচ হয় তিন হাযার টাকা। আর ‘রিপার’ দিয়ে ধান কাটতে বিঘা প্রতি খরচ হয় মাত্র ৫০০ টাকা। সময়ও লাগে কম। অপর দিকে গরু দিয়ে হালচাষ করতে বিঘা প্রতি খরচ হয় ৭০০ টাকা। আর পাওয়ার টিলার দিয়ে চাষ করতে খরচ হয় প্রতি বিঘায় ৪০০ টাকা। ট্রাক্টর দিয়ে খরচ হয় মাত্র ২৫০ টাকা। তাই কৃষকরা এসব আধুনিক যন্ত্র ব্যবহারের দিকেই ঝুঁকছেন। তবে এসব যন্ত্রপাতির দাম কমানো দরকার।
কৃষিবিদরা জানান, দেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় চার কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়। উৎপাদন থেকে বাজারজাত পর্যন্ত প্রায় ১৪ শতাংশ খাদ্যশস্য নষ্ট হয়, যার পরিমাণ ৪২ লাখ টন। চাষাবাদে পুরোপুরি আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে এসব সমস্যা দূর করা সম্ভব।
সম্প্রতি শেষ হওয়া কৃষি যন্ত্রপাতির প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিচালক মুহাম্মাদ মঞ্জুরুল আলম বলেন, কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার হচ্ছে ঠিকই কিন্তু এখনও আমরা প্রতিবেশী দেশ ভারত, চীন থেকে অনেক পিছিয়ে আছি। আমাদের দেশে কৃষিযন্ত্রপাতির মধ্যে পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর ও মাড়াই যন্ত্র উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু অন্যান্য যন্ত্রপাতির ব্যবহার এখনো শতাংশের হিসাবের মধ্যেই আসেনি। তিনি বলেন, ফসলের ন্যায্যমূল্য না হওয়ায় কৃষকরা হতাশ। কিন্তু তাদের যদি চাষাবাদের সকল পর্যায়ে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা যায়, তাহ’লে ফসলের উৎপাদন খরচ অনেক কমে যাবে এবং তারা লাভের মুখ দেখবে।
কৃষি যন্ত্রপাতির বেশিরভাগ এখন দেশেই তৈরি হচ্ছে। আবার দাম খুব বেশি নয়। তাই আমাদের কৃষকদের আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) মহাপরিচালক রফীকুল ইসলাম মন্ডল বলেন, আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরিতে ইনস্টিটিউটের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ প্রতিনিয়ত কাজ করছে। বারি উদ্ভাবিত পাওয়ার টিলার অপারেটেড সিডার-এর উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, এই যন্ত্রটি দিয়ে একইসাথে জমি চাষ, জমি লেভেল, সার ও বীজ বপন করা যায়। তিনি বলেন, দিন দিন আমাদের জমি কমে যাচ্ছে, কিন্তু খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে। তাই কৃষিতে বিপ্লব ঘটাতে চাষাবাদের সকল পর্যায়ে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হবে। তাহ’লেই কাঙ্ক্ষিত সফলতা আসবে।
\ সংকলিত